দুই উপজেলার অপকর্মে মায়ার দুই বাহিনী

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৯: ০০

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া চাঁদপুর-২ আসনের (মতলব উত্তর ও দক্ষিণ) সাবেক সংসদ সদস্য। ক্ষমতায় থাকাকালে তাঁর হয়ে এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত দুটি বাহিনী। একটির নিয়ন্ত্রণে ছিল মতলব উত্তর উপজেলা এবং আরেকটির ছিল মতলব দক্ষিণ। 

সরকার পতনের পর স্থানীয় লোকজন ও দলের নেতা-কর্মীরাই বলছেন, সরকারি উন্নয়নমূলক কাজের কমিশন, মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করত এই দুই বাহিনী। গত ৫ আগস্টের পর মায়া চৌধুরীসহ তাঁর বাহিনীর লোকজন এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন। তবে মতলব উত্তর উপজেলায় মেঘনা নদীতে বালু উত্তোলন এখনো চলছে।

আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলে জানা গেছে, মতলব উত্তরের মায়ার বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন মামুন ওরফে কুত্তা মামুন, রিয়াদ, রিয়াজুল ইসলাম, শরীফ ও ইউপি চেয়ারম্যান ছোবহান সরকার। দক্ষিণের নেতৃত্বে ছিলেন মতলব পৌরসভার সাবেক মেয়র আওলাদ হোসেন লিটন, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান শওকত আলী বাদল এবং জেলা পরিষদ সদস্য ও ছাত্রলীগ নেতা আল-আমিন ফরাজি।

সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারেরা এই দুই বাহিনীর নাম বললেও কেউ নিজে টাকা দেওয়ার কথা সরাসরি স্বীকার না করে অন্যকে দেখিয়ে দেন।   

উন্নয়নমূলক কাজের কমিশন
মতলব উত্তর সেচ প্রকল্পের আওতাধীন বেড়িবাঁধ রক্ষায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্লক বসানোর কাজ থেকে মায়া চৌধুরী ১০ শতাংশ কমিশন নিয়েছেন বলে প্রকল্পের একটি সূত্র জানিয়েছে। স্থানীয় আলাউদ্দিন সরকার, বাতেন চেয়ারম্যান, লধুয়া গ্রামের রিপন পাটওয়ারী যৌথভাবে এই কাজের ঠিকাদার ছিলেন। 

ঠিকাদার আলাউদ্দিন সরকার জানান, তিনি ব্লকের কাজ করেছেন সংস্কারমূলক। তাঁর কাজ ছিল ছোট। তাঁকে এমপির লোকজন তেমন বিরক্ত করেননি। তবে মতলব দক্ষিণের আওয়ামী লীগ সভাপতি এইচ এম কবিরের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন নিয়েছেন।
পরে এইচ এম কবিরকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আমি সরাসরি কাজ করি নাই। আমার ছোট ভাইসহ কয়েকজন ব্লকের কাজের ঠিকাদার।’ এমপির লোকজন কমিশন নিয়েছেন সরাসরি স্বীকার না করলেও তিনি বলেন, কাজ করলে লাভ-লোকসান হবেই।
এদিকে স্থানীয় সরকারের অধীন দুই উপজেলার গ্রামীণ উন্নয়নের বিভিন্ন প্রকল্পের প্রায় ৭০০ কোটি টাকার কাজ এবং মতলব উত্তরে নির্মাণাধীন হাই-টেক পার্কের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কমিশন নিয়েছেন মায়া চৌধুরী। তবে এই বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল প্রকৌশলীসহ কেউ নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। 

টাকার বিনিময়ে দলীয় মনোনয়ন 
২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন এবং সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রত্যেক চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীকে দলীয় মনোনয়ন ও সমর্থন দিতে টাকা নেওয়া হয়েছে। মায়া চৌধুরীর পক্ষে এ কাজে যুক্ত ছিলেন তাঁর প্রয়াত ছেলে দীপু চৌধুরী। 

মোহনপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন হাফিজ মাস্টার। তিনি নৌকার প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করার কথা স্বীকার করেন। তবে টাকা দেওয়ার বিষয়ে বলেন, ‘আপনি আমার সামনে আসেন, তখন বলব।’

মতলব দক্ষিণ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এইচ এম কবির বলেন, ‘সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মায়া চৌধুরী আমাকে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে সমর্থন করেননি। বরং উল্টো তাঁর লোকজন দিয়ে আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছেন। এ বিষয়ে ওই সময় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আমি যাকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি, সেই সিরাজুল মোস্তফা তালুকদারকে তিনি মনোনয়ন নিয়ে দিয়েছেন।’

একই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী রিপন মীর বলেন, ‘আমি কখনো টাকা দিয়ে নৌকার মনোনয়ন পাইনি। দল থেকেই আমাকে দিয়েছে। তবে আমাদের ইউনিয়নের জাহাঙ্গীরসহ কয়েকজন টাকা দিয়ে নৌকার প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করেছেন।’

অবৈধ বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ 
২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মায়া চৌধুরী ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী। ওই সময় মেঘনা নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনকারীদের কাছ থেকে তাঁর ছেলে দীপু চৌধুরী, স্ত্রীসহ পরিবারের একাধিক সদস্যের নামে প্রতিদিন ২০ লাখ টাকা ওঠানো হতো। এলাকাভিত্তিক এই কাজ করতেন তাঁর আত্মীয় আহার খালাসি, বোরহান খালাসি ও ইউপি চেয়ারম্যান ছোবহান সরকার। আর ওই টাকা ঢাকায় পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করতেন মোহনপুর ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান বালু মিজান, ছ্যাঙ্গারচর পৌরসভার সাবেক মেয়র রফিকুল ইসলাম জজ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর মাস্টার। 

এই বিষয়ে মতলব উত্তর উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা বিল্লাল মৃধা বলেন, মায়া চৌধুরী যতবারই এমপি এবং মন্ত্রী হয়েছেন, তিনি নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করেছেন। 

দলের নেতা-কর্মীদের নির্যাতন
মায়ার প্রতিহিংসার শিকার আওয়ামী লীগ নেতা বিল্লাল মৃধা বলেন, ‘তাঁর অত্যাচারের কারণে ৫ মাস বিভিন্ন জায়গায় থেকে ৫ আগস্টের পরে বাড়িতে এসেছি।’

মায়া চৌধুরীর নিজ ইউনিয়ন মোহনপুর। ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন তাঁর চাচাতো ভাই বাবুল চৌধুরী। তিনি মারা যাওয়ার পর ২০২৩ সালে উপনির্বাচন হয়। সেখানে নৌকা প্রতীক পান কাজী মিজানুর রহমান। তিনি মায়া চৌধুরীর মতের বিরুদ্ধের লোক হওয়ায় তাঁর পরিবর্তে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাইকে নৌকা এনে দেন। এরপর শুরু হয় কাজী মিজানের বিরুদ্ধে অত্যাচার ও হামলা-মামলা।

কাজী মিজান বলেন, ‘আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মোহনপুর পর্যটনকেন্দ্র ভেঙে সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে গেছে তার লোকজন। আমার ২০ কোটি টাকার ক্ষতি করেছে। এসব ঘটনায় আমি তার লোকজনের বিরুদ্ধে আদালতে দুটি মামলা দিয়েছি।’

বিরোধী দমন
চাঁদপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তানভীর হুদা বলেন, আওয়ামী লীগের ১৬ বছরে মতলব উত্তর ও দক্ষিণ উপজেলায় নেতা-কর্মীরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বহু গায়েবি মামলার আসামি হয়েছেন আমাদের নেতা-কর্মীরা।’ 
অভিযোগের বিষয়ে জানতে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিক ফোন দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে। আর দুই উপজেলায় তাঁর বাহিনীর লোকজনও সরকার পতনের পর আত্মগোপনে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরাসরি সমুদ্রপথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ঐতিহাসিক যুগে বাংলাদেশ-পাকিস্তান, শঙ্কায় ভারত

হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ার পর দেশ ‘মবের মুল্লুক’: সামিনা লুৎফা

বাংলাদেশের বন্দরে পাকিস্তানের কার্গো জাহাজ, ‘ঐতিহাসিক’ বলা হচ্ছে যে কারণে

পরশুরামে ছুরিকাঘাতে তরুণ নিহত

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সংলাপ শুরু কাল, চলবে পুরো নভেম্বর

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত