মো. সাহাব উদ্দিন, ফেনী
নিজাম হাজারী। ফেনীর রাজনীতিতে এক যুগের বেশি সময়ের দাপুটে চরিত্র। রাজনৈতিক প্রভাব আর ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে হয়েছেন কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক। এসব সম্পদ করেছেন চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বালুমহাল, জমি দখলসহ নানা উপায়ে। তবে রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষ বলতে কাউকেই দাঁড়াতে দেননি; এমনকি নিজ দলের নেতাদেরও হত্যা করেছেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, একসময় ফেনীর ‘গডফাদার’খ্যাত জয়নাল হাজারীর হাত ধরে রাজনীতিতে এলেও চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছিরের মাধ্যমে উত্থান হয় নিজাম হাজারীর। ২০০১ সালে যৌথ বাহিনীর অভিযানের মুখে জয়নাল হাজারী সাম্রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে আওয়ামী রাজনীতির হাল ধরতে চট্টগ্রাম থেকে ফেনীতে আসেন নিজাম হাজারী। তৈরি করেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। কোণঠাসা করে ফেনীতে ঢুকতে দেননি জয়নাল হাজারীকেও।
নিজাম হাজারী ২০১১ সালের ১৮ জানুয়ারির পৌরসভা নির্বাচনে কারচুপির মধ্য দিয়ে ফেনী পৌর মেয়র হন বলে অভিযোগ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের। আর দলের নেতা-কর্মীরা জানান, ২০১২ সালে জেলা রাজনীতির অঘোষিত অভিভাবক, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের হাত ধরে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে যান নিজাম। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রথম সংসদ সদস্য হন তিনি। পরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের হাত ধরে পরপর দুবার (২০১৮ ও ২০২৪) সংসদ সদস্য হন নিজাম।
হাজার কোটি টাকার সম্পদ
বিলাসবহুল বাগানবাড়ি, খামারবাড়ি ছাড়াও নিজাম হাজারীর অনেক জায়গাজমি ও বাড়ি রয়েছে মাস্টারপাড়ায়। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে,৬টি সাততলা এবং ১০টি একতলা বাড়ির পাশাপাশি ২০০ বিঘা জমি রয়েছে তাঁর। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রামে তাঁর নামে-বেনামে মার্কেট ও ফ্ল্যাট রয়েছে বলে শোনা যায়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মাস্টারপাড়ার বাড়ি থেকে ৬০০ মিটার দক্ষিণে অন্যদের প্রায় ৩৫০ শতাংশ জায়গা দখল করে বিলাসবহুল বাগানবাড়ি গড়ে তোলেন নিজাম হাজারী। বাগানবাড়িতে ছিল হেলিপ্যাড, টেনিস কোর্ট, লেক, পুল, থিয়েটার, সুইমিংপুল। আঙিনায় সুসজ্জিত বাগানের গাছ ও ঘাস এবং বাসার আসবাব বিভিন্ন দেশ থেকে আনা হয় বলে প্রচার ছিল। এই বাগানবাড়ির বাজারমূল্য হিসাব করলে প্রায় হাজার কোটি টাকা।
বিলাসবহুল বাগানবাড়ির উত্তর পাশে ৭৮ শতাংশ জমিতে গড়ে তোলেন খামারবাড়ি। সেখানে একটি পুকুরের চারপাশে গরু, ছাগল, মহিষ ও মুরগির খামার। খামারবাড়িতে প্রবেশের দক্ষিণ পাশে একটি ঘরে লেখা রয়েছে ‘তালতলা বাগান বাড়ী’। তবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর হাজার কোটি টাকার বিলাসবহুল সাম্রাজ্য পুড়িয়ে দেয় ছাত্র-জনতা।
‘১০ খলিফা’ ও ক্যাডার বাহিনী
নিজাম হাজারী মূলত ফেনীর ৬ উপজেলায় অপরাধের সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন বিশ্বস্ত ১০ সহযোগী ও নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী দিয়ে। স্থানীয়দের কাছে ওই ১০ সহযোগী নিজাম হাজারীর ‘১০ খলিফা’ নামে পরিচিত ছিল।
জেলার একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওই খলিফাদের কারণে সব সময় দলে কোণঠাসা হয়ে থাকতেন তাঁরা। ওই ১০ সহযোগীকে দিয়ে বালুমহাল দখল, টেন্ডার-বাণিজ্য, সম্পত্তি দখল, অর্থ আত্মসাৎ, চাঁদাবাজির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন নিজাম। এ ছাড়া বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের দমন-পীড়নের পাশাপাশি দলীয় নেতা-কর্মীদেরও নির্যাতন; এমনকি হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে নিজামের বিরুদ্ধে।
দখল, টেন্ডারবাজি
একাধিক ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), স্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্য, গণপূর্ত, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন নিজাম হাজারীর খলিফারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদার বলেন, নিজাম হাজারী কাজের বরাদ্দভেদে ৭ শতাংশ, ১০ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ধরে অগ্রিম টাকা নিতেন খলিফাদের মাধ্যমে।
স্থানীয় ও ঠিকাদার সূত্রে জানা গেছে, নিজাম হাজারীর বিশ্বস্ত ‘ডান হাত’ হিসেবে পরিচিত ফেনী সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শুসেন চন্দ্র শীল। তাঁর মাধ্যমে গত ১৫ বছর এলজিইডির সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন। এ ছাড়া জেলার কোন দপ্তরের কাজ কে করবে, সেটিও তিনি শুসেনের মাধ্যমে বণ্টন করতেন।
পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজীকে দিয়ে ফেনী পৌর এলাকার ১৮টি ওয়ার্ডের রাজনীতি ও কাউন্সিলরদের নিয়ন্ত্রণ করতেন নিজাম হাজারী। জমি দখল, উচ্ছেদ ও চাঁদাবাজির দায়িত্ব ছিল তাঁর চাচাতো ভাই হিসেবে পরিচিত জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক লুৎফুর রহমান খোকন হাজারীর। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের টেন্ডারের ভাগ, পরিবহন ও শহরের চাঁদার টাকা সংগ্রহ করতেন জেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরীফ উল্যাহ ওরফে শরীফ হাজারী। আদায় করা টাকা প্রতিদিন শহরের ট্রাংক রোডের একটি ব্যাংকের শাখায় জমা করতেন শরিফ হাজারী। সড়ক ও জনপথ বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্বাস্থ্য বিভাগের টেন্ডার-বাণিজ্য, দরপত্র দাখিলসহ কাজের নির্দিষ্ট কমিশনের টাকা আদায় করতেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল জলিল আদর। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর ও গণপূর্ত বিভাগের সব ঠিকাদারি কাজ ভাগ-বাঁটোয়ারা ও চাঁদা তুলতেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শম্ভু বৈষ্ণব। আর সীমান্তে চোরাচালানি পণ্য, অস্ত্র ও মাদক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বৈধ-অবৈধ বালুমহাল দখলবাজির দায়িত্ব ছিল ছাগলনাইয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেজবাউল হায়দার চৌধুরী ওরফে সোহেল চৌধুরীর।
সোনাগাজী উপজেলায় চরাঞ্চলের জমি দখল করে অবৈধভাবে মাছ চাষ করে নিজাম হাজারীকে ভাগ দেওয়া এবং উপজেলার বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডার-বাণিজ্যের টাকা পৌঁছে দিতেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম খোকন।
ফুলগাজী সীমান্তের চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে চাঁদা নিজাম হাজারীর কাছে জমা দিতেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন মজুমদার ওরফে লাল হারুন। দাগনভূঞা উপজেলায় টেন্ডার-বাণিজ্য, হাটবাজারের চাঁদা তুলে হাজারীর কাছে পৌঁছে দিতেন জেলা যুবলীগের সভাপতি ও দাগনভূঞা উপজেলা চেয়ারম্যান দিদারুল কবির রতন।
এ ছাড়া জেলা যুবলীগের সহসম্পাদক হুমায়ুন কবীর ভূইয়ার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য বিভাগের সব টেন্ডার-বাণিজ্য নিজাম হাজারী নিয়ন্ত্রণ করতেন। ফাজিলপুরে বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করতেন ওই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মজিবুল হক রিপনের মাধ্যমে। জেলখানা থেকে সোনাগাজী উপজেলার বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করতেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত আসামি রুহুল আমিনের মাধ্যমে।
জেলার মাদক ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করতেন জেলা যুবলীগের সহসভাপতি জিয়াউল আলম মিস্টার। জেলা পরিষদের সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন সদর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি নুরুল আফসারের মাধ্যমে। বিলোনিয়া সীমান্তের চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করতেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন চৌধুরী সাজেল।
ফারুক হোসেন নামের এক ঠিকাদার জানান, সড়কের ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকার একটি কাজের জন্য নিজাম হাজারীকে অগ্রিম ৪০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন তিনি। সরকার পতনের পর এখন তিনিও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফেনী পৌরসভার ডাক্তার পাড়ার এক বাসিন্দা জানান, পৌরসভার মাধ্যমে চাঁদা নেওয়ার বুথ খুলেছিলেন নিজাম হাজারী।
শহরের রাজাজি দিঘির পাড়ে অবৈধভাবে প্রায় ৩০০ দোকান নির্মাণ করে প্রতিদিন লাখ টাকা চাঁদা তুলতেন পৌর যুবলীগ নেতা রুবেল হাজারী।
দলের নেতাদেরও খুন, নির্যাতন
নিজাম হাজারীর সিদ্ধান্তের বাইরে যাঁরা গেছেন, তাঁরাই হামলা, মামলাসহ নানা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নিজের প্রভাব বিস্তারে বাধা হওয়ায় ২০১৪ সালের ২০ মে প্রকাশ্যে ফেনী শহরের একাডেমি রোডে ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরামকে গুলি করে, কুপিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
একরামের স্বজনেরা জানান, হত্যার হুকুমদাতা হিসেবে নিজামের নাম উঠে এলেও অদৃশ্য শক্তির ইশারায় সেই মামলা থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হয়।
শুধু একরাম নন, ধর্মপুরের যুবলীগ নেতা রেজাউল করিম, বালিগাঁওয়ের জয়নাল মেম্বার, দাগনভূঞা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ফখরুল, ফেনী পৌর ছাত্রলীগ নেতা ইফতি, ফেনী পৌর এলাকায় শাহ জালাল নামের এক গরু ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যাসহ দলের ১৪ জনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে নিজাম হাজারীর ক্যাডারদের বিরুদ্ধে।
নামকরণ
ফেনী সদর উপজেলার বালিগাঁও ইউনিয়নের ডোমরা ও সুন্দরপুর মৌজার প্রায় ২৫ একর জায়গা দখল করে নিজ নামে প্রস্তাবিত কারিগরি মহাবিদ্যালয়, স্ত্রী নুরজাহান বেগমের নামে মসজিদ ও প্রয়াত বাবা কমিশনার জয়নাল আবেদীন এবং মা দেল আফরোজ বেগমের নামে একটি নূরানী মাদরাসা কমপ্লেক্স স্থাপনের কাজ শুরু করেন নিজাম হাজারী।
এসব ভূমির মালিকদের অভিযোগ, ওই দখলে নেতৃত্ব দিয়েছেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শুসেন চন্দ্র শীল, বালিগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সেলিম মুহুরি ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি জিয়া উদ্দিন বাবলু।
১০ মামলার আসামি
গত ৪ আগস্ট ফেনীর মহিপালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি চালায় নিজাম হাজারীর ক্যাডার বাহিনী। এতে ৭ জন নিহত হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পৌর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, ‘নিজাম হাজারীকে বারবার বলেছি, মহিপালে আন্দোলনরতরা কিছুক্ষণ পর চলে যাবে। হামলা করার দরকার নেই। কথা অগ্রাহ্য করে শুসেনকে দায়িত্ব দেন নিজাম হাজারী।’
ফেনীর পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৮টি হত্যা মামলাসহ ১০টি মামলা হয়েছে। তাঁকে ধরতে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
নিজাম হাজারী। ফেনীর রাজনীতিতে এক যুগের বেশি সময়ের দাপুটে চরিত্র। রাজনৈতিক প্রভাব আর ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে হয়েছেন কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক। এসব সম্পদ করেছেন চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বালুমহাল, জমি দখলসহ নানা উপায়ে। তবে রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষ বলতে কাউকেই দাঁড়াতে দেননি; এমনকি নিজ দলের নেতাদেরও হত্যা করেছেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, একসময় ফেনীর ‘গডফাদার’খ্যাত জয়নাল হাজারীর হাত ধরে রাজনীতিতে এলেও চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছিরের মাধ্যমে উত্থান হয় নিজাম হাজারীর। ২০০১ সালে যৌথ বাহিনীর অভিযানের মুখে জয়নাল হাজারী সাম্রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে আওয়ামী রাজনীতির হাল ধরতে চট্টগ্রাম থেকে ফেনীতে আসেন নিজাম হাজারী। তৈরি করেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। কোণঠাসা করে ফেনীতে ঢুকতে দেননি জয়নাল হাজারীকেও।
নিজাম হাজারী ২০১১ সালের ১৮ জানুয়ারির পৌরসভা নির্বাচনে কারচুপির মধ্য দিয়ে ফেনী পৌর মেয়র হন বলে অভিযোগ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের। আর দলের নেতা-কর্মীরা জানান, ২০১২ সালে জেলা রাজনীতির অঘোষিত অভিভাবক, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের হাত ধরে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে যান নিজাম। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রথম সংসদ সদস্য হন তিনি। পরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের হাত ধরে পরপর দুবার (২০১৮ ও ২০২৪) সংসদ সদস্য হন নিজাম।
হাজার কোটি টাকার সম্পদ
বিলাসবহুল বাগানবাড়ি, খামারবাড়ি ছাড়াও নিজাম হাজারীর অনেক জায়গাজমি ও বাড়ি রয়েছে মাস্টারপাড়ায়। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে,৬টি সাততলা এবং ১০টি একতলা বাড়ির পাশাপাশি ২০০ বিঘা জমি রয়েছে তাঁর। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রামে তাঁর নামে-বেনামে মার্কেট ও ফ্ল্যাট রয়েছে বলে শোনা যায়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মাস্টারপাড়ার বাড়ি থেকে ৬০০ মিটার দক্ষিণে অন্যদের প্রায় ৩৫০ শতাংশ জায়গা দখল করে বিলাসবহুল বাগানবাড়ি গড়ে তোলেন নিজাম হাজারী। বাগানবাড়িতে ছিল হেলিপ্যাড, টেনিস কোর্ট, লেক, পুল, থিয়েটার, সুইমিংপুল। আঙিনায় সুসজ্জিত বাগানের গাছ ও ঘাস এবং বাসার আসবাব বিভিন্ন দেশ থেকে আনা হয় বলে প্রচার ছিল। এই বাগানবাড়ির বাজারমূল্য হিসাব করলে প্রায় হাজার কোটি টাকা।
বিলাসবহুল বাগানবাড়ির উত্তর পাশে ৭৮ শতাংশ জমিতে গড়ে তোলেন খামারবাড়ি। সেখানে একটি পুকুরের চারপাশে গরু, ছাগল, মহিষ ও মুরগির খামার। খামারবাড়িতে প্রবেশের দক্ষিণ পাশে একটি ঘরে লেখা রয়েছে ‘তালতলা বাগান বাড়ী’। তবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর হাজার কোটি টাকার বিলাসবহুল সাম্রাজ্য পুড়িয়ে দেয় ছাত্র-জনতা।
‘১০ খলিফা’ ও ক্যাডার বাহিনী
নিজাম হাজারী মূলত ফেনীর ৬ উপজেলায় অপরাধের সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন বিশ্বস্ত ১০ সহযোগী ও নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী দিয়ে। স্থানীয়দের কাছে ওই ১০ সহযোগী নিজাম হাজারীর ‘১০ খলিফা’ নামে পরিচিত ছিল।
জেলার একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওই খলিফাদের কারণে সব সময় দলে কোণঠাসা হয়ে থাকতেন তাঁরা। ওই ১০ সহযোগীকে দিয়ে বালুমহাল দখল, টেন্ডার-বাণিজ্য, সম্পত্তি দখল, অর্থ আত্মসাৎ, চাঁদাবাজির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন নিজাম। এ ছাড়া বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের দমন-পীড়নের পাশাপাশি দলীয় নেতা-কর্মীদেরও নির্যাতন; এমনকি হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে নিজামের বিরুদ্ধে।
দখল, টেন্ডারবাজি
একাধিক ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), স্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্য, গণপূর্ত, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন নিজাম হাজারীর খলিফারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদার বলেন, নিজাম হাজারী কাজের বরাদ্দভেদে ৭ শতাংশ, ১০ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ধরে অগ্রিম টাকা নিতেন খলিফাদের মাধ্যমে।
স্থানীয় ও ঠিকাদার সূত্রে জানা গেছে, নিজাম হাজারীর বিশ্বস্ত ‘ডান হাত’ হিসেবে পরিচিত ফেনী সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শুসেন চন্দ্র শীল। তাঁর মাধ্যমে গত ১৫ বছর এলজিইডির সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন। এ ছাড়া জেলার কোন দপ্তরের কাজ কে করবে, সেটিও তিনি শুসেনের মাধ্যমে বণ্টন করতেন।
পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজীকে দিয়ে ফেনী পৌর এলাকার ১৮টি ওয়ার্ডের রাজনীতি ও কাউন্সিলরদের নিয়ন্ত্রণ করতেন নিজাম হাজারী। জমি দখল, উচ্ছেদ ও চাঁদাবাজির দায়িত্ব ছিল তাঁর চাচাতো ভাই হিসেবে পরিচিত জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক লুৎফুর রহমান খোকন হাজারীর। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের টেন্ডারের ভাগ, পরিবহন ও শহরের চাঁদার টাকা সংগ্রহ করতেন জেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরীফ উল্যাহ ওরফে শরীফ হাজারী। আদায় করা টাকা প্রতিদিন শহরের ট্রাংক রোডের একটি ব্যাংকের শাখায় জমা করতেন শরিফ হাজারী। সড়ক ও জনপথ বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্বাস্থ্য বিভাগের টেন্ডার-বাণিজ্য, দরপত্র দাখিলসহ কাজের নির্দিষ্ট কমিশনের টাকা আদায় করতেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল জলিল আদর। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর ও গণপূর্ত বিভাগের সব ঠিকাদারি কাজ ভাগ-বাঁটোয়ারা ও চাঁদা তুলতেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শম্ভু বৈষ্ণব। আর সীমান্তে চোরাচালানি পণ্য, অস্ত্র ও মাদক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বৈধ-অবৈধ বালুমহাল দখলবাজির দায়িত্ব ছিল ছাগলনাইয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেজবাউল হায়দার চৌধুরী ওরফে সোহেল চৌধুরীর।
সোনাগাজী উপজেলায় চরাঞ্চলের জমি দখল করে অবৈধভাবে মাছ চাষ করে নিজাম হাজারীকে ভাগ দেওয়া এবং উপজেলার বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডার-বাণিজ্যের টাকা পৌঁছে দিতেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম খোকন।
ফুলগাজী সীমান্তের চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে চাঁদা নিজাম হাজারীর কাছে জমা দিতেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন মজুমদার ওরফে লাল হারুন। দাগনভূঞা উপজেলায় টেন্ডার-বাণিজ্য, হাটবাজারের চাঁদা তুলে হাজারীর কাছে পৌঁছে দিতেন জেলা যুবলীগের সভাপতি ও দাগনভূঞা উপজেলা চেয়ারম্যান দিদারুল কবির রতন।
এ ছাড়া জেলা যুবলীগের সহসম্পাদক হুমায়ুন কবীর ভূইয়ার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য বিভাগের সব টেন্ডার-বাণিজ্য নিজাম হাজারী নিয়ন্ত্রণ করতেন। ফাজিলপুরে বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করতেন ওই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মজিবুল হক রিপনের মাধ্যমে। জেলখানা থেকে সোনাগাজী উপজেলার বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করতেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত আসামি রুহুল আমিনের মাধ্যমে।
জেলার মাদক ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করতেন জেলা যুবলীগের সহসভাপতি জিয়াউল আলম মিস্টার। জেলা পরিষদের সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন সদর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি নুরুল আফসারের মাধ্যমে। বিলোনিয়া সীমান্তের চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করতেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন চৌধুরী সাজেল।
ফারুক হোসেন নামের এক ঠিকাদার জানান, সড়কের ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকার একটি কাজের জন্য নিজাম হাজারীকে অগ্রিম ৪০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন তিনি। সরকার পতনের পর এখন তিনিও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফেনী পৌরসভার ডাক্তার পাড়ার এক বাসিন্দা জানান, পৌরসভার মাধ্যমে চাঁদা নেওয়ার বুথ খুলেছিলেন নিজাম হাজারী।
শহরের রাজাজি দিঘির পাড়ে অবৈধভাবে প্রায় ৩০০ দোকান নির্মাণ করে প্রতিদিন লাখ টাকা চাঁদা তুলতেন পৌর যুবলীগ নেতা রুবেল হাজারী।
দলের নেতাদেরও খুন, নির্যাতন
নিজাম হাজারীর সিদ্ধান্তের বাইরে যাঁরা গেছেন, তাঁরাই হামলা, মামলাসহ নানা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নিজের প্রভাব বিস্তারে বাধা হওয়ায় ২০১৪ সালের ২০ মে প্রকাশ্যে ফেনী শহরের একাডেমি রোডে ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরামকে গুলি করে, কুপিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
একরামের স্বজনেরা জানান, হত্যার হুকুমদাতা হিসেবে নিজামের নাম উঠে এলেও অদৃশ্য শক্তির ইশারায় সেই মামলা থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হয়।
শুধু একরাম নন, ধর্মপুরের যুবলীগ নেতা রেজাউল করিম, বালিগাঁওয়ের জয়নাল মেম্বার, দাগনভূঞা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ফখরুল, ফেনী পৌর ছাত্রলীগ নেতা ইফতি, ফেনী পৌর এলাকায় শাহ জালাল নামের এক গরু ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যাসহ দলের ১৪ জনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে নিজাম হাজারীর ক্যাডারদের বিরুদ্ধে।
নামকরণ
ফেনী সদর উপজেলার বালিগাঁও ইউনিয়নের ডোমরা ও সুন্দরপুর মৌজার প্রায় ২৫ একর জায়গা দখল করে নিজ নামে প্রস্তাবিত কারিগরি মহাবিদ্যালয়, স্ত্রী নুরজাহান বেগমের নামে মসজিদ ও প্রয়াত বাবা কমিশনার জয়নাল আবেদীন এবং মা দেল আফরোজ বেগমের নামে একটি নূরানী মাদরাসা কমপ্লেক্স স্থাপনের কাজ শুরু করেন নিজাম হাজারী।
এসব ভূমির মালিকদের অভিযোগ, ওই দখলে নেতৃত্ব দিয়েছেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শুসেন চন্দ্র শীল, বালিগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সেলিম মুহুরি ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি জিয়া উদ্দিন বাবলু।
১০ মামলার আসামি
গত ৪ আগস্ট ফেনীর মহিপালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি চালায় নিজাম হাজারীর ক্যাডার বাহিনী। এতে ৭ জন নিহত হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পৌর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, ‘নিজাম হাজারীকে বারবার বলেছি, মহিপালে আন্দোলনরতরা কিছুক্ষণ পর চলে যাবে। হামলা করার দরকার নেই। কথা অগ্রাহ্য করে শুসেনকে দায়িত্ব দেন নিজাম হাজারী।’
ফেনীর পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৮টি হত্যা মামলাসহ ১০টি মামলা হয়েছে। তাঁকে ধরতে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বরিশাল-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
৫ ঘণ্টা আগেনড়াইলের কালিয়া উপজেলার ধানখেত থেকে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে নড়াগাতী থানার খাশিয়াল ইউনিয়নের পাকুড়িয়া গ্রামের ধানখেত থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়।
৯ ঘণ্টা আগেঝিনাইদহ সদর উপজেলার শিকারপুর গ্রামের পুকুর থেকে এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় তার এক সহপাঠীকে আটক করেছে পুলিশ।
৯ ঘণ্টা আগেসুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে পৃথক দুটি হত্যা মামলায় দুই শিশুসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার তাঁদের সুনামগঞ্জ আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। গতকাপল বুধবার রাতে তাঁদের পৃথক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
৯ ঘণ্টা আগে