দরজার পাশে নামফলকে (নেমপ্লেট) লেখা, ‘মুর্তজা বশীর’। নিচে লেখা আছে, ‘আছেন’। আছেন! চাবি দিয়ে দরজা খুলে মুর্তজাকন্যা মুনীরা বশীর ইশারা দিয়ে প্রবেশের আহ্বান জানালেন। ঘরের ভেতর সন্তর্পণে পা ফেললাম। যেদিকেই তাকাই স্যারের (মুর্তজা বশীর) মুখাবয়ব। অনুভব করলাম, স্যার অভ্যর্থনা জানালেন, কুশলবিনিময় করলেন এবং তিনি সঙ্গে আছেন। নানা প্রশ্নোত্তরে মত্ত হয়ে থাকলাম একটা ঘোরের মধ্যে। এক এক করে ঘরে ঢুকলেন স্যারের প্রিয়ভাজন আলোকচিত্রী মোহাম্মদ আসাদ, সাংবাদিক আশফাকুর রহমান ও নিজাম বিশ্বাস। তাঁরা স্যারের সংগ্রহের অ্যান্টিক ও শিল্পকর্ম প্রদর্শন উপযোগী বিন্যস্ত করতে ব্যস্ত।
এ সময় স্যারের শয়নকক্ষ, পাঠকক্ষে ঢুকে আমি যেন গুপ্তধন পাওয়ার মতো বিস্মিত হলাম। আবিষ্কার করলাম, গবেষণাধর্মী শিল্পিত-জীবনের নিমগ্ন সাধক মুর্তজা বশীরকে। না, তাঁর বিখ্যাত সিরিজচিত্রগুলোর কথা বলছি না; এসব সিরিজচিত্রের কেবল দু-একটি কাজ চোখে পড়ল। এটা মূলত স্যারের ব্যবহৃত ফ্ল্যাট-বাসা। পুরোটাই এখন জাদুঘরের মতো। অভ্যর্থনা কক্ষ বা ড্রয়িংরুমের বড় দুই দেয়ালজুড়ে ৯০টির অধিক আত্মপ্রতিকৃতি, অ্যান্টিক, মুদ্রা, ডাকটিকিট, বই, চাবির রিং, দেশলাইয়ের বাক্স, হস্তলিপি, বিভিন্ন রকম পাথর, টেরাকোটা প্রভৃতি সুবিন্যস্ত করে রাখা। উল্টেপাল্টে দেখছি, আর নেপথ্যের স্মৃতি, তথ্য, ইতিহাসগুলো শুনিয়ে যাচ্ছিলেন মুনীরা বশীর। বিচিত্র কর্মযজ্ঞের নিদর্শনই অধিকাংশ জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছে। এত সব দেখে ভুলে যাচ্ছিলাম তাঁর ‘দেয়াল’, ‘শহীদ-শিরোনাম’, ‘পাখা’, ‘রমণী’, ‘কলেমা তৈয়বা’ প্রভৃতি বিখ্যাত সিরিজচিত্রের ড্রয়িং ও রঙের স্বতন্ত্রে উজ্জ্বল চিত্রের কথা। বিস্ময় জাগাল দেয়ালে সাজানো আত্মপ্রতিকৃতিগুলো। ১৯৫৩ থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের জীবনপঞ্জি যেন একনজরে পাঠ মিলল; অর্থাৎ দেয়াল যেন আস্ত এক গবেষণাধর্মী পুস্তক। যার এক একটি পৃষ্ঠায় রয়েছে এক একটি আত্মপ্রতিকৃতি। তরজমা করতে হলে আলাদা করে দৃষ্টিপাঠের দাবি রাখে। রীতিমতো বর্ণাঢ্য জীবনের বিস্ময়কর ডকুমেন্টেশন। তেলরং, জলরং, প্যাস্টেল, পেনসিল, মিশ্র মাধ্যমে ড্রয়িং, চিত্রকলা, প্রিন্ট—কী নেই এসব চিত্রে? শক্তিশালী ড্রয়িং, রেখার বৈচিত্র্য, রঙের সুমিত ব্যবহার, প্রতীক-সংকেতে ভিন্ন ভিন্ন রাগ-রাগিণী সৃষ্টি হয়েছে এসব চিত্রে। দৃষ্টির পথ ধরে মর্মে পৌঁছে ভাবনার জগতে ঝড় তুলে দেয়। শুধু কি শৈল্পিক দিক? এ হলো পঞ্চাশের দশক থেকে আত্মপ্রতিকৃতি বা আত্মজীবনীর বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যভান্ডার। বর্ণাঢ্য বিচিত্র জীবনের সবকিছুই তিনি যেন চিত্রকর্মে, সাহিত্যে, সংগ্রহে ডকুমেন্টেশন করে রেখেছেন। ফটোগ্রাফির বড় এক আর্কাইভ রয়েছে। যেখানে বিভিন্ন জাদুঘরের শিল্প-নিদর্শনগুলোর সযত্ন ফটোগ্রাফি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে পারিবারিক আবেগময় মুহূর্ত ও শৈল্পিক বিষয়াবলির অনুসন্ধানী ফটোগ্রাফি। একজন পিতা হিসেবে সন্তানদের প্রতি তিনি ছিলেন বিনিদ্র যত্নশীল। স্ত্রীর গর্ভে প্রথম সন্তানের (মুনীরা বশীর) অস্তিত্ব পাওয়ার পর থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন পরম স্নেহ-ভালোবাসায় স্ত্রীর গর্ভাবস্থার প্রতিদিনের একটি করে ছবি তুলে রেখেছেন। এ নিশ্চয়ই পারিবারিক ভালোবাসামিশ্রিত বিজ্ঞানভিত্তিক ফটোগ্রাফির অনন্য দৃষ্টান্ত। শ্রম, সাধনা, নিষ্ঠা, রুচি ও ভালোবাসার আশ্চর্য পরিচয় মেলে তাঁর এ কাজে।
শিল্পীরা সাধারণত অগোছালো হয়ে থাকেন। ঠিক বিপরীত জীবনদর্শন দেখিয়েছেন শিল্পী মুর্তজা বশীর। তাঁর শখের সংগ্রহ আনন্দ ও আবেগকে উসকে দিত বলেই নির্ভার মনে আবার এক কাজ থেকে অন্য কাজ করার শক্তি পেতেন। ছবি আঁকায় অবকাশ পেতেন। সংগ্রহের তালিকায় অসংখ্য বই রয়েছে। বইয়ের পৃষ্ঠায় সমান্তরাল রেখা টানা দেখে বোঝা যায়, জানার জগতে কী নিমগ্ন ছিলেন। সত্যিকার অর্থে তিনি একজন নিমগ্ন সাধক। ছবি আঁকা, শিক্ষকতা, গবেষণা, লেখালেখি, সংগ্রহ—সংসারজীবনের প্রাত্যহিক দায়িত্ব পালনে বাধা হয়নি। দেশ-বিদেশের চমৎকার রান্না করা তাঁর শৈল্পিক গুণ হিসেবেই বিবেচ্য।
‘দেয়াল’ সিরিজের মধ্য দিয়ে তিনি বিমূর্ত বাস্তববাদ ধারণার সূচনা করেছেন। এই বিমূর্ত বাস্তববাদ ‘শহীদ শিরোনাম’, ‘পাখা’সহ আরও কয়েকটি সিরিজচিত্রে দেখিয়েছেন। ‘পাখা’ সিরিজচিত্রে প্রজাপতির রং-বেরঙের পাখাকে স্টাডি করে জীবনের সম্ভাবনা, চাঞ্চল্য, স্বপ্ন, অনুভূতিকে ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন। সব কাজের মধ্যেই তথ্য বা রেফারেন্স যুক্ত করা তাঁর সৃষ্টি শৈলীর অনন্য ভঙ্গি। ‘জ্যোতি’ সিরিজচিত্রে রয়েছে এমন তথ্যযুক্ত প্রতীকী ব্যঞ্জনা। আশির দশকে শবাগারে গিয়ে ড্রয়িং করেছেন, আবার একই হাতে ফুল ও রমণীর লাবণ্য ফুটেছে। ‘আমার জীবন ও অন্যান্য গ্রন্থে’ (২০১৪) তিনি লিখেছেন, ‘আজ পর্যন্ত আমি কোনো ফরমায়েশি ছবি আঁকিনি। আপন পর্যবেক্ষণকৃত মানুষ, জীবন, জীবনের দুঃখ-বঞ্চনা, টানাপোড়েন স্বপ্ন নিয়ে ভেতরের তাগিদ থেকে আমি ছবি আঁকছি।’ ড্রয়িং তাঁর শক্তিশালী প্রকাশ। নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের বাস্তবানুগ প্রতিকৃতি একাধিক ড্রয়িংয়ে ধরা পড়েছে। তবে ছবির নির্মাণ-প্রক্রিয়ায় তিনি খুব সচেতন এবং উচ্চাভিলাষী ছিলেন। একটা ছবি নির্মাণের আগে একাধিক ড্রয়িং করে নিতেন। যেটা পছন্দ হতো, কাঙ্ক্ষিত অবস্থায় (পারফেকশন) পৌঁছাত, সেটিতেই কেবলমাত্র স্বাক্ষর করতেন। দেয়ালে ঝোলানো একটি ড্রয়িং দেখে বোঝা গেল তিনি ছবি আঁকার ক্ষেত্রে কালার চার্ট করে নিতেন। কোথায় কী রং বসবে, তার সুপরিকল্পিত ছক থাকত। কাচের জারের মধ্যে রাখা তাঁর ব্যক্তিগত কিছু ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মধ্যে একটি ঘড়ি খুব সহজেই নজর কাড়ল। ঘড়িতে তিনি কালার চার্ট দিয়ে নকশা করে রেখেছেন। ঘরের নেমপ্লেটেও রয়েছে তাঁর শৈল্পিক ছোঁয়া। ব্যবহারিক জীবনে কী পরিমাণ সৌন্দর্যবোধের পিপাসা থাকলে তিনি এসব করতে পারেন—এই দুটো কাজে তার প্রমাণ মেলে।
তাঁকে মুদ্রা ও ডাকটিকিটের সংগ্রাহক হিসেবে আমার জানা থাকলেও ব্যক্তিগত অ্যান্টিক সংগ্রহের বিষয়টি জানা ছিল না। ব্রহ্মাণ্ডের অফুরন্ত সামগ্রীর মধ্য থেকে শৈল্পিক, শিক্ষণীয় ও প্রয়োজনের বস্তুটি সংগ্রহ করার দৃষ্টি না থাকলে সংগ্রহও জঞ্জাল হতে পারে। কিন্তু না, মুর্তজা বশীরের প্রতিটি সংগ্রহে তাঁর গবেষণা ও দৃষ্টি শক্তির গভীরতাকে সাধুবাদ জানানো যায়। দেয়ালে ঝোলানো একটি টালি (টেরাকোটা) ময়ূরখচিত। লোকশিল্পীদের তৈরি ঘরে ব্যবহারের জন্য টালির এই শৈল্পিক সৌন্দর্যটি তিনি খুঁজে নিয়েছেন, যা কালান্তরে গবেষণার উপাত্ত হয়ে রইল। এ ছাড়া রয়েছে অনেক নামীদামি ভাস্কর্য ও মূর্তি। মুনীরা বললেন, সংসারের অর্থাভাব থাকলেও অ্যান্টিক সংগ্রহের তিনি কার্পণ্য করেননি। কখনো কখনো দামি দ্রব্যাদি কিনে দিনের পর দিন লুকিয়ে রেখেছেন। ছোট্ট একটি বেসমেন্টের ওপর রাখা হয়েছে অনেকগুলো চাবির রিং, দেশ-বিদেশে ভ্রমণের সময় চাবির রিং সংগ্রহ করা তাঁর আরেক শখ ছিল। প্রায় ৫০০-এর মতো এসব রিং দেশ-বিদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক পরিচয়ের আধার হয়ে আছে। অবাক হতে হয়, কতটা গোছাল থাকলে প্রতিটি সিরিজচিত্র যে রঙের প্লেট ব্যবহারে করেছেন তা পেইন্টিংয়ে রূপদান করেছেন। দেয়ালে ঝোলানো এই পেইন্টিং দেখে বোঝা যায় তিনি কোন সিরিজের কাজ কোন রং ব্যবহার করে করেছিলেন। সর্বোপরি বলা যায়, তিনি যা কিছু করেছেন, সবকিছুই যেন ডকুমেন্টেশন করে রেখেছেন। শখ, রুচি ও সংগ্রহে তাঁর একাগ্রতা ও নিষ্ঠা শিল্পী ও সাধারণ মানুষের আদর্শ এবং কর্মময় জীবন পাঠ্য হয়ে থাকবে। ৯০তম জন্মবার্ষিকীতে স্যারের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
দরজার পাশে নামফলকে (নেমপ্লেট) লেখা, ‘মুর্তজা বশীর’। নিচে লেখা আছে, ‘আছেন’। আছেন! চাবি দিয়ে দরজা খুলে মুর্তজাকন্যা মুনীরা বশীর ইশারা দিয়ে প্রবেশের আহ্বান জানালেন। ঘরের ভেতর সন্তর্পণে পা ফেললাম। যেদিকেই তাকাই স্যারের (মুর্তজা বশীর) মুখাবয়ব। অনুভব করলাম, স্যার অভ্যর্থনা জানালেন, কুশলবিনিময় করলেন এবং তিনি সঙ্গে আছেন। নানা প্রশ্নোত্তরে মত্ত হয়ে থাকলাম একটা ঘোরের মধ্যে। এক এক করে ঘরে ঢুকলেন স্যারের প্রিয়ভাজন আলোকচিত্রী মোহাম্মদ আসাদ, সাংবাদিক আশফাকুর রহমান ও নিজাম বিশ্বাস। তাঁরা স্যারের সংগ্রহের অ্যান্টিক ও শিল্পকর্ম প্রদর্শন উপযোগী বিন্যস্ত করতে ব্যস্ত।
এ সময় স্যারের শয়নকক্ষ, পাঠকক্ষে ঢুকে আমি যেন গুপ্তধন পাওয়ার মতো বিস্মিত হলাম। আবিষ্কার করলাম, গবেষণাধর্মী শিল্পিত-জীবনের নিমগ্ন সাধক মুর্তজা বশীরকে। না, তাঁর বিখ্যাত সিরিজচিত্রগুলোর কথা বলছি না; এসব সিরিজচিত্রের কেবল দু-একটি কাজ চোখে পড়ল। এটা মূলত স্যারের ব্যবহৃত ফ্ল্যাট-বাসা। পুরোটাই এখন জাদুঘরের মতো। অভ্যর্থনা কক্ষ বা ড্রয়িংরুমের বড় দুই দেয়ালজুড়ে ৯০টির অধিক আত্মপ্রতিকৃতি, অ্যান্টিক, মুদ্রা, ডাকটিকিট, বই, চাবির রিং, দেশলাইয়ের বাক্স, হস্তলিপি, বিভিন্ন রকম পাথর, টেরাকোটা প্রভৃতি সুবিন্যস্ত করে রাখা। উল্টেপাল্টে দেখছি, আর নেপথ্যের স্মৃতি, তথ্য, ইতিহাসগুলো শুনিয়ে যাচ্ছিলেন মুনীরা বশীর। বিচিত্র কর্মযজ্ঞের নিদর্শনই অধিকাংশ জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছে। এত সব দেখে ভুলে যাচ্ছিলাম তাঁর ‘দেয়াল’, ‘শহীদ-শিরোনাম’, ‘পাখা’, ‘রমণী’, ‘কলেমা তৈয়বা’ প্রভৃতি বিখ্যাত সিরিজচিত্রের ড্রয়িং ও রঙের স্বতন্ত্রে উজ্জ্বল চিত্রের কথা। বিস্ময় জাগাল দেয়ালে সাজানো আত্মপ্রতিকৃতিগুলো। ১৯৫৩ থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের জীবনপঞ্জি যেন একনজরে পাঠ মিলল; অর্থাৎ দেয়াল যেন আস্ত এক গবেষণাধর্মী পুস্তক। যার এক একটি পৃষ্ঠায় রয়েছে এক একটি আত্মপ্রতিকৃতি। তরজমা করতে হলে আলাদা করে দৃষ্টিপাঠের দাবি রাখে। রীতিমতো বর্ণাঢ্য জীবনের বিস্ময়কর ডকুমেন্টেশন। তেলরং, জলরং, প্যাস্টেল, পেনসিল, মিশ্র মাধ্যমে ড্রয়িং, চিত্রকলা, প্রিন্ট—কী নেই এসব চিত্রে? শক্তিশালী ড্রয়িং, রেখার বৈচিত্র্য, রঙের সুমিত ব্যবহার, প্রতীক-সংকেতে ভিন্ন ভিন্ন রাগ-রাগিণী সৃষ্টি হয়েছে এসব চিত্রে। দৃষ্টির পথ ধরে মর্মে পৌঁছে ভাবনার জগতে ঝড় তুলে দেয়। শুধু কি শৈল্পিক দিক? এ হলো পঞ্চাশের দশক থেকে আত্মপ্রতিকৃতি বা আত্মজীবনীর বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যভান্ডার। বর্ণাঢ্য বিচিত্র জীবনের সবকিছুই তিনি যেন চিত্রকর্মে, সাহিত্যে, সংগ্রহে ডকুমেন্টেশন করে রেখেছেন। ফটোগ্রাফির বড় এক আর্কাইভ রয়েছে। যেখানে বিভিন্ন জাদুঘরের শিল্প-নিদর্শনগুলোর সযত্ন ফটোগ্রাফি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে পারিবারিক আবেগময় মুহূর্ত ও শৈল্পিক বিষয়াবলির অনুসন্ধানী ফটোগ্রাফি। একজন পিতা হিসেবে সন্তানদের প্রতি তিনি ছিলেন বিনিদ্র যত্নশীল। স্ত্রীর গর্ভে প্রথম সন্তানের (মুনীরা বশীর) অস্তিত্ব পাওয়ার পর থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন পরম স্নেহ-ভালোবাসায় স্ত্রীর গর্ভাবস্থার প্রতিদিনের একটি করে ছবি তুলে রেখেছেন। এ নিশ্চয়ই পারিবারিক ভালোবাসামিশ্রিত বিজ্ঞানভিত্তিক ফটোগ্রাফির অনন্য দৃষ্টান্ত। শ্রম, সাধনা, নিষ্ঠা, রুচি ও ভালোবাসার আশ্চর্য পরিচয় মেলে তাঁর এ কাজে।
শিল্পীরা সাধারণত অগোছালো হয়ে থাকেন। ঠিক বিপরীত জীবনদর্শন দেখিয়েছেন শিল্পী মুর্তজা বশীর। তাঁর শখের সংগ্রহ আনন্দ ও আবেগকে উসকে দিত বলেই নির্ভার মনে আবার এক কাজ থেকে অন্য কাজ করার শক্তি পেতেন। ছবি আঁকায় অবকাশ পেতেন। সংগ্রহের তালিকায় অসংখ্য বই রয়েছে। বইয়ের পৃষ্ঠায় সমান্তরাল রেখা টানা দেখে বোঝা যায়, জানার জগতে কী নিমগ্ন ছিলেন। সত্যিকার অর্থে তিনি একজন নিমগ্ন সাধক। ছবি আঁকা, শিক্ষকতা, গবেষণা, লেখালেখি, সংগ্রহ—সংসারজীবনের প্রাত্যহিক দায়িত্ব পালনে বাধা হয়নি। দেশ-বিদেশের চমৎকার রান্না করা তাঁর শৈল্পিক গুণ হিসেবেই বিবেচ্য।
‘দেয়াল’ সিরিজের মধ্য দিয়ে তিনি বিমূর্ত বাস্তববাদ ধারণার সূচনা করেছেন। এই বিমূর্ত বাস্তববাদ ‘শহীদ শিরোনাম’, ‘পাখা’সহ আরও কয়েকটি সিরিজচিত্রে দেখিয়েছেন। ‘পাখা’ সিরিজচিত্রে প্রজাপতির রং-বেরঙের পাখাকে স্টাডি করে জীবনের সম্ভাবনা, চাঞ্চল্য, স্বপ্ন, অনুভূতিকে ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন। সব কাজের মধ্যেই তথ্য বা রেফারেন্স যুক্ত করা তাঁর সৃষ্টি শৈলীর অনন্য ভঙ্গি। ‘জ্যোতি’ সিরিজচিত্রে রয়েছে এমন তথ্যযুক্ত প্রতীকী ব্যঞ্জনা। আশির দশকে শবাগারে গিয়ে ড্রয়িং করেছেন, আবার একই হাতে ফুল ও রমণীর লাবণ্য ফুটেছে। ‘আমার জীবন ও অন্যান্য গ্রন্থে’ (২০১৪) তিনি লিখেছেন, ‘আজ পর্যন্ত আমি কোনো ফরমায়েশি ছবি আঁকিনি। আপন পর্যবেক্ষণকৃত মানুষ, জীবন, জীবনের দুঃখ-বঞ্চনা, টানাপোড়েন স্বপ্ন নিয়ে ভেতরের তাগিদ থেকে আমি ছবি আঁকছি।’ ড্রয়িং তাঁর শক্তিশালী প্রকাশ। নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের বাস্তবানুগ প্রতিকৃতি একাধিক ড্রয়িংয়ে ধরা পড়েছে। তবে ছবির নির্মাণ-প্রক্রিয়ায় তিনি খুব সচেতন এবং উচ্চাভিলাষী ছিলেন। একটা ছবি নির্মাণের আগে একাধিক ড্রয়িং করে নিতেন। যেটা পছন্দ হতো, কাঙ্ক্ষিত অবস্থায় (পারফেকশন) পৌঁছাত, সেটিতেই কেবলমাত্র স্বাক্ষর করতেন। দেয়ালে ঝোলানো একটি ড্রয়িং দেখে বোঝা গেল তিনি ছবি আঁকার ক্ষেত্রে কালার চার্ট করে নিতেন। কোথায় কী রং বসবে, তার সুপরিকল্পিত ছক থাকত। কাচের জারের মধ্যে রাখা তাঁর ব্যক্তিগত কিছু ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মধ্যে একটি ঘড়ি খুব সহজেই নজর কাড়ল। ঘড়িতে তিনি কালার চার্ট দিয়ে নকশা করে রেখেছেন। ঘরের নেমপ্লেটেও রয়েছে তাঁর শৈল্পিক ছোঁয়া। ব্যবহারিক জীবনে কী পরিমাণ সৌন্দর্যবোধের পিপাসা থাকলে তিনি এসব করতে পারেন—এই দুটো কাজে তার প্রমাণ মেলে।
তাঁকে মুদ্রা ও ডাকটিকিটের সংগ্রাহক হিসেবে আমার জানা থাকলেও ব্যক্তিগত অ্যান্টিক সংগ্রহের বিষয়টি জানা ছিল না। ব্রহ্মাণ্ডের অফুরন্ত সামগ্রীর মধ্য থেকে শৈল্পিক, শিক্ষণীয় ও প্রয়োজনের বস্তুটি সংগ্রহ করার দৃষ্টি না থাকলে সংগ্রহও জঞ্জাল হতে পারে। কিন্তু না, মুর্তজা বশীরের প্রতিটি সংগ্রহে তাঁর গবেষণা ও দৃষ্টি শক্তির গভীরতাকে সাধুবাদ জানানো যায়। দেয়ালে ঝোলানো একটি টালি (টেরাকোটা) ময়ূরখচিত। লোকশিল্পীদের তৈরি ঘরে ব্যবহারের জন্য টালির এই শৈল্পিক সৌন্দর্যটি তিনি খুঁজে নিয়েছেন, যা কালান্তরে গবেষণার উপাত্ত হয়ে রইল। এ ছাড়া রয়েছে অনেক নামীদামি ভাস্কর্য ও মূর্তি। মুনীরা বললেন, সংসারের অর্থাভাব থাকলেও অ্যান্টিক সংগ্রহের তিনি কার্পণ্য করেননি। কখনো কখনো দামি দ্রব্যাদি কিনে দিনের পর দিন লুকিয়ে রেখেছেন। ছোট্ট একটি বেসমেন্টের ওপর রাখা হয়েছে অনেকগুলো চাবির রিং, দেশ-বিদেশে ভ্রমণের সময় চাবির রিং সংগ্রহ করা তাঁর আরেক শখ ছিল। প্রায় ৫০০-এর মতো এসব রিং দেশ-বিদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক পরিচয়ের আধার হয়ে আছে। অবাক হতে হয়, কতটা গোছাল থাকলে প্রতিটি সিরিজচিত্র যে রঙের প্লেট ব্যবহারে করেছেন তা পেইন্টিংয়ে রূপদান করেছেন। দেয়ালে ঝোলানো এই পেইন্টিং দেখে বোঝা যায় তিনি কোন সিরিজের কাজ কোন রং ব্যবহার করে করেছিলেন। সর্বোপরি বলা যায়, তিনি যা কিছু করেছেন, সবকিছুই যেন ডকুমেন্টেশন করে রেখেছেন। শখ, রুচি ও সংগ্রহে তাঁর একাগ্রতা ও নিষ্ঠা শিল্পী ও সাধারণ মানুষের আদর্শ এবং কর্মময় জীবন পাঠ্য হয়ে থাকবে। ৯০তম জন্মবার্ষিকীতে স্যারের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
চারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
৬ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
১৩ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
১৩ দিন আগেদ্য ভেজিটেরিয়ানের পর হান কাঙের পরের উপন্যাস ছিল ‘দ্য উইন্ড ব্লোজ, গো’। এই উপন্যাস লেখার সময়ই ঘটে বিপত্তি! হান অনুভব করেন তিনি আর লিখতে পারছেন না। গত বছর নিজের পঞ্চম উপন্যাস ‘গ্রিক লেসন’ ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হলে স্পেনের এল-পাইস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি।
১০ অক্টোবর ২০২৪