রাফাত মিশু
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) কেন বড় কবি, সেটি এখন আর কোনো অমীমাংসিত বিষয় নয়। বাংলা কবিতার ইতিহাসে শুধু নয়, বাংলা জনাঞ্চলের আর্থরাজনৈতিক পটভূমিতেও কাজী নজরুলের একটি স্বতন্ত্র অবস্থান আছে। সেই পরম্পরায় নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে ভূষিত হয়েছেন এবং মৃত্যুর পর তাঁর সমাধি এই বাংলাদেশের মাটিতেই সংরক্ষিত আছে। ফলে বাংলাদেশে নজরুল-বিচার কেবল সাহিত্য-শিল্প-নন্দনের মাপকাঠি দিয়ে চলে না এবং সেটা হয়ওনি। এর সঙ্গে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে থাকে বাংলাদেশের জাতীয় চেতনা এবং জাতীয় চেতনার রূপান্তর। নজরুল তো সেই ১৯৪২ সালেই নির্বাক হয়ে যান। এর আগে সবাক নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, খেলাফত আন্দোলন, স্বরাজসহ প্রায় প্রতিটি জাতীয় আন্দোলনে সক্রিয় থেকেছেন এবং নিজের অবস্থান অকুণ্ঠভাবেই প্রকাশ করেছেন স্লোগানে, গানে, কবিতায়, কথাসাহিত্যে—সর্বত্র। বেঁচে থাকার পুরোটা সময় চেতনশীল থাকলে নিশ্চয়ই চল্লিশের দশকের দ্বিজাতিতত্ত্ব-ভিত্তিক পাকিস্তান আন্দোলন, ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা, বিভাগ-পরবর্তী ভারত ও পাকিস্তানের রাজনীতি এবং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে তিনি তাঁর অবস্থানের জানান দিতেন। তিনি সেই সুযোগ পাননি। কিন্তু পাঠক-অনুরাগীদের কাছে নজরুল যেমন নানা মাত্রিক ইতিবাচকতার মধ্য দিয়ে, বিপ্লবী চেতনার মধ্য দিয়ে গৃহীত হয়েছেন, তেমনি বিভিন্ন আমলের শাসকগোষ্ঠীও নানাভাবে নজরুলকে বিবেচনায় এনেছে। বিশেষত পাকিস্তান-পর্বের আইয়ুবি কালো দশকে নজরুলের কবিতা ও গানে নানা ধরনের কাটাছেঁড়া ও শব্দ পুনঃস্থাপনের যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তা থেকে নজরুলপাঠে রাজনীতি সাপেক্ষতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একাত্তর-পরবর্তীকালে নজরুলকে ঢাকায় নিয়ে আসা, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া, জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা দেওয়া, তাঁকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করা—একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, নজরুল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা—এ সবই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও বিবেচনার ফলাফল। ফলে নজরুলসাহিত্যের চর্চা, তার প্রসার এবং জাতীয় জীবনে নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা অনুসন্ধান ইত্যাদি বিষয়-আশয় রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে। বাংলাদেশ একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত। তাই রাষ্ট্রীয় বিষয়গুলো এখানে জাতীয় বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। রাষ্ট্রের নানান গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের মধ্যে তাঁর শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কারণ রাষ্ট্র তার ভবিষ্যৎ নাগরিকদের কীভাবে গড়ে নিতে চায়, তার অনেকখানি এই বিষয়ের ওপর নির্ভর করে এবং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। যেকোনো রাষ্ট্রের ইতিহাসপাঠের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পাঠ্যপুস্তকের স্বরূপ ও রূপান্তর অন্বেষণের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। সেই বিবেচনায় রাষ্ট্র কীভাবে নজরুলকে, অর্থাৎ তার জাতীয় কবিকে পেতে চায়, তা জানার জন্য পাঠ্যপুস্তকে নজরুল কীভাবে আছেন সেটি বুঝে নেওয়া জরুরি।
কাজী নজরুল এক অর্থে সব্যসাচী লেখক। গান-কবিতা-ছড়া-উপন্যাস-গল্প-প্রবন্ধ-পত্র-অভিভাষণ—সবই লিখেছেন। এসব রচনার মধ্যে নজরুলের সমকালের অভিঘাত আছে, আছে শিল্পসৃজনের বহুস্তরিক কলাকৌশল, তত্ত্ব ও মতবাদের ঘনিষ্ঠতা। তেমনি বর্তমানে দাঁড়িয়ে শতবর্ষকাল আগের নজরুলকে দেখার মধ্য দিয়ে বর্তমানের চোখটিও যুক্ত হয়ে যায় অনিবার্যভাবে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পাঠ্যপুস্তককে যে চোখ দিয়ে পাঠ করানো হয়, তা কেবল ব্যক্তি অথবা সমষ্টির থাকে না; সেটি মূলত রাষ্ট্রেরই চোখ হয়ে ওঠে। অন্য যেকোনো পাঠের মতো নজরুলপাঠও তাই কেবল অতীতের বিষয় হয়ে থাকে না। স্বাধীন বাংলাদেশের আগে-পরে নজরুল ও নজরুলসাহিত্য পাঠ্যতালিকায় সব সময়ই কমবেশি ছিল। শিল্পের তাত্ত্বিকদের কাছে নজরুল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাত্রায় গৃহীত হয়েছেন—কখনো কম, কখনো বেশি; কখনো শুরু, কখনো গুরু। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে শিশু থেকে তরুণ সবাই নজরুলসাহিত্যের কিছু দিক সম্পর্কে অবহিত থেকেছে। ফলে বাংলাদেশের সাক্ষর-শিক্ষিতদের চেতনাস্রোতে নজরুলের অবস্থান বেশ স্থায়ী। কিন্তু নজরুলপাঠ তো বড় বিষয়; পাঠ্যপুস্তকে নজরুলের সব সৃজনকর্ম অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভবও নয়। তাই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে নজরুল কীভাবে, কোন দৃষ্টিকোণ থেকে এবং কত পরিমাণে উপস্থিত থাকছেন, তা জানার মধ্য দিয়ে জাতীয়ভাবে নজরুলের একটি প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ পাঠ গ্রহণ করা যায়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বহুধারায় বিভক্ত, সেগুলো নিয়ে আছে নানা বিতর্ক—বর্তমান আলোচনার ক্ষেত্র সেটা নয়। এখানে কেবল বাংলাদেশের পুস্তক প্রণয়নসংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রণীত বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে নজরুলরচনার পরিচয় ও সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ের কার্যকারণ বোঝার চেষ্টা করা হবে। ২০২২ সালে প্রণীত পাঠ্যপুস্তকই বর্তমান আলোচনার উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে। এর মধ্য দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চোখ ও নজরুলচেতনার মধ্যে একটি দৃষ্টিভঙ্গিগত সাদৃশ্য, বৈচিত্র্য ও বিপ্রতীপতা অনুধাবন করা সম্ভব হবে।
প্রথম থেকে দ্বাদশ—এই বারোটি শ্রেণির আবশ্যিক হিসেবে বাংলা বিষয়ের বই প্রণয়ন করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড নামক প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি শ্রেণির বাংলা বইয়ে নজরুলকৃত সাহিত্যকর্মকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়, অর্থাৎ প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ের নাম অভিন্ন—‘আমার বাংলা বই’। প্রথম শ্রেণির বইয়ে আছে কাজী নজরুলের ‘ঝিঙে ফুল’ (১৯২৬) কাব্যগ্রন্থভুক্ত জনপ্রিয় শিশুতোষ ছড়া ‘প্রভাতী’র কিছু অংশ; অর্থাৎ সবার পরিচিত ‘ভোর হলো/দোর খোল/খুকুমণি ওঠরে!’ যদিও পাঠ্যবইয়ে কবিতার নামকরণ করা হয়েছে ‘ভোর হলো’। হয়তো প্রথম শ্রেণির শিশু শিক্ষার্থীদের ‘প্রভাতী’র র-ফলা পাঠের জটিলতা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা। দ্বিতীয় শ্রেণির বইয়ে আছে ‘আমি হব সকাল বেলার পাখি। সবার আগে কুসুমবাগে উঠব আমি ডাকি।’ এর নামকরণ করা হয়েছে ‘আমি হব’। এটি মূলত নজরুলের ‘সাত ভাই চম্পা’র প্রথম অংশ। তৃতীয় শ্রেণিতে আছে বিখ্যাত রণসংগীত হিসেবে পরিচিত ‘সন্ধ্যা’ (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থের ‘নতুনের গান’ কবিতার প্রথম অংশ: ‘চল্ চল্ চল্’। চতুর্থ শ্রেণির বইয়ে আছে ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থভুক্ত ‘মা’ কবিতা: ‘যেখানেতে দেখি যাহা/মা-এর মতন আহা/একটি কথায় এত সুধা মেশে নাই...’। পঞ্চম শ্রেণিতে নজরুলের ‘সংকল্প’ কবিতা (অগ্রন্থিত) অর্থাৎ ‘থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,’ কবিতার সংক্ষেপিত রূপ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা বই ‘চারুপাঠ’-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে আরও একটি বহুল পঠিত ছড়া-কবিতা ‘ঝিঙে ফুল’। সপ্তম শ্রেণির ‘সপ্তবর্ণা’য় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সাম্যবাদী (১৯২৫) কাব্যগ্রন্থভুক্ত ‘কুলি-মজুর’ কবিতার সংক্ষেপিত রূপ। সপ্তম শ্রেণির ‘আনন্দপাঠ’ (দ্রুতপঠন) নামক বইয়ে নজরুলের ‘জাগো সুন্দর’ নামক নাটিকা আছে; যদিও এর মূল নাম ‘জাগো সুন্দর চিরকিশোর’। অষ্টম শ্রেণির ‘সাহিত্য কণিকা’ বইয়ে কাজী নজরুলের দুটি রচনা স্থান পেয়েছে: একটি প্রবন্ধ ‘ভাব ও কাজ’ (যুগবাণী), অপরটি কবিতা ‘নারী’ (সাম্যবাদী)। নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য প্রণীত ‘বাংলা সাহিত্য’ বইয়ে নজরুলের তিনটি রচনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে: প্রবন্ধ ‘উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন’ (যুগবাণী), কবিতা ‘দোলন-চাঁপা’ (১৯২৩) কাব্যগ্রন্থভুক্ত ‘আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’ এবং কবিতা ‘মানুষ’ (সাম্যবাদী); এগুলোর মধ্যে শিক্ষার্থীদের যেকোনো দুটি পাঠ্য। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ‘সাহিত্যপাঠ’ বইয়েও তিনটি নজরুলরচনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে: একটি প্রবন্ধ ‘রুদ্রমঙ্গল’ (১৯২৭) গ্রন্থভুক্ত ‘আমার পথ’ এবং দুটি কবিতা ‘অগ্নি-বীণা’ (১৯২২) কাব্যগ্রন্থভুক্ত ‘বিদ্রোহী’ ও ‘সাম্যবাদী’। এ ছাড়া চতুর্থ শ্রেণির ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইয়ে কাজী নজরুল রচিত ‘শোন শোন ইয়া ইলাহী আমার মোনাজাত’ সূচক ‘হামদে ইলাহী’ সংযোজিত হয়েছে।
আগেই বলা হয়েছে, নজরুলের রচনাসম্ভার আয়তনে অনেক বড়। নজরুলরচনার কী কী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তার তালিকা হবে অসীমের মতো দীর্ঘ। কী কী রাখা যেত, সেটাও অনেকখানি আপেক্ষিক। তাই নজরুলকৃত যেসব রচনা পাঠ্যপুস্তকভুক্ত হয়েছে, সেসব কী রূপে ও কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সেটাই এই আলোচনায় মুখ্যতা পাবে। নজরুলের সাহিত্যকর্ম যে সব পর্যায়ে পাঠ্যভুক্ত আছে, এ থেকে বোঝা যায়, রাষ্ট্র নজরুলকে পাঠ করতে আগ্রহী। প্রাথমিক শ্রেণি পর্যায়ে নজরুলের যেসব ছড়া ও কবিতাজাতীয় রচনা পাঠ্যভুক্ত হয়েছে, সেসবের পাঠ সহৃদয়তা তৈরি, ছন্দ ও শ্রুতিমাধুর্য, ভাষার বর্ণ-শব্দ-উচ্চারণে সাবলীলতা সম্পর্কে শিশুদের পরিচিতকরণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। প্রকৃতিচেতনা, কর্তব্যবোধ, মাতৃভক্তি, জ্ঞানের প্রতি কৌতূহল—এই বিষয়গুলোও ওইজাতীয় রচনার সঙ্গে জড়িত। মাধ্যমিক শ্রেণিতে কবিতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রবন্ধ। নজরুলের সাংগীতিক কাব্যবোধের সঙ্গে মনন ও চিন্তার যুক্তিশৃঙ্খলা সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা অবহিত হয় প্রবন্ধপাঠের মাধ্যমে। এই পর্বে নজরুলের বেশির ভাগ প্রবন্ধ গ্রহণ করা হয়েছে যুগবাণী (১৯২২) প্রবন্ধগ্রন্থ থেকে। যুগবাণীর বেশির ভাগ প্রবন্ধ ‘দৈনিক নবযুগ’ (১৯২০) পত্রিকার সম্পাদকীয় হিসেবে রচিত হয়েছিল। পুরো প্রবন্ধগ্রন্থে তৎকালের অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের উত্তাপ এবং নজরুলের বিপ্লবী অবস্থান অনুধাবন করা যায়। ‘উগ্র জাতীয়তাবাদ’ ছড়ানোর অভিযোগে যুগবাণী একসময় ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধঘোষিত হয় (১৯২২)। যদিও পাঠ্যপুস্তকে বিপ্লবাত্মক কোনো প্রবন্ধ নির্বাচন করা হয়নি। মানুষকে কর্মমুখী করে তোলা, তার সদর্থক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো এবং সেই সূত্রে নজরুলের কর্মমুখরতা সম্পর্কে জানানোর জন্য প্রবন্ধগুলো নির্বাচন করা হয়ে থাকতে পারে। কবিতার ক্ষেত্রে নজরুলের নিজস্ব ধাঁচের সাম্যবাদী চিন্তা, মানবমুখিতা, শোষণহীন সমাজ, লিঙ্গসমতা, বৈষম্যমুক্তি গুরুত্ব পেয়েছে। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে, অর্থাৎ সাধারণ বাংলা শিক্ষা গ্রহণের সর্বোচ্চ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে নজরুলের যুগচিহ্নিত কবিতা ‘বিদ্রোহী’; পুরোটা নয়, সংক্ষেপিত। পাঠ্যপুস্তকে অনেক সময় বড় রচনাকে সংক্ষেপিত ও পরিমার্জনা করা হয় মূলত শিক্ষার্থীদের পঠনপরিধি, বয়সের সঙ্গে সংগতি রক্ষা এবং আধুনিক বানান সমন্বয়ের বিষয় বিবেচনায় রেখে। একই বিবেচনায় হয়তো প্রাথমিক শ্রেণি পর্যায়ে কিছু কবিতার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। যদিও কবিতার মূল নাম জানাটাও শিক্ষার একটি অংশ। কিন্তু একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির মতো পরিণত পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রণীত বাংলা সাহিত্যের বইয়ে ‘বিদ্রোহী’র মতো গুরুত্বপূর্ণ কবিতা কেন সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশ করা হলো, তা ভাবনার দাবি রাখে। আর কবিতাটি যেভাবে বইয়ে মুদ্রিত রয়েছে, তাতে কবিতার মাত্রা-তাল-লয় ও ছন্দবোধ অনেকখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতিপর্ব, স্তবকবিন্যাস—এই বিষয়গুলো নেই হয়ে গেছে। আর সংক্ষিপ্তকরণের নামে যা যা ছেঁটে ফেলা হয়েছে, তা আরও ভাবিয়ে তোলে। আমরা সবাই জানি, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নজরুলের ‘আমিত্ব’বোধের জাগরণের আগ্নেয়গিরিসম সৃষ্টি। এখানে যে বিদ্রোহ উপস্থিত আছে, তার রূপ নানামাত্রিক ও বহুকৌণিক। এই বিদ্রোহ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ; অশুভ শক্তি, জড়তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং উপনিবেশ-শৃঙ্খলিত শোষিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তি-আকাঙ্ক্ষায় নজরুলের এই বিদ্রোহ। নজরুল তাঁর বিদ্রোহের স্বরূপ প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি নিজের ধর্মগত ঐতিহ্য ও জাতিগত সংস্কৃতি দুই জায়গা থেকেই উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। সে কারণে তাঁর পুরাণ-চেতনায় ঘটে পশ্চিম এশীয় ও ভারতীয় চেতনার দারুণ মিথস্ক্রিয়া; অনেকে দুই প্রবণতাকে মুসলিম ঐতিহ্য ও হিন্দু ঐতিহ্য বলেও চিহ্নিত করে থাকে। কিন্তু আমরা যখন পাঠ্যবইয়ের ‘বিদ্রোহী’ পড়ি, তখন কিছু প্রসঙ্গের সচেতন অবলুপ্তি নজরুলের স্বরূপ চিনতে বাধাগ্রস্ত করে। যেমন মূল পাঠের সপ্তম-অষ্টম-নবম পঙ্ক্তিতে আছে—‘ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া, /উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রীর’। মূল পাঠেই ‘আরশ’ শব্দটি যে আক্ষরিক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, তা বোঝাতে একে উদ্ধরণ চিহ্নের (‘’) মধ্যে রাখা হয়েছে। আর এই ‘খোদার আরশ’ যে ঔপনিবেশিক শক্তির ক্ষমতাকেন্দ্র, আক্ষরিক ইসলাম ধর্মের আল্লাহর আরশ নয়, তা নজরুল-সমকালেই সাহিত্যপাঠকেরা শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। অথচ পাঠ্যবইয়ে সেই পঙ্ক্তি বাদ পড়ে গেল। ‘বিদ্রোহী’ অগ্নিবীণার শতবর্ষে এসে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হতে হয় এক আপসী পরিস্থিতির। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে আরও একটি পঙ্ক্তি বাদ হয়ে গেছে—‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন!’ এটিও আজ কারোর অজানা নয় যে, এই ভগবান ব্রিটিশ শোষকেরই রূপক। সবাই জানলেও রাষ্ট্র ঝুঁকি নিতে চায় না। আর তাই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পাঠ্যবইয়ে জায়গা পেলেও নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার পূর্ণরূপ অনেকটাই অধরা থেকে যায়। হয়তো রাষ্ট্র এমন এক বিদ্রোহী নজরুলকে পরিচিত করাতে চায় যে ‘সীমিত মাত্রার বিদ্রোহী’, সে চায় না কোনো বিপ্লবীকেও। রাষ্ট্র তার পূর্বসূরি বিপ্লবীদের ইতিহাসের আবদ্ধ মলাটের মধ্যে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বাংলা সাহিত্যে নজরুলই সম্পূর্ণত অসাম্প্রদায়িক ও আপসহীন কবি। কিন্তু রাষ্ট্রের চোখে আমরা যে নজরুলকে পাঠ করি, তার স্বরূপটিও অনেকখানি রাষ্ট্রসাপেক্ষ থেকে যায়। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের মনস্তত্ত্ব ও চারিত্র্যও টের পাওয়া যায়। এটি নতুন কোনো বিষয় নয়। পাকিস্তান পর্বে নজরুলের কবিতায় ‘সজীব করিব মহাশ্মশান’-এর বদলে ‘সজীব করিব গোরস্থান’-এর বহুল প্রচলন, শ্যামাসংগীত নিষিদ্ধকরণ, কেবল হামদ-নাত পরিবেশন—এসবও রাষ্ট্রকৃত বিষয়ই ছিল। তার বিপরীতে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামের ফসলই আমাদের বর্তমানের বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তককে হতে হবে অসংকোচ, দ্বিধাহীন ও প্রাগ্রসর। সেই সঙ্গে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে নজরুলপাঠ ও রাষ্ট্রের চোখে নজরুল—এই দুইয়ের মধ্যে থাকবে না কোনো নীতিগত বিপ্রতীপতা—এ-ই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) কেন বড় কবি, সেটি এখন আর কোনো অমীমাংসিত বিষয় নয়। বাংলা কবিতার ইতিহাসে শুধু নয়, বাংলা জনাঞ্চলের আর্থরাজনৈতিক পটভূমিতেও কাজী নজরুলের একটি স্বতন্ত্র অবস্থান আছে। সেই পরম্পরায় নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে ভূষিত হয়েছেন এবং মৃত্যুর পর তাঁর সমাধি এই বাংলাদেশের মাটিতেই সংরক্ষিত আছে। ফলে বাংলাদেশে নজরুল-বিচার কেবল সাহিত্য-শিল্প-নন্দনের মাপকাঠি দিয়ে চলে না এবং সেটা হয়ওনি। এর সঙ্গে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে থাকে বাংলাদেশের জাতীয় চেতনা এবং জাতীয় চেতনার রূপান্তর। নজরুল তো সেই ১৯৪২ সালেই নির্বাক হয়ে যান। এর আগে সবাক নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, খেলাফত আন্দোলন, স্বরাজসহ প্রায় প্রতিটি জাতীয় আন্দোলনে সক্রিয় থেকেছেন এবং নিজের অবস্থান অকুণ্ঠভাবেই প্রকাশ করেছেন স্লোগানে, গানে, কবিতায়, কথাসাহিত্যে—সর্বত্র। বেঁচে থাকার পুরোটা সময় চেতনশীল থাকলে নিশ্চয়ই চল্লিশের দশকের দ্বিজাতিতত্ত্ব-ভিত্তিক পাকিস্তান আন্দোলন, ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা, বিভাগ-পরবর্তী ভারত ও পাকিস্তানের রাজনীতি এবং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে তিনি তাঁর অবস্থানের জানান দিতেন। তিনি সেই সুযোগ পাননি। কিন্তু পাঠক-অনুরাগীদের কাছে নজরুল যেমন নানা মাত্রিক ইতিবাচকতার মধ্য দিয়ে, বিপ্লবী চেতনার মধ্য দিয়ে গৃহীত হয়েছেন, তেমনি বিভিন্ন আমলের শাসকগোষ্ঠীও নানাভাবে নজরুলকে বিবেচনায় এনেছে। বিশেষত পাকিস্তান-পর্বের আইয়ুবি কালো দশকে নজরুলের কবিতা ও গানে নানা ধরনের কাটাছেঁড়া ও শব্দ পুনঃস্থাপনের যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তা থেকে নজরুলপাঠে রাজনীতি সাপেক্ষতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একাত্তর-পরবর্তীকালে নজরুলকে ঢাকায় নিয়ে আসা, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া, জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা দেওয়া, তাঁকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করা—একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, নজরুল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা—এ সবই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও বিবেচনার ফলাফল। ফলে নজরুলসাহিত্যের চর্চা, তার প্রসার এবং জাতীয় জীবনে নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা অনুসন্ধান ইত্যাদি বিষয়-আশয় রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে। বাংলাদেশ একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত। তাই রাষ্ট্রীয় বিষয়গুলো এখানে জাতীয় বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। রাষ্ট্রের নানান গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের মধ্যে তাঁর শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কারণ রাষ্ট্র তার ভবিষ্যৎ নাগরিকদের কীভাবে গড়ে নিতে চায়, তার অনেকখানি এই বিষয়ের ওপর নির্ভর করে এবং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। যেকোনো রাষ্ট্রের ইতিহাসপাঠের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পাঠ্যপুস্তকের স্বরূপ ও রূপান্তর অন্বেষণের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। সেই বিবেচনায় রাষ্ট্র কীভাবে নজরুলকে, অর্থাৎ তার জাতীয় কবিকে পেতে চায়, তা জানার জন্য পাঠ্যপুস্তকে নজরুল কীভাবে আছেন সেটি বুঝে নেওয়া জরুরি।
কাজী নজরুল এক অর্থে সব্যসাচী লেখক। গান-কবিতা-ছড়া-উপন্যাস-গল্প-প্রবন্ধ-পত্র-অভিভাষণ—সবই লিখেছেন। এসব রচনার মধ্যে নজরুলের সমকালের অভিঘাত আছে, আছে শিল্পসৃজনের বহুস্তরিক কলাকৌশল, তত্ত্ব ও মতবাদের ঘনিষ্ঠতা। তেমনি বর্তমানে দাঁড়িয়ে শতবর্ষকাল আগের নজরুলকে দেখার মধ্য দিয়ে বর্তমানের চোখটিও যুক্ত হয়ে যায় অনিবার্যভাবে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পাঠ্যপুস্তককে যে চোখ দিয়ে পাঠ করানো হয়, তা কেবল ব্যক্তি অথবা সমষ্টির থাকে না; সেটি মূলত রাষ্ট্রেরই চোখ হয়ে ওঠে। অন্য যেকোনো পাঠের মতো নজরুলপাঠও তাই কেবল অতীতের বিষয় হয়ে থাকে না। স্বাধীন বাংলাদেশের আগে-পরে নজরুল ও নজরুলসাহিত্য পাঠ্যতালিকায় সব সময়ই কমবেশি ছিল। শিল্পের তাত্ত্বিকদের কাছে নজরুল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাত্রায় গৃহীত হয়েছেন—কখনো কম, কখনো বেশি; কখনো শুরু, কখনো গুরু। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে শিশু থেকে তরুণ সবাই নজরুলসাহিত্যের কিছু দিক সম্পর্কে অবহিত থেকেছে। ফলে বাংলাদেশের সাক্ষর-শিক্ষিতদের চেতনাস্রোতে নজরুলের অবস্থান বেশ স্থায়ী। কিন্তু নজরুলপাঠ তো বড় বিষয়; পাঠ্যপুস্তকে নজরুলের সব সৃজনকর্ম অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভবও নয়। তাই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে নজরুল কীভাবে, কোন দৃষ্টিকোণ থেকে এবং কত পরিমাণে উপস্থিত থাকছেন, তা জানার মধ্য দিয়ে জাতীয়ভাবে নজরুলের একটি প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ পাঠ গ্রহণ করা যায়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বহুধারায় বিভক্ত, সেগুলো নিয়ে আছে নানা বিতর্ক—বর্তমান আলোচনার ক্ষেত্র সেটা নয়। এখানে কেবল বাংলাদেশের পুস্তক প্রণয়নসংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রণীত বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে নজরুলরচনার পরিচয় ও সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ের কার্যকারণ বোঝার চেষ্টা করা হবে। ২০২২ সালে প্রণীত পাঠ্যপুস্তকই বর্তমান আলোচনার উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে। এর মধ্য দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চোখ ও নজরুলচেতনার মধ্যে একটি দৃষ্টিভঙ্গিগত সাদৃশ্য, বৈচিত্র্য ও বিপ্রতীপতা অনুধাবন করা সম্ভব হবে।
প্রথম থেকে দ্বাদশ—এই বারোটি শ্রেণির আবশ্যিক হিসেবে বাংলা বিষয়ের বই প্রণয়ন করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড নামক প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি শ্রেণির বাংলা বইয়ে নজরুলকৃত সাহিত্যকর্মকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়, অর্থাৎ প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ের নাম অভিন্ন—‘আমার বাংলা বই’। প্রথম শ্রেণির বইয়ে আছে কাজী নজরুলের ‘ঝিঙে ফুল’ (১৯২৬) কাব্যগ্রন্থভুক্ত জনপ্রিয় শিশুতোষ ছড়া ‘প্রভাতী’র কিছু অংশ; অর্থাৎ সবার পরিচিত ‘ভোর হলো/দোর খোল/খুকুমণি ওঠরে!’ যদিও পাঠ্যবইয়ে কবিতার নামকরণ করা হয়েছে ‘ভোর হলো’। হয়তো প্রথম শ্রেণির শিশু শিক্ষার্থীদের ‘প্রভাতী’র র-ফলা পাঠের জটিলতা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা। দ্বিতীয় শ্রেণির বইয়ে আছে ‘আমি হব সকাল বেলার পাখি। সবার আগে কুসুমবাগে উঠব আমি ডাকি।’ এর নামকরণ করা হয়েছে ‘আমি হব’। এটি মূলত নজরুলের ‘সাত ভাই চম্পা’র প্রথম অংশ। তৃতীয় শ্রেণিতে আছে বিখ্যাত রণসংগীত হিসেবে পরিচিত ‘সন্ধ্যা’ (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থের ‘নতুনের গান’ কবিতার প্রথম অংশ: ‘চল্ চল্ চল্’। চতুর্থ শ্রেণির বইয়ে আছে ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থভুক্ত ‘মা’ কবিতা: ‘যেখানেতে দেখি যাহা/মা-এর মতন আহা/একটি কথায় এত সুধা মেশে নাই...’। পঞ্চম শ্রেণিতে নজরুলের ‘সংকল্প’ কবিতা (অগ্রন্থিত) অর্থাৎ ‘থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,’ কবিতার সংক্ষেপিত রূপ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা বই ‘চারুপাঠ’-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে আরও একটি বহুল পঠিত ছড়া-কবিতা ‘ঝিঙে ফুল’। সপ্তম শ্রেণির ‘সপ্তবর্ণা’য় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সাম্যবাদী (১৯২৫) কাব্যগ্রন্থভুক্ত ‘কুলি-মজুর’ কবিতার সংক্ষেপিত রূপ। সপ্তম শ্রেণির ‘আনন্দপাঠ’ (দ্রুতপঠন) নামক বইয়ে নজরুলের ‘জাগো সুন্দর’ নামক নাটিকা আছে; যদিও এর মূল নাম ‘জাগো সুন্দর চিরকিশোর’। অষ্টম শ্রেণির ‘সাহিত্য কণিকা’ বইয়ে কাজী নজরুলের দুটি রচনা স্থান পেয়েছে: একটি প্রবন্ধ ‘ভাব ও কাজ’ (যুগবাণী), অপরটি কবিতা ‘নারী’ (সাম্যবাদী)। নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য প্রণীত ‘বাংলা সাহিত্য’ বইয়ে নজরুলের তিনটি রচনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে: প্রবন্ধ ‘উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন’ (যুগবাণী), কবিতা ‘দোলন-চাঁপা’ (১৯২৩) কাব্যগ্রন্থভুক্ত ‘আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’ এবং কবিতা ‘মানুষ’ (সাম্যবাদী); এগুলোর মধ্যে শিক্ষার্থীদের যেকোনো দুটি পাঠ্য। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ‘সাহিত্যপাঠ’ বইয়েও তিনটি নজরুলরচনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে: একটি প্রবন্ধ ‘রুদ্রমঙ্গল’ (১৯২৭) গ্রন্থভুক্ত ‘আমার পথ’ এবং দুটি কবিতা ‘অগ্নি-বীণা’ (১৯২২) কাব্যগ্রন্থভুক্ত ‘বিদ্রোহী’ ও ‘সাম্যবাদী’। এ ছাড়া চতুর্থ শ্রেণির ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইয়ে কাজী নজরুল রচিত ‘শোন শোন ইয়া ইলাহী আমার মোনাজাত’ সূচক ‘হামদে ইলাহী’ সংযোজিত হয়েছে।
আগেই বলা হয়েছে, নজরুলের রচনাসম্ভার আয়তনে অনেক বড়। নজরুলরচনার কী কী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তার তালিকা হবে অসীমের মতো দীর্ঘ। কী কী রাখা যেত, সেটাও অনেকখানি আপেক্ষিক। তাই নজরুলকৃত যেসব রচনা পাঠ্যপুস্তকভুক্ত হয়েছে, সেসব কী রূপে ও কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সেটাই এই আলোচনায় মুখ্যতা পাবে। নজরুলের সাহিত্যকর্ম যে সব পর্যায়ে পাঠ্যভুক্ত আছে, এ থেকে বোঝা যায়, রাষ্ট্র নজরুলকে পাঠ করতে আগ্রহী। প্রাথমিক শ্রেণি পর্যায়ে নজরুলের যেসব ছড়া ও কবিতাজাতীয় রচনা পাঠ্যভুক্ত হয়েছে, সেসবের পাঠ সহৃদয়তা তৈরি, ছন্দ ও শ্রুতিমাধুর্য, ভাষার বর্ণ-শব্দ-উচ্চারণে সাবলীলতা সম্পর্কে শিশুদের পরিচিতকরণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। প্রকৃতিচেতনা, কর্তব্যবোধ, মাতৃভক্তি, জ্ঞানের প্রতি কৌতূহল—এই বিষয়গুলোও ওইজাতীয় রচনার সঙ্গে জড়িত। মাধ্যমিক শ্রেণিতে কবিতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রবন্ধ। নজরুলের সাংগীতিক কাব্যবোধের সঙ্গে মনন ও চিন্তার যুক্তিশৃঙ্খলা সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা অবহিত হয় প্রবন্ধপাঠের মাধ্যমে। এই পর্বে নজরুলের বেশির ভাগ প্রবন্ধ গ্রহণ করা হয়েছে যুগবাণী (১৯২২) প্রবন্ধগ্রন্থ থেকে। যুগবাণীর বেশির ভাগ প্রবন্ধ ‘দৈনিক নবযুগ’ (১৯২০) পত্রিকার সম্পাদকীয় হিসেবে রচিত হয়েছিল। পুরো প্রবন্ধগ্রন্থে তৎকালের অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের উত্তাপ এবং নজরুলের বিপ্লবী অবস্থান অনুধাবন করা যায়। ‘উগ্র জাতীয়তাবাদ’ ছড়ানোর অভিযোগে যুগবাণী একসময় ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধঘোষিত হয় (১৯২২)। যদিও পাঠ্যপুস্তকে বিপ্লবাত্মক কোনো প্রবন্ধ নির্বাচন করা হয়নি। মানুষকে কর্মমুখী করে তোলা, তার সদর্থক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো এবং সেই সূত্রে নজরুলের কর্মমুখরতা সম্পর্কে জানানোর জন্য প্রবন্ধগুলো নির্বাচন করা হয়ে থাকতে পারে। কবিতার ক্ষেত্রে নজরুলের নিজস্ব ধাঁচের সাম্যবাদী চিন্তা, মানবমুখিতা, শোষণহীন সমাজ, লিঙ্গসমতা, বৈষম্যমুক্তি গুরুত্ব পেয়েছে। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে, অর্থাৎ সাধারণ বাংলা শিক্ষা গ্রহণের সর্বোচ্চ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে নজরুলের যুগচিহ্নিত কবিতা ‘বিদ্রোহী’; পুরোটা নয়, সংক্ষেপিত। পাঠ্যপুস্তকে অনেক সময় বড় রচনাকে সংক্ষেপিত ও পরিমার্জনা করা হয় মূলত শিক্ষার্থীদের পঠনপরিধি, বয়সের সঙ্গে সংগতি রক্ষা এবং আধুনিক বানান সমন্বয়ের বিষয় বিবেচনায় রেখে। একই বিবেচনায় হয়তো প্রাথমিক শ্রেণি পর্যায়ে কিছু কবিতার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। যদিও কবিতার মূল নাম জানাটাও শিক্ষার একটি অংশ। কিন্তু একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির মতো পরিণত পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রণীত বাংলা সাহিত্যের বইয়ে ‘বিদ্রোহী’র মতো গুরুত্বপূর্ণ কবিতা কেন সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশ করা হলো, তা ভাবনার দাবি রাখে। আর কবিতাটি যেভাবে বইয়ে মুদ্রিত রয়েছে, তাতে কবিতার মাত্রা-তাল-লয় ও ছন্দবোধ অনেকখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতিপর্ব, স্তবকবিন্যাস—এই বিষয়গুলো নেই হয়ে গেছে। আর সংক্ষিপ্তকরণের নামে যা যা ছেঁটে ফেলা হয়েছে, তা আরও ভাবিয়ে তোলে। আমরা সবাই জানি, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নজরুলের ‘আমিত্ব’বোধের জাগরণের আগ্নেয়গিরিসম সৃষ্টি। এখানে যে বিদ্রোহ উপস্থিত আছে, তার রূপ নানামাত্রিক ও বহুকৌণিক। এই বিদ্রোহ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ; অশুভ শক্তি, জড়তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং উপনিবেশ-শৃঙ্খলিত শোষিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তি-আকাঙ্ক্ষায় নজরুলের এই বিদ্রোহ। নজরুল তাঁর বিদ্রোহের স্বরূপ প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি নিজের ধর্মগত ঐতিহ্য ও জাতিগত সংস্কৃতি দুই জায়গা থেকেই উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। সে কারণে তাঁর পুরাণ-চেতনায় ঘটে পশ্চিম এশীয় ও ভারতীয় চেতনার দারুণ মিথস্ক্রিয়া; অনেকে দুই প্রবণতাকে মুসলিম ঐতিহ্য ও হিন্দু ঐতিহ্য বলেও চিহ্নিত করে থাকে। কিন্তু আমরা যখন পাঠ্যবইয়ের ‘বিদ্রোহী’ পড়ি, তখন কিছু প্রসঙ্গের সচেতন অবলুপ্তি নজরুলের স্বরূপ চিনতে বাধাগ্রস্ত করে। যেমন মূল পাঠের সপ্তম-অষ্টম-নবম পঙ্ক্তিতে আছে—‘ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া, /উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রীর’। মূল পাঠেই ‘আরশ’ শব্দটি যে আক্ষরিক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, তা বোঝাতে একে উদ্ধরণ চিহ্নের (‘’) মধ্যে রাখা হয়েছে। আর এই ‘খোদার আরশ’ যে ঔপনিবেশিক শক্তির ক্ষমতাকেন্দ্র, আক্ষরিক ইসলাম ধর্মের আল্লাহর আরশ নয়, তা নজরুল-সমকালেই সাহিত্যপাঠকেরা শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। অথচ পাঠ্যবইয়ে সেই পঙ্ক্তি বাদ পড়ে গেল। ‘বিদ্রোহী’ অগ্নিবীণার শতবর্ষে এসে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হতে হয় এক আপসী পরিস্থিতির। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে আরও একটি পঙ্ক্তি বাদ হয়ে গেছে—‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন!’ এটিও আজ কারোর অজানা নয় যে, এই ভগবান ব্রিটিশ শোষকেরই রূপক। সবাই জানলেও রাষ্ট্র ঝুঁকি নিতে চায় না। আর তাই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পাঠ্যবইয়ে জায়গা পেলেও নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার পূর্ণরূপ অনেকটাই অধরা থেকে যায়। হয়তো রাষ্ট্র এমন এক বিদ্রোহী নজরুলকে পরিচিত করাতে চায় যে ‘সীমিত মাত্রার বিদ্রোহী’, সে চায় না কোনো বিপ্লবীকেও। রাষ্ট্র তার পূর্বসূরি বিপ্লবীদের ইতিহাসের আবদ্ধ মলাটের মধ্যে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বাংলা সাহিত্যে নজরুলই সম্পূর্ণত অসাম্প্রদায়িক ও আপসহীন কবি। কিন্তু রাষ্ট্রের চোখে আমরা যে নজরুলকে পাঠ করি, তার স্বরূপটিও অনেকখানি রাষ্ট্রসাপেক্ষ থেকে যায়। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের মনস্তত্ত্ব ও চারিত্র্যও টের পাওয়া যায়। এটি নতুন কোনো বিষয় নয়। পাকিস্তান পর্বে নজরুলের কবিতায় ‘সজীব করিব মহাশ্মশান’-এর বদলে ‘সজীব করিব গোরস্থান’-এর বহুল প্রচলন, শ্যামাসংগীত নিষিদ্ধকরণ, কেবল হামদ-নাত পরিবেশন—এসবও রাষ্ট্রকৃত বিষয়ই ছিল। তার বিপরীতে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামের ফসলই আমাদের বর্তমানের বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তককে হতে হবে অসংকোচ, দ্বিধাহীন ও প্রাগ্রসর। সেই সঙ্গে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে নজরুলপাঠ ও রাষ্ট্রের চোখে নজরুল—এই দুইয়ের মধ্যে থাকবে না কোনো নীতিগত বিপ্রতীপতা—এ-ই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
চারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
৬ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
১৩ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
১৩ দিন আগেদ্য ভেজিটেরিয়ানের পর হান কাঙের পরের উপন্যাস ছিল ‘দ্য উইন্ড ব্লোজ, গো’। এই উপন্যাস লেখার সময়ই ঘটে বিপত্তি! হান অনুভব করেন তিনি আর লিখতে পারছেন না। গত বছর নিজের পঞ্চম উপন্যাস ‘গ্রিক লেসন’ ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হলে স্পেনের এল-পাইস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি।
১০ অক্টোবর ২০২৪