রাজীব সরকার
নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত জার্মান লেখক হেরমান হেসের উপন্যাস ‘সিদ্ধার্থ’ ১৯২২ সালে প্রকাশলগ্নেই অসামান্য খ্যাতি অর্জন করে। পরবর্তী এক শ বছরে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম ধ্রুপদি সম্পদ হয়ে উঠেছে এটি। হেসের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম রয়েছে। কথাসাহিত্য, কবিতা রচনার পাশাপাশি চিত্রকর হিসেবেও তিনি খ্যাতিমান ছিলেন। তবে তাঁর জগৎজোড়া বিস্তৃত খ্যাতির প্রধান উৎস ‘সিদ্ধার্থ’।
উপন্যাসের কাহিনি শুরু হয়েছে তরুণ ব্রাহ্মণ সিদ্ধার্থের অনুসন্ধিৎসু মনের পরিচয় দিয়ে। গোবিন্দ তাঁর অন্তরঙ্গ সহচর। সিদ্ধার্থের মেধা, পরিচ্ছন্ন চিন্তা, দৃঢ় সংকল্প ও জীবনের মহৎ লক্ষ্য গোবিন্দকে মুগ্ধ করে। তাঁর নিষ্ঠা ও জ্ঞানতৃষ্ণা দেখে পিতা স্বপ্ন দেখেন, ছেলে একদিন অসাধারণ পণ্ডিত ও শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ হবেন। সুদর্শন সিদ্ধার্থের সুকুমার কান্তি ও পরিশীলিত চলাফেরা দেখে মায়ের মন গর্বে ভরে ওঠে। তাঁর উন্নত ললাট, রাজোচিত চোখ, আকর্ষণীয় শারীরিক গঠন তরুণীদের হৃদয়ে প্রেমের ঢেউ জাগায়। কিন্তু সিদ্ধার্থের মনে শান্তি নেই। এক অতৃপ্তির বীজ তিনি বহন করে চলেছেন।
সিদ্ধার্থ লক্ষ করেছেন, পুরুষানুক্রমে ব্রাহ্মণেরা বিপুল পরিমাণ জ্ঞান সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছেন। কিন্তু কোথায় সেই ব্রাহ্মণ, পুরোহিত ও পণ্ডিত, যাঁরা শুধু বইয়ের পৃষ্ঠায় সুগভীর জ্ঞানরাশি সঞ্চয় করেননি, জীবনেও তাদের উপলব্ধি করেছেন? তাঁর পিতা ধর্মপরায়ণ ও বিদ্বান। সূক্ষ্ম ও মহৎ চিন্তায় তাঁর মস্তিষ্ক পূর্ণ। এত জেনেও কি তিনি অতৃপ্ত তত্ত্বানুসন্ধানী নন? এসব প্রশ্ন প্রতিনিয়ত সিদ্ধার্থকে উদ্বেলিত করে। তাঁর মনে হয় নিজের গভীর সত্তার মধ্যেই তো সবকিছুর মূল কারণ রয়েছে। তাঁকে জানতে হবে, আয়ত্ত করতে হবে। অন্তহীন জীবন জিজ্ঞাসার একপর্যায়ে সিদ্ধার্থ সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। শুরুতে পিতা অমত করলেও পরে তিনি সম্মতি দেন। গোবিন্দ সিদ্ধার্থের অনুগামী হয়।
সন্ন্যাসীদের সান্নিধ্যে তিন বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর দুই বন্ধু জানতে পারেন গৌতম বুদ্ধ নামে একজন মহাত্মার আবির্ভাব ঘটেছে। তিনি জয় করেছেন জীবনের সব দুঃখ এবং রুদ্ধ করে দিয়েছেন জীবন-মৃত্যুর চক্রাকার গতি। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেয় সন্ন্যাসীদের সঙ্গ ছেড়ে বুদ্ধের সান্নিধ্য লাভ করার। গৌতম বুদ্ধের সান্নিধ্যে কিছুদিন কাটানোর পর গোবিন্দ বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু সিদ্ধার্থ গ্রহণ করে ভিন্ন সিদ্ধান্ত। বুদ্ধের মহত্ত্ব এবং কীর্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া সত্ত্বেও তিনি যেতে চান নতুন কোনো তীর্থে। গোবিন্দ চিরকাল সিদ্ধার্থকে অনুসরণ করে এসেছেন। এই প্রথম তাঁরা বিচ্ছিন্ন হলেন। গোবিন্দ নিজের পথ খুঁজে নেওয়ায় সিদ্ধার্থ খুশি হন। অশ্রুসিক্ত হয়ে তাঁর কাছ থেকে গোবিন্দ বিদায় নেন। নিজের অতৃপ্ত জিজ্ঞাসাকে বুদ্ধের কাছে উপস্থাপন করে সংশয়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন সিদ্ধার্থ। যেহেতু বুদ্ধের ধর্মশিক্ষাই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারেনি, তাই অন্য কারও ধর্মোপদেশও তা পারবে না। বুদ্ধের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নত হয়ে সিদ্ধার্থ অনুভব করেন, ‘বুদ্ধ আমার সব কেড়ে নিয়েছেন। কিন্তু আমার সবকিছু হরণ করেও ফিরিয়ে দিয়েছেন তার চেয়ে মূল্যবান জিনিস। তিনি অপহরণ করেছেন আমার বন্ধুকে। গোবিন্দের আস্থা ছিল আমার ওপর, সে এখন নির্ভর করবে বুদ্ধের ওপর। একদিন গোবিন্দ ছিল আমার ছায়া, সে এখন হয়েছে গৌতমের ছায়া। কিন্তু তিনি আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন সিদ্ধার্থকে, আমাকে।’
বুদ্ধের মতো মহাত্মা ও শ্রেষ্ঠ পুণ্যাত্মাকেও সিদ্ধার্থ গুরু হিসেবে গ্রহণ করতে পারেননি। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিনিয়ত জানতে তৎপর হয় সিদ্ধার্থ। আত্মাকে, ব্রহ্মকে খুঁজতে গিয়ে নিজের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি, অগ্রাহ্য করেছেন নিজের অস্তিত্বকে। দৃশ্যমান জগৎকে মায়া বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। এই ভ্রান্তির নাগপাশ মোচন করে সিদ্ধার্থ জেগে ওঠেন। নবজন্ম হয় তাঁর। বুদ্ধের অন্যতম বাণী ছিল, ‘আত্মদীপো ভব’, অর্থাৎ নিজেই নিজের প্রদীপ হও। বুদ্ধের প্রত্যক্ষ শিষ্যত্ব গ্রহণ না করলেও এই বাণীই যেন পরিচালিত করেছেন সিদ্ধার্থকে। সন্ন্যাসী, পুরোহিত, ব্রাহ্মণ—কোনো পরিচয়েই আর নিজেকে খুঁজে পান না তিনি। তাঁর লক্ষ্য শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়া। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, অন্যের উপদেশ থেকে কিছু শেখা যায় না। নিজের জীবন ক্ষয় করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। নিজের পথের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন সিদ্ধার্থ।
নদী পার হতে গিয়ে মাঝি বাসুদেবের সঙ্গে পরিচয় হয় সিদ্ধার্থের। তাঁর কাছে নদীর অসামান্য তাৎপর্য সম্বন্ধে শিক্ষালাভ করেন তিনি। নদী পার হয়ে সন্ধ্যায় নগরে উপস্থিত হন। নগরে ঢুকেই সুপরিচিতা বীরাঙ্গনা কমলার মুখোমুখি হন তিনি। লাস্যময়ী কমলার অপূর্ব দেহসৌন্দর্য সিদ্ধার্থকে আকৃষ্ট করে। তাকে নিজের গুরু হিসেবে গ্রহণ করতে চান সিদ্ধার্থ। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কমলাকে নিজের তিনটি গুণের কথা বলেন—ধ্যান, অপেক্ষা ও ধৈর্য। অসাধারণ আবৃত্তির বিনিময়ে কমলা তাঁকে চুম্বনসিক্ত করে। কমলার উদ্যোগে বণিক কামস্বামীর কাছে কাজের অভিজ্ঞতা লাভ করেন সিদ্ধার্থ। এভাবে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে বাস্তবতার সম্মুখীন হন। কামকলানিপুণা কমলার সান্নিধ্যে সিদ্ধার্থ যৌন ক্রীড়ায় নৈপুণ্য অর্জন করেন। তাঁদের মিলনে একসময়ে কমলা সন্তানসম্ভবা হয়। এই সংবাদ জানার আগেই সিদ্ধার্থ কামিনী কাঞ্চনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে কমলার রমণীয় উদ্যান ত্যাগ করেন।
পথ চলতে চলতে সিদ্ধার্থ আবার এসে দাঁড়ান সেই সুন্দর নদীতীরে। একদিন এই নদী পার হয়ে নগরে পৌঁছেছিলেন তিনি। পুরোনো মাঝি বাসুদেবের সাক্ষাৎ পান। তাঁর কুটিরে রাত কাটিয়ে মাঝিকে নিজের জীবনের গল্প বলেন সিদ্ধার্থ। নদীর তীরে বছরের পর বছর কেটে যায় সিদ্ধার্থ ও বাসুদেবের। একসময় খবর এল ভগবান বুদ্ধ শয্যাশায়ী, তাঁর মহানির্বাণ লাভ আসন্ন।
দলে দলে পুণ্যার্থী, ভক্ত ও শিষ্যরা ছুটে আসে শেষবারের মতো তাঁকে দেখার আশায়। মাঝি তাঁদের নৌকায় পারাপার করে। এককালের প্রসিদ্ধ বীরাঙ্গনা কমলা তার সব ঐশ্বর্য ও উদ্যান দান করেছে বুদ্ধের শিষ্যদের সেবার জন্য। সে নিজেও বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। বুদ্ধের দেহত্যাগ আসন্ন জেনে সে-ও পৌঁছে যায় নদীতীরে একমাত্র পুত্রের হাত ধরে। সাপের কামড়ে আহত হয় কমলা। ঘটনাচক্রে তার সেবায় এগিয়ে আসেন বাসুদেব ও সিদ্ধার্থ। কমলা ও নিজের পুত্রকে চিনতে পারেন সিদ্ধার্থ। শেষ মিলনের ক্ষণে কমলা ও সিদ্ধার্থের কথোপকথনের ভাষা হৃদয়স্পর্শী। বুদ্ধের দেখা না পাওয়ার অতৃপ্তি ঘুচে যায় সিদ্ধার্থকে দেখে। কমলার জীবনদীপ নির্বাপিত হয়।
পুত্রকে কাছে পেয়ে সিদ্ধার্থ নিজেকে সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি বলে অনুভব করে কিন্তু অচিরেই তাঁর ভুল ভাঙে। পুত্র মায়ের বিলাসী জীবনধারায় বড় হয়েছে। সিদ্ধার্থের দরিদ্র কুটিরে কষ্টকর জীবনের সঙ্গে সে খাপ খাওয়াতে পারে না। সিদ্ধার্থ সর্বোচ্চ ধৈর্য ও নিষ্ঠার পরিচয় দেন পুত্রের হৃদয় জয় করার জন্য। কিন্তু পুত্রের ঔদ্ধত্য ও পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বাড়তেই থাকে। একদিন ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সিদ্ধার্থের উদ্দেশে পুত্র বলে, ‘তুমি আমার মায়ের প্রেমিক হলেও তোমাকে আমি পিতা বলে স্বীকার করি না, তোমাকে ঘৃণা করি।’ কুটির থেকে পালিয়ে যায় পুত্র।
নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ সিদ্ধার্থ জীবনের শেষ পর্বে আবারও মুখোমুখি হন গোবিন্দের। দুই অকৃত্রিম বন্ধু নিজেদের অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষা বিনিময় করেন পরস্পরের সঙ্গে। মাঝি বাসুদেব ও নদীকে নিজের শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করেন সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থ নিঃসংকোচে বলেন, ‘গোবিন্দ, আমার মনে হয় ভালোবাসা সংসারের সবচেয়ে বড় জিনিস। বড় বড় দার্শনিক পৃথিবীকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে পারেন, সংসার-কর্মকাণ্ডের চমৎকার ব্যাখ্যা দিতে পারেন, ত্রিশটি বিচ্যুতির জন্য পৃথিবীকে ঘৃণাও করতে পারেন, কিন্তু আমাদের পক্ষে সবচেয়ে বড় কথা, এই পৃথিবীকে ভালোবাসা, তাকে ঘৃণা করা নয়। আমরা পরস্পরকে ভালোবাসব, এখানকার প্রতিটি প্রাণী ও বস্তুকে ভালোবাসব, সম্মান করব, শ্রদ্ধা করব এই সৃষ্টির সঙ্গে একাত্ম হয়ে।’ সিদ্ধার্থের অনন্ত জীবনতৃষ্ণা এভাবেই তৃপ্ত হয়। প্রকৃতি ও সৃষ্টিজগতের প্রতি ভালোবাসাই মোক্ষলাভের শ্রেষ্ঠ উপায়। সন্দেহ নেই, সিদ্ধার্থের এই শিক্ষা লেখক হেরমান হেসেরও জীবনদর্শন।
নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত জার্মান লেখক হেরমান হেসের উপন্যাস ‘সিদ্ধার্থ’ ১৯২২ সালে প্রকাশলগ্নেই অসামান্য খ্যাতি অর্জন করে। পরবর্তী এক শ বছরে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম ধ্রুপদি সম্পদ হয়ে উঠেছে এটি। হেসের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম রয়েছে। কথাসাহিত্য, কবিতা রচনার পাশাপাশি চিত্রকর হিসেবেও তিনি খ্যাতিমান ছিলেন। তবে তাঁর জগৎজোড়া বিস্তৃত খ্যাতির প্রধান উৎস ‘সিদ্ধার্থ’।
উপন্যাসের কাহিনি শুরু হয়েছে তরুণ ব্রাহ্মণ সিদ্ধার্থের অনুসন্ধিৎসু মনের পরিচয় দিয়ে। গোবিন্দ তাঁর অন্তরঙ্গ সহচর। সিদ্ধার্থের মেধা, পরিচ্ছন্ন চিন্তা, দৃঢ় সংকল্প ও জীবনের মহৎ লক্ষ্য গোবিন্দকে মুগ্ধ করে। তাঁর নিষ্ঠা ও জ্ঞানতৃষ্ণা দেখে পিতা স্বপ্ন দেখেন, ছেলে একদিন অসাধারণ পণ্ডিত ও শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ হবেন। সুদর্শন সিদ্ধার্থের সুকুমার কান্তি ও পরিশীলিত চলাফেরা দেখে মায়ের মন গর্বে ভরে ওঠে। তাঁর উন্নত ললাট, রাজোচিত চোখ, আকর্ষণীয় শারীরিক গঠন তরুণীদের হৃদয়ে প্রেমের ঢেউ জাগায়। কিন্তু সিদ্ধার্থের মনে শান্তি নেই। এক অতৃপ্তির বীজ তিনি বহন করে চলেছেন।
সিদ্ধার্থ লক্ষ করেছেন, পুরুষানুক্রমে ব্রাহ্মণেরা বিপুল পরিমাণ জ্ঞান সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছেন। কিন্তু কোথায় সেই ব্রাহ্মণ, পুরোহিত ও পণ্ডিত, যাঁরা শুধু বইয়ের পৃষ্ঠায় সুগভীর জ্ঞানরাশি সঞ্চয় করেননি, জীবনেও তাদের উপলব্ধি করেছেন? তাঁর পিতা ধর্মপরায়ণ ও বিদ্বান। সূক্ষ্ম ও মহৎ চিন্তায় তাঁর মস্তিষ্ক পূর্ণ। এত জেনেও কি তিনি অতৃপ্ত তত্ত্বানুসন্ধানী নন? এসব প্রশ্ন প্রতিনিয়ত সিদ্ধার্থকে উদ্বেলিত করে। তাঁর মনে হয় নিজের গভীর সত্তার মধ্যেই তো সবকিছুর মূল কারণ রয়েছে। তাঁকে জানতে হবে, আয়ত্ত করতে হবে। অন্তহীন জীবন জিজ্ঞাসার একপর্যায়ে সিদ্ধার্থ সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। শুরুতে পিতা অমত করলেও পরে তিনি সম্মতি দেন। গোবিন্দ সিদ্ধার্থের অনুগামী হয়।
সন্ন্যাসীদের সান্নিধ্যে তিন বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর দুই বন্ধু জানতে পারেন গৌতম বুদ্ধ নামে একজন মহাত্মার আবির্ভাব ঘটেছে। তিনি জয় করেছেন জীবনের সব দুঃখ এবং রুদ্ধ করে দিয়েছেন জীবন-মৃত্যুর চক্রাকার গতি। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেয় সন্ন্যাসীদের সঙ্গ ছেড়ে বুদ্ধের সান্নিধ্য লাভ করার। গৌতম বুদ্ধের সান্নিধ্যে কিছুদিন কাটানোর পর গোবিন্দ বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু সিদ্ধার্থ গ্রহণ করে ভিন্ন সিদ্ধান্ত। বুদ্ধের মহত্ত্ব এবং কীর্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া সত্ত্বেও তিনি যেতে চান নতুন কোনো তীর্থে। গোবিন্দ চিরকাল সিদ্ধার্থকে অনুসরণ করে এসেছেন। এই প্রথম তাঁরা বিচ্ছিন্ন হলেন। গোবিন্দ নিজের পথ খুঁজে নেওয়ায় সিদ্ধার্থ খুশি হন। অশ্রুসিক্ত হয়ে তাঁর কাছ থেকে গোবিন্দ বিদায় নেন। নিজের অতৃপ্ত জিজ্ঞাসাকে বুদ্ধের কাছে উপস্থাপন করে সংশয়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন সিদ্ধার্থ। যেহেতু বুদ্ধের ধর্মশিক্ষাই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারেনি, তাই অন্য কারও ধর্মোপদেশও তা পারবে না। বুদ্ধের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নত হয়ে সিদ্ধার্থ অনুভব করেন, ‘বুদ্ধ আমার সব কেড়ে নিয়েছেন। কিন্তু আমার সবকিছু হরণ করেও ফিরিয়ে দিয়েছেন তার চেয়ে মূল্যবান জিনিস। তিনি অপহরণ করেছেন আমার বন্ধুকে। গোবিন্দের আস্থা ছিল আমার ওপর, সে এখন নির্ভর করবে বুদ্ধের ওপর। একদিন গোবিন্দ ছিল আমার ছায়া, সে এখন হয়েছে গৌতমের ছায়া। কিন্তু তিনি আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন সিদ্ধার্থকে, আমাকে।’
বুদ্ধের মতো মহাত্মা ও শ্রেষ্ঠ পুণ্যাত্মাকেও সিদ্ধার্থ গুরু হিসেবে গ্রহণ করতে পারেননি। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিনিয়ত জানতে তৎপর হয় সিদ্ধার্থ। আত্মাকে, ব্রহ্মকে খুঁজতে গিয়ে নিজের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি, অগ্রাহ্য করেছেন নিজের অস্তিত্বকে। দৃশ্যমান জগৎকে মায়া বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। এই ভ্রান্তির নাগপাশ মোচন করে সিদ্ধার্থ জেগে ওঠেন। নবজন্ম হয় তাঁর। বুদ্ধের অন্যতম বাণী ছিল, ‘আত্মদীপো ভব’, অর্থাৎ নিজেই নিজের প্রদীপ হও। বুদ্ধের প্রত্যক্ষ শিষ্যত্ব গ্রহণ না করলেও এই বাণীই যেন পরিচালিত করেছেন সিদ্ধার্থকে। সন্ন্যাসী, পুরোহিত, ব্রাহ্মণ—কোনো পরিচয়েই আর নিজেকে খুঁজে পান না তিনি। তাঁর লক্ষ্য শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়া। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, অন্যের উপদেশ থেকে কিছু শেখা যায় না। নিজের জীবন ক্ষয় করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। নিজের পথের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন সিদ্ধার্থ।
নদী পার হতে গিয়ে মাঝি বাসুদেবের সঙ্গে পরিচয় হয় সিদ্ধার্থের। তাঁর কাছে নদীর অসামান্য তাৎপর্য সম্বন্ধে শিক্ষালাভ করেন তিনি। নদী পার হয়ে সন্ধ্যায় নগরে উপস্থিত হন। নগরে ঢুকেই সুপরিচিতা বীরাঙ্গনা কমলার মুখোমুখি হন তিনি। লাস্যময়ী কমলার অপূর্ব দেহসৌন্দর্য সিদ্ধার্থকে আকৃষ্ট করে। তাকে নিজের গুরু হিসেবে গ্রহণ করতে চান সিদ্ধার্থ। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কমলাকে নিজের তিনটি গুণের কথা বলেন—ধ্যান, অপেক্ষা ও ধৈর্য। অসাধারণ আবৃত্তির বিনিময়ে কমলা তাঁকে চুম্বনসিক্ত করে। কমলার উদ্যোগে বণিক কামস্বামীর কাছে কাজের অভিজ্ঞতা লাভ করেন সিদ্ধার্থ। এভাবে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে বাস্তবতার সম্মুখীন হন। কামকলানিপুণা কমলার সান্নিধ্যে সিদ্ধার্থ যৌন ক্রীড়ায় নৈপুণ্য অর্জন করেন। তাঁদের মিলনে একসময়ে কমলা সন্তানসম্ভবা হয়। এই সংবাদ জানার আগেই সিদ্ধার্থ কামিনী কাঞ্চনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে কমলার রমণীয় উদ্যান ত্যাগ করেন।
পথ চলতে চলতে সিদ্ধার্থ আবার এসে দাঁড়ান সেই সুন্দর নদীতীরে। একদিন এই নদী পার হয়ে নগরে পৌঁছেছিলেন তিনি। পুরোনো মাঝি বাসুদেবের সাক্ষাৎ পান। তাঁর কুটিরে রাত কাটিয়ে মাঝিকে নিজের জীবনের গল্প বলেন সিদ্ধার্থ। নদীর তীরে বছরের পর বছর কেটে যায় সিদ্ধার্থ ও বাসুদেবের। একসময় খবর এল ভগবান বুদ্ধ শয্যাশায়ী, তাঁর মহানির্বাণ লাভ আসন্ন।
দলে দলে পুণ্যার্থী, ভক্ত ও শিষ্যরা ছুটে আসে শেষবারের মতো তাঁকে দেখার আশায়। মাঝি তাঁদের নৌকায় পারাপার করে। এককালের প্রসিদ্ধ বীরাঙ্গনা কমলা তার সব ঐশ্বর্য ও উদ্যান দান করেছে বুদ্ধের শিষ্যদের সেবার জন্য। সে নিজেও বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। বুদ্ধের দেহত্যাগ আসন্ন জেনে সে-ও পৌঁছে যায় নদীতীরে একমাত্র পুত্রের হাত ধরে। সাপের কামড়ে আহত হয় কমলা। ঘটনাচক্রে তার সেবায় এগিয়ে আসেন বাসুদেব ও সিদ্ধার্থ। কমলা ও নিজের পুত্রকে চিনতে পারেন সিদ্ধার্থ। শেষ মিলনের ক্ষণে কমলা ও সিদ্ধার্থের কথোপকথনের ভাষা হৃদয়স্পর্শী। বুদ্ধের দেখা না পাওয়ার অতৃপ্তি ঘুচে যায় সিদ্ধার্থকে দেখে। কমলার জীবনদীপ নির্বাপিত হয়।
পুত্রকে কাছে পেয়ে সিদ্ধার্থ নিজেকে সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি বলে অনুভব করে কিন্তু অচিরেই তাঁর ভুল ভাঙে। পুত্র মায়ের বিলাসী জীবনধারায় বড় হয়েছে। সিদ্ধার্থের দরিদ্র কুটিরে কষ্টকর জীবনের সঙ্গে সে খাপ খাওয়াতে পারে না। সিদ্ধার্থ সর্বোচ্চ ধৈর্য ও নিষ্ঠার পরিচয় দেন পুত্রের হৃদয় জয় করার জন্য। কিন্তু পুত্রের ঔদ্ধত্য ও পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বাড়তেই থাকে। একদিন ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সিদ্ধার্থের উদ্দেশে পুত্র বলে, ‘তুমি আমার মায়ের প্রেমিক হলেও তোমাকে আমি পিতা বলে স্বীকার করি না, তোমাকে ঘৃণা করি।’ কুটির থেকে পালিয়ে যায় পুত্র।
নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ সিদ্ধার্থ জীবনের শেষ পর্বে আবারও মুখোমুখি হন গোবিন্দের। দুই অকৃত্রিম বন্ধু নিজেদের অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষা বিনিময় করেন পরস্পরের সঙ্গে। মাঝি বাসুদেব ও নদীকে নিজের শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করেন সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থ নিঃসংকোচে বলেন, ‘গোবিন্দ, আমার মনে হয় ভালোবাসা সংসারের সবচেয়ে বড় জিনিস। বড় বড় দার্শনিক পৃথিবীকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে পারেন, সংসার-কর্মকাণ্ডের চমৎকার ব্যাখ্যা দিতে পারেন, ত্রিশটি বিচ্যুতির জন্য পৃথিবীকে ঘৃণাও করতে পারেন, কিন্তু আমাদের পক্ষে সবচেয়ে বড় কথা, এই পৃথিবীকে ভালোবাসা, তাকে ঘৃণা করা নয়। আমরা পরস্পরকে ভালোবাসব, এখানকার প্রতিটি প্রাণী ও বস্তুকে ভালোবাসব, সম্মান করব, শ্রদ্ধা করব এই সৃষ্টির সঙ্গে একাত্ম হয়ে।’ সিদ্ধার্থের অনন্ত জীবনতৃষ্ণা এভাবেই তৃপ্ত হয়। প্রকৃতি ও সৃষ্টিজগতের প্রতি ভালোবাসাই মোক্ষলাভের শ্রেষ্ঠ উপায়। সন্দেহ নেই, সিদ্ধার্থের এই শিক্ষা লেখক হেরমান হেসেরও জীবনদর্শন।
চারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
৬ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
১৩ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
১৩ দিন আগেদ্য ভেজিটেরিয়ানের পর হান কাঙের পরের উপন্যাস ছিল ‘দ্য উইন্ড ব্লোজ, গো’। এই উপন্যাস লেখার সময়ই ঘটে বিপত্তি! হান অনুভব করেন তিনি আর লিখতে পারছেন না। গত বছর নিজের পঞ্চম উপন্যাস ‘গ্রিক লেসন’ ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হলে স্পেনের এল-পাইস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি।
১০ অক্টোবর ২০২৪