বিশ্বজিৎ চৌধুরী
কবি নজরুলের জন্য ১৭ বছর অপেক্ষা করেছিলেন এক নারী। এই একটি তথ্যই কৌতূহলী করে তুলেছিল আমাকে। তাঁর প্রথম প্রেম নার্গিস। মিলনের পূর্ণতা
পায়নি এই প্রেম। সেই হাহাকার উৎকীর্ণ হয়ে আছে তাঁর গানে-কবিতায়।
স্কুলজীবনের শেষ দিকে কিংবা কলেজজীবনের শুরুতে, আজ আর নির্দিষ্ট দিনক্ষণ মনে করতে পারি না, একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একজন আবৃত্তিকারের ভরাট কণ্ঠে নজরুলের একটি চিঠির পাঠ শুনেছিলাম।
চিঠির সব কথা স্মৃতিতে ধারণ করতে পারিনি, শুধু মনে পড়ে অদ্ভুত এক আবেগে আক্রান্ত হয়েছিলাম সেদিন। বেশ কিছুকাল পর যখন নিজেরই সেই চিঠি পাঠের সুযোগ হলো, তখন আর আমি নবীন কিশোর নই, কিন্তু কী আশ্চর্য! পরিণত বয়সেও সেই চিঠি আমাকে যেন একইভাবে রোমাঞ্চিত করে তোলে, আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
চিঠিতে নজরুল লিখেছিলেন—
“কল্যাণীয়াসু,
তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নববর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে। মেঘ-মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল। পনর বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি বারিধারার প্লাবন নেমেছিল—তা তুমিও স্মরণ করতে পারো। আষাঢ়ের নব মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার।...এই আষাঢ় আমায় কল্পনার স্বর্গলোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে। যাক্ তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দিই। তুমি বিশ্বাস করো, আমি যা লিখছি তা সত্য। লোকের মুখের শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা করে থাকো, তাহলে আমায় ভুল বুঝবে—আর তা মিথ্যা।
তোমার উপর আমি কোন জিঘাংসা পোষণ করি না—এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কী গভীর ক্ষত, কী অসীম বেদনা! সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি—তা দিয়ে তোমায় কোনো দিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না—‘ধূমকেতু’র বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।”
দীর্ঘ চিঠির এটুকু অংশ পড়েই অজস্র প্রশ্ন জাগে মনে। কে এই নারী? কেন তাঁর কাছে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করছেন কবি? সেই নারীর জন্য যদি সত্যিই তাঁর হৃদয়জুড়ে ‘গভীর ক্ষত’ ও ‘অসীম বেদনা’, তাহলে কেন বিচ্ছেদের করুণ পরিণতি পেয়েছিল এই সম্পর্ক? কেন বিয়ের সাজ ও স্বপ্নে সজ্জিতা একটি মেয়েকে বাসররাত ফুরোবার আগেই ফেলে রেখে এসেছিলেন কবি? ১৫ বছর পর এই পত্র কি নিজের অপরাধকে লঘু করার চেষ্টা?
এসব প্রশ্নের সূত্র ধরে কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুর গ্রামের নার্গিসকে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম আমি, তাঁকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখব এই অভিপ্রায়ে। কিন্তু সেই পথ বড় অসহজ, দুর্গম। কবি নজরুল ইসলামের জীবনীভিত্তিক বহু গ্রন্থ পাঠ করে দেখি, এই নার্গিস প্রসঙ্গ কুয়াশাচ্ছন্ন করে তুলেছেন লেখকেরা। নজরুল-নার্গিস সম্পর্ক ও তার পরিণতি সম্পর্কে গবেষকেরা রীতিমতো দ্বিধাবিভক্ত।
১৯২১ সালে আলী আকবর খানের সঙ্গে দৌলতপুরে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন নজরুল। সেখানে প্রায় আড়াই মাস অবস্থানকালে খান সাহেবের ভাগনি নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে—এ তথ্য নিয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু ১৯২১ সালের ১৭ জুন নির্ধারিত তারিখে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল, নাকি কাবিননামা বা অন্য কোনো মতবিরোধের কারণে নজরুল বিয়ের আসর ছেড়ে উঠে চলে গিয়েছিলেন—এ নিয়েই যাবতীয় মতভিন্নতা।
কমরেড মুজফ্ফর আহমদ ছিলেন নজরুলের ঘনিষ্ঠ সুহৃদ ও অভিভাবকতুল্য। তাঁর ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে বিয়ের প্রসঙ্গটি যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তা-ই যথার্থ বিবেচনা করেছেন রফিকুল ইসলাম, হায়াৎ মামুদ, জিয়াদ আলী ও শান্তনু কায়সারদের মতো বিজ্ঞ নজরুল গবেষকেরা; অর্থাৎ নজরুল ও নার্গিসের বিয়েটা শেষ অবধি হয়নি। বিয়ের আসর থেকেই উঠে চলে গিয়েছিলেন নজরুল। কিন্তু মুজফ্ফরের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন খোদ তাঁর জামাতা কবি আবদুল কাদির।
তিনি মুসলিম বিবাহ আইন উদ্ধৃত করে, ঘটনাপরম্পরা উল্লেখ করে বলেছিলেন, শাস্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে বিয়েটা হয়েছিল। বিয়ের পরদিন সকালে নজরুল কুমিল্লা ছেড়ে গিয়েছিলেন।
নজরুল গবেষক আজহার আলী খান তো বটেই, সুফী জুলফিকার হায়দার, কাজী মোতাহের হোসেন, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন প্রমুখ নজরুলের ঘনিষ্ঠজনদের বক্তব্যও ছিল আবদুল কাদিরের অনুরূপ। তবে বিয়েতে কিছু একটা গোলযোগ হয়েছিল, এ বিষয়ে সবাই ছিলেন একমত।
উপন্যাস তো গবেষণা নয়, গবেষকদের দোটানার মধ্যে নিজের মতো করে পথ কেটে নিয়েছি আমি। তথ্য যেখানে শেষ, সেখানেই বিস্তৃতি ঘটেছে কল্পনার। এটুকু স্বাধীনতা ঔপন্যাসিকের প্রাপ্য বলেই মনে করি।
উপন্যাসে আমি সৈয়দা আসার খানম নামের একটি গ্রাম্য কিশোরীর কথা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি, যাঁকে ভালোবেসে নজরুল তাঁর প্রিয় ফুলের নামে নাম দিয়েছিলেন নার্গিস। আষাঢ় মাসে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পরদিন চলে যাওয়ার সময় কবি তাঁকে বলে গিয়েছিলেন, শ্রাবণ মাসে পরিবার-পরিজনসমেত এসে তুলে নিয়ে যাবেন। কিন্তু সেই যে গেলেন, ১৭টি বছর কাটল, ‘শাওন আসিল ফিরে, সে ফিরে এল না।’
‘নার্গিস’ উপন্যাসটি লেখার সময় নজরুলের জীবনসংক্রান্ত প্রচুর বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়েছে। তখনই আরেকটি চরিত্র আমার মনে দারুণ রেখাপাত করে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী এবং অঙ্কশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া ফজিলতুন্নেসা।
কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকায় এসেছিলেন মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে অতিথি হয়ে। সেটা ১৯২৮ সাল। সেই সম্মেলনে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন বিদূষী ফজিলতুন্নেসা। কিন্তু সেখানে নয়, এই শ্যামাঙ্গী মেধাবী তরুণীর সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয় কাজী মোতাহের হোসেনের বর্ধমান হাউসের বাড়িতে।
এই দীপ্তিময়ীর সঙ্গে প্রথম আলাপেই মুগ্ধ হন কবি এবং সেই মুগ্ধতা দ্রুত প্রেমে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু ফজিলতুন্নেসা তো নার্গিস নন। ঢাকার ইডেন কলেজ ও কলকাতার বেথুন কলেজে কৃতিত্বের সঙ্গে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তুখোড় ছাত্রীর সামনে তখন ভবিষ্যতের দিগন্ত অনেক দূর বিস্তৃত। কবির সান্নিধ্য, তাঁর গান ও কবিতা তাঁকে মুগ্ধ করে বটে, কিন্তু এই বিবাহিত পুরুষের প্রেমে পড়ার মতো হঠকারিতা তিনি করতে পারেন না। কোথাও হয়তো প্রশ্রয় কিছুটা ছিল, এদিকে নজরুলের ছিল নারীর হৃদয় জয় করার সহজাত ক্ষমতা।
তাই তিনি ভেবেছিলেন এখানেও সফল হবেন তিনি। তা হয়নি। প্রত্যাখ্যানের আঘাতে জর্জরিত হয়েছিলেন। নজরুলের অনেক কালজয়ী কবিতা ও গানে আছে সেই বেদনার বয়ান।
ফজিলতুন্নেসা ইংল্যান্ড চলে গিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য। এখানেই চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটতে পারত এই সম্পর্কের; ঘটেনি। ঘটেনি বলেই ফজিলতুন্নেসাকে নিয়ে কবি যেমন কবিতা লিখেছিলেন ‘রহস্যময়ী’ নামে, আমাদেরও তাঁকে কিছুটা রহস্যময়ীই মনে হয়েছে। এই সম্পর্ক–বৈচিত্র্যকেই আমি তুলে ধরতে চেয়েছি ‘কবি ও রহস্যময়ী’ উপন্যাসে।
নার্গিস বা ফজিলতুন্নেসা ছাড়াও নজরুলের জীবনে এসেছেন আরও অনেক নারী। এসব সম্পর্ক অনেকটা ‘ঘরেতে এল না সে তো মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া...’ গোছের।
কিন্তু আশালতা সেনগুপ্তের (প্রমীলা) সঙ্গে নজরুলের অসবর্ণ প্রেম সমাজের নানা ভ্রুকুটি বা আপত্তি সত্ত্বেও গৃহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। পূর্ববর্তী দুটি উপন্যাস লেখার সময় নজরুল-জীবনীতে আমি বারবার আশালতার দিকে সবিস্ময়ে তাকিয়েছি। দেশব্যাপী তুমুল জনপ্রিয় এই মানুষটির সঙ্গে ঘর করা আর ঝড়কে নিজের ঘরে বন্দী করার চেষ্টা তো সমার্থক।
কখনো অভাব-দারিদ্র্য, কখনোবা প্রাচুর্য ও অপচয়—সবকিছুতেই লাগামহীন জীবনে অভ্যস্ত একটি মানুষকে নিজের শেষ দিনটি পর্যন্ত আগলে রেখেছিলেন যে নারী, তাঁকে নিয়ে না লিখলে বৃত্তটা তো সম্পূর্ণ হয় না! সেই ভাবনা থেকে ‘আশালতা’ নামের একটি উপন্যাস লিখতে শুরু করি। ২০২১ সালের একটি ঈদসংখ্যায় এ উপন্যাস সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশিত হয়েছে। আশা করছি, আগামী ফেব্রুয়ারির বইমেলায় পূর্ণাঙ্গ ‘আশালতা’ প্রকাশ পাবে।
২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘নার্গিস’-এর সাতটি মুদ্রণ এবং ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘কবি ও রহস্যময়ী’র দুটি মুদ্রণ এযাবৎ প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকদের কাছ থেকে পাওয়া এই আনুকূল্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে আমার মনে হয়, নজরুলের কবিতা এখনো যেমন সমান আগ্রহে পাঠ করেন পাঠক, তেমনি তাঁর বর্ণময় ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে অনুসন্ধিৎসাও কমেনি। সে ক্ষেত্রে নিরেট ইতিহাস পাঠের চেয়ে আখ্যান পাঠের আনন্দ যে বেশি, তা তো বলাই বাহুল্য।
কবি নজরুলের জন্য ১৭ বছর অপেক্ষা করেছিলেন এক নারী। এই একটি তথ্যই কৌতূহলী করে তুলেছিল আমাকে। তাঁর প্রথম প্রেম নার্গিস। মিলনের পূর্ণতা
পায়নি এই প্রেম। সেই হাহাকার উৎকীর্ণ হয়ে আছে তাঁর গানে-কবিতায়।
স্কুলজীবনের শেষ দিকে কিংবা কলেজজীবনের শুরুতে, আজ আর নির্দিষ্ট দিনক্ষণ মনে করতে পারি না, একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একজন আবৃত্তিকারের ভরাট কণ্ঠে নজরুলের একটি চিঠির পাঠ শুনেছিলাম।
চিঠির সব কথা স্মৃতিতে ধারণ করতে পারিনি, শুধু মনে পড়ে অদ্ভুত এক আবেগে আক্রান্ত হয়েছিলাম সেদিন। বেশ কিছুকাল পর যখন নিজেরই সেই চিঠি পাঠের সুযোগ হলো, তখন আর আমি নবীন কিশোর নই, কিন্তু কী আশ্চর্য! পরিণত বয়সেও সেই চিঠি আমাকে যেন একইভাবে রোমাঞ্চিত করে তোলে, আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
চিঠিতে নজরুল লিখেছিলেন—
“কল্যাণীয়াসু,
তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নববর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে। মেঘ-মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল। পনর বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি বারিধারার প্লাবন নেমেছিল—তা তুমিও স্মরণ করতে পারো। আষাঢ়ের নব মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার।...এই আষাঢ় আমায় কল্পনার স্বর্গলোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে। যাক্ তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দিই। তুমি বিশ্বাস করো, আমি যা লিখছি তা সত্য। লোকের মুখের শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা করে থাকো, তাহলে আমায় ভুল বুঝবে—আর তা মিথ্যা।
তোমার উপর আমি কোন জিঘাংসা পোষণ করি না—এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কী গভীর ক্ষত, কী অসীম বেদনা! সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি—তা দিয়ে তোমায় কোনো দিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না—‘ধূমকেতু’র বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।”
দীর্ঘ চিঠির এটুকু অংশ পড়েই অজস্র প্রশ্ন জাগে মনে। কে এই নারী? কেন তাঁর কাছে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করছেন কবি? সেই নারীর জন্য যদি সত্যিই তাঁর হৃদয়জুড়ে ‘গভীর ক্ষত’ ও ‘অসীম বেদনা’, তাহলে কেন বিচ্ছেদের করুণ পরিণতি পেয়েছিল এই সম্পর্ক? কেন বিয়ের সাজ ও স্বপ্নে সজ্জিতা একটি মেয়েকে বাসররাত ফুরোবার আগেই ফেলে রেখে এসেছিলেন কবি? ১৫ বছর পর এই পত্র কি নিজের অপরাধকে লঘু করার চেষ্টা?
এসব প্রশ্নের সূত্র ধরে কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুর গ্রামের নার্গিসকে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম আমি, তাঁকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখব এই অভিপ্রায়ে। কিন্তু সেই পথ বড় অসহজ, দুর্গম। কবি নজরুল ইসলামের জীবনীভিত্তিক বহু গ্রন্থ পাঠ করে দেখি, এই নার্গিস প্রসঙ্গ কুয়াশাচ্ছন্ন করে তুলেছেন লেখকেরা। নজরুল-নার্গিস সম্পর্ক ও তার পরিণতি সম্পর্কে গবেষকেরা রীতিমতো দ্বিধাবিভক্ত।
১৯২১ সালে আলী আকবর খানের সঙ্গে দৌলতপুরে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন নজরুল। সেখানে প্রায় আড়াই মাস অবস্থানকালে খান সাহেবের ভাগনি নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে—এ তথ্য নিয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু ১৯২১ সালের ১৭ জুন নির্ধারিত তারিখে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল, নাকি কাবিননামা বা অন্য কোনো মতবিরোধের কারণে নজরুল বিয়ের আসর ছেড়ে উঠে চলে গিয়েছিলেন—এ নিয়েই যাবতীয় মতভিন্নতা।
কমরেড মুজফ্ফর আহমদ ছিলেন নজরুলের ঘনিষ্ঠ সুহৃদ ও অভিভাবকতুল্য। তাঁর ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে বিয়ের প্রসঙ্গটি যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তা-ই যথার্থ বিবেচনা করেছেন রফিকুল ইসলাম, হায়াৎ মামুদ, জিয়াদ আলী ও শান্তনু কায়সারদের মতো বিজ্ঞ নজরুল গবেষকেরা; অর্থাৎ নজরুল ও নার্গিসের বিয়েটা শেষ অবধি হয়নি। বিয়ের আসর থেকেই উঠে চলে গিয়েছিলেন নজরুল। কিন্তু মুজফ্ফরের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন খোদ তাঁর জামাতা কবি আবদুল কাদির।
তিনি মুসলিম বিবাহ আইন উদ্ধৃত করে, ঘটনাপরম্পরা উল্লেখ করে বলেছিলেন, শাস্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে বিয়েটা হয়েছিল। বিয়ের পরদিন সকালে নজরুল কুমিল্লা ছেড়ে গিয়েছিলেন।
নজরুল গবেষক আজহার আলী খান তো বটেই, সুফী জুলফিকার হায়দার, কাজী মোতাহের হোসেন, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন প্রমুখ নজরুলের ঘনিষ্ঠজনদের বক্তব্যও ছিল আবদুল কাদিরের অনুরূপ। তবে বিয়েতে কিছু একটা গোলযোগ হয়েছিল, এ বিষয়ে সবাই ছিলেন একমত।
উপন্যাস তো গবেষণা নয়, গবেষকদের দোটানার মধ্যে নিজের মতো করে পথ কেটে নিয়েছি আমি। তথ্য যেখানে শেষ, সেখানেই বিস্তৃতি ঘটেছে কল্পনার। এটুকু স্বাধীনতা ঔপন্যাসিকের প্রাপ্য বলেই মনে করি।
উপন্যাসে আমি সৈয়দা আসার খানম নামের একটি গ্রাম্য কিশোরীর কথা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি, যাঁকে ভালোবেসে নজরুল তাঁর প্রিয় ফুলের নামে নাম দিয়েছিলেন নার্গিস। আষাঢ় মাসে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পরদিন চলে যাওয়ার সময় কবি তাঁকে বলে গিয়েছিলেন, শ্রাবণ মাসে পরিবার-পরিজনসমেত এসে তুলে নিয়ে যাবেন। কিন্তু সেই যে গেলেন, ১৭টি বছর কাটল, ‘শাওন আসিল ফিরে, সে ফিরে এল না।’
‘নার্গিস’ উপন্যাসটি লেখার সময় নজরুলের জীবনসংক্রান্ত প্রচুর বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়েছে। তখনই আরেকটি চরিত্র আমার মনে দারুণ রেখাপাত করে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী এবং অঙ্কশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া ফজিলতুন্নেসা।
কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকায় এসেছিলেন মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে অতিথি হয়ে। সেটা ১৯২৮ সাল। সেই সম্মেলনে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন বিদূষী ফজিলতুন্নেসা। কিন্তু সেখানে নয়, এই শ্যামাঙ্গী মেধাবী তরুণীর সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয় কাজী মোতাহের হোসেনের বর্ধমান হাউসের বাড়িতে।
এই দীপ্তিময়ীর সঙ্গে প্রথম আলাপেই মুগ্ধ হন কবি এবং সেই মুগ্ধতা দ্রুত প্রেমে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু ফজিলতুন্নেসা তো নার্গিস নন। ঢাকার ইডেন কলেজ ও কলকাতার বেথুন কলেজে কৃতিত্বের সঙ্গে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তুখোড় ছাত্রীর সামনে তখন ভবিষ্যতের দিগন্ত অনেক দূর বিস্তৃত। কবির সান্নিধ্য, তাঁর গান ও কবিতা তাঁকে মুগ্ধ করে বটে, কিন্তু এই বিবাহিত পুরুষের প্রেমে পড়ার মতো হঠকারিতা তিনি করতে পারেন না। কোথাও হয়তো প্রশ্রয় কিছুটা ছিল, এদিকে নজরুলের ছিল নারীর হৃদয় জয় করার সহজাত ক্ষমতা।
তাই তিনি ভেবেছিলেন এখানেও সফল হবেন তিনি। তা হয়নি। প্রত্যাখ্যানের আঘাতে জর্জরিত হয়েছিলেন। নজরুলের অনেক কালজয়ী কবিতা ও গানে আছে সেই বেদনার বয়ান।
ফজিলতুন্নেসা ইংল্যান্ড চলে গিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য। এখানেই চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটতে পারত এই সম্পর্কের; ঘটেনি। ঘটেনি বলেই ফজিলতুন্নেসাকে নিয়ে কবি যেমন কবিতা লিখেছিলেন ‘রহস্যময়ী’ নামে, আমাদেরও তাঁকে কিছুটা রহস্যময়ীই মনে হয়েছে। এই সম্পর্ক–বৈচিত্র্যকেই আমি তুলে ধরতে চেয়েছি ‘কবি ও রহস্যময়ী’ উপন্যাসে।
নার্গিস বা ফজিলতুন্নেসা ছাড়াও নজরুলের জীবনে এসেছেন আরও অনেক নারী। এসব সম্পর্ক অনেকটা ‘ঘরেতে এল না সে তো মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া...’ গোছের।
কিন্তু আশালতা সেনগুপ্তের (প্রমীলা) সঙ্গে নজরুলের অসবর্ণ প্রেম সমাজের নানা ভ্রুকুটি বা আপত্তি সত্ত্বেও গৃহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। পূর্ববর্তী দুটি উপন্যাস লেখার সময় নজরুল-জীবনীতে আমি বারবার আশালতার দিকে সবিস্ময়ে তাকিয়েছি। দেশব্যাপী তুমুল জনপ্রিয় এই মানুষটির সঙ্গে ঘর করা আর ঝড়কে নিজের ঘরে বন্দী করার চেষ্টা তো সমার্থক।
কখনো অভাব-দারিদ্র্য, কখনোবা প্রাচুর্য ও অপচয়—সবকিছুতেই লাগামহীন জীবনে অভ্যস্ত একটি মানুষকে নিজের শেষ দিনটি পর্যন্ত আগলে রেখেছিলেন যে নারী, তাঁকে নিয়ে না লিখলে বৃত্তটা তো সম্পূর্ণ হয় না! সেই ভাবনা থেকে ‘আশালতা’ নামের একটি উপন্যাস লিখতে শুরু করি। ২০২১ সালের একটি ঈদসংখ্যায় এ উপন্যাস সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশিত হয়েছে। আশা করছি, আগামী ফেব্রুয়ারির বইমেলায় পূর্ণাঙ্গ ‘আশালতা’ প্রকাশ পাবে।
২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘নার্গিস’-এর সাতটি মুদ্রণ এবং ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘কবি ও রহস্যময়ী’র দুটি মুদ্রণ এযাবৎ প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকদের কাছ থেকে পাওয়া এই আনুকূল্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে আমার মনে হয়, নজরুলের কবিতা এখনো যেমন সমান আগ্রহে পাঠ করেন পাঠক, তেমনি তাঁর বর্ণময় ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে অনুসন্ধিৎসাও কমেনি। সে ক্ষেত্রে নিরেট ইতিহাস পাঠের চেয়ে আখ্যান পাঠের আনন্দ যে বেশি, তা তো বলাই বাহুল্য।
চারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
৬ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
১৩ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
১৩ দিন আগেদ্য ভেজিটেরিয়ানের পর হান কাঙের পরের উপন্যাস ছিল ‘দ্য উইন্ড ব্লোজ, গো’। এই উপন্যাস লেখার সময়ই ঘটে বিপত্তি! হান অনুভব করেন তিনি আর লিখতে পারছেন না। গত বছর নিজের পঞ্চম উপন্যাস ‘গ্রিক লেসন’ ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হলে স্পেনের এল-পাইস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি।
১০ অক্টোবর ২০২৪