মোস্তফা অভি
প্রকৃতির এমন এক নিষ্ঠুর নিয়ম– ইচ্ছা করলেও কেউ সেটাকে এড়িয়ে যেতে পারে না। একদিন মধ্যরাতে ছোবাহান ঘুম থেকে জেগে বমি করে বিছানা ভাসায়। মাথাটা ঝিনঝিন করে তার। স্ত্রী ছোবাহানের মাথাটা তার কোলের ওপর রেখে কয়েকবার মৃদুস্বরে ডেকে বলল—ওগো, কেমন লাগছে তোমার? ছোবাহান একদিকে কাত হয়ে সেই যে চোখ বন্ধ করল, আর হুঁশে ফিরল না। তার তিন ছেলে ধরাধরি করে রাতের মধ্যেই সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। পথে স্ত্রী আর ছেলেরা কত রকমের আশঙ্কার কথা বলল, ছোবাহান উঁহু পর্যন্ত করল না। সে চোখ খুলল পরদিন দুপুরের দিকে। ছোবাহান প্রথম চাহনিতে স্ত্রীর মুখের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল, যেন মৃত মানুষের মতো পলকহীন চোখ দুটো তার। কেমন অদ্ভুত, অবাধ্য রকমের ঘুমে তার চোখ দুটো আচ্ছন্ন হয়ে যায়! সমস্ত পৃথিবী গোল্লায় যাক, ছোবাহান গভীর ঘুমে ঢলে পড়ুক। পৃথিবীতে ঘুমের চেয়ে শান্তি আর কী আছে!
পরদিন সকালে রাউন্ডে এসে ডাক্তার জানাল, ব্রেন স্ট্রোক। ছোবাহান আবার চোখ খুলল পরদিন রাতে।
মানুষ দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেলে যেভাবে ধড়ফড় করে জেগে ওঠে, ছোবাহান হঠাৎ চোখ মেলে সেভাবেই বিছানার ওপর বসল। জলের ভেতর মাছ খোঁজার মতো তার হাত দুটো সামনের দিকে হাতড়ে বেড়ায়। এতক্ষণ মা আর ছেলেদের মাঝে যে স্তব্ধতা নেমেছিল, ছোবাহানের এক চিৎকারে সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ছোবাহান ডান হাতে স্ত্রীর কাঁধটা খুঁজে পেয়ে বলল, চোহে তো কিচ্ছু দেহি না মুই।
ভালো চোখ দুটো আলো হারানোর পর চোখের ভেতর মণি দুটো এমনভাবে ঘুরতে থাকে, ছেলেদের মনে হয়, বাবাকে এইমাত্র নতুন করে দেখতে শুরু করেছে ওরা। এক মুহূর্তের মধ্যে বহু বছরের চেনা মানুষটি ওদের কাছে হঠাৎ কেমন অচেনা হয়ে যায়। ছোবাহানের জীবনে এই সময়ে এটাই অদৃষ্ট।
তিন-চার দিন এভাবেই কেটে যায়। বাড়ি থেকে ছেলেরা যে টাকাপয়সা সঙ্গে নিয়ে এসেছিল, ওষুধপত্তর কিনে অনেকটাই ফুরিয়ে যায়। রাতে ডাক্তার রাউন্ডে এসে জানাল, উন্নত চিকিৎসায় ছোবাহান চোখের আলো আবার ফিরে পেলেও পেতে পারে; তবে সত্যিই যে পাবে, এমন ভরসা দেওয়া পুরোপুরি সম্ভব নয়। ডাক্তার ছোবাহানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
পরদিন বেলা ১১টার দিকে ছোবাহানের ছুটি হয়। বাড়ি থেকে আনা বিছানাপত্র গোল করে বেঁধে সবাই মিলে ভ্যানগাড়িতে চড়ে বাড়ির পথে রওনা হয়। ১০-১৫ মাইল পথের ব্যবধানে ছোবাহান কারও সঙ্গে একটা কথাও বলল না। শুধু মনে মনে সে ভাবে, চোখ দুটো হঠাৎ করে কেড়ে নিল খোদাতাল্লায়! যেমন সুস্থ, স্বাভাবিক চোখ নিয়ে সে হাসপাতালে এসেছিল, সেভাবেই আবার গ্রামে ফিরে যাচ্ছে, পার্থক্য শুধু একটা কালো চশমা। এভাবেই শুরু হলো তার অন্ধত্ব যাত্রার ভূমিকা।
সারাটা পথ সে কত রকমের কথা ভেবে ভেবে অস্থির হলো, দোকানটার কী হবে ভবিষ্যৎ? বড় ছেলেটা খুব শান্ত স্বভাবের, ইন্টারমিডিয়েট পাস করে দুই বছর অনার্সে ক্লাস করেছে। এখন আর পড়াশোনার উপায় নেই। মেজ ছেলেটা অস্থির প্রকৃতির। গ্রামের ভালোমন্দ সব রকমের ছেলেদের সঙ্গে চলাফেরা তার। আয়রোজগার যদিও করে কিন্তু প্রতিদিন কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে মানুষের সঙ্গে অনর্থক বিবাদে জড়ায়। ছোট ছেলেটা কীভাবে বড় করবে, সেসবের ভরসা নেই। যখন তাকে নিয়ে ভ্যানগাড়িটা গ্রামের পিচঢালা সরু পথ ধরে বাড়ির কাছাকাছি চলে যাবে, তখন রাস্তার দুই ধারের লোকেরা হাতের কাজ ফেলে তার ভ্যানের কাছে এসে দাঁড়াবে। চশমার আড়ালে ঢেকে রাখা চোখ দুটো দেখার কত কৌতূহল হবে তাদের! কেউ কেউ তার পিঠের ওপর হাত রেখে বলবে, আফসোস কইর না ভাই, মোরা তো কেউ মরি নাই। বাড়ি যাওয়ার পর প্রতিবেশীরা তার চারপাশ ঘিরে দাঁড়াবে। ছেলেদের আড়ালে ডেকে নিয়ে চুপি চুপি জানতে চাইবে, একেবারেই কি নিভে গেছে চোখের আলো? মেয়েলোকেরা ফিসফিস করে কত রকমের কথা বলবে, সেসবের হিসাব নেই। যাদের সঙ্গে ছোট থেকে মাঠঘাটে কাজ করে বড় হয়েছে সে, বরিশাল রূপাতলী জাগুয়ার গ্রামে মাসের পর মাস ধানখেতে বদলা দিয়েছে একসঙ্গে, পেছনের দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করে তারাও হয়তো হায়বাত করবে। তার সমবয়সী বন্ধুরা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে যখন হাউমাউ করে কেঁদে ফেলবে, তখন কেমন লাগবে তার! এসব ভেবে ছোবাহানের অন্ধ চোখে জল এসে যায়। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর কল্পনার সবকিছুই কেমন যেন পাল্টে গেল তার। দুপুরের পর দু-তিনজন এসে ছোবাহানের বিছানার পাশে বসে ছেলেদের কাছে ঘটনার বিবরণ শুনল। তারা ছোবাহানের পিঠের ওপর কর্তব্যের স্পর্শ দিয়ে যে যার বাড়ি চলে যায়। বিকেলের দিকে আর কেউ এল না।
সন্ধ্যার পর গ্রামের লোকেরা মাঠঘাটের কাজ সেরে একটু অবসর আর বিনোদনের জন্য রাস্তার ধারে চা খেতে যায়। এত দিন তার নিজের দোকানে চা খেতে খেতে কত রকমের গল্প-আড্ডায় জমিয়ে রাখত তারা, কয়েক দিন বন্ধ থাকায় দোকানের সেই সরগরম ভাবটা আগুনে পানি ঢালার মতো নিষ্প্রভ। দোকানের বারান্দায় কয়েকটা কুকুর লেজ গুটিয়ে ঘুমিয়ে থাকে, সেসব তার স্ত্রীর কাছে শুনেছে। দোকানের সেই কাস্টমারগুলো পোয়া মাইল হেঁটে রাস্তার মাথার দোকানে টিভি দেখতে যায়। ঘরের পাশ দিয়ে টিভি দেখতে যাওয়া লোকেদের দৈনন্দিন গালগল্প তার কানে এসে ছুরির ফলার মতো বিঁধে যেতে থাকে। কেউ একবার তার কথা স্মরণ করে ঘরের দরজায় উঁকি পর্যন্ত দিল না।
মানুষ কীভাবে এ রকম পর হয়ে যায়!
কয়েক দিনের ব্যবধানে তার জীবনটা একেবারে ‘নাই’ হয়ে প্রান্তসীমায় গিয়ে ঠেকেছে। মেজ ছেলেটা দোকান খুলে তিন-চার দিন চায়ের চুলায় আগুন ধরিয়ে পথের দিকে চেয়ে রইল। কত পরিচিত লোকজন দোকানের সামনে দিয়ে চলে যায়, একবারের জন্যও টুলের ওপর বসে জিরানোর চিন্তা করল না তারা। যে কুকুরগুলো কয়েক দিনের কোলাহলহীন দোকানের বারান্দায় থাকার জায়গা করে নিয়েছিল, ওগুলো দোকান খোলার পরও নড়ল না মোটে। খরিদ্দারের অভাবে দোকানটা একেবারে বন্ধ হওয়ার জোগাড়। ছোবাহান স্ত্রীকে ডেকে বলল, মাহাজনের ধারে মাল কেনার টাহা বাহি রইয়া গ্যাছে, দোহানে যেয়া আছে বেইচ্যা কিইন্যা দেনাদারি শোধ কইর্যা দেও।
মহাজন খবরটা পেয়েছে সত্যি, যাই-যাব করে আর আসা হয়নি তার। একদিন দুপুরে লোকটি এসে কয়েকটা সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে যাওয়ার সময় ছোবাহানের হাত ধরে চুপি চুপি বলল, মোর টাহা কয়ডা যে দরকার। বোঝোই তো, সামান্য চালান। অনেক দিন তো হইয়া গেল।
এক দিনের নোটিশে ছোবাহানের দোকানটা খালি হয়ে যায়।
মেজ ছেলে এখানে-সেখানে কাজ করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে সামান্য কিছু টাকা তুলে দেয়। মাস দুয়েক যাওয়ার পর একদিন সন্ধ্যায় সে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরল।
গ্রামের লোকেরা ছোবাহানের চোখ হারানোয় নিরুত্তাপ থাকলেও দুর্দিনে বড় ভাইকে রেখে মেজ ভাই বিয়ে করে এনেছে, এসব নিন্দাচর্চা প্রতিভার সঙ্গেই তারা করল। অন্ধ মানুষটি আর কী বলবে, ছেলের হাতের কামাই খেয়ে তাকে বলার মতো কোনো ভাষাই যে নেই তার। মাঝরাতে পাশের ঘর থেকে যখন নতুন বউয়ের হাস্যধ্বনি শোনা যায়, তখন ছোবাহানের মনে হয়, অন্ধ জীবনের এমন পীড়া অত্যন্ত ব্যথার। যদি সে সুযোগ পেত, তবে আত্মহত্যা করে হয়তো চিরদিনের জন্য বেঁচে যেতে পারত। কিন্তু চোখে না দেখলে মৃত্যুর আয়োজন করার যেসব রসদ জোগাড় করা প্রয়োজন, তার পক্ষে সেসব করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বড় ছেলে রাগ করে আর বাড়ি ফিরল না। স্ত্রীর ব্যবহারও আগের মতো নেই। ছোবাহান চোখে না দেখুক, কান দিয়ে যা কিছু শোনে, তাতে অনুভব করতে পারে, কয়েক দিনের মধ্যে সে সংসারে কেমন বোঝা হয়ে উঠেছে। সবকিছুর ওপর যেন মিথ্যার পরত পড়া, কোথাও মায়া-মমতার ছায়াটুকুও নেই। জীবনের এমন এক নির্মম পরিহাস।
মেজ ছেলের কামাই কমে আসায় টাকাপয়সার টান পড়লে ছোবাহানের স্ত্রী বলল, ঘরে তো খাওয়ার মতো কিছুই নেই। ছোবাহান অন্ধ চোখের দুই ফোঁটা জল ফেলে বলল, আর কইও না কিছু মোরে, কাইল বেইল ওডার আগেই যেন মোর মরণ অয়!
প্রকৃতির এমন এক নিষ্ঠুর নিয়ম– ইচ্ছা করলেও কেউ সেটাকে এড়িয়ে যেতে পারে না। একদিন মধ্যরাতে ছোবাহান ঘুম থেকে জেগে বমি করে বিছানা ভাসায়। মাথাটা ঝিনঝিন করে তার। স্ত্রী ছোবাহানের মাথাটা তার কোলের ওপর রেখে কয়েকবার মৃদুস্বরে ডেকে বলল—ওগো, কেমন লাগছে তোমার? ছোবাহান একদিকে কাত হয়ে সেই যে চোখ বন্ধ করল, আর হুঁশে ফিরল না। তার তিন ছেলে ধরাধরি করে রাতের মধ্যেই সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। পথে স্ত্রী আর ছেলেরা কত রকমের আশঙ্কার কথা বলল, ছোবাহান উঁহু পর্যন্ত করল না। সে চোখ খুলল পরদিন দুপুরের দিকে। ছোবাহান প্রথম চাহনিতে স্ত্রীর মুখের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল, যেন মৃত মানুষের মতো পলকহীন চোখ দুটো তার। কেমন অদ্ভুত, অবাধ্য রকমের ঘুমে তার চোখ দুটো আচ্ছন্ন হয়ে যায়! সমস্ত পৃথিবী গোল্লায় যাক, ছোবাহান গভীর ঘুমে ঢলে পড়ুক। পৃথিবীতে ঘুমের চেয়ে শান্তি আর কী আছে!
পরদিন সকালে রাউন্ডে এসে ডাক্তার জানাল, ব্রেন স্ট্রোক। ছোবাহান আবার চোখ খুলল পরদিন রাতে।
মানুষ দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেলে যেভাবে ধড়ফড় করে জেগে ওঠে, ছোবাহান হঠাৎ চোখ মেলে সেভাবেই বিছানার ওপর বসল। জলের ভেতর মাছ খোঁজার মতো তার হাত দুটো সামনের দিকে হাতড়ে বেড়ায়। এতক্ষণ মা আর ছেলেদের মাঝে যে স্তব্ধতা নেমেছিল, ছোবাহানের এক চিৎকারে সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ছোবাহান ডান হাতে স্ত্রীর কাঁধটা খুঁজে পেয়ে বলল, চোহে তো কিচ্ছু দেহি না মুই।
ভালো চোখ দুটো আলো হারানোর পর চোখের ভেতর মণি দুটো এমনভাবে ঘুরতে থাকে, ছেলেদের মনে হয়, বাবাকে এইমাত্র নতুন করে দেখতে শুরু করেছে ওরা। এক মুহূর্তের মধ্যে বহু বছরের চেনা মানুষটি ওদের কাছে হঠাৎ কেমন অচেনা হয়ে যায়। ছোবাহানের জীবনে এই সময়ে এটাই অদৃষ্ট।
তিন-চার দিন এভাবেই কেটে যায়। বাড়ি থেকে ছেলেরা যে টাকাপয়সা সঙ্গে নিয়ে এসেছিল, ওষুধপত্তর কিনে অনেকটাই ফুরিয়ে যায়। রাতে ডাক্তার রাউন্ডে এসে জানাল, উন্নত চিকিৎসায় ছোবাহান চোখের আলো আবার ফিরে পেলেও পেতে পারে; তবে সত্যিই যে পাবে, এমন ভরসা দেওয়া পুরোপুরি সম্ভব নয়। ডাক্তার ছোবাহানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
পরদিন বেলা ১১টার দিকে ছোবাহানের ছুটি হয়। বাড়ি থেকে আনা বিছানাপত্র গোল করে বেঁধে সবাই মিলে ভ্যানগাড়িতে চড়ে বাড়ির পথে রওনা হয়। ১০-১৫ মাইল পথের ব্যবধানে ছোবাহান কারও সঙ্গে একটা কথাও বলল না। শুধু মনে মনে সে ভাবে, চোখ দুটো হঠাৎ করে কেড়ে নিল খোদাতাল্লায়! যেমন সুস্থ, স্বাভাবিক চোখ নিয়ে সে হাসপাতালে এসেছিল, সেভাবেই আবার গ্রামে ফিরে যাচ্ছে, পার্থক্য শুধু একটা কালো চশমা। এভাবেই শুরু হলো তার অন্ধত্ব যাত্রার ভূমিকা।
সারাটা পথ সে কত রকমের কথা ভেবে ভেবে অস্থির হলো, দোকানটার কী হবে ভবিষ্যৎ? বড় ছেলেটা খুব শান্ত স্বভাবের, ইন্টারমিডিয়েট পাস করে দুই বছর অনার্সে ক্লাস করেছে। এখন আর পড়াশোনার উপায় নেই। মেজ ছেলেটা অস্থির প্রকৃতির। গ্রামের ভালোমন্দ সব রকমের ছেলেদের সঙ্গে চলাফেরা তার। আয়রোজগার যদিও করে কিন্তু প্রতিদিন কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে মানুষের সঙ্গে অনর্থক বিবাদে জড়ায়। ছোট ছেলেটা কীভাবে বড় করবে, সেসবের ভরসা নেই। যখন তাকে নিয়ে ভ্যানগাড়িটা গ্রামের পিচঢালা সরু পথ ধরে বাড়ির কাছাকাছি চলে যাবে, তখন রাস্তার দুই ধারের লোকেরা হাতের কাজ ফেলে তার ভ্যানের কাছে এসে দাঁড়াবে। চশমার আড়ালে ঢেকে রাখা চোখ দুটো দেখার কত কৌতূহল হবে তাদের! কেউ কেউ তার পিঠের ওপর হাত রেখে বলবে, আফসোস কইর না ভাই, মোরা তো কেউ মরি নাই। বাড়ি যাওয়ার পর প্রতিবেশীরা তার চারপাশ ঘিরে দাঁড়াবে। ছেলেদের আড়ালে ডেকে নিয়ে চুপি চুপি জানতে চাইবে, একেবারেই কি নিভে গেছে চোখের আলো? মেয়েলোকেরা ফিসফিস করে কত রকমের কথা বলবে, সেসবের হিসাব নেই। যাদের সঙ্গে ছোট থেকে মাঠঘাটে কাজ করে বড় হয়েছে সে, বরিশাল রূপাতলী জাগুয়ার গ্রামে মাসের পর মাস ধানখেতে বদলা দিয়েছে একসঙ্গে, পেছনের দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করে তারাও হয়তো হায়বাত করবে। তার সমবয়সী বন্ধুরা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে যখন হাউমাউ করে কেঁদে ফেলবে, তখন কেমন লাগবে তার! এসব ভেবে ছোবাহানের অন্ধ চোখে জল এসে যায়। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর কল্পনার সবকিছুই কেমন যেন পাল্টে গেল তার। দুপুরের পর দু-তিনজন এসে ছোবাহানের বিছানার পাশে বসে ছেলেদের কাছে ঘটনার বিবরণ শুনল। তারা ছোবাহানের পিঠের ওপর কর্তব্যের স্পর্শ দিয়ে যে যার বাড়ি চলে যায়। বিকেলের দিকে আর কেউ এল না।
সন্ধ্যার পর গ্রামের লোকেরা মাঠঘাটের কাজ সেরে একটু অবসর আর বিনোদনের জন্য রাস্তার ধারে চা খেতে যায়। এত দিন তার নিজের দোকানে চা খেতে খেতে কত রকমের গল্প-আড্ডায় জমিয়ে রাখত তারা, কয়েক দিন বন্ধ থাকায় দোকানের সেই সরগরম ভাবটা আগুনে পানি ঢালার মতো নিষ্প্রভ। দোকানের বারান্দায় কয়েকটা কুকুর লেজ গুটিয়ে ঘুমিয়ে থাকে, সেসব তার স্ত্রীর কাছে শুনেছে। দোকানের সেই কাস্টমারগুলো পোয়া মাইল হেঁটে রাস্তার মাথার দোকানে টিভি দেখতে যায়। ঘরের পাশ দিয়ে টিভি দেখতে যাওয়া লোকেদের দৈনন্দিন গালগল্প তার কানে এসে ছুরির ফলার মতো বিঁধে যেতে থাকে। কেউ একবার তার কথা স্মরণ করে ঘরের দরজায় উঁকি পর্যন্ত দিল না।
মানুষ কীভাবে এ রকম পর হয়ে যায়!
কয়েক দিনের ব্যবধানে তার জীবনটা একেবারে ‘নাই’ হয়ে প্রান্তসীমায় গিয়ে ঠেকেছে। মেজ ছেলেটা দোকান খুলে তিন-চার দিন চায়ের চুলায় আগুন ধরিয়ে পথের দিকে চেয়ে রইল। কত পরিচিত লোকজন দোকানের সামনে দিয়ে চলে যায়, একবারের জন্যও টুলের ওপর বসে জিরানোর চিন্তা করল না তারা। যে কুকুরগুলো কয়েক দিনের কোলাহলহীন দোকানের বারান্দায় থাকার জায়গা করে নিয়েছিল, ওগুলো দোকান খোলার পরও নড়ল না মোটে। খরিদ্দারের অভাবে দোকানটা একেবারে বন্ধ হওয়ার জোগাড়। ছোবাহান স্ত্রীকে ডেকে বলল, মাহাজনের ধারে মাল কেনার টাহা বাহি রইয়া গ্যাছে, দোহানে যেয়া আছে বেইচ্যা কিইন্যা দেনাদারি শোধ কইর্যা দেও।
মহাজন খবরটা পেয়েছে সত্যি, যাই-যাব করে আর আসা হয়নি তার। একদিন দুপুরে লোকটি এসে কয়েকটা সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে যাওয়ার সময় ছোবাহানের হাত ধরে চুপি চুপি বলল, মোর টাহা কয়ডা যে দরকার। বোঝোই তো, সামান্য চালান। অনেক দিন তো হইয়া গেল।
এক দিনের নোটিশে ছোবাহানের দোকানটা খালি হয়ে যায়।
মেজ ছেলে এখানে-সেখানে কাজ করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে সামান্য কিছু টাকা তুলে দেয়। মাস দুয়েক যাওয়ার পর একদিন সন্ধ্যায় সে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরল।
গ্রামের লোকেরা ছোবাহানের চোখ হারানোয় নিরুত্তাপ থাকলেও দুর্দিনে বড় ভাইকে রেখে মেজ ভাই বিয়ে করে এনেছে, এসব নিন্দাচর্চা প্রতিভার সঙ্গেই তারা করল। অন্ধ মানুষটি আর কী বলবে, ছেলের হাতের কামাই খেয়ে তাকে বলার মতো কোনো ভাষাই যে নেই তার। মাঝরাতে পাশের ঘর থেকে যখন নতুন বউয়ের হাস্যধ্বনি শোনা যায়, তখন ছোবাহানের মনে হয়, অন্ধ জীবনের এমন পীড়া অত্যন্ত ব্যথার। যদি সে সুযোগ পেত, তবে আত্মহত্যা করে হয়তো চিরদিনের জন্য বেঁচে যেতে পারত। কিন্তু চোখে না দেখলে মৃত্যুর আয়োজন করার যেসব রসদ জোগাড় করা প্রয়োজন, তার পক্ষে সেসব করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বড় ছেলে রাগ করে আর বাড়ি ফিরল না। স্ত্রীর ব্যবহারও আগের মতো নেই। ছোবাহান চোখে না দেখুক, কান দিয়ে যা কিছু শোনে, তাতে অনুভব করতে পারে, কয়েক দিনের মধ্যে সে সংসারে কেমন বোঝা হয়ে উঠেছে। সবকিছুর ওপর যেন মিথ্যার পরত পড়া, কোথাও মায়া-মমতার ছায়াটুকুও নেই। জীবনের এমন এক নির্মম পরিহাস।
মেজ ছেলের কামাই কমে আসায় টাকাপয়সার টান পড়লে ছোবাহানের স্ত্রী বলল, ঘরে তো খাওয়ার মতো কিছুই নেই। ছোবাহান অন্ধ চোখের দুই ফোঁটা জল ফেলে বলল, আর কইও না কিছু মোরে, কাইল বেইল ওডার আগেই যেন মোর মরণ অয়!
চারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
৬ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
১৩ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
১৩ দিন আগেদ্য ভেজিটেরিয়ানের পর হান কাঙের পরের উপন্যাস ছিল ‘দ্য উইন্ড ব্লোজ, গো’। এই উপন্যাস লেখার সময়ই ঘটে বিপত্তি! হান অনুভব করেন তিনি আর লিখতে পারছেন না। গত বছর নিজের পঞ্চম উপন্যাস ‘গ্রিক লেসন’ ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হলে স্পেনের এল-পাইস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি।
১০ অক্টোবর ২০২৪