তপনের কথা শেষ হতে পারে না। আমরা অবাক হাসিতে ফেটে পড়ি। হাসতে হাসতে চোখে পানি আসে। তারপরও আমরা হাসি। বলা যায় হাসির ফোয়ারায় আমরা আপাতত ডুবে আছি। পেটের গহিন থেকে হাসি ঠমকে ঠমকে উঠে আসছে। আমরা হাসিকে বাঁধ দিয়েও রুখতে পারছি না। আশপাশের লোকজন বিস্ময়ে আমাদের হাসি দেখছে আর ভ্রু কুঁচকে যা-তা বলছে।
বলুক। তাতে আমরা থোড়াই কেয়ার করি। আমাদের চলছে হাসির মচ্ছব। অনেকক্ষণ হাসার পর পেট চেপে ধরে শব্দ না করে কেবল দাঁত বের করে হাসছে আমজাদ। হাসতে হাসতে আমার ক্লান্তি এসে গেছে। চেয়ারে শরীর এলিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে হাসি বন্ধ করার চেষ্টা করছি আমি। কাঁহাতক আর হাসা যায়! অন্যদিকে সুমন শরীর দুলিয়ে এখনও হেসে যাচ্ছে। তপন তাড়িয়ে তাড়িয়ে আমাদের লবেজান অবস্থা দেখছে আর ঠোঁটের কোনায় ঝুলিয়ে রেখেছে তেরছা মৃদু হাসি।
সুমনের বাবা বিরাট কন্ট্রাক্টর। তার দরকার প্রচুর রড-সিমেন্ট। হিসেবি মানুষ। নিজের দোকান থেকে কিনলে দুই প্রকার লাভ। কিছুটা কম দামে রড-সিমেন্ট কেনা যায়, আবার দোকান থেকেও কিছু আসে। আমাদের ধারণা, সুমনকে টাইট দেওয়ার কৌশল হিসেবে আংকেল এই দোকানের আয়োজন করেছে। কারণ সপ্তাহের তিন দিন সুমনকে বাধ্যতামূলক মেসার্স সোনার বাংলা এন্টারপ্রাইজে বসতে হয় সকাল-বিকেল। সুমন যেহেতু আমাদের বন্ধু, সুতরাং আমরাও আসি আড্ডা দিতে সুমনের দোকানে। সুমনও আমাদের প্রশ্রয় দেয়। ক্যাশ থেকে টাকা বের করে ডিম-পরোটা, মোগলাই-পরোটা, চা-সিগারেট খাওয়ায়। মেসার্স সোনার বাংলা এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার তপন মাহমুদ আমাদের চেয়ে সামান্য সিনিয়র হলেও ভদ্রলোকের বন্ধুসুলভ আচরণের কারণে সে অতি অল্পদিনের মধ্যে আমাদের একজন হয়ে যায়। তপন গ্রামের মানুষ। বরিশালের আদি বাসিন্দা। অকৃত্রিম আর প্রাঞ্জল তার কথাবার্তা। গ্রামের মানুষ হিসেবে তার ভান্ডারে রয়েছে বিপুল এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতা। প্রসঙ্গ এলে মাঝেমধ্যে দু-একটা ঘটনা বলে আসর মাত করে দেয়।
আজকে তার প্রেমসম্পর্কিত ঘটনা বলছিল। পাশের গ্রামের মেয়ে সুমাইয়ার সঙ্গে প্রেম করে তপন। সুমাইয়ার বাবা খুব মেজাজি মানুষ। কলেজ থেকে আসা-যাওয়ার পথে দেখা এবং কথা হয়। সুমাইয়ার চাচাতো ভাই হুমায়ুনেরও ইচ্ছা ওর সঙ্গে প্রেম করে, কিন্তু তার আগে তপনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে সুমাইয়া। ব্যাপারটা ভালোভাবে নেয় না হুমায়ুন। সে নানা কৌশলে সুমাইয়া আর তপনের প্রেমঘটিত ঘটনা তার চাচার কাছে প্রকাশ করে এবং তপনের চরিত্র নিয়ে বিশদ অপব্যাখাও জুড়ে দেয়। ফলে পিতা হিসেবে মেয়ের ভবিষ্যৎ রক্ষায় সে নেমে পড়ে কোমর বেঁধে।
সুমাইয়ার বাবা সেকেন্দার আলী মেয়ের ওপর প্রথম আদেশ জারি করেন কলেজে যেন ভুল করেও তপনের মতো একটা বখাটে আর অমার্জিত ছেলের সঙ্গে কথা না বলে।
বাবার আদেশ শুনে চমকে উঠলেও ভেতরে ভেতরে হাসে সুমাইয়া। কলেজে ক্লাস করব, না তপনের সঙ্গে কথা বলব—সেটা আমার ব্যাপার। কিন্তু গম্ভীর পিতার সামনে ভয়ে কম্পমান হয়ে ঘাড় কাত করে পিতার আদেশের প্রতি নিজের আনুগত্য প্রকাশ করে। পিতা খুব খুশি হন। সুমাইয়া কলেজে এসে যথারীতি পিতার আদেশ ভুলে তপন মাহমুদের সঙ্গে আড্ডায় মাতে। পেছনে লেগে থাকা ব্যর্থ প্রেমিক হুমায়ুন, সে খবর অনেক বড় করে পৌঁছে দেয় চাচা সেকেন্দার আলীর কানে। পিতার পৌরুষ জেগে ওঠে। সে সুমাইয়ার কলেজে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। একলা অসহায় মেয়ে ফাঁদে পড়ে কাঁদে আর স্মৃতি রোমন্থনে দিন কাটায়। ব্যর্থ প্রেমিক হুমায়ুন এবার সুযোগ বুঝে মাঠে নামে। সে ইনিয়ে-বিনিয়ে চিঠি লিখে প্রেম নিবেদন করে সুমাইয়াকে। সুমাইয়া চিঠি পেয়ে উল্টো পিঠে লিখে পাঠায়, ‘তুই একটা খচ্চর’।
এদিকে সুমাইয়ার পিতা সেকেন্দার আলী মেয়ের বিয়ের টেন্ডার পাঠায় নানা জায়গায়। দ্রুত সাড়া আসে অবিবাহিত তরুণ এবং তাদের গার্ডিয়ানদের কাছ থেকে। প্রথম কারণ—সুমাইয়ার স্নিগ্ধ সৌন্দর্য আর দ্বিতীয় কারণ, সুমাইয়ার পিতা সেকেন্দার আলীর সম্পদ। সুমাইয়ার বিয়ের টেন্ডারের খবর যথাসময়ে পৌঁছে যায় তপনের কাছে। অনেক ভেবেচিন্তে একটা বড়শি ফেলে তপন। সেকেন্দার আলীর অনেক দিনের কাজের লোক জয়নালকে সে বাজারের রসময় ময়রার দোকান থেকে পেটভরে রসগোল্লা খাওয়ায় এবং নগদ দু শ টাকা বিনিয়োগ করে একটি চিঠি পাঠায় সুমাইয়ার কাছে। যে চিঠিতে মূল খবর ছিল—‘আজ রাত নটায় তোমাদের পেছনের পুকুরপাড়ে এসো। তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।’
অনেক শংকা আর টেনশন নিয়ে তপন কালো জামা গায়ে সেকেন্দার আলীর বাড়ির পেছনের পুকুরপাড়ে উপস্থিত হয় ঘুটঘুটে অন্ধকারে। গ্রামের লোকেরা ইতিমধ্যে ঘুমের আয়োজন করেছে। মশার বহুমুখী আক্রমণে দিশেহারা তপন হঠাৎ দেখে তার দিকে একটা মানুষ এগিয়ে আসছে। আকার-আয়তন দেখে বুঝতে পারে একজন মেয়েই আসছে। তপন এগিয়ে যায় এবং খপ করে হাত ধরে। ‘আসতে এত দেরি করলে কেন সুমাইয়া? মশার কামড়ে শরীরে জ্বর আসছে। চলো, জামগাছের নিচে বসি। তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।’
‘আমি সুমাইয়া না, সুমাইয়ার মা।’ সুমাইয়ার মা ফিসফিস করে বলে। ‘প্রাণের মায়া থাকলে এখান থেকে পালাও’ 85।’
সঙ্গে সঙ্গে আমরা অবাক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি। প্রেমিকা নয়, প্রেমিকার মা চলে এসেছেন পুকুরপাড়ে। প্রায় পনেরো-বিশ মিনিট পর আমাদের হাসি থামলে তপন বলে, ‘সুমাইয়ার মায়ের কথায় আমার শরীর হঠাৎ ভয়ে পাথরে পরিণত হলো। কয়েক মুহূর্ত নড়তেই পারলাম না। তখন সুমাইয়ার মা তার হাতের বদনা থেকে আমার গায়ে পানি ঢেলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আমি দৌড়ে যে পথে এসেছিলাম, সে পথে হারিয়ে গেলাম।’
‘কিন্তু সুমাইয়ার মা কেন এল? সুমাইয়া এল না কেন?’ প্রশ্ন করি আমি।
‘পরে জেনেছি, জয়নাল চিঠিটা ইচ্ছা করেই সুমাইয়ার মায়ের হাতে দিয়েছিল।’
‘কেন? লোকটাকে এতো খাইয়েছে!’ জানতে চায় সুমন।
সুমনের কথার মধ্যে ঢোকে আমজাদ। ‘তার ওপর নগদ দু শ টাকা?’
তোমাদের প্রশ্ন ঠিকই আছে; কিন্তু জয়নালের কথা আরও ঠিক।
‘মানে?’ প্রশ্ন আমজাদের।
তপন খুব মজা করে হাসে। আসল কথাই বলা হয়নি। অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে সুমাইয়ার সঙ্গেই আমার বিয়ে হয়েছে। এবং বিয়ের পর জয়নালকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি আমার চিঠিটা সুমাইয়ার হাতে না দিয়ে ওর মায়ের হাতে কেন দিলেন?’
‘কী উত্তর দিল সে?’ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে জিজ্ঞেস করে আমজাদ।
তার উত্তরের পর আমি আর কোনো উত্তর দিতে পারিনি। জয়নাল বলেছিলেন, ‘আপনে আমারে পেট ভইরা একদিন মিষ্টি খাওয়াইলেন আর দু শ টাহা দিয়া আমারে কিনবার চাইলেন। যার বাড়িতে বছরের পর বছর কাম করি, খাই, ঘুমাই, তার সর্বনাশ আমি কেমনে করি? আপনে কন? সেই জন্য অনেক চিন্তাভাবনা কইরা চিডিটা খালাম্বার হাতে দিচি। খালাম্বা অনেক জ্ঞানী মানুষ, সে সব সামলাইবে, আমি জানতাম। দেহেন সে সব ঠিক কইরা দিচে না?’
সুমন মন্তব্য করে, ‘বাহ্, জয়নাল মিয়াতো খুব নীতিবান লোক।’
‘তুই থাক তোর নীতি নিয়ে, আমরা নাচতে থাকি।’ আমি উল্লাসে নাচতে থাকি। আমার সঙ্গে যোগ দেয় আমজাদ। তপন মাহমুদ হাসে আর আমাদের নাচ ও আনন্দ উপভোগ করে। এই নাচ ও আনন্দের মধ্যে সুমন ঘোষণা করে, ‘আজ রাতে সে আমাদের ভোজনে আপ্যায়িত করবে।’ আমরা দ্বিগুণ আনন্দে নাচতে থাকি।’ অনেকক্ষণ নাচার পর আমরা ক্লান্ত হয়ে বসলে তপন একটু আবেগ নিয়ে বলে, ‘অবশ্য এই বিয়ের পেছনে সুমাইয়ার অবদান অনেক বেশি। আমার সঙ্গে সংসার করার জন্য পিতার সংসারে থেকেই পিতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।’
‘এখন বলুন, সংসার সুখের তো?’ জানতে চায় আমজাদ।
গভীর তৃপ্তির সঙ্গে জবাব দেয় তপন মাহমুদ। ‘জগতে যদি একটা সুখের সংসার থাকে সেটা আমাদের সংসার। আর সুমাইয়ার স্যাক্রিফাইসের কোনো তুলনা হয় না।’
আমাদের কথাবার্তার মধ্যে পাশের রেস্টুরেন্ট থেকে চা আসে। আমরা চায়ে চুমুক দিয়ে সিগারেটে টান মারছি আর ধোঁয়া উগরে দিচ্ছি। এক ধরনের সুখের সায়রে নাও ভাসাইয়া আমরা ভাসতেছি। আপাতত আমাদের কোনো কাজ নেই। বাপের হোটেলে খাই আর আড্ডা মেরে সময় নিহত করি।
চা-পান আমাদের প্রায় শেষ। উঠব উঠব করছি। ঠিক এ সময়ে সোনার বাংলা এন্টারপ্রাইজের সামনে একজন ভিক্ষুক আসে দশাসই চেহারার। স্বাস্থ্যবান, গায়ের রঙ হালকা ফর্সা, মুখে বেশ লম্বা কাঁচা-পাকা দাড়ি, মাথার ওপর অনেক ময়লা টুপি, ডান হাতে তসবি। তার বাম হাত ধরে এগোচ্ছে সাত-আট বছরের একটি মেয়ে। মেয়েটির হাতে অ্যালুমিনিয়ামের একটি বাটি। বাটিতে বেশ কয়েকটা এক টাকার কয়েন এবং দু-তিনটি ছেঁড়া দুই টাকার নোট।
‘বাজান, ভিক্ষা দেন।’ লোকটা খুব সাবলীলভাবে বলে দাঁড়িয়ে হাতের তসবিহ টিপতে থাকে। সঙ্গের মেয়েটা হাতের বাটি বাড়িয়ে ধরে। আমাদের অবারিত আনন্দের মধ্যে এই লোকটি এবং মেয়েটি কদাকার দৃশ্য হয়ে উপস্থিত হয়েছে। তপন মাহমুদ ড্রয়ার খুলে একটা দু টাকার নোট বের করে মেয়েটির বাটিতে রাখে।
‘চাচা চলো।’ মেয়েটি সামনে হাঁটতে শুরু করে। লোকটিও মেয়েটির পেছনে হাঁটতে শুরু করে। সুমন ওদের দিকে বিশেষ করে লোকটির দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে পলকহীন চোখে।
‘কি রে সুমন? ধাক্কা দেয় আমজাদ। ‘লোকটির দিকে অমন করে তাকিয়ে আছিস কেন?’ আমজাদের ধাক্কায়ও কাজ হয় না, সুমন লোকটির দিকে তাকিয়েই থাকে। মনে হচ্ছে, সুমন গভীর কোনো স্মৃতি খুঁজে ফিরছে। আমাদের মনের ভাবনা শেষ হতে পারে না। সুমন ডাক দেয়, ‘চাচা? শোনেন তো একটু...’
কিন্তু ভিখারিকে কেউ ‘চাচা’ সম্বোধন করতে পারে বা করে, হয়তো সে অভিজ্ঞতা ভিখারির নেই বা ছিল না। সুতরাং সে বারেক না তাকিয়েই হন হন করে মেয়েটির সঙ্গে হাঁটতে থাকে, যদি অন্য কোথাও আর একটি টাকা উপার্জন করা যায়, এই আশায়। সুমন গদি ছেড়ে স্প্রিং দেওয়া পুতুলের মতো লাফিয়ে ওঠে এবং পলকে লোকটির কাছে ছুটে যায়। আমরা অবাক চোখে তাকিয়ে আছি, তাকিয়ে ঘটনার তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টা করছি। লোকটি কি সুমনদের আত্মীয়? কিংবা খুব পরিচিত? অথবা প্রতিবেশী?
আমি আর আমজাদ তপনের দিকে তাকাই। তপন মাহমুদও ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে আছে সুমনের দিকে।
তপন ভাই তাকায় আমার দিকে। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘চেনেন নাকি লোকটাকে?’
‘নাহ্’—তপন এক কথায় না করে দেয়। ‘কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।’
‘তাহলে লোকটা কে?’ সুমনের এতো আগ্রহ কেন ভিখারি লোকটার প্রতি? আমাদের ভাবনার মধ্যে সুমন লোকটাকে খুব যত্নের সঙ্গে ধরে এনে বসায় আমাদের সামনে একটা খালি চেয়ারে। নিজেও বসে আগের চেয়ারে। সুমন যেন এখন আমাদের চেনে না। ওর সব মনোযোগ ভিখারি লোকটার প্রতি। ভিখারি সঙ্গের মেয়েটিকেও বসতে দেয় আর একটি চেয়ারে। হঠাৎ অভাবনীয় সম্মানে ভিখারি এবং মেয়েটি খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেও, তারা এটাকে উপভোগ করতেও শুরু করে।
‘কী খাবেন চাচা?’ সুমন জিজ্ঞেস করে ভিখারি লোকটাকে।
লোকটা প্রাণ খুলে হাসতে শুরু করে। ‘বাজান, আমি ভিখারি মানুষ। যা পাই খাই। কোনো কিছু চাইয়া খাই না।’
‘তারপরও বলুন। আজ আপনি যা বলবেন আমি খাওয়াব। এখানে মুরগির বিরিয়ানি পাওয়া যায়। গরুর মাংসের ভুনা খিচুড়িও আছে। সাদা ভাত আছে। কোনটা খাবেন?’ সুমন খুব সম্মানের সঙ্গে জানতে চায়।
মেয়েটা লোকটার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে একটা কিছু বলে। অমায়িক হাসিতে লোকটার মুখ থইথই করে ওঠে, ‘বাজান, আমার সঙ্গে মাইয়াটা আমার ছোট ভাইয়ের মেয়ে। ওর বাপ মারা গেছে। মাইয়াটার নাম দরদী। ও আমার লগে থাকে। দরদী মুরগির সালুন দিয়া সাদাভাত খাইতে চায়। আপনের কি খুব অসুবিধা অইবে?’
‘আরে না। দু-তিন মিনিটের কারবার।’ সুমন দাঁড়ায়, ‘আপনারা বসুন, আমি আসছি।’
সুমন আবার গদি ছেড়ে বেবিয়ে পড়ে। মেসার্স সোনার বাংলা এন্টারপ্রাইজের ঠিক উল্টোদিকে হোটেল মধুমিতায় ঢোকে সুমন। সাধারণত এমনটা ঘটে না। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে এপার থেকে ডাক বা ইশারা দিলে হোটেল মধুমিতার কোনো একজন মেসিয়ার ছুটে আসে। কারণ ভালো সেলামি মেলে এখানে। আবার অনেক সময়ে আমরা নিজেরাই হোটেল মধুমিতায় প্রবেশ করি।
‘বাজানের মনে গরিবের লাইগা অনেক দরদ।’ ভিখারি লোকটা আপন মনে না কি আমাদের শুনিয়ে কথাটা বলে, ঠিক ঠাহর করতে পারি না আমরা। কিন্তু একটা বিষাদ বিরক্তিতে আমাদের মন ভরে গেছে। সুমন কি আমাদের ওর সংবেদনশীল মনের পরিচয় দেখানোর জন্য হঠাৎ এই আয়োজনে নেমেছে? না ও-তো এমন মানুষ না। তা হলে? হঠাৎ কী কারণে এই ভিখারি লোকটা ওর কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ হলো?
‘রাহাত?’ আমার কাঁধ খামচে ধরে আমজাদ।
আমি ওর দিকে তাকাই। ও ইশারা করলে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাই এবং তাকিয়েই হতবাক। সুমন নিজের হাতে ভাতের প্লেট নিয়ে আসছে দুই হাতে। পেছনে হোটেলের বয়। বয়ের হাতে মুরগির মাংসের বাটি, পানির জগ ও গ্লাস। সব এনে টেবিলের ওপর রাখে।
‘চাচা, শুরু করুন।’
দরদী চটপট টাইপের মেয়ে। সে দ্রুত তার চাচার হাত ধুইয়ে প্লেট টেনে ধরিয়ে দেয়। নিজেও হাত ধুয়ে অন্য প্লেট টেনে মুরগির সালুন পাতে নিয়ে দ্রুত খেতে আরম্ভ করে খুব সাবলীলভাবে। আমরা যে কয়েকজন মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এ নিয়ে কোনো ভাবান্তর দেখলাম না। আমাদের নাকে মুরগির মাংসের গন্ধ এসে ধাক্কা দেয়। পুরো পরিবেশটা কেমন অসহ্য হয়ে উঠল। আমজাদ তাকায় আমার দিকে। ‘রাহাত, চল।’
‘চল।’ আমি দাঁড়াই।
খপ করে হাত ধরে সুমন। ‘আরে, আর একটু বস।’
‘তা হলে আমি যাই?’ আমজাদ বলে। ‘আমার একটা জরুরি কাজ আছে।’
না, যাবি না তোরা কেউ। বস। তোদের সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।’ খুব সিরিয়াসভাবে বলে সুমন।
আমজাদ অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকায়। আমি ওদের খাওয়ার দৃশ্য থেকে চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রাস্তায় চলাচলরত যানবাহন দেখতে থাকি। যানবাহন দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। একটা বাসের মধ্যে হরেকরকম মানুষ গাদাগাদি আর ঠাসাঠাসি করে একে অপরের সঙ্গে গুঁতোগুঁতির দাপটে ছুটে চলে ঊর্ধ্বশ্বাসে। যেন সে না গেলে পৃথিবীর এক প্রান্ত অতলে হারিয়ে যাবে। কোথায় যায় এতো মানুষ? আমার ভাবনা আমার ভেতর বেশিক্ষণ ক্রিয়া করতে পারে না সুমনের সংলাপের কারণে।
‘চাচা?’ ডাকে সুমন।
সুড়ুৎ সুড়ুৎ ঝোল টেনে খেতে খেতে কথা বলে লোকটা। ‘বলেন বাজান।’
‘আপনার নাম কী?’
‘বাজান নাম দিয়া কী করবেন? আমি রাস্তার সামান্য ফকির মানুষ। ভিক্ষা কইরা খাই।’
‘কিন্তু আমি আপনার নাম জানি।’
লোকটার ছলাৎ ছলাৎ খাওয়ার গতি হঠাৎ থেমে যায়। ‘আপনে আমার নাম জানেন?’
‘জানি। আপনার নাম তোবারক। লোকে আপনাকে জবাই তোবারক বলত। কি আমি ঠিক বলেছি?’
তোবারক খাওয়া থামিয়ে তাকায় সুমনের দিকে। ‘আপনে যহন খুব যত্ন কইরা বসাইতেছিলেন তহনই আমার মনে কেমন সন্দেহ হইতেছিল। বাজান, যা হবার হইয়া গেছে, আগের কথা আর সামনে টানতে চাই না।’ লোকটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার খাওয়ায় মন দেয়।
আমরা-আমি, আমজাদ আর তপন মাহমুদ একটা অন্য রকমের ঘটনার সন্ধান পাই। সুমন লোকটার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। লোকটাকে, তোবারককে অনেক স্মৃতির ওপার থেকে চিনবার চেষ্টা করছে মনে হচ্ছে।
‘সুমন?’ ডাকে আমজাদ। ‘এই লোকটা কে?’
‘শুনবি?’
‘বল।’
আমরা আমাদের বিবমিষা ভুলে সুমনের ঘটনা শুনতে বসে গেলাম।
‘খুব শৈশবে নানা মুখে শুনতাম, তোবারক ডাকাতের নানা লোমহর্ষ ঘটনা। যে বাড়িতে তোবারক ডাকাত ঢোকে, সে বাড়িতে একটা-দুটো মানুষ খুন হবেই। খুন বললে ভুল বলা হবে, জবাই করে হত্যা। এবং এই জবাই করার কাজটা করত ডাকাত সরদার তোবারক নিজে। কারণ, মানুষ জবাই করে হত্যা করতে সে খুব পছন্দ করত। জবাই হয়ে যাওয়া মানুষটির আর্তি ও আর্তনাদ ডাকাত সরদার তোবারকের খুব ভালো লাগত। মানুষকে জবাই করার সময়ে নিজেকে তার বিধাতার মতো শক্তিশালী মনে হতো।’
সুমন বলছে আর আমরা তোবারকের দিকে তাকিয়েই আছি। লোকটা নির্বিকার। যেন শুনতে পাচ্ছে না কিছুই। তার একমাত্র কাজ খেয়ে যাওয়া, সে খেয়ে যাচ্ছে। কথার ফাঁকে সুমন আর এক প্লেট ভাত তোবারকের পাতে ঢেলে দেয়। তোবারক মুরগির মাংসের সালুন আর পাতলা ডালের সঙ্গে ভাত মেখে মেখে মুখে দিতে থাকে। মনে হয় তার পেটে অনন্তের ক্ষুধা।
‘আমরা তখন সিক্সে কিংবা সেভেনে পড়ি। এ সময়ে আমাদের বাড়িতে ডাকাত সরদার তোবারক চিঠি পাঠায়।’
‘লোকটা চিঠি দিয়ে ডাকাতি করত?’ প্রশ্ন আমজাদের।
‘হ্যাঁ। বড় বড় ডাকাতেরা চিঠি দিয়ে ডাকাতি করত একসময়ে। তখন দেশ সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। চারদিকে পাকিস্তানিদের ধ্বংসযজ্ঞ। আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ ততটা মজবুত হয়ে বসতে পারেনি। এ সুযোগটা গ্রহণ করেছিল মানুষরূপী হায়েনাদের অনেকগুলো দল। শোনা যায়, তারা মুক্তিযুদ্ধের নামে অপকর্ম করে বেড়াত। বলা যায়, এরা ছিল রাজাকার-আলবদরদের একটি শাখা সংগঠন। তাদেরই একটি শাখা দলের প্রধান ছিল এই তোবারক ডাকাত। তার দলের নৃশংসতার খবর লোকের মুখে মুখে ফিরত। শুনেছি, ছোট বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে কিংবা ভাত খাওয়াতে তোবারক ডাকাতের ভয় দেখাত মা-চাচিরা।’
‘তোদের বাড়িতে তোবারক ডাকাত এসেছিল?’ সামনে বসে তোবারক ডাকাতকে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করি আমি। আমার কেমন যেন সন্দেহ জাগে। সুমন আমাদের সন্মোহিত করতে চাইছে। একজন খুনে রক্তপিপাসু ডাকাতকে সামনে বসিয়ে আদরে-যত্নে মুরগির সালুন দিয়ে সাদাভাত খাওয়াতে খাওয়াতে আমাদেরকে কোনো এক বধ্যভূমিতে নিয়ে যাচ্ছে ও?
মৃদু হাসে সুমন। ‘এসেছিল মানে? অবশ্যই এসেছিল। নইলে এই তোবারক ডাকাতকে চিনলাম কী করে?’
‘তোর শৈশবের ঘটনা মনে আছে?’ মৃদু সংশয় প্রকাশ করে আমজাদ।
‘পুরোটা শোন। তা হলে বুঝবি, শুধু আমার নয়, যেকোনো মানুষেরই মনে থাকবে সেই লোমহর্ষ ঘটনা ও ঘটনার মানুষকে।’
‘বল।’ অনুমতি দেয় আমজাদ।
‘আমাদের বাড়িটা অনেক বড়। এগারোটা ছোটবড় ঘর। প্রত্যেক ঘরে যদি দুজন করে তরুণও থাকে, সর্বমোট বাইশজন। কিন্তু ছিল আরও অনেক বেশি তরুণ চাচাতো-মামাতো ভাই মিলে। এলাকার লোকজন আমাদের বাড়ির কারও সঙ্গে পারতপক্ষে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করতে যেত না। একডাকে আমাদের বাড়ি থেকে বিশ-পঁচিশজন লোক বের হয়ে আসত। আবার ভেতরের ব্যাপার ছিল ভিন্ন। বাইরে একতা থাকলেও ভেতরে ভেতরে কিন্তু একে অন্যের শত্রু ছিল। কেউ কারও চেয়ে খেয়েপরে ভালো থাকুক, অন্যরা চাইত না। কিংবা ধর, কারও ছেলেমেয়ে পড়াশোনায় ভালো করল, এটা নিয়েও ঈর্ষা হতো। ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতেও ঝামেলা করত কেউ কেউ।’
‘ইন্টাংরেস্টিং তো!’ আমি ফোড়ন কাটি।
‘যেখানে বেশি মানুষ, সেখানেই বেশি সংঘাত, ঈর্ষা আর মানুষের ঠুনকো বড়াই থাকবেই।’
ধমক দেয় আমজাদ। তোর তত্ত্বকথা রাখ। সামনে বাড়।’
তোবারক ডাকাতের খাওয়ার গতি কমে গেছে। সে খেতে পারছে না। মনে হচ্ছে, মেসার্স সোনার বাংলা এন্টারপ্রাইজের দোকান থেকে পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে। বারবার পানি খাচ্ছে। গলায় মুরগির সালুন আর সাদাভাত আটকে যাচ্ছে। মেয়েটি, দরদী, নির্বিকারভাবে হাপুসহুপুস খেয়ে যাচ্ছে। হয়তো জানেও না একজন লোমহর্ষ ডাকাতের সঙ্গে সে ভিক্ষার ব্যবসা করে।
অতবড় বাড়ি। প্রচুর লোক। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সবাই ছিল না। কেউ কেউ ইসলামের নামে পৃথিবীর অবাস্তব রাষ্ট্র পাকিস্তানকেও সমর্থন দিয়েছিল। আমাদের বড় চাচা সরাসরি পাকিস্তানের দালাল ছিল। তার ধারণা ছিল, পাকিস্তান না থাকলে দুনিয়ায় ইসলাম থাকবে না। অথচ তথাকথিত পাকিস্তান জন্মানোর আগে কয়েক শ বছর আগে ইসলাম পৃথিবীতে এসেছিল। আরও কয়েকজন ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। আমরা পুরো পরিবার স্বাধীন বাংলার পক্ষে। আমার বড় ভাই মাসুদ ভাইকে তো তোরা চিনিস। সে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। থাকত ইকবাল হলে। এখন যেটা সার্জেন্ট জহুরুল হক হল। ছাত্রলীগের মাঝারি সাইজের নেতা। বাবা তো সরাসরি শেখ মুজিবের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন। আমাদের এলাকায় মিটিং করতে এলে শেখ মুজিব আমাদের বাড়িতে উঠতেন। ফলে একটা বাড়িতে অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করছিল। আমরা যারা ছোট, অত না বুঝলেও পরিবারের সেই সৌহার্দ্য যে নেই বুঝতাম। একেক পরিবার পাশাপাশি থাকলেও সুযোগ বুঝে রাজনৈতিক স্বার্থ বুননের চেষ্টাও ছিল। এত কিছুর পরও মুক্তিযোদ্ধা ছিল প্রায় আঠারো-উনিশজন সারা বাড়িতে। তোবারক ডাকাতের চিঠি পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের লুকিয়ে রাখা অস্ত্র বের করে আনে।’
‘বাহ্! এতো দেখছি রীতিমতো যুদ্ধ!’ বিস্ময় প্রকাশ করে তপন।
‘তপন ভাই ঠিকই বলেছেন।’ সমর্থন করে সুমন। ‘সেটা সত্যি একটা যুদ্ধই ছিল। বাড়ির পেছনে ট্রেঞ্চ করা হয়েছিল। যে রাতে ডাকাত আসার কথা, সে রাতে শিশু ও নারীরা সন্ধ্যা থেকেই সেই ট্রেঞ্চে লুকিয়েছিলাম। মাঝরাতে আমরা শুনেছিলাম কান ফাটা অজস্র গুলির শব্দ। একসময়ে আর কিছু মনে নেই—আমরা ঘুমিয়ে যাই। খুব সকালে ঘুম ভাঙলে দেখি, বাড়ির সামনে হাজার হাজার মানুষ। মানুষের সেই মিছিল আর শোরগোল লক্ষ্য করে এগিয়ে দেখি, অনেকগুলো মানুষ হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাটিতে মুখথুবড়ে পড়ে আছে। আর ছেলে-বুড়ো যে যেভাবে পারছে লাথি-কিল-গুঁতো দিচ্ছে। কেউ কেউ লাঠি দিয়ে আচ্ছা করে পেটাচ্ছে। লোকগুলো নির্বিকারভাবে মুখ বুঝে সব সহ্য করে যাচ্ছে, আর ফ্যাল ফ্যাল করে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। সেদিন না বুঝলেও আজ বুঝতে পারি, কী ছিল সেই দৃষ্টিতে।’
‘বল তো কী ছিল তাদের দৃষ্টিতে?’ জিজ্ঞেস করে আমজাদ।
‘তাদের দৃষ্টিতে ছিল নিখাদ বিস্ময়। যারা এতদিন মানুষ মেরেছে, মানুষের সংসার লুট করেছে, আজ সেই তারা লুটের শিকার? বসে বসে মার খেয়েও সেটা মানতে পারছিল না তারা।’
মৃদু হাসে আমজাদ। ‘তোর মধ্যে এক সাংঘাতিক দার্শনিক বাস করে রে সুমন। এতদিন জানতে পারিনি।’
প্রতি উত্তরে সুমনও মৃদু হাসে।
‘তোর সেই লোকগুলোই তো এই তোবারক ডাকাত দলের সদস্য?’ আমি জানতে চাই।
‘ঠিকই বলেছিস।’ সুমন তাকায় আমার দিকে। ‘তোরা আমাকে বোকা ভাবতে পারিস। কিন্তু আমি সত্যি বলছি, ডাকাত যে মানুষ, আমি এদের না দেখা পর্যন্ত জানতাম না সেই কিশোর বয়সে। আমি ভাবতাম, যারা মানুষকে এমন নিপীড়ন করে, আনন্দের সঙ্গে জবাই করে তারা ভিন্ন জাতের কোনো প্রাণী। মানুষ হয়ে মানুষকে এমন নির্দয়ভাবে খুন করে কীভাবে? যেমন ধর, মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার-আলবদর জামায়াতের নির্মম খুনোখুনির কথা শুনতাম, এরাও যে মানুষ জানতাম না। ভেবেছি এরা এক ধরনের জন্তু বা জানোয়ার। কিন্তু বড় হয়ে যখন বুঝতে পারলাম এই খুনিরাও মানুষ, তখন বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি। যারা কেবল চিন্তার পার্থক্যের জন্য একই ধর্মের মানুষ হয়েও হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে প্রতিবেশী বা স্বদেশের মেধাবী মানুষদের, তারা কেমনে মানুষ হয়? এ প্রশ্নের উত্তর আজো পাইনি।’
সুমনের ভেতর যে এমন চিন্তার বিস্তার আছে, আমরা সত্যি জানতাম না। ওকে দেখতাম ভাসমান পদ্মর মতো সদাহাস্য মুখ। দিন-রাত হাসি-আনন্দের স্রোতে গা লাগিয়ে থাকে। আসলে প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব একটা ভুবন থাকে। যে ভুবন একান্ত তার নিজের। আজকে বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো তোবারক ডাকাতের মুখোমুখি না হলে সুমনের গভীর অন্তরলোকের এই বিচিত্র মানবিক ভাবনার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হতো না।
‘চাচাজান?’ দরদী ডাকে তোবারক ডাকাতকে। দরদীর খাওয়া শেষ। সে খুব যত্নের সঙ্গে ডান হাতের সালুনমাখা আঙুলগুলো চাটছে।
তোবারক ডাকাতের খাওয়াও শেষ। তার ডান হাতখানা চেটেপুটে খাওয়া ভাতের থালার মাঝখানে ছিন্ন জামরুলের মতো স্থির। মুখ ভাবলেশহীন। তার শ্বাসপ্রশ্বাস বেড়ে গেছে। শব্দ করে শ্বাস নিচ্ছে সে। ইতিমধ্যে মেসার্স সোনার বাংলা এন্টারপ্রাইজের টেবিল ঘিরে একটা ছোটোখাট জটলা জমেছে। আশপাশের দোকানের লোকজন এসে সুমনের মুখে তোবারক ডাকাতের ঘটনা শোনে আর বিস্ফোরিত চোখে সামনে বসা জ্বলজ্যান্ত তোবারককে দেখে। তোবারকও বুঝে গেছে, সে এক চিড়িয়াখানার জন্তু বনে গেছে।
‘হ্যাশে আপনেরা তোবারক ডাকাইতরে কী করলেন?’ পাশের দোকানের এক কর্মচারী জানতে চায়।
‘আমার তো কিছু করার ছিল না, যা করার বড়রাই করেছে। আমি এবং আমার বয়সের ছেলেমেয়েরা দেখেছি। এখন আপনাদের যা বলছি, আমার সেই সময়ের দেখা দৃশ্যাবলি থেকেই বলছি এবং পরবর্তী সময়ে বড় ভাইদের বলা ঘটনা থেকে।’ সুমন যেন উপস্থিত জনতাকে একটা কৈফিয়ত দিচ্ছে।
এতক্ষণ আমজাদ চুপ থাকার পর মুখ খোলে। ‘তোর বড় ভাইয়েরা খুব খারাপ একটা কাজ করেছে রে সুমন।’ ওর কণ্ঠে খানিকটা ক্ষোভ।
‘কীভাবে?’
‘এই খুনে রক্তপিপাসু ডাকাতটাকে বাঁচিয়ে রেখে মস্ত অন্যায় করেছে তারা।’
‘সেটা তাদের ব্যাপার ছিল। তবে তাদের বিচারটা মনে হয় ভালোই হয়েছে’—বলে সে তাকায় তোবারক ডাকাতের দিকে। ‘আপনি কি বলেন তোবারক সাহেব?’
হঠাৎ তোবারক ডাকাত তার দশাসই শরীর কাঁপিয়ে টেবিলে মাথা রেখে হাহাকার করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। উপস্থিত লোকসকল এই হঠাৎ কান্নার জন্য প্রস্তুত ছিল না। যে ডাকাত নিজের হাতে মানুষ জবাই করার সময়ে নিজেকে বিধাতা ভাবত, জবাই করে মানুষের টাটকা রক্তে হাত ডুবিয়ে দেয়ালে দেয়ালে ছবি আঁকত, সেই তোবারক ডাকাতের এমন সকরুণ আত্মসমর্পণ কেউ আশা করেনি। তারা ভেবেছিল, সুমনের কথা শেষ হওয়ার আগেই তোবারক ডাকাত রাগে-ক্ষোভে চিৎকারে ফেটে পড়বে। সুমনকে কেটে টুকরো টুকরো করে মহাসড়কের কংক্রিটে বিছিয়ে সুনামির সর্বনাশে অবাক অট্টহাসিতে নাচবে। সেখানে সে কি নির্বিকার! তার এই নির্মম নির্বিকারত্ব উপস্থিত লোকসকল মানতে পারছে না। তারা চায় তোবারক ডাকাত একটা ভয়ংকর হুঙ্কার দিয়ে আবার মাঠে নামুক। দেখিয়ে দিক তার প্রবল প্রতাপ আর...’
দরদী এবার বিচলিতবোধ করে। সে তার এতদিনের পরিচিত চাচাকে অপরিচিত আঙিকে কাঁদতে দেখে হতবাক। দরদী তার চাচার পিঠে হাত রাখে। তোবারক তার উচ্চস্বরের কান্না থামায় এবং থেঁতলানো মিহি সুরে কাঁদতে থাকে। তার কাঁদার সঙ্গে সঙ্গে শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে।
‘বিচারে কী হয়েছিল?’ প্রতিবেশী দোকানদারদের একজন জানতে চায়।
‘আমাদের এলাকা থেকে থানা ছিল অনেক দূরে। প্রায় আট-নয় কিলোমিটার দূরে। সকালেই থানায় খবর দেওয়ার জন্য লোক পাঠানো হয়েছিল। এই ফাঁকে ডাকাতের হাতে অত্যাচারিত লোকজন হামলে পড়ে। কয়েকজন ডাকাতকে পিটিয়ে মেরে ফেলে উন্মত্ত জনতা। কিন্তু সব মানুষের ক্ষোভ এই তোবারক ডাকাতের ওপর। তাকে নিয়ে কী করা যায়? ভাবছে সবাই। থানা থেকে পুলিশ এলে ওকে নিয়ে যাবে, পুলিশ ওকে জেলে পাঠাবে এবং কয়েক বছর জেল খেটে বের হয়ে এসে আবার দ্বিগুণ উৎসাহে প্রতিশোধ নেবে। পুলিশ আসার আগে ওকে চিরকাল মনে রাখার মতো একটা শাস্তি দিতে চায় সবাই। কেউ বলে একটা হাত কেটে দিতে, কেউ বলে একটা পা কেটে দিতে। তখন আমাদের হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক গৌরকিশোর ঘোষ একটা পরামর্শ দেন, যা সবার মনে লাগে। এখানে একটা কথা বলা দরকার, গৌরকিশোর ঘোষ স্যারের তিন ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যায় এবং তিনজনই শহীদ হয়।
উপস্থিত লোকজনের মনে তৎক্ষণাৎ না দেখা শিক্ষক গৌরকিশোর ঘোষের জন্য গভীর সহানুভূতি ও সম্মান অনুরণিত হয়।
তোবারক ডাকাতের কান্না থেমে গেছে। বুঝে গেছে জীবনের গল্প তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে এভাবে। সুতরাং’ 85
‘গৌরবাবু কী সিদ্ধান্ত দিলেন?’ আমার প্রশ্ন।
‘তিনি বললেন, তোবারককে মেরে ফেলা অন্যায় হবে। ওকে এমন একটা শাস্তি দিতে হবে, যাতে বুঝতে পারে অন্য মানুষকে কষ্ট দেওয়া কত অন্যায় ছিল। তিনি বললেন, ওর চোখদুটো তুলে ওকে মুক্তি দাও। সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত লোকজন জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে স্যারের ঘোষণাকে স্বাগত জানাল।’ একটু থামে সুমন। ‘সেই সকাল, সেই দিনটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি হয়ে আছে। আমাদের এলাকার কসাই হাবিবুরকে দায়িত্ব দেওয়া হলো ওনার চোখ তোলার। হাবিবুরের ছোট বোনের বাড়িতে মাসতিনেক আগে ডাকাতি করেছে তোবারক ডাকাতের দল। লোকমুখে জানা গেছে, হাবিবুরের ছোট বোনকে ডাকাতেরা ধর্ষণও করেছে। এ কারণে বোনটা এখন হাবিবুরদের বাড়িতে। জামাই নিতে চায় না। সুতরাং হাবিবুরের ক্ষোভ ছিল ভয়ংকর রকম। অল্প সময়ের মধ্যে গরু বাঁধার দড়ি জোগাড় হলো এবং ওনাকে চোখের পলকের মধ্যে বেঁধে ফেলা হলো। হাতে সময় নেই। কারণ, পুলিশ এসে পড়তে পারে যেকোনো সময়। পুলিশ এলে চোখ তোলা যাবে না। দ্রুত ওনাকে আমাদের গ্রামের খেলার মাঠে নিয়ে গেল সবাই ধরাধরি করে। হাজার হাজার লোক চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুক্তিযোদ্ধারা পাহারা দিচ্ছে। ওনাকে চিৎ করে সবুজ ঘাসের ওপর শোয়ানো হলো। যদিও হাতদুটো পিছমোড়া বাঁধা। তারপরও চার-পাঁচজনে মিলে হাত ও পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে গেল, যাতে সে একচুল পরিমাণ নড়াচড়া করতে না পারে। হাবিবুর তার গরুর মাংস কাটার বিশেষ কায়দায় বানানো তীক্ষ্ণ চাকু নিয়ে দাঁড়ায় ওনার বুকের ওপর। তাকায় উপস্থিত জনতার দিকে। জনতার ভেতর থেকে স্বতঃস্ফুর্ত স্লোগান ওঠে, ‘জয় বাংলা’।
হাবিবুর মৃদু হেসে হাতের ছুরিটা নাচাতে নাচাতে হঠাৎ ঢুকিয়ে দেয় ডান চোখে। ফিকনি দিয়ে রক্তের একটা ধারা উঠল এবং কানে এল একটি সকরুণ বিলাপধ্বনি। আমি সেই আর্তধ্বনি আর কখনও কোথাও শুনিনি। বাতাসে কান পাতলে আমি এখনও একজন মানুষের অতিমানবিক বিলাপধ্বনি শুনতে পাই। উপস্থিত হাজার হাজার লোকের মধ্যে নেমে এল অবাক নীরবতা। মনে হলো, সেই মাঠে কোনো মানুষ উপস্থিত নেই। হাবিবুর হাতে ওনার চোখটা নিয়ে একটু পরখ করে দেখে জনতার দিকে ছুড়ে মারে। জনতা দূরে সরে যায়। চোখটা বিপুল ঘাসের সবুজ রঙের মধ্যে ডুব দেয়। তার কয়েক মুহূর্ত পর হাবিবুর দ্বিতীয় চোখ তুলে আনে একলহমায় এবং বাতাসে ভেসে আসে আগের চেয়েও করুণ বর্ণনাতীত বিলাপধ্বনি। দ্বিতীয় চোখ হাতে নিয়ে হাবিবুর নেমে আসে ওনার বুকের ওপর থেকে। অন্যরাও নামে। শরীরের ওপর থেকে লোক সরে গেলে তোবারক সাহেব উঠে বসার চেষ্টা করে। কিন্তু হাত-পা বাঁধা থাকায় পারে না। তখন আপনি কী করেছিলেন, আপনার মনে আছে?’ সামনে বসা তোবারক ডাকাতকে খুব আলতোভাবে জিজ্ঞেস করে সুমন। যেন অনেক দিনের পরিচয় ওদের দুজনের মধ্যে।
তোবারক নিরুত্তর থাকে। দরদীর কাঁধে হাত রাখে। সে এখান থেকে চলে যেতে চায়। এখানে থাকা মানে দ্বিতীয়বার তার হত্যাদৃশ্য তাকেই উপভোগ করতে হবে।
‘আপনার মনে না থাকলেও আমার মনে আছে।’ সুমনকে আজ স্মৃতিতাড়িত কথায় পেয়েছে এবং সেই সঙ্গে পেয়েছে নিষ্ঠাবান শ্রোতা, সামনে পেয়েছে প্রধান চরিত্র তোবারককে। সুতরাং কথা তো বলবেই। ‘আপনি দড়ি পাকানোর মতো করে সারাটা মাঠে গড়িয়ে যেতে যেতে হাহাকার করে কাঁদছিলেন। মাঠে ছিল লম্বা ঘাস। আপনি সেই ঘাসের ওপর দিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে যখন শরীরে দড়ি পাকাচ্ছিলেন, যদিও আপনি অনেক মানুষকে নিজের হাতে হাসতে হাসতে খুন করেছিলেন, সেই সকালে আমাদের খেলার মাঠে উপস্থিত প্রত্যেকটি মানুষের চোখে আপনি ছিলেন গণশত্রু। কিন্তু কি আশ্চর্য! আপনার চোখদুটো উপড়ে ফেলার পর সকরুণ বিলাপ ও আর্তনাদে অনেকের চোখে আমি পানি দেখেছি। এমন কি আমি নিজেও কেঁদেছি আপনার জন্য’85 বিশ্বাস করুন।’ সুমন হাত ধরে তোবারক ডাকাতের।
‘আমি অহন যাইতে চাই।’ গলায় অসহায় ক্ষোভ।
‘আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে ভাবিনি তোবারক সাহেব। আচ্ছা, তারপর আপনাকে না পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল! শুনেছিলাম আপনার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। ছাড়া পেলেন কীভাবে?’
‘অন্ধ মানুষরে জেলেও রাখতে চায় না। তাই আমারে কয়েক বছর পর ছাইড়া দিছে।’ দাঁড়ায় তোবারক। ‘আমারে যাইতে দেন।’
‘যান আপনি। আপনাকে কেউ কিছু বলবে না।’ সুমন কথা বলতে বলতে মানিব্যাগ বের করে দরদীর হাতে দুটো পাঁচ শ টাকার নোট ধরিয়ে দেয়। দরদীর চোখেমুখে উল্লাস।
যেতে যেতে লোকটা, তোবারক, ফিরে তাকায়। ‘বাজান, আপনেরে একটা কথা কই?’
‘বলুন।’
‘আপনেরা যদি আমারে অন্ধ না কইরা মাইরা ফালাইতেন, অনেক ভালো অইত।’ তার কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে। ‘পথে পথে ভিক্ষা কইরা কুত্তা-বিলাইয়ের মতো আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না। কতদিন মরতে চাইছি; কিন্তু সেই সব মানুষের মরণের কষ্ট মনে পইড়া যায়... মনে পইড়া যায়। আর মরতে পারি না’ 85’
লোকটা ধিকিধিকি আগুনের মধ্যে দরদীর কাঁধে হাত রেখে হেঁটে হেঁটে চলে যায়।