মন্টি বৈষ্ণব, ঢাকা
প্রকৃতির সঙ্গে সংগীতের রয়েছে অদ্ভুত এক সম্পর্ক। এই যে পানি বয়ে চলার শব্দ, পাখির কুহু কুহু ডাক, মেঘেদের ছুটে চলা, গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ার শব্দ—এসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সংগীতের সুর। অথবা বলা যায়, এসবের মাঝেই খুঁজে পাওয়া যাবে সংগীতের সুর, তাল ও লয়।
আমাদের প্রতিদিনের কাজের অনেকাংশেই যুক্ত সংগীত। দিনে কিংবা রাতে গুন গুন করে গান করেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মানুষের সুখ-দুঃখে সংগীত বন্ধুর মতো কাজ করে। তাই সংগীতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক হৃদয়ের।
সংগীতের সঙ্গে এই হৃদয়যোগের কথা কিন্তু একটুও বাড়িয়ে বলা নয়। ২০১৬ সালে জার্মান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের গবেষণা পত্রিকা ডয়চেস অ্যার্জটাব্লাট ইন্টারন্যাশনালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সংগীতের সঙ্গে সরাসরি রয়েছে হৃদয়ের যোগ। মোজার্টের মতো ধ্রুপদি সংগীতের প্রভাবে হৃদযন্ত্রের স্পন্দন তুলনামূলক নিয়ন্ত্রণে আসে। একই সঙ্গে কমে রক্তচাপ। অন্য সুর বা গানের ক্ষেত্রে কিন্তু এমন ফল পাওয়া যায়নি। বলে রাখা ভালো, ওই গবেষণায় মোজার্টের পাশাপাশি বিখ্যাত ব্যান্ড অ্যাবার গানও রাখা হয়েছিল। দুই ধরনের সংগীতের ক্ষেত্রে গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। একই বছরে আরেক গবেষণা পত্রিকা প্লস ওয়ানে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, মানুষের মন, আবেগ ইত্যাদির ওপর সংগীতের রয়েছে বড় ধরনের প্রভাব। সংগীতের হৃদয়ঘটিত ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে ২০১৫ সালে ক্রিটিক্যাল কেয়ার নামের জার্নালেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। খুঁজলে এমন হাজারটা গবেষণার কথা জানা যাবে।
মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী অসুখ। অসুস্থতা থেকে সেরে উঠতে আমরা কতই না ওষুধ খেয়ে থাকি। চিকিৎসকদের মতে, রোগমুক্তির অনেকগুলো পন্থার মধ্যে একটি মাধ্যম হলো মিউজিক থেরাপি। অর্থাৎ, সুর দিয়ে রোগীকে রোগ থেকে দূরে রাখা। মানুষের শরীরের নিস্তেজ হয়ে যাওয়া স্নায়ুকে রিদমের (ছন্দ) মাধ্যমে জাগিয়ে তোলাই মিউজিক থেরাপির মূল কাজ। মিউজিক থেরাপি মূলত মানুষের মন, শরীর ও মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে মানুষকে সুস্থ-স্বাভাবিক রাখতে সহযোগিতা করে।
মানবদেহে কানের মধ্য দিয়ে সুরতরঙ্গাকারে প্রবেশ করে। আর সেই সুর স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে প্রবাহিত হয় মস্তিষ্কে। সংগীত এমন এক মাধ্যম, যা মস্তিষ্কের সব অংশকেই উজ্জীবিত করে। সংগীতের সুর ও তাল বা বিট মস্তিষ্কের কার্যকলাপকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক করে তোলে। মানুষের হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক করে। সংগীতের এই প্রভাবকেই চিকিৎসার কাজে লাগানোর নাম মিউজিক থেরাপি।
মিউজিক থেরাপি একদিকে যেমন মন ভালো রাখে, অন্যদিকে ভালো রাখে মস্তিষ্ক আর হৃদযন্ত্রকে। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর অস্ত্রোপচারের সময়েও অনেক জায়গায় হালকা সুরের ব্যবস্থা রাখা হয়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ক্রিটিক্যাল কেয়ার নামের জার্নালে ২০১৫ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার হয়েছে এমন কিছু লোকের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, ধ্রুপদি সংগীত সরাসরি কানে প্রবেশ করলে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি চোখ বুঁজে থাকলে তাদের ঘুমানোটা সহজ হয়। শুধু তাই নয়, ঘুমের সমস্যায় যাঁরা ভোগেন, তাঁরাও এই থেরাপি নিলে সহজে ঘুমাতে পারেন। অস্ত্রোপচারকক্ষে (ওটি) হালকা সুর চললে তা রোগীকে আশ্বস্ত করে। রোগী অনেক সময় ভয় ও ব্যথা থেকে দূরে থাকে। বিশেষ করে অ্যানেসথেসিয়ায় মিউজিক থেরাপির ভূমিকা প্রশংসনীয়। এমনকি ক্যানসার রোগীদের কেমোথেরাপিতেও মিউজিক থেরাপি রোগীর কষ্ট কমাতে সহযোগিতা করে।
মানুষের শরীরে সংগীতের বিস্তৃত প্রভাব রয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সেলিম হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মানুষ যখন মানসিকভাবে প্রচণ্ড চাপে থাকে, তখন তার মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো বেশ আন্দোলিত হয়। সে সময় সংগীত শুনলে এর রিদম মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলোকে শান্ত হতে সহায়তা করে। যেমন—আপনি যদি শাহবাগ মোড়ে গিয়ে দাঁড়ান, তাহলে অনেক ধরনের শব্দ শুনতে পাবেন। এরপর আপনি এমন কোনো স্থানে গেলেন, যেখানে হালকা সংগীত চালু রয়েছে। সেখানে আপনা-আপনি আপনার মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসবে।। এভাবে চিকিৎসার ক্ষেত্রে মিউজিক থেরাপি ব্যবহার করা হচ্ছে।’
অস্ত্রোপচারকক্ষে হালকা সুর চালানোর কারণ সম্পর্কে মো. সেলিম হোসেন বলেন, ‘অস্ত্রোপচারের জন্য মানুষকে যখন ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন রোগীর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনা খুব মুশকিল হয়ে পড়ে। এ কারণে রোগীকে ওটিতে নেওয়ার আগে অন্য এক কক্ষে নিয়ে তাঁর মন শান্ত রাখার জন্য শব্দবিহীন সুর শোনানো হয়। এতে রোগীর মস্তিষ্কের কার্যকলাপ আস্তে আস্তে শান্ত হয়।’
মিউজিকের রিদমকে কাজে লাগিয়ে রোগীকে রোগ থেকে দূরে রাখার বিষয়ে মো. সেলিম হোসেন বলেন, ‘হার্টবিট বেড়ে গেলে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে শরীরে কিছু সমস্যা তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে সংগীতকে যদি থেরাপি হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে হার্টবিট কমে যাবে। যেমন—রোগীর হার্টবিট বেশি ওঠানামা করলে, ডেলিভারিতে তার হার্টবিটের সঙ্গে মিল রেখে মিউজিকের রিদমকে সামঞ্জস্য করা হয়। কারও হার্টবিট বেশি বেড়ে গেলে সে ক্ষেত্রে শব্দবিহীন মিউজিকের মাধ্যমে আস্তে আস্তে রোগীর হার্টবিট কমানোর চেষ্টা করা হয়। এ ক্ষেত্রে রোগীর পছন্দ জানা থাকলে তার পছন্দের মিউজিক শোনানো হয়। জানা না থাকলে শুধু সুর শোনানোর চেষ্টা করা হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোগীকে স্থিতিশীল অবস্থায় আনা হয়। আর রোগীকে দীর্ঘ সময়ের জন্য সুস্থ রাখতে চাইলে প্রতিদিন সকাল-বিকেল রোগীর পছন্দের সুর বা গান শোনানোর ব্যবস্থা করা হয়। এতে রোগীর স্নায়ু শান্ত হয়। আর রোগী আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠে।’
স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে আনতেও কার্যকর সংগীত। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, চেনা বা পছন্দের সুর স্মৃতি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভালো কাজে দেয়। স্মৃতি সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত স্নায়ু সংগীতের মাধ্যমে উদ্দীপিত হয়। একই কথা বললেন মো. সেলিম হোসেনও। তিনি বলেন, ‘মানুষের স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে আনতে মিউজিক থেরাপির ভূমিকা অনেক বেশি। সংগীত এমন একটা বিষয়, যা শোনার পর আপনার মস্তিষ্কের সব অংশ একসঙ্গে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। গান শোনার সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাশক্তিও বাড়ে। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, যাঁরা মিউজিক থেরাপি নেন, তাঁদের আলঝেইমার বা স্মৃতিশক্তি সম্পর্কিত রোগের আশঙ্কা কমে। ক্যানসারের ক্ষেত্রেও মিউজিক থেরাপির ভূমিকা অনবদ্য। ক্যানসারের জন্য দায়ী কোষের বৃদ্ধি কমাতে মিউজিক থেরাপি কাজ করে।’
এ ছাড়া স্ট্রোকের ক্ষেত্রে যদি রোগীকে হারমোনিয়াম, গিটার, পিয়ানো, বাঁশি, ভায়োলিনের মতো কোনো যন্ত্র বাজাতে দেওয়া হয়, এতে হারমোনিয়াম বা পিয়ানোতে রোগীর আঙুলের ব্যবহার মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে, যা মস্তিষ্ককে ক্রিয়াশীল করে। এ থেরাপি বিশ্বের বহু দেশেই এখন প্রচলিত। এমনকি আলঝেইমার রোগীদের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, তিনি হয়তো তাঁর একেবারে কাছের মানুষকেই চিনতে পারছেন না; কিন্তু ঠিকই পিয়ানো বাজাতে পারছেন। এটা সম্ভব হচ্ছে, পিয়ানো বা হারমোনিয়ামের রিডের স্মৃতি আর শুধু মস্তিষ্কে থাকে না, এটা পেশির স্মৃতিতেও চলে যায়। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন কথা বলা হয়েছে। মিউজিক থেরাপির কথা যদিও বাংলাদেশের খুব কম মানুষ জানে। সংগীত সাধারণভাবে বিনোদনের অংশ হিসেবেই এখানে বিবেচিত হয়। কিন্তু চাইলেই সুর ও সংগীতকে কাজে লাগিয়ে চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যায়। বিশেষত মনোরোগের ক্ষেত্রে এই থেরাপি বেশ কাজে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘মানসিক সমস্যায় মানুষের স্বাভাবিক চিন্তা ও আচরণের ছন্দপতন হয়। এটি দীর্ঘস্থায়ী হলে তা মানসিক অসুস্থতায় রূপ নেয়। এই সময়ে মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর মধ্যে চলমান স্বাভাবিক নিউরাল নেটওয়ার্ক পরিবর্তিত হয়ে অসুস্থ নিউরাল নেটওয়ার্কে পরিণত হতে পারে। গ্রামের সবুজ মাঠে কোনাকুনি হাঁটতে থাকলে কিছুদিন পর সবুজ ঘাস মরে গিয়ে একটা মেঠো পথ তৈরি হয়। আবার সেই পথের গতি রোধ করলে আস্তে আস্তে ঘাস গজিয়ে মেঠো পথ বিলীন হয়ে সবুজ হয়ে যায়। ব্যাপারটা ঠিক সে রকম। মিউজিক থেরাপিতে ব্যক্তিকে সংগীতের মাধ্যমে এমনভাবে সম্পৃক্ত করা হয়, যাতে ব্যক্তি তার অসুস্থ নিউরাল নেটওয়ার্কে ফাটল ধরাতে পারে। এ কাজ করতে গিয়ে ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে একজন প্রশিক্ষিত থেরাপিস্ট সংগীত লেখা, তাতে সুর দেওয়া, বাদ্যযন্ত্র বাজানো অথবা শুধু পছন্দের গান শোনাতে পারেন। ফলে ব্যক্তি সুস্থ চিন্তা করার শক্তি পায়, যার বহিঃপ্রকাশ ইতিবাচক আচরণের মাধ্যমে ঘটে। এভাবে ধীরে ধীরে ব্যক্তি সুস্থতার দিকে ধাবিত হয়।’
মিউজিক থেরাপি বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘সংগীতের সঙ্গে আমাদের আবেগ কাজ করে। যাদের স্মৃতি নষ্ট হয়ে যায়, তাদের পুরোনো স্মৃতি জমা থাকে। তারা নতুন কোনো স্মৃতি মনে রাখতে পারেন না। স্মৃতি নষ্ট হয়ে গেলে নতুন পরিবেশে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তারা। সবকিছু অচেনা লাগে। এ ক্ষেত্রে যদি রোগীকে তার পছন্দের পুরোনো দিনের গান শোনানো হয়, রোগী সেই গান শুনে পুরোনো অনেক স্মৃতি মনে করতে পারে। এ ক্ষেত্রে রোগী গান শুনতে শুনতে পরিচিত পরিবেশের মধ্যে আছে মনে করে। এ ছাড়া সংগীতে একধরনের ছন্দ আছে, যা মনের অস্থিরতা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, হতাশা দূর করে। তাই মানসিক প্রশান্তির জন্য গান হতে পারে চমৎকার একটি ওষুধ। আবার অনেক ক্ষেত্রে স্মৃতিশক্তি বাড়াতে নতুন গান শিখতে বলা হয়। নতুন গান বা সুর তৈরি করতে শিখলে মস্তিষ্কে নতুন নতুন সংযোগ তৈরি হয়। এতে মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তি বাড়তে থাকে। এমনকি করোনার সংক্রমণ রোধেও মিউজিক থেরাপি প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। এ ছাড়া নিয়মিত সংগীতের রেওয়াজ করলে বা গান শুনলে আমাদের হৃৎপিণ্ড এবং মস্তিষ্কের কার্যকলাপ অনেক ভালো থাকে।’
প্রকৃতির সঙ্গে সংগীতের রয়েছে অদ্ভুত এক সম্পর্ক। এই যে পানি বয়ে চলার শব্দ, পাখির কুহু কুহু ডাক, মেঘেদের ছুটে চলা, গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ার শব্দ—এসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সংগীতের সুর। অথবা বলা যায়, এসবের মাঝেই খুঁজে পাওয়া যাবে সংগীতের সুর, তাল ও লয়।
আমাদের প্রতিদিনের কাজের অনেকাংশেই যুক্ত সংগীত। দিনে কিংবা রাতে গুন গুন করে গান করেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মানুষের সুখ-দুঃখে সংগীত বন্ধুর মতো কাজ করে। তাই সংগীতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক হৃদয়ের।
সংগীতের সঙ্গে এই হৃদয়যোগের কথা কিন্তু একটুও বাড়িয়ে বলা নয়। ২০১৬ সালে জার্মান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের গবেষণা পত্রিকা ডয়চেস অ্যার্জটাব্লাট ইন্টারন্যাশনালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সংগীতের সঙ্গে সরাসরি রয়েছে হৃদয়ের যোগ। মোজার্টের মতো ধ্রুপদি সংগীতের প্রভাবে হৃদযন্ত্রের স্পন্দন তুলনামূলক নিয়ন্ত্রণে আসে। একই সঙ্গে কমে রক্তচাপ। অন্য সুর বা গানের ক্ষেত্রে কিন্তু এমন ফল পাওয়া যায়নি। বলে রাখা ভালো, ওই গবেষণায় মোজার্টের পাশাপাশি বিখ্যাত ব্যান্ড অ্যাবার গানও রাখা হয়েছিল। দুই ধরনের সংগীতের ক্ষেত্রে গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। একই বছরে আরেক গবেষণা পত্রিকা প্লস ওয়ানে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, মানুষের মন, আবেগ ইত্যাদির ওপর সংগীতের রয়েছে বড় ধরনের প্রভাব। সংগীতের হৃদয়ঘটিত ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে ২০১৫ সালে ক্রিটিক্যাল কেয়ার নামের জার্নালেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। খুঁজলে এমন হাজারটা গবেষণার কথা জানা যাবে।
মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী অসুখ। অসুস্থতা থেকে সেরে উঠতে আমরা কতই না ওষুধ খেয়ে থাকি। চিকিৎসকদের মতে, রোগমুক্তির অনেকগুলো পন্থার মধ্যে একটি মাধ্যম হলো মিউজিক থেরাপি। অর্থাৎ, সুর দিয়ে রোগীকে রোগ থেকে দূরে রাখা। মানুষের শরীরের নিস্তেজ হয়ে যাওয়া স্নায়ুকে রিদমের (ছন্দ) মাধ্যমে জাগিয়ে তোলাই মিউজিক থেরাপির মূল কাজ। মিউজিক থেরাপি মূলত মানুষের মন, শরীর ও মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে মানুষকে সুস্থ-স্বাভাবিক রাখতে সহযোগিতা করে।
মানবদেহে কানের মধ্য দিয়ে সুরতরঙ্গাকারে প্রবেশ করে। আর সেই সুর স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে প্রবাহিত হয় মস্তিষ্কে। সংগীত এমন এক মাধ্যম, যা মস্তিষ্কের সব অংশকেই উজ্জীবিত করে। সংগীতের সুর ও তাল বা বিট মস্তিষ্কের কার্যকলাপকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক করে তোলে। মানুষের হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক করে। সংগীতের এই প্রভাবকেই চিকিৎসার কাজে লাগানোর নাম মিউজিক থেরাপি।
মিউজিক থেরাপি একদিকে যেমন মন ভালো রাখে, অন্যদিকে ভালো রাখে মস্তিষ্ক আর হৃদযন্ত্রকে। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর অস্ত্রোপচারের সময়েও অনেক জায়গায় হালকা সুরের ব্যবস্থা রাখা হয়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ক্রিটিক্যাল কেয়ার নামের জার্নালে ২০১৫ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার হয়েছে এমন কিছু লোকের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, ধ্রুপদি সংগীত সরাসরি কানে প্রবেশ করলে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি চোখ বুঁজে থাকলে তাদের ঘুমানোটা সহজ হয়। শুধু তাই নয়, ঘুমের সমস্যায় যাঁরা ভোগেন, তাঁরাও এই থেরাপি নিলে সহজে ঘুমাতে পারেন। অস্ত্রোপচারকক্ষে (ওটি) হালকা সুর চললে তা রোগীকে আশ্বস্ত করে। রোগী অনেক সময় ভয় ও ব্যথা থেকে দূরে থাকে। বিশেষ করে অ্যানেসথেসিয়ায় মিউজিক থেরাপির ভূমিকা প্রশংসনীয়। এমনকি ক্যানসার রোগীদের কেমোথেরাপিতেও মিউজিক থেরাপি রোগীর কষ্ট কমাতে সহযোগিতা করে।
মানুষের শরীরে সংগীতের বিস্তৃত প্রভাব রয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সেলিম হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মানুষ যখন মানসিকভাবে প্রচণ্ড চাপে থাকে, তখন তার মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো বেশ আন্দোলিত হয়। সে সময় সংগীত শুনলে এর রিদম মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলোকে শান্ত হতে সহায়তা করে। যেমন—আপনি যদি শাহবাগ মোড়ে গিয়ে দাঁড়ান, তাহলে অনেক ধরনের শব্দ শুনতে পাবেন। এরপর আপনি এমন কোনো স্থানে গেলেন, যেখানে হালকা সংগীত চালু রয়েছে। সেখানে আপনা-আপনি আপনার মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসবে।। এভাবে চিকিৎসার ক্ষেত্রে মিউজিক থেরাপি ব্যবহার করা হচ্ছে।’
অস্ত্রোপচারকক্ষে হালকা সুর চালানোর কারণ সম্পর্কে মো. সেলিম হোসেন বলেন, ‘অস্ত্রোপচারের জন্য মানুষকে যখন ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন রোগীর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনা খুব মুশকিল হয়ে পড়ে। এ কারণে রোগীকে ওটিতে নেওয়ার আগে অন্য এক কক্ষে নিয়ে তাঁর মন শান্ত রাখার জন্য শব্দবিহীন সুর শোনানো হয়। এতে রোগীর মস্তিষ্কের কার্যকলাপ আস্তে আস্তে শান্ত হয়।’
মিউজিকের রিদমকে কাজে লাগিয়ে রোগীকে রোগ থেকে দূরে রাখার বিষয়ে মো. সেলিম হোসেন বলেন, ‘হার্টবিট বেড়ে গেলে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে শরীরে কিছু সমস্যা তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে সংগীতকে যদি থেরাপি হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে হার্টবিট কমে যাবে। যেমন—রোগীর হার্টবিট বেশি ওঠানামা করলে, ডেলিভারিতে তার হার্টবিটের সঙ্গে মিল রেখে মিউজিকের রিদমকে সামঞ্জস্য করা হয়। কারও হার্টবিট বেশি বেড়ে গেলে সে ক্ষেত্রে শব্দবিহীন মিউজিকের মাধ্যমে আস্তে আস্তে রোগীর হার্টবিট কমানোর চেষ্টা করা হয়। এ ক্ষেত্রে রোগীর পছন্দ জানা থাকলে তার পছন্দের মিউজিক শোনানো হয়। জানা না থাকলে শুধু সুর শোনানোর চেষ্টা করা হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোগীকে স্থিতিশীল অবস্থায় আনা হয়। আর রোগীকে দীর্ঘ সময়ের জন্য সুস্থ রাখতে চাইলে প্রতিদিন সকাল-বিকেল রোগীর পছন্দের সুর বা গান শোনানোর ব্যবস্থা করা হয়। এতে রোগীর স্নায়ু শান্ত হয়। আর রোগী আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠে।’
স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে আনতেও কার্যকর সংগীত। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, চেনা বা পছন্দের সুর স্মৃতি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভালো কাজে দেয়। স্মৃতি সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত স্নায়ু সংগীতের মাধ্যমে উদ্দীপিত হয়। একই কথা বললেন মো. সেলিম হোসেনও। তিনি বলেন, ‘মানুষের স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে আনতে মিউজিক থেরাপির ভূমিকা অনেক বেশি। সংগীত এমন একটা বিষয়, যা শোনার পর আপনার মস্তিষ্কের সব অংশ একসঙ্গে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। গান শোনার সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাশক্তিও বাড়ে। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, যাঁরা মিউজিক থেরাপি নেন, তাঁদের আলঝেইমার বা স্মৃতিশক্তি সম্পর্কিত রোগের আশঙ্কা কমে। ক্যানসারের ক্ষেত্রেও মিউজিক থেরাপির ভূমিকা অনবদ্য। ক্যানসারের জন্য দায়ী কোষের বৃদ্ধি কমাতে মিউজিক থেরাপি কাজ করে।’
এ ছাড়া স্ট্রোকের ক্ষেত্রে যদি রোগীকে হারমোনিয়াম, গিটার, পিয়ানো, বাঁশি, ভায়োলিনের মতো কোনো যন্ত্র বাজাতে দেওয়া হয়, এতে হারমোনিয়াম বা পিয়ানোতে রোগীর আঙুলের ব্যবহার মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে, যা মস্তিষ্ককে ক্রিয়াশীল করে। এ থেরাপি বিশ্বের বহু দেশেই এখন প্রচলিত। এমনকি আলঝেইমার রোগীদের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, তিনি হয়তো তাঁর একেবারে কাছের মানুষকেই চিনতে পারছেন না; কিন্তু ঠিকই পিয়ানো বাজাতে পারছেন। এটা সম্ভব হচ্ছে, পিয়ানো বা হারমোনিয়ামের রিডের স্মৃতি আর শুধু মস্তিষ্কে থাকে না, এটা পেশির স্মৃতিতেও চলে যায়। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন কথা বলা হয়েছে। মিউজিক থেরাপির কথা যদিও বাংলাদেশের খুব কম মানুষ জানে। সংগীত সাধারণভাবে বিনোদনের অংশ হিসেবেই এখানে বিবেচিত হয়। কিন্তু চাইলেই সুর ও সংগীতকে কাজে লাগিয়ে চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যায়। বিশেষত মনোরোগের ক্ষেত্রে এই থেরাপি বেশ কাজে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘মানসিক সমস্যায় মানুষের স্বাভাবিক চিন্তা ও আচরণের ছন্দপতন হয়। এটি দীর্ঘস্থায়ী হলে তা মানসিক অসুস্থতায় রূপ নেয়। এই সময়ে মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর মধ্যে চলমান স্বাভাবিক নিউরাল নেটওয়ার্ক পরিবর্তিত হয়ে অসুস্থ নিউরাল নেটওয়ার্কে পরিণত হতে পারে। গ্রামের সবুজ মাঠে কোনাকুনি হাঁটতে থাকলে কিছুদিন পর সবুজ ঘাস মরে গিয়ে একটা মেঠো পথ তৈরি হয়। আবার সেই পথের গতি রোধ করলে আস্তে আস্তে ঘাস গজিয়ে মেঠো পথ বিলীন হয়ে সবুজ হয়ে যায়। ব্যাপারটা ঠিক সে রকম। মিউজিক থেরাপিতে ব্যক্তিকে সংগীতের মাধ্যমে এমনভাবে সম্পৃক্ত করা হয়, যাতে ব্যক্তি তার অসুস্থ নিউরাল নেটওয়ার্কে ফাটল ধরাতে পারে। এ কাজ করতে গিয়ে ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে একজন প্রশিক্ষিত থেরাপিস্ট সংগীত লেখা, তাতে সুর দেওয়া, বাদ্যযন্ত্র বাজানো অথবা শুধু পছন্দের গান শোনাতে পারেন। ফলে ব্যক্তি সুস্থ চিন্তা করার শক্তি পায়, যার বহিঃপ্রকাশ ইতিবাচক আচরণের মাধ্যমে ঘটে। এভাবে ধীরে ধীরে ব্যক্তি সুস্থতার দিকে ধাবিত হয়।’
মিউজিক থেরাপি বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘সংগীতের সঙ্গে আমাদের আবেগ কাজ করে। যাদের স্মৃতি নষ্ট হয়ে যায়, তাদের পুরোনো স্মৃতি জমা থাকে। তারা নতুন কোনো স্মৃতি মনে রাখতে পারেন না। স্মৃতি নষ্ট হয়ে গেলে নতুন পরিবেশে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তারা। সবকিছু অচেনা লাগে। এ ক্ষেত্রে যদি রোগীকে তার পছন্দের পুরোনো দিনের গান শোনানো হয়, রোগী সেই গান শুনে পুরোনো অনেক স্মৃতি মনে করতে পারে। এ ক্ষেত্রে রোগী গান শুনতে শুনতে পরিচিত পরিবেশের মধ্যে আছে মনে করে। এ ছাড়া সংগীতে একধরনের ছন্দ আছে, যা মনের অস্থিরতা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, হতাশা দূর করে। তাই মানসিক প্রশান্তির জন্য গান হতে পারে চমৎকার একটি ওষুধ। আবার অনেক ক্ষেত্রে স্মৃতিশক্তি বাড়াতে নতুন গান শিখতে বলা হয়। নতুন গান বা সুর তৈরি করতে শিখলে মস্তিষ্কে নতুন নতুন সংযোগ তৈরি হয়। এতে মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তি বাড়তে থাকে। এমনকি করোনার সংক্রমণ রোধেও মিউজিক থেরাপি প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। এ ছাড়া নিয়মিত সংগীতের রেওয়াজ করলে বা গান শুনলে আমাদের হৃৎপিণ্ড এবং মস্তিষ্কের কার্যকলাপ অনেক ভালো থাকে।’
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
৩ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৭ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
৯ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
৯ দিন আগে