অনলাইন ডেস্ক
৮ জুলাই, ২০২২। জাপানের নারা শহরে এক নির্বাচনী জনসভায় আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান শিনজো আবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুতে শোকাহত হয় পুরো জাপান। রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ঘোষণা দেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা। কিন্তু কয়েক দিন পরই জানা যায়, একটি বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থাকায় ‘প্রতিশোধ’ নিতে আবেকে হত্যা করেন তেৎসুয়া ইয়ামাগামি নামে এক যুবক। আবের হত্যাকাণ্ড জাপানের ‘পরিচ্ছন্ন’ রাজনীতির এক নতুন দিক উন্মোচন করে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিনজো আবে যে ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত বলে শোনা যাচ্ছে সেটির নাম ইউনিফিকেশন চার্চ। ১৯৫৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় সান মিয়াং মুন বিশ্ব শান্তি এবং পুনর্মিলনের লক্ষ্যে খ্রিষ্ট ধর্মের নতুন এক ধারা ‘ইউনিফিকেশন চার্চ’ গঠন করেন। মতাদর্শিক দিক থেকে গোষ্ঠীটি সমাজতন্ত্র-বিরোধী এবং পারিবারিক রক্ষণশীলতায় বিশ্বাসী।
দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের রাজনীতিতে এই চার্চ ব্যাপক প্রভাবশালী বলে ধারণা করা হয়। কেউ সেই প্রভাব বলয়ে থাকতে অথবা ভক্তিতে মোটা অঙ্কের চাঁদা দেন। ভক্তদের চাঁদার অর্থে বিশ্বজুড়ে প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে গোষ্ঠীটি।
করোনা মহামারীর সময় এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামাজিক দূরত্বের বিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছিল। স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করে এক ধর্মগুরুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বিপুল ভক্তের অংশগ্রহণ থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তারের প্রমাণ পাওয়া যায়। পরে এই গোষ্ঠীর সর্বোচ্চ নেতা সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চান।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভক্তদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থের জোরে ১৯৬৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় টঙ্গিল গ্রুপ নামে একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান খোলেন সান মিয়াং মুন। এই কনগ্লোমারেটে রয়েছে—গলফ ও স্কি রিসোর্ট পরিচালনা প্রতিষ্ঠান, প্রতিরক্ষা শিল্প গোষ্ঠী, রাসায়নিক কারখানা, গাড়ির যন্ত্রাংশ ব্যবসা এবং সংবাদপত্রের মালিকানা। যুক্তরাষ্ট্রেও ইউনিফিকেশন চার্চের বিপুল সম্পত্তি রয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক বিনিয়োগ থাকলেও ইউনিফিকেশন চার্চ এখনো ভক্তদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা সংগ্রহ করে। জাপানি সংবাদমাধ্যমগুলোর মতে, কেবল জাপানেই চার্চের অন্তত ১ লাখ সক্রিয় সদস্য রয়েছেন। যারা জাপানের বর্তমান শাসক দল এবং শিনজো আবের দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি–এলডিপির প্রার্থীদের নির্বাচনে জয়ের ক্ষেত্রে প্রচারণাসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন। এলডিপির আইনপ্রণেতাদের একটি বড় অংশই ইউনিফিকেশন চার্চের সঙ্গে জড়িত।
জাপানের সংবাদমাধ্যম আশাহি শিম্বুন চার্চটির সাবেক এক অনুসারীর বরাত দিয়ে বলেছে, তিনি জাপানকে ‘রক্ষা’ করতে আবের মিত্র কোইচি হাগুইদাকে নির্বাচনী প্রচারণায় সহায়তা করেছেন। আরও পাঁচজন ভক্ত নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, এলডিপির প্রার্থীদের হয়ে কাজ করার জন্য তাঁদের চার্চ থেকে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হতো।
যাই হোক, শিনজো আবের সঙ্গে ইউনিফিকেশন চার্চের সম্পর্ক ব্যক্তিগত নয় বরং পারিবারিক। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সাল জাপানের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন নবুসুকো কিশি। তিনি সম্পর্কে শিনজো আবের দাদা। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেই মুনের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাঁর। কিশিই ১৯৬৮ সালে ইউনিফিকেশন চার্চের রাজনৈতিক শাখা ‘ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর ভিক্টরি ওভার কমিউনিজম’ স্থাপনে সাহায্য করেন। সংগঠনটি জাপানে শক্ত ভিত্তি গড়ার পর থেকেই চার্চ অনুসারীদের ‘অর্থনৈতিক শক্তি’ হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে। অনুসারীদের কাছ থেকে সরাসরি চাঁদা কিংবা বিভিন্ন ‘আধ্যাত্মিক বস্তুর’ বিনিময়ে অর্থ সংগ্রহ করত।
অনুসারীদের মাঝে চার্চের এতটাই প্রভাব বিস্তৃত যে, অনেকেই চার্চের জন্য নিজেদের সবটুকু উৎসর্গ করেছেন। সেরকমই একজন তেৎসুয়া ইয়ামাগামির মা। তাঁর এক আত্মীয় আল–জাজিরাকে বলেছেন, ‘তাঁর মা গোষ্ঠীটির একজন নিবেদিতপ্রাণ ভক্ত ছিলেন। তিনি চার্চকে ১০ কোটি জাপানি ইয়েন দান করেছিলেন।’ এই অর্থ তেৎসুয়ার মা পেয়েছিলেন মৃত স্বামীর পেনশন থেকে। স্বামীর পেনশনের টাকা সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য না রেখে প্রায় পুরোটাই দান করায় তেৎসুয়ার উচ্চশিক্ষার পথ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
এই বঞ্চনা থেকেই ক্ষোভ জন্ম নেয় তেৎসুয়ার মনে। তিনি চার্চের বর্তমান প্রধান হাক জা মুনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। হাক জা মুন ২০১২ সালে তাঁর স্বামী ও চার্চের প্রতিষ্ঠাতা সুন মিয়াং মুনের মৃত্যুর পর গোষ্ঠীটির প্রধান হন। কোভিড মহামারির কারণে তিনি জাপান সফরে আসতে পারছিলেন না। তাই তাঁকে হত্যাও করতে পারছিলেন না তেৎসুয়া। পরে গোষ্ঠীটিকে পাঠানো শিনজো আবের শুভেচ্ছা বার্তা দেখে পরিকল্পনা বদলান তেৎসুয়া।
আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তেৎসুয়া জাপানি এক ব্লগারের কাছে লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন—হাক জা মুনকে হত্যা করা প্রায় ‘অসম্ভব’ এবং আবে কখনোই তাঁর ‘মূল শত্রু’ ছিলেন না।
ইউনিফিকেশন চার্চ তাঁর পরিবারকে ধ্বংস করেছে উল্লেখ করে তেৎসুয়া আরও লিখেন, আবে ‘চার্চের পক্ষে অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি’। ঠিক এ কারণেই তিনি চার্চের সঙ্গে পূর্বের দায় মেটাতে আবেকে হত্যা করবেন।
জাপানে ইউনিফিকেশন চার্চ নিয়ে বেশ সমালোচনা চলছে। গোষ্ঠীটি আদৌ কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নাকি একটি কাল্ট (সংঘ) তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে আবের মৃত্যুর পর গোষ্ঠীটিকে কাল্ট হিসেবেই বিবেচনা করছেন অনেকে।
এই বিষয়ে টোকিওর সোফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক কোইচি নাকানো আল–জাজিরাকে বলেছেন, ‘ইউনিফিকেশন চার্চকে ধর্মীয় সংঘের চেয়ে জাপানে একটি স্বার্থান্বেষী সম্প্রদায় হিসেবেই বেশি বিবেচনা করা হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘এলডিপি এই কুখ্যাত সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে দেশের জনগণকে খেপিয়ে তুলেছে।’
জনগণ যে ক্ষুব্ধ হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় আবের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতার ঘোষণা আসার পর। জাপানের জনগণ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বিরোধিতা করতে থাকেন। যদিও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। তবে জনরোষ সামলাতে বাধ্য হয়ে মন্ত্রিসভায় রদবদল আনতে হয়েছে কিশিদাকে। দলীয় আইনপ্রণেতাদের ওই চার্চের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।
চার্চকে দেওয়া অনুদান যারা এখন ফেরত চাচ্ছেন বা এই চক্র থেকে মুক্তি চান তাঁদের আইনি সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন কিশিদা।
অবশ্য কিশিদার জন্য বিষয়টি সহজ হবে না। কারণ, এলডিপির অভ্যন্তরীণ এক জরিপ থেকে দেখা গেছে, দেশজুড়ে দলটির ৩৭৯ জন আইনপ্রণেতার অর্ধেকেরও বেশি ইউনিফিকেশন চার্চের সঙ্গে যুক্ত। ৯৭ জন আইনপ্রণেতা চার্চের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সরাসরি যোগ দিয়েছেন। ফলে, সংস্কার চালাতে গিয়ে দলেই তাঁর অবস্থান ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
শিনজো আবে হত্যাকাণ্ডের পর দেশটির রাজনীতিতে বিশেষ ধর্মের প্রভাব নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তবে ইউনিফিকেশন চার্চ জাপানের কোনো রাজনৈতিক দলকে সরাসরি সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে তারা তাদের রাজনৈতিক শাখার সঙ্গে এলডিপির আইনপ্রণেতাদের সংযোগের বিষয়টি স্বীকার করেছে। বলেছে, যেহেতু তাঁরা অভিন্ন মূল্যবোধ লালন করেন তাই এমন সংযোগ অস্বাভাবিক নয়।
বিভিন্ন সূত্র মিলে গেলেও আবের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ইউনিফিকেশন চার্চের জড়িত থাকার বিষয়টি এখনো প্রমাণিত নয়, দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে, গুজব ছাপিয়ে বিষয়টি সত্য হয়ে ওঠাও অস্বাভাবিক কিছু না। এ প্রসঙ্গে জাপানের কানাজাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক মাসাকি নাকাসামা বলেন, তাঁর মতে, এলডিপি এবং ইউনিফিকেশন চার্চের যোগসূত্র ‘খুব একটা শক্ত’ নয়। তবে আবের হত্যাকারী তেৎসুয়ার দাবির সূত্রে জাপানের রাজনীতিতে ‘ধর্ম’, বিশেষ করে কাল্টের প্রভাব নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
অধ্যাপক মাসাকি নাকাসামার মতে, আবের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিসৌধ হবে, আলোচনা হবে। কিন্তু সময় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বিষয়টি ভুলে যাবে। জাপানের রাজনীতিবিদদের রাজনীতির প্রতি নিবেদনের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রক্ষণশীল জাপানি রাজনীতিবিদদের নিবেদিত ধর্মপ্রাণে পরিণত করা সত্যিই কঠিন।’
জাপানের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব জেঁকে বসা আদৌ সম্ভব কি না তা সময়ই বলে দেবে। তবে জাপানের রাজনীতির অতীত ইতিহাস বলে—নিকট অতীতে দেশটির রাজনীতিতে ধর্মীয় কাল্টের প্রভাব খুব বেশি দেখা যায়নি। ভবিষ্যতে দেখা যাবে কি না তার উত্তর পাওয়া যাবে এলডিপির সঙ্গে ইউনিফিকেশন চার্চের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, থাকলে তার শিকড় কতটা গভীরে তা উদ্ঘাটিত হলে।
তবে, আবের মৃত্যুর সঙ্গে ইউনিফিকেশন চার্চের জড়িত থাকার আলাপ যে নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আল–জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান
৮ জুলাই, ২০২২। জাপানের নারা শহরে এক নির্বাচনী জনসভায় আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান শিনজো আবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুতে শোকাহত হয় পুরো জাপান। রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ঘোষণা দেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা। কিন্তু কয়েক দিন পরই জানা যায়, একটি বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থাকায় ‘প্রতিশোধ’ নিতে আবেকে হত্যা করেন তেৎসুয়া ইয়ামাগামি নামে এক যুবক। আবের হত্যাকাণ্ড জাপানের ‘পরিচ্ছন্ন’ রাজনীতির এক নতুন দিক উন্মোচন করে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিনজো আবে যে ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত বলে শোনা যাচ্ছে সেটির নাম ইউনিফিকেশন চার্চ। ১৯৫৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় সান মিয়াং মুন বিশ্ব শান্তি এবং পুনর্মিলনের লক্ষ্যে খ্রিষ্ট ধর্মের নতুন এক ধারা ‘ইউনিফিকেশন চার্চ’ গঠন করেন। মতাদর্শিক দিক থেকে গোষ্ঠীটি সমাজতন্ত্র-বিরোধী এবং পারিবারিক রক্ষণশীলতায় বিশ্বাসী।
দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের রাজনীতিতে এই চার্চ ব্যাপক প্রভাবশালী বলে ধারণা করা হয়। কেউ সেই প্রভাব বলয়ে থাকতে অথবা ভক্তিতে মোটা অঙ্কের চাঁদা দেন। ভক্তদের চাঁদার অর্থে বিশ্বজুড়ে প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে গোষ্ঠীটি।
করোনা মহামারীর সময় এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামাজিক দূরত্বের বিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছিল। স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করে এক ধর্মগুরুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বিপুল ভক্তের অংশগ্রহণ থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তারের প্রমাণ পাওয়া যায়। পরে এই গোষ্ঠীর সর্বোচ্চ নেতা সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চান।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভক্তদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থের জোরে ১৯৬৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় টঙ্গিল গ্রুপ নামে একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান খোলেন সান মিয়াং মুন। এই কনগ্লোমারেটে রয়েছে—গলফ ও স্কি রিসোর্ট পরিচালনা প্রতিষ্ঠান, প্রতিরক্ষা শিল্প গোষ্ঠী, রাসায়নিক কারখানা, গাড়ির যন্ত্রাংশ ব্যবসা এবং সংবাদপত্রের মালিকানা। যুক্তরাষ্ট্রেও ইউনিফিকেশন চার্চের বিপুল সম্পত্তি রয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক বিনিয়োগ থাকলেও ইউনিফিকেশন চার্চ এখনো ভক্তদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা সংগ্রহ করে। জাপানি সংবাদমাধ্যমগুলোর মতে, কেবল জাপানেই চার্চের অন্তত ১ লাখ সক্রিয় সদস্য রয়েছেন। যারা জাপানের বর্তমান শাসক দল এবং শিনজো আবের দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি–এলডিপির প্রার্থীদের নির্বাচনে জয়ের ক্ষেত্রে প্রচারণাসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন। এলডিপির আইনপ্রণেতাদের একটি বড় অংশই ইউনিফিকেশন চার্চের সঙ্গে জড়িত।
জাপানের সংবাদমাধ্যম আশাহি শিম্বুন চার্চটির সাবেক এক অনুসারীর বরাত দিয়ে বলেছে, তিনি জাপানকে ‘রক্ষা’ করতে আবের মিত্র কোইচি হাগুইদাকে নির্বাচনী প্রচারণায় সহায়তা করেছেন। আরও পাঁচজন ভক্ত নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, এলডিপির প্রার্থীদের হয়ে কাজ করার জন্য তাঁদের চার্চ থেকে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হতো।
যাই হোক, শিনজো আবের সঙ্গে ইউনিফিকেশন চার্চের সম্পর্ক ব্যক্তিগত নয় বরং পারিবারিক। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সাল জাপানের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন নবুসুকো কিশি। তিনি সম্পর্কে শিনজো আবের দাদা। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেই মুনের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাঁর। কিশিই ১৯৬৮ সালে ইউনিফিকেশন চার্চের রাজনৈতিক শাখা ‘ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর ভিক্টরি ওভার কমিউনিজম’ স্থাপনে সাহায্য করেন। সংগঠনটি জাপানে শক্ত ভিত্তি গড়ার পর থেকেই চার্চ অনুসারীদের ‘অর্থনৈতিক শক্তি’ হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে। অনুসারীদের কাছ থেকে সরাসরি চাঁদা কিংবা বিভিন্ন ‘আধ্যাত্মিক বস্তুর’ বিনিময়ে অর্থ সংগ্রহ করত।
অনুসারীদের মাঝে চার্চের এতটাই প্রভাব বিস্তৃত যে, অনেকেই চার্চের জন্য নিজেদের সবটুকু উৎসর্গ করেছেন। সেরকমই একজন তেৎসুয়া ইয়ামাগামির মা। তাঁর এক আত্মীয় আল–জাজিরাকে বলেছেন, ‘তাঁর মা গোষ্ঠীটির একজন নিবেদিতপ্রাণ ভক্ত ছিলেন। তিনি চার্চকে ১০ কোটি জাপানি ইয়েন দান করেছিলেন।’ এই অর্থ তেৎসুয়ার মা পেয়েছিলেন মৃত স্বামীর পেনশন থেকে। স্বামীর পেনশনের টাকা সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য না রেখে প্রায় পুরোটাই দান করায় তেৎসুয়ার উচ্চশিক্ষার পথ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
এই বঞ্চনা থেকেই ক্ষোভ জন্ম নেয় তেৎসুয়ার মনে। তিনি চার্চের বর্তমান প্রধান হাক জা মুনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। হাক জা মুন ২০১২ সালে তাঁর স্বামী ও চার্চের প্রতিষ্ঠাতা সুন মিয়াং মুনের মৃত্যুর পর গোষ্ঠীটির প্রধান হন। কোভিড মহামারির কারণে তিনি জাপান সফরে আসতে পারছিলেন না। তাই তাঁকে হত্যাও করতে পারছিলেন না তেৎসুয়া। পরে গোষ্ঠীটিকে পাঠানো শিনজো আবের শুভেচ্ছা বার্তা দেখে পরিকল্পনা বদলান তেৎসুয়া।
আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তেৎসুয়া জাপানি এক ব্লগারের কাছে লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন—হাক জা মুনকে হত্যা করা প্রায় ‘অসম্ভব’ এবং আবে কখনোই তাঁর ‘মূল শত্রু’ ছিলেন না।
ইউনিফিকেশন চার্চ তাঁর পরিবারকে ধ্বংস করেছে উল্লেখ করে তেৎসুয়া আরও লিখেন, আবে ‘চার্চের পক্ষে অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি’। ঠিক এ কারণেই তিনি চার্চের সঙ্গে পূর্বের দায় মেটাতে আবেকে হত্যা করবেন।
জাপানে ইউনিফিকেশন চার্চ নিয়ে বেশ সমালোচনা চলছে। গোষ্ঠীটি আদৌ কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নাকি একটি কাল্ট (সংঘ) তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে আবের মৃত্যুর পর গোষ্ঠীটিকে কাল্ট হিসেবেই বিবেচনা করছেন অনেকে।
এই বিষয়ে টোকিওর সোফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক কোইচি নাকানো আল–জাজিরাকে বলেছেন, ‘ইউনিফিকেশন চার্চকে ধর্মীয় সংঘের চেয়ে জাপানে একটি স্বার্থান্বেষী সম্প্রদায় হিসেবেই বেশি বিবেচনা করা হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘এলডিপি এই কুখ্যাত সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে দেশের জনগণকে খেপিয়ে তুলেছে।’
জনগণ যে ক্ষুব্ধ হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় আবের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতার ঘোষণা আসার পর। জাপানের জনগণ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বিরোধিতা করতে থাকেন। যদিও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। তবে জনরোষ সামলাতে বাধ্য হয়ে মন্ত্রিসভায় রদবদল আনতে হয়েছে কিশিদাকে। দলীয় আইনপ্রণেতাদের ওই চার্চের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।
চার্চকে দেওয়া অনুদান যারা এখন ফেরত চাচ্ছেন বা এই চক্র থেকে মুক্তি চান তাঁদের আইনি সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন কিশিদা।
অবশ্য কিশিদার জন্য বিষয়টি সহজ হবে না। কারণ, এলডিপির অভ্যন্তরীণ এক জরিপ থেকে দেখা গেছে, দেশজুড়ে দলটির ৩৭৯ জন আইনপ্রণেতার অর্ধেকেরও বেশি ইউনিফিকেশন চার্চের সঙ্গে যুক্ত। ৯৭ জন আইনপ্রণেতা চার্চের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সরাসরি যোগ দিয়েছেন। ফলে, সংস্কার চালাতে গিয়ে দলেই তাঁর অবস্থান ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
শিনজো আবে হত্যাকাণ্ডের পর দেশটির রাজনীতিতে বিশেষ ধর্মের প্রভাব নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তবে ইউনিফিকেশন চার্চ জাপানের কোনো রাজনৈতিক দলকে সরাসরি সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে তারা তাদের রাজনৈতিক শাখার সঙ্গে এলডিপির আইনপ্রণেতাদের সংযোগের বিষয়টি স্বীকার করেছে। বলেছে, যেহেতু তাঁরা অভিন্ন মূল্যবোধ লালন করেন তাই এমন সংযোগ অস্বাভাবিক নয়।
বিভিন্ন সূত্র মিলে গেলেও আবের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ইউনিফিকেশন চার্চের জড়িত থাকার বিষয়টি এখনো প্রমাণিত নয়, দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে, গুজব ছাপিয়ে বিষয়টি সত্য হয়ে ওঠাও অস্বাভাবিক কিছু না। এ প্রসঙ্গে জাপানের কানাজাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক মাসাকি নাকাসামা বলেন, তাঁর মতে, এলডিপি এবং ইউনিফিকেশন চার্চের যোগসূত্র ‘খুব একটা শক্ত’ নয়। তবে আবের হত্যাকারী তেৎসুয়ার দাবির সূত্রে জাপানের রাজনীতিতে ‘ধর্ম’, বিশেষ করে কাল্টের প্রভাব নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
অধ্যাপক মাসাকি নাকাসামার মতে, আবের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিসৌধ হবে, আলোচনা হবে। কিন্তু সময় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বিষয়টি ভুলে যাবে। জাপানের রাজনীতিবিদদের রাজনীতির প্রতি নিবেদনের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রক্ষণশীল জাপানি রাজনীতিবিদদের নিবেদিত ধর্মপ্রাণে পরিণত করা সত্যিই কঠিন।’
জাপানের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব জেঁকে বসা আদৌ সম্ভব কি না তা সময়ই বলে দেবে। তবে জাপানের রাজনীতির অতীত ইতিহাস বলে—নিকট অতীতে দেশটির রাজনীতিতে ধর্মীয় কাল্টের প্রভাব খুব বেশি দেখা যায়নি। ভবিষ্যতে দেখা যাবে কি না তার উত্তর পাওয়া যাবে এলডিপির সঙ্গে ইউনিফিকেশন চার্চের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, থাকলে তার শিকড় কতটা গভীরে তা উদ্ঘাটিত হলে।
তবে, আবের মৃত্যুর সঙ্গে ইউনিফিকেশন চার্চের জড়িত থাকার আলাপ যে নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আল–জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
২ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৭ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
৯ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
৯ দিন আগে