মারুফ ইসলাম
প্রযুক্তির বাজার দিনে দিনে পরিবর্তিত হচ্ছে। এই বাজারে খেলোয়াড়ও অনেক। কখনো যুক্তরাষ্ট্র বা কখনো চীন এই বাজারে ছড়ি ঘোরানোর চেষ্টা করছে। এবার প্রযুক্তির বিশ্বে সেমিকন্ডাক্টর গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটিই হয়ে উঠেছে তুরুপের তাস।
‘সেমিকন্ডাক্টর’ শব্দটি নতুন নয়, তবে নতুন করে শব্দটি গত দু-এক বছর ধরে আলোচনায় এসেছে। সেমিকন্ডাক্টর আসলে কী? এর পারিভাষিক অর্থ ‘অর্ধপরিবাহী’। ব্যক্তিগত ব্যবহার্য গাড়ি, ওয়াশিং মেশিন, স্মার্টফোন, কম্পিউটার চিপ—কোথায় নেই সেমিকন্ডাক্টর? মূলত সেমিকন্ডাক্টরের জোগানের ওপরই নির্ভর করে বেশ কয়েকটি শিল্প খাতের বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ। বিশ্বজুড়ে এই সেমিকন্ডাক্টরের বাণিজ্য দিনকে দিন বাড়ছে। আর যেখানে বাণিজ্য থাকবে, সেখানে প্রতিযোগিতা থাকবে না, তা কি হয়? এরই মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে বিশ্বের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে। আর সেই প্রতিযোগিতায় মূল পণ্য চিপ।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন অনেক মানুষ চীনের প্রযুক্তি দক্ষতার দিকে তাকিয়েছিল। কেউ কেউ এমনও বলেছিলেন যে চীনের এই প্রযুক্তিগত উত্থান শুধু পশ্চিমা অর্থনীতির জন্যই নয়, বরং সারা বিশ্বের নিরাপত্তার জন্যই হুমকি। এই হুমকির জন্য অভিযোগের আঙুল তোলা হচ্ছিল হুয়াওয়ে নামের এক ‘সফল’ প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, এই প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান চীন সরকারের নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের বাহক হিসেবে কাজ করছে। ২০১৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র হুয়াওয়েকে নানাভাবে আটকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। দেশটি চীনের প্রযুক্তি কারখানাগুলোতে মার্কিন মাইক্রোচিপ রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত কাঙ্ক্ষিত প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে। গত বছর হুয়াওয়ের আয় এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস পেয়েছে।
হুয়াওয়ের আয় প্রায় মাইক্রোসফটের মতোই বিপুল ছিল। একটি রাষ্ট্রের পক্ষে এত বড় একটি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানকে আটকে ফেলা ছিল বিস্ময়কর। হুয়াওয়ের এই পরিণতি দেখে সাবধান হয়ে গেছে জাপানের কারখানাগুলো। তারা যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি প্রবিধান এড়াতে তাদের পণ্যগুলো নীরবে বাজারজাত শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান চীনের কাছে প্রতিবছর কোটি কোটি ডলারের সরঞ্জাম বিক্রি করে। তারা এখন প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানির জন্য নতুন দেশ খুঁজতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে তাদের পছন্দের প্রথম দিকে আছে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার নাম।
এদিকে চীন সরকার তাদের দেশীয় প্রযুক্তি কারখানাগুলোকে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে। চীন চাইছে, যেসব প্রযুক্তি সরঞ্জাম (চিপ) যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করতে হয়, সেসব চীনা কারখানা নিজেরাই তৈরি করুক। চীন যদি এই প্রচেষ্টায় সফল হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে তার চিপ সাপ্লাইচেইনের ওপর আধিপত্য হারাবে।
জো বাইডেন গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছেন। তারপর থেকে বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা যখনই বিদেশি মিত্রদের সঙ্গে কথা বলেন, তখনই তারা এই চিপ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি উত্থাপন করেন। ওয়াশিংটনের একজন লবিস্ট নাম না প্রকাশের শর্তে বলেছেন, সেমিকন্ডাক্টর যে ধারাবাহিক কূটনৈতিক বিষয় হতে পারে, তা তিনি গত ২৫ বছরেও দেখেননি। এ জন্য ফোরামও গঠন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
এই ফোরাম গঠনকে অনেকেই ওপেকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংস্থা ওপেক। এই সংস্থাভুক্ত দেশগুলো বিশ্বের তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ কোন দেশে কতটুকু তেল পৌঁছাবে, তেলের দাম বাড়বে নাকি কমবে—এসব নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ওপেক। ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র যে নতুন প্রযুক্তি ফোরাম গঠন করেছে, সেটিও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। একে ডাকা হতে পারে ‘ওসেক’ (অর্গানাইজেশন অব দ্য সেমিকন্ডাক্টর এক্সপোর্টিং কান্ট্রিস) নামে।
অনেক কূটনৈতিক সংস্থা রয়েছে, যারা প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানিবিষয়ক বহুপক্ষীয় চুক্তি করে থাকে। কিন্তু সেমিকন্ডাক্টরের ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে এই সংস্থাগুলো খুবই দুর্বল। উদাহরণ হিসেবে ওয়াসেনার চুক্তির কথা বলা যায়। সামরিক কাজে ব্যবহৃত হতে পারে এমন জিনিসপত্রের ব্যবসা তত্ত্বাবধানের জন্য ১৯৯৬ সালে ওয়াসেনার চুক্তি করা হয়েছিল। এই চুক্তিকে কোকোমের (কো-অর্ডিনেটিং কমিটি ফর মাল্টিলেটারাল এক্সপোর্ট কনট্রোল) উত্তরসূরি বলা হয়। সংস্থাটি স্নায়ুযুদ্ধের সময় সাবেক সোভিয়েত ব্লকের সঙ্গে বাণিজ্যে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে গঠিত নতুন এই ফোরামের দাপ্তরিক নাম ‘ইইউ-ইউএস ট্রেড অ্যান্ড টেকনোলজি কাউন্সিল’। প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে নিবেদিত একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ নিয়ে গত জুনে এই ফোরাম গঠিত হয়েছে। এই ফোরামের এজেন্ডায় মূলত রয়েছে সেমিকন্ডাক্টর। গত সেপ্টেম্বরে পিটর্সবার্গে ফোরামের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের পর সংগঠনটি এক বিবৃতিতে জানায়, চিপ রপ্তানির বৈশ্বিক সাপ্লাইচেইন ব্যবস্থাপনায় তারা ভারসাম্য আনতে চায়। এটি আসলে চীনকে তাদের কাছ থেকে দূরে রাখার একটি কূটনৈতিক ভাষা বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
চিপ কূটনীতি ইদানীং এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে কি না—এমন আলোচনার ফাঁকেও চিপ প্রসঙ্গ উঠে আসছে। হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত রপ্তানিকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণগুলো কীভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজের অংশ হতে পারে, সে বিষয়ে ইতিমধ্যে সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনকে অবহিত করেছে মার্কিন প্রশাসন। রাশিয়ার এমন কোনো উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিশিল্প নেই। তাই এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা বাজেভাবে রাশিয়াকে আঘাত করবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। তবে এটি রাশিয়ার পক্ষে তার শত্রুদের ওপর সাইবার আক্রমণ চালানো কঠিন করে তুলতে পারে বলে মনে করছেন নিন্দুকেরা।
চিপ সাপ্লাইচেইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও নেদারল্যান্ডসের মধ্যে যেসব চুক্তি হয়েছে, সেসব নিয়ে বরং আলোচনা হওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই তিনটি দেশ চিপ তৈরির সিংহভাগ যন্ত্রপাতি উৎপাদন করে। ট্রাম্প আমলের শেষ মেয়াদে এই তিন দেশ চিপ বাণিজ্যনীতিতে ঐকমত্যে পৌঁছায়। তারা প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে চীনের ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এএসএমএল (অ্যাডভান্সড সেমিকন্ডাক্টর ম্যাটেরিয়ালস লিথোগ্রাফি) নামের একটি ডাচ প্রতিষ্ঠান চীনের সবচেয়ে বড় চিপ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান স্মিকের কাছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি বিক্রি করতে চেয়েছিল। এ খবর জানতে পেরে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ডাচ সরকারকে চেপে ধরে, যেন তারা ওই প্রতিষ্ঠানকে যন্ত্রপাতি রপ্তানি করার লাইসেন্স না দেয়।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, চীন যাতে যুক্তরাষ্ট্রের চিপ সরঞ্জামগুলো সহজে না পায়, তার জন্য যা করণীয় সবই করবে মার্কিন প্রশাসন। পাশাপাশি চিপ বাণিজ্য বিষয়ে চীনের সঙ্গে একধরনের আপসরফাও করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। সেই চাওয়া পূরণ হওয়া নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্রের চিপ-কূটনীতির ওপর। অস্বীকার করার উপায় নেই, যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি-কূটনীতি এখনো কিছুটা দুর্বল।
বিষয়টি বোঝা যায়, বিশ্বের বৃহত্তম সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টিএসএমসির শীর্ষ আইনজীবী রিচার্ড থার্স্টনের একটি বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, চিপ উৎপাদন নিয়ে অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। কারণ প্রেসিডেন্ট বাইডেন শেষ পর্যন্ত পাশে থাকবেন কি না, বোঝা মুশকিল। এ বছরের শেষের দিকে কংগ্রেসে যদি রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যায়, তাহলে অনেক চুক্তিই বাতিল হয়ে যেত পারে। আর এই ভয়ে বাইডেন প্রশাসন ‘চিপ্লোম্যাসি’ তথা চিপ-কূটনীতি নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
এদিকে চীন ক্রমাগত তাদের চিপ-প্রযুক্তি উন্নত করে চলেছে। চীনের তৈরি করা চিপের বিক্রি সারা পৃথিবীতেই ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রচারাভিযান এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও চীনের চিপ-বাণিজ্য ঊর্ধ্বগতিতে ফুলে-ফেঁপে উঠছে।
তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি, যেটি টিএসএমসি নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত, সেটি গত ১৩ জানুয়ারি বলেছে, ২০২২ সালে তারা সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনের পেছনে ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ব্যয় করবে। এটি গত বছরের চেয়ে ৩ হাজার কোটি ডলারের বেশি।
এদিক মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান ইনটেল এ বছর ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ব্যয় করার পরিকল্পনা করেছে। গত ২১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ২০২৫ সালের মধ্যে ওহাইওতে ইনটেল দুটি নতুন কারখানা তৈরি করবে। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান স্যামসাং বলেছে, এ বছর তাদের ব্যয় গত বছরের চেয়ে অন্তত ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার বেশি হবে। এবং সেটি হবে মূলত চিপের কারণেই।
সারা পৃথিবীতেই প্রযুক্তি খাতে চিপের চাহিদা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠান মর্গান স্ট্যানলির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত দুই বছরে চিপ ক্রেতার সংখ্যা বেড়ে গেছে। শতকরা ৫৫ শতাংশ ক্রেতা আগের চেয়ে দ্বিগুণ চিপ অর্ডার করছেন।
সুতরাং পৃথিবীজুড়েই সেমিকন্ডাক্টরের চাহিদা বাড়ছে। আর এই বিশাল বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চায় চীন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এত সহজে এই সুযোগ দেবে কেন? তারাও নানা তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, বিবিসি, দ্য ডিপ্লোম্যাট ও দ্য ইকোনমিক টাইমস
বিশ্লেষণ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
প্রযুক্তির বাজার দিনে দিনে পরিবর্তিত হচ্ছে। এই বাজারে খেলোয়াড়ও অনেক। কখনো যুক্তরাষ্ট্র বা কখনো চীন এই বাজারে ছড়ি ঘোরানোর চেষ্টা করছে। এবার প্রযুক্তির বিশ্বে সেমিকন্ডাক্টর গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটিই হয়ে উঠেছে তুরুপের তাস।
‘সেমিকন্ডাক্টর’ শব্দটি নতুন নয়, তবে নতুন করে শব্দটি গত দু-এক বছর ধরে আলোচনায় এসেছে। সেমিকন্ডাক্টর আসলে কী? এর পারিভাষিক অর্থ ‘অর্ধপরিবাহী’। ব্যক্তিগত ব্যবহার্য গাড়ি, ওয়াশিং মেশিন, স্মার্টফোন, কম্পিউটার চিপ—কোথায় নেই সেমিকন্ডাক্টর? মূলত সেমিকন্ডাক্টরের জোগানের ওপরই নির্ভর করে বেশ কয়েকটি শিল্প খাতের বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ। বিশ্বজুড়ে এই সেমিকন্ডাক্টরের বাণিজ্য দিনকে দিন বাড়ছে। আর যেখানে বাণিজ্য থাকবে, সেখানে প্রতিযোগিতা থাকবে না, তা কি হয়? এরই মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে বিশ্বের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে। আর সেই প্রতিযোগিতায় মূল পণ্য চিপ।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন অনেক মানুষ চীনের প্রযুক্তি দক্ষতার দিকে তাকিয়েছিল। কেউ কেউ এমনও বলেছিলেন যে চীনের এই প্রযুক্তিগত উত্থান শুধু পশ্চিমা অর্থনীতির জন্যই নয়, বরং সারা বিশ্বের নিরাপত্তার জন্যই হুমকি। এই হুমকির জন্য অভিযোগের আঙুল তোলা হচ্ছিল হুয়াওয়ে নামের এক ‘সফল’ প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, এই প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান চীন সরকারের নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের বাহক হিসেবে কাজ করছে। ২০১৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র হুয়াওয়েকে নানাভাবে আটকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। দেশটি চীনের প্রযুক্তি কারখানাগুলোতে মার্কিন মাইক্রোচিপ রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত কাঙ্ক্ষিত প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে। গত বছর হুয়াওয়ের আয় এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস পেয়েছে।
হুয়াওয়ের আয় প্রায় মাইক্রোসফটের মতোই বিপুল ছিল। একটি রাষ্ট্রের পক্ষে এত বড় একটি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানকে আটকে ফেলা ছিল বিস্ময়কর। হুয়াওয়ের এই পরিণতি দেখে সাবধান হয়ে গেছে জাপানের কারখানাগুলো। তারা যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি প্রবিধান এড়াতে তাদের পণ্যগুলো নীরবে বাজারজাত শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান চীনের কাছে প্রতিবছর কোটি কোটি ডলারের সরঞ্জাম বিক্রি করে। তারা এখন প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানির জন্য নতুন দেশ খুঁজতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে তাদের পছন্দের প্রথম দিকে আছে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার নাম।
এদিকে চীন সরকার তাদের দেশীয় প্রযুক্তি কারখানাগুলোকে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে। চীন চাইছে, যেসব প্রযুক্তি সরঞ্জাম (চিপ) যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করতে হয়, সেসব চীনা কারখানা নিজেরাই তৈরি করুক। চীন যদি এই প্রচেষ্টায় সফল হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে তার চিপ সাপ্লাইচেইনের ওপর আধিপত্য হারাবে।
জো বাইডেন গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছেন। তারপর থেকে বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা যখনই বিদেশি মিত্রদের সঙ্গে কথা বলেন, তখনই তারা এই চিপ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি উত্থাপন করেন। ওয়াশিংটনের একজন লবিস্ট নাম না প্রকাশের শর্তে বলেছেন, সেমিকন্ডাক্টর যে ধারাবাহিক কূটনৈতিক বিষয় হতে পারে, তা তিনি গত ২৫ বছরেও দেখেননি। এ জন্য ফোরামও গঠন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
এই ফোরাম গঠনকে অনেকেই ওপেকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংস্থা ওপেক। এই সংস্থাভুক্ত দেশগুলো বিশ্বের তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ কোন দেশে কতটুকু তেল পৌঁছাবে, তেলের দাম বাড়বে নাকি কমবে—এসব নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ওপেক। ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র যে নতুন প্রযুক্তি ফোরাম গঠন করেছে, সেটিও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। একে ডাকা হতে পারে ‘ওসেক’ (অর্গানাইজেশন অব দ্য সেমিকন্ডাক্টর এক্সপোর্টিং কান্ট্রিস) নামে।
অনেক কূটনৈতিক সংস্থা রয়েছে, যারা প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানিবিষয়ক বহুপক্ষীয় চুক্তি করে থাকে। কিন্তু সেমিকন্ডাক্টরের ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে এই সংস্থাগুলো খুবই দুর্বল। উদাহরণ হিসেবে ওয়াসেনার চুক্তির কথা বলা যায়। সামরিক কাজে ব্যবহৃত হতে পারে এমন জিনিসপত্রের ব্যবসা তত্ত্বাবধানের জন্য ১৯৯৬ সালে ওয়াসেনার চুক্তি করা হয়েছিল। এই চুক্তিকে কোকোমের (কো-অর্ডিনেটিং কমিটি ফর মাল্টিলেটারাল এক্সপোর্ট কনট্রোল) উত্তরসূরি বলা হয়। সংস্থাটি স্নায়ুযুদ্ধের সময় সাবেক সোভিয়েত ব্লকের সঙ্গে বাণিজ্যে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে গঠিত নতুন এই ফোরামের দাপ্তরিক নাম ‘ইইউ-ইউএস ট্রেড অ্যান্ড টেকনোলজি কাউন্সিল’। প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে নিবেদিত একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ নিয়ে গত জুনে এই ফোরাম গঠিত হয়েছে। এই ফোরামের এজেন্ডায় মূলত রয়েছে সেমিকন্ডাক্টর। গত সেপ্টেম্বরে পিটর্সবার্গে ফোরামের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের পর সংগঠনটি এক বিবৃতিতে জানায়, চিপ রপ্তানির বৈশ্বিক সাপ্লাইচেইন ব্যবস্থাপনায় তারা ভারসাম্য আনতে চায়। এটি আসলে চীনকে তাদের কাছ থেকে দূরে রাখার একটি কূটনৈতিক ভাষা বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
চিপ কূটনীতি ইদানীং এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে কি না—এমন আলোচনার ফাঁকেও চিপ প্রসঙ্গ উঠে আসছে। হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত রপ্তানিকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণগুলো কীভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজের অংশ হতে পারে, সে বিষয়ে ইতিমধ্যে সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনকে অবহিত করেছে মার্কিন প্রশাসন। রাশিয়ার এমন কোনো উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিশিল্প নেই। তাই এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা বাজেভাবে রাশিয়াকে আঘাত করবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। তবে এটি রাশিয়ার পক্ষে তার শত্রুদের ওপর সাইবার আক্রমণ চালানো কঠিন করে তুলতে পারে বলে মনে করছেন নিন্দুকেরা।
চিপ সাপ্লাইচেইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও নেদারল্যান্ডসের মধ্যে যেসব চুক্তি হয়েছে, সেসব নিয়ে বরং আলোচনা হওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই তিনটি দেশ চিপ তৈরির সিংহভাগ যন্ত্রপাতি উৎপাদন করে। ট্রাম্প আমলের শেষ মেয়াদে এই তিন দেশ চিপ বাণিজ্যনীতিতে ঐকমত্যে পৌঁছায়। তারা প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে চীনের ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এএসএমএল (অ্যাডভান্সড সেমিকন্ডাক্টর ম্যাটেরিয়ালস লিথোগ্রাফি) নামের একটি ডাচ প্রতিষ্ঠান চীনের সবচেয়ে বড় চিপ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান স্মিকের কাছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি বিক্রি করতে চেয়েছিল। এ খবর জানতে পেরে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ডাচ সরকারকে চেপে ধরে, যেন তারা ওই প্রতিষ্ঠানকে যন্ত্রপাতি রপ্তানি করার লাইসেন্স না দেয়।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, চীন যাতে যুক্তরাষ্ট্রের চিপ সরঞ্জামগুলো সহজে না পায়, তার জন্য যা করণীয় সবই করবে মার্কিন প্রশাসন। পাশাপাশি চিপ বাণিজ্য বিষয়ে চীনের সঙ্গে একধরনের আপসরফাও করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। সেই চাওয়া পূরণ হওয়া নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্রের চিপ-কূটনীতির ওপর। অস্বীকার করার উপায় নেই, যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি-কূটনীতি এখনো কিছুটা দুর্বল।
বিষয়টি বোঝা যায়, বিশ্বের বৃহত্তম সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টিএসএমসির শীর্ষ আইনজীবী রিচার্ড থার্স্টনের একটি বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, চিপ উৎপাদন নিয়ে অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। কারণ প্রেসিডেন্ট বাইডেন শেষ পর্যন্ত পাশে থাকবেন কি না, বোঝা মুশকিল। এ বছরের শেষের দিকে কংগ্রেসে যদি রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যায়, তাহলে অনেক চুক্তিই বাতিল হয়ে যেত পারে। আর এই ভয়ে বাইডেন প্রশাসন ‘চিপ্লোম্যাসি’ তথা চিপ-কূটনীতি নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
এদিকে চীন ক্রমাগত তাদের চিপ-প্রযুক্তি উন্নত করে চলেছে। চীনের তৈরি করা চিপের বিক্রি সারা পৃথিবীতেই ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রচারাভিযান এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও চীনের চিপ-বাণিজ্য ঊর্ধ্বগতিতে ফুলে-ফেঁপে উঠছে।
তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি, যেটি টিএসএমসি নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত, সেটি গত ১৩ জানুয়ারি বলেছে, ২০২২ সালে তারা সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনের পেছনে ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ব্যয় করবে। এটি গত বছরের চেয়ে ৩ হাজার কোটি ডলারের বেশি।
এদিক মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান ইনটেল এ বছর ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ব্যয় করার পরিকল্পনা করেছে। গত ২১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ২০২৫ সালের মধ্যে ওহাইওতে ইনটেল দুটি নতুন কারখানা তৈরি করবে। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান স্যামসাং বলেছে, এ বছর তাদের ব্যয় গত বছরের চেয়ে অন্তত ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার বেশি হবে। এবং সেটি হবে মূলত চিপের কারণেই।
সারা পৃথিবীতেই প্রযুক্তি খাতে চিপের চাহিদা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠান মর্গান স্ট্যানলির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত দুই বছরে চিপ ক্রেতার সংখ্যা বেড়ে গেছে। শতকরা ৫৫ শতাংশ ক্রেতা আগের চেয়ে দ্বিগুণ চিপ অর্ডার করছেন।
সুতরাং পৃথিবীজুড়েই সেমিকন্ডাক্টরের চাহিদা বাড়ছে। আর এই বিশাল বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চায় চীন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এত সহজে এই সুযোগ দেবে কেন? তারাও নানা তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, বিবিসি, দ্য ডিপ্লোম্যাট ও দ্য ইকোনমিক টাইমস
বিশ্লেষণ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
৩ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৮ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
১০ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
১০ দিন আগে