মারুফ ইসলাম
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মাত্র কিছুদিন আগেই (১ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বলেছেন, ‘একটি নির্বাচনের ফলাফল যদি দুটি হয়, অর্থাৎ জয়ী হওয়া অথবা প্রতারিত হওয়া, তাহলে সেখানে গণতন্ত্র টিকতে পারে না।’ কথাটা হয়তো তিনি ব্রাজিলকে উদ্দেশ করেও বলেছিলেন। কারণ, ব্রাজিলের নির্বাচনী পরিস্থিতি ঠিক সেদিকেই যাচ্ছে, যে দিকে গেলে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে।
আগামী মাসেই একটি নির্বাচনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো। সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, তিনি সম্ভবত এ নির্বাচনে হেরে যাবেন। এর আগে গত বছরের মার্চে পরিচালিত এক জরিপেও তাঁর ভোট কমে যাওয়ার চিত্র উঠে এসেছিল। সেই জরিপে ৫৯ শতাংশ ভোটার তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
যা হোক, পরাজয়ের আগাম ইঙ্গিত পেয়ে ‘যদি’ যুক্ত করে একটি মন্তব্য করেছেন বলসোনারো। তিনি বলেছেন, নির্বাচনের ফলাফল তখনই গ্রহণ করবেন যদি নির্বাচন স্বচ্ছ ও পরিষ্কার হয়।
ব্রাজিলে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন সম্পর্কে সমালোচনা তুলনামূলক কম। সেখানে হস্তক্ষেপ করা বেশ কঠিন। তারপরও এই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বলসোনারো। তিনি বলেছেন, নির্বাচনে কোনো না কোনোভাবে তাঁর বিরুদ্ধে কারচুপি হতে পারে।
তবে এ ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বলসোনারো অবশ্য যথাযথ প্রমাণ দেখাতে পারেননি। তাতে বলসোনারোর খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। কারণ, তাঁর সমর্থকেরা তাঁকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। ফলে ব্রাজিলের অনেকেরই ধারণা, নির্বাচনে হেরে গেলে বলসোনারো তাঁর অন্ধ অনুসারীদের উসকে দিয়ে বিদ্রোহের দিকে ঠেলে দিতে পারেন। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল যুক্তরাষ্ট্রে। গত বছরের ৬ জানুয়ারি নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর ক্যাপিটল হিল আক্রমণ করতে অন্ধ সমর্থকদের উসকে দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বিশ্লেষকদের ধারণা, ব্রাজিলে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে, তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
অনেকেই ভাবতে পারেন, বলসোনারো তাঁর ভক্তদের উসকে দিতে পারেন—এমন আগাম ধারণা করার কোনো কারণ আছে কি? হ্যাঁ, আছে বৈকি। এর আগে এ ধরনের কাজ তিনি করেছেন। তিনি মানুষের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করতে পটু। তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনা উঠলেই তিনি তা ‘ভুয়া খবর’ বলে উড়িয়ে দেন। তিনি ট্রাম্পের মতোই কর্তৃত্ববাদী। বলসোনারো ছিলেন ব্রাজিলের সাবেক সেনা কর্মকর্তা। কর্তৃত্ববাদী মনোভাব তাঁর অভ্যাসের মধ্যেই রয়েছে। সেই অভ্যাস মাঝে মাঝেই তাঁকে নস্টালজিক করে তোলে। তাঁর এক ছেলে তো ট্রাম্প সমর্থকদের ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। সেই ছেলে আবার বলসোনারোর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা।
আজেবাজে কথা বলার জন্য বলসোনারোর সুনাম সুবিদিত। তিনি ২০১৮ সাল থেকে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের পদে রয়েছেন। কেউ কেউ বলে থাকেন, তিনি পৃথিবীর সমস্ত ‘মুখ খারাপ করা’ নেতাদের কাছ থেকে সব ধরনের নোংরা ভাষা রপ্ত করেছেন। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কতটা ‘জঘন্যভাবে’ অপব্যবহার করা যায়, সেই বিদ্যাও তিনি আয়ত্তে এনেছেন। এই কাজে ব্রাজিলে তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। তিনি একপ্রকার অপ্রতিদ্বন্দ্বী!
বিশ্লেষকদের ধারণা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তিনি মূলত তাঁর সমর্থকদের দুটি জিনিস খুব চমৎকারভাবে বোঝাতে সক্ষম হবেন। এক. ভোটে হেরে গেলে, নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে বলে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা এবং দুই. তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভাকে ‘শয়তান’ বলে প্রচার করা। তিনি এ রকমটা প্রচার করবেন যে, লুলার হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া মানে ব্রাজিলকে শয়তানের হাতে তুলে দেওয়া। তিনি ব্রাজিলের সব গির্জা বন্ধ করে দেবেন। দেশকে মাদকের আখড়ায় পরিণত করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
লুলা দা সিলভা একজন বাস্তববাদী বামপন্থী। তিনি ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলের মোটামুটি সফল একজন প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাঁর শাসনামলে পণ্য উৎপাদন বেড়েছিল এবং মানুষের আয় বেড়েছিল। ব্রাজিলের রাজনীতিসংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ মনে করেন, তিনি দেশটিকে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের দিকে অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঘুষ গ্রহণের কেলেঙ্কারি মাথায় নিয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল লুলাকে। যদিও তিনি তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। সুতরাং তিনিও খুব একটা আদর্শ প্রার্থী নন, তবে তিনি গণতন্ত্রের সমর্থক।
তবে বলসোনারো সহজাতভাবে গণতান্ত্রিক নন। তিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে কাজ করলেও ক্রমাগত গণতন্ত্র এড়ানোর উপায় খুঁজছেন। তাঁর উত্থান হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন ব্রাজিল নানা সংকটে নিমজ্জিত ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর ব্যক্তি হিসেবে বলসোনারোর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। সেই জনপ্রিয়তার পিঠে সওয়ার হয়েই তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন বর্ণবাদী ও নারীবিদ্বেষী কট্টর ব্যক্তি।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ট্রাম্পকে যতটা সহজে থামানো গেছে, বলসোনারোকে থামানো ততটা সহজ হবে না। কারণ, ব্রাজিলের ‘সিস্টেম’ ততটা শক্তিশালী নয়। যুক্তরাষ্ট্রে সেনাবাহিনী ক্যু ঘটিয়ে ক্ষমতার পালাবদল ঘটাবে— এমনটা অকল্পনীয়। কিন্তু ব্রাজিলে সামরিক শাসন শেষ হয়েছে মোটে ১৯৮৫ সালে। ব্রাজিলে সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর এখনো গভীর আঁতাত রয়েছে। ইতিমধ্যেই একটি সম্ভাব্য ‘বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান’ নিয়ে গুঞ্জন চাউর হয়েছে ব্রাজিলে।
বড় ধরনের অভ্যুত্থান না ঘটলেও একধরনের বিদ্রোহ হতে পারে বলেই অনেকের ধারণা। কারণ, বলসোনারো প্রায়ই সহিংসতা উসকে দেন। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৪৫ জনেরও বেশি রাজনীতিবিদ খুন হয়েছেন ব্রাজিলে। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বলসোনারোর সমর্থকেরা আরও বেশি সশস্ত্র হয়েছে। তিনি ক্ষমতায় আরোহণের পর থেকে দেশে বন্দুকের ব্যবহার বেড়েছে। ব্যক্তিগত বন্দুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা আগের চেয়ে হয়েছে দ্বিগুণ।
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ব্রাজিলের ইলেকটোরাল ট্রাইব্যুনাল যদি লুলাকে বিজয়ী ঘোষণা করে, তবে বলসোনারোর সশস্ত্র সমর্থকেরা ট্রাইব্যুনালে হামলা চালাতে পারে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্রাজিলের পুলিশ বাহিনীতে প্রায় ৪ লাখ সদস্য রয়েছে। শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বে থাকা এই পুলিশেরা তখন কোন পক্ষ নেবে? বলসোনারোর পক্ষ নেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, বন্দুক চালানোতে যথেচ্ছাচারী এ বাহিনীর সদস্যদের সুরক্ষা দিতে বলসোনারো ইতিমধ্যে একটি আইনের প্রস্তাব করেছেন। এর ফলে তারা বলসোনারোর ‘ভক্ত’ হয়ে উঠেছে।
এই সবকিছু মিলিয়ে বলসোনারো এখন লাতিন আমেরিকার গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছেন। তিনি ট্রাম্পের কাছ থেকে শিখেছেন, পরাজয়ের পরেও কীভাবে চোয়াল শক্ত রাখতে হয় এবং ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে হয়।
ট্রাম্প যখন নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন, তখন তাঁর সমর্থকদের বলেছিলেন, ‘আমাদের ভোট ছিনতাই হয়ে গেছে’। তাঁর এই অকপট মিথ্যা একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে উসকে দিয়েছিল। তাঁর মিথ্যা বক্তব্যের ওপর ভর করে হাজার হাজার মানুষ একত্র হয়েছিল এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামায় নেমেছিল।
একই ধরনের মিথ্যা বলসোনারোকেও ব্রাজিলের প্রভাবশালী বিরোধীদলীয় নেতায় পরিণত করতে পারে। তাঁর শক্তির জায়গাগুলো হচ্ছে—খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারকেরা, সশস্ত্র সমর্থকেরা এবং ভূমিহীন দুর্বল গ্রামীণ মানুষ। তাঁরা মনে করেন, বলসোনারো ব্রাজিলের জন্য সঠিক প্রেসিডেন্ট।
বলসোনারো ব্রাজিলের জনগণকে আরও বেশি বিভক্ত করার ক্ষমতা রাখেন। দ্বিধা, বিভক্তি, উসকানি—এসবই তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। শোনা যায়, তিনি যখন সেনা কর্মকর্তা ছিলেন, তখন একবার সেনাদের বেতন বাড়ানোর আন্দোলনকে বেগবান করতে তাঁর ব্যারাকের একটি বাথরুমে বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করেছিলেন!
ব্রাজিলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফা শুরু হচ্ছে আগামী ২ অক্টোবর, শেষ হবে ৩০ অক্টোবর। ফলাফল যেটাই হোক না কেন, সন্দেহ নেই যে—বলসোনারো জিতেছেন বলেই দাবি করবেন। সুতরাং ব্রাজিলে আগামী কয়েক সপ্তাহ খুব বিপজ্জনক ও উত্তেজনাপূর্ণ হবে, তা হলফ করেই বলা যায়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশের উচিত, ব্রাজিলের গণতন্ত্রকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়া। একই সঙ্গে সেনাবাহিনীকেও স্পষ্টভাবে বার্তা দেওয়া দরকার যে, অভ্যুত্থানের মতো কিছু ঘটলে ব্রাজিল একটি ‘অচ্ছুত ও বিচ্ছিন্ন’ দেশে পরিণত হবে। ব্রাজিলের জনগণের উচিত, ভোটের মাধ্যমে একজন নির্লজ্জ পপুলিস্টকে প্রতিহত করা। এবং জনগণের বিশ্বাস রাখা উচিত যে, তাদের দেশ আরও ভালো নেতা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে।
ব্রাজিলের জনগণ ব্যালটে কী সিদ্ধান্ত নেন, তা-ই এখন দেখার।
তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, এনবিসি নিউজ, দ্য গার্ডিয়ান ও ডয়চে ভেলে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মাত্র কিছুদিন আগেই (১ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বলেছেন, ‘একটি নির্বাচনের ফলাফল যদি দুটি হয়, অর্থাৎ জয়ী হওয়া অথবা প্রতারিত হওয়া, তাহলে সেখানে গণতন্ত্র টিকতে পারে না।’ কথাটা হয়তো তিনি ব্রাজিলকে উদ্দেশ করেও বলেছিলেন। কারণ, ব্রাজিলের নির্বাচনী পরিস্থিতি ঠিক সেদিকেই যাচ্ছে, যে দিকে গেলে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে।
আগামী মাসেই একটি নির্বাচনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো। সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, তিনি সম্ভবত এ নির্বাচনে হেরে যাবেন। এর আগে গত বছরের মার্চে পরিচালিত এক জরিপেও তাঁর ভোট কমে যাওয়ার চিত্র উঠে এসেছিল। সেই জরিপে ৫৯ শতাংশ ভোটার তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
যা হোক, পরাজয়ের আগাম ইঙ্গিত পেয়ে ‘যদি’ যুক্ত করে একটি মন্তব্য করেছেন বলসোনারো। তিনি বলেছেন, নির্বাচনের ফলাফল তখনই গ্রহণ করবেন যদি নির্বাচন স্বচ্ছ ও পরিষ্কার হয়।
ব্রাজিলে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন সম্পর্কে সমালোচনা তুলনামূলক কম। সেখানে হস্তক্ষেপ করা বেশ কঠিন। তারপরও এই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বলসোনারো। তিনি বলেছেন, নির্বাচনে কোনো না কোনোভাবে তাঁর বিরুদ্ধে কারচুপি হতে পারে।
তবে এ ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বলসোনারো অবশ্য যথাযথ প্রমাণ দেখাতে পারেননি। তাতে বলসোনারোর খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। কারণ, তাঁর সমর্থকেরা তাঁকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। ফলে ব্রাজিলের অনেকেরই ধারণা, নির্বাচনে হেরে গেলে বলসোনারো তাঁর অন্ধ অনুসারীদের উসকে দিয়ে বিদ্রোহের দিকে ঠেলে দিতে পারেন। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল যুক্তরাষ্ট্রে। গত বছরের ৬ জানুয়ারি নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর ক্যাপিটল হিল আক্রমণ করতে অন্ধ সমর্থকদের উসকে দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বিশ্লেষকদের ধারণা, ব্রাজিলে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে, তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
অনেকেই ভাবতে পারেন, বলসোনারো তাঁর ভক্তদের উসকে দিতে পারেন—এমন আগাম ধারণা করার কোনো কারণ আছে কি? হ্যাঁ, আছে বৈকি। এর আগে এ ধরনের কাজ তিনি করেছেন। তিনি মানুষের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করতে পটু। তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনা উঠলেই তিনি তা ‘ভুয়া খবর’ বলে উড়িয়ে দেন। তিনি ট্রাম্পের মতোই কর্তৃত্ববাদী। বলসোনারো ছিলেন ব্রাজিলের সাবেক সেনা কর্মকর্তা। কর্তৃত্ববাদী মনোভাব তাঁর অভ্যাসের মধ্যেই রয়েছে। সেই অভ্যাস মাঝে মাঝেই তাঁকে নস্টালজিক করে তোলে। তাঁর এক ছেলে তো ট্রাম্প সমর্থকদের ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। সেই ছেলে আবার বলসোনারোর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা।
আজেবাজে কথা বলার জন্য বলসোনারোর সুনাম সুবিদিত। তিনি ২০১৮ সাল থেকে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের পদে রয়েছেন। কেউ কেউ বলে থাকেন, তিনি পৃথিবীর সমস্ত ‘মুখ খারাপ করা’ নেতাদের কাছ থেকে সব ধরনের নোংরা ভাষা রপ্ত করেছেন। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কতটা ‘জঘন্যভাবে’ অপব্যবহার করা যায়, সেই বিদ্যাও তিনি আয়ত্তে এনেছেন। এই কাজে ব্রাজিলে তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। তিনি একপ্রকার অপ্রতিদ্বন্দ্বী!
বিশ্লেষকদের ধারণা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তিনি মূলত তাঁর সমর্থকদের দুটি জিনিস খুব চমৎকারভাবে বোঝাতে সক্ষম হবেন। এক. ভোটে হেরে গেলে, নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে বলে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা এবং দুই. তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভাকে ‘শয়তান’ বলে প্রচার করা। তিনি এ রকমটা প্রচার করবেন যে, লুলার হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া মানে ব্রাজিলকে শয়তানের হাতে তুলে দেওয়া। তিনি ব্রাজিলের সব গির্জা বন্ধ করে দেবেন। দেশকে মাদকের আখড়ায় পরিণত করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
লুলা দা সিলভা একজন বাস্তববাদী বামপন্থী। তিনি ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলের মোটামুটি সফল একজন প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাঁর শাসনামলে পণ্য উৎপাদন বেড়েছিল এবং মানুষের আয় বেড়েছিল। ব্রাজিলের রাজনীতিসংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ মনে করেন, তিনি দেশটিকে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের দিকে অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঘুষ গ্রহণের কেলেঙ্কারি মাথায় নিয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল লুলাকে। যদিও তিনি তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। সুতরাং তিনিও খুব একটা আদর্শ প্রার্থী নন, তবে তিনি গণতন্ত্রের সমর্থক।
তবে বলসোনারো সহজাতভাবে গণতান্ত্রিক নন। তিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে কাজ করলেও ক্রমাগত গণতন্ত্র এড়ানোর উপায় খুঁজছেন। তাঁর উত্থান হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন ব্রাজিল নানা সংকটে নিমজ্জিত ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর ব্যক্তি হিসেবে বলসোনারোর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। সেই জনপ্রিয়তার পিঠে সওয়ার হয়েই তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন বর্ণবাদী ও নারীবিদ্বেষী কট্টর ব্যক্তি।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ট্রাম্পকে যতটা সহজে থামানো গেছে, বলসোনারোকে থামানো ততটা সহজ হবে না। কারণ, ব্রাজিলের ‘সিস্টেম’ ততটা শক্তিশালী নয়। যুক্তরাষ্ট্রে সেনাবাহিনী ক্যু ঘটিয়ে ক্ষমতার পালাবদল ঘটাবে— এমনটা অকল্পনীয়। কিন্তু ব্রাজিলে সামরিক শাসন শেষ হয়েছে মোটে ১৯৮৫ সালে। ব্রাজিলে সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর এখনো গভীর আঁতাত রয়েছে। ইতিমধ্যেই একটি সম্ভাব্য ‘বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান’ নিয়ে গুঞ্জন চাউর হয়েছে ব্রাজিলে।
বড় ধরনের অভ্যুত্থান না ঘটলেও একধরনের বিদ্রোহ হতে পারে বলেই অনেকের ধারণা। কারণ, বলসোনারো প্রায়ই সহিংসতা উসকে দেন। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৪৫ জনেরও বেশি রাজনীতিবিদ খুন হয়েছেন ব্রাজিলে। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বলসোনারোর সমর্থকেরা আরও বেশি সশস্ত্র হয়েছে। তিনি ক্ষমতায় আরোহণের পর থেকে দেশে বন্দুকের ব্যবহার বেড়েছে। ব্যক্তিগত বন্দুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা আগের চেয়ে হয়েছে দ্বিগুণ।
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ব্রাজিলের ইলেকটোরাল ট্রাইব্যুনাল যদি লুলাকে বিজয়ী ঘোষণা করে, তবে বলসোনারোর সশস্ত্র সমর্থকেরা ট্রাইব্যুনালে হামলা চালাতে পারে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্রাজিলের পুলিশ বাহিনীতে প্রায় ৪ লাখ সদস্য রয়েছে। শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বে থাকা এই পুলিশেরা তখন কোন পক্ষ নেবে? বলসোনারোর পক্ষ নেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, বন্দুক চালানোতে যথেচ্ছাচারী এ বাহিনীর সদস্যদের সুরক্ষা দিতে বলসোনারো ইতিমধ্যে একটি আইনের প্রস্তাব করেছেন। এর ফলে তারা বলসোনারোর ‘ভক্ত’ হয়ে উঠেছে।
এই সবকিছু মিলিয়ে বলসোনারো এখন লাতিন আমেরিকার গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছেন। তিনি ট্রাম্পের কাছ থেকে শিখেছেন, পরাজয়ের পরেও কীভাবে চোয়াল শক্ত রাখতে হয় এবং ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে হয়।
ট্রাম্প যখন নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন, তখন তাঁর সমর্থকদের বলেছিলেন, ‘আমাদের ভোট ছিনতাই হয়ে গেছে’। তাঁর এই অকপট মিথ্যা একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে উসকে দিয়েছিল। তাঁর মিথ্যা বক্তব্যের ওপর ভর করে হাজার হাজার মানুষ একত্র হয়েছিল এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামায় নেমেছিল।
একই ধরনের মিথ্যা বলসোনারোকেও ব্রাজিলের প্রভাবশালী বিরোধীদলীয় নেতায় পরিণত করতে পারে। তাঁর শক্তির জায়গাগুলো হচ্ছে—খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারকেরা, সশস্ত্র সমর্থকেরা এবং ভূমিহীন দুর্বল গ্রামীণ মানুষ। তাঁরা মনে করেন, বলসোনারো ব্রাজিলের জন্য সঠিক প্রেসিডেন্ট।
বলসোনারো ব্রাজিলের জনগণকে আরও বেশি বিভক্ত করার ক্ষমতা রাখেন। দ্বিধা, বিভক্তি, উসকানি—এসবই তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। শোনা যায়, তিনি যখন সেনা কর্মকর্তা ছিলেন, তখন একবার সেনাদের বেতন বাড়ানোর আন্দোলনকে বেগবান করতে তাঁর ব্যারাকের একটি বাথরুমে বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করেছিলেন!
ব্রাজিলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফা শুরু হচ্ছে আগামী ২ অক্টোবর, শেষ হবে ৩০ অক্টোবর। ফলাফল যেটাই হোক না কেন, সন্দেহ নেই যে—বলসোনারো জিতেছেন বলেই দাবি করবেন। সুতরাং ব্রাজিলে আগামী কয়েক সপ্তাহ খুব বিপজ্জনক ও উত্তেজনাপূর্ণ হবে, তা হলফ করেই বলা যায়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশের উচিত, ব্রাজিলের গণতন্ত্রকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়া। একই সঙ্গে সেনাবাহিনীকেও স্পষ্টভাবে বার্তা দেওয়া দরকার যে, অভ্যুত্থানের মতো কিছু ঘটলে ব্রাজিল একটি ‘অচ্ছুত ও বিচ্ছিন্ন’ দেশে পরিণত হবে। ব্রাজিলের জনগণের উচিত, ভোটের মাধ্যমে একজন নির্লজ্জ পপুলিস্টকে প্রতিহত করা। এবং জনগণের বিশ্বাস রাখা উচিত যে, তাদের দেশ আরও ভালো নেতা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে।
ব্রাজিলের জনগণ ব্যালটে কী সিদ্ধান্ত নেন, তা-ই এখন দেখার।
তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, এনবিসি নিউজ, দ্য গার্ডিয়ান ও ডয়চে ভেলে
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
২ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৬ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
৮ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
৯ দিন আগে