মারুফ ইসলাম
স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাই সশস্ত্র বাহিনীর কাজ; সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক সব রাষ্ট্রেই তা-ই হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানই বোধ হয় একমাত্র রাষ্ট্র, যেখানে রাজনৈতিক দল ও গণতন্ত্রের প্রধান উপাদান নির্বাচনী ব্যবস্থা থাকার পরও দশকের পর দশক ধরে রাষ্ট্র পরিচালনায় সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ চলছে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে থাকা এই দেশে বরাবরই সহিংস বিক্ষোভ হয়, জঙ্গি হামলাও প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠী সেনাবাহিনী কখনো আক্রান্ত হয়নি। এবার সেই বিরল ঘটনাটি ঘটেছে, সেনাসদরে হামলা হয়েছে।
দুর্নীতির একটি মামলায় গত মঙ্গলবার (৯ মে) ইসলামাবাদ হাইকোর্টের সামনে থেকে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) প্রধান ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর থেকে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে পাকিস্তান। ইমরানের হাজার হাজার সমর্থক রাস্তায় নেমে এসেছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষও। বিক্ষোভের মধ্যে গাড়ি ভাঙচুর, টায়ারে অগ্নিসংযোগ ও সরকারি ভবনের আসবাব তছনছের মতো ঘটনা ঘটেছে।
মঙ্গলবার রাত থেকে ইসলামাবাদ, পেশোয়ার, পাঞ্জাব, লাহোর, খাইবার পাখতুনখাওয়া, রাওয়ালপিন্ডিসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষে এ পর্যন্ত আটজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন প্রায় ৩০০ মানুষ। গ্রেপ্তার করা হয়েছে অন্তত দুই হাজার বিক্ষোভকারীকে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে খাইবার পাখতুনখাওয়া এবং ইসলামাবাদে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে শাহবাজ শরিফের সরকার। তবু পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার নাম নেই। পাকিস্তানের গণমাধ্যম বলছে, আজও দেশটির বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ-বিক্ষোভকারী সংঘর্ষ হয়েছে। অনেকেই বলছেন, পাকিস্তানের এই বিক্ষোভ ‘নজিরবিহীন’।
কেন এবারের বিক্ষোভ ‘নজিরবিহীন’
পাকিস্তান রাষ্ট্র ও রাজনীতির ইতিহাসের সঙ্গে সেনাবাহিনী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষ ঠাট্টা করে বলে, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী রয়েছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি রাষ্ট্র রয়েছে। আজ অবধি পাকিস্তানের কোনো রাষ্ট্রনায়কই সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ মদদ ছাড়া রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসতে পারেনি। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষও এত দিন এটা বিশ্বাস করে এসেছে যে, কোনো না কোনোভাবে সেনাবাহিনী পাকিস্তানের রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করবেই।
কিন্তু মঙ্গলবার দিন শেষে শুরু হওয়া বিক্ষোভটি ক্রমেই সেনাবিরোধী বিক্ষোভে রূপ নিতে দেখা যাচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ, গতকাল বুধবার রাওয়ালপিন্ডিতে সেনাসদর দপ্তরের মূল ফটকে বিক্ষোভকারীদের হামলা। পাকিস্তানের বিক্ষোভ-সংগ্রামের ইতিহাসে এমনটি এর আগে ঘটেনি। এ কারণে বিক্ষোভটিকে নজিরবিহীন বলছেন বিশ্লেষকেরা।
এ ছাড়া ইসলামাবাদে পুলিশ কার্যালয়, লাহোরে পুলিশ স্টেশন, পেশোয়ারে রেডিও পাকিস্তান ভবন, লোয়ার দিরের চাকদারায় স্কাউটস ফোর্টে আগুন এবং তারনোল এলাকায় রেললাইন উপড়ে ফেলাসহ বিভিন্ন জায়গায় সরকারি কার্যালয়ে ঢুকে আসবাব তছনছ করেছ বিক্ষোভকারী। এসব ঘটনা পাকিস্তানের ইতিহাসে সত্যিই নজিরবিহীন।
সেনাবিরোধী মনোভাব তৈরিতে ইমরানের ভূমিকা
পাকিস্তানে মানুষের মধ্যে ‘সেনাবিরোধী’ যে মনোভাব দেখা যাচ্ছে, তা তৈরিতে ইমরান খানের কোনো ভূমিকা আছে কি? বিশ্লেষকেরা বলছেন, আছে।
গত বছর আস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ইমরান খান সেনাবিরোধী বক্তব্য দিতে শুরু করেন। পাকিস্তানের রাজনীতিকে যে তিনি সেনাবাহিনীর প্রভাবমুক্ত করতে চান তাঁর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট হতে থাকে। এমনকি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তনের কথাও তোলেন তিনি। তিনি জোরালো স্বরেই বলতে থাকেন, পশ্চিমের প্রভুরা পাকিস্তানের রাজনীতি ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করবে, তা পাকিস্তানের মানুষের মেনে নেওয়া উচিত নয়।
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইমরান খান বলেছিলেন, ‘আমি সেনাপ্রধানকে (তৎকালীন সেনাপ্রধান বাজওয়া) বিশ্বাস করতাম। কিন্তু পরে দেখলাম, তিনি জবাবদিহিতায় বিশ্বাস করেন না। তিনি দুর্নীতিকে খারাপ মনে করেন না। এমনকি আইনের শাসনেও বিশ্বাস করেন না। এমন সেনাবাহিনী নিয়ে আমরা কী করব?’
পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ইমরান বলেন, ‘আমি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলাম, তখন পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছিলাম। ইউক্রেন যুদ্ধের ইস্যুতে আমাদের হয়তো নিরপেক্ষ থাকা উচিত ছিল, কিন্তু আমরা ন্যায়ের প্রশ্নে রাশিয়ার নিন্দা করেছিলাম।’
খান সাহেবের এসব বক্তব্য পিটিআই সমর্থকদের তো বটেই, সাধারণ মানুষকেও ব্যাপকভাবে উসকে দিয়েছে। তাদের মনে ও মগজে সেনাবিরোধিতা প্রকটভাবে ঢুকে গেছে। ফলে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বিপুল তরঙ্গের মতো ফুঁসে উঠেছে। এরই প্রতিফল দেখা যাচ্ছে চলমান বিক্ষোভে।
একজন বিরোধী নেতার পক্ষে এত বিপুল জনসমর্থন পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা যায়নি। এ কথা ইমরান নিজেও স্বীকার করেছেন আল-জাজিরার ওই সাক্ষাৎকারে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পাকিস্তানকে একমাত্র শিরোপা এনে দেওয়া এই নেতা বলেন, ‘আমার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের জনগণ সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আপনারা হয়তো লক্ষ করেছেন, প্রথমবারের মতো জনগণ কোনো অপসারিত সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। সাধারণত যখন সরকার অপসারণ করা হয়, সাধারণ মানুষ সেটি উদ্যাপন করে এবং মিষ্টি বিতরণ করে।’
ইমরান খানের জনপ্রিয়তা যে সত্যিই বেড়েছে, তা উঠেছে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্যালাপের সাম্প্রতিক জরিপেও। গ্যালাপ জরিপে দেখা গেছে, ইমরান খানের জনপ্রিয়তা ৬১ শতাংশ, নওয়াজ শরিফের ৩৬ শতাংশ, বিলাওয়াল ভুট্টোর ৩৬ শতাংশ, প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের ৩২ শতাংশ এবং মরিয়ম নওয়াজের ৩৪ শতাংশ।
এর আগেও বিভিন্ন সময়ে ইমরানের জনপ্রিয়তার উত্তাপ দেখা গেছে রাজপথে। ইমরান খান যখনই লং মার্চের ডাক দিয়েছেন, তখনই হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছে। যখনই কোথাও সমাবেশ করেছেন, সেখানে হাজারো মানুষ জড়ো হয়েছে। গত মার্চে লাহোরে ইমরানের জামান পার্কের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ। তাঁকে গ্রেপ্তারেও উদ্যোগ নিয়েছিল। সে উদ্যোগকে বানচাল করে দিয়েছিল ইমরানের সমর্থকেরা। আগামী অক্টোবরে পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা।
এই নির্বাচনে ইমরান খান যে ‘বড় প্রপঞ্চ’ হয়ে উঠবেন, তা অনুমান করাই যায়। সেই অনুমান থেকেই সম্ভবত শাহবাজ সরকার ও তার নেপথ্যের সেনাবাহিনী ইমরানকে বধ করতে চাইছে।
এই বিক্ষোভ কি পাকিস্তানের ইতিহাসের মোড় বদলাবে
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সেনাবাহিনী। সেই ইতিহাস বদলানোর একটি সুযোগ এসেছে পাকিস্তানের সামনে। পাকিস্তানের জনগণ যেভাবে সেনাপ্রভাবের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে, তা অব্যাহত থাকলে সামনের দিনগুলোতে অনেক রক্ত ঝরবে নিঃসন্দেহে। আর সেই রক্তের পথ ধরেই হয়তো পাকিস্তানের রাজনীতি সেনা প্রভাবমুক্ত হবে।
তবে এ বিক্ষোভের ভেতরে অনেক ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’ আছে। যেমন, চলমান বিক্ষোভকে কেউ কেউ স্রেফ নাশকতা মনে করছেন, কোনো স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ নয়।
প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ সরাসরিই বলেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদী ও তাদের সহযোগীরা দেশের শত্রু। দ্রুত তাদের এসব রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। দুষ্কৃতকারীদের কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হবে।’
অর্থাৎ শাহবাজ শরিফ বলতে চাচ্ছেন, যারা বিক্ষোভ করছে, তারা দুষ্কৃতকারী। তারা কেউ সাধারণ জনগণ নয়। যদি শাহবাজের এ মন্তব্য সত্য হয়, তবে এ বিক্ষোভ দমন করা সরকারের পক্ষে খুব একটা কঠিন হবে না।
কিন্তু বিক্ষোভ যদি স্বতঃস্ফূর্ত হয় এবং আরও বিপুলসংখ্যক জনগণ যদি এতে সম্পৃক্ত হয়, তবে তা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠবে। সে ক্ষেত্র বদলে যেতে পারে পাকিস্তানের চিরাচরিত রাজনীতির চিত্র।
ইমরান খান গ্রেপ্তার হওয়ার পরপরই এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘নিজের অধিকার আদায়ে রাজপথে নামুন। স্বাধীনতা কেউ প্লেটে সাজিয়ে দেয় না, অর্জন করতে হয়।’
ইমরানের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিপুল পাকিস্তানি যদি রাস্তায় নামে, তাহলে সত্যিই বদলে যেতে পারে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস।
তথ্যসূত্র: ডন, আল-জাজিরা, আরব নিউজ ও ডয়চে ভেলে
স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাই সশস্ত্র বাহিনীর কাজ; সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক সব রাষ্ট্রেই তা-ই হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানই বোধ হয় একমাত্র রাষ্ট্র, যেখানে রাজনৈতিক দল ও গণতন্ত্রের প্রধান উপাদান নির্বাচনী ব্যবস্থা থাকার পরও দশকের পর দশক ধরে রাষ্ট্র পরিচালনায় সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ চলছে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে থাকা এই দেশে বরাবরই সহিংস বিক্ষোভ হয়, জঙ্গি হামলাও প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠী সেনাবাহিনী কখনো আক্রান্ত হয়নি। এবার সেই বিরল ঘটনাটি ঘটেছে, সেনাসদরে হামলা হয়েছে।
দুর্নীতির একটি মামলায় গত মঙ্গলবার (৯ মে) ইসলামাবাদ হাইকোর্টের সামনে থেকে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) প্রধান ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর থেকে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে পাকিস্তান। ইমরানের হাজার হাজার সমর্থক রাস্তায় নেমে এসেছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষও। বিক্ষোভের মধ্যে গাড়ি ভাঙচুর, টায়ারে অগ্নিসংযোগ ও সরকারি ভবনের আসবাব তছনছের মতো ঘটনা ঘটেছে।
মঙ্গলবার রাত থেকে ইসলামাবাদ, পেশোয়ার, পাঞ্জাব, লাহোর, খাইবার পাখতুনখাওয়া, রাওয়ালপিন্ডিসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষে এ পর্যন্ত আটজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন প্রায় ৩০০ মানুষ। গ্রেপ্তার করা হয়েছে অন্তত দুই হাজার বিক্ষোভকারীকে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে খাইবার পাখতুনখাওয়া এবং ইসলামাবাদে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে শাহবাজ শরিফের সরকার। তবু পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার নাম নেই। পাকিস্তানের গণমাধ্যম বলছে, আজও দেশটির বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ-বিক্ষোভকারী সংঘর্ষ হয়েছে। অনেকেই বলছেন, পাকিস্তানের এই বিক্ষোভ ‘নজিরবিহীন’।
কেন এবারের বিক্ষোভ ‘নজিরবিহীন’
পাকিস্তান রাষ্ট্র ও রাজনীতির ইতিহাসের সঙ্গে সেনাবাহিনী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষ ঠাট্টা করে বলে, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী রয়েছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি রাষ্ট্র রয়েছে। আজ অবধি পাকিস্তানের কোনো রাষ্ট্রনায়কই সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ মদদ ছাড়া রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসতে পারেনি। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষও এত দিন এটা বিশ্বাস করে এসেছে যে, কোনো না কোনোভাবে সেনাবাহিনী পাকিস্তানের রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করবেই।
কিন্তু মঙ্গলবার দিন শেষে শুরু হওয়া বিক্ষোভটি ক্রমেই সেনাবিরোধী বিক্ষোভে রূপ নিতে দেখা যাচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ, গতকাল বুধবার রাওয়ালপিন্ডিতে সেনাসদর দপ্তরের মূল ফটকে বিক্ষোভকারীদের হামলা। পাকিস্তানের বিক্ষোভ-সংগ্রামের ইতিহাসে এমনটি এর আগে ঘটেনি। এ কারণে বিক্ষোভটিকে নজিরবিহীন বলছেন বিশ্লেষকেরা।
এ ছাড়া ইসলামাবাদে পুলিশ কার্যালয়, লাহোরে পুলিশ স্টেশন, পেশোয়ারে রেডিও পাকিস্তান ভবন, লোয়ার দিরের চাকদারায় স্কাউটস ফোর্টে আগুন এবং তারনোল এলাকায় রেললাইন উপড়ে ফেলাসহ বিভিন্ন জায়গায় সরকারি কার্যালয়ে ঢুকে আসবাব তছনছ করেছ বিক্ষোভকারী। এসব ঘটনা পাকিস্তানের ইতিহাসে সত্যিই নজিরবিহীন।
সেনাবিরোধী মনোভাব তৈরিতে ইমরানের ভূমিকা
পাকিস্তানে মানুষের মধ্যে ‘সেনাবিরোধী’ যে মনোভাব দেখা যাচ্ছে, তা তৈরিতে ইমরান খানের কোনো ভূমিকা আছে কি? বিশ্লেষকেরা বলছেন, আছে।
গত বছর আস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ইমরান খান সেনাবিরোধী বক্তব্য দিতে শুরু করেন। পাকিস্তানের রাজনীতিকে যে তিনি সেনাবাহিনীর প্রভাবমুক্ত করতে চান তাঁর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট হতে থাকে। এমনকি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তনের কথাও তোলেন তিনি। তিনি জোরালো স্বরেই বলতে থাকেন, পশ্চিমের প্রভুরা পাকিস্তানের রাজনীতি ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করবে, তা পাকিস্তানের মানুষের মেনে নেওয়া উচিত নয়।
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইমরান খান বলেছিলেন, ‘আমি সেনাপ্রধানকে (তৎকালীন সেনাপ্রধান বাজওয়া) বিশ্বাস করতাম। কিন্তু পরে দেখলাম, তিনি জবাবদিহিতায় বিশ্বাস করেন না। তিনি দুর্নীতিকে খারাপ মনে করেন না। এমনকি আইনের শাসনেও বিশ্বাস করেন না। এমন সেনাবাহিনী নিয়ে আমরা কী করব?’
পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ইমরান বলেন, ‘আমি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলাম, তখন পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছিলাম। ইউক্রেন যুদ্ধের ইস্যুতে আমাদের হয়তো নিরপেক্ষ থাকা উচিত ছিল, কিন্তু আমরা ন্যায়ের প্রশ্নে রাশিয়ার নিন্দা করেছিলাম।’
খান সাহেবের এসব বক্তব্য পিটিআই সমর্থকদের তো বটেই, সাধারণ মানুষকেও ব্যাপকভাবে উসকে দিয়েছে। তাদের মনে ও মগজে সেনাবিরোধিতা প্রকটভাবে ঢুকে গেছে। ফলে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বিপুল তরঙ্গের মতো ফুঁসে উঠেছে। এরই প্রতিফল দেখা যাচ্ছে চলমান বিক্ষোভে।
একজন বিরোধী নেতার পক্ষে এত বিপুল জনসমর্থন পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা যায়নি। এ কথা ইমরান নিজেও স্বীকার করেছেন আল-জাজিরার ওই সাক্ষাৎকারে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পাকিস্তানকে একমাত্র শিরোপা এনে দেওয়া এই নেতা বলেন, ‘আমার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের জনগণ সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আপনারা হয়তো লক্ষ করেছেন, প্রথমবারের মতো জনগণ কোনো অপসারিত সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। সাধারণত যখন সরকার অপসারণ করা হয়, সাধারণ মানুষ সেটি উদ্যাপন করে এবং মিষ্টি বিতরণ করে।’
ইমরান খানের জনপ্রিয়তা যে সত্যিই বেড়েছে, তা উঠেছে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্যালাপের সাম্প্রতিক জরিপেও। গ্যালাপ জরিপে দেখা গেছে, ইমরান খানের জনপ্রিয়তা ৬১ শতাংশ, নওয়াজ শরিফের ৩৬ শতাংশ, বিলাওয়াল ভুট্টোর ৩৬ শতাংশ, প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের ৩২ শতাংশ এবং মরিয়ম নওয়াজের ৩৪ শতাংশ।
এর আগেও বিভিন্ন সময়ে ইমরানের জনপ্রিয়তার উত্তাপ দেখা গেছে রাজপথে। ইমরান খান যখনই লং মার্চের ডাক দিয়েছেন, তখনই হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছে। যখনই কোথাও সমাবেশ করেছেন, সেখানে হাজারো মানুষ জড়ো হয়েছে। গত মার্চে লাহোরে ইমরানের জামান পার্কের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ। তাঁকে গ্রেপ্তারেও উদ্যোগ নিয়েছিল। সে উদ্যোগকে বানচাল করে দিয়েছিল ইমরানের সমর্থকেরা। আগামী অক্টোবরে পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা।
এই নির্বাচনে ইমরান খান যে ‘বড় প্রপঞ্চ’ হয়ে উঠবেন, তা অনুমান করাই যায়। সেই অনুমান থেকেই সম্ভবত শাহবাজ সরকার ও তার নেপথ্যের সেনাবাহিনী ইমরানকে বধ করতে চাইছে।
এই বিক্ষোভ কি পাকিস্তানের ইতিহাসের মোড় বদলাবে
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সেনাবাহিনী। সেই ইতিহাস বদলানোর একটি সুযোগ এসেছে পাকিস্তানের সামনে। পাকিস্তানের জনগণ যেভাবে সেনাপ্রভাবের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে, তা অব্যাহত থাকলে সামনের দিনগুলোতে অনেক রক্ত ঝরবে নিঃসন্দেহে। আর সেই রক্তের পথ ধরেই হয়তো পাকিস্তানের রাজনীতি সেনা প্রভাবমুক্ত হবে।
তবে এ বিক্ষোভের ভেতরে অনেক ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’ আছে। যেমন, চলমান বিক্ষোভকে কেউ কেউ স্রেফ নাশকতা মনে করছেন, কোনো স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ নয়।
প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ সরাসরিই বলেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদী ও তাদের সহযোগীরা দেশের শত্রু। দ্রুত তাদের এসব রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। দুষ্কৃতকারীদের কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হবে।’
অর্থাৎ শাহবাজ শরিফ বলতে চাচ্ছেন, যারা বিক্ষোভ করছে, তারা দুষ্কৃতকারী। তারা কেউ সাধারণ জনগণ নয়। যদি শাহবাজের এ মন্তব্য সত্য হয়, তবে এ বিক্ষোভ দমন করা সরকারের পক্ষে খুব একটা কঠিন হবে না।
কিন্তু বিক্ষোভ যদি স্বতঃস্ফূর্ত হয় এবং আরও বিপুলসংখ্যক জনগণ যদি এতে সম্পৃক্ত হয়, তবে তা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠবে। সে ক্ষেত্র বদলে যেতে পারে পাকিস্তানের চিরাচরিত রাজনীতির চিত্র।
ইমরান খান গ্রেপ্তার হওয়ার পরপরই এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘নিজের অধিকার আদায়ে রাজপথে নামুন। স্বাধীনতা কেউ প্লেটে সাজিয়ে দেয় না, অর্জন করতে হয়।’
ইমরানের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিপুল পাকিস্তানি যদি রাস্তায় নামে, তাহলে সত্যিই বদলে যেতে পারে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস।
তথ্যসূত্র: ডন, আল-জাজিরা, আরব নিউজ ও ডয়চে ভেলে
কোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
২ দিন আগেনবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
৫ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
১০ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
১২ দিন আগে