তুহিন কান্তি দাস, ঢাকা
পাঁচ মাসের গর্ভবতী এক নারী বস্তাবন্দী অবস্থায় পড়ে ছিলেন কুমার নদে। তাঁর শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। তারপর স্থানীয় জেলেদের মাধ্যমে উদ্ধার ও বেঁচে ফেরা। একেবারে মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসা সেই নারী এরপর থানা-আদালত ঘুরে ফিরেছিলেন স্বামীর কাছে; কিন্তু থাকা হয়নি। গর্ভে থাকা সেই পাঁচ মাসের ভ্রূণ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুকে নিয়েই তাঁকে ঘুরতে হয়েছে আখড়া থেকে আখড়ায় এবং সেই সূত্রে গানের সঙ্গে গাঁটছড়া। মাঝে মুক্তিযুদ্ধ, ভারতে আশ্রয়, সেখানেও গানই হয়ে থাকল তাঁর একমাত্র সখা। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হলো, বাংলাদেশ এগিয়ে গেল অনেকটাই, সেই নারীও ক্রমে এক আইকনে পরিণত হলেন, কিন্তু লড়াইয়ের ময়দান থেকে ফেরা হলো না। তাঁর নাম কাঙ্গালিনী সুফিয়া।
কাঙ্গালিনী সুফিয়া সেই নাম, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরানের বান্ধবের খোঁজে বুড়িয়ে যাওয়া এক জীবনের দীর্ঘশ্বাস। সাধক ওয়াহিদের লেখা এই গান সুফিয়ার কণ্ঠের জাদুতে বাংলা লোকসংগীতের এক অনন্য নিদর্শন হয়ে আছে। বাউলশিল্পী হিসেবে দেশ-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করা এই শিল্পীর ব্যক্তিজীবনের সংগ্রাম সম্পর্কে কতটুকু জানি আমরা? নজর পড়েছে কি কখনো শিল্পীর আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক অদম্য নারীর আত্মমগ্নতায়?
এই দেশে নারীর একজীবনে তাকে যে কত নাম নিতে হয়, তার ইয়ত্তা নেই। তারপরও কাঙ্গালিনী সুফিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নামের হদিস নিতে গেলে বিস্মিত হতে হয়। এক দরিদ্র জেলে পরিবারের টুনি কিংবা অনিতা হালদার থেকে কালের পরিক্রমায় সুফিয়া খাতুন, সুফিয়া খাতুন থেকে বাউল সুফিয়া, আবার বাউল সুফিয়া থেকে কাঙ্গালিনী সুফিয়া হয়ে ওঠার সেই অজানা গল্পের প্রতিটি বাঁকে রয়েছে এক নারীর আজীবন ইস্পাতকঠিন লড়াইয়ের কাহিনি।
সুফিয়ার আসল নাম ছিল অনিতা হালদার বা টুনি হালদার, ডাকনাম বুচি। কমলা হালদার ও খোকন হালদার দম্পতির তিন মেয়ে ও এক ছেলের সর্বশেষ টুনি হালদার। শৈশব থেকেই জেলে পরিবারের আবহমান অভাব-অনটনে বড় হয়েছেন। সুফিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী, বর্তমান রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার রামদিয়া গ্রামে ১৯৫৫-৫৬ সালে তাঁর জন্ম। তবে পাসপোর্টে তাঁর জন্মসাল লেখা ১৯৬২।
ছোটকাল থেকেই গানের প্রতি সহজাত টানের দরুন পাশের সোনাপুরের বৈষ্ণব আখড়ায় সুফিয়া ছুটে গেছেন বহুবার। সব সময় গুনগুন করে গাইতেন পল্লিগান। একবার শুনেই যেকোনো গান মনে রাখতে পারতেন অবিকল। কিন্তু এই সংগীতযাত্রায় ঠিকভাবে নামার আগেই বদলে গেল সব। ভাগ্যের ফেরে বারো-তেরো বছর বয়সে সুধীর হালদারের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়।
সুদর্শন সুধীর হালদার পাতলা গড়নের শ্যামলা অনিতাকে পছন্দ করতেন না। ফলে প্রায় সময়ই স্বামীর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতেন অনিতা। পাঁচ মাসের গর্ভবতী অনিতাকে একবার অজ্ঞান অবস্থায় তাঁর স্বামী বস্তাবন্দী করে ফেলে দেন কুমার নদে।
সেখান থেকে খোলা চুল দেখে মাছ ধরতে আসা জেলেরা উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যান অনিতাকে। খবর পেয়ে মা-বাবা এসে স্বামীর বাড়ি থেকে নিয়ে যান মেয়েকে। নির্যাতন মামলায় স্বামী কয়েক মাস কারাবাসের পর স্ত্রী-কন্যার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেওয়ার শর্তে সমঝোতা হয়। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান মেলেনি। ফলে মেয়ে পুষ্পকে নিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি পালিয়ে যান অনিতা। পরে মেয়ে পুষ্পকে রেখে মায়ের সহযোগিতায় বাবার হাত ধরে আশ্রয় নেন বৈষ্ণব আখড়ায়। ফেরা হলো গানের জগতে।
অনিতা বৈষ্ণব ধর্মের দীক্ষা গ্রহণ করে প্রায় পাঁচ বছর সোনাপুর আশ্রমে কাটান। সেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় দেবেন ক্ষ্যাপা ও গৌর মোহন্তের। তাঁদের গুরু মেনে বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের পাঠ নেন তিনি।
এই আখড়াতেই অনিতা হালদারের নাম বদলে হয় অনিতা ক্ষ্যাপী। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা বৈষ্ণব আখড়ায় হামলা চালালে দেশ ত্যাগ করে তিনি আশ্রয় নেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা ও সীমান্তবর্তী লালগোলায়। সেখানকার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে প্রায়ই তিনি গান শুনিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আনন্দ দিতেন, প্রেরণা জোগাতেন। ক্যাম্পে গান গাইতে গাইতে পরিচয় হয় মুক্তিযোদ্ধা মান্দার ফকিরের সঙ্গে। দেশ স্বাধীন হলে অনিতা ক্ষ্যাপী মান্দার ফকিরের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গায় চলে যান। সেখানে গিয়ে ধর্মান্তরিত হয়ে নিজ নাম বদলে রাখেন সুফিয়া খাতুন।
গানের জগতে বিচরণের জন্য সুফিয়া খাতুন ভাঙ্গা থেকে আবার চলে আসেন তৎকালীন পাবনা জেলার অন্তর্ভুক্ত ও বর্তমান সিরাজগঞ্জ সদরে। এই সময়ে তিনি পালাগানের নতুন জগৎ গড়ে তোলেন। পাল্লা দিয়ে গান গাইতে গাইতে তিনি বাউল সুফিয়া হিসেবে পরিচিতি পান।
সমসাময়িক শিল্পীদের পরামর্শে মেয়ে পুষ্পকে নিয়ে ১৯৭৬ সালের দিকে ঢাকায় চলে আসেন বাউল সুফিয়া। সুফিয়ার ভাষায়, ‘একজন শিল্পী বলছিল ঢাকায় না গেলে নামকরা শিল্পী হওয়া যাবে না। তুমি ঢাকায় যাও, দেখবা একদিন নামকরা শিল্পী হইবা।’
সুফিয়া ঢাকার বাড্ডায় শাহাজাদপুরে এসে ওঠেন। হাইকোর্টের মাজারের মজমায় গান গাইতেন নিয়মিত। বিভিন্ন মজমায় লালন ও বাউলগান গেয়ে সংসার চালাতেন তিনি। সেই মজমাতেই একদিন কবি আসাদ চৌধুরী দেখা পান বাউল সুফিয়ার।
হাইকোর্ট মাজারের সামনে শিল্পী কানাইলাল শীলের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালন করছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন। সেখানে গান গাইতে আসেন বাউল সুফিয়া। অসাধারণ কণ্ঠে তিনি মুগ্ধ করেন সবাইকে। অনুষ্ঠান শেষে আসাদ চৌধুরী সুফিয়াকে বাংলা একাডেমিতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। এভাবেই বাংলা লোকসংগীতের কালজয়ী ফেরিওয়ালা কাঙ্গালিনী সুফিয়াকে আবিষ্কার করেছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী।
আসাদ চৌধুরী সে সময় বাংলা একাডেমিতে কর্মরত ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি বিটিভিতে ‘প্রচ্ছদ’ নামে একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। সেই অনুষ্ঠানে এবং পরে বাংলা একাডেমিতে সুফিয়াকে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ জানান তিনি। তৎকালীন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। তিনি কোরিয়ায় অনুষ্ঠেয় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ দলের প্রধান হিসেবে সহকর্মীদের অনুরোধ করেন গ্রামবাংলার প্রতিভাবান কোনো শিল্পীর সন্ধান করতে।
সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে সহকর্মীরা মুস্তাফা মনোয়ারের কাছে নিয়ে আসেন সুফিয়াকে। সুফিয়ার অপূর্ব গায়কি, ভাব-আবেগ মুগ্ধ করে মুস্তাফা মনোয়ারকে। সুফিয়াকে গান গাইতে কোরিয়ায় যাওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি। কিন্তু সুফিয়া তখন ছিলেন আর্থিকভাবে নাজেহাল। তাঁর এই করুণ চিত্র দেখেই মুস্তাফা মনোয়ার তাঁর নাম দিয়েছিলেন সুফিয়া কাঙ্গালিনী। সময়ের বিবর্তনে ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন কাঙ্গালিনী সুফিয়া।
শেষ এই নামটিই আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন সুফিয়া। যদিও তাঁর জীবনের ভাঁজে ভাঁজে রয়ে গেছেন সেই বুচি, টুনি বা অনিতা হালদারেরা। রয়ে গেছে আখড়ায় বা বৈষ্ণবদের কাছ থেকে পাওয়া অনিতা ক্ষ্যাপী নামটি। মজমায় মজমায় গান গেয়ে বেড়ানো সুফিয়া এক আজন্ম বাউল। বয়সী এই মানুষটির সঙ্গী হিসেবে রয়ে গেছে শুধু দুটি জিনিস—গান আর পুষ্প। মায়ের মতো পুষ্পও গান করেন। কুমার নদে বস্তাবন্দী পড়ে থাকা সুফিয়া বা অনিতার পক্ষে একজীবনে সব বাধা ভাঙা সম্ভব না হলেও, সব লড়াইয়ে জয় পাওয়া সম্ভব না হলেও বহু মানুষকে তিনি লড়াইয়ের শক্তি জুগিয়েছেন, যেমন জুগিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়।
পাঁচ মাসের গর্ভবতী এক নারী বস্তাবন্দী অবস্থায় পড়ে ছিলেন কুমার নদে। তাঁর শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। তারপর স্থানীয় জেলেদের মাধ্যমে উদ্ধার ও বেঁচে ফেরা। একেবারে মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসা সেই নারী এরপর থানা-আদালত ঘুরে ফিরেছিলেন স্বামীর কাছে; কিন্তু থাকা হয়নি। গর্ভে থাকা সেই পাঁচ মাসের ভ্রূণ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুকে নিয়েই তাঁকে ঘুরতে হয়েছে আখড়া থেকে আখড়ায় এবং সেই সূত্রে গানের সঙ্গে গাঁটছড়া। মাঝে মুক্তিযুদ্ধ, ভারতে আশ্রয়, সেখানেও গানই হয়ে থাকল তাঁর একমাত্র সখা। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হলো, বাংলাদেশ এগিয়ে গেল অনেকটাই, সেই নারীও ক্রমে এক আইকনে পরিণত হলেন, কিন্তু লড়াইয়ের ময়দান থেকে ফেরা হলো না। তাঁর নাম কাঙ্গালিনী সুফিয়া।
কাঙ্গালিনী সুফিয়া সেই নাম, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরানের বান্ধবের খোঁজে বুড়িয়ে যাওয়া এক জীবনের দীর্ঘশ্বাস। সাধক ওয়াহিদের লেখা এই গান সুফিয়ার কণ্ঠের জাদুতে বাংলা লোকসংগীতের এক অনন্য নিদর্শন হয়ে আছে। বাউলশিল্পী হিসেবে দেশ-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করা এই শিল্পীর ব্যক্তিজীবনের সংগ্রাম সম্পর্কে কতটুকু জানি আমরা? নজর পড়েছে কি কখনো শিল্পীর আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক অদম্য নারীর আত্মমগ্নতায়?
এই দেশে নারীর একজীবনে তাকে যে কত নাম নিতে হয়, তার ইয়ত্তা নেই। তারপরও কাঙ্গালিনী সুফিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নামের হদিস নিতে গেলে বিস্মিত হতে হয়। এক দরিদ্র জেলে পরিবারের টুনি কিংবা অনিতা হালদার থেকে কালের পরিক্রমায় সুফিয়া খাতুন, সুফিয়া খাতুন থেকে বাউল সুফিয়া, আবার বাউল সুফিয়া থেকে কাঙ্গালিনী সুফিয়া হয়ে ওঠার সেই অজানা গল্পের প্রতিটি বাঁকে রয়েছে এক নারীর আজীবন ইস্পাতকঠিন লড়াইয়ের কাহিনি।
সুফিয়ার আসল নাম ছিল অনিতা হালদার বা টুনি হালদার, ডাকনাম বুচি। কমলা হালদার ও খোকন হালদার দম্পতির তিন মেয়ে ও এক ছেলের সর্বশেষ টুনি হালদার। শৈশব থেকেই জেলে পরিবারের আবহমান অভাব-অনটনে বড় হয়েছেন। সুফিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী, বর্তমান রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার রামদিয়া গ্রামে ১৯৫৫-৫৬ সালে তাঁর জন্ম। তবে পাসপোর্টে তাঁর জন্মসাল লেখা ১৯৬২।
ছোটকাল থেকেই গানের প্রতি সহজাত টানের দরুন পাশের সোনাপুরের বৈষ্ণব আখড়ায় সুফিয়া ছুটে গেছেন বহুবার। সব সময় গুনগুন করে গাইতেন পল্লিগান। একবার শুনেই যেকোনো গান মনে রাখতে পারতেন অবিকল। কিন্তু এই সংগীতযাত্রায় ঠিকভাবে নামার আগেই বদলে গেল সব। ভাগ্যের ফেরে বারো-তেরো বছর বয়সে সুধীর হালদারের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়।
সুদর্শন সুধীর হালদার পাতলা গড়নের শ্যামলা অনিতাকে পছন্দ করতেন না। ফলে প্রায় সময়ই স্বামীর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতেন অনিতা। পাঁচ মাসের গর্ভবতী অনিতাকে একবার অজ্ঞান অবস্থায় তাঁর স্বামী বস্তাবন্দী করে ফেলে দেন কুমার নদে।
সেখান থেকে খোলা চুল দেখে মাছ ধরতে আসা জেলেরা উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যান অনিতাকে। খবর পেয়ে মা-বাবা এসে স্বামীর বাড়ি থেকে নিয়ে যান মেয়েকে। নির্যাতন মামলায় স্বামী কয়েক মাস কারাবাসের পর স্ত্রী-কন্যার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেওয়ার শর্তে সমঝোতা হয়। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান মেলেনি। ফলে মেয়ে পুষ্পকে নিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি পালিয়ে যান অনিতা। পরে মেয়ে পুষ্পকে রেখে মায়ের সহযোগিতায় বাবার হাত ধরে আশ্রয় নেন বৈষ্ণব আখড়ায়। ফেরা হলো গানের জগতে।
অনিতা বৈষ্ণব ধর্মের দীক্ষা গ্রহণ করে প্রায় পাঁচ বছর সোনাপুর আশ্রমে কাটান। সেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় দেবেন ক্ষ্যাপা ও গৌর মোহন্তের। তাঁদের গুরু মেনে বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের পাঠ নেন তিনি।
এই আখড়াতেই অনিতা হালদারের নাম বদলে হয় অনিতা ক্ষ্যাপী। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা বৈষ্ণব আখড়ায় হামলা চালালে দেশ ত্যাগ করে তিনি আশ্রয় নেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা ও সীমান্তবর্তী লালগোলায়। সেখানকার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে প্রায়ই তিনি গান শুনিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আনন্দ দিতেন, প্রেরণা জোগাতেন। ক্যাম্পে গান গাইতে গাইতে পরিচয় হয় মুক্তিযোদ্ধা মান্দার ফকিরের সঙ্গে। দেশ স্বাধীন হলে অনিতা ক্ষ্যাপী মান্দার ফকিরের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গায় চলে যান। সেখানে গিয়ে ধর্মান্তরিত হয়ে নিজ নাম বদলে রাখেন সুফিয়া খাতুন।
গানের জগতে বিচরণের জন্য সুফিয়া খাতুন ভাঙ্গা থেকে আবার চলে আসেন তৎকালীন পাবনা জেলার অন্তর্ভুক্ত ও বর্তমান সিরাজগঞ্জ সদরে। এই সময়ে তিনি পালাগানের নতুন জগৎ গড়ে তোলেন। পাল্লা দিয়ে গান গাইতে গাইতে তিনি বাউল সুফিয়া হিসেবে পরিচিতি পান।
সমসাময়িক শিল্পীদের পরামর্শে মেয়ে পুষ্পকে নিয়ে ১৯৭৬ সালের দিকে ঢাকায় চলে আসেন বাউল সুফিয়া। সুফিয়ার ভাষায়, ‘একজন শিল্পী বলছিল ঢাকায় না গেলে নামকরা শিল্পী হওয়া যাবে না। তুমি ঢাকায় যাও, দেখবা একদিন নামকরা শিল্পী হইবা।’
সুফিয়া ঢাকার বাড্ডায় শাহাজাদপুরে এসে ওঠেন। হাইকোর্টের মাজারের মজমায় গান গাইতেন নিয়মিত। বিভিন্ন মজমায় লালন ও বাউলগান গেয়ে সংসার চালাতেন তিনি। সেই মজমাতেই একদিন কবি আসাদ চৌধুরী দেখা পান বাউল সুফিয়ার।
হাইকোর্ট মাজারের সামনে শিল্পী কানাইলাল শীলের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালন করছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন। সেখানে গান গাইতে আসেন বাউল সুফিয়া। অসাধারণ কণ্ঠে তিনি মুগ্ধ করেন সবাইকে। অনুষ্ঠান শেষে আসাদ চৌধুরী সুফিয়াকে বাংলা একাডেমিতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। এভাবেই বাংলা লোকসংগীতের কালজয়ী ফেরিওয়ালা কাঙ্গালিনী সুফিয়াকে আবিষ্কার করেছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী।
আসাদ চৌধুরী সে সময় বাংলা একাডেমিতে কর্মরত ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি বিটিভিতে ‘প্রচ্ছদ’ নামে একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। সেই অনুষ্ঠানে এবং পরে বাংলা একাডেমিতে সুফিয়াকে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ জানান তিনি। তৎকালীন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। তিনি কোরিয়ায় অনুষ্ঠেয় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ দলের প্রধান হিসেবে সহকর্মীদের অনুরোধ করেন গ্রামবাংলার প্রতিভাবান কোনো শিল্পীর সন্ধান করতে।
সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে সহকর্মীরা মুস্তাফা মনোয়ারের কাছে নিয়ে আসেন সুফিয়াকে। সুফিয়ার অপূর্ব গায়কি, ভাব-আবেগ মুগ্ধ করে মুস্তাফা মনোয়ারকে। সুফিয়াকে গান গাইতে কোরিয়ায় যাওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি। কিন্তু সুফিয়া তখন ছিলেন আর্থিকভাবে নাজেহাল। তাঁর এই করুণ চিত্র দেখেই মুস্তাফা মনোয়ার তাঁর নাম দিয়েছিলেন সুফিয়া কাঙ্গালিনী। সময়ের বিবর্তনে ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন কাঙ্গালিনী সুফিয়া।
শেষ এই নামটিই আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন সুফিয়া। যদিও তাঁর জীবনের ভাঁজে ভাঁজে রয়ে গেছেন সেই বুচি, টুনি বা অনিতা হালদারেরা। রয়ে গেছে আখড়ায় বা বৈষ্ণবদের কাছ থেকে পাওয়া অনিতা ক্ষ্যাপী নামটি। মজমায় মজমায় গান গেয়ে বেড়ানো সুফিয়া এক আজন্ম বাউল। বয়সী এই মানুষটির সঙ্গী হিসেবে রয়ে গেছে শুধু দুটি জিনিস—গান আর পুষ্প। মায়ের মতো পুষ্পও গান করেন। কুমার নদে বস্তাবন্দী পড়ে থাকা সুফিয়া বা অনিতার পক্ষে একজীবনে সব বাধা ভাঙা সম্ভব না হলেও, সব লড়াইয়ে জয় পাওয়া সম্ভব না হলেও বহু মানুষকে তিনি লড়াইয়ের শক্তি জুগিয়েছেন, যেমন জুগিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়।
বারী সিদ্দিকী সংগীতজীবনের প্রথম দিকে বংশীবাদক হিসেবে পরিচিত পেলেও পরবর্তী সময়ে তিনি একজন লোকসংগীতশিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
৬ ঘণ্টা আগেতিনি ছিলেন একজন আদর্শবান শিক্ষক—অজিতকুমার গুহর এটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়। নিজের জাগতিক উন্নতিকে কখনো বড় করে দেখেননি তিনি। শিক্ষার্থীদের আদর্শ জীবন উপহার দেওয়াই ছিল তাঁর ব্রত। তিনি সক্রিয় ছিলেন ঢাকার প্রগতিশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিসরেও। সুবক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতির কমতি ছিল না।
৩ দিন আগেআব্দুল করিম খাঁ ছিলেন হিন্দুস্তানি ধ্রুপদি সংগীতের অন্যতম কিংবদন্তি। কিরানা ঘরানারও তিনি কিংবদন্তি ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত—তিনি গান গাওয়ার সময় এমনভাবে ধ্যানমগ্ন হয়ে যেতেন যে, শ্রোতারাও সেই সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন।
৪ দিন আগেমানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছিলেন বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের নিপীড়িত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের মুক্তির আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা। তিনি এম এন লারমা নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। ডাকনাম ছিল মঞ্জু। তাঁর নেতৃত্বেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫ দিন আগে