বিভুরঞ্জন সরকার
বেলাল চৌধুরী। কবি হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত কিন্তু তিনি আসলে বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এক মানুষ। জন্ম ১৯৩৮ সালের ১২ নভেম্বর। প্রায় ৮০ বছর বেঁচেছিলেন তিনি। এক জীবনে অনেকের পক্ষেই বহু কাজ করা সম্ভব হয় না। ফেনির সন্তান বেলাল চৌধুরী এক জীবনে বহু কাজ করেছেন।
কী না করেছেন তিনি! বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়েছেন। ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। জেল খেটেছেন। পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষুকে ফাঁকি দিয়ে কলকাতা গিয়ে উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়েছেন। অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। প্রবন্ধ লিখেছেন। বিদেশি সাহিত্য থেকে অনুবাদ করেছেন। সাংবাদিকতা করেছেন। পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেছেন। আর সব থেকে যেটা বেশি করেছেন, সেটা হলো চুটিয়ে আড্ডা দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেন, বেলাল ভাই যদি একটু কম আড্ডা দিতেন, সময়টাকে যদি এত কম মূল্যবান ভেবে ওভাবে খরচ না করতেন, তাহলে তিনি আরও অনেক বেশি লিখতে পারতেন। বাংলা সাহিত্য তাঁর কাছ থেকে আরও বেশি সোনালি ফসল পেতে পারত।
কিন্তু বেলাল ভাই বলতেন অন্য কথা। তিনি বলতেন, তিনি ততটুকুই করেন, যতটুকু তাঁর করার কথা। সময়ের সঙ্গে তাঁর কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে তিনি পাকিস্তানি শাসকদের ফাঁকি দিয়ে ওপার বাংলায় গিয়ে প্রথম দিকে খুবই কষ্টের জীবন কাটিয়েছেন। থাকা-খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। প্রতিটি মুহূর্ত ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা। তাঁর নিজের কথায়—‘যেখানে রাত, সেখানে কাত’ অবস্থায় কেটেছে অনেক দিন। তারপর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়সহ কলকাতার কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় এবং সখ্য গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে এক ধরনের স্থিতি এসেছিল তাঁর জীবনে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিখ্যাত ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা সম্পাদনায় অংশ নিতে পারা ছিল তাঁর জীবনের এক উজ্জ্বল ঘটনা। সম্ভবত প্রায় দেড় দশককাল স্থায়ী হয়েছিল তাঁর কলকাতা জীবন। ১৯৭৪ সালে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং বলা যায় নতুন করে শুরু হয় তাঁর যাত্রা। সময়ের সঙ্গে এবং সহযোগীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি বেলাল ভাইকে। তিনি এমন একজন মানুষ যে, মুহূর্তেই তাঁকে আপন করে না নিয়ে উপায় থাকে না। ঢাকার জীবন গুছিয়ে নিতে, বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে নিতে তাঁর খুব সময় লাগেনি।
বেলাল চৌধুরীর কবিতা বা অন্য সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনার যোগ্য বা উপযুক্ত লোক আমি নই। তাঁর সঙ্গে নানাভাবে মেশার যে সুযোগ আমার হয়েছিল, তার সূত্র ধরেই কিছু কথা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য পেশ করছি।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর অনেক আড্ডায় উপস্থিত থাকার। প্রচুর সময় আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি। ঘুরে বেড়িয়েছি এখানে-সেখানে, শহরে এবং নিভৃত পল্লিতে। তার সবগুলো বলা যাবে না, দু-একটি শুধু উল্লেখ করব। বেলাল ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সময়টা ঠিক মনে নেই। তবে সম্ভবত ১৯৭৮-৭৯ সালের দিকে হবে। তিনি তখন সচিত্র সন্ধানী নামের সে সময়ের জনপ্রিয় সাপ্তাহিকের নির্বাহী অথবা ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। গাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ ছিলেন সন্ধানীর সম্পাদক-প্রকাশক। পুরানা পল্টনে সন্ধানী অফিসেই বেলাল ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা। আমরা কাছাকাছি বয়সের না হলেও বেলাল ভাইয়ের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা গড়ে উঠতে সমস্যা হয়নি। সে সময় গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের বাসায় ঢাকার খ্যাতিমান এবং উঠতি লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডা হতো বলতে গেলে প্রায় সন্ধ্যাতেই। গাজী ভাই ছিলেন একসময় লেখক-শিল্পীদের অঘোষিত পৃষ্ঠপোষক। সাপ্তাহিক সন্ধানী পত্রিকা ছাড়াও সন্ধানী প্রকাশনী নামে একটি অভিজাত প্রকাশনা সংস্থাও ছিল গাজী ভাইয়ের।
এখনকার মতো এত পত্রপত্রিকা ছিল না তখন। ফলে সন্ধানী ছিল একটি আকর্ষণীয় ক্ষেত্র। সন্ধানীকে ঘিরে দেশের প্রগতিশীল সুস্থ চিন্তার শিল্পী-সাহিত্যিকদের একটি বলয় গড়ে উঠেছিল। বেলাল ভাই সন্ধানীতে যোগ দেওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই পত্রিকার গুণ-মান দুটোই উন্নত হয়। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পাশাপাশি নতুন লেখিয়েদেরও বেলাল ভাই সুযোগ করে দিতেন। বেলাল ভাই ছিলেন একজন অতি দক্ষ সম্পাদক। একটি যেনতেন লেখাকেও তিনি তাঁর সুসম্পাদনার গুণে সুখপাঠ্য করে তুলতে পারতেন। লেখা সম্পাদনার সময় বিভিন্ন রঙের কলম ব্যবহার করতেন। নবীন লিখিয়েদের লেখা তিনি যখন নানা রঙের কালি দিয়ে কাটাকুটি করতেন, তখন তা একটি দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্মে পরিণত হতো।
বেলাল ভাই কিছুদিন ‘সন্দীপ’ নামের একটি সাপ্তাহিক কাগজের সম্পাদনার দায়িত্বও পেয়েছিলেন। সন্দীপে প্রতি সপ্তাহেই আমার কলাম ছাপতেন বেলাল ভাই। তত দিনে সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের কারণে পরিচিত মহলে আমার একটু কদরও বেড়েছিল।
বলছিলাম, গাজী ভাইয়ের বাসায় সান্ধ্য আড্ডার কথা। কী জমজমাট ছিল সে আড্ডাগুলো। কারা থাকতেন সেসব আড্ডায়, সে প্রশ্ন না তুলে বরং প্রশ্ন করা ভালো—কারা থাকতেন না সে আড্ডায়! শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সাঈয়ীদ আতীকুল্লাহ, কাইয়ুম চৌধুরী, রফিক আজাদ থেকে শুরু করে ত্রিদিব দস্তিদার, সৈয়দ হায়দার, সুশান্ত মজুমদার পর্যন্ত অনেকেই আসতেন সেখানে। বলা নিষ্প্রয়োজন যে বেলাল ভাইয়ের উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। আমি এ রকম অনেক আড্ডায় উপস্থিত থেকে এই খ্যাতিমান ব্যক্তিদের নিকট-সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছি। মাঝেমধ্যে গাজী ভাইয়ের বাসার আড্ডায় পশ্চিমবঙ্গের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, নবনীতা দেবসেনসহ কারও কারও উপস্থিতিও ঘটত। ওই আড্ডাগুলোতে পরচর্চা হতো না, বরং শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্ক হতো। আমি যায়যায়দিনে রাজনৈতিক কলাম লেখার অনেক উপাদান-উপকরণ ওই আড্ডা থেকে পেতাম।
এরশাদ জামানাতেই গাজী ভাই প্রতি শুক্রবার ঢাকার বাইরে যাওয়ার নিয়ম চালু করলেন। শহরের কোলাহল থেকে দূরে কোনো গ্রামে গাছের নিচে বসে অথবা কোনো নদীর তীর ঘেঁষে কিংবা বিখ্যাত কোনো মানুষের গ্রামের বাড়িতে চলে যেতাম আমরা। এই বেড়ানোর দলেও শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, বেলাল চৌধুরী, বেনজীর আহমেদ, সংবাদের সালাম জুবায়েরের সঙ্গে আমিও জুটে যেতাম। একদিন তো আমরা ঘুরতে ঘুরতে চলে গেলাম কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বাড়িতে। আমরা ভরদুপুরে ওই বাড়িতে গিয়ে হাজির হই। বাড়িতে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এ রকম অযাচিত অতিথি দেখে অবাক। আমাদের সবার পরিচয় পেয়ে তাঁরা কীভাবে আপ্যায়ন করবেন, তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। গাছ থেকে ডাব পাড়া হলো, পুকুর থেকে ধরা হলো মাছ, রান্না চড়িয়ে মুড়ি চিড়ে দেওয়া হলো বসে বসে চিবানোর জন্য। বেলাল ভাই বিপুল উৎসাহ নিয়ে ঘুরে দেখতে শুরু করলেন তাজউদ্দীন আহমদের স্মৃতিজড়ানো জায়গাগুলো। যে মাটি ও জল-হাওয়া তাজউদ্দনের মতো নেতার জন্ম দিয়েছে, তার স্পর্শ নিতে পেরে আমরা সেদিন গৌরববোধ করেছিলাম। গরম-গরম ভাত, টাটকা মাছের ঝোল, তাজা সবজির উপাদেয় খাবার খেয়ে ওই গ্রাম থেকে বিদায় নিতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল।
বেলাল ভাই ছিলেন কিছুটা আলাভোলা ধরনের মানুষ। তাঁর চলনবলন ছিল একেবারেই সাদামাটা। মানুষের উপকার করার জন্য সারাক্ষণ যেন এক পায়ে খাড়া থাকতেন। তিনি যখন ভারত বিচিত্রার সম্পাদক, তখন কজনকে যে ভারতের ভিসা পেতে সাহায্য করেছেন, তার হিসাব নেই। একবার চিকিৎসার জন্য কলকাতা যাওয়ার জন্য আমার জরুরিভাবে ভিসা প্রয়োজন ছিল। বেলাল ভাইয়ের কাছে গিয়ে হাজির হলে তিনি আমাকে বসিয়ে রেখে হাতে হাতে ভিসা করিয়ে দিয়েছেন।
আজ সবকিছু স্মৃতি হয়ে গেছে। বেলাল চৌধুরী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল। মৃত্যুর আগে বছর দু-এক অসুস্থতার খবর পেয়ে তাঁকে পুরানা পল্টনের বাসায় দেখতে গিয়েছিলাম। তারপর দেখা হয় শহীদ মিনারে শেষ বিদায়ের আগে শ্রদ্ধা জানানোর আগে। আমি তাঁকে দেখেছি কিন্তু তিনি আমাকে দেখেননি।
‘আত্মপ্রতিকৃতি’ নামের কবিতায় তিনি লিখছেন—
সারা দিন আমি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে
কী দেখেছিলাম? ভাট ফুল, আকন্দের ঝোপঝাপ
মাছরাঙাদের অকারণ খিটিমিটি?
গ্রামীণ ছবিতে আজ আর নেই সেই কিংবদন্তিখ্যাত
মসলিন, নকশিকাঁথার দিন।
গোলায়ভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ
এ জাতীয় কথারা আজ সেরেফ কথার কথামালা
গ্রামগুলি হতশ্রী—
না, বেলাল ভাই আমাদের গ্রামগুলো আবার শ্রী ফিরে পেতে শুরু করেছে। মসলিন নেই, কিন্তু নকশিকাঁথা ফিরছে। নতুন চেহারার গ্রাম দেখার জন্য আপনার সঙ্গে আর নতুন কোনো যাত্রায় যাওয়া হবে না আমাদের।
‘সেলাই করা ছায়া’ কবিতায় লিখেছেন—
শহরতলি ছাড়িয়ে লোকালয়কে বানিয়ে বহুদূরের ধূ-ধূ
বুক ভরে টাটকা সতেজ সবুজ নিশ্বাস নিতে নিতে
গহীন বনের কিনারায় এসে দেখি তাকে,
গৈরিক বসনাবৃত পরম নিবিষ্টচিত্ত একা একা বসে,
কে তিনি পথিক না পরিব্রাজক?
আমার মনেও প্রশ্ন, বেলাল ভাই কী হিসেবে কাটিয়ে গেছেন ৮০ বছরের জীবন, পথিক না পরিব্রাজক?
‘নারীটি যখন নদী হয়ে গেল’ কবিতার কয়টি লাইন উদ্ধৃত করেই কবি বেলাল চৌধুরীর প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।
সে কি তার মৃত্যু দৃশ্যে
পেয়েছিল পরিপূর্ণতা, কে জানে!
না হলে ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসিটি
কি করে ফুটিয়ে তুলেছিল ঐ বিভ্রম;
বেলাল চৌধুরী। কবি হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত কিন্তু তিনি আসলে বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এক মানুষ। জন্ম ১৯৩৮ সালের ১২ নভেম্বর। প্রায় ৮০ বছর বেঁচেছিলেন তিনি। এক জীবনে অনেকের পক্ষেই বহু কাজ করা সম্ভব হয় না। ফেনির সন্তান বেলাল চৌধুরী এক জীবনে বহু কাজ করেছেন।
কী না করেছেন তিনি! বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়েছেন। ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। জেল খেটেছেন। পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষুকে ফাঁকি দিয়ে কলকাতা গিয়ে উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়েছেন। অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। প্রবন্ধ লিখেছেন। বিদেশি সাহিত্য থেকে অনুবাদ করেছেন। সাংবাদিকতা করেছেন। পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেছেন। আর সব থেকে যেটা বেশি করেছেন, সেটা হলো চুটিয়ে আড্ডা দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেন, বেলাল ভাই যদি একটু কম আড্ডা দিতেন, সময়টাকে যদি এত কম মূল্যবান ভেবে ওভাবে খরচ না করতেন, তাহলে তিনি আরও অনেক বেশি লিখতে পারতেন। বাংলা সাহিত্য তাঁর কাছ থেকে আরও বেশি সোনালি ফসল পেতে পারত।
কিন্তু বেলাল ভাই বলতেন অন্য কথা। তিনি বলতেন, তিনি ততটুকুই করেন, যতটুকু তাঁর করার কথা। সময়ের সঙ্গে তাঁর কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে তিনি পাকিস্তানি শাসকদের ফাঁকি দিয়ে ওপার বাংলায় গিয়ে প্রথম দিকে খুবই কষ্টের জীবন কাটিয়েছেন। থাকা-খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। প্রতিটি মুহূর্ত ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা। তাঁর নিজের কথায়—‘যেখানে রাত, সেখানে কাত’ অবস্থায় কেটেছে অনেক দিন। তারপর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়সহ কলকাতার কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় এবং সখ্য গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে এক ধরনের স্থিতি এসেছিল তাঁর জীবনে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিখ্যাত ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা সম্পাদনায় অংশ নিতে পারা ছিল তাঁর জীবনের এক উজ্জ্বল ঘটনা। সম্ভবত প্রায় দেড় দশককাল স্থায়ী হয়েছিল তাঁর কলকাতা জীবন। ১৯৭৪ সালে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং বলা যায় নতুন করে শুরু হয় তাঁর যাত্রা। সময়ের সঙ্গে এবং সহযোগীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি বেলাল ভাইকে। তিনি এমন একজন মানুষ যে, মুহূর্তেই তাঁকে আপন করে না নিয়ে উপায় থাকে না। ঢাকার জীবন গুছিয়ে নিতে, বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে নিতে তাঁর খুব সময় লাগেনি।
বেলাল চৌধুরীর কবিতা বা অন্য সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনার যোগ্য বা উপযুক্ত লোক আমি নই। তাঁর সঙ্গে নানাভাবে মেশার যে সুযোগ আমার হয়েছিল, তার সূত্র ধরেই কিছু কথা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য পেশ করছি।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর অনেক আড্ডায় উপস্থিত থাকার। প্রচুর সময় আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি। ঘুরে বেড়িয়েছি এখানে-সেখানে, শহরে এবং নিভৃত পল্লিতে। তার সবগুলো বলা যাবে না, দু-একটি শুধু উল্লেখ করব। বেলাল ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সময়টা ঠিক মনে নেই। তবে সম্ভবত ১৯৭৮-৭৯ সালের দিকে হবে। তিনি তখন সচিত্র সন্ধানী নামের সে সময়ের জনপ্রিয় সাপ্তাহিকের নির্বাহী অথবা ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। গাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ ছিলেন সন্ধানীর সম্পাদক-প্রকাশক। পুরানা পল্টনে সন্ধানী অফিসেই বেলাল ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা। আমরা কাছাকাছি বয়সের না হলেও বেলাল ভাইয়ের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা গড়ে উঠতে সমস্যা হয়নি। সে সময় গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের বাসায় ঢাকার খ্যাতিমান এবং উঠতি লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডা হতো বলতে গেলে প্রায় সন্ধ্যাতেই। গাজী ভাই ছিলেন একসময় লেখক-শিল্পীদের অঘোষিত পৃষ্ঠপোষক। সাপ্তাহিক সন্ধানী পত্রিকা ছাড়াও সন্ধানী প্রকাশনী নামে একটি অভিজাত প্রকাশনা সংস্থাও ছিল গাজী ভাইয়ের।
এখনকার মতো এত পত্রপত্রিকা ছিল না তখন। ফলে সন্ধানী ছিল একটি আকর্ষণীয় ক্ষেত্র। সন্ধানীকে ঘিরে দেশের প্রগতিশীল সুস্থ চিন্তার শিল্পী-সাহিত্যিকদের একটি বলয় গড়ে উঠেছিল। বেলাল ভাই সন্ধানীতে যোগ দেওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই পত্রিকার গুণ-মান দুটোই উন্নত হয়। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পাশাপাশি নতুন লেখিয়েদেরও বেলাল ভাই সুযোগ করে দিতেন। বেলাল ভাই ছিলেন একজন অতি দক্ষ সম্পাদক। একটি যেনতেন লেখাকেও তিনি তাঁর সুসম্পাদনার গুণে সুখপাঠ্য করে তুলতে পারতেন। লেখা সম্পাদনার সময় বিভিন্ন রঙের কলম ব্যবহার করতেন। নবীন লিখিয়েদের লেখা তিনি যখন নানা রঙের কালি দিয়ে কাটাকুটি করতেন, তখন তা একটি দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্মে পরিণত হতো।
বেলাল ভাই কিছুদিন ‘সন্দীপ’ নামের একটি সাপ্তাহিক কাগজের সম্পাদনার দায়িত্বও পেয়েছিলেন। সন্দীপে প্রতি সপ্তাহেই আমার কলাম ছাপতেন বেলাল ভাই। তত দিনে সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের কারণে পরিচিত মহলে আমার একটু কদরও বেড়েছিল।
বলছিলাম, গাজী ভাইয়ের বাসায় সান্ধ্য আড্ডার কথা। কী জমজমাট ছিল সে আড্ডাগুলো। কারা থাকতেন সেসব আড্ডায়, সে প্রশ্ন না তুলে বরং প্রশ্ন করা ভালো—কারা থাকতেন না সে আড্ডায়! শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সাঈয়ীদ আতীকুল্লাহ, কাইয়ুম চৌধুরী, রফিক আজাদ থেকে শুরু করে ত্রিদিব দস্তিদার, সৈয়দ হায়দার, সুশান্ত মজুমদার পর্যন্ত অনেকেই আসতেন সেখানে। বলা নিষ্প্রয়োজন যে বেলাল ভাইয়ের উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। আমি এ রকম অনেক আড্ডায় উপস্থিত থেকে এই খ্যাতিমান ব্যক্তিদের নিকট-সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছি। মাঝেমধ্যে গাজী ভাইয়ের বাসার আড্ডায় পশ্চিমবঙ্গের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, নবনীতা দেবসেনসহ কারও কারও উপস্থিতিও ঘটত। ওই আড্ডাগুলোতে পরচর্চা হতো না, বরং শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্ক হতো। আমি যায়যায়দিনে রাজনৈতিক কলাম লেখার অনেক উপাদান-উপকরণ ওই আড্ডা থেকে পেতাম।
এরশাদ জামানাতেই গাজী ভাই প্রতি শুক্রবার ঢাকার বাইরে যাওয়ার নিয়ম চালু করলেন। শহরের কোলাহল থেকে দূরে কোনো গ্রামে গাছের নিচে বসে অথবা কোনো নদীর তীর ঘেঁষে কিংবা বিখ্যাত কোনো মানুষের গ্রামের বাড়িতে চলে যেতাম আমরা। এই বেড়ানোর দলেও শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, বেলাল চৌধুরী, বেনজীর আহমেদ, সংবাদের সালাম জুবায়েরের সঙ্গে আমিও জুটে যেতাম। একদিন তো আমরা ঘুরতে ঘুরতে চলে গেলাম কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বাড়িতে। আমরা ভরদুপুরে ওই বাড়িতে গিয়ে হাজির হই। বাড়িতে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এ রকম অযাচিত অতিথি দেখে অবাক। আমাদের সবার পরিচয় পেয়ে তাঁরা কীভাবে আপ্যায়ন করবেন, তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। গাছ থেকে ডাব পাড়া হলো, পুকুর থেকে ধরা হলো মাছ, রান্না চড়িয়ে মুড়ি চিড়ে দেওয়া হলো বসে বসে চিবানোর জন্য। বেলাল ভাই বিপুল উৎসাহ নিয়ে ঘুরে দেখতে শুরু করলেন তাজউদ্দীন আহমদের স্মৃতিজড়ানো জায়গাগুলো। যে মাটি ও জল-হাওয়া তাজউদ্দনের মতো নেতার জন্ম দিয়েছে, তার স্পর্শ নিতে পেরে আমরা সেদিন গৌরববোধ করেছিলাম। গরম-গরম ভাত, টাটকা মাছের ঝোল, তাজা সবজির উপাদেয় খাবার খেয়ে ওই গ্রাম থেকে বিদায় নিতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল।
বেলাল ভাই ছিলেন কিছুটা আলাভোলা ধরনের মানুষ। তাঁর চলনবলন ছিল একেবারেই সাদামাটা। মানুষের উপকার করার জন্য সারাক্ষণ যেন এক পায়ে খাড়া থাকতেন। তিনি যখন ভারত বিচিত্রার সম্পাদক, তখন কজনকে যে ভারতের ভিসা পেতে সাহায্য করেছেন, তার হিসাব নেই। একবার চিকিৎসার জন্য কলকাতা যাওয়ার জন্য আমার জরুরিভাবে ভিসা প্রয়োজন ছিল। বেলাল ভাইয়ের কাছে গিয়ে হাজির হলে তিনি আমাকে বসিয়ে রেখে হাতে হাতে ভিসা করিয়ে দিয়েছেন।
আজ সবকিছু স্মৃতি হয়ে গেছে। বেলাল চৌধুরী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল। মৃত্যুর আগে বছর দু-এক অসুস্থতার খবর পেয়ে তাঁকে পুরানা পল্টনের বাসায় দেখতে গিয়েছিলাম। তারপর দেখা হয় শহীদ মিনারে শেষ বিদায়ের আগে শ্রদ্ধা জানানোর আগে। আমি তাঁকে দেখেছি কিন্তু তিনি আমাকে দেখেননি।
‘আত্মপ্রতিকৃতি’ নামের কবিতায় তিনি লিখছেন—
সারা দিন আমি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে
কী দেখেছিলাম? ভাট ফুল, আকন্দের ঝোপঝাপ
মাছরাঙাদের অকারণ খিটিমিটি?
গ্রামীণ ছবিতে আজ আর নেই সেই কিংবদন্তিখ্যাত
মসলিন, নকশিকাঁথার দিন।
গোলায়ভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ
এ জাতীয় কথারা আজ সেরেফ কথার কথামালা
গ্রামগুলি হতশ্রী—
না, বেলাল ভাই আমাদের গ্রামগুলো আবার শ্রী ফিরে পেতে শুরু করেছে। মসলিন নেই, কিন্তু নকশিকাঁথা ফিরছে। নতুন চেহারার গ্রাম দেখার জন্য আপনার সঙ্গে আর নতুন কোনো যাত্রায় যাওয়া হবে না আমাদের।
‘সেলাই করা ছায়া’ কবিতায় লিখেছেন—
শহরতলি ছাড়িয়ে লোকালয়কে বানিয়ে বহুদূরের ধূ-ধূ
বুক ভরে টাটকা সতেজ সবুজ নিশ্বাস নিতে নিতে
গহীন বনের কিনারায় এসে দেখি তাকে,
গৈরিক বসনাবৃত পরম নিবিষ্টচিত্ত একা একা বসে,
কে তিনি পথিক না পরিব্রাজক?
আমার মনেও প্রশ্ন, বেলাল ভাই কী হিসেবে কাটিয়ে গেছেন ৮০ বছরের জীবন, পথিক না পরিব্রাজক?
‘নারীটি যখন নদী হয়ে গেল’ কবিতার কয়টি লাইন উদ্ধৃত করেই কবি বেলাল চৌধুরীর প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।
সে কি তার মৃত্যু দৃশ্যে
পেয়েছিল পরিপূর্ণতা, কে জানে!
না হলে ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসিটি
কি করে ফুটিয়ে তুলেছিল ঐ বিভ্রম;
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
১ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
২ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
২ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
২ ঘণ্টা আগে