মহিউদ্দিন খান মোহন
আজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা। এ কথা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা তিনিই প্রথম প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেছিলেন। ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের কাগমারী (সন্তোষ) সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশে ‘আসসালামু আলাইকুম’ এবং ১৯৭০ সালের ২৩ নভেম্বর পল্টন ময়দানের জনসভায় পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশে ‘লা কুম দ্বীনি কুম ওয়াল ইয়া দ্বীন’ বলে তিনি স্পষ্টভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করেন। এরপর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তবে তাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। ৯ মার্চ মওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আপস-আলোচনার ভ্রান্ত পথ পরিহার করে সরাসরি স্বাধীনতাসংগ্রামে ব্রতী হওয়ার আহ্বান জানান।
২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ শুরু হওয়ার সময় মওলানা ভাসানী সন্তোষে নিজের বাড়িতেই ছিলেন। ৩ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী তাঁর সন্তোষের বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। সে সময় তিনি পার্শ্ববর্তী বিন্নাফৈর গ্রামে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ভিত্তিভূমি ভারতের আসাম রাজ্যে প্রবেশ করেন। এ সম্পর্কে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও ভাসানী গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর ‘ভাসানী’ গ্রন্থে (প্রথম খণ্ড) লিখেছেন, ‘১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল কলকাতার দৈনিক পত্রিকা আনন্দবাজার “সীমান্তের এপার ভাসানী: সজল চোখে সাহায্য প্রার্থনা” শিরোনামে এক প্রতিবেদনে লেখে—পূর্ব বাংলার অশীতিপর বৃদ্ধ নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী গতকাল মাঝরাতে সীমান্তের এপারে এসে কোন-এক জায়গায় কেন্দ্রীয় শিল্পোন্নয়ন মন্ত্রী শ্রী মৈনুল হক চৌধুরী ও আসামের তথ্য ও জনসংযোগ দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী সৈয়দ আমেদ আলীর সংগে দেখা করেন। বাংলাদেশের জনগণের উপর পাকিস্তানী জঙ্গী ফৌজের নির্যাতন বন্ধের জন্য তিনি ভারত সরকারের সাহায্য প্রার্থনা করেন, আজ এখানে সরকারী মহলে এ কথা জানা গিয়েছে। আকাশবাণী গৌহাটি কেন্দ্র থেকে আজ এ কথা প্রচার করা হয়।’
কাকতালীয় ব্যাপার হলো, আনন্দবাজার পত্রিকা যেদিন মওলানা ভাসানীর ভারতে যাওয়ার খবরটি প্রকাশ করে, ওই দিনই কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে। দুটি ঘটনা একই সময়ে ঘটলেও একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো যোগাযোগ ছিল না। সুতরাং এ কথা নিঃসংকোচে বলা যায় যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ছিলেন উচ্চকণ্ঠ এবং কারও আহ্বানের অপেক্ষা না করেই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণ ও তা পালনে ব্রতী হয়েছেন। ১৮ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকায় পিটিআই পরিবেশিত অপর এক খবরে বলা হয়: জাতীয় আওয়ামী পার্টির নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের দাবি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দাবি নয়, বরং পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থের বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে এ এক পবিত্র সংগ্রাম।’ (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা: ৩৬৪-৩৬৫)
এরপর মওলানা ভাসানী কলকাতায় যান। ২৩ এপ্রিল আনন্দবাজার মওলানা ভাসানীর আরেকটি সুদীর্ঘ বিবৃতি প্রকাশ করে। তাতে তিনি দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, জুলুম, নির্যাতন ও গণহত্যার তীব্র সমালোচনা করে একাত্তরের সংগ্রামকে বহিঃশক্তির শোষণ, শাসন ও বাঙালিদের স্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে ন্যায়সংগত সংগ্রাম হিসেবে অভিহিত করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ববাসীর সমর্থন আহ্বান করেন।
মওলানা ভাসানীর ভারতে গমন ও স্বাধীনতার পক্ষে তৎপরতা সম্বন্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বিশেষ সহকারী মঈদুল হাসান তাঁর ‘মূলধারা ৭১’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে আসাম সীমান্তের ধুবড়ী দিয়ে ভারতে প্রবেশের পর মওলানা ভাসানী কলকাতায় আসেন এবং তাজউদ্দীনের সঙ্গে পরামর্শের পর চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, মিসর, জাতিসংঘ, আরব লীগ প্রভৃতি দেশ ও সংস্থার নেতাদের বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের অনুরোধ জানিয়ে আলাদা আলাদাভাবে তারবার্তা প্রেরণ করেন। মঈদুল হাসান লিখেছেন, ‘মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রতিরোধ সংগ্রামের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান করার জন্য তাজউদ্দীন ও ভারত সরকারের কাছে ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং চারটি বিকল্প অঞ্চলকে তিনি চিহ্নিত করেন। প্রতিটি অঞ্চলের তুলনামূলক সুবিধা-অসুবিধা বিচার করে এই চারটি অঞ্চলের মধ্যে রংপুর-কুচবিহার সীমান্তকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয় এবং মাসাধিককাল কোলকাতায় অবস্থানের পর তিনি কুচবিহার শহরের অদূরে তাঁর নতুন আশ্রয়স্থলে যান।’ এ সময় তাঁর গুরুতর পেটের পীড়া দেখা দেওয়ায় তাঁকে দিল্লির ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস’-এ ভর্তি করা হয়। রোগমুক্তির পর হিমালয়ের পাদদেশে দেরাদুন শহরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
ভারত সরকার মওলানা ভাসানীকে সন্দেহের চোখে দেখত। এর কারণ ছিল তাঁর চীন কানেকশন। আর ভারত অসন্তুষ্ট হবে—এ আশঙ্কায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারও মওলানা ভাসানীকে এড়িয়ে চলার নীতি অবলম্বন করে। তবে একপর্যায়ে এসে প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকারকে মওলানার দ্বারস্থ হতে হয়। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ‘শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের আন্দোলন এবং তাকে ভারত সশস্ত্র যুদ্ধের রূপ দিয়েছে’ বলে মন্তব্য করলে ভারত বেকায়দায় পড়ে যায়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের প্রতিনিধির মন্তব্যের বিপরীতে ভারতের প্রতিনিধি সমর সেন একেবারে লা জবাব হয়ে যান। কেননা, তাঁর কাছে এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত বা প্রমাণ ছিল না, যা দ্বারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সব রাজনৈতিক দল ও জনগণ সমর্থিত জনযুদ্ধ হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। সমর সেন এ খবর দিল্লিতে পাঠালে ভারত সরকার প্রমাদ গোনে এবং অতি দ্রুততার সঙ্গে মওলানা ভাসানীকে দেরাদুন থেকে কলকাতায় এনে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, কমরেড মণি সিংহ ও মনোরঞ্জন ধরসহ বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ওই সভার ছবি প্রকাশ করে প্রবাসী সরকার বলে যে এই সর্বদলীয় কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী এই সরকার গঠন করা হয়েছে এবং এই কমিটির পরামর্শেই সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে।
ওই উপদেষ্টা কমিটি গঠনের মূল কারণ ছিল ভারতের পরামর্শ। ভারত চেয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে সর্বদলীয় ও জনসমর্থিত জনযুদ্ধ হিসেবে পরিচিত করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই যুদ্ধের যৌক্তিকতা উপস্থাপন ও সমর্থনের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠন সহজ করতে। কিন্তু আওয়ামী লীগ দলীয় সংকীর্ণতায় এতটাই আচ্ছন্ন ছিল যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকেই সে কমিটির আহ্বায়ক করেছিল। তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করায় ওই কমিটি সরকারের একটি সাবকমিটিতে পরিণত হয়। ফলে এর কোনো কার্যকারিতা আর থাকেনি। উল্লেখ্য, ৮ সেপ্টেম্বরের পরে ওই উপদেষ্টা কমিটির আর কোনো সভা হয়নি। মুখরক্ষার উপদেষ্টা কমিটি গঠনের পরে মওলানা ভাসানীর প্রয়োজনও সরকারের কাছে ফুরিয়ে যায়। তাঁকে পুনরায় দেরাদুনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত কড়া নজরদারিতে তাঁকে গৃহবন্দী জীবন কাটাতে হয়।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও মওলানা ভাসানী মুক্ত হন ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি। পরে তিনি সিলেট সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে দুই দিনের কষ্টকর ভ্রমণ শেষে ২২ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের সন্তোষে নিজ বাড়িতে পৌঁছান। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদকারী ও স্বাধীনতার আওয়াজ উচ্চারণকারী এই মহান নেতাকে শুধু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংকীর্ণতা ও ভারতের চীনভীতির কারণে পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় অনুপস্থিত থাকতে হয়। ফলে দেশবাসী ও যুদ্ধরত মুক্তিসেনারা সে ক্রান্তিকালে তাঁর মূল্যবান দিকনির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হন।
মহিউদ্দিন খান মোহন, সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
আজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা। এ কথা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা তিনিই প্রথম প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেছিলেন। ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের কাগমারী (সন্তোষ) সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশে ‘আসসালামু আলাইকুম’ এবং ১৯৭০ সালের ২৩ নভেম্বর পল্টন ময়দানের জনসভায় পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশে ‘লা কুম দ্বীনি কুম ওয়াল ইয়া দ্বীন’ বলে তিনি স্পষ্টভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করেন। এরপর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তবে তাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। ৯ মার্চ মওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আপস-আলোচনার ভ্রান্ত পথ পরিহার করে সরাসরি স্বাধীনতাসংগ্রামে ব্রতী হওয়ার আহ্বান জানান।
২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ শুরু হওয়ার সময় মওলানা ভাসানী সন্তোষে নিজের বাড়িতেই ছিলেন। ৩ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী তাঁর সন্তোষের বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। সে সময় তিনি পার্শ্ববর্তী বিন্নাফৈর গ্রামে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ভিত্তিভূমি ভারতের আসাম রাজ্যে প্রবেশ করেন। এ সম্পর্কে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও ভাসানী গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর ‘ভাসানী’ গ্রন্থে (প্রথম খণ্ড) লিখেছেন, ‘১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল কলকাতার দৈনিক পত্রিকা আনন্দবাজার “সীমান্তের এপার ভাসানী: সজল চোখে সাহায্য প্রার্থনা” শিরোনামে এক প্রতিবেদনে লেখে—পূর্ব বাংলার অশীতিপর বৃদ্ধ নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী গতকাল মাঝরাতে সীমান্তের এপারে এসে কোন-এক জায়গায় কেন্দ্রীয় শিল্পোন্নয়ন মন্ত্রী শ্রী মৈনুল হক চৌধুরী ও আসামের তথ্য ও জনসংযোগ দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী সৈয়দ আমেদ আলীর সংগে দেখা করেন। বাংলাদেশের জনগণের উপর পাকিস্তানী জঙ্গী ফৌজের নির্যাতন বন্ধের জন্য তিনি ভারত সরকারের সাহায্য প্রার্থনা করেন, আজ এখানে সরকারী মহলে এ কথা জানা গিয়েছে। আকাশবাণী গৌহাটি কেন্দ্র থেকে আজ এ কথা প্রচার করা হয়।’
কাকতালীয় ব্যাপার হলো, আনন্দবাজার পত্রিকা যেদিন মওলানা ভাসানীর ভারতে যাওয়ার খবরটি প্রকাশ করে, ওই দিনই কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে। দুটি ঘটনা একই সময়ে ঘটলেও একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো যোগাযোগ ছিল না। সুতরাং এ কথা নিঃসংকোচে বলা যায় যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ছিলেন উচ্চকণ্ঠ এবং কারও আহ্বানের অপেক্ষা না করেই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণ ও তা পালনে ব্রতী হয়েছেন। ১৮ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকায় পিটিআই পরিবেশিত অপর এক খবরে বলা হয়: জাতীয় আওয়ামী পার্টির নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের দাবি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দাবি নয়, বরং পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থের বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে এ এক পবিত্র সংগ্রাম।’ (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা: ৩৬৪-৩৬৫)
এরপর মওলানা ভাসানী কলকাতায় যান। ২৩ এপ্রিল আনন্দবাজার মওলানা ভাসানীর আরেকটি সুদীর্ঘ বিবৃতি প্রকাশ করে। তাতে তিনি দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, জুলুম, নির্যাতন ও গণহত্যার তীব্র সমালোচনা করে একাত্তরের সংগ্রামকে বহিঃশক্তির শোষণ, শাসন ও বাঙালিদের স্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে ন্যায়সংগত সংগ্রাম হিসেবে অভিহিত করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ববাসীর সমর্থন আহ্বান করেন।
মওলানা ভাসানীর ভারতে গমন ও স্বাধীনতার পক্ষে তৎপরতা সম্বন্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বিশেষ সহকারী মঈদুল হাসান তাঁর ‘মূলধারা ৭১’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে আসাম সীমান্তের ধুবড়ী দিয়ে ভারতে প্রবেশের পর মওলানা ভাসানী কলকাতায় আসেন এবং তাজউদ্দীনের সঙ্গে পরামর্শের পর চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, মিসর, জাতিসংঘ, আরব লীগ প্রভৃতি দেশ ও সংস্থার নেতাদের বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের অনুরোধ জানিয়ে আলাদা আলাদাভাবে তারবার্তা প্রেরণ করেন। মঈদুল হাসান লিখেছেন, ‘মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রতিরোধ সংগ্রামের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান করার জন্য তাজউদ্দীন ও ভারত সরকারের কাছে ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং চারটি বিকল্প অঞ্চলকে তিনি চিহ্নিত করেন। প্রতিটি অঞ্চলের তুলনামূলক সুবিধা-অসুবিধা বিচার করে এই চারটি অঞ্চলের মধ্যে রংপুর-কুচবিহার সীমান্তকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয় এবং মাসাধিককাল কোলকাতায় অবস্থানের পর তিনি কুচবিহার শহরের অদূরে তাঁর নতুন আশ্রয়স্থলে যান।’ এ সময় তাঁর গুরুতর পেটের পীড়া দেখা দেওয়ায় তাঁকে দিল্লির ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস’-এ ভর্তি করা হয়। রোগমুক্তির পর হিমালয়ের পাদদেশে দেরাদুন শহরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
ভারত সরকার মওলানা ভাসানীকে সন্দেহের চোখে দেখত। এর কারণ ছিল তাঁর চীন কানেকশন। আর ভারত অসন্তুষ্ট হবে—এ আশঙ্কায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারও মওলানা ভাসানীকে এড়িয়ে চলার নীতি অবলম্বন করে। তবে একপর্যায়ে এসে প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকারকে মওলানার দ্বারস্থ হতে হয়। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ‘শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের আন্দোলন এবং তাকে ভারত সশস্ত্র যুদ্ধের রূপ দিয়েছে’ বলে মন্তব্য করলে ভারত বেকায়দায় পড়ে যায়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের প্রতিনিধির মন্তব্যের বিপরীতে ভারতের প্রতিনিধি সমর সেন একেবারে লা জবাব হয়ে যান। কেননা, তাঁর কাছে এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত বা প্রমাণ ছিল না, যা দ্বারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সব রাজনৈতিক দল ও জনগণ সমর্থিত জনযুদ্ধ হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। সমর সেন এ খবর দিল্লিতে পাঠালে ভারত সরকার প্রমাদ গোনে এবং অতি দ্রুততার সঙ্গে মওলানা ভাসানীকে দেরাদুন থেকে কলকাতায় এনে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, কমরেড মণি সিংহ ও মনোরঞ্জন ধরসহ বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ওই সভার ছবি প্রকাশ করে প্রবাসী সরকার বলে যে এই সর্বদলীয় কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী এই সরকার গঠন করা হয়েছে এবং এই কমিটির পরামর্শেই সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে।
ওই উপদেষ্টা কমিটি গঠনের মূল কারণ ছিল ভারতের পরামর্শ। ভারত চেয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে সর্বদলীয় ও জনসমর্থিত জনযুদ্ধ হিসেবে পরিচিত করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই যুদ্ধের যৌক্তিকতা উপস্থাপন ও সমর্থনের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠন সহজ করতে। কিন্তু আওয়ামী লীগ দলীয় সংকীর্ণতায় এতটাই আচ্ছন্ন ছিল যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকেই সে কমিটির আহ্বায়ক করেছিল। তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করায় ওই কমিটি সরকারের একটি সাবকমিটিতে পরিণত হয়। ফলে এর কোনো কার্যকারিতা আর থাকেনি। উল্লেখ্য, ৮ সেপ্টেম্বরের পরে ওই উপদেষ্টা কমিটির আর কোনো সভা হয়নি। মুখরক্ষার উপদেষ্টা কমিটি গঠনের পরে মওলানা ভাসানীর প্রয়োজনও সরকারের কাছে ফুরিয়ে যায়। তাঁকে পুনরায় দেরাদুনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত কড়া নজরদারিতে তাঁকে গৃহবন্দী জীবন কাটাতে হয়।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও মওলানা ভাসানী মুক্ত হন ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি। পরে তিনি সিলেট সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে দুই দিনের কষ্টকর ভ্রমণ শেষে ২২ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের সন্তোষে নিজ বাড়িতে পৌঁছান। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদকারী ও স্বাধীনতার আওয়াজ উচ্চারণকারী এই মহান নেতাকে শুধু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংকীর্ণতা ও ভারতের চীনভীতির কারণে পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় অনুপস্থিত থাকতে হয়। ফলে দেশবাসী ও যুদ্ধরত মুক্তিসেনারা সে ক্রান্তিকালে তাঁর মূল্যবান দিকনির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হন।
মহিউদ্দিন খান মোহন, সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
৩ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
৩ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
৩ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে এ দেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে শাসন করেছে। মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ কনসেপ্ট। এটার সবচেয়ে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা হলো, এটা একটা গড়, যেটা স্বল্পসংখ্যক ধনী এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন-মধ্যবিত্ত
১ দিন আগে