মযহারুল ইসলাম বাবলা
ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ নির্মূল করা সম্ভব না হলে সেটা তীব্র আকার ধারণ করে বিশ্ব পরিস্থিতিকে কেবল অশান্ত নয়, চরম ভয়াবহতায় বিপন্ন করে তুলবে। যার থেকে দেশে দেশে বসবাসরত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন বিপন্ন ও ধ্বংসের পথে এগোবে।
বৌদ্ধধর্মের মৌলিক ভিত্তিই হচ্ছে, জীব হত্যা মহা পাপ, অহিংস পরম ধর্ম। গৌতম বুদ্ধপ্রদত্ত এই বাণী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মাঝে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য এবং ক্রিয়াশীল বলেই আমরা জানি।
সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত-নিবেদিতপ্রাণ হয়েও অপরাপর ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অপর ধর্মাবলম্বীদের ওপর নানা কালাকানুন আরোপসহ নির্যাতন-নিপীড়নেরও অসংখ্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।
সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন ধর্মমতের আগমনে এক ধর্মের অনুসারীরা অপর ধর্মানুসারীর প্রতি সহিষ্ণুতার নজির ইতিহাসে নেই বললেই চলে। নিজ ধর্ম অপর ধর্মের মানুষের ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার অগণিত ঘটনাও ঘটেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের শক্তি-সামর্থ্যের ওপর ভর করেই এসব অনাচার ধর্মমতের আগমনের পর থেকেই চলে আসছে।
এশিয়া মহাদেশের মধ্যপ্রাচ্যেই সর্বাধিক এবং ভারতবর্ষে কয়েকটি ধর্মমতের আবির্ভাব ঘটেছে। আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া কোনো মহাদেশেই ধর্মমতের আবির্ভাব ঘটেনি।
মধ্যপ্রাচ্যেই সর্বাধিক ধর্মমতের আবির্ভাবের কারণে এক ধর্মমত অপর ধর্মমতের ওপর প্রভাব বিস্তারে অগণিত রক্তক্ষয়ী ঘটনা ক্রমাগত ঘটেছে এবং ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামায়, নৃশংসতায় প্রাণ দিতে হয়েছে অগণিত মানুষকে। এসব যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ (ক্রুসেড) নামকরণে ধর্ম রক্ষার তাগিদে অকাতরে নৃশংস ঘটনায় অংশ নিয়ে স্বধর্মের প্রসারে জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অপর ধর্মের অনুসারীদের ওপর। অথচ প্রতিটি ধর্মমতই অপর ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের কঠোর নির্দেশ দিয়েছে।
কিন্তু ধর্মান্ধ-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ধর্মীয় আদেশ-নির্দেশ উপেক্ষা করে সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের ওপর বর্বরোচিত আচরণ অব্যাহত রেখে এসেছে। বিশ্বজুড়ে নির্মমতার শিকার হতে হয়েছে এবং হচ্ছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের। অনায়াসে যেটিকে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ বললে অত্যুক্তি হবে না। এই ফ্যাসিবাদের চারণক্ষেত্র এখন বিশ্বময়।
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কার দিকে তাকালে দেখা যায়, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রতি আমাদের প্রচলিত ধারণা কত ভ্রান্ত এবং ভুলে ভরা। মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরোচিত গণহত্যা চালিয়ে তাদের দেশছাড়া করা হয়েছে নৃশংস উপায়ে। মুসলিম এবং স্বল্প হলেও হিন্দু ধর্মাবলম্বী রোহিঙ্গাদের ওপর সে দেশের সেনাবাহিনী, শান্তিরক্ষী বাহিনী, বৌদ্ধ ভিক্ষু থেকে সর্বস্তরের বৌদ্ধরা শামিল হয়েছে ভূমি থেকে উচ্ছেদে এবং নির্মম হত্যাযজ্ঞে। শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চিও মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী এবং নিজ বৌদ্ধধর্মের প্রতি আনুগত্যে এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ না করে পক্ষান্তরে ওই রোহিঙ্গা গণহত্যা এবং তাদের বিতাড়নকেই সমর্থন জুগিয়েছেন। চীন ও ভারতের মধ্যকার নানা টানাপোড়েন থাকলেও তারা তাদের জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় রোহিঙ্গা বিতাড়ন এবং গণহত্যায় মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে এসেছে।
একসময় সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন মিয়ানমার ওই চীন-ভারতের বলয়ে থাকলেও এখন তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। গত কয়েক বছরে মিয়ানমারকে প্রশিক্ষণ ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত করার ক্ষেত্রে ওই দুই দেশ সামরিক সহায়তা দিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের সামরিক শক্তির তুলনায় বহু গুণ শক্তিশালী মিয়ানমার বাংলাদেশকে সে কারণেই তুচ্ছজ্ঞান করছে।
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে মুসলিম নিধন-বিতাড়ন সম্পন্ন হলেও অপর সংখ্যালঘু সান প্রদেশের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপর আগাগোড়া চাপ থাকলেও খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীর মিত্ররাষ্ট্রগুলোর কারণে খ্রিষ্টানদের দেশছাড়া-গণহত্যার শিকারে পরিণত হতে হয়নি। তবে মিয়ানমারের খ্রিষ্টানরাও মূলধারা থেকে বিচ্যুত। অনেক ক্ষেত্রে নাগরিক অধিকার থেকেও। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ব্যতীত অপরাপর ধর্মমতের ওপর রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও বৌদ্ধধর্মীয় ফ্যাসিবাদ নৃশংসতার চরম নজির রেখে চলেছে। পরধর্মমতসহিষ্ণুতার কোনো দৃষ্টান্ত সেখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বৌদ্ধ ফ্যাসিবাদ সেখানে চরমভাবে ক্রিয়াশীল।
শ্রীলঙ্কাও বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ। সেখানে অপরাপর ধর্মমতের মানুষেরা নিরাপদে নেই। সংখ্যাবিচারে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় তারা অনেকটাই নিরাপত্তায় নাগরিক অধিকার পেয়ে এসেছে। তামিলভাষী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ব্রিটিশরা চা ও রাবারবাগানের দক্ষ শ্রমিক হিসেবে ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্য থেকে নিয়ে এসেছিল। ব্রিটিশ শাসনাধীন শ্রীলঙ্কার জনগণ সেটি কখনো ভালো চোখে দেখেনি। ব্রিটিশদের বিদায়ের পর স্বাধীন শ্রীলঙ্কায় তামিলদের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ভোটাধিকার পর্যন্ত হরণ করা হয়। এতে বঞ্চিত তামিল জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভের দানা বাঁধে। বঞ্চনা থেকেই তামিল টাইগার নামের সশস্ত্র সংগঠন গড়ে ওঠে। কয়েক যুগের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে নির্বিচারে তামিল গণহত্যার মধ্য দিয়ে।
কয়েক বছর আগে শ্রীলঙ্কায় গির্জায় হামলার পর সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর চরম নৃশংসতা প্রদর্শন করা হয়েছিল। মোট জনসংখ্যার ক্ষুদ্র অংশ মুসলিম সম্প্রদায় শ্রীলঙ্কায় পূর্ণ নাগরিক অধিকার-মর্যাদা কখনো পায়নি। ইস্টার সানডে উদযাপনকালে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের গির্জায় বোমা হামলার পর দেশটির মুসলিম সম্প্রদায় বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সম্মিলিত হামলার মুখে পড়ে। ফিলিস্তিনসহ আরব বিশ্বে ইসরায়েলের ক্রমাগত ভূমি দখল, হত্যা, গণহত্যার বিরুদ্ধে আজ অবধি আইএসের ন্যূনতম তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি। বিপরীতে মুসলিম সংখ্যাধিক্য দেশগুলোয় আইএসের নৃশংস জঙ্গি তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। আইএসের তিন পৃষ্ঠপোষক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও সৌদি আরব তাই নিরবচ্ছিন্ন নিরাপত্তায় রয়েছে।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর চলছে সম্প্রদায়গত নিপীড়ন-নৃশংসতা। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান এ ক্ষেত্রে তো উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি তৎপরতার ক্ষেত্রে মুসলিম মৌলবাদীদের ভূমিকা সর্বজন বিদিত। মানুষের ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে মৌলবাদী গোষ্ঠীর হীন তৎপরতা সারা বিশ্বে মুসলিম সম্প্রদায়কে লজ্জায় ফেলেছে। নিউজিল্যান্ডের মতো শান্তিপ্রিয় দেশেও খ্রিষ্ট মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা মসজিদে বোমা হামলা চালিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে। মসজিদে ওই বোমা হামলাকে কেন্দ্র করে যদি মুসলিমরাও একই পথে হাঁটত, তাহলে নিউজিল্যান্ডের জন্য সেটা শুভবার্তা বয়ে আনত না। নিউজিল্যান্ড সরকারের কর্তব্য ছিল সংখ্যালঘু মুসলিমদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি খ্রিষ্ট জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের ক্ষমতা লাভের পর থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিনাশ ক্রমাগত ঘটেই চলেছে। বহুত্ববাদ ত্যাগ করে ভারতে হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা দেশটিকে প্রকৃত অর্থে ভাঙনের মুখেই ঠেলে দেবে। সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর বৈরী-অমানবিক আচরণ অব্যাহত থাকলে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান যে ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে!
আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ভূমি, জমি, বাড়ি দখলের অভিপ্রায়ে হিন্দুদের ওপর নিষ্ঠুরতার অজস্র নজির রয়েছে। দেশভাগের পর থেকে ওই ঘৃণ্য অপকীর্তি আজও চলমান।
এই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ নির্মূল করা সম্ভব না হলে সেটা তীব্র আকার ধারণ করে বিশ্ব পরিস্থিতিকে কেবল অশান্ত নয়, চরম ভয়াবহতায় বিপন্ন করে তুলবে। যার থেকে দেশে দেশে বসবাসরত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন বিপন্ন ও ধ্বংসের পথে এগোবে। এর মাশুল গুনতে হবে সব দেশের সব ধর্মমতের সংখ্যালঘুদের। ধর্মীয় অনুশাসন কোনোক্রমেই চলমান ধর্মীয় ফ্যাসিবাদকে অনুমোদন করে না; বরং পরমতসহিষ্ণুতার কথাই জোর দিয়ে বারবার বলেছে।
কিন্তু প্রবচন আছে, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।
ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ নির্মূল করা সম্ভব না হলে সেটা তীব্র আকার ধারণ করে বিশ্ব পরিস্থিতিকে কেবল অশান্ত নয়, চরম ভয়াবহতায় বিপন্ন করে তুলবে। যার থেকে দেশে দেশে বসবাসরত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন বিপন্ন ও ধ্বংসের পথে এগোবে।
বৌদ্ধধর্মের মৌলিক ভিত্তিই হচ্ছে, জীব হত্যা মহা পাপ, অহিংস পরম ধর্ম। গৌতম বুদ্ধপ্রদত্ত এই বাণী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মাঝে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য এবং ক্রিয়াশীল বলেই আমরা জানি।
সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত-নিবেদিতপ্রাণ হয়েও অপরাপর ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অপর ধর্মাবলম্বীদের ওপর নানা কালাকানুন আরোপসহ নির্যাতন-নিপীড়নেরও অসংখ্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।
সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন ধর্মমতের আগমনে এক ধর্মের অনুসারীরা অপর ধর্মানুসারীর প্রতি সহিষ্ণুতার নজির ইতিহাসে নেই বললেই চলে। নিজ ধর্ম অপর ধর্মের মানুষের ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার অগণিত ঘটনাও ঘটেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের শক্তি-সামর্থ্যের ওপর ভর করেই এসব অনাচার ধর্মমতের আগমনের পর থেকেই চলে আসছে।
এশিয়া মহাদেশের মধ্যপ্রাচ্যেই সর্বাধিক এবং ভারতবর্ষে কয়েকটি ধর্মমতের আবির্ভাব ঘটেছে। আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া কোনো মহাদেশেই ধর্মমতের আবির্ভাব ঘটেনি।
মধ্যপ্রাচ্যেই সর্বাধিক ধর্মমতের আবির্ভাবের কারণে এক ধর্মমত অপর ধর্মমতের ওপর প্রভাব বিস্তারে অগণিত রক্তক্ষয়ী ঘটনা ক্রমাগত ঘটেছে এবং ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামায়, নৃশংসতায় প্রাণ দিতে হয়েছে অগণিত মানুষকে। এসব যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ (ক্রুসেড) নামকরণে ধর্ম রক্ষার তাগিদে অকাতরে নৃশংস ঘটনায় অংশ নিয়ে স্বধর্মের প্রসারে জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অপর ধর্মের অনুসারীদের ওপর। অথচ প্রতিটি ধর্মমতই অপর ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের কঠোর নির্দেশ দিয়েছে।
কিন্তু ধর্মান্ধ-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ধর্মীয় আদেশ-নির্দেশ উপেক্ষা করে সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের ওপর বর্বরোচিত আচরণ অব্যাহত রেখে এসেছে। বিশ্বজুড়ে নির্মমতার শিকার হতে হয়েছে এবং হচ্ছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের। অনায়াসে যেটিকে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ বললে অত্যুক্তি হবে না। এই ফ্যাসিবাদের চারণক্ষেত্র এখন বিশ্বময়।
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কার দিকে তাকালে দেখা যায়, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রতি আমাদের প্রচলিত ধারণা কত ভ্রান্ত এবং ভুলে ভরা। মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরোচিত গণহত্যা চালিয়ে তাদের দেশছাড়া করা হয়েছে নৃশংস উপায়ে। মুসলিম এবং স্বল্প হলেও হিন্দু ধর্মাবলম্বী রোহিঙ্গাদের ওপর সে দেশের সেনাবাহিনী, শান্তিরক্ষী বাহিনী, বৌদ্ধ ভিক্ষু থেকে সর্বস্তরের বৌদ্ধরা শামিল হয়েছে ভূমি থেকে উচ্ছেদে এবং নির্মম হত্যাযজ্ঞে। শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চিও মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী এবং নিজ বৌদ্ধধর্মের প্রতি আনুগত্যে এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ না করে পক্ষান্তরে ওই রোহিঙ্গা গণহত্যা এবং তাদের বিতাড়নকেই সমর্থন জুগিয়েছেন। চীন ও ভারতের মধ্যকার নানা টানাপোড়েন থাকলেও তারা তাদের জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় রোহিঙ্গা বিতাড়ন এবং গণহত্যায় মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে এসেছে।
একসময় সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন মিয়ানমার ওই চীন-ভারতের বলয়ে থাকলেও এখন তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। গত কয়েক বছরে মিয়ানমারকে প্রশিক্ষণ ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত করার ক্ষেত্রে ওই দুই দেশ সামরিক সহায়তা দিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের সামরিক শক্তির তুলনায় বহু গুণ শক্তিশালী মিয়ানমার বাংলাদেশকে সে কারণেই তুচ্ছজ্ঞান করছে।
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে মুসলিম নিধন-বিতাড়ন সম্পন্ন হলেও অপর সংখ্যালঘু সান প্রদেশের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপর আগাগোড়া চাপ থাকলেও খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীর মিত্ররাষ্ট্রগুলোর কারণে খ্রিষ্টানদের দেশছাড়া-গণহত্যার শিকারে পরিণত হতে হয়নি। তবে মিয়ানমারের খ্রিষ্টানরাও মূলধারা থেকে বিচ্যুত। অনেক ক্ষেত্রে নাগরিক অধিকার থেকেও। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ব্যতীত অপরাপর ধর্মমতের ওপর রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও বৌদ্ধধর্মীয় ফ্যাসিবাদ নৃশংসতার চরম নজির রেখে চলেছে। পরধর্মমতসহিষ্ণুতার কোনো দৃষ্টান্ত সেখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বৌদ্ধ ফ্যাসিবাদ সেখানে চরমভাবে ক্রিয়াশীল।
শ্রীলঙ্কাও বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ। সেখানে অপরাপর ধর্মমতের মানুষেরা নিরাপদে নেই। সংখ্যাবিচারে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় তারা অনেকটাই নিরাপত্তায় নাগরিক অধিকার পেয়ে এসেছে। তামিলভাষী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ব্রিটিশরা চা ও রাবারবাগানের দক্ষ শ্রমিক হিসেবে ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্য থেকে নিয়ে এসেছিল। ব্রিটিশ শাসনাধীন শ্রীলঙ্কার জনগণ সেটি কখনো ভালো চোখে দেখেনি। ব্রিটিশদের বিদায়ের পর স্বাধীন শ্রীলঙ্কায় তামিলদের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ভোটাধিকার পর্যন্ত হরণ করা হয়। এতে বঞ্চিত তামিল জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভের দানা বাঁধে। বঞ্চনা থেকেই তামিল টাইগার নামের সশস্ত্র সংগঠন গড়ে ওঠে। কয়েক যুগের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে নির্বিচারে তামিল গণহত্যার মধ্য দিয়ে।
কয়েক বছর আগে শ্রীলঙ্কায় গির্জায় হামলার পর সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর চরম নৃশংসতা প্রদর্শন করা হয়েছিল। মোট জনসংখ্যার ক্ষুদ্র অংশ মুসলিম সম্প্রদায় শ্রীলঙ্কায় পূর্ণ নাগরিক অধিকার-মর্যাদা কখনো পায়নি। ইস্টার সানডে উদযাপনকালে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের গির্জায় বোমা হামলার পর দেশটির মুসলিম সম্প্রদায় বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সম্মিলিত হামলার মুখে পড়ে। ফিলিস্তিনসহ আরব বিশ্বে ইসরায়েলের ক্রমাগত ভূমি দখল, হত্যা, গণহত্যার বিরুদ্ধে আজ অবধি আইএসের ন্যূনতম তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি। বিপরীতে মুসলিম সংখ্যাধিক্য দেশগুলোয় আইএসের নৃশংস জঙ্গি তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। আইএসের তিন পৃষ্ঠপোষক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও সৌদি আরব তাই নিরবচ্ছিন্ন নিরাপত্তায় রয়েছে।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর চলছে সম্প্রদায়গত নিপীড়ন-নৃশংসতা। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান এ ক্ষেত্রে তো উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি তৎপরতার ক্ষেত্রে মুসলিম মৌলবাদীদের ভূমিকা সর্বজন বিদিত। মানুষের ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে মৌলবাদী গোষ্ঠীর হীন তৎপরতা সারা বিশ্বে মুসলিম সম্প্রদায়কে লজ্জায় ফেলেছে। নিউজিল্যান্ডের মতো শান্তিপ্রিয় দেশেও খ্রিষ্ট মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা মসজিদে বোমা হামলা চালিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে। মসজিদে ওই বোমা হামলাকে কেন্দ্র করে যদি মুসলিমরাও একই পথে হাঁটত, তাহলে নিউজিল্যান্ডের জন্য সেটা শুভবার্তা বয়ে আনত না। নিউজিল্যান্ড সরকারের কর্তব্য ছিল সংখ্যালঘু মুসলিমদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি খ্রিষ্ট জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের ক্ষমতা লাভের পর থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিনাশ ক্রমাগত ঘটেই চলেছে। বহুত্ববাদ ত্যাগ করে ভারতে হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা দেশটিকে প্রকৃত অর্থে ভাঙনের মুখেই ঠেলে দেবে। সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর বৈরী-অমানবিক আচরণ অব্যাহত থাকলে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান যে ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে!
আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ভূমি, জমি, বাড়ি দখলের অভিপ্রায়ে হিন্দুদের ওপর নিষ্ঠুরতার অজস্র নজির রয়েছে। দেশভাগের পর থেকে ওই ঘৃণ্য অপকীর্তি আজও চলমান।
এই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ নির্মূল করা সম্ভব না হলে সেটা তীব্র আকার ধারণ করে বিশ্ব পরিস্থিতিকে কেবল অশান্ত নয়, চরম ভয়াবহতায় বিপন্ন করে তুলবে। যার থেকে দেশে দেশে বসবাসরত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন বিপন্ন ও ধ্বংসের পথে এগোবে। এর মাশুল গুনতে হবে সব দেশের সব ধর্মমতের সংখ্যালঘুদের। ধর্মীয় অনুশাসন কোনোক্রমেই চলমান ধর্মীয় ফ্যাসিবাদকে অনুমোদন করে না; বরং পরমতসহিষ্ণুতার কথাই জোর দিয়ে বারবার বলেছে।
কিন্তু প্রবচন আছে, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
৬ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
৭ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
৭ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
৭ ঘণ্টা আগে