মুহম্মদ জাফর ইকবাল
এখন রাত দুইটা বাজে। একটু আগে টেলিফোন বেজে উঠেছে। গভীর রাতে টেলিফোন বেজে উঠলে বুকটা ধক করে ওঠে, তাই টেলিফোনটা ধরেছি। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র ফোন করেছে। পত্রপত্রিকার খবর থেকে জানি, সেখানে ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করছে। মোটামুটি নিরীহ একটা আন্দোলন বিপজ্জনক আন্দোলনে মোড় নিয়েছে। ছাত্রটি ফোনে আমাকে জানাল, অনশন করা কয়েকজন ছাত্রকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। একজনের অবস্থা খুবই খারাপ। ডাক্তার বলেছেন, কিছু না খেলে ‘কোমায়’ চলে যেতে পারে। ফোন রেখে দেওয়ার আগে ভাঙা গলায় বলেছে, ‘স্যার, কিছু একটা করেন।’
আমি তখন থেকে চুপচাপ বসে আছি, কী করব? আমার কি কিছু করার আছে?
আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে আমি অনেকবার অনেক ধরনের আন্দোলন হতে দেখেছি। কাজেই আমি একটি আন্দোলনের ধাপগুলো জানি। প্রথম ধাপে যখন হলের মেয়েরা তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে উপাচার্যের কাছে গিয়েছে, সেটি সেখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। আমি খুব ভালো করে জানি, একটুখানি আন্তরিকতা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের কঠিন দাবিদাওয়াকে শান্ত করে দেওয়া যায়। কেউ একজন তাদের ভালো-মন্দ নিয়ে মাথা ঘামায়, তারা শুধু এটুকু নিশ্চয়তা চায়। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন যদি একটুখানি জনপ্রিয়তা পায়, তখন সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সেখানে ঢুকে পড়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেটাকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা যদি সতর্ক না থাকে, তখন নেতৃত্ব তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। আন্দোলন যদি থেমে না যায়, তখন সরকারি ছাত্রদের সংগঠন (এখানে ছাত্রলীগ) তাদের ওপর হামলা করে। প্রায় সব সময়ই সেটা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তাদের সলাপরামর্শে। তারপরও যদি আন্দোলন চলতে থাকে, তখন কর্তৃপক্ষকে পুলিশ ডাকতে হয়; পুলিশ এসে পেটানোর দায়িত্ব নেয়।
এই আন্দোলনে আমি এর প্রতিটি ধাপ ঘটতে দেখেছি। প্রচলিত প্রক্রিয়ার বাইরে যেটা হয়েছে, সেটা হচ্ছে পুলিশের অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতা। যত বড় পুলিশ বাহিনীই হোক, তারা ছাত্রছাত্রীদের গায়ে হাত তোলার আগে এক শবার চিন্তা করে। এখানে সেটা হয়নি। শটগান দিয়ে গুলি পর্যন্ত করা হয়েছে। বিষয়টি আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। পুলিশের চৌদ্দ পুরুষের সৌভাগ্য যে, সেই গুলিতে কেউ মারা যায়নি। বোঝাই যাচ্ছে, সিলেটের পুলিশ বাহিনীর তেজ এখনো কমেনি। তারা দুই শ থেকে তিন শ ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করে রেখেছে। যখন প্রয়োজন হবে, কোনো একজনের নাম ঢুকিয়ে তাকে শায়েস্তা করা যাবে! হয়রানি কত প্রকার ও কী কী—শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম বয়সী ছাত্রছাত্রীরা সেটা এবারে টের পাবে।
তবে একটি ব্যাপার আমি এখনো বুঝতে পারছি না। পুলিশের এই অবিশ্বাস্য আক্রমণ ঘটার কারণ হচ্ছে, উপাচার্য মহোদয়কে তালাবদ্ধ বিল্ডিং থেকে উদ্ধার করা। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের জন্য একটা ভবনে তালাবদ্ধ হয়ে আটকে পড়া এমন কোনো বড় ঘটনা নয়। একাডেমিক কাউন্সিল কিংবা সিন্ডিকেট মিটিং চলার সময় দাবি আদায়ের জন্য বাইরে থেকে তালা মেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকদের আটকে রাখার ঘটনা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়েই একাধিকবার ঘটেছে। তাঁরা তখন গল্পগুজব করে সময় কাটিয়েছেন, সোফায় শুয়ে রাত কাটিয়েছেন, গোপনে কিছু খাবার আনিয়ে ভাগাভাগি করে খেয়ে হাসি-তামাশা করেছেন। কিন্তু পুলিশ ডাকিয়ে ছাত্রদের গায়ে হাত তুলে মুক্ত হওয়ার জন্য কখনো ব্যস্ত হননি। এবার উপাচার্যকে উদ্ধার করার জন্য ছাত্রছাত্রীর ওপর একটি অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতা করা হলো। এর চেয়ে বড় অমানবিক কাজ কী হতে পারে; আমি জানি না। স্বাভাবিক নিয়মেই আন্দোলনটি এখন উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে রূপ নিয়েছে। তবে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এটা এমন কিছু বিচিত্র দাবি নয়। আমরা প্রায় নিয়মিতভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের পদত্যাগের দাবি শুনে আসছি।
ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে ছাত্রছাত্রীদের ক্যাম্পাস থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এবারেও সেই চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে যায়নি। এটিও নতুন একটি ঘটনা—তারা এখন কোথায় থাকে, কী খায়; আমি জানি না।
আন্দোলন যতক্ষণ পর্যন্ত স্লোগান, মিছিল, উত্তপ্ত বক্তৃতা এবং দেশাত্মবোধক গানের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে, সেটাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সেটি যদি শেষ পর্যায়ে চলে যায়, যখন ছাত্রছাত্রীরা আমরণ অনশন করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সেটি খুবই বিপজ্জনক। তাদের প্রচণ্ড ক্রোধ ও ক্ষোভ তখন একটা গভীর দুঃখবোধ এবং অভিমানে পাল্টে যায়। হঠাৎ করে তারা টের পায়, তারা আসলে একা, তাদের পাশে কেউ নেই। ‘আমরণ’ কথাটি থেকে ভয়ংকর কোনো কথা আমি জানি না। বড় মানুষেরা সেটাকে কৌশলী একটা শব্দ হিসেবে ব্যবহার করেন। কিন্তু এই বয়সী ছাত্রছাত্রীরা তাদের তীব্র আবেগের কারণে শব্দটাকে আক্ষরিক অর্থে ব্যবহার করে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলোর নামকরণ করা নিয়ে একবার বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। তখন আমাদের ছাত্রছাত্রীরা শহীদ মিনারে অনশন করে বিশ্ববিদ্যালয়টি খোলার ব্যবস্থা করেছিল। অভুক্ত ছাত্রছাত্রীদের দুর্বল শরীরে যখন খিঁচুনি হতে থাকে, সেই দৃশ্য সহ্য করার মতো নয়। (পরে তারা আমাকে তাদের অভিজ্ঞতার গল্প শুনিয়েছে। দিনরাত তারা বোধ-শক্তিহীনভাবে পড়ে আছে। অন্য কোনো অনুভূতি নেই। শুধু এক প্লেট খাবারের স্বপ্ন দেখছে! আমি তাদের সেই কষ্টের কথাগুলো কখনো ভুলতে পারি না।) যে কারণেই হোক, আমার এককালীন ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীরা আবার সেই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি চিন্তা করে আমি খুবই অশান্তি অনুভব করছি।
দুই.
প্রায় তিন বছর আগে অবসর নিয়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসার আগের মুহূর্তে আমি বর্তমান উপাচার্যকে তিন পৃষ্ঠার একটি লম্বা চিঠি লিখে এসেছিলাম। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে তাঁকে সেই চিঠিতে বেশ কয়েকটি উপদেশ দিয়েছিলাম। তিনি যদি আমার উপদেশগুলো শুনে সেভাবে কাজ করতেন, তাহলে আজকে বিশ্ববিদ্যালয়টি এ রকম বিপজ্জনক একটা জায়গায় পৌঁছাত না।
তিনি আমার উপদেশগুলো সহজভাবে নেবেন—আমি সেটা আশা করি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি করা শিক্ষকদের পুরস্কার হিসেবে উপাচার্য হিসেবে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। যদিও অনেক দিক দিয়েই শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় অনেক আধুনিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপক তাঁদের উন্নাসিকতার কারণে সেটা মেনে নেন না। কাজেই প্রান্তিক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার মতো একজন শিক্ষকের উপদেশ তাঁর ভালো লাগার কথা নয়।
কিছুদিন আগে আমার ওপর জঙ্গি হামলার বিচারের শুনানিতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আমাকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। আমি এক দিনের জন্য সিলেটে গিয়েছিলাম এবং বহুদিন পর ক্যাম্পাসে পা দিয়েছিলাম। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা রীতিমতো অপরাধ। তাই সবাই দূরে দূরে থাকলেও ছাত্রছাত্রীরা মন খুলে আমার সাথে কথা বলেছে। আমি বেশ দুঃখের সাথে আবিষ্কার করেছি, আমার পরিচিত শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রটি পাল্টে যাচ্ছে।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া বিশেষ হয় না (এখানে শুধু পরীক্ষা হয়)। কাজেই ভালো ছাত্রছাত্রীরা চেষ্টা-চরিত্র করে নিজেরা যেটুকু পারে শিখে নেয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈচিত্র্যময় পরিবেশে অন্য সবার সাথে সময় কাটিয়ে তাদের একধরনের মানসিক গঠন হয়; সেটার মূল্য কম নয়। সে জন্য আমি যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম, সব সময় তাদের সব রকম সংগঠন করে নানা ধরনের কাজকর্মে যুক্ত হতে উৎসাহ দিয়ে এসেছি। ছাত্রছাত্রীরা জানাল—এখন তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও বাধা-নিষেধ থাকে। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় আমাদের ছাত্রছাত্রীরা ক্যাম্পাসের রাস্তায় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও সবচেয়ে দীর্ঘ আলপনা এঁকেছিল। ছাত্রছাত্রীরা জানাল, এখন তারা রাস্তায় আলপনাও আঁকতে পারে না। তাদের দুঃখের কাহিনি শোনা ছাড়া আমার কিছু করার ছিল না। আমি শুধু তাদের ভেতরকার চাপা ক্ষোভটি অনুভব করেছি। সেই ক্ষোভ এখন বিস্ফোরণে রূপ নিয়েছে।
তিন.
কিছুদিন আগে লন্ডনের একটি ওয়েবিনারে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সেটি ছিল বাংলাদেশের শিক্ষা-সংক্রান্ত একটি ওয়েবিনার। আমি বক্তব্য দেওয়ার পর সঞ্চালক উইকিপিডিয়া থেকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভয়ংকর দুরবস্থার বর্ণনা পড়ে শোনালেন। তারপর এই ব্যাপারে আমার বক্তব্য জানতে চাইলেন। আমি বললাম, ‘আমি এই ব্যাপারটি খুব ভালো করে জানি এবং চাইলে সেটি সম্পর্কে বলতেও পারব। কিন্তু নীতিগতভাবে আমি দেশের বাইরের কোনো অনুষ্ঠানে দেশ সম্পর্কে খারাপ কিছু বলি না। কাজেই আমি এটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না। আপনি যদি সত্যিই জানতে চান, ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করলে বলতে পারি।’ সঞ্চালক বললেন, ‘তাহলে অন্তত এর সমাধান কী হতে পারে, সেটা বলেন।’ আমি বললাম, ‘সমাধান খুব কঠিন নয়। যেহেতু বাংলাদেশে উপাচার্যরা হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তা-বিধাতা, তাই রাজনীতি করা শিক্ষকদের নিয়োগ না দিয়ে খাঁটি শিক্ষাবিদদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেহারা পাল্টে যাবে।’
সেই ওয়েবিনারে আমাদের শিক্ষামন্ত্রীও ছিলেন। তিনি তাঁর বক্তব্য দেওয়ার সময় বললেন, ‘একজন উপাচার্যকে যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অনেক কাজ করতে হয়, তাই শুধু শিক্ষাবিদ সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। তাঁর ভেতর নেতৃত্ব দেওয়ার গুণ থাকতে হয়। সে জন্য নেতৃত্ব দিতে পারেন, সে রকম উপাচার্য নিয়োগ দিতে হয়।’
বলা যেতে পারে, আমি তখন প্রথমবার বুঝতে পেরেছি, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেন সব সময় দলীয় রাজনীতি করা শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এটি আকস্মিক ঘটনা নয়। সেটি একটি সুচিন্তিত কিন্তু বিপজ্জনক এবং ভুল সিদ্ধান্ত! একজন শিক্ষক যদি শিক্ষাবিদ হন, তাহলে তাঁর ভেতর নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি থাকবে না—সেটি মোটেও সত্যি নয়। তা ছাড়া এই দেশে দলীয় রাজনীতি করা শিক্ষক সব সময় আদর্শের জন্য রাজনীতি করেন, সেটিও সত্যি নয়। যিনি একসময় ‘জিয়া চেয়ার’ স্থাপনের প্রস্তাবক, সাদা দলের রাজনীতি করেছেন, তিনি সময়ের প্রয়োজনে নীল দলের রাজনীতি করে অবলীলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে পারেন। সে রকম উদাহরণ কি আমাদের সামনে নেই?
চার.
কাজেই আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকেরা যদি আদর্শবাদী হতেন, উপাচার্যদের স্বেচ্ছাচারী কিংবা একগুঁয়ে না হতে দিতেন, ভুল কিংবা অন্যায় করলে প্রতিবাদ করতেন, তাহলেও একটা আশা ছিল। কিন্তু সেগুলো হয় না। উপাচার্য যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তা-বিধাতা, তাই তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে ‘জি হুজুর’ করার একটি প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের ওপর নির্দয় আক্রমণ শুরু করেছিল, তখন একজন শিক্ষকও ছুটে গিয়ে পুলিশকে থামানোর চেষ্টা করেননি! ছাত্রছাত্রী এখন শিক্ষকদের শত্রুপক্ষ। আমাদের শিক্ষকেরা সব ধোয়া তুলসীপাতা এবং ছাত্রছাত্রীরা বেয়াদব এবং অশোভন (আচরণ করে)—আমি সেটা বিশ্বাস করি না। শিক্ষক হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের জন্য সম্মানবোধ থাকতে হবে; তাদের জন্য ভালোবাসা থাকতে হবে। সেটি এখন নেই। ভর্তি পরীক্ষার জন্য ছাত্রছাত্রীদের কী পরিমাণ কষ্ট করতে হয়, সেটি সবাই জানে। সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে সেটি চোখের পলকে দূর করে দেওয়া যায়। বহুকাল আগে একবার তার উদ্যোগ নিয়ে সেই সময়কার শিক্ষামন্ত্রী সব উপাচার্যকে ডেকেছিলেন। আমি সেখানে প্রস্তাবটি ব্যাখ্যা করেছিলাম এবং তখন আবিষ্কার করেছিলাম—আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভেতরে রয়েছে সর্বগ্রাসী লোভ! সেটি প্রকাশ্যে ঘোষণা করতেও তাঁরা সংকোচ অনুভব করেন না! সেই সভায় তাঁরা এককথায় ছাত্রছাত্রীদের জীবনকে সহজ করার সেই উদ্যোগ বাতিল করে দিয়েছিলেন!
এই মুহূর্তে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে খুবই জটিল একটি অবস্থা বিরাজ করছে। আমি এক মাস দেশের বাইরে ছিলাম বলে পত্রপত্রিকার খবরের বাইরে কিছু জানি না। খবরের বাইরেও খবর থাকে এবং আজকাল সামাজিক নেটওয়ার্কে বিষ উগরে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে। আমি সেগুলো জানি না। যখন একটি নিরীহ আন্দোলন বিপজ্জনক আন্দোলনে পাল্টে যাচ্ছে, আমি তখন প্লেনে বসে আছি। দেশে এসে প্রায় হঠাৎ করে জানতে পেরেছি, আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়টি ভালো নেই।
একদিকে ছাত্রছাত্রী, অন্যদিকে উপাচার্যের নেতৃত্বে সকল শিক্ষক। ছাত্রছাত্রীদের দাবি খুবই চাঁছাছোলা। এটাকে মোলায়েম করার কোনো উপায় নেই। যেহেতু নির্দয় পুলিশি হামলা করার লজ্জাটুকু কেটে গেছে, তাই যদি দ্বিতীয়বার সেটাকে প্রয়োগ করে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়, তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এর একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের কোনো উপায় নেই।
সরকারের নিয়োগ দেওয়া উপাচার্যকে প্রত্যাহার করা সরকারের জন্য খুবই অপমানজনক একটা ব্যাপার। তাই সরকার কখনোই সেটা করবে না। ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয়ের সাথে যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক আছেন, শুধু তা-ই নয়, দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ উপাচার্যরাও আছেন, কাজেই তাঁর নিজে থেকে পদত্যাগ করার প্রশ্নই আসে না।
মনে হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের অনির্দিষ্টকাল হাড়কাঁপানো শীতে অনশন করে খোলা রাস্তায় শুয়ে থাকতে হবে। কেউ তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না। যে ছাত্রজীবনটি তাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় হতে পারত, সেই সময়টি তাদের জন্য অপমান আর অবহেলার সময় হয়ে যাচ্ছে, সেই জন্য আমি তাদের কাছে ক্ষমা চাই।
ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয় আমার এই লেখা পড়বেন কি না, জানি না। যদি পড়েন তাঁকে বলব, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শেষ দিনটিতে আমি তাঁকে যে চিঠি লিখে এসেছিলাম, সেটি যেন আরেকবার পড়েন। সম্ভব হলে তাঁর আশপাশে থাকা শিক্ষকদেরও পড়তে দেন।
এখন যা ঘটছে, সেটি যে একদিন ঘটবে, আমি সেটি তিন বছর আগে তাঁকে জানিয়ে রেখেছিলাম। তিনি আমার কথায় বিশ্বাস করেননি।
লেখক: শিক্ষাবিদ
এখন রাত দুইটা বাজে। একটু আগে টেলিফোন বেজে উঠেছে। গভীর রাতে টেলিফোন বেজে উঠলে বুকটা ধক করে ওঠে, তাই টেলিফোনটা ধরেছি। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র ফোন করেছে। পত্রপত্রিকার খবর থেকে জানি, সেখানে ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করছে। মোটামুটি নিরীহ একটা আন্দোলন বিপজ্জনক আন্দোলনে মোড় নিয়েছে। ছাত্রটি ফোনে আমাকে জানাল, অনশন করা কয়েকজন ছাত্রকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। একজনের অবস্থা খুবই খারাপ। ডাক্তার বলেছেন, কিছু না খেলে ‘কোমায়’ চলে যেতে পারে। ফোন রেখে দেওয়ার আগে ভাঙা গলায় বলেছে, ‘স্যার, কিছু একটা করেন।’
আমি তখন থেকে চুপচাপ বসে আছি, কী করব? আমার কি কিছু করার আছে?
আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে আমি অনেকবার অনেক ধরনের আন্দোলন হতে দেখেছি। কাজেই আমি একটি আন্দোলনের ধাপগুলো জানি। প্রথম ধাপে যখন হলের মেয়েরা তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে উপাচার্যের কাছে গিয়েছে, সেটি সেখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। আমি খুব ভালো করে জানি, একটুখানি আন্তরিকতা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের কঠিন দাবিদাওয়াকে শান্ত করে দেওয়া যায়। কেউ একজন তাদের ভালো-মন্দ নিয়ে মাথা ঘামায়, তারা শুধু এটুকু নিশ্চয়তা চায়। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন যদি একটুখানি জনপ্রিয়তা পায়, তখন সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সেখানে ঢুকে পড়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেটাকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা যদি সতর্ক না থাকে, তখন নেতৃত্ব তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। আন্দোলন যদি থেমে না যায়, তখন সরকারি ছাত্রদের সংগঠন (এখানে ছাত্রলীগ) তাদের ওপর হামলা করে। প্রায় সব সময়ই সেটা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তাদের সলাপরামর্শে। তারপরও যদি আন্দোলন চলতে থাকে, তখন কর্তৃপক্ষকে পুলিশ ডাকতে হয়; পুলিশ এসে পেটানোর দায়িত্ব নেয়।
এই আন্দোলনে আমি এর প্রতিটি ধাপ ঘটতে দেখেছি। প্রচলিত প্রক্রিয়ার বাইরে যেটা হয়েছে, সেটা হচ্ছে পুলিশের অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতা। যত বড় পুলিশ বাহিনীই হোক, তারা ছাত্রছাত্রীদের গায়ে হাত তোলার আগে এক শবার চিন্তা করে। এখানে সেটা হয়নি। শটগান দিয়ে গুলি পর্যন্ত করা হয়েছে। বিষয়টি আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। পুলিশের চৌদ্দ পুরুষের সৌভাগ্য যে, সেই গুলিতে কেউ মারা যায়নি। বোঝাই যাচ্ছে, সিলেটের পুলিশ বাহিনীর তেজ এখনো কমেনি। তারা দুই শ থেকে তিন শ ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করে রেখেছে। যখন প্রয়োজন হবে, কোনো একজনের নাম ঢুকিয়ে তাকে শায়েস্তা করা যাবে! হয়রানি কত প্রকার ও কী কী—শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম বয়সী ছাত্রছাত্রীরা সেটা এবারে টের পাবে।
তবে একটি ব্যাপার আমি এখনো বুঝতে পারছি না। পুলিশের এই অবিশ্বাস্য আক্রমণ ঘটার কারণ হচ্ছে, উপাচার্য মহোদয়কে তালাবদ্ধ বিল্ডিং থেকে উদ্ধার করা। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের জন্য একটা ভবনে তালাবদ্ধ হয়ে আটকে পড়া এমন কোনো বড় ঘটনা নয়। একাডেমিক কাউন্সিল কিংবা সিন্ডিকেট মিটিং চলার সময় দাবি আদায়ের জন্য বাইরে থেকে তালা মেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকদের আটকে রাখার ঘটনা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়েই একাধিকবার ঘটেছে। তাঁরা তখন গল্পগুজব করে সময় কাটিয়েছেন, সোফায় শুয়ে রাত কাটিয়েছেন, গোপনে কিছু খাবার আনিয়ে ভাগাভাগি করে খেয়ে হাসি-তামাশা করেছেন। কিন্তু পুলিশ ডাকিয়ে ছাত্রদের গায়ে হাত তুলে মুক্ত হওয়ার জন্য কখনো ব্যস্ত হননি। এবার উপাচার্যকে উদ্ধার করার জন্য ছাত্রছাত্রীর ওপর একটি অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতা করা হলো। এর চেয়ে বড় অমানবিক কাজ কী হতে পারে; আমি জানি না। স্বাভাবিক নিয়মেই আন্দোলনটি এখন উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে রূপ নিয়েছে। তবে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এটা এমন কিছু বিচিত্র দাবি নয়। আমরা প্রায় নিয়মিতভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের পদত্যাগের দাবি শুনে আসছি।
ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে ছাত্রছাত্রীদের ক্যাম্পাস থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এবারেও সেই চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে যায়নি। এটিও নতুন একটি ঘটনা—তারা এখন কোথায় থাকে, কী খায়; আমি জানি না।
আন্দোলন যতক্ষণ পর্যন্ত স্লোগান, মিছিল, উত্তপ্ত বক্তৃতা এবং দেশাত্মবোধক গানের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে, সেটাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সেটি যদি শেষ পর্যায়ে চলে যায়, যখন ছাত্রছাত্রীরা আমরণ অনশন করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সেটি খুবই বিপজ্জনক। তাদের প্রচণ্ড ক্রোধ ও ক্ষোভ তখন একটা গভীর দুঃখবোধ এবং অভিমানে পাল্টে যায়। হঠাৎ করে তারা টের পায়, তারা আসলে একা, তাদের পাশে কেউ নেই। ‘আমরণ’ কথাটি থেকে ভয়ংকর কোনো কথা আমি জানি না। বড় মানুষেরা সেটাকে কৌশলী একটা শব্দ হিসেবে ব্যবহার করেন। কিন্তু এই বয়সী ছাত্রছাত্রীরা তাদের তীব্র আবেগের কারণে শব্দটাকে আক্ষরিক অর্থে ব্যবহার করে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলোর নামকরণ করা নিয়ে একবার বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। তখন আমাদের ছাত্রছাত্রীরা শহীদ মিনারে অনশন করে বিশ্ববিদ্যালয়টি খোলার ব্যবস্থা করেছিল। অভুক্ত ছাত্রছাত্রীদের দুর্বল শরীরে যখন খিঁচুনি হতে থাকে, সেই দৃশ্য সহ্য করার মতো নয়। (পরে তারা আমাকে তাদের অভিজ্ঞতার গল্প শুনিয়েছে। দিনরাত তারা বোধ-শক্তিহীনভাবে পড়ে আছে। অন্য কোনো অনুভূতি নেই। শুধু এক প্লেট খাবারের স্বপ্ন দেখছে! আমি তাদের সেই কষ্টের কথাগুলো কখনো ভুলতে পারি না।) যে কারণেই হোক, আমার এককালীন ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীরা আবার সেই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি চিন্তা করে আমি খুবই অশান্তি অনুভব করছি।
দুই.
প্রায় তিন বছর আগে অবসর নিয়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসার আগের মুহূর্তে আমি বর্তমান উপাচার্যকে তিন পৃষ্ঠার একটি লম্বা চিঠি লিখে এসেছিলাম। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে তাঁকে সেই চিঠিতে বেশ কয়েকটি উপদেশ দিয়েছিলাম। তিনি যদি আমার উপদেশগুলো শুনে সেভাবে কাজ করতেন, তাহলে আজকে বিশ্ববিদ্যালয়টি এ রকম বিপজ্জনক একটা জায়গায় পৌঁছাত না।
তিনি আমার উপদেশগুলো সহজভাবে নেবেন—আমি সেটা আশা করি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি করা শিক্ষকদের পুরস্কার হিসেবে উপাচার্য হিসেবে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। যদিও অনেক দিক দিয়েই শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় অনেক আধুনিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপক তাঁদের উন্নাসিকতার কারণে সেটা মেনে নেন না। কাজেই প্রান্তিক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার মতো একজন শিক্ষকের উপদেশ তাঁর ভালো লাগার কথা নয়।
কিছুদিন আগে আমার ওপর জঙ্গি হামলার বিচারের শুনানিতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আমাকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। আমি এক দিনের জন্য সিলেটে গিয়েছিলাম এবং বহুদিন পর ক্যাম্পাসে পা দিয়েছিলাম। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা রীতিমতো অপরাধ। তাই সবাই দূরে দূরে থাকলেও ছাত্রছাত্রীরা মন খুলে আমার সাথে কথা বলেছে। আমি বেশ দুঃখের সাথে আবিষ্কার করেছি, আমার পরিচিত শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রটি পাল্টে যাচ্ছে।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া বিশেষ হয় না (এখানে শুধু পরীক্ষা হয়)। কাজেই ভালো ছাত্রছাত্রীরা চেষ্টা-চরিত্র করে নিজেরা যেটুকু পারে শিখে নেয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈচিত্র্যময় পরিবেশে অন্য সবার সাথে সময় কাটিয়ে তাদের একধরনের মানসিক গঠন হয়; সেটার মূল্য কম নয়। সে জন্য আমি যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম, সব সময় তাদের সব রকম সংগঠন করে নানা ধরনের কাজকর্মে যুক্ত হতে উৎসাহ দিয়ে এসেছি। ছাত্রছাত্রীরা জানাল—এখন তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও বাধা-নিষেধ থাকে। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় আমাদের ছাত্রছাত্রীরা ক্যাম্পাসের রাস্তায় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও সবচেয়ে দীর্ঘ আলপনা এঁকেছিল। ছাত্রছাত্রীরা জানাল, এখন তারা রাস্তায় আলপনাও আঁকতে পারে না। তাদের দুঃখের কাহিনি শোনা ছাড়া আমার কিছু করার ছিল না। আমি শুধু তাদের ভেতরকার চাপা ক্ষোভটি অনুভব করেছি। সেই ক্ষোভ এখন বিস্ফোরণে রূপ নিয়েছে।
তিন.
কিছুদিন আগে লন্ডনের একটি ওয়েবিনারে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সেটি ছিল বাংলাদেশের শিক্ষা-সংক্রান্ত একটি ওয়েবিনার। আমি বক্তব্য দেওয়ার পর সঞ্চালক উইকিপিডিয়া থেকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভয়ংকর দুরবস্থার বর্ণনা পড়ে শোনালেন। তারপর এই ব্যাপারে আমার বক্তব্য জানতে চাইলেন। আমি বললাম, ‘আমি এই ব্যাপারটি খুব ভালো করে জানি এবং চাইলে সেটি সম্পর্কে বলতেও পারব। কিন্তু নীতিগতভাবে আমি দেশের বাইরের কোনো অনুষ্ঠানে দেশ সম্পর্কে খারাপ কিছু বলি না। কাজেই আমি এটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না। আপনি যদি সত্যিই জানতে চান, ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করলে বলতে পারি।’ সঞ্চালক বললেন, ‘তাহলে অন্তত এর সমাধান কী হতে পারে, সেটা বলেন।’ আমি বললাম, ‘সমাধান খুব কঠিন নয়। যেহেতু বাংলাদেশে উপাচার্যরা হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তা-বিধাতা, তাই রাজনীতি করা শিক্ষকদের নিয়োগ না দিয়ে খাঁটি শিক্ষাবিদদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেহারা পাল্টে যাবে।’
সেই ওয়েবিনারে আমাদের শিক্ষামন্ত্রীও ছিলেন। তিনি তাঁর বক্তব্য দেওয়ার সময় বললেন, ‘একজন উপাচার্যকে যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অনেক কাজ করতে হয়, তাই শুধু শিক্ষাবিদ সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। তাঁর ভেতর নেতৃত্ব দেওয়ার গুণ থাকতে হয়। সে জন্য নেতৃত্ব দিতে পারেন, সে রকম উপাচার্য নিয়োগ দিতে হয়।’
বলা যেতে পারে, আমি তখন প্রথমবার বুঝতে পেরেছি, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেন সব সময় দলীয় রাজনীতি করা শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এটি আকস্মিক ঘটনা নয়। সেটি একটি সুচিন্তিত কিন্তু বিপজ্জনক এবং ভুল সিদ্ধান্ত! একজন শিক্ষক যদি শিক্ষাবিদ হন, তাহলে তাঁর ভেতর নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি থাকবে না—সেটি মোটেও সত্যি নয়। তা ছাড়া এই দেশে দলীয় রাজনীতি করা শিক্ষক সব সময় আদর্শের জন্য রাজনীতি করেন, সেটিও সত্যি নয়। যিনি একসময় ‘জিয়া চেয়ার’ স্থাপনের প্রস্তাবক, সাদা দলের রাজনীতি করেছেন, তিনি সময়ের প্রয়োজনে নীল দলের রাজনীতি করে অবলীলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে পারেন। সে রকম উদাহরণ কি আমাদের সামনে নেই?
চার.
কাজেই আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকেরা যদি আদর্শবাদী হতেন, উপাচার্যদের স্বেচ্ছাচারী কিংবা একগুঁয়ে না হতে দিতেন, ভুল কিংবা অন্যায় করলে প্রতিবাদ করতেন, তাহলেও একটা আশা ছিল। কিন্তু সেগুলো হয় না। উপাচার্য যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তা-বিধাতা, তাই তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে ‘জি হুজুর’ করার একটি প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের ওপর নির্দয় আক্রমণ শুরু করেছিল, তখন একজন শিক্ষকও ছুটে গিয়ে পুলিশকে থামানোর চেষ্টা করেননি! ছাত্রছাত্রী এখন শিক্ষকদের শত্রুপক্ষ। আমাদের শিক্ষকেরা সব ধোয়া তুলসীপাতা এবং ছাত্রছাত্রীরা বেয়াদব এবং অশোভন (আচরণ করে)—আমি সেটা বিশ্বাস করি না। শিক্ষক হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের জন্য সম্মানবোধ থাকতে হবে; তাদের জন্য ভালোবাসা থাকতে হবে। সেটি এখন নেই। ভর্তি পরীক্ষার জন্য ছাত্রছাত্রীদের কী পরিমাণ কষ্ট করতে হয়, সেটি সবাই জানে। সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে সেটি চোখের পলকে দূর করে দেওয়া যায়। বহুকাল আগে একবার তার উদ্যোগ নিয়ে সেই সময়কার শিক্ষামন্ত্রী সব উপাচার্যকে ডেকেছিলেন। আমি সেখানে প্রস্তাবটি ব্যাখ্যা করেছিলাম এবং তখন আবিষ্কার করেছিলাম—আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভেতরে রয়েছে সর্বগ্রাসী লোভ! সেটি প্রকাশ্যে ঘোষণা করতেও তাঁরা সংকোচ অনুভব করেন না! সেই সভায় তাঁরা এককথায় ছাত্রছাত্রীদের জীবনকে সহজ করার সেই উদ্যোগ বাতিল করে দিয়েছিলেন!
এই মুহূর্তে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে খুবই জটিল একটি অবস্থা বিরাজ করছে। আমি এক মাস দেশের বাইরে ছিলাম বলে পত্রপত্রিকার খবরের বাইরে কিছু জানি না। খবরের বাইরেও খবর থাকে এবং আজকাল সামাজিক নেটওয়ার্কে বিষ উগরে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে। আমি সেগুলো জানি না। যখন একটি নিরীহ আন্দোলন বিপজ্জনক আন্দোলনে পাল্টে যাচ্ছে, আমি তখন প্লেনে বসে আছি। দেশে এসে প্রায় হঠাৎ করে জানতে পেরেছি, আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়টি ভালো নেই।
একদিকে ছাত্রছাত্রী, অন্যদিকে উপাচার্যের নেতৃত্বে সকল শিক্ষক। ছাত্রছাত্রীদের দাবি খুবই চাঁছাছোলা। এটাকে মোলায়েম করার কোনো উপায় নেই। যেহেতু নির্দয় পুলিশি হামলা করার লজ্জাটুকু কেটে গেছে, তাই যদি দ্বিতীয়বার সেটাকে প্রয়োগ করে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়, তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এর একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের কোনো উপায় নেই।
সরকারের নিয়োগ দেওয়া উপাচার্যকে প্রত্যাহার করা সরকারের জন্য খুবই অপমানজনক একটা ব্যাপার। তাই সরকার কখনোই সেটা করবে না। ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয়ের সাথে যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক আছেন, শুধু তা-ই নয়, দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ উপাচার্যরাও আছেন, কাজেই তাঁর নিজে থেকে পদত্যাগ করার প্রশ্নই আসে না।
মনে হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের অনির্দিষ্টকাল হাড়কাঁপানো শীতে অনশন করে খোলা রাস্তায় শুয়ে থাকতে হবে। কেউ তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না। যে ছাত্রজীবনটি তাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় হতে পারত, সেই সময়টি তাদের জন্য অপমান আর অবহেলার সময় হয়ে যাচ্ছে, সেই জন্য আমি তাদের কাছে ক্ষমা চাই।
ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয় আমার এই লেখা পড়বেন কি না, জানি না। যদি পড়েন তাঁকে বলব, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শেষ দিনটিতে আমি তাঁকে যে চিঠি লিখে এসেছিলাম, সেটি যেন আরেকবার পড়েন। সম্ভব হলে তাঁর আশপাশে থাকা শিক্ষকদেরও পড়তে দেন।
এখন যা ঘটছে, সেটি যে একদিন ঘটবে, আমি সেটি তিন বছর আগে তাঁকে জানিয়ে রেখেছিলাম। তিনি আমার কথায় বিশ্বাস করেননি।
লেখক: শিক্ষাবিদ
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
৩ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
৩ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
৩ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
৩ ঘণ্টা আগে