এস এম মাসুম বিল্লাহ
‘যাইবার কোনো জায়গা তো নাই রে. .
নাই আর কোন মান-সম্মান...
চন্দ্র-সূর্য যত বড়
আমার দুঃখ তার সমান...’
—শহীদুল্লাহ ফরায়জী/বারী সিদ্দিকী।
পরীমণিকে তৃতীয় দফা ‘রিমান্ডে’ নেওয়া হয়েছে। এই তৃতীয় দফা রিমান্ডের আইনি গ্রহণযোগ্যতা ও সাংবিধানিকতা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। একদিক দিয়ে দেখলে পরীমণির দুঃখ ‘চন্দ্র-সূর্যের সমান’। তাঁর মান-সম্মান নিয়েও চলছে টানাটানি।
কথাটা পাড়ার অজুহাত ওই মান-সম্মানের জায়গায়। তাঁর মান-সম্মানের ক্ষতি তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগপ্রসূত ক্ষতির চেয়েও বেশি। আমি আইনের ছাত্র। আইনের অ-আইনসুলভ প্রয়োগে ব্যথিত হই, ছাত্রদের সামনে সংবিধান ক্লাসে হাজির হওয়ার মনের জোর কমে। বইয়ে লেখা আইন আর প্রায়োগিক আইনের কোনো মিল পাই না। ছাত্রদের সামনে কথা হাতড়াই।
আমরা ওই ১৭৬৫ সালেই আছি। ওই বছর বাড়ি তল্লাশি করার আইনি পরিধি (পাঠক একটু ‘পান’ যুক্ত করার জন্য ‘পরী-ধি’ পড়তে পারেন) সংক্রান্ত মামলায় লর্ড ক্যামডেন তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি করেন, ‘কোনো আইন, আইন কিনা, তা নিরূপণে দেখতে হবে সেটা আইনি কেতাবে আছে কিনা। যদি থাকে, তবে তা আইন। আর যদি না থাকে, তবে তা আইন নয়।’
ইংল্যান্ডের এই মামলা আইনের বাজারে অ্যান্টিক ভার্সেস ক্যারিংটন (১৭৬৫) নামে নাজেল আছে। বাংলাদেশের আইনের তালেবে-এলেমরা তাঁদের সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক আইনের ক্লাসে ওই মামলা যত্ন করে জপ করেন। মার্কিন সংবিধানের চতুর্থ ও পঞ্চম সংশোধনীতে ক্যামডেন-দর্শনের প্রভাব আছে বলে অনেক পণ্ডিত নিবেদন করে থাকেন।
এবার দেখি আমাদের আইনে কী আছে। রাষ্ট্রের একটা সর্বোচ্চ মান-আইন থাকে। সেখানে যা লেখা থাকে, তাকে ‘মান-মন্দির’ বলা যায়। কারণ সংবিধানে বিধৃত কথাকে ইংরেজিতে বলে ‘এন-শ্রাইন’! পুরোনো আচারের লোকজন একে ‘শাসনতন্ত্র’ আর কলিকালের লোকজন একে ভালোবেসে ডাকেন ‘সংবিধান’ বলে। রক্ত, ঘাম ও অশ্রু দিয়ে ১৯৭২ সালে লেখা আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরও একটি সংবিধান রয়েছে। উক্ত সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে আমরা লিখেছি, ‘প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও মানব মর্যাদা এবং ব্যক্তিসত্তার প্রতি শ্রদ্ধা নিশ্চিত করা হবে।’
মানব মর্যাদা পরম সুন্দর একটি জিনিস। এগারোর ভাষা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, মানব মর্যাদা নিজেই যেমন একটা গুণ, তেমনি একটা রাষ্ট্রিক মূল্যবোধ। ভারতের নমস্য বিচারপতি কৃষ্ণা আয়ার ১৯৮০ সালে ‘প্রেম শংকর বনাম দিল্লি প্রশাসন’ মামলায় ‘মানব মর্যাদার নিশ্চয়তাকে ভারতের সাংবিধানিক সংস্কৃতির অংশ’ বলে মন্তব্য করেন। আমাদের ঐতিহ্যও এর আলাদা কিছু হওয়ার নয়। দুঃখজনকভাবে, মানব সত্তার মর্যাদা, মৌলিক অধিকার নামের নকশিকাঁথা আমরা ভালোভাবে বুনতে পারিনি।
এখন দেখি সংবিধানের ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদ কী বলতে চাইছে। সেখানে বলা আছে—আইন অনুযায়ী খাতির (ব্যবহার) পাওয়ার অধিকার সবার আছে। শাস্ত্রমতে, আইনও আইন, আইনের ব্যবহারটাও আইন। তাই এর ইংরেজিতে লেখা হয়েছে ‘ট্রিট’। আর আইনবিজ্ঞানের আরেক নাম ‘ব্যবহারশাস্ত্র’। পাকিস্তানিরা আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি। তাই আমরা স্বাধীন হয়ে নিজেদের বানানো সংবিধানে ভালো ব্যবহারকেও আইনের অংশ করেছি। এর অন্যথা হলে তা আমাদের ‘প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্ক্ষার’ (প্রস্তাবনা, সংবিধান) সঙ্গে যায় না।
একত্রিশ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী (in accordance with law) কথাটা দুবার বলা আছে। দুবার বলার অর্থ হলো আইনটিকে যেমন ভালো হতে হবে, আইনের ব্যবহারবিধিও ভালো হতে হবে। বিশেষ করে বলা আছে—আইনের বিধান ব্যতিরেকে মানুষের জীবন, স্বাধীনতা, শরীর, সুনাম ও সম্পত্তির জন্য হানিকর কোনো কাজ রাষ্ট্র করবে না। আগেই বলেছি, এই আইনকে সাংবিধানিক মানদণ্ডে পদ্ধতিগত ও মৌলিক মানে উত্তীর্ণ হতে হয়। মার্কিন মুলুকে এর নাম ফিফথ অ্যামেন্ডমেন্ট রাইট বা ডিউ প্রসেস ক্লজ। ব্রিটেনে পরিচয় ‘রুল অব ল’ বলে। আর ভারতে এটি জারি আছে আইনের প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি অনুসৃত হওয়ার অধিকার হিসেবে (procedure established by law—অনুচ্ছেদ ২১, ভারতীয় সংবিধান)।
আমাদের সংবিধানবিজ্ঞানের প্রধান পুরোহিত মাহমুদুল ইসলাম তাঁর ‘বাংলাদেশের সাংবিধানিক আইন’ (মল্লিক ব্রাদার্স, ২০১২) বইয়ে লিখেছেন, একত্রিশ নম্বরের আওতা ও পরিধি আমেরিকার ডিউ প্রসেস থেকেও ব্যাপক ও বেশি ইঙ্গিতপূর্ণ।
এর পর আমরা নজর দিই আমাদের সংবিধানের তেতাল্লিশ নম্বর অনুচ্ছেদে। সেখানে আমরা লিখেছি, জন নৈতিকতা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রশ্নে যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে একজন নাগরিক তার বাড়িতে প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক হতে সুরক্ষিত থাকবেন। জন নৈতিকতার কোনো সংজ্ঞা সেখানে নেই। তবে ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে গণিকাবৃত্তি ও জুয়া খেলাকে জন নৈতিকতা বিরোধী কাজের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা আছে। আর আরোগ্যের প্রয়োজনে বা আইন অনুমোদিত অন্য প্রয়োজনে মদ্য, মাদক পানীয় ও স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজ ব্যবহার করাকে জনস্বাস্থ্য বিরুদ্ধ কাজের উদাহরণ হিসেবে ১৮ অনুচ্ছেদে দেখানো হয়েছে। পশ্চিমা দার্শনিক নোম চমস্কি জন নৈতিকতা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি—এ ধরনের অজুহাতকে ‘পাওয়ারফুল সেমান্টিক টুলস’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
এমনিতেই আমাদের সমাজের মানুষ ‘মদ’ শব্দটাকেই ম্লেচ্ছ মনে করেন। কিন্তু যখন একে কেউ ‘শরাব’ বলেন, তখন তাতে তারা কাব্য খুঁজে পান। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ ‘বুক’ বললে নারীর ক্ষেত্রে সেটাকে ‘স্তন’ বোঝেন, দুধ বললেও নারীর ক্ষেত্রে তাঁরা ‘স্তন’-কেই বোঝেন। বহু নিরীহ শব্দকেও এই সমাজে ভাষিক সহিংসতার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি নারী হন তাহলে ঠেকায় কে?
পুলিশ কর্তৃক মদ উদ্ধারের খবর বা ভুল শব্দ প্রয়োগ তাই ‘রগরগে’ বিচারের (erotic justice) ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। ‘মিনিবার’ শব্দটাও এই সমাজ-মানসে সমান অবমাননাকর। এদিক দিয়ে ভাবলে বলা যায়, এহেন সমাজে জন-নৈতিকতার মতো কোনো দোদুল্যমান মতবাদকে মাপকাঠি ধরার কোনো সুযোগ নেই। যদি থাকেও, সেটাকে হতে হবে বিচারিক মন প্রয়োগ করে আরও সুনির্দিষ্ট, সুসংহত ও যুক্তিপূর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত।
তাহলে পরীমণির ঘরে যদি ‘মদ’ থেকে থাকে, এবং তিনি যদি অনুমোদনের ক্ষেত্রগুলো দেখাতে ব্যর্থ হন, তাঁর বিরুদ্ধে স্বাভাবিক আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে কিছুদিন আগে প্রভাবশালী এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌন আগ্রাসনের অভিযোগ এনে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা, ঘরে অবস্থানরত মা–বাবাহীন এক নারীর বাসায়, বিনা ওয়ারেন্টে সিভিল পোশাকে পরিচয় যথার্থভাবে না দিয়েই ঘরে ঢুকে পুলিশি (RAB) তল্লাশি করা এবং তাঁকে আটক করা—প্রতিষ্ঠিত গ্রেপ্তার সংক্রান্ত আইন সমর্থন করে না। ফৌজদারি আইনে (১৮৯৮) আছে, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে পরোয়ানা নিয়ে বা শর্ত সাপেক্ষে পরোয়ানা ছাড়া একজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা যাবে। কিন্তু আইনে যা নেই, তা হলো—
(১) সাদা পোশাকে একজনকে গ্রেপ্তার করতে যাওয়া;
(২) বাড়ি প্রবেশ করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানানো;
(৩) গৃহে প্রবেশের উদ্দেশ্য প্রকাশ করতে না চাওয়া;
(৪) ওয়ারেন্টসহ এবং ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তারের মধ্যে কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য পার্থক্য না করে হরহামেশা এর যত্র-তত্র ব্যবহার করা;
(৫) তল্লাশি চলাকালে বাড়ির সামনে থেকে গ্রেপ্তারের ঘটনা সরাসরি মিডিয়াতে প্রচার করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করে একটা ‘মিডিয়াক্র্যাসি’ তৈরি করা;
(৬) তল্লাশি শেষ হওয়ার আগেই জব্দ আলামতের মোবাইল ক্লিপ সাংবাদিকদের সরবরাহ করা;
(৭) ভিন্ন ব্যক্তির বাড়ি থেকে যৌনতা সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্র উদ্ধার করে সেগুলোকে একজন নারীসহ-অভিযুক্তের বাসা থেকে জব্দ দ্রব্যের সঙ্গে একাকার করে রেখে গণমাধ্যমে ডিসপ্লে (media parade) করতে দেওয়া;
(৮) পুলিশি হেফাজতে ২৪ ঘণ্টা রাখতে পারার যে আইনি সুবিধা আছে, তার সুযোগ নিয়ে খোদ রাজধানীতেই গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে কোনো রেকর্ডেড কারণ ছাড়াই থানা-হেফাজতে (RAB Headquarter) কড়ায়-গন্ডায় পূর্ণ করে ২৪ ঘণ্টা (বা তার কিছু কম–বেশি) রাখা।
আর যেটা সংবিধানে নেই তা হলো, সংশোধন ধাঁচের মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনকে (২০১৮) শাস্তি জর্জরিত ফৌজদারি আইন হিসেবে প্রণয়ন করে, তা বাস্তবায়ন করতে না পেরে বিনা বিচারে ক্রসফায়ারে মানুষ মেরে ফেলা।
তাহলে আইনে কী আছে, আর কী নেই—তা আপনারা জানলেন। যেহেতু ‘নেই’–এর তালিকা দীর্ঘ, এবং এর এমনকি মাত্র একটির সদুত্তরও যদি রাষ্ট্রের কাছে না থাকে, তাহলে পরীমণির গ্রেপ্তার আইনসম্মত হয়নি বলে প্রতীয়মান হয়। স্মরণ রাখা দরকার—পরীমণির বাসা তন্ন তন্ন (ransack) করাকে র্যাব ও মিডিয়ার ভাষায় ‘অভিযান’ (তল্লাশি নয়) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমাদের সংবিধানের জনকগণ তাঁদের কানুনি কল্পনায় ‘অভিযান’–এর ধারণাকে আনতেই পারেননি।
তাই লর্ড ক্যামডেন-এর থিওরিতে পুলিশ-প্রসূত এই ফৌজদারি আইন, আইন নয়। আগেই উল্লেখ করেছি, মানব-মর্যাদার অধিকার ও সুনামের অধিকার আমাদের সংবিধানে স্বীকৃত স্বতন্ত্র মৌলিক অধিকার। সে জন্যে ফৌজদারি আইনের গ্রেপ্তার–সংক্রান্ত বিধান দিয়ে এগুলোকে কেড়ে নেওয়া যায় না। বরং ওই গ্রেপ্তার পদ্ধতি মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ না হওয়ায় সংবিধানের ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পরিত্যাজ্য। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস সম্প্রতি এক মামলায় ওয়ারেন্ট ছাড়া বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রগুলোকে সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। আমাদের দেশেও এটা হওয়া প্রয়োজন। যেমন বিনা ওয়ারেন্টে বাড়ি তল্লাশির একটা গ্রহণযোগ্য ক্ষেত্র হলো জঙ্গি দমন অভিযান। হয়তো ক্ষেত্রগুলো কিছুটা সুনির্দিষ্ট করা আছেও, আমি গভীরভাবে খতিয়ে দেখে পড়ার সময় পাইনি।
এটা শুধু পরীর কারণে নয়, বরং ভবিষ্যতে যাতে এর ব্যবহার ‘ক্রসফায়ার’–এর ব্যবহারের মতো স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত না হয়, সে জন্যে করা দরকার। র্যাব কর্তৃক সংজ্ঞায়িত এবং পুরুষতান্ত্রিক ও ধর্মীয় মতবাদ প্রাধান্যময় সমাজে রাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী ক্ষমতা একজন নারী-শিল্পীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে হইহই রৈরবে—এটা সমাজে ভুল বার্তা দেবে। কেউই আমরা এর কুফল এড়াতে পারব না; সে আজ হোক বা কাল।
পরীকে আটকের দিন এক টিভি উপস্থাপক সরেজমিনে থাকা এক রিপোর্টারকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘পরীমণিকে (চারতলা থেকে) নামানো হবে কখন?’ জবাবে রিপোর্টার বলেন, ‘জানি না, তবে (হাবভাব দেখে বুঝতে পারছি) একটু পরই নামানো হবে।’ আসলেই তো। পরীকে আইনি ভাষায় সেদিন ‘গ্রেপ্তার’ করা হয়নি। তাঁকে নামিয়ে মারমার কাটকাট ভঙ্গিতে গাড়িতে ‘তুলে’ আনা হয়েছে। বলা বাহুল্য, বিভিন্ন মামলায় বিভিন্ন দেশের বিচারকেরা বলে রেখেছেন, গ্রেপ্তার যদি নির্দিষ্ট ধাপগুলো অনুসরণ না করে, তবে তা গ্রেপ্তার নয়। এটা পুলিশি কার্যক্রমের গোড়ায় আঘাত করে এবং পুরো বিচার প্রক্রিয়াকেই অর্থহীন করে ফেলে।
আমাদের আইনি সংস্কৃতিতে আরেক অদ্ভুত জিনিসের নাম ‘রিমান্ড’। সংবিধানে নেই, ফৌজদারি আইনে নেই, কিন্তু বিচারের হাটে রয়েছে এর সানন্দ উপস্থিতি। নাটকের অঙ্কের মতো পুলিশ আসামি ধরে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করে। পাঁচ-দশদিন ‘রিমান্ড’ চায়। ম্যাজিস্ট্রেট প্রায় ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে ‘পরী-মিতি’ বোধের পরিচয় না দিয়েই অব্যর্থভাবে প্রার্থিত সময়ের চেয়ে দু–একদিন কমিয়ে আসামিকে রিমান্ড দেন। আর গণমাধ্যমে রটে যায় আদালত ‘রিমান্ড’ মঞ্জুর করেছেন! কত মানুষকে যে রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ মেরে ফেলেছে বলে অভিযোগ রয়েছে, তার হিসাব নেই! অথচ উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছেন কীভাবে, কখন একজন অভিযুক্তকে রিমান্ডে নেওয়া যাবে (দেখুন, ব্লাস্ট মামলা, ২০১৬)। সরকার মানেনি। সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়ে আপিল করে দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল রিমান্ড অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে মানবাধিকার সুরক্ষার গাইডলাইনগুলোকে।
তো এভাবে চলছে। আচ্ছা, পরীমণিকে কি তাঁর আইনজীবী বা পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ? সেটাই তো হওয়ার কথা ছিল, নাকি? যে কর্মকর্তা তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন, তিনি কি রাগী, নাকি তিনি সুন্দর করে কথার জাল বুনে পরীকে ফাঁদে ফেলতে পারেন? এভাবে প্রাপ্ত সাক্ষ্যের সাক্ষ্যগত মূল্য কী? সে সত্য কি কাননের বিষাক্ত বৃক্ষের ফল (fruit of the poisonous tree), নাকি টিভি-স্ক্রলে ঘন ঘন মিটির মিটির উঠতে-নামতে থাকা ব্রেকিং নিউজ? ব্যক্তিজীবনের ‘অনৈতিকতা’ খারাপ, কিন্তু সেটা রোধে রাষ্ট্রের ‘পরহেজগারি’ সমানভাবে খারাপ। এর পরিধি ঠিক না করতে পারলে সুশাসন ও গণতন্ত্রের জন্য খারাপ পরিণাম ডেকে আনে, এবং আনবে। ফৌজদারি আইন ও সাংবিধানিক আইন বৈরী কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। অধ্যাপক রিদওয়ানুল হক তাঁর একটা লেখায় যথার্থই বলেছেন (বিলিয়া, ২০০৭), ‘আমাদের সাংবিধানিক ফৌজদারি আইন (constitutional criminal law) চর্চা করার দরকার পড়েছে।’
পরীর সংগ্রামী জীবন ও অভিনয় দক্ষতায় আমি কিছু ক্ষেত্রে মুগ্ধ হয়েছি। বিশেষ করে তাঁর নৃত্য-শৈলী এবং ‘স্বপ্নজাল’ ও ‘বিশ্বসুন্দরী’ ছবিতে অভিনয় দক্ষতা আমাকে অবাক করেছে। তিনি অসাধারণ সুন্দরী এবং সম্ভাবনাময়ী এক প্রাণপ্রাচুর্যময় শিল্পী। তাঁর ‘প্রীতিলতা’ দেখতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তাঁর এবং তাঁর কাজের প্রতি আমার মুগ্ধতা প্রকাশ করছি। এবং আশা করছি এই আইনি লড়াইটাও তিনি জিতবেন।
ড. এস এম মাসুম বিল্লাহ: শিক্ষক, তুলনামূলক সাংবিধানিক আইন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
‘যাইবার কোনো জায়গা তো নাই রে. .
নাই আর কোন মান-সম্মান...
চন্দ্র-সূর্য যত বড়
আমার দুঃখ তার সমান...’
—শহীদুল্লাহ ফরায়জী/বারী সিদ্দিকী।
পরীমণিকে তৃতীয় দফা ‘রিমান্ডে’ নেওয়া হয়েছে। এই তৃতীয় দফা রিমান্ডের আইনি গ্রহণযোগ্যতা ও সাংবিধানিকতা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। একদিক দিয়ে দেখলে পরীমণির দুঃখ ‘চন্দ্র-সূর্যের সমান’। তাঁর মান-সম্মান নিয়েও চলছে টানাটানি।
কথাটা পাড়ার অজুহাত ওই মান-সম্মানের জায়গায়। তাঁর মান-সম্মানের ক্ষতি তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগপ্রসূত ক্ষতির চেয়েও বেশি। আমি আইনের ছাত্র। আইনের অ-আইনসুলভ প্রয়োগে ব্যথিত হই, ছাত্রদের সামনে সংবিধান ক্লাসে হাজির হওয়ার মনের জোর কমে। বইয়ে লেখা আইন আর প্রায়োগিক আইনের কোনো মিল পাই না। ছাত্রদের সামনে কথা হাতড়াই।
আমরা ওই ১৭৬৫ সালেই আছি। ওই বছর বাড়ি তল্লাশি করার আইনি পরিধি (পাঠক একটু ‘পান’ যুক্ত করার জন্য ‘পরী-ধি’ পড়তে পারেন) সংক্রান্ত মামলায় লর্ড ক্যামডেন তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি করেন, ‘কোনো আইন, আইন কিনা, তা নিরূপণে দেখতে হবে সেটা আইনি কেতাবে আছে কিনা। যদি থাকে, তবে তা আইন। আর যদি না থাকে, তবে তা আইন নয়।’
ইংল্যান্ডের এই মামলা আইনের বাজারে অ্যান্টিক ভার্সেস ক্যারিংটন (১৭৬৫) নামে নাজেল আছে। বাংলাদেশের আইনের তালেবে-এলেমরা তাঁদের সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক আইনের ক্লাসে ওই মামলা যত্ন করে জপ করেন। মার্কিন সংবিধানের চতুর্থ ও পঞ্চম সংশোধনীতে ক্যামডেন-দর্শনের প্রভাব আছে বলে অনেক পণ্ডিত নিবেদন করে থাকেন।
এবার দেখি আমাদের আইনে কী আছে। রাষ্ট্রের একটা সর্বোচ্চ মান-আইন থাকে। সেখানে যা লেখা থাকে, তাকে ‘মান-মন্দির’ বলা যায়। কারণ সংবিধানে বিধৃত কথাকে ইংরেজিতে বলে ‘এন-শ্রাইন’! পুরোনো আচারের লোকজন একে ‘শাসনতন্ত্র’ আর কলিকালের লোকজন একে ভালোবেসে ডাকেন ‘সংবিধান’ বলে। রক্ত, ঘাম ও অশ্রু দিয়ে ১৯৭২ সালে লেখা আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরও একটি সংবিধান রয়েছে। উক্ত সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে আমরা লিখেছি, ‘প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও মানব মর্যাদা এবং ব্যক্তিসত্তার প্রতি শ্রদ্ধা নিশ্চিত করা হবে।’
মানব মর্যাদা পরম সুন্দর একটি জিনিস। এগারোর ভাষা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, মানব মর্যাদা নিজেই যেমন একটা গুণ, তেমনি একটা রাষ্ট্রিক মূল্যবোধ। ভারতের নমস্য বিচারপতি কৃষ্ণা আয়ার ১৯৮০ সালে ‘প্রেম শংকর বনাম দিল্লি প্রশাসন’ মামলায় ‘মানব মর্যাদার নিশ্চয়তাকে ভারতের সাংবিধানিক সংস্কৃতির অংশ’ বলে মন্তব্য করেন। আমাদের ঐতিহ্যও এর আলাদা কিছু হওয়ার নয়। দুঃখজনকভাবে, মানব সত্তার মর্যাদা, মৌলিক অধিকার নামের নকশিকাঁথা আমরা ভালোভাবে বুনতে পারিনি।
এখন দেখি সংবিধানের ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদ কী বলতে চাইছে। সেখানে বলা আছে—আইন অনুযায়ী খাতির (ব্যবহার) পাওয়ার অধিকার সবার আছে। শাস্ত্রমতে, আইনও আইন, আইনের ব্যবহারটাও আইন। তাই এর ইংরেজিতে লেখা হয়েছে ‘ট্রিট’। আর আইনবিজ্ঞানের আরেক নাম ‘ব্যবহারশাস্ত্র’। পাকিস্তানিরা আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি। তাই আমরা স্বাধীন হয়ে নিজেদের বানানো সংবিধানে ভালো ব্যবহারকেও আইনের অংশ করেছি। এর অন্যথা হলে তা আমাদের ‘প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্ক্ষার’ (প্রস্তাবনা, সংবিধান) সঙ্গে যায় না।
একত্রিশ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী (in accordance with law) কথাটা দুবার বলা আছে। দুবার বলার অর্থ হলো আইনটিকে যেমন ভালো হতে হবে, আইনের ব্যবহারবিধিও ভালো হতে হবে। বিশেষ করে বলা আছে—আইনের বিধান ব্যতিরেকে মানুষের জীবন, স্বাধীনতা, শরীর, সুনাম ও সম্পত্তির জন্য হানিকর কোনো কাজ রাষ্ট্র করবে না। আগেই বলেছি, এই আইনকে সাংবিধানিক মানদণ্ডে পদ্ধতিগত ও মৌলিক মানে উত্তীর্ণ হতে হয়। মার্কিন মুলুকে এর নাম ফিফথ অ্যামেন্ডমেন্ট রাইট বা ডিউ প্রসেস ক্লজ। ব্রিটেনে পরিচয় ‘রুল অব ল’ বলে। আর ভারতে এটি জারি আছে আইনের প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি অনুসৃত হওয়ার অধিকার হিসেবে (procedure established by law—অনুচ্ছেদ ২১, ভারতীয় সংবিধান)।
আমাদের সংবিধানবিজ্ঞানের প্রধান পুরোহিত মাহমুদুল ইসলাম তাঁর ‘বাংলাদেশের সাংবিধানিক আইন’ (মল্লিক ব্রাদার্স, ২০১২) বইয়ে লিখেছেন, একত্রিশ নম্বরের আওতা ও পরিধি আমেরিকার ডিউ প্রসেস থেকেও ব্যাপক ও বেশি ইঙ্গিতপূর্ণ।
এর পর আমরা নজর দিই আমাদের সংবিধানের তেতাল্লিশ নম্বর অনুচ্ছেদে। সেখানে আমরা লিখেছি, জন নৈতিকতা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রশ্নে যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে একজন নাগরিক তার বাড়িতে প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক হতে সুরক্ষিত থাকবেন। জন নৈতিকতার কোনো সংজ্ঞা সেখানে নেই। তবে ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে গণিকাবৃত্তি ও জুয়া খেলাকে জন নৈতিকতা বিরোধী কাজের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা আছে। আর আরোগ্যের প্রয়োজনে বা আইন অনুমোদিত অন্য প্রয়োজনে মদ্য, মাদক পানীয় ও স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজ ব্যবহার করাকে জনস্বাস্থ্য বিরুদ্ধ কাজের উদাহরণ হিসেবে ১৮ অনুচ্ছেদে দেখানো হয়েছে। পশ্চিমা দার্শনিক নোম চমস্কি জন নৈতিকতা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি—এ ধরনের অজুহাতকে ‘পাওয়ারফুল সেমান্টিক টুলস’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
এমনিতেই আমাদের সমাজের মানুষ ‘মদ’ শব্দটাকেই ম্লেচ্ছ মনে করেন। কিন্তু যখন একে কেউ ‘শরাব’ বলেন, তখন তাতে তারা কাব্য খুঁজে পান। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ ‘বুক’ বললে নারীর ক্ষেত্রে সেটাকে ‘স্তন’ বোঝেন, দুধ বললেও নারীর ক্ষেত্রে তাঁরা ‘স্তন’-কেই বোঝেন। বহু নিরীহ শব্দকেও এই সমাজে ভাষিক সহিংসতার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি নারী হন তাহলে ঠেকায় কে?
পুলিশ কর্তৃক মদ উদ্ধারের খবর বা ভুল শব্দ প্রয়োগ তাই ‘রগরগে’ বিচারের (erotic justice) ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। ‘মিনিবার’ শব্দটাও এই সমাজ-মানসে সমান অবমাননাকর। এদিক দিয়ে ভাবলে বলা যায়, এহেন সমাজে জন-নৈতিকতার মতো কোনো দোদুল্যমান মতবাদকে মাপকাঠি ধরার কোনো সুযোগ নেই। যদি থাকেও, সেটাকে হতে হবে বিচারিক মন প্রয়োগ করে আরও সুনির্দিষ্ট, সুসংহত ও যুক্তিপূর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত।
তাহলে পরীমণির ঘরে যদি ‘মদ’ থেকে থাকে, এবং তিনি যদি অনুমোদনের ক্ষেত্রগুলো দেখাতে ব্যর্থ হন, তাঁর বিরুদ্ধে স্বাভাবিক আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে কিছুদিন আগে প্রভাবশালী এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌন আগ্রাসনের অভিযোগ এনে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা, ঘরে অবস্থানরত মা–বাবাহীন এক নারীর বাসায়, বিনা ওয়ারেন্টে সিভিল পোশাকে পরিচয় যথার্থভাবে না দিয়েই ঘরে ঢুকে পুলিশি (RAB) তল্লাশি করা এবং তাঁকে আটক করা—প্রতিষ্ঠিত গ্রেপ্তার সংক্রান্ত আইন সমর্থন করে না। ফৌজদারি আইনে (১৮৯৮) আছে, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে পরোয়ানা নিয়ে বা শর্ত সাপেক্ষে পরোয়ানা ছাড়া একজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা যাবে। কিন্তু আইনে যা নেই, তা হলো—
(১) সাদা পোশাকে একজনকে গ্রেপ্তার করতে যাওয়া;
(২) বাড়ি প্রবেশ করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানানো;
(৩) গৃহে প্রবেশের উদ্দেশ্য প্রকাশ করতে না চাওয়া;
(৪) ওয়ারেন্টসহ এবং ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তারের মধ্যে কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য পার্থক্য না করে হরহামেশা এর যত্র-তত্র ব্যবহার করা;
(৫) তল্লাশি চলাকালে বাড়ির সামনে থেকে গ্রেপ্তারের ঘটনা সরাসরি মিডিয়াতে প্রচার করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করে একটা ‘মিডিয়াক্র্যাসি’ তৈরি করা;
(৬) তল্লাশি শেষ হওয়ার আগেই জব্দ আলামতের মোবাইল ক্লিপ সাংবাদিকদের সরবরাহ করা;
(৭) ভিন্ন ব্যক্তির বাড়ি থেকে যৌনতা সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্র উদ্ধার করে সেগুলোকে একজন নারীসহ-অভিযুক্তের বাসা থেকে জব্দ দ্রব্যের সঙ্গে একাকার করে রেখে গণমাধ্যমে ডিসপ্লে (media parade) করতে দেওয়া;
(৮) পুলিশি হেফাজতে ২৪ ঘণ্টা রাখতে পারার যে আইনি সুবিধা আছে, তার সুযোগ নিয়ে খোদ রাজধানীতেই গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে কোনো রেকর্ডেড কারণ ছাড়াই থানা-হেফাজতে (RAB Headquarter) কড়ায়-গন্ডায় পূর্ণ করে ২৪ ঘণ্টা (বা তার কিছু কম–বেশি) রাখা।
আর যেটা সংবিধানে নেই তা হলো, সংশোধন ধাঁচের মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনকে (২০১৮) শাস্তি জর্জরিত ফৌজদারি আইন হিসেবে প্রণয়ন করে, তা বাস্তবায়ন করতে না পেরে বিনা বিচারে ক্রসফায়ারে মানুষ মেরে ফেলা।
তাহলে আইনে কী আছে, আর কী নেই—তা আপনারা জানলেন। যেহেতু ‘নেই’–এর তালিকা দীর্ঘ, এবং এর এমনকি মাত্র একটির সদুত্তরও যদি রাষ্ট্রের কাছে না থাকে, তাহলে পরীমণির গ্রেপ্তার আইনসম্মত হয়নি বলে প্রতীয়মান হয়। স্মরণ রাখা দরকার—পরীমণির বাসা তন্ন তন্ন (ransack) করাকে র্যাব ও মিডিয়ার ভাষায় ‘অভিযান’ (তল্লাশি নয়) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমাদের সংবিধানের জনকগণ তাঁদের কানুনি কল্পনায় ‘অভিযান’–এর ধারণাকে আনতেই পারেননি।
তাই লর্ড ক্যামডেন-এর থিওরিতে পুলিশ-প্রসূত এই ফৌজদারি আইন, আইন নয়। আগেই উল্লেখ করেছি, মানব-মর্যাদার অধিকার ও সুনামের অধিকার আমাদের সংবিধানে স্বীকৃত স্বতন্ত্র মৌলিক অধিকার। সে জন্যে ফৌজদারি আইনের গ্রেপ্তার–সংক্রান্ত বিধান দিয়ে এগুলোকে কেড়ে নেওয়া যায় না। বরং ওই গ্রেপ্তার পদ্ধতি মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ না হওয়ায় সংবিধানের ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পরিত্যাজ্য। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস সম্প্রতি এক মামলায় ওয়ারেন্ট ছাড়া বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রগুলোকে সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। আমাদের দেশেও এটা হওয়া প্রয়োজন। যেমন বিনা ওয়ারেন্টে বাড়ি তল্লাশির একটা গ্রহণযোগ্য ক্ষেত্র হলো জঙ্গি দমন অভিযান। হয়তো ক্ষেত্রগুলো কিছুটা সুনির্দিষ্ট করা আছেও, আমি গভীরভাবে খতিয়ে দেখে পড়ার সময় পাইনি।
এটা শুধু পরীর কারণে নয়, বরং ভবিষ্যতে যাতে এর ব্যবহার ‘ক্রসফায়ার’–এর ব্যবহারের মতো স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত না হয়, সে জন্যে করা দরকার। র্যাব কর্তৃক সংজ্ঞায়িত এবং পুরুষতান্ত্রিক ও ধর্মীয় মতবাদ প্রাধান্যময় সমাজে রাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী ক্ষমতা একজন নারী-শিল্পীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে হইহই রৈরবে—এটা সমাজে ভুল বার্তা দেবে। কেউই আমরা এর কুফল এড়াতে পারব না; সে আজ হোক বা কাল।
পরীকে আটকের দিন এক টিভি উপস্থাপক সরেজমিনে থাকা এক রিপোর্টারকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘পরীমণিকে (চারতলা থেকে) নামানো হবে কখন?’ জবাবে রিপোর্টার বলেন, ‘জানি না, তবে (হাবভাব দেখে বুঝতে পারছি) একটু পরই নামানো হবে।’ আসলেই তো। পরীকে আইনি ভাষায় সেদিন ‘গ্রেপ্তার’ করা হয়নি। তাঁকে নামিয়ে মারমার কাটকাট ভঙ্গিতে গাড়িতে ‘তুলে’ আনা হয়েছে। বলা বাহুল্য, বিভিন্ন মামলায় বিভিন্ন দেশের বিচারকেরা বলে রেখেছেন, গ্রেপ্তার যদি নির্দিষ্ট ধাপগুলো অনুসরণ না করে, তবে তা গ্রেপ্তার নয়। এটা পুলিশি কার্যক্রমের গোড়ায় আঘাত করে এবং পুরো বিচার প্রক্রিয়াকেই অর্থহীন করে ফেলে।
আমাদের আইনি সংস্কৃতিতে আরেক অদ্ভুত জিনিসের নাম ‘রিমান্ড’। সংবিধানে নেই, ফৌজদারি আইনে নেই, কিন্তু বিচারের হাটে রয়েছে এর সানন্দ উপস্থিতি। নাটকের অঙ্কের মতো পুলিশ আসামি ধরে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করে। পাঁচ-দশদিন ‘রিমান্ড’ চায়। ম্যাজিস্ট্রেট প্রায় ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে ‘পরী-মিতি’ বোধের পরিচয় না দিয়েই অব্যর্থভাবে প্রার্থিত সময়ের চেয়ে দু–একদিন কমিয়ে আসামিকে রিমান্ড দেন। আর গণমাধ্যমে রটে যায় আদালত ‘রিমান্ড’ মঞ্জুর করেছেন! কত মানুষকে যে রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ মেরে ফেলেছে বলে অভিযোগ রয়েছে, তার হিসাব নেই! অথচ উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছেন কীভাবে, কখন একজন অভিযুক্তকে রিমান্ডে নেওয়া যাবে (দেখুন, ব্লাস্ট মামলা, ২০১৬)। সরকার মানেনি। সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়ে আপিল করে দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল রিমান্ড অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে মানবাধিকার সুরক্ষার গাইডলাইনগুলোকে।
তো এভাবে চলছে। আচ্ছা, পরীমণিকে কি তাঁর আইনজীবী বা পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ? সেটাই তো হওয়ার কথা ছিল, নাকি? যে কর্মকর্তা তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন, তিনি কি রাগী, নাকি তিনি সুন্দর করে কথার জাল বুনে পরীকে ফাঁদে ফেলতে পারেন? এভাবে প্রাপ্ত সাক্ষ্যের সাক্ষ্যগত মূল্য কী? সে সত্য কি কাননের বিষাক্ত বৃক্ষের ফল (fruit of the poisonous tree), নাকি টিভি-স্ক্রলে ঘন ঘন মিটির মিটির উঠতে-নামতে থাকা ব্রেকিং নিউজ? ব্যক্তিজীবনের ‘অনৈতিকতা’ খারাপ, কিন্তু সেটা রোধে রাষ্ট্রের ‘পরহেজগারি’ সমানভাবে খারাপ। এর পরিধি ঠিক না করতে পারলে সুশাসন ও গণতন্ত্রের জন্য খারাপ পরিণাম ডেকে আনে, এবং আনবে। ফৌজদারি আইন ও সাংবিধানিক আইন বৈরী কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। অধ্যাপক রিদওয়ানুল হক তাঁর একটা লেখায় যথার্থই বলেছেন (বিলিয়া, ২০০৭), ‘আমাদের সাংবিধানিক ফৌজদারি আইন (constitutional criminal law) চর্চা করার দরকার পড়েছে।’
পরীর সংগ্রামী জীবন ও অভিনয় দক্ষতায় আমি কিছু ক্ষেত্রে মুগ্ধ হয়েছি। বিশেষ করে তাঁর নৃত্য-শৈলী এবং ‘স্বপ্নজাল’ ও ‘বিশ্বসুন্দরী’ ছবিতে অভিনয় দক্ষতা আমাকে অবাক করেছে। তিনি অসাধারণ সুন্দরী এবং সম্ভাবনাময়ী এক প্রাণপ্রাচুর্যময় শিল্পী। তাঁর ‘প্রীতিলতা’ দেখতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তাঁর এবং তাঁর কাজের প্রতি আমার মুগ্ধতা প্রকাশ করছি। এবং আশা করছি এই আইনি লড়াইটাও তিনি জিতবেন।
ড. এস এম মাসুম বিল্লাহ: শিক্ষক, তুলনামূলক সাংবিধানিক আইন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
১৬ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
১৭ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
১৭ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
১৭ ঘণ্টা আগে