বিভুরঞ্জন সরকার
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমেই সাধারণত জনমতের প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু আমাদের দেশে যাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলেন, তাঁদের পেছনে যে জনসমর্থন আছে, তার প্রমাণ কী?
বিরোধী দলের কথা দিয়েই শুরু করা যাক। বড় কোনো রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ এখন আর হয় না। পল্টন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কিংবা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জনসভা হয় না কত বছর হলো, তা এক গবেষণার বিষয় হতে পারে। ‘এক বিরাট জনসভা’ বক্তৃতা করবেন-জাতীয় মাইকিং শুনেও এখন আর কান ঝালাপালা হয় না। তাই বলে রাজনৈতিক নেতাদের কথা বলা বা বক্তৃতা করা বন্ধ আছে, সেটা মনে করা ঠিক হবে না। পৃথিবী এখন ছোট হয়ে এসেছে। তাই রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ আর বড় হয় কী করে? অবশ্য বিরোধী দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, সরকার রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করতে দেয় না। কথা বলতে দেয় না। বাক্স্বাধীনতা সরকার কেড়ে নিয়েছে। কারণ, সরকার শুধু প্রশংসা শুনতে চায়, সমালোচনা নয়।
বিরোধী দলের এই অভিযোগ পুরো সত্যও নয়, আবার মিথ্যাও নয়। বিরোধী দলকে সভা করতে দেয় না শুনলে মনে হয় সরকারি দল কিংবা সরকার-সমর্থকদের জনসভা করার অনুমতি দেওয়া হয়। সরকারি দল বা সরকার-সমর্থকেরাও আজকাল খুব বড় জনসভা করছে না। আবার সরকার যদি কথা বলার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েই থাকে তাহলে বিরোধীদের যেসব বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, সেগুলো কি মুখনিঃসৃত নয়? ওগুলো কি ইশারা ভাষায় বলা হয়?
না, তাঁরা মুখেই বলেন, তবে ছোট এবং ঘরোয়া সমাবেশে। ঘরের বাইরে যেসব সমাবেশ হয়, তাতেও জনসমাগম খুব বেশি হয় না। ছোট সমাবেশে বড় বড় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন আমাদের নেতারা। তাঁরা বলার সময় বাড়তি কথা বলে বা বাড়িয়ে বলতে বলতে এমন অবস্থা তৈরি করেছেন যে, মানুষ সেগুলো এক কান দিয়ে শোনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেন। মনে দাগ কাটে না, মরমে পৌঁছে না। বলাউল্লাহ বলে, শোনাউল্লাহ শোনে।
বিরোধীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে সরকার ক্ষমতায় আছে, সেই সরকার জনগণের আস্থাভাজন নয়। জনগণের কাছ থেকে ক্ষমতার দায়িত্ব তাঁরা পাননি। যদি তর্কের খাতিরে এটা ধরে নেওয়া হয় যে, বর্তমান সরকার অবাধ ভোটের রায়ে নয়, বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন আসে, যাঁরা এসব বলছেন, তাঁরা যে বিপুল জনপ্রিয় বা ব্যাপক জনসমর্থনপুষ্ট, সেটা বোঝা যাচ্ছে কীভাবে? তাঁদের ডাকে কি মানুষ সাড়া দিচ্ছে? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমেই সাধারণত জনমতের প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু আমাদের দেশে যাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলেন, তাঁদের পেছনে যে জনসমর্থন আছে, তার প্রমাণ কী?
অন্যদের কথা বাদ দিয়ে ড. কামাল হোসেনের কথাই বলা যাক। তিনি দেশের একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ঢোকেন। ১৯৭০ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেওয়া আসনে, উপনির্বাচনে। ১৯৭৩ সালেও তা-ই। এরপর আর কোনো নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেননি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে নিজেই একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তাঁর দল গণফোরাম মূলধারার প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু হয়নি। কেউ কেউ মনে করেন, কামাল হোসেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্যতা রাখেন, কিন্তু বাংলাদেশে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়াও তাঁর জন্য কঠিন। কারণ, আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা এবং ভোটারদের ভোট দেওয়ার প্রবণতা বা ধরন কিছুটা বিচিত্র। যোগ্য মানুষকে ভোট দেওয়ার কথা সবাই বলেন, কিন্তু ভোট দেওয়ার সময় প্রার্থীর যোগ্যতা বিবেচনা না করে ভোট দেন মার্কা দেখে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন, অথচ ভোট দেওয়ার সময় একজন চিহ্নিত দুর্নীতিবাজকে বেছে নিতে দ্বিধা করেন না। সৎ মানুষ সাধারণত ভোটে জেতেন না।
কামাল হোসেন (তাঁর মতো আরও অনেক নেতা আছেন) জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েও কিসের জোরে নিজেকে জাতির পক্ষে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলেন?
জনসমর্থন না থাকলে সরকার গঠন করা যায় না, সেটা নিন্দনীয়। কিন্তু জনসমর্থনহীন হয়ে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দেওয়া যায় এবং সরকারের সমালোচনা করা যায়। বিষয়টি একটু স্ববিরোধী নয় কি? অবশ্য রাজনীতি বিষয়টিই নানা বিরোধিতাপূর্ণ বিষয়ে ঠাসা। যেমন আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে যেটা অন্যায্য মনে করা হয়, বিএনপির জন্য তা ন্যায্য। জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ প্রক্রিয়া প্রায় অভিন্ন। তাঁরা কেউ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছাননি। কিন্তু জিয়াকে অনেকেই স্বৈরাচারী বলতে চান না, আবার এরশাদ হয়ে আছেন স্বৈরাচারের প্রতীক।
এবার আসা যাক মূল আলোচনায়। গত ২৯ অক্টোবর একটি ছোট রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিনিধি সম্মেলনে ড. কামাল হোসেন বক্তৃতায় দেশের অবস্থা বর্ণনা করে বলেছেন, ‘মানুষ উদ্বিগ্ন। এ অবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে। আর পরিবর্তন আনার একমাত্র উপায় হলো, জনগণের ঐক্য। মানুষের মধ্যে ঐক্য হয়ে আছে। এখন তা আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। মাঠে নামলেই ঐক্যের শক্তি কাজ করবে। বাড়িতে আর বসে থাকা যাবে না। রাজপথ দখল করতে হবে। রাজপথে নেমে দেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’
যাঁরা এই বক্তৃতা শুনেছেন বা পত্রিকায় পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বলবেন যে কামাল হোসেন ঠিক কথাই বলেছেন। তাঁর মতো বড় মাপের মানুষের কথা তো ফেলনা হতে পারে না। তিনি যা বলেন, তা খবর হয়। সবার কথা কি আর খবর হয়?
ড. কামালের বক্তব্য একটু ব্যাখ্যা করা যাক। পরিবর্তন আনার জন্য মানুষের মধ্যে ঐক্য হয়ে আছে, সেটা তিনি কীভাবে বুঝলেন? জনমত জরিপ করেছেন? নাকি মানুষ তাঁর কাছে দরখাস্ত দিয়ে এ ব্যাপারে আবেদন জানিয়েছে? নাকি এটা একান্তই তাঁর কথা? নিশ্চয়ই দেশের সব মানুষ সরকারের ওপর তুষ্ট নয়। পৃথিবীর কোনো দেশেই কোনো সরকার সব মানুষের মনের মতো হয় না। হোক সে সরকার নির্বাচিত, কিংবা ক্ষমতা জবরদখলকারী। সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে মানুষ থাকেই। বাংলাদেশের সমাজ বেশি বিভক্ত। নানাভাবে, নানা ঘটনায় এই বিভক্তির প্রকাশ দেখা যায়। তাই মানুষ মাঠে নামলেই একটি পরিবর্তন আসবে, সেটা জোর দিয়ে বলা যায় কি?
ড. কামাল হোসেন বলেছেন, রাজপথ দখল করতে হবে। বাড়িতে আর বসে থাকা যাবে না। প্রশ্ন হলো, তিনি যখন জানেন যে আর ঘরে বসে থাকা যাবে না, রাজপথ দখল করতে হবে। তাহলে তিনি নিজে ঘরে বসে আছেন কেন? কেউ কি তাঁকে ঘরের বের হতে বাধা দিয়েছে? যদি তিনি বাধা পেয়ে থাকেন, তাহলে যে সমাবেশে তিনি বক্তৃতা করলেন, সেখানে গেলেন কীভাবে? এভাবে অস্পষ্ট ও লক্ষ্যহীন কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়; কিন্তু কিছু অর্জন করা যায় না। কামাল হোসেন এবং তাঁর মতো আরও কোনো কোনো নেতার সম্ভাবনা ছিল বড় কিছু করার। কিন্তু প্রয়োজনের সময় যেভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো দরকার, তাঁরা সেভাবে দাঁড়াননি। শেখ মুজিবের জীবন ও সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিলে তাঁরা ঝুঁকি নিতেন। যাঁরা ঝুঁকি এড়িয়ে নেতা হতে চান, মানুষ তাঁদের ডাকে সাড়া দেয় না, এড়িয়ে চলে।
প্রসঙ্গত, আর একজন বিখ্যাত মানুষের কথা না বললেই নয়। তিনি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং গরিব-দরদি চিকিৎসক। তিনি সরাসরি রাজনীতি করেন না। কিন্তু পুরোদস্তুর রাজনৈতিক নেতার মতো কথা বলতে ভালোবাসেন। বিভিন্ন সময় নানা বিষয়ে গণকের মতো ভবিষ্যদ্বাণী করেন, যার একটাও ফলে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বদান্যতায় তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মতো একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে নয়। আওয়ামী লীগের পক্ষে সবাইকে থাকতেই হবে, এটা হতে পারে না। রাজনৈতিক বিশ্বাসটা অনেকটা ধর্মবিশ্বাসের মতো। যার যার, তার তার। কাজেই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বললে দোষের কিছু নেই। তবে তিনি যা বলেন তা যথার্থ কি না, সেটা নিশ্চয়ই বিবেচনা করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে রাজপথ দখল করতে পারলে এক বছরের মধ্যে এই সরকার চলে যাবে।’
আসলে কি তাই? এই মুহূর্তে রাজপথ দখল করলে যদি এক বছরের মধ্যে সরকারের চলে যাওয়া নিশ্চিত হয়, তাহলে জাফরুল্লাহ চৌধুরীরা সেই চেষ্টা করছেন না কেন? আর রাজপথ দখলের পরও সরকারের চলে যেতে এক বছর সময় লাগবে কেন? ঢাল তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দারদের হাতে রাজনীতি যেন জিম্মি হয়ে পড়েছে।
সেই পুরোনো কৌতুকটি মনে পড়ছে। এক ব্যক্তি পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন, মন চায় পাহাড়টা তুইলা একটা আছাড় মারি? পাশ থেকে একজন শুনতে পেয়ে জানতে চান, তা আছাড়টা মারছেন না কেন?
শক্তিতে কুলায় না জাদু! জবাব দিলেন প্রথমজন।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা ।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমেই সাধারণত জনমতের প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু আমাদের দেশে যাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলেন, তাঁদের পেছনে যে জনসমর্থন আছে, তার প্রমাণ কী?
বিরোধী দলের কথা দিয়েই শুরু করা যাক। বড় কোনো রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ এখন আর হয় না। পল্টন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কিংবা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জনসভা হয় না কত বছর হলো, তা এক গবেষণার বিষয় হতে পারে। ‘এক বিরাট জনসভা’ বক্তৃতা করবেন-জাতীয় মাইকিং শুনেও এখন আর কান ঝালাপালা হয় না। তাই বলে রাজনৈতিক নেতাদের কথা বলা বা বক্তৃতা করা বন্ধ আছে, সেটা মনে করা ঠিক হবে না। পৃথিবী এখন ছোট হয়ে এসেছে। তাই রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ আর বড় হয় কী করে? অবশ্য বিরোধী দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, সরকার রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করতে দেয় না। কথা বলতে দেয় না। বাক্স্বাধীনতা সরকার কেড়ে নিয়েছে। কারণ, সরকার শুধু প্রশংসা শুনতে চায়, সমালোচনা নয়।
বিরোধী দলের এই অভিযোগ পুরো সত্যও নয়, আবার মিথ্যাও নয়। বিরোধী দলকে সভা করতে দেয় না শুনলে মনে হয় সরকারি দল কিংবা সরকার-সমর্থকদের জনসভা করার অনুমতি দেওয়া হয়। সরকারি দল বা সরকার-সমর্থকেরাও আজকাল খুব বড় জনসভা করছে না। আবার সরকার যদি কথা বলার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েই থাকে তাহলে বিরোধীদের যেসব বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, সেগুলো কি মুখনিঃসৃত নয়? ওগুলো কি ইশারা ভাষায় বলা হয়?
না, তাঁরা মুখেই বলেন, তবে ছোট এবং ঘরোয়া সমাবেশে। ঘরের বাইরে যেসব সমাবেশ হয়, তাতেও জনসমাগম খুব বেশি হয় না। ছোট সমাবেশে বড় বড় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন আমাদের নেতারা। তাঁরা বলার সময় বাড়তি কথা বলে বা বাড়িয়ে বলতে বলতে এমন অবস্থা তৈরি করেছেন যে, মানুষ সেগুলো এক কান দিয়ে শোনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেন। মনে দাগ কাটে না, মরমে পৌঁছে না। বলাউল্লাহ বলে, শোনাউল্লাহ শোনে।
বিরোধীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে সরকার ক্ষমতায় আছে, সেই সরকার জনগণের আস্থাভাজন নয়। জনগণের কাছ থেকে ক্ষমতার দায়িত্ব তাঁরা পাননি। যদি তর্কের খাতিরে এটা ধরে নেওয়া হয় যে, বর্তমান সরকার অবাধ ভোটের রায়ে নয়, বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন আসে, যাঁরা এসব বলছেন, তাঁরা যে বিপুল জনপ্রিয় বা ব্যাপক জনসমর্থনপুষ্ট, সেটা বোঝা যাচ্ছে কীভাবে? তাঁদের ডাকে কি মানুষ সাড়া দিচ্ছে? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমেই সাধারণত জনমতের প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু আমাদের দেশে যাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলেন, তাঁদের পেছনে যে জনসমর্থন আছে, তার প্রমাণ কী?
অন্যদের কথা বাদ দিয়ে ড. কামাল হোসেনের কথাই বলা যাক। তিনি দেশের একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ঢোকেন। ১৯৭০ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেওয়া আসনে, উপনির্বাচনে। ১৯৭৩ সালেও তা-ই। এরপর আর কোনো নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেননি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে নিজেই একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তাঁর দল গণফোরাম মূলধারার প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু হয়নি। কেউ কেউ মনে করেন, কামাল হোসেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্যতা রাখেন, কিন্তু বাংলাদেশে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়াও তাঁর জন্য কঠিন। কারণ, আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা এবং ভোটারদের ভোট দেওয়ার প্রবণতা বা ধরন কিছুটা বিচিত্র। যোগ্য মানুষকে ভোট দেওয়ার কথা সবাই বলেন, কিন্তু ভোট দেওয়ার সময় প্রার্থীর যোগ্যতা বিবেচনা না করে ভোট দেন মার্কা দেখে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন, অথচ ভোট দেওয়ার সময় একজন চিহ্নিত দুর্নীতিবাজকে বেছে নিতে দ্বিধা করেন না। সৎ মানুষ সাধারণত ভোটে জেতেন না।
কামাল হোসেন (তাঁর মতো আরও অনেক নেতা আছেন) জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েও কিসের জোরে নিজেকে জাতির পক্ষে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলেন?
জনসমর্থন না থাকলে সরকার গঠন করা যায় না, সেটা নিন্দনীয়। কিন্তু জনসমর্থনহীন হয়ে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দেওয়া যায় এবং সরকারের সমালোচনা করা যায়। বিষয়টি একটু স্ববিরোধী নয় কি? অবশ্য রাজনীতি বিষয়টিই নানা বিরোধিতাপূর্ণ বিষয়ে ঠাসা। যেমন আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে যেটা অন্যায্য মনে করা হয়, বিএনপির জন্য তা ন্যায্য। জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ প্রক্রিয়া প্রায় অভিন্ন। তাঁরা কেউ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছাননি। কিন্তু জিয়াকে অনেকেই স্বৈরাচারী বলতে চান না, আবার এরশাদ হয়ে আছেন স্বৈরাচারের প্রতীক।
এবার আসা যাক মূল আলোচনায়। গত ২৯ অক্টোবর একটি ছোট রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিনিধি সম্মেলনে ড. কামাল হোসেন বক্তৃতায় দেশের অবস্থা বর্ণনা করে বলেছেন, ‘মানুষ উদ্বিগ্ন। এ অবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে। আর পরিবর্তন আনার একমাত্র উপায় হলো, জনগণের ঐক্য। মানুষের মধ্যে ঐক্য হয়ে আছে। এখন তা আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। মাঠে নামলেই ঐক্যের শক্তি কাজ করবে। বাড়িতে আর বসে থাকা যাবে না। রাজপথ দখল করতে হবে। রাজপথে নেমে দেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’
যাঁরা এই বক্তৃতা শুনেছেন বা পত্রিকায় পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বলবেন যে কামাল হোসেন ঠিক কথাই বলেছেন। তাঁর মতো বড় মাপের মানুষের কথা তো ফেলনা হতে পারে না। তিনি যা বলেন, তা খবর হয়। সবার কথা কি আর খবর হয়?
ড. কামালের বক্তব্য একটু ব্যাখ্যা করা যাক। পরিবর্তন আনার জন্য মানুষের মধ্যে ঐক্য হয়ে আছে, সেটা তিনি কীভাবে বুঝলেন? জনমত জরিপ করেছেন? নাকি মানুষ তাঁর কাছে দরখাস্ত দিয়ে এ ব্যাপারে আবেদন জানিয়েছে? নাকি এটা একান্তই তাঁর কথা? নিশ্চয়ই দেশের সব মানুষ সরকারের ওপর তুষ্ট নয়। পৃথিবীর কোনো দেশেই কোনো সরকার সব মানুষের মনের মতো হয় না। হোক সে সরকার নির্বাচিত, কিংবা ক্ষমতা জবরদখলকারী। সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে মানুষ থাকেই। বাংলাদেশের সমাজ বেশি বিভক্ত। নানাভাবে, নানা ঘটনায় এই বিভক্তির প্রকাশ দেখা যায়। তাই মানুষ মাঠে নামলেই একটি পরিবর্তন আসবে, সেটা জোর দিয়ে বলা যায় কি?
ড. কামাল হোসেন বলেছেন, রাজপথ দখল করতে হবে। বাড়িতে আর বসে থাকা যাবে না। প্রশ্ন হলো, তিনি যখন জানেন যে আর ঘরে বসে থাকা যাবে না, রাজপথ দখল করতে হবে। তাহলে তিনি নিজে ঘরে বসে আছেন কেন? কেউ কি তাঁকে ঘরের বের হতে বাধা দিয়েছে? যদি তিনি বাধা পেয়ে থাকেন, তাহলে যে সমাবেশে তিনি বক্তৃতা করলেন, সেখানে গেলেন কীভাবে? এভাবে অস্পষ্ট ও লক্ষ্যহীন কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়; কিন্তু কিছু অর্জন করা যায় না। কামাল হোসেন এবং তাঁর মতো আরও কোনো কোনো নেতার সম্ভাবনা ছিল বড় কিছু করার। কিন্তু প্রয়োজনের সময় যেভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো দরকার, তাঁরা সেভাবে দাঁড়াননি। শেখ মুজিবের জীবন ও সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিলে তাঁরা ঝুঁকি নিতেন। যাঁরা ঝুঁকি এড়িয়ে নেতা হতে চান, মানুষ তাঁদের ডাকে সাড়া দেয় না, এড়িয়ে চলে।
প্রসঙ্গত, আর একজন বিখ্যাত মানুষের কথা না বললেই নয়। তিনি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং গরিব-দরদি চিকিৎসক। তিনি সরাসরি রাজনীতি করেন না। কিন্তু পুরোদস্তুর রাজনৈতিক নেতার মতো কথা বলতে ভালোবাসেন। বিভিন্ন সময় নানা বিষয়ে গণকের মতো ভবিষ্যদ্বাণী করেন, যার একটাও ফলে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বদান্যতায় তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মতো একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে নয়। আওয়ামী লীগের পক্ষে সবাইকে থাকতেই হবে, এটা হতে পারে না। রাজনৈতিক বিশ্বাসটা অনেকটা ধর্মবিশ্বাসের মতো। যার যার, তার তার। কাজেই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বললে দোষের কিছু নেই। তবে তিনি যা বলেন তা যথার্থ কি না, সেটা নিশ্চয়ই বিবেচনা করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে রাজপথ দখল করতে পারলে এক বছরের মধ্যে এই সরকার চলে যাবে।’
আসলে কি তাই? এই মুহূর্তে রাজপথ দখল করলে যদি এক বছরের মধ্যে সরকারের চলে যাওয়া নিশ্চিত হয়, তাহলে জাফরুল্লাহ চৌধুরীরা সেই চেষ্টা করছেন না কেন? আর রাজপথ দখলের পরও সরকারের চলে যেতে এক বছর সময় লাগবে কেন? ঢাল তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দারদের হাতে রাজনীতি যেন জিম্মি হয়ে পড়েছে।
সেই পুরোনো কৌতুকটি মনে পড়ছে। এক ব্যক্তি পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন, মন চায় পাহাড়টা তুইলা একটা আছাড় মারি? পাশ থেকে একজন শুনতে পেয়ে জানতে চান, তা আছাড়টা মারছেন না কেন?
শক্তিতে কুলায় না জাদু! জবাব দিলেন প্রথমজন।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা ।
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
৬ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
৭ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
৭ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
৭ ঘণ্টা আগে