বিজন সাহা
এরই মধ্যে ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু বায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরির খোঁজ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে আগেও কথা হয়েছে। তবে এই প্রথম এদের বিভিন্ন দলিল রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে এল। যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার স্টেট সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড সেটা স্বীকারও করেছেন। এখানে বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল অস্ত্র তৈরির পরীক্ষা হতো বলে রাশিয়া ও চীন অভিযোগ করছে। যুক্তরাষ্ট্র আপাতত সেটা স্বীকার করছে না। কিন্তু জর্জিয়ায় অনেকের অকস্মাৎ মৃত্যু, দাগিস্তানে বিরল প্রাণীদের দল বেঁধে মৃত্যু—এসব পরোক্ষভাবে প্রমাণ করে যে, ওসব ল্যাবরেটরিতে এমন কিছু জীবাণু তৈরি হতো, যা পাখির মাধ্যমে ছড়ানো যায়। ইদানীং পাওয়া কিছু তথ্য বলছে ইউক্রেন তুরস্কের কাছে এমন কিছু ড্রোন অর্ডার দিতে চেয়েছিল, যা ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত স্প্রে ছড়াতে পারে।
উল্লেখ্য, ইউক্রেন, জর্জিয়া, কাজাখস্তানসহ অন্যান্য এক্স-সোভিয়েত রিপাবলিকগুলোয় এমন অনেক ল্যাবরেটরি আছে, যা মার্কিন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পেন্টাগনের অর্থ সহায়তায় চালিত। ইউক্রেনসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠিত হয় খুব সম্ভব ২০০৫ সালে তৎকালীন সিনেটর বারাক ওবামার অংশগ্রহণে। পরে প্রেসিডেন্ট ওবামা যুক্তরাষ্ট্র বা পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে এ ধরনের ল্যাবরেটরি স্থাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এটাও পরোক্ষভাবে প্রমাণ করে যে, এসব ল্যাবরেটরিতে এমন সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হতো, যা নিরাপদ ছিল না। রাশিয়া ও চীনের চারদিকে বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটির পাশাপাশি এ ধরনের ল্যাবরেটরির উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, আজ হোক, আর কাল হোক এই সংঘাত ছিল অবশ্যম্ভাবী। তবে তখন সেটা হতো আরও কঠিন যুদ্ধ।
আজ যারা রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তাঁরা যদি একইভাবে ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন; ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আমেরিকার আগ্রাসনের বিপক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতেন; দেশে দেশে রং-বেরঙের বিপ্লবের বিরুদ্ধে কথা বলতেন; পৃথিবী আজ এই মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারে এসে দাঁড়াত না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সাম্প্রতিক বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, হান্টার বাইডেন এসব ল্যাবরেটরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যখন ইউক্রেনে এসব ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়, তখন সে দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন মার্কিন নাগরিক উলিয়ানা সুপ্রুম, যাঁর পিতামহ স্তেপান বান্দেরার সহযোগী ছিলেন।
উল্লেখ্য, বিদেশি নাগরিকের মন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে ইউক্রেনে সাংবিধানিক বাধানিষেধ থাকার পরও সুপ্রুম কিন্তু নিয়োগ পেয়েছিলেন। এটা আবার প্রমাণ করে যে, ইউক্রেনের আসল শাসক কারা। বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে হান্টার বাইডেন আলোচনায় আসেন। তাঁর ল্যাপটপ থেকে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। তখন মার্কিন সংবাদমাধ্যম একে রাশিয়ার চক্রান্ত বলে উড়িয়ে দেয়। তবে সাম্প্রতিককালে তারা স্বীকার করেছে, ল্যাপটপের ঘটনায় রাশিয়া জড়িত ছিল না। কিছু কিছু নথি প্রমাণ করে যে, জো বাইডেন শুধু হান্টারের পিতাই নন, বিজনেস পার্টনারও বটে। অন্তত তিনি ছেলের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেতেন। তাই সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পাশাপাশি যে বাইডেন ফ্যামিলির স্বার্থও জড়িত—এটা বলা অপেক্ষা রাখে না। এ ছাড়া অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন, ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড—এদের শিকড় ইউক্রেনের ওদেসায়। এই দুই পরিবারই কয়েক প্রজন্ম আগে জারের রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র যায় ভাগ্যের সন্ধানে। তাই এদের মধ্যেও যে অন্ধ রুশ বিরোধিতা নেই, সেটাই-বা কে জানে?
বাচ্চারা যখন ছোট ছিল, তখন একটা জিনিস খেয়াল করতাম। অনেক সময় ওরা অপেক্ষা করত ছোট ভাই বা বোন কখন আঘাত পেয়ে কাঁদবে, তারপর ওকে কোলে নিয়ে সান্ত্বনা দেবে। যদিও চাইলে আগেই ওরা বাচ্চাটা যাতে আঘাত না পায়, সেটা করতে পারত, যা সাধারণত বড়রা করে। মনে হয় প্রথমত কিউরিওসিটি থেকে—দেখি কী হয় পড়ে কি পড়ে না। আবার যদি আগে থেকেই ব্যবস্থা নিত, তাহলে বাহবা পাওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু ক্রন্দনরত বাচ্চাকে সান্ত্বনা দিয়ে বাবা-মার কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া যায়। আজ রাশিয়া যদি ইউক্রেনের দনবাসে তাণ্ডব চালানোর পর সেখানে আসত, হয়তো এতটা সমালোচনার মুখে পড়ত না। বরং অনেকের কাছ থেকে বাহবা পেত। যেমন হয়েছে সিরিয়ায়। কিন্তু আমরা কি এ জন্যে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষের জীবন বলিদান করতে প্রস্তুত? মনে হয় তাই। আমরা আমাদের কাজের যুক্তি খুঁজি কোনো ঘটনা ঘটার পর, কেন ঘটল সেটা প্রায়ই বিবেচনায় না এনে।
মানুষের চরিত্রই এমন যে, কেউ বিপদে পড়লে, সে তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে না। কিন্তু যখন সেই বিপদগ্রস্ত মানুষ মারা যাবে, তখন তার প্রতি সমবেদনার অন্ত থাকবে না। কিন্তু সেই একই লোক যদি জীবন বাঁচাতে অন্যায় কিছু করে, তখন সবাই মিলে তাকে অপরাধী সাজিয়ে ছাড়বে। আর এটা সে করে সব সময় শুধু খণ্ডচিত্র বিবেচনায় আনে বলে। যেকোনো বিষয়ে কম-বেশি নিরপেক্ষ ও সঠিক সিদ্ধান্তে আসার জন্য দরকার পূর্ণ চিত্র বিবেচনা করা। বর্তমান পৃথিবী এত বেশি স্বার্থান্ধ যে, সে কাউকে পূর্ণ চিত্র দেখতে শেখায় না। সবাই দেখায় শুধু সেই চিত্রটাই, অনেক সময় ফেইক চিত্র, যেটা তার স্বার্থ উদ্ধার করবে। এখন সত্য খোঁজা হয় না। যে ভাষ্য স্বার্থ উদ্ধার করতে সাহায্য করে, সেটাকেই ছলে-বলে-কৌশলে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সব রকম চেষ্টা করা হয়। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে তাই প্রতিষ্ঠিত অনেক আইন-কানুন আজ কাজ করে না। অন্যদিকে নতুন বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নতুন আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও সামাজিক চুক্তি এখনো তৈরি হয়নি। এর ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।
দনবাসের সংকট ছড়াল যে কারণে
অনেককেই বলতে শুনি দনবাসে যেহেতু যুদ্ধ চলছে, তাহলে রুশ আক্রমণ এখানে সীমাবদ্ধ রাখলেই তো হতো। এখানে হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের আগে সমস্ত ইউরোপ পদানত করে। আর এসব দেশ প্রায় বিনা প্রতিরোধে জার্মানির অধীনতা মেনে নেয়। ফলে সেসব দেশে পারতপক্ষে ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম হয়। এসব দেশের সৈন্যরা জার্মান সৈন্যের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করতে। পরাজিত জার্মান বাহিনী যখন পিছু হটতে শুরু করে, তখন প্রশ্ন আসে সোভিয়েত সীমান্ত ত্যাগের পর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হবে কি হবে না। যদি সেটা না হতো বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদের সমর্থনকারী সরকার ক্ষমতায় থাকত। এমনকি কয়েক বছরের মধ্যেই জার্মানি নতুন করে শক্তি সংগ্রহ করে যুদ্ধ শুরু করত। তাই সে সময় ইউরোপকে ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মুক্ত করার বিকল্প ছিল না। আর যেহেতু প্রায় প্রতিটি দেশেই যেটুকু প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা হয়েছিল সেসব দেশের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন সেসব এলাকা মুক্ত করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে গড়ে উঠেছিল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এখানে শুধু গায়ের জোর ছিল না, ছিল অবজেকটিভ রিয়্যালিটিও।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, জেনারেল ফ্রাঙ্কো ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত স্পেন শাসন করেছেন। হিটলার ও মুসোলিনির মতো না হলেও তিনি এদের চেয়ে খুব বেশি দূরে ছিলেন না। ফ্যাসিবাদমুক্ত হওয়ার কারণেই ১৯৪৫ থেকে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ইউরোপ যুদ্ধ দেখেনি। সেই একই কারণে ইউক্রেন থেকে ফ্যাসিবাদের উচ্ছেদ আজ যুগের দাবি। তা না করলে অচিরেই নতুন করে যুদ্ধ শুরু হবে, আর তা হবে আরও ভয়ংকর। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান এটাই বলার চেষ্টা করে যে, এই যুদ্ধের পেছনে ভারতের হাত আছে, আর দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরাই এ জন্যে দায়ী। ফলে একাত্তরে তারা নির্বিচারে হিন্দু নিধন করে। সঙ্গে ছিল আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীরা। এমনকি এখন যে জামায়াত-হেফাজতসহ পাকিস্তানপন্থী বিভিন্ন দল হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করে, সেটা তখনকার রাগ থেকেও। একইভাবে যদি ইউক্রেন থেকে ফ্যাসিবাদ সমূলে উৎপাটন না করা হয়, তাহলে সেখানকার রুশদের সেই একই রকম বিপদের মধ্যে রাখা হবে।
কারণ, এসব ফ্যাসিবাদী দল প্রথম সুযোগেই আক্রমণ করবে স্থানীয় রুশদের, আর রুশপন্থী ইউক্রেনীয়দের ওপর। এরই মধ্যে সেখানে অনেকেই ডাক দিচ্ছে রুশ হত্যার, বিশেষ করে রুশ শিশু হত্যার, যাতে করে উত্তরসূরিরা পিতামাতা হত্যার প্রতিশোধ নিতে না পারে। মনে করিয়ে দিতে চাই যে,১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে, রাজাকার-আলবদর নয়। শেখ মুজিবের ডাকে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র সমর্পণ করে, রাজাকাররা নয়। একাত্তরের বিজয়ের পরে প্রয়োজন ছিল রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা চালিয়ে যাওয়া, দেশকে আক্ষরিক অর্থেই রাজাকারমুক্ত করা। তখন সেটা হয়নি বলেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হয়েছে, তখন সেটা হয়নি বলেই বিভিন্ন সময় বাংলাদেশকে নতুন করে পাকিস্তানের জুতা পরতে হয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের আরেকটা দিক ছিল—পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যুদ্ধের শুরুতেই অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছিল—কী হবে এসব কেন্দ্রের। চেরনোবিলের স্মৃতি এখনো অনেকের মনেই ভেসে ওঠে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষার জন্য যথেষ্ট যত্ন করেই তৈরি করা হয়েছিল। এগুলো গড়ে (১) ৩০ কিলোপাসকেল শক্তির শকওয়েভের চাপ সহ্য করতে পারে। এই চাপে বিমান দুমড়ে-মুচড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যায়; (২) ২০ টন ওজনের প্লেন ৭২০ কিমি/ঘণ্টা বেগে এর ওপর পড়লেও এগুলো ঠিক দাঁড়িয়ে থাকবে; (৩) ৫৬ মি/সেকেন্ড বেগের ঝড় সইতে পারে এগুলো; (৪) বন্যায় টিকে থাকতে পারে; (৫) রিখটার স্কেলের ৮ মাত্রার ভূমিকম্পেও দাঁড়িয়ে থাকে। তবে চেরনোবিলের ঘটনা প্রমাণ করে যে, ভেতর থেকে সেখানে দুর্ঘটনা ঘটানো অসম্ভব কিছু নয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু রাখতে হয়। একটা নির্দিষ্ট সময়ের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করলে সেখানে এমন অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে, যখন দুর্ঘটনা এড়ানো কঠিন। ইউক্রেন সেই চেষ্টা করেছিল চেরনোবিলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে। যদিও রুশ সৈন্যরা প্রথমে জেনারেটরের সাহায্যে, পরে বেলারুশ থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে সে সমস্যার সমাধান করে। ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র জাপারোঝিয়ায় তারা প্রভোকেশন করেছিল। যদিও রুশ সৈন্যদের সময়োপযোগী হস্তক্ষেপে সেটা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসে। আসলে উগ্রবাদীদের হাতে যেকোনো অস্ত্রই মানবতার জন্য হুমকিস্বরূপ। সেই প্রমাণ তালেবান, আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট নিকট অতীতে বারবার দিয়েছে।
রুশোফোবিয়া: শুনব নাকি শুনব না
যুদ্ধ শুরুর পর রুশোফোবিয়া অসম্ভব রকম বেড়ে গেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, পোল্যান্ডের এক মন্ত্রী শিকার করেছেন—রুশোফোবিয়া এখন পশ্চিমা বিশ্বের মেইন স্ট্রিম আইডিয়া। আর এটা শুধু যারা রাশিয়ার নাগরিক তাদের সাথেই ঘটছে না, যারা যুগ যুগ ধরে ইউরোপে বা যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্ব নিয়ে বাস করছে, তারাও আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকায় অধ্যয়নরত শত শত রুশ ছাত্রছাত্রীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দস্তইয়েভস্কি, চাইকোভস্কি—মানে রুশ সাহিত্য, রুশ মিউজিক আজ পশ্চিমা বিশ্বে নিষিদ্ধ। ভালেরি গিওর্গিয়েভ, আন্না নিত্রেপকাসহ অনেক বিশ্ববরেণ্য শিল্পী, যারা ওখানে কাজ করতেন বা রেগুলার প্রোগ্রাম করতেন, তাঁদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। তাঁদের বলা হচ্ছে—এই আক্রমণের বিরোধিতা করতে। কিন্তু এঁরা তো জানেন, দনবাসের মানুষের কষ্টের কথা। সমস্ত খেলাধুলায় এদের অংশগ্রহণ বাতিল করা হয়েছে। শত শত রুশ ড্রাইভার আটকা পড়েছেন পোল্যান্ড-বেলারুশ সীমান্তে। এখন বাল্টিক দেশগুলো রাশিয়া ও বেলারুশের ট্রাক ও অন্যান্য মালবাহী গাড়ি আটকে দিচ্ছে।
এটা আসলে রাশিয়াকে ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা বই কিছু নয়। কোনো কোনো হাসপাতাল রুশ রোগীদের সেবা দিতে অস্বীকার করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কোনো কোনো ক্যানসার রিসার্চ সেন্টার রুশ রোগীদের স্যাম্পল টেস্ট না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ এরাই নিজেদের মানবতার ধারক ও বাহক বলে ভাবে। অনেকে রুশদের কাছে বাসা ভাড়া দিচ্ছে না বা যারা অনেক দিন বাসা ভাড়া করে আছে, তাদের উঠে যেতে বলছে। এটা অনেকটা আমাদের সব দেশে ধর্ম দেখে বাসা ভাড়া দেওয়া বা না দেওয়ার মত। স্কুলের বাচ্চাদের শিক্ষক ও সহপাঠীরা মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছে। তাদের রুশবিরোধী কাগজে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। বাল্টিক দেশগুলোয় রুশ ছাত্রছাত্রীদের ফর্ম পূরণ করতে বলা হচ্ছে, যেখানে বাবা-মার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য, যেমন তারা এই যুদ্ধের ব্যাপারে কোন পক্ষ সমর্থন করে, সেসব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই ইউরোপের কোন না কোন দেশে শুধু রুশ হওয়ার অপরাধে অনেকের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ইউক্রেন থেকে অনেকেই বিভিন্ন দেশে অবসর যাপনকারী রুশ নারী ও শিশুদের হত্যার ডাক দিচ্ছে।
এ কারণে এ দেশে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামকে সন্ত্রাসবাদী সাইট বলে ঘোষণা করা হয়েছে। মনে পড়ে ১৯৯১ সালের কথা। পোল্যান্ড দূতাবাসে গেছি ভিসার জন্য। খুব ভোরে গেছি, দূতাবাস তখনো খোলেনি। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলে জানলাম ও পাকিস্তান থেকে এসেছে। কিছুক্ষণ পর কিছু দূরে আরেকজনকে আসতে দেখলাম। পোশাক দেখে বুঝলাম শিখ। হঠাৎ করেই পাকিস্তানি ছেলেটা ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অপরাধ—ও ভারতীয়। এই দুজন লোক কোনো দিন একে অন্যকে দেখেনি, কেউ কারও ক্ষতি করেনি, অথচ বিনা কারণে একজন আরেকজনের ওপর হামলা চালাল। তখন অবাক হয়েছিলাম। এখন দেখছি সভ্য ইউরোপের মানুষও এ ব্যাপারে খুব একটা এগিয়ে যায়নি। আসলে কী বলব। মাত্র তিন বছরে জার্মানির শিক্ষিত, সভ্য মানুষেরা হিটলারের ডাকে বিশ্বে তাণ্ডব চালিয়েছিল। ঘৃণা করতে শেখানো খুব সহজ, কিন্তু একদিন যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে, তখন কিন্তু একদিনে এই ঘৃণা চলে যাবে না। বুক ভরা ঘৃণা নিয়ে মানুষ তখন কী সমাজ গড়বে?
এরই মধ্যে রাশিয়ার ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মুদ্রা আটকে দেওয়া হয়েছে। এক কথায় যেভাবে পারছে দেশটির সম্পদ লুটপাট করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত সাড়ে ৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। দেশটাকে ধ্বংস করার জন্য যা যা করা দরকার, সম্মিলিত পশ্চিমা বিশ্ব সেটাই করছে। করছে নিজেরাই এদের এই পর্যায়ে নিয়ে এসে। কারণ এটা তাদের অস্তিত্বের লড়াই। এখানে আমি ১৯৮৩ সাল থেকে। একটা দিনের কথাও মনে পড়ে না, যখন এদের ওপর একটা না একটা নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিল না। আসলে কারও উদ্দেশ্য যদি হয় প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করা, সে অজুহাত খুঁজে বের করবেই।
সেই নব্বইয়ের দশকে, যখন বরিস (ইয়েলৎসিন) আর বিল (ক্লিনটন) নিজেদের বন্ধু বলে সম্বোধন করতেন, তখনো সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আরোপিত বহু নিষেধাজ্ঞা কাজ করত। এটা অনেকটা সেই গল্পের মতো—‘যখন নেকড়ে ভাঁটিতে জলপানরত ভেড়াকে খেতে চায় জল ঘোলা করার অপরাধে। ভেড়া ভাঁটিতে দাঁড়িয়ে আছে এই অজুহাত দেওয়ার চেষ্টা করলে নেকড়ে বলে, তুই না হলে তোর দাদা নিশ্চয়ই আমার জল ঘোলা করেছিল। তাই তোকেই সে ঋণ শোধ করতে হবে।’ বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকায় রুশদের নিয়ে যা ঘটছে, সেটা আমায় মনে করিয়ে দেয় ১১ সেপ্টেম্বরের পরের দিনগুলোর কথা, যখন অনেক মার্কিন মুসলিম নাগরিকও ডিসক্রিমিনেশনের শিকার হয়েছিল। যদিও ইউরোপের মাল্টি-কালচারাল আইডিয়া অনেক আগেই মৃত্যুশয্যাশায়ী ছিল, বর্তমান ঘটনা খুব সম্ভব তার জন্য শেষের ঘণ্টা বাজিয়ে দিল। টলারেন্স বা পরমত সহিষ্ণুতা এভাবেই বেঘোরে মারা গেল। যুদ্ধে যাই ঘটুক ইউরোপ যে আর কোনো দিন আগের ইউরোপ থাকবে না, সেটা জোরেশোরেই বলা যায়।
লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো
রাশিয়া ইউক্রেন সংকট সম্পর্কিত পড়ুন:
এরই মধ্যে ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু বায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরির খোঁজ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে আগেও কথা হয়েছে। তবে এই প্রথম এদের বিভিন্ন দলিল রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে এল। যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার স্টেট সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড সেটা স্বীকারও করেছেন। এখানে বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল অস্ত্র তৈরির পরীক্ষা হতো বলে রাশিয়া ও চীন অভিযোগ করছে। যুক্তরাষ্ট্র আপাতত সেটা স্বীকার করছে না। কিন্তু জর্জিয়ায় অনেকের অকস্মাৎ মৃত্যু, দাগিস্তানে বিরল প্রাণীদের দল বেঁধে মৃত্যু—এসব পরোক্ষভাবে প্রমাণ করে যে, ওসব ল্যাবরেটরিতে এমন কিছু জীবাণু তৈরি হতো, যা পাখির মাধ্যমে ছড়ানো যায়। ইদানীং পাওয়া কিছু তথ্য বলছে ইউক্রেন তুরস্কের কাছে এমন কিছু ড্রোন অর্ডার দিতে চেয়েছিল, যা ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত স্প্রে ছড়াতে পারে।
উল্লেখ্য, ইউক্রেন, জর্জিয়া, কাজাখস্তানসহ অন্যান্য এক্স-সোভিয়েত রিপাবলিকগুলোয় এমন অনেক ল্যাবরেটরি আছে, যা মার্কিন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পেন্টাগনের অর্থ সহায়তায় চালিত। ইউক্রেনসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠিত হয় খুব সম্ভব ২০০৫ সালে তৎকালীন সিনেটর বারাক ওবামার অংশগ্রহণে। পরে প্রেসিডেন্ট ওবামা যুক্তরাষ্ট্র বা পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে এ ধরনের ল্যাবরেটরি স্থাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এটাও পরোক্ষভাবে প্রমাণ করে যে, এসব ল্যাবরেটরিতে এমন সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হতো, যা নিরাপদ ছিল না। রাশিয়া ও চীনের চারদিকে বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটির পাশাপাশি এ ধরনের ল্যাবরেটরির উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, আজ হোক, আর কাল হোক এই সংঘাত ছিল অবশ্যম্ভাবী। তবে তখন সেটা হতো আরও কঠিন যুদ্ধ।
আজ যারা রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তাঁরা যদি একইভাবে ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন; ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আমেরিকার আগ্রাসনের বিপক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতেন; দেশে দেশে রং-বেরঙের বিপ্লবের বিরুদ্ধে কথা বলতেন; পৃথিবী আজ এই মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারে এসে দাঁড়াত না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সাম্প্রতিক বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, হান্টার বাইডেন এসব ল্যাবরেটরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যখন ইউক্রেনে এসব ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়, তখন সে দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন মার্কিন নাগরিক উলিয়ানা সুপ্রুম, যাঁর পিতামহ স্তেপান বান্দেরার সহযোগী ছিলেন।
উল্লেখ্য, বিদেশি নাগরিকের মন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে ইউক্রেনে সাংবিধানিক বাধানিষেধ থাকার পরও সুপ্রুম কিন্তু নিয়োগ পেয়েছিলেন। এটা আবার প্রমাণ করে যে, ইউক্রেনের আসল শাসক কারা। বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে হান্টার বাইডেন আলোচনায় আসেন। তাঁর ল্যাপটপ থেকে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। তখন মার্কিন সংবাদমাধ্যম একে রাশিয়ার চক্রান্ত বলে উড়িয়ে দেয়। তবে সাম্প্রতিককালে তারা স্বীকার করেছে, ল্যাপটপের ঘটনায় রাশিয়া জড়িত ছিল না। কিছু কিছু নথি প্রমাণ করে যে, জো বাইডেন শুধু হান্টারের পিতাই নন, বিজনেস পার্টনারও বটে। অন্তত তিনি ছেলের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেতেন। তাই সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পাশাপাশি যে বাইডেন ফ্যামিলির স্বার্থও জড়িত—এটা বলা অপেক্ষা রাখে না। এ ছাড়া অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন, ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড—এদের শিকড় ইউক্রেনের ওদেসায়। এই দুই পরিবারই কয়েক প্রজন্ম আগে জারের রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র যায় ভাগ্যের সন্ধানে। তাই এদের মধ্যেও যে অন্ধ রুশ বিরোধিতা নেই, সেটাই-বা কে জানে?
বাচ্চারা যখন ছোট ছিল, তখন একটা জিনিস খেয়াল করতাম। অনেক সময় ওরা অপেক্ষা করত ছোট ভাই বা বোন কখন আঘাত পেয়ে কাঁদবে, তারপর ওকে কোলে নিয়ে সান্ত্বনা দেবে। যদিও চাইলে আগেই ওরা বাচ্চাটা যাতে আঘাত না পায়, সেটা করতে পারত, যা সাধারণত বড়রা করে। মনে হয় প্রথমত কিউরিওসিটি থেকে—দেখি কী হয় পড়ে কি পড়ে না। আবার যদি আগে থেকেই ব্যবস্থা নিত, তাহলে বাহবা পাওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু ক্রন্দনরত বাচ্চাকে সান্ত্বনা দিয়ে বাবা-মার কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া যায়। আজ রাশিয়া যদি ইউক্রেনের দনবাসে তাণ্ডব চালানোর পর সেখানে আসত, হয়তো এতটা সমালোচনার মুখে পড়ত না। বরং অনেকের কাছ থেকে বাহবা পেত। যেমন হয়েছে সিরিয়ায়। কিন্তু আমরা কি এ জন্যে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষের জীবন বলিদান করতে প্রস্তুত? মনে হয় তাই। আমরা আমাদের কাজের যুক্তি খুঁজি কোনো ঘটনা ঘটার পর, কেন ঘটল সেটা প্রায়ই বিবেচনায় না এনে।
মানুষের চরিত্রই এমন যে, কেউ বিপদে পড়লে, সে তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে না। কিন্তু যখন সেই বিপদগ্রস্ত মানুষ মারা যাবে, তখন তার প্রতি সমবেদনার অন্ত থাকবে না। কিন্তু সেই একই লোক যদি জীবন বাঁচাতে অন্যায় কিছু করে, তখন সবাই মিলে তাকে অপরাধী সাজিয়ে ছাড়বে। আর এটা সে করে সব সময় শুধু খণ্ডচিত্র বিবেচনায় আনে বলে। যেকোনো বিষয়ে কম-বেশি নিরপেক্ষ ও সঠিক সিদ্ধান্তে আসার জন্য দরকার পূর্ণ চিত্র বিবেচনা করা। বর্তমান পৃথিবী এত বেশি স্বার্থান্ধ যে, সে কাউকে পূর্ণ চিত্র দেখতে শেখায় না। সবাই দেখায় শুধু সেই চিত্রটাই, অনেক সময় ফেইক চিত্র, যেটা তার স্বার্থ উদ্ধার করবে। এখন সত্য খোঁজা হয় না। যে ভাষ্য স্বার্থ উদ্ধার করতে সাহায্য করে, সেটাকেই ছলে-বলে-কৌশলে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সব রকম চেষ্টা করা হয়। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে তাই প্রতিষ্ঠিত অনেক আইন-কানুন আজ কাজ করে না। অন্যদিকে নতুন বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নতুন আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও সামাজিক চুক্তি এখনো তৈরি হয়নি। এর ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।
দনবাসের সংকট ছড়াল যে কারণে
অনেককেই বলতে শুনি দনবাসে যেহেতু যুদ্ধ চলছে, তাহলে রুশ আক্রমণ এখানে সীমাবদ্ধ রাখলেই তো হতো। এখানে হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের আগে সমস্ত ইউরোপ পদানত করে। আর এসব দেশ প্রায় বিনা প্রতিরোধে জার্মানির অধীনতা মেনে নেয়। ফলে সেসব দেশে পারতপক্ষে ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম হয়। এসব দেশের সৈন্যরা জার্মান সৈন্যের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করতে। পরাজিত জার্মান বাহিনী যখন পিছু হটতে শুরু করে, তখন প্রশ্ন আসে সোভিয়েত সীমান্ত ত্যাগের পর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হবে কি হবে না। যদি সেটা না হতো বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদের সমর্থনকারী সরকার ক্ষমতায় থাকত। এমনকি কয়েক বছরের মধ্যেই জার্মানি নতুন করে শক্তি সংগ্রহ করে যুদ্ধ শুরু করত। তাই সে সময় ইউরোপকে ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মুক্ত করার বিকল্প ছিল না। আর যেহেতু প্রায় প্রতিটি দেশেই যেটুকু প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা হয়েছিল সেসব দেশের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন সেসব এলাকা মুক্ত করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে গড়ে উঠেছিল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এখানে শুধু গায়ের জোর ছিল না, ছিল অবজেকটিভ রিয়্যালিটিও।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, জেনারেল ফ্রাঙ্কো ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত স্পেন শাসন করেছেন। হিটলার ও মুসোলিনির মতো না হলেও তিনি এদের চেয়ে খুব বেশি দূরে ছিলেন না। ফ্যাসিবাদমুক্ত হওয়ার কারণেই ১৯৪৫ থেকে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ইউরোপ যুদ্ধ দেখেনি। সেই একই কারণে ইউক্রেন থেকে ফ্যাসিবাদের উচ্ছেদ আজ যুগের দাবি। তা না করলে অচিরেই নতুন করে যুদ্ধ শুরু হবে, আর তা হবে আরও ভয়ংকর। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান এটাই বলার চেষ্টা করে যে, এই যুদ্ধের পেছনে ভারতের হাত আছে, আর দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরাই এ জন্যে দায়ী। ফলে একাত্তরে তারা নির্বিচারে হিন্দু নিধন করে। সঙ্গে ছিল আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীরা। এমনকি এখন যে জামায়াত-হেফাজতসহ পাকিস্তানপন্থী বিভিন্ন দল হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করে, সেটা তখনকার রাগ থেকেও। একইভাবে যদি ইউক্রেন থেকে ফ্যাসিবাদ সমূলে উৎপাটন না করা হয়, তাহলে সেখানকার রুশদের সেই একই রকম বিপদের মধ্যে রাখা হবে।
কারণ, এসব ফ্যাসিবাদী দল প্রথম সুযোগেই আক্রমণ করবে স্থানীয় রুশদের, আর রুশপন্থী ইউক্রেনীয়দের ওপর। এরই মধ্যে সেখানে অনেকেই ডাক দিচ্ছে রুশ হত্যার, বিশেষ করে রুশ শিশু হত্যার, যাতে করে উত্তরসূরিরা পিতামাতা হত্যার প্রতিশোধ নিতে না পারে। মনে করিয়ে দিতে চাই যে,১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে, রাজাকার-আলবদর নয়। শেখ মুজিবের ডাকে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র সমর্পণ করে, রাজাকাররা নয়। একাত্তরের বিজয়ের পরে প্রয়োজন ছিল রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা চালিয়ে যাওয়া, দেশকে আক্ষরিক অর্থেই রাজাকারমুক্ত করা। তখন সেটা হয়নি বলেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হয়েছে, তখন সেটা হয়নি বলেই বিভিন্ন সময় বাংলাদেশকে নতুন করে পাকিস্তানের জুতা পরতে হয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের আরেকটা দিক ছিল—পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যুদ্ধের শুরুতেই অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছিল—কী হবে এসব কেন্দ্রের। চেরনোবিলের স্মৃতি এখনো অনেকের মনেই ভেসে ওঠে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষার জন্য যথেষ্ট যত্ন করেই তৈরি করা হয়েছিল। এগুলো গড়ে (১) ৩০ কিলোপাসকেল শক্তির শকওয়েভের চাপ সহ্য করতে পারে। এই চাপে বিমান দুমড়ে-মুচড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যায়; (২) ২০ টন ওজনের প্লেন ৭২০ কিমি/ঘণ্টা বেগে এর ওপর পড়লেও এগুলো ঠিক দাঁড়িয়ে থাকবে; (৩) ৫৬ মি/সেকেন্ড বেগের ঝড় সইতে পারে এগুলো; (৪) বন্যায় টিকে থাকতে পারে; (৫) রিখটার স্কেলের ৮ মাত্রার ভূমিকম্পেও দাঁড়িয়ে থাকে। তবে চেরনোবিলের ঘটনা প্রমাণ করে যে, ভেতর থেকে সেখানে দুর্ঘটনা ঘটানো অসম্ভব কিছু নয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু রাখতে হয়। একটা নির্দিষ্ট সময়ের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করলে সেখানে এমন অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে, যখন দুর্ঘটনা এড়ানো কঠিন। ইউক্রেন সেই চেষ্টা করেছিল চেরনোবিলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে। যদিও রুশ সৈন্যরা প্রথমে জেনারেটরের সাহায্যে, পরে বেলারুশ থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে সে সমস্যার সমাধান করে। ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র জাপারোঝিয়ায় তারা প্রভোকেশন করেছিল। যদিও রুশ সৈন্যদের সময়োপযোগী হস্তক্ষেপে সেটা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসে। আসলে উগ্রবাদীদের হাতে যেকোনো অস্ত্রই মানবতার জন্য হুমকিস্বরূপ। সেই প্রমাণ তালেবান, আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট নিকট অতীতে বারবার দিয়েছে।
রুশোফোবিয়া: শুনব নাকি শুনব না
যুদ্ধ শুরুর পর রুশোফোবিয়া অসম্ভব রকম বেড়ে গেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, পোল্যান্ডের এক মন্ত্রী শিকার করেছেন—রুশোফোবিয়া এখন পশ্চিমা বিশ্বের মেইন স্ট্রিম আইডিয়া। আর এটা শুধু যারা রাশিয়ার নাগরিক তাদের সাথেই ঘটছে না, যারা যুগ যুগ ধরে ইউরোপে বা যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্ব নিয়ে বাস করছে, তারাও আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকায় অধ্যয়নরত শত শত রুশ ছাত্রছাত্রীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দস্তইয়েভস্কি, চাইকোভস্কি—মানে রুশ সাহিত্য, রুশ মিউজিক আজ পশ্চিমা বিশ্বে নিষিদ্ধ। ভালেরি গিওর্গিয়েভ, আন্না নিত্রেপকাসহ অনেক বিশ্ববরেণ্য শিল্পী, যারা ওখানে কাজ করতেন বা রেগুলার প্রোগ্রাম করতেন, তাঁদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। তাঁদের বলা হচ্ছে—এই আক্রমণের বিরোধিতা করতে। কিন্তু এঁরা তো জানেন, দনবাসের মানুষের কষ্টের কথা। সমস্ত খেলাধুলায় এদের অংশগ্রহণ বাতিল করা হয়েছে। শত শত রুশ ড্রাইভার আটকা পড়েছেন পোল্যান্ড-বেলারুশ সীমান্তে। এখন বাল্টিক দেশগুলো রাশিয়া ও বেলারুশের ট্রাক ও অন্যান্য মালবাহী গাড়ি আটকে দিচ্ছে।
এটা আসলে রাশিয়াকে ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা বই কিছু নয়। কোনো কোনো হাসপাতাল রুশ রোগীদের সেবা দিতে অস্বীকার করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কোনো কোনো ক্যানসার রিসার্চ সেন্টার রুশ রোগীদের স্যাম্পল টেস্ট না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ এরাই নিজেদের মানবতার ধারক ও বাহক বলে ভাবে। অনেকে রুশদের কাছে বাসা ভাড়া দিচ্ছে না বা যারা অনেক দিন বাসা ভাড়া করে আছে, তাদের উঠে যেতে বলছে। এটা অনেকটা আমাদের সব দেশে ধর্ম দেখে বাসা ভাড়া দেওয়া বা না দেওয়ার মত। স্কুলের বাচ্চাদের শিক্ষক ও সহপাঠীরা মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছে। তাদের রুশবিরোধী কাগজে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। বাল্টিক দেশগুলোয় রুশ ছাত্রছাত্রীদের ফর্ম পূরণ করতে বলা হচ্ছে, যেখানে বাবা-মার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য, যেমন তারা এই যুদ্ধের ব্যাপারে কোন পক্ষ সমর্থন করে, সেসব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই ইউরোপের কোন না কোন দেশে শুধু রুশ হওয়ার অপরাধে অনেকের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ইউক্রেন থেকে অনেকেই বিভিন্ন দেশে অবসর যাপনকারী রুশ নারী ও শিশুদের হত্যার ডাক দিচ্ছে।
এ কারণে এ দেশে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামকে সন্ত্রাসবাদী সাইট বলে ঘোষণা করা হয়েছে। মনে পড়ে ১৯৯১ সালের কথা। পোল্যান্ড দূতাবাসে গেছি ভিসার জন্য। খুব ভোরে গেছি, দূতাবাস তখনো খোলেনি। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলে জানলাম ও পাকিস্তান থেকে এসেছে। কিছুক্ষণ পর কিছু দূরে আরেকজনকে আসতে দেখলাম। পোশাক দেখে বুঝলাম শিখ। হঠাৎ করেই পাকিস্তানি ছেলেটা ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অপরাধ—ও ভারতীয়। এই দুজন লোক কোনো দিন একে অন্যকে দেখেনি, কেউ কারও ক্ষতি করেনি, অথচ বিনা কারণে একজন আরেকজনের ওপর হামলা চালাল। তখন অবাক হয়েছিলাম। এখন দেখছি সভ্য ইউরোপের মানুষও এ ব্যাপারে খুব একটা এগিয়ে যায়নি। আসলে কী বলব। মাত্র তিন বছরে জার্মানির শিক্ষিত, সভ্য মানুষেরা হিটলারের ডাকে বিশ্বে তাণ্ডব চালিয়েছিল। ঘৃণা করতে শেখানো খুব সহজ, কিন্তু একদিন যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে, তখন কিন্তু একদিনে এই ঘৃণা চলে যাবে না। বুক ভরা ঘৃণা নিয়ে মানুষ তখন কী সমাজ গড়বে?
এরই মধ্যে রাশিয়ার ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মুদ্রা আটকে দেওয়া হয়েছে। এক কথায় যেভাবে পারছে দেশটির সম্পদ লুটপাট করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত সাড়ে ৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। দেশটাকে ধ্বংস করার জন্য যা যা করা দরকার, সম্মিলিত পশ্চিমা বিশ্ব সেটাই করছে। করছে নিজেরাই এদের এই পর্যায়ে নিয়ে এসে। কারণ এটা তাদের অস্তিত্বের লড়াই। এখানে আমি ১৯৮৩ সাল থেকে। একটা দিনের কথাও মনে পড়ে না, যখন এদের ওপর একটা না একটা নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিল না। আসলে কারও উদ্দেশ্য যদি হয় প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করা, সে অজুহাত খুঁজে বের করবেই।
সেই নব্বইয়ের দশকে, যখন বরিস (ইয়েলৎসিন) আর বিল (ক্লিনটন) নিজেদের বন্ধু বলে সম্বোধন করতেন, তখনো সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আরোপিত বহু নিষেধাজ্ঞা কাজ করত। এটা অনেকটা সেই গল্পের মতো—‘যখন নেকড়ে ভাঁটিতে জলপানরত ভেড়াকে খেতে চায় জল ঘোলা করার অপরাধে। ভেড়া ভাঁটিতে দাঁড়িয়ে আছে এই অজুহাত দেওয়ার চেষ্টা করলে নেকড়ে বলে, তুই না হলে তোর দাদা নিশ্চয়ই আমার জল ঘোলা করেছিল। তাই তোকেই সে ঋণ শোধ করতে হবে।’ বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকায় রুশদের নিয়ে যা ঘটছে, সেটা আমায় মনে করিয়ে দেয় ১১ সেপ্টেম্বরের পরের দিনগুলোর কথা, যখন অনেক মার্কিন মুসলিম নাগরিকও ডিসক্রিমিনেশনের শিকার হয়েছিল। যদিও ইউরোপের মাল্টি-কালচারাল আইডিয়া অনেক আগেই মৃত্যুশয্যাশায়ী ছিল, বর্তমান ঘটনা খুব সম্ভব তার জন্য শেষের ঘণ্টা বাজিয়ে দিল। টলারেন্স বা পরমত সহিষ্ণুতা এভাবেই বেঘোরে মারা গেল। যুদ্ধে যাই ঘটুক ইউরোপ যে আর কোনো দিন আগের ইউরোপ থাকবে না, সেটা জোরেশোরেই বলা যায়।
লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো
রাশিয়া ইউক্রেন সংকট সম্পর্কিত পড়ুন:
শেখ হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে এ দেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে শাসন করেছে। মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ কনসেপ্ট। এটার সবচেয়ে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা হলো, এটা একটা গড়, যেটা স্বল্পসংখ্যক ধনী এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন-মধ্যবিত্ত
২১ ঘণ্টা আগেআমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীকে জলবায়ু-বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’-এর ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
২১ ঘণ্টা আগেআমেরিকার ১৩২ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম মেয়াদে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ট্রাম্প।
২১ ঘণ্টা আগেজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড্ড কষ্ট বুকে নিয়েই ‘সব শালারা বাটপার’ স্লোগানটি দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা দ্বিতীয় ক্যাম্পাস পাচ্ছেন না। ঠিকাদারেরা ভেলকিবাজি করছেন।ক্যাম্পাসের জন্য জমিও অধিগ্রহণ করা হয়নি।
২১ ঘণ্টা আগে