আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বঙ্গবন্ধু যখন রক্ষীবাহিনী গঠন করেন, তখন তাঁর বিরোধীরা জেনেশুনেও একটা মিথ্যা প্রচার চালিয়েছিল। এই মিথ্যা প্রচারটা ছিল–বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীকে বিশ্বাস করেন না, তাই নিজস্ব বাহিনী গঠন করেছেন। শিগগিরই সেনাবাহিনীকে ভেঙে দেবেন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের কাজে রক্ষীবাহিনীকে ব্যবহার করবেন। এই মিথ্যা প্রচারটা স্বাধীনতার শত্রুপক্ষ দুই উদ্দেশ্যে করেছিল। প্রথমত. জনসাধারণের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এই বিভ্রান্তি ছড়ানো যে তিনি স্বৈরাচারী হতে চান। দ্বিতীয়ত, সেনাবাহিনীর মন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুলে ভবিষ্যতে সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুত করা।
রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে সারা দেশের মানুষের মন বিষিয়ে তোলা হয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধীরা বারবার প্রচার চালাচ্ছিল, এটা রাজনৈতিক বাহিনী। রক্ষীবাহিনী দেশে সরকারবিরোধী নেতা-কর্মীদের গুপ্তহত্যার শিকার করছে–এই মর্মেও তারা গুজব ছড়াচ্ছিল। অনেক ডান ও বাম দলও এই প্রচার চালিয়েছে। যদিও গুরুত্বপূর্ণ কোনো নেতার নাম তারা বলতে পারেনি, যাঁদের হত্যা করা হয়েছে। তবু প্রচারণার জোরে রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারের কথাটা অনেকের মুখে মুখে থাকত।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে অরাজকতা দূর করার কাজে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা উচিত নয়। তাতে তাদের মধ্যে রাজনীতি ঢুকে যেতে পারে। স্বাভাবিক সময়ে পুলিশই অরাজকতা দূর করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন স্বাভাবিক সময় নয়। পাকিস্তানের হানাদারদের কবলমুক্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে স্বাধীনতার শত্রুরা, পঞ্চম বাহিনীর লোক এবং ধ্বংসাত্মক চরিত্রের বহু লোক লুকিয়ে আছে। তাদের দমন করার জন্য পুলিশবাহিনী এখনো নির্ভরযোগ্য শক্তি নয়। এ জন্যই রক্ষীবাহিনী গঠন। সৈন্যবাহিনী সীমান্ত ও দেশরক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকবে। দেশের অভ্যন্তরীণ কাজে যেমন: ভুয়া রেশন কার্ড উদ্ধার, স্বাধীনতাবিরোধী সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড দমন, ভয়ংকর সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করা প্রভৃতি কাজে রক্ষীবাহিনীকে ব্যবহার করা হবে।
বঙ্গবন্ধু যখন এসব কথা বলেছেন, তখন বাংলাদেশের অবস্থা ছিল নাজুক। হানাদাররা আত্মসমর্পণ করেছে; কিন্তু তাদের অনুচরেরা তখনো অস্ত্র ত্যাগ করেনি। বিভ্রান্ত কয়েকটি বাম উপদল নিজেদের মাওবাদী পরিচয় দিয়ে উত্তরবঙ্গে রীতিমতো সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে। দক্ষিণবঙ্গে সিরাজ সিকদার ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। তাদের সমান্তরালে স্বাধীনতার শত্রু ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, এমনকি এমপিদের একের পর এক হত্যা করছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধে আওয়ামী লীগের যে কয়জন এমপি মারা গেছেন, তার চেয়ে বেশি এমপি ও নেতা মারা গেছেন স্বাধীনতার পর সন্ত্রাসীদের হাতে।
এ ধরনের সন্ত্রাস মোকাবিলায় সব দেশেই স্পেশাল ফোর্স বা নিরাপত্তা বাহিনী থাকে। ব্রিটেন ও আমেরিকায়ও আছে। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর এই রক্ষীবাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা ও তার কর্মকাণ্ড দেশবাসীর কাছে আওয়ামী লীগ যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি। রক্ষীবাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যও বোঝাতে পারেনি। দেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে পূর্ববঙ্গ কমিউনিস্ট পার্টি, সর্বহারা পার্টি, সাম্যবাদী দল প্রভৃতি নামে তখন যে ভয়াবহ সন্ত্রাসী দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল এবং দেশে রক্ষীবাহিনীর মতো ফোর্স গঠন করা ছাড়া যে উপায় ছিল না–এ কথাটা জনগণকে বোঝাতে আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের প্রচারব্যবস্থা তখনো খুব দুর্বল ছিল, এখনো দুর্বলই আছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান খুব সহজেই রক্ষীবাহিনী ভেঙে দিয়েছিলেন। তিনি তো তিন বছর ধরে ঢাকায় কারফিউ জারি রেখে দেশ শাসন করেছেন। বুলেটে বুলেটে তাঁর শরীর ঝাঁজরা হয়েছিল। তাঁকে শনাক্ত করার উপায় পর্যন্ত ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী খালেদা জিয়া নিজেদের সৃষ্ট সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থ হয়ে র্যাব গঠনে বাধ্য হয়েছিলেন। এই র্যাবের হাতে হত্যার ছাড়পত্র তুলে দেওয়া হয়েছিল। র্যাবের সন্ত্রাস দমন অভিযানে যে অসংখ্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার অধিকাংশকেই ক্রসফায়ারিংয়ে মৃত্যু বলে চালানো হয়েছে। আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় এসে র্যাব ভেঙে দেয়নি; বরং কাজে লাগিয়েছে। আওয়ামী লীগের আমলেও র্যাব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড থেকে বিরত নেই।
রাষ্ট্রের হাতে যে রক্ষীবাহিনী বা র্যাবের মতো বাহিনী থাকা দরকার, তা প্রমাণিত হয়েছে দেশে উগ্র মৌলবাদী ও ইসলামি জঙ্গিদের উত্থানের সময়। ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতিদের ভয়াবহ তাণ্ডবের সময়ও বাংলাদেশে র্যাবের প্রয়োজনীয়তা বোঝা গেছে। র্যাব অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে, ধৈর্যের সঙ্গে এই সন্ত্রাস দমন করেছে, উচ্ছেদ করেছেও বলা চলে। বাম অথবা ডান কোনো সন্ত্রাসেরই আওয়াজ এখন আর উত্তরবঙ্গে অথবা দক্ষিণবঙ্গে পাওয়া যায় না। সন্ত্রাস দমনে এমন সাফল্য ব্রিটেন অথবা যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল ফোর্স দেখাতে পারেনি। ব্রিটেনে এখন ‘নাইফ ক্রাইম’ (knife crime) চলছে তিন বছর ধরে। এই করোনার সময়েও ব্রিটিশ পুলিশ, ব্রিটিশ গোয়েন্দারা তা দমাতে পারেননি।
আমেরিকার সাদা পুলিশ ও স্পেশাল ফোর্সের অনেক দুর্নাম আছে। কালো মানুষ দেখলেই তাদের হাত নিশপিশ করে। আমাদের র্যাবের তেমন কোনো দুর্নাম নেই। এখন দেশে যেটা হচ্ছে–প্রশাসন, পুলিশ কোনো কিছুর ওপরই রাজনৈতিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। যেখানে দুর্নীতি বা অসদাচরণের সিন্ডিকেট ভাঙতে কামান দাগানো দরকার, সেখানে সেই কামান দাগা হচ্ছে মশার ওপর। সিন্ডিকেটের রাজত্ব সেই কামানের আশ্রয়ে রয়েছে। পরীমণির ঘটনাই বলি। তাঁর বাড়িতে যে কায়দায় সন্ত্রাসী বা ডাকাত ধরার মতো অভিযান চালানো হয়েছে, সে জন্য আমরা র্যাবকে দোষ দিই না। তারা হুকুম পালন করেছে মাত্র। এই হুকুম দিয়েছেন নিঃসন্দেহে কোনো ওপরওয়ালা। এই ওপরওয়ালা কে? যিনি তাঁর আক্রোশ মেটানোর জন্য গোটা রাষ্ট্রশক্তিকে ২৮ বছর বয়সী এক চিত্রনায়িকার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন। তাঁর আক্রোশের কারণ বোধগম্য নয়। তবে একটি ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে তাঁকে ধর্ষণচেষ্টার মামলা করেছিলেন পরীমণি। এই ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে অনেক রুই-কাতলার ব্যবসায়িক ও অন্যান্য অবৈধ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ এবং গুজব দুটোই বাজারে রয়েছে। এর বাইরেও কারও সঙ্গে পরীমণির কোনো সম্পর্কের জেরে কোনো ওপরওয়ালা নাখোশ হয়ে থাকতে পারেন। এসব মিলিয়েই একজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা করার স্পর্ধা দেখানোর জন্য পরীমণিকে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে শায়েস্তা করা হলো। যেখানে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে পাঁচজন পুলিশ পাঠানোই যথেষ্ট ছিল, সেখানে র্যাবের মেদিনী-কাঁপানো ইউনিট পাঠানো হলো, তাঁকে রাতের রানি আখ্যা দিয়ে ভাড়া করা মাফিয়া মারফত চরিত্র হনন করা হলো। নিম্ন আদালতে তাঁকে সংবিধানবহির্ভূতভাবে, অন্যায়ভাবে জামিনদান বন্ধ রাখা হলো (শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে জামিন দিতে হয়েছে। পরীমণিকে বারবার রিমান্ডে দেওয়ার বিষয়টিকে ‘সভ্য সমাজে এভাবে চলতে পারে না’ বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট)। দেশের সব বুদ্ধিজীবী একযোগে বলেছেন, এটা মানবতা ও নারীর অধিকারের ওপর হিংস্র হামলা এবং এটা ঘটেছে আওয়ামী লীগের নারীর ক্ষমতায়নের যুগে।
র্যাবকে এভাবে নিজেদের আক্রোশ মেটানোর কাজে ব্যবহারের প্রবণতা দেখে প্রশাসনের উচ্চপর্যায়কে বিরত রাখার ব্যবস্থা গ্রহণের এখন সময় এসেছে। র্যাব এখনো বাংলাদেশে দরকার। আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা দখল করার পর বাংলাদেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়তে পারে। তা ছাড়া, দেশের রাজনৈতিক সরকারকে উচ্ছেদের লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র তো চলছেই। র্যাবকে এ ধরনের সন্ত্রাস দমন ও উচ্ছেদের কাজে ব্যবহার করাই ভালো এবং সংগত। র্যাব এই কাজে তার প্রশংসনীয় সাফল্যও দেখিয়েছে। ছোটখাটো অপরাধ দমনের কাজে আমাদের পুলিশই যথেষ্ট।
মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী শাসনামলে তাদের কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গ্রেপ্তার করতে হলে প্রথমে তাঁর বাসভবন ঘেরাও করে ফেলত। তারপর বীরদর্পে রাজনীতিকের বাড়িতে ঢুকে তাঁর বাড়ি তছনছ করে ফেলত। এই ব্যবস্থা বাতিলের দাবি তোলা হলে মুসলিম লীগ সরকার বলেছিল, রাজনৈতিক নেতা গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য পালিয়ে যেতে পারেন। এ জন্যই এই ব্যবস্থা। অথচ এ ব্যবস্থাটি ব্রিটিশ সরকার করেছিল বিপজ্জনক চোর-ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের জন্য। এই আইনটি পাকিস্তানে রাজনৈতিক নেতাদের ধরার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে এবং অদ্যাবধি হচ্ছে। অথচ ব্রিটিশ আমলেও গান্ধী, নেহরু, চিত্তরঞ্জন দাসকে গ্রেপ্তারের ছবি দেখেছি। তাঁদের সঙ্গে পুলিশ কয়েদির মতো ব্যবহার করেনি।
এখনো রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ ব্রিটিশ আমলের অশ্লীল আইনটিই ব্যবহার করে। আওয়ামী লীগ সরকার এটি বাতিল করতে পারে না? পারে না র্যাবকে অহেতুক ব্যবহার করার প্রবণতা থেকে প্রশাসনের উচ্চপর্যায়কে মুক্ত থাকার কঠোর নির্দেশ দিতে? কথায় বলে, অ্যান্টিবায়োটিক অপ্রয়োজনে এবং বারবার ব্যবহারে তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। র্যাবকেও যদি তার প্রয়োজনের বাইরে এবং অনাবশ্যক স্থানে বারবার ব্যবহার করা হয়, সে-ও তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলবে।
লেখক: বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও কলামিস্ট
বঙ্গবন্ধু যখন রক্ষীবাহিনী গঠন করেন, তখন তাঁর বিরোধীরা জেনেশুনেও একটা মিথ্যা প্রচার চালিয়েছিল। এই মিথ্যা প্রচারটা ছিল–বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীকে বিশ্বাস করেন না, তাই নিজস্ব বাহিনী গঠন করেছেন। শিগগিরই সেনাবাহিনীকে ভেঙে দেবেন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের কাজে রক্ষীবাহিনীকে ব্যবহার করবেন। এই মিথ্যা প্রচারটা স্বাধীনতার শত্রুপক্ষ দুই উদ্দেশ্যে করেছিল। প্রথমত. জনসাধারণের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এই বিভ্রান্তি ছড়ানো যে তিনি স্বৈরাচারী হতে চান। দ্বিতীয়ত, সেনাবাহিনীর মন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুলে ভবিষ্যতে সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুত করা।
রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে সারা দেশের মানুষের মন বিষিয়ে তোলা হয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধীরা বারবার প্রচার চালাচ্ছিল, এটা রাজনৈতিক বাহিনী। রক্ষীবাহিনী দেশে সরকারবিরোধী নেতা-কর্মীদের গুপ্তহত্যার শিকার করছে–এই মর্মেও তারা গুজব ছড়াচ্ছিল। অনেক ডান ও বাম দলও এই প্রচার চালিয়েছে। যদিও গুরুত্বপূর্ণ কোনো নেতার নাম তারা বলতে পারেনি, যাঁদের হত্যা করা হয়েছে। তবু প্রচারণার জোরে রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারের কথাটা অনেকের মুখে মুখে থাকত।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে অরাজকতা দূর করার কাজে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা উচিত নয়। তাতে তাদের মধ্যে রাজনীতি ঢুকে যেতে পারে। স্বাভাবিক সময়ে পুলিশই অরাজকতা দূর করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন স্বাভাবিক সময় নয়। পাকিস্তানের হানাদারদের কবলমুক্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে স্বাধীনতার শত্রুরা, পঞ্চম বাহিনীর লোক এবং ধ্বংসাত্মক চরিত্রের বহু লোক লুকিয়ে আছে। তাদের দমন করার জন্য পুলিশবাহিনী এখনো নির্ভরযোগ্য শক্তি নয়। এ জন্যই রক্ষীবাহিনী গঠন। সৈন্যবাহিনী সীমান্ত ও দেশরক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকবে। দেশের অভ্যন্তরীণ কাজে যেমন: ভুয়া রেশন কার্ড উদ্ধার, স্বাধীনতাবিরোধী সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড দমন, ভয়ংকর সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করা প্রভৃতি কাজে রক্ষীবাহিনীকে ব্যবহার করা হবে।
বঙ্গবন্ধু যখন এসব কথা বলেছেন, তখন বাংলাদেশের অবস্থা ছিল নাজুক। হানাদাররা আত্মসমর্পণ করেছে; কিন্তু তাদের অনুচরেরা তখনো অস্ত্র ত্যাগ করেনি। বিভ্রান্ত কয়েকটি বাম উপদল নিজেদের মাওবাদী পরিচয় দিয়ে উত্তরবঙ্গে রীতিমতো সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে। দক্ষিণবঙ্গে সিরাজ সিকদার ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। তাদের সমান্তরালে স্বাধীনতার শত্রু ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, এমনকি এমপিদের একের পর এক হত্যা করছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধে আওয়ামী লীগের যে কয়জন এমপি মারা গেছেন, তার চেয়ে বেশি এমপি ও নেতা মারা গেছেন স্বাধীনতার পর সন্ত্রাসীদের হাতে।
এ ধরনের সন্ত্রাস মোকাবিলায় সব দেশেই স্পেশাল ফোর্স বা নিরাপত্তা বাহিনী থাকে। ব্রিটেন ও আমেরিকায়ও আছে। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর এই রক্ষীবাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা ও তার কর্মকাণ্ড দেশবাসীর কাছে আওয়ামী লীগ যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি। রক্ষীবাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যও বোঝাতে পারেনি। দেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে পূর্ববঙ্গ কমিউনিস্ট পার্টি, সর্বহারা পার্টি, সাম্যবাদী দল প্রভৃতি নামে তখন যে ভয়াবহ সন্ত্রাসী দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল এবং দেশে রক্ষীবাহিনীর মতো ফোর্স গঠন করা ছাড়া যে উপায় ছিল না–এ কথাটা জনগণকে বোঝাতে আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের প্রচারব্যবস্থা তখনো খুব দুর্বল ছিল, এখনো দুর্বলই আছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান খুব সহজেই রক্ষীবাহিনী ভেঙে দিয়েছিলেন। তিনি তো তিন বছর ধরে ঢাকায় কারফিউ জারি রেখে দেশ শাসন করেছেন। বুলেটে বুলেটে তাঁর শরীর ঝাঁজরা হয়েছিল। তাঁকে শনাক্ত করার উপায় পর্যন্ত ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী খালেদা জিয়া নিজেদের সৃষ্ট সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থ হয়ে র্যাব গঠনে বাধ্য হয়েছিলেন। এই র্যাবের হাতে হত্যার ছাড়পত্র তুলে দেওয়া হয়েছিল। র্যাবের সন্ত্রাস দমন অভিযানে যে অসংখ্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার অধিকাংশকেই ক্রসফায়ারিংয়ে মৃত্যু বলে চালানো হয়েছে। আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় এসে র্যাব ভেঙে দেয়নি; বরং কাজে লাগিয়েছে। আওয়ামী লীগের আমলেও র্যাব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড থেকে বিরত নেই।
রাষ্ট্রের হাতে যে রক্ষীবাহিনী বা র্যাবের মতো বাহিনী থাকা দরকার, তা প্রমাণিত হয়েছে দেশে উগ্র মৌলবাদী ও ইসলামি জঙ্গিদের উত্থানের সময়। ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতিদের ভয়াবহ তাণ্ডবের সময়ও বাংলাদেশে র্যাবের প্রয়োজনীয়তা বোঝা গেছে। র্যাব অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে, ধৈর্যের সঙ্গে এই সন্ত্রাস দমন করেছে, উচ্ছেদ করেছেও বলা চলে। বাম অথবা ডান কোনো সন্ত্রাসেরই আওয়াজ এখন আর উত্তরবঙ্গে অথবা দক্ষিণবঙ্গে পাওয়া যায় না। সন্ত্রাস দমনে এমন সাফল্য ব্রিটেন অথবা যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল ফোর্স দেখাতে পারেনি। ব্রিটেনে এখন ‘নাইফ ক্রাইম’ (knife crime) চলছে তিন বছর ধরে। এই করোনার সময়েও ব্রিটিশ পুলিশ, ব্রিটিশ গোয়েন্দারা তা দমাতে পারেননি।
আমেরিকার সাদা পুলিশ ও স্পেশাল ফোর্সের অনেক দুর্নাম আছে। কালো মানুষ দেখলেই তাদের হাত নিশপিশ করে। আমাদের র্যাবের তেমন কোনো দুর্নাম নেই। এখন দেশে যেটা হচ্ছে–প্রশাসন, পুলিশ কোনো কিছুর ওপরই রাজনৈতিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। যেখানে দুর্নীতি বা অসদাচরণের সিন্ডিকেট ভাঙতে কামান দাগানো দরকার, সেখানে সেই কামান দাগা হচ্ছে মশার ওপর। সিন্ডিকেটের রাজত্ব সেই কামানের আশ্রয়ে রয়েছে। পরীমণির ঘটনাই বলি। তাঁর বাড়িতে যে কায়দায় সন্ত্রাসী বা ডাকাত ধরার মতো অভিযান চালানো হয়েছে, সে জন্য আমরা র্যাবকে দোষ দিই না। তারা হুকুম পালন করেছে মাত্র। এই হুকুম দিয়েছেন নিঃসন্দেহে কোনো ওপরওয়ালা। এই ওপরওয়ালা কে? যিনি তাঁর আক্রোশ মেটানোর জন্য গোটা রাষ্ট্রশক্তিকে ২৮ বছর বয়সী এক চিত্রনায়িকার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন। তাঁর আক্রোশের কারণ বোধগম্য নয়। তবে একটি ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে তাঁকে ধর্ষণচেষ্টার মামলা করেছিলেন পরীমণি। এই ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে অনেক রুই-কাতলার ব্যবসায়িক ও অন্যান্য অবৈধ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ এবং গুজব দুটোই বাজারে রয়েছে। এর বাইরেও কারও সঙ্গে পরীমণির কোনো সম্পর্কের জেরে কোনো ওপরওয়ালা নাখোশ হয়ে থাকতে পারেন। এসব মিলিয়েই একজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা করার স্পর্ধা দেখানোর জন্য পরীমণিকে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে শায়েস্তা করা হলো। যেখানে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে পাঁচজন পুলিশ পাঠানোই যথেষ্ট ছিল, সেখানে র্যাবের মেদিনী-কাঁপানো ইউনিট পাঠানো হলো, তাঁকে রাতের রানি আখ্যা দিয়ে ভাড়া করা মাফিয়া মারফত চরিত্র হনন করা হলো। নিম্ন আদালতে তাঁকে সংবিধানবহির্ভূতভাবে, অন্যায়ভাবে জামিনদান বন্ধ রাখা হলো (শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে জামিন দিতে হয়েছে। পরীমণিকে বারবার রিমান্ডে দেওয়ার বিষয়টিকে ‘সভ্য সমাজে এভাবে চলতে পারে না’ বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট)। দেশের সব বুদ্ধিজীবী একযোগে বলেছেন, এটা মানবতা ও নারীর অধিকারের ওপর হিংস্র হামলা এবং এটা ঘটেছে আওয়ামী লীগের নারীর ক্ষমতায়নের যুগে।
র্যাবকে এভাবে নিজেদের আক্রোশ মেটানোর কাজে ব্যবহারের প্রবণতা দেখে প্রশাসনের উচ্চপর্যায়কে বিরত রাখার ব্যবস্থা গ্রহণের এখন সময় এসেছে। র্যাব এখনো বাংলাদেশে দরকার। আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা দখল করার পর বাংলাদেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়তে পারে। তা ছাড়া, দেশের রাজনৈতিক সরকারকে উচ্ছেদের লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র তো চলছেই। র্যাবকে এ ধরনের সন্ত্রাস দমন ও উচ্ছেদের কাজে ব্যবহার করাই ভালো এবং সংগত। র্যাব এই কাজে তার প্রশংসনীয় সাফল্যও দেখিয়েছে। ছোটখাটো অপরাধ দমনের কাজে আমাদের পুলিশই যথেষ্ট।
মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী শাসনামলে তাদের কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গ্রেপ্তার করতে হলে প্রথমে তাঁর বাসভবন ঘেরাও করে ফেলত। তারপর বীরদর্পে রাজনীতিকের বাড়িতে ঢুকে তাঁর বাড়ি তছনছ করে ফেলত। এই ব্যবস্থা বাতিলের দাবি তোলা হলে মুসলিম লীগ সরকার বলেছিল, রাজনৈতিক নেতা গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য পালিয়ে যেতে পারেন। এ জন্যই এই ব্যবস্থা। অথচ এ ব্যবস্থাটি ব্রিটিশ সরকার করেছিল বিপজ্জনক চোর-ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের জন্য। এই আইনটি পাকিস্তানে রাজনৈতিক নেতাদের ধরার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে এবং অদ্যাবধি হচ্ছে। অথচ ব্রিটিশ আমলেও গান্ধী, নেহরু, চিত্তরঞ্জন দাসকে গ্রেপ্তারের ছবি দেখেছি। তাঁদের সঙ্গে পুলিশ কয়েদির মতো ব্যবহার করেনি।
এখনো রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ ব্রিটিশ আমলের অশ্লীল আইনটিই ব্যবহার করে। আওয়ামী লীগ সরকার এটি বাতিল করতে পারে না? পারে না র্যাবকে অহেতুক ব্যবহার করার প্রবণতা থেকে প্রশাসনের উচ্চপর্যায়কে মুক্ত থাকার কঠোর নির্দেশ দিতে? কথায় বলে, অ্যান্টিবায়োটিক অপ্রয়োজনে এবং বারবার ব্যবহারে তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। র্যাবকেও যদি তার প্রয়োজনের বাইরে এবং অনাবশ্যক স্থানে বারবার ব্যবহার করা হয়, সে-ও তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলবে।
লেখক: বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
১ দিন আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
১ দিন আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
১ দিন আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
১ দিন আগে