জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। রুশ বাহিনী ঢুকে পড়েছে ইউক্রেনে। এটা এখন আর নতুন খবর নয়। যুদ্ধ কোনদিকে মোড় নেবে, তা নিয়েও চলবে বিচার-বিশ্লেষণ। কিন্তু কী করে রাশিয়া-ইউক্রেনের সম্পর্ক এই নাজুক পর্যায়ে পৌঁছাল, সে বিষয়ে একটু জেনে নেওয়া যাক। ছাড়া-ছাড়াভাবে তা বলা হয়েছে অনেকবার। কিন্তু একসঙ্গে পুরো ঘটনাটা দেখতে গেলে আমাদের যেতে হবে একেবারে ১৯৯২ সালে। এই পথটুকু পিছিয়ে না গেলে আজকের ২০২২ সালের সংকটটি বুঝতে পারা যাবে না।
আমরা তো ইতিমধ্যে জেনে গেছি, ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ‘কিয়েভ রুস’-এর প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। যখন এখনকার রাশিয়া ও ইউক্রেন দুটো দেশই ছিল কিয়েভ রুশের অংশ। বেলারুসকেও এর বাইরে রাখা যাবে না।
তবে রুশ প্রেসিডেন্ট তাঁর ভাষণে এ কথাও বলেছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মানুষ সব সময় একরকম করে ভাবেনি। তাই তাদের চলার পথও সব সময় একদিকে হয়েছে এমনও নয়। ফলে তৈরি হয়েছে দুটো ভাষা, দুটো সংস্কৃতি। দুই জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি দুই ধরনের বটে, কিন্তু তারা একই পরিবারভুক্ত।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর যখন রাশিয়া ও ইউক্রেন—এই দুই দেশের জন্ম হলো, তখন রাজনৈতিকভাবে দুই দেশের মধ্যে একটি পার্থক্য গড়ে উঠল। কিয়েভ এবার হাঁটতে চাইল পশ্চিম ইউরোপের দেখানো পথে। মস্কোকে এড়িয়ে কিয়েভের এই পথচলা ভালো লাগেনি মস্কোর।
বর্তমান যুদ্ধ আসলে বিগত ৩০ বছরের রাজনীতির সরাসরি ফল। তিনটি ধাপে এই সময়কে ভাগ করলে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট বোঝা সহজ হবে।
প্রথম ধাপ: ১৯৯২-২০০৩
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে বেলারুসের এক খামারবাড়িতে রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুসের তিন প্রেসিডেন্ট এক বৈঠক করেন। প্রাসাদোপম সেই বাড়িতে ছিল বিলাসের সব আয়োজন। সেখানে বসেই এই তিন নেতা (রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ক্রাভচুক ও বেলারুসের প্রেসিডেন্ট স্তালিস্লাভ শুশকিয়েভিচ) সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার বিষয়ে কথা বলেন। মনে রাখতে হবে, তত দিনে বার্লিন দেওয়াল ভেঙে গেছে ঠিকই, কিন্তু টিকে আছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট তখনো মিখাইল সের্গিয়েভিচ গরবাচেভ।
এই তিন প্রেসিডেন্ট নিজেদের মধ্যে একটি হালকা সম্পর্ক বজায় রেখে আলাদা হয়ে যাওয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন। স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর একটি কমনওয়েলথ তৈরি করা হলো আলমাআতা চুক্তির মাধ্যমে, যেখানে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ১১টি দেশ স্বাক্ষর করল। প্রি-বাল্টিকের তিনটি দেশ আগেই বের হয়ে গিয়েছিল। এই চুক্তিতে জর্জিয়া স্বাক্ষর করেনি।
চুক্তি সাক্ষর হওয়ার পর গর্বাচেভ হয়ে গেলেন নিধিরাম সর্দার। তাঁর হাতে আর কোনো ক্ষমতা রইল না।
ইউক্রেন তখন থেকেই পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে ছিল। ক্রেমলিন, অর্থাৎ রুশদের জন্য তা ছিল বিড়ম্বনার। মনে রাখতে হবে, সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরাধিকার হিসেবে ইউক্রেনে ১০ লাখ সোভিয়েত সেনা ছিল, ছিল পরমাণু অস্ত্রের একটি বড় অংশ। মিসাইলগুলো ইউক্রেন আর নিজের দখলে রাখেনি। তারা তা রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করে নিজেদের জন্য চেয়েছে নিরাপত্তার গ্যারান্টি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা। কিন্তু এখানে বলতে হবে, পারমাণবিক অস্ত্র না রাখলেও পারমাণবিক স্থাপনাগুলো কিন্তু রয়ে গেছে। যে কারণে ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত হলে সেই স্থাপনাগুলোয় আবার পারমাণবিক অস্ত্র রাখা যাবে, সেই আশঙ্কা আছে। সেটা রাশিয়ার মাথাব্যাথার কারণ হতে পারে।
যত দিন পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনের বিষয়ে সরাসরি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, তত দিন পর্যন্ত রাশিয়া ইউক্রেনের ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। সে সময় দুই দেশের মধ্যে কোনো সংঘর্ষও হয়নি। তবে এ জায়গায় একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হবে। ১৯৯২ সালে যখন চেরনোমোরস্কি ফ্লোতের (ফ্লিট) একটি জাহাজে ইউক্রেনের পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং সেই যুদ্ধজাহাজ সেভাস্তাপোল থেকে ওদেসায় চলে যায়। সে সময় গোলাগুলির কিছু ঘটনা ঘটেছিল, কিন্তু বর্তমান সংকটের তুলনায় তা ছিল মামুলি।
মনে রাখতে হবে, সে সময় রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবে ছিল খুব দুর্বল একটি দেশ। চেচেন যুদ্ধ তাদের অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে দিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে চেরনোমোরস্কি ফ্লোত (ফ্লিট) ভাগাভাগি করে নেওয়ার সময় রাশিয়া মেনে নিল ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তরেখা। তখন ক্রিমিয়া ছিল ইউক্রেনের অংশ।
এখানে আরেকটি ব্যাপার না বললেই নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ইউক্রেন রুশ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি খুবই নির্দয় হয়ে উঠেছিল। অকারণ জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে তারা ইউক্রেনের স্কুলগুলো থেকে রুশ ভাষা উঠিয়ে দিয়েছিল। এটা খুব ভালো কাজ হয়নি। ইউক্রেনে স্বাভাবিক কারণেই রুশ জাতির মানুষের সংখ্যা কম নয়। বিশেষ করে পূর্ব ইউক্রেনে। তাদের জন্য এ ছিল এক বড় ধরনের অপমান। সে কথা ইউক্রেনের সরকারগুলো কখনোই আমলে নেয়নি। ফলে পরবর্তীকালে ইউক্রেনের যে শহর বা অঞ্চলগুলোয় রুশ জাতির মানুষ বেশি, সেসব অঞ্চলে ইউক্রেন থেকে বিযুক্ত হওয়ার আন্দোলন সুদৃঢ় হয়েছে।
দ্বিতীয় ধাপ: সোভিয়েত-পরবর্তী সময়ের বন্ধুত্বে ছেদরেখা
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে প্রথম বড় ধরনের সংকট শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালে। ভ্লাদিমির পুতিনই তখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। রাশিয়া তখন ইউক্রেনের তুজলা দ্বীপের কেরচেন প্রণালিতে একটা বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে। ইউক্রেন অভিযোগ করে, এটা ইউক্রেনের সীমান্তের অভ্যন্তরের এলাকা। রুশ এলাকা নয়। দুই দেশের প্রেসিডেন্ট বৈঠক করার পর এই সংকটের নিরসন হয়। বাঁধ তৈরির কাজ বন্ধ করে রাশিয়া। কিন্তু দুই দেশের সম্পর্কে প্রথমবারের মতো বড় ধরনের চিড় ধরে।
২০০৪ সালে ইউক্রেনের নির্বাচনে রাশিয়া তাদের অনুসারী ভিক্তর ইয়ানুকোভিচকে সমর্থন দেয়। কিন্তু সে সময় ইউক্রেনের ‘কমলা বিপ্লব’ ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতায় বসতে দেয়নি। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ইউক্রেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন পশ্চিমের দিকে হেলে থাকা ভিক্তর ইউশেঙ্কো। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্ক নতুন দিকে মোড় নেয়। ইউশেঙ্কোর শাসনামলে রাশিয়া ২০০৬ ও ২০০৯ সালে দুবার তেলের পাইপলাইন বন্ধ করে দেয়। ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি বিঘ্নিত হয়।
রাশিয়া এখন সমুদ্রের অভ্যন্তর দিয়ে আরেকটি পাইপলাইন তৈরি করছে, যা ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে যাবে না। এটা তৈরি হলে ইউরোপে তেল রপ্তানির সময় রাশিয়াকে ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে তেল প্রবাহিত করতে হবে না। এটা ইউক্রেনের জন্য মাথাব্যথার কারণ। এই খাতে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার সমাগম ঘটে।
বর্তমান সংকটকে বুঝতে হলে ২০০৮ সালে ঘটা একটি ঘটনার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সে বছর ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণের পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। পুতিন এই পরিকল্পনার কড়া প্রতিবাদ করেছিলেন। মস্কো তখন বলেছিল, ইউক্রেনকে পূর্ণ স্বাধীন দেশ হিসেবে তারা স্বীকার করে না। এরপর ফ্রান্স ও জার্মানি জর্জ বুশের এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়া হবে—এ কথা বলা হয় ঠিকই, তবে সেটা কবে দেওয়া হবে, তা উল্লেখ করা হয় না।
ন্যাটোতে যোগ দেওয়া হলো না বলে ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করার প্রয়াস নিয়েছিল ২০১৩ সালে। রাশিয়া তখন ইউক্রেনের সীমান্তগুলো বন্ধ করে দেয়। রপ্তানির পথ বন্ধ হয়ে যায় ইউক্রেনের। ফলে ইউক্রেন ব্রাসেলস চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। রাশিয়ার চাপে পড়েই তারা চুক্তি সই করছে না, তা জানিয়ে দেয়। ২০১০ সালে ইয়ানুকোভিচ প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনিই এই কাজ করেন। তাতে ইউক্রেনজুড়ে বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভের তোড়ে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ায় পালিয়ে যান।
পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়া এ কথাই প্রচার করে। কিন্তু তারা একবারও বলে না, ইউক্রেনে ‘বিপ্লব’ আমদানি করার জন্য, তথা ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র কত টাকা খরচ করেছে। মার্কিনরাই এখন সে কথা বলছে। ইন্টারনেট ঘাটলে সে তথ্য হাজির হবে আপনার সামনে।
তৃতীয় ধাপ: ২০১৪-২০২১
এই সময়টিকে বলতে হবে ক্রিমিয়া ও দোনবাসের সময়। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়াকে নিজের অংশ করে নেয়। সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ১৯৫৪ সালে ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অংশ করে দেন। তার আগে এটা ছিল রাশিয়ার অংশ। এ সময় রাশিয়া আবার ক্রিমিয়ার দখল নিয়ে নিল।
একই সঙ্গে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে দোনবাসে (দানিয়েৎস্ক অঞ্চলে) বিচ্ছিন্নতাবাদে মদদও দিয়েছে রাশিয়া। ফলে ‘লুগানস্ক প্রজাতন্ত্র’ ও ‘দানিয়েৎস্ক প্রজাতন্ত্র’ নামে দুটো প্রজাতন্ত্রের ঘোষণা দেয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। কিয়েভ তার প্রতিক্রিয়া দেখায় খুব ধীরলয়ে। প্রথমে দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তারপর ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান’ নাম দিয়ে এসব এলাকায় সৈন্য পাঠিয়ে দেয়। তারা যথেষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ইউক্রেনের রুশ বংশোদ্ভূত নাগরিকেরা তাতে প্রচণ্ড আঘাত পায়। তারা নিজেদের অসহায়ত্ব বুঝতে পারে। ইউক্রেন সরকার যে নিজ দেশের রুশ বংশোদ্ভূত নাগরিকদের ব্যাপারে উদাসীন, সেটা অনুভব করে তারা।
২০১৪ সালে নরম্যান্ডি চুক্তির ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট পিওতর পারাশেঙ্কোর। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ছিলেন ফ্রান্স ও জার্মানির নেতারা। সেখানে রুশ ও ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট একটা সমঝোতা চুক্তি করেন। তবে এর পর শুরু হয় মজার ব্যাপার। ইউক্রেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোনঠাসা করে ফেলে। তারা প্রবল বিক্রমে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতিরোধ চূর্ণ করে দিতে থাকে। কিন্তু আগস্ট মাসে রাশিয়ার সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নিশ্বাস ফেলার সুযোগ পায়। ইউক্রেন হেরে যায় ইলোভাইস্কির যুদ্ধে। এখানেই সংকট ঘণীভূত হয়। সেপ্টেম্বরে মিনস্কে দু দেশ শান্তি চুক্তি করে। কিন্তু শান্তির দেখা আর মেলেনি।
২০১৫ সাল থেকে অবস্থানগত যুদ্ধ শুরু হয়। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যুদ্ধে নানা ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে। ইউক্রেন অভিযোগ করে, এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে ছদ্মবেশী রুশ সেনা সদস্যরা রয়েছে। রাশিয়া তা অস্বীকার করে। দেবালৎসেভা শহরের কাছে ইউক্রেনীয় বাহিনী পরাজিত হয়। তখন ফ্রান্স ও জার্মানির সহায়তায় ‘মিনস্ক-২’ নামে আরেকটি চুক্তি সম্পাদন করে রাশিয়া ও ইউক্রেন।
২০১৯ সালে শেষবার একটি অগ্রগতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। গ্রীষ্ম এবং শরৎকালে দুই দেশই সম্মত হয়ে বেশ কয়েকটি এলাকায় নিজেদের বাহিনী প্রত্যাহারের বিষয়টি বাস্তবায়ন করেছিল। কিন্তু প্যারিসে নরম্যান্ডি ফরম্যাটের শীর্ষ সম্মেলনের পর আর কোনো বৈঠক হয়নি। রাশিয়া ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে অস্বীকার করেছিল। রাশিয়া ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ‘মিনস্ক-২’ বাস্তবায়নে ব্যর্থতার অভিযোগ আনে। ২০২১ সালে, রাশিয়ান ফেডারেশন দুবার ইউক্রেনের সীমানায় সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছিল; বসন্ত এবং শরতের শেষের দিকে।
একই বছরের ডিসেম্বরে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রথমবারের মতো ইউক্রেন এবং অন্যান্য সোভিয়েত-পরবর্তী দেশগুলোকে জোটে গ্রহণ না করার এবং তাদের সামরিক সহায়তা না দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোকে একটি আল্টিমেটাম জারি করেন। জোট সে আলটিমেটাম প্রত্যাখ্যান করে। ন্যাটো জোট আরও পূর্বদিকে সম্প্রসারিত হয়েছিল। এটা রাশিয়ার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন বৈকি। কিন্তু ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো তা আমলে নেয়নি।
অতঃপর ২০২২: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ
দানিয়েৎস্ক প্রজাতন্ত্র ও লুগানস্ক প্রজাতন্ত্রকে এ বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি দিয়েছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই দুই প্রজাতন্ত্রই রাশিয়া-লাগোয়া এবং ইউক্রেনের অংশ। রুশ প্রেসিডেন্টের এ স্বীকৃতি ইতিমধ্যেই রুশ আইনসভায় অনুমোদন পেয়েছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোর বেলায় রুশ নেতা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জানিয়েছেন, রুশ ফেডারেশন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। এই হামলা শুধু লুগানস্ক ও দানিয়েৎস্কেই চালানো হচ্ছে না, রুশ সেনারা ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে বোমা হামলা শুরু করেছে।
এই যুদ্ধ কোনদিকে যাবে, তা এখনই বলে দেওয়া যাবে না। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আসছে। কিন্তু রাশিয়া এরই মধ্যে নিজেদের রিজার্ভ নিয়ে গেছে শক্ত অবস্থানে। তবে যুদ্ধ যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়, তাহলে রাশিয়া সংকটে পড়তে পারে। অন্যদিকে ন্যাটো শুধু বৈঠক করে যাবে, নাকি ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো অস্ত্র হাতে ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়াবে, সেটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে যুদ্ধের কয়েকদিনের মধ্যেই। আপাতত তেমন কোনো ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি প্রথমে ন্যাটোর আচরণে আক্ষেপ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং এখন শান্তির কথা বলছেন। রাশিয়া এখনো থামেনি। তাই এখনো যতি চিহ্ন টানা যাচ্ছে না।
আর একটা কথা না বললেই নয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা কমছে, রাশিয়ায় পুতিনও চলছেন একনায়কত্বে বলীয়ান হয়ে, জনসমর্থনের ধার না ধেরে। তাঁরা দুজনই নতুন করে জনপ্রিয়তা বাড়াতে চান। তাঁদের এই জনপ্রিয়তা বাড়ানোর বলি হলো কিনা ইউক্রেন, সেটাও একটা প্রশ্ন বটে!
যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। রুশ বাহিনী ঢুকে পড়েছে ইউক্রেনে। এটা এখন আর নতুন খবর নয়। যুদ্ধ কোনদিকে মোড় নেবে, তা নিয়েও চলবে বিচার-বিশ্লেষণ। কিন্তু কী করে রাশিয়া-ইউক্রেনের সম্পর্ক এই নাজুক পর্যায়ে পৌঁছাল, সে বিষয়ে একটু জেনে নেওয়া যাক। ছাড়া-ছাড়াভাবে তা বলা হয়েছে অনেকবার। কিন্তু একসঙ্গে পুরো ঘটনাটা দেখতে গেলে আমাদের যেতে হবে একেবারে ১৯৯২ সালে। এই পথটুকু পিছিয়ে না গেলে আজকের ২০২২ সালের সংকটটি বুঝতে পারা যাবে না।
আমরা তো ইতিমধ্যে জেনে গেছি, ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ‘কিয়েভ রুস’-এর প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। যখন এখনকার রাশিয়া ও ইউক্রেন দুটো দেশই ছিল কিয়েভ রুশের অংশ। বেলারুসকেও এর বাইরে রাখা যাবে না।
তবে রুশ প্রেসিডেন্ট তাঁর ভাষণে এ কথাও বলেছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মানুষ সব সময় একরকম করে ভাবেনি। তাই তাদের চলার পথও সব সময় একদিকে হয়েছে এমনও নয়। ফলে তৈরি হয়েছে দুটো ভাষা, দুটো সংস্কৃতি। দুই জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি দুই ধরনের বটে, কিন্তু তারা একই পরিবারভুক্ত।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর যখন রাশিয়া ও ইউক্রেন—এই দুই দেশের জন্ম হলো, তখন রাজনৈতিকভাবে দুই দেশের মধ্যে একটি পার্থক্য গড়ে উঠল। কিয়েভ এবার হাঁটতে চাইল পশ্চিম ইউরোপের দেখানো পথে। মস্কোকে এড়িয়ে কিয়েভের এই পথচলা ভালো লাগেনি মস্কোর।
বর্তমান যুদ্ধ আসলে বিগত ৩০ বছরের রাজনীতির সরাসরি ফল। তিনটি ধাপে এই সময়কে ভাগ করলে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট বোঝা সহজ হবে।
প্রথম ধাপ: ১৯৯২-২০০৩
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে বেলারুসের এক খামারবাড়িতে রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুসের তিন প্রেসিডেন্ট এক বৈঠক করেন। প্রাসাদোপম সেই বাড়িতে ছিল বিলাসের সব আয়োজন। সেখানে বসেই এই তিন নেতা (রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ক্রাভচুক ও বেলারুসের প্রেসিডেন্ট স্তালিস্লাভ শুশকিয়েভিচ) সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার বিষয়ে কথা বলেন। মনে রাখতে হবে, তত দিনে বার্লিন দেওয়াল ভেঙে গেছে ঠিকই, কিন্তু টিকে আছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট তখনো মিখাইল সের্গিয়েভিচ গরবাচেভ।
এই তিন প্রেসিডেন্ট নিজেদের মধ্যে একটি হালকা সম্পর্ক বজায় রেখে আলাদা হয়ে যাওয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন। স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর একটি কমনওয়েলথ তৈরি করা হলো আলমাআতা চুক্তির মাধ্যমে, যেখানে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ১১টি দেশ স্বাক্ষর করল। প্রি-বাল্টিকের তিনটি দেশ আগেই বের হয়ে গিয়েছিল। এই চুক্তিতে জর্জিয়া স্বাক্ষর করেনি।
চুক্তি সাক্ষর হওয়ার পর গর্বাচেভ হয়ে গেলেন নিধিরাম সর্দার। তাঁর হাতে আর কোনো ক্ষমতা রইল না।
ইউক্রেন তখন থেকেই পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে ছিল। ক্রেমলিন, অর্থাৎ রুশদের জন্য তা ছিল বিড়ম্বনার। মনে রাখতে হবে, সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরাধিকার হিসেবে ইউক্রেনে ১০ লাখ সোভিয়েত সেনা ছিল, ছিল পরমাণু অস্ত্রের একটি বড় অংশ। মিসাইলগুলো ইউক্রেন আর নিজের দখলে রাখেনি। তারা তা রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করে নিজেদের জন্য চেয়েছে নিরাপত্তার গ্যারান্টি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা। কিন্তু এখানে বলতে হবে, পারমাণবিক অস্ত্র না রাখলেও পারমাণবিক স্থাপনাগুলো কিন্তু রয়ে গেছে। যে কারণে ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত হলে সেই স্থাপনাগুলোয় আবার পারমাণবিক অস্ত্র রাখা যাবে, সেই আশঙ্কা আছে। সেটা রাশিয়ার মাথাব্যাথার কারণ হতে পারে।
যত দিন পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনের বিষয়ে সরাসরি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, তত দিন পর্যন্ত রাশিয়া ইউক্রেনের ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। সে সময় দুই দেশের মধ্যে কোনো সংঘর্ষও হয়নি। তবে এ জায়গায় একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হবে। ১৯৯২ সালে যখন চেরনোমোরস্কি ফ্লোতের (ফ্লিট) একটি জাহাজে ইউক্রেনের পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং সেই যুদ্ধজাহাজ সেভাস্তাপোল থেকে ওদেসায় চলে যায়। সে সময় গোলাগুলির কিছু ঘটনা ঘটেছিল, কিন্তু বর্তমান সংকটের তুলনায় তা ছিল মামুলি।
মনে রাখতে হবে, সে সময় রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবে ছিল খুব দুর্বল একটি দেশ। চেচেন যুদ্ধ তাদের অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে দিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে চেরনোমোরস্কি ফ্লোত (ফ্লিট) ভাগাভাগি করে নেওয়ার সময় রাশিয়া মেনে নিল ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তরেখা। তখন ক্রিমিয়া ছিল ইউক্রেনের অংশ।
এখানে আরেকটি ব্যাপার না বললেই নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ইউক্রেন রুশ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি খুবই নির্দয় হয়ে উঠেছিল। অকারণ জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে তারা ইউক্রেনের স্কুলগুলো থেকে রুশ ভাষা উঠিয়ে দিয়েছিল। এটা খুব ভালো কাজ হয়নি। ইউক্রেনে স্বাভাবিক কারণেই রুশ জাতির মানুষের সংখ্যা কম নয়। বিশেষ করে পূর্ব ইউক্রেনে। তাদের জন্য এ ছিল এক বড় ধরনের অপমান। সে কথা ইউক্রেনের সরকারগুলো কখনোই আমলে নেয়নি। ফলে পরবর্তীকালে ইউক্রেনের যে শহর বা অঞ্চলগুলোয় রুশ জাতির মানুষ বেশি, সেসব অঞ্চলে ইউক্রেন থেকে বিযুক্ত হওয়ার আন্দোলন সুদৃঢ় হয়েছে।
দ্বিতীয় ধাপ: সোভিয়েত-পরবর্তী সময়ের বন্ধুত্বে ছেদরেখা
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে প্রথম বড় ধরনের সংকট শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালে। ভ্লাদিমির পুতিনই তখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। রাশিয়া তখন ইউক্রেনের তুজলা দ্বীপের কেরচেন প্রণালিতে একটা বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে। ইউক্রেন অভিযোগ করে, এটা ইউক্রেনের সীমান্তের অভ্যন্তরের এলাকা। রুশ এলাকা নয়। দুই দেশের প্রেসিডেন্ট বৈঠক করার পর এই সংকটের নিরসন হয়। বাঁধ তৈরির কাজ বন্ধ করে রাশিয়া। কিন্তু দুই দেশের সম্পর্কে প্রথমবারের মতো বড় ধরনের চিড় ধরে।
২০০৪ সালে ইউক্রেনের নির্বাচনে রাশিয়া তাদের অনুসারী ভিক্তর ইয়ানুকোভিচকে সমর্থন দেয়। কিন্তু সে সময় ইউক্রেনের ‘কমলা বিপ্লব’ ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতায় বসতে দেয়নি। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ইউক্রেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন পশ্চিমের দিকে হেলে থাকা ভিক্তর ইউশেঙ্কো। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্ক নতুন দিকে মোড় নেয়। ইউশেঙ্কোর শাসনামলে রাশিয়া ২০০৬ ও ২০০৯ সালে দুবার তেলের পাইপলাইন বন্ধ করে দেয়। ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি বিঘ্নিত হয়।
রাশিয়া এখন সমুদ্রের অভ্যন্তর দিয়ে আরেকটি পাইপলাইন তৈরি করছে, যা ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে যাবে না। এটা তৈরি হলে ইউরোপে তেল রপ্তানির সময় রাশিয়াকে ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে তেল প্রবাহিত করতে হবে না। এটা ইউক্রেনের জন্য মাথাব্যথার কারণ। এই খাতে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার সমাগম ঘটে।
বর্তমান সংকটকে বুঝতে হলে ২০০৮ সালে ঘটা একটি ঘটনার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সে বছর ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণের পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। পুতিন এই পরিকল্পনার কড়া প্রতিবাদ করেছিলেন। মস্কো তখন বলেছিল, ইউক্রেনকে পূর্ণ স্বাধীন দেশ হিসেবে তারা স্বীকার করে না। এরপর ফ্রান্স ও জার্মানি জর্জ বুশের এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়া হবে—এ কথা বলা হয় ঠিকই, তবে সেটা কবে দেওয়া হবে, তা উল্লেখ করা হয় না।
ন্যাটোতে যোগ দেওয়া হলো না বলে ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করার প্রয়াস নিয়েছিল ২০১৩ সালে। রাশিয়া তখন ইউক্রেনের সীমান্তগুলো বন্ধ করে দেয়। রপ্তানির পথ বন্ধ হয়ে যায় ইউক্রেনের। ফলে ইউক্রেন ব্রাসেলস চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। রাশিয়ার চাপে পড়েই তারা চুক্তি সই করছে না, তা জানিয়ে দেয়। ২০১০ সালে ইয়ানুকোভিচ প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনিই এই কাজ করেন। তাতে ইউক্রেনজুড়ে বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভের তোড়ে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ায় পালিয়ে যান।
পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়া এ কথাই প্রচার করে। কিন্তু তারা একবারও বলে না, ইউক্রেনে ‘বিপ্লব’ আমদানি করার জন্য, তথা ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র কত টাকা খরচ করেছে। মার্কিনরাই এখন সে কথা বলছে। ইন্টারনেট ঘাটলে সে তথ্য হাজির হবে আপনার সামনে।
তৃতীয় ধাপ: ২০১৪-২০২১
এই সময়টিকে বলতে হবে ক্রিমিয়া ও দোনবাসের সময়। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়াকে নিজের অংশ করে নেয়। সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ১৯৫৪ সালে ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অংশ করে দেন। তার আগে এটা ছিল রাশিয়ার অংশ। এ সময় রাশিয়া আবার ক্রিমিয়ার দখল নিয়ে নিল।
একই সঙ্গে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে দোনবাসে (দানিয়েৎস্ক অঞ্চলে) বিচ্ছিন্নতাবাদে মদদও দিয়েছে রাশিয়া। ফলে ‘লুগানস্ক প্রজাতন্ত্র’ ও ‘দানিয়েৎস্ক প্রজাতন্ত্র’ নামে দুটো প্রজাতন্ত্রের ঘোষণা দেয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। কিয়েভ তার প্রতিক্রিয়া দেখায় খুব ধীরলয়ে। প্রথমে দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তারপর ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান’ নাম দিয়ে এসব এলাকায় সৈন্য পাঠিয়ে দেয়। তারা যথেষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ইউক্রেনের রুশ বংশোদ্ভূত নাগরিকেরা তাতে প্রচণ্ড আঘাত পায়। তারা নিজেদের অসহায়ত্ব বুঝতে পারে। ইউক্রেন সরকার যে নিজ দেশের রুশ বংশোদ্ভূত নাগরিকদের ব্যাপারে উদাসীন, সেটা অনুভব করে তারা।
২০১৪ সালে নরম্যান্ডি চুক্তির ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট পিওতর পারাশেঙ্কোর। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ছিলেন ফ্রান্স ও জার্মানির নেতারা। সেখানে রুশ ও ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট একটা সমঝোতা চুক্তি করেন। তবে এর পর শুরু হয় মজার ব্যাপার। ইউক্রেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোনঠাসা করে ফেলে। তারা প্রবল বিক্রমে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতিরোধ চূর্ণ করে দিতে থাকে। কিন্তু আগস্ট মাসে রাশিয়ার সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নিশ্বাস ফেলার সুযোগ পায়। ইউক্রেন হেরে যায় ইলোভাইস্কির যুদ্ধে। এখানেই সংকট ঘণীভূত হয়। সেপ্টেম্বরে মিনস্কে দু দেশ শান্তি চুক্তি করে। কিন্তু শান্তির দেখা আর মেলেনি।
২০১৫ সাল থেকে অবস্থানগত যুদ্ধ শুরু হয়। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যুদ্ধে নানা ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে। ইউক্রেন অভিযোগ করে, এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে ছদ্মবেশী রুশ সেনা সদস্যরা রয়েছে। রাশিয়া তা অস্বীকার করে। দেবালৎসেভা শহরের কাছে ইউক্রেনীয় বাহিনী পরাজিত হয়। তখন ফ্রান্স ও জার্মানির সহায়তায় ‘মিনস্ক-২’ নামে আরেকটি চুক্তি সম্পাদন করে রাশিয়া ও ইউক্রেন।
২০১৯ সালে শেষবার একটি অগ্রগতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। গ্রীষ্ম এবং শরৎকালে দুই দেশই সম্মত হয়ে বেশ কয়েকটি এলাকায় নিজেদের বাহিনী প্রত্যাহারের বিষয়টি বাস্তবায়ন করেছিল। কিন্তু প্যারিসে নরম্যান্ডি ফরম্যাটের শীর্ষ সম্মেলনের পর আর কোনো বৈঠক হয়নি। রাশিয়া ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে অস্বীকার করেছিল। রাশিয়া ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ‘মিনস্ক-২’ বাস্তবায়নে ব্যর্থতার অভিযোগ আনে। ২০২১ সালে, রাশিয়ান ফেডারেশন দুবার ইউক্রেনের সীমানায় সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছিল; বসন্ত এবং শরতের শেষের দিকে।
একই বছরের ডিসেম্বরে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রথমবারের মতো ইউক্রেন এবং অন্যান্য সোভিয়েত-পরবর্তী দেশগুলোকে জোটে গ্রহণ না করার এবং তাদের সামরিক সহায়তা না দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোকে একটি আল্টিমেটাম জারি করেন। জোট সে আলটিমেটাম প্রত্যাখ্যান করে। ন্যাটো জোট আরও পূর্বদিকে সম্প্রসারিত হয়েছিল। এটা রাশিয়ার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন বৈকি। কিন্তু ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো তা আমলে নেয়নি।
অতঃপর ২০২২: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ
দানিয়েৎস্ক প্রজাতন্ত্র ও লুগানস্ক প্রজাতন্ত্রকে এ বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি দিয়েছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই দুই প্রজাতন্ত্রই রাশিয়া-লাগোয়া এবং ইউক্রেনের অংশ। রুশ প্রেসিডেন্টের এ স্বীকৃতি ইতিমধ্যেই রুশ আইনসভায় অনুমোদন পেয়েছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোর বেলায় রুশ নেতা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জানিয়েছেন, রুশ ফেডারেশন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। এই হামলা শুধু লুগানস্ক ও দানিয়েৎস্কেই চালানো হচ্ছে না, রুশ সেনারা ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে বোমা হামলা শুরু করেছে।
এই যুদ্ধ কোনদিকে যাবে, তা এখনই বলে দেওয়া যাবে না। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আসছে। কিন্তু রাশিয়া এরই মধ্যে নিজেদের রিজার্ভ নিয়ে গেছে শক্ত অবস্থানে। তবে যুদ্ধ যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়, তাহলে রাশিয়া সংকটে পড়তে পারে। অন্যদিকে ন্যাটো শুধু বৈঠক করে যাবে, নাকি ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো অস্ত্র হাতে ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়াবে, সেটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে যুদ্ধের কয়েকদিনের মধ্যেই। আপাতত তেমন কোনো ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি প্রথমে ন্যাটোর আচরণে আক্ষেপ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং এখন শান্তির কথা বলছেন। রাশিয়া এখনো থামেনি। তাই এখনো যতি চিহ্ন টানা যাচ্ছে না।
আর একটা কথা না বললেই নয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা কমছে, রাশিয়ায় পুতিনও চলছেন একনায়কত্বে বলীয়ান হয়ে, জনসমর্থনের ধার না ধেরে। তাঁরা দুজনই নতুন করে জনপ্রিয়তা বাড়াতে চান। তাঁদের এই জনপ্রিয়তা বাড়ানোর বলি হলো কিনা ইউক্রেন, সেটাও একটা প্রশ্ন বটে!
শেখ হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে এ দেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে শাসন করেছে। মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ কনসেপ্ট। এটার সবচেয়ে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা হলো, এটা একটা গড়, যেটা স্বল্পসংখ্যক ধনী এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন-মধ্যবিত্ত
১ দিন আগেআমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীকে জলবায়ু-বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’-এর ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
১ দিন আগেআমেরিকার ১৩২ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম মেয়াদে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ট্রাম্প।
১ দিন আগেজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড্ড কষ্ট বুকে নিয়েই ‘সব শালারা বাটপার’ স্লোগানটি দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা দ্বিতীয় ক্যাম্পাস পাচ্ছেন না। ঠিকাদারেরা ভেলকিবাজি করছেন।ক্যাম্পাসের জন্য জমিও অধিগ্রহণ করা হয়নি।
১ দিন আগে