মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নীতি, পরিকল্পনা ও কৌশলে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রথমত, বর্তমান মন্ত্রিসভায় প্রয়োজনে দায়িত্ব পুনর্বণ্টন এবং দুর্বল অবস্থানে সবলের দৃঢ় ভূমিকা নেওয়ার ব্যবস্থা তৈরি করা একান্ত জরুরি।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার অষ্টমী থেকে বিজয়া দশমী এবং এরপর দেশব্যাপী যেসব আক্রমণ, ধর্মের অবমাননার অভিযোগ, তাণ্ডব, মন্দির, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া, বিপণিবিতানে লুটপাট এবং নিরীহ মানুষ হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে সচেতন মহল লজ্জাবোধ করলেও; যাঁরা এসবকে অপরাধ মনে করেন না, তাঁদের কিছু যায়-আসে না। বরং তাঁরা মনে মনে হিন্দুদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার মনোভাব চেপে ধরে রাখছেন! হয়তো প্রকাশ এখন আর করছেন না। তবে সুবিধামতো সময়ে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটবে না—এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। করোনার সংক্রমণ অনেকটা কমে আসা স্পষ্ট হওয়ার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা ছড়াতে থাকে। তবে জাতীয় প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটি এবং দলীয় অফিসে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে গতবারের মতো সরকার উৎখাত, গণ-অভ্যুত্থান, পালানোর পথ না পাওয়া ইত্যাদি বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। এখন অবশ্য রাজনীতির জন্য জেলায় জেলায় সফর, জনসভা, বক্তৃতা প্রভৃতির খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে না। ঢাকায় এতসব বেসরকারি টিভি চ্যানেল রয়েছে, এর বাইরে নানা ধরনের তথাকথিত সোশ্যাল মিডিয়া তো রয়েছেই। এগুলোতেই নেতাদের বক্তৃতা আর কিছু কর্মীর হাততালির দৃশ্য প্রচারিত হলেই দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া বক্তব্য দলীয় নেতা-কর্মীদের জানার মধ্যেই চলে যায়। ডিজিটাল বাংলাদেশে এখন তাই বড় রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না, তেমন বেশি পয়সাও খরচ করতে হয় না।
পূজার আগেই মনে হয়েছিল, দেশে আন্দোলনের উত্তাপ ছড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। গতবার বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে ছড়ানো উত্তেজনা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, সরকারকে ফেলে দেওয়ার মনোভাব প্রকাশ্যেই দেখা গেছে। এখন যেই উত্তেজনা মাত্র শুরু হয়েছিল, তা দেখে মনে হয়েছিল দুই বছর পরের নির্বাচনের আগেই দেশে ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির একটা মহড়া হয়তো শুরু হচ্ছে। বিরোধী দল এবার সরকারকে ছেড়ে দেবে না—এমন কথা প্রতিদিনই উচ্চারণ করছে। বিএনপি গণমাধ্যমে সে ধরনের বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে বলেই আমরা জানতে পারছি। কিন্তু জামায়াত দীর্ঘদিন ধরে নীরব রয়েছে। প্রকাশ্যে আসে না, কথাও বলে না। তবে জামায়াতের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা মোটেও বসে নেই। গ্রামগঞ্জে তাদের কর্মীদের যাতায়াত অনেকটাই গোপনে হলেও নিয়মিত, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
জামায়াতের নেতা-কর্মীদের কাছে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রস্তুতি গ্রহণের নানা পরামর্শ আসছে বলে বিভিন্ন দিক থেকে শোনা যাচ্ছে; কিন্তু তাদের অনেক কিছুই এখন আগের মতো প্রকাশ্যে জানা যাবে না। তারা বেশ কৌশলী হয়ে পড়েছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ছাড়া অন্য কারও পক্ষে জামায়াতের প্রস্তুতি সম্পর্কে আগেভাগে জানা যাবে না। কিন্তু তারা আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে জিতিয়ে আনার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করছে—এমনটি দেশে-বিদেশে অবস্থানরত তাদের প্রচারমাধ্যমে জানা যাচ্ছে।
অন্যদিকে হেফাজতে ইসলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার পর কিছুটা দ্বিধাবিভক্ত হলেও সরকারের বিরুদ্ধে তাদের মনোভাব জামায়াতের চেয়ে কোনো অংশেই ভিন্নতর কিছু নয় বলেই মনে হয়। এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে এসে হঠাৎ দুর্গাপূজায় কুমিল্লার নানুয়া দিঘির পাড়ে পূজামণ্ডপে মুসলমানদের পবিত্র কোরআন মূর্তির পায়ের কাছে বসিয়ে যে ধর্মানুভূতির আবেগ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে, সেটি বিশেষভাবে মনোযোগের দাবি রাখে। ঘটনাটি যে খুব পরিকল্পিত ও নিপুণ হাতে করা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই একটি ঘটনাই গোটা দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট ছিল। কুমিল্লায় পরিস্থিতি যতটা নাজুক হওয়ার ধারণা করা হয়েছিল, ততটা হতে পারেনি। তবে হাজীগঞ্জ, চৌমুহনী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, সিলেটের হবিগঞ্জ এবং সবশেষে রংপুরের পীরগঞ্জে এর থাবা যেভাবে পড়েছিল, তাতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শুধু পূজাই পণ্ড হয়নি; জীবন, ঘরবাড়ি, সম্পদ এবং মনও ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। দেশে প্রায় ২০টি জেলায় ছোট-বড় আকারে অসংখ্য হামলা ঘটেছে। এতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর মহলবিশেষের গোসসা যেমন প্রকাশিত হয়েছে, আবার লুটপাটকারীদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণও ঘটেছে।
বেশ কিছুদিন ধরেই রাজনীতিসচেতন মহল দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা শঙ্কা প্রকাশ করে আসছিল। এ বছরই সরকারবিরোধী অপশক্তির দুটি বড় ধরনের আক্রমণের রিহার্সাল দৃশ্যমান হলো। প্রথমটি গত মার্চে, দ্বিতীয়টি দুর্গাপূজা উপলক্ষে। ভবিষ্যতে সরকারের বিরুদ্ধশক্তি আর কোনো রিহার্সাল মঞ্চস্থ করবে, নাকি তাদের ভাষায় ‘ফাইনাল খেলা’ খেলবে, সেটি ভবিষ্যতের বিষয়। যেটি স্পষ্ট বোঝা যায় তা হচ্ছে, জামায়াত এবং মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী সব গোষ্ঠী যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিশোধসহ বাংলাদেশকে আফগান-তালেবান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শেষ চেষ্টা তারা করবেই। এটি তাদের জন্য অনেকটা জীবনমরণ পণ। অন্যদিকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে দণ্ডিত, অনেকটা অসুস্থ, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কারাদণ্ড নিয়ে বিদেশ থেকে ভার্চুয়ালি দল পরিচালনা এবং আগামী নির্বাচনের কৌশল নির্ধারণ করছেন। তারাও চূড়ান্ত লড়াইয়ের চেষ্টা করবেই। এ ছাড়া আরও কিছু ছোট ছোট দল পর্দার অন্তরালে যুবসমাজসহ সমাজের বিক্ষুব্ধ অংশকে একত্র করার চেষ্টা করছে। তারাও ফাইনাল খেলার মনোভাব ব্যক্ত করছে। এ ছাড়া দেশের বাইরে থাকা এসব অপশক্তির বন্ধুরা মাঠ গরম করার জন্য প্রতিনিয়ত গুজব, অপপ্রচার, মিথ্যাচার, হুমকি-ধমকি ও উত্তেজনা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক কোনো কোনো মহল বিপুল অর্থবিত্ত নিয়ে আগামী নির্বাচনকে নিজেদের স্বার্থে আনার জন্য অনেক আগে থেকেই গোপনে কাজ করে চলেছে। বলা চলে, আওয়ামীবিরোধী সব শক্তি এখন মুখে ও বাইরে যা বলুক এবং দেখাক না কেন, ভেতরে-ভেতরে তারা এককাট্টা।
আমরা মনে করি, এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নীতি, পরিকল্পনা ও কৌশলে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রথমত, বর্তমান মন্ত্রিসভায় প্রয়োজনে দায়িত্ব পুনর্বণ্টন এবং দুর্বল অবস্থানে সবলের দৃঢ় ভূমিকা নেওয়ার ব্যবস্থা তৈরি করা একান্ত জরুরি। প্রশাসনের সর্বস্তরেও ঘাটতি, দুর্বলতা, দোদুল্যমানতা এবং সিদ্ধান্তহীনতার বিষয়গুলো এখনই চিহ্নিতকরণ, যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যোগ্য নেতৃত্বকে সমাসীন করা জরুরি। এ মুহূর্তে সরকারের বাণিজ্য, কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে নিবিড় সমন্বয় সাধন অপরিহার্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর বাজার মানুষের নাগালের মধ্যে আনতেই হবে। টিসিবিকে জনবান্ধব করা এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষা করার উপায় বের করতেই হবে। এটি অবশ্যই সম্ভব। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক শক্তির সমাবেশকে রাস্তায় প্রদর্শন না করে জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরের দুর্বলতা কারও অজানা নয়। সুতরাং দলকে সবল করার জন্য দলের তৃণমূল থেকে নীতিনির্ধারণী পর্যন্ত দলের চেইন অব কমান্ড সুদৃঢ় করতেই হবে। দলের বিতর্কিত নেতা-কর্মীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একই সঙ্গে দলের ত্যাগী, যোগ্য এবং প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের এই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের অনেক তরুণ নেতা-কর্মী সাম্প্রদায়িকতা-অসাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন না। এঁদের অনেকেই ফেসবুকে না বুঝে মন্তব্য করেন, যা দলের এবং রাষ্ট্রের আদর্শের পরিপন্থী। সুতরাং দলের তৃণমূল থেকে নেতা-কর্মীদের রাজনীতিসচেতন করা, শত্রুপক্ষের রাজনীতির পরিণতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া এবং দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে দলের করণীয়গুলো জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে বিতর্কিত ব্যক্তিদের কোনোভাবেই সম্মুখে আনা যাবে না। আওয়ামী লীগকে সমাজের সচেতন মহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে হবে। তাদের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কাজ ত্বরান্বিত করতে হবে। তৃতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছোট ছোট যেসব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পেশাজীবী সংগঠন রয়েছে, সেগুলোকে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সূচিত আন্দোলনে যুক্ত এবং ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা নিতে হবে। তাদের হাতেও তুলে দিতে হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলনীতি, আদর্শ এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক-সামাজিক চিন্তাভাবনার নানা ধরনের উপকরণ, যা তারা প্রয়োজনে ভার্চুয়ালি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে পারবে।
চতুর্থত, সামাজিক এবং গণমাধ্যমকে জনসচেতনতা তৈরিতে সহযোগিতা করার উপায় উদ্ভাবন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রচার যেন সব সময় নান্দনিক হয়, কোনো অবস্থায়ই নিন্দনীয় না হয়ে যায়—সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কোনো প্রচার-প্রচারণাই যেন অতিকথনে বিরক্তির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। আগামী নির্বাচনে শুধু লক্ষ্য হিসেবে স্থির থাকবে না; বরং পরবর্তী সময়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে সব পক্ষের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা নিশ্চিত করা জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়ন, সুশাসন, ন্যায়বিচার, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা, মানুষের মেধা ও যোগ্যতাভিত্তিক কর্মসংস্থান ইত্যাদির লক্ষ্য নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে দলীয় গণ্ডির ঊর্ধ্বে জাতীয় নেতৃত্বের পর্যায়ে দৃঢ় ভূমিকা নেওয়ার কথা ভাবতে হবে। সর্বক্ষেত্রেই যোগ্য ও মেধাবীদের দায়িত্ব প্রদান এবং তা পরিবীক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এটিই সময়ের দাবি।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নীতি, পরিকল্পনা ও কৌশলে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রথমত, বর্তমান মন্ত্রিসভায় প্রয়োজনে দায়িত্ব পুনর্বণ্টন এবং দুর্বল অবস্থানে সবলের দৃঢ় ভূমিকা নেওয়ার ব্যবস্থা তৈরি করা একান্ত জরুরি।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার অষ্টমী থেকে বিজয়া দশমী এবং এরপর দেশব্যাপী যেসব আক্রমণ, ধর্মের অবমাননার অভিযোগ, তাণ্ডব, মন্দির, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া, বিপণিবিতানে লুটপাট এবং নিরীহ মানুষ হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে সচেতন মহল লজ্জাবোধ করলেও; যাঁরা এসবকে অপরাধ মনে করেন না, তাঁদের কিছু যায়-আসে না। বরং তাঁরা মনে মনে হিন্দুদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার মনোভাব চেপে ধরে রাখছেন! হয়তো প্রকাশ এখন আর করছেন না। তবে সুবিধামতো সময়ে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটবে না—এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। করোনার সংক্রমণ অনেকটা কমে আসা স্পষ্ট হওয়ার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা ছড়াতে থাকে। তবে জাতীয় প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটি এবং দলীয় অফিসে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে গতবারের মতো সরকার উৎখাত, গণ-অভ্যুত্থান, পালানোর পথ না পাওয়া ইত্যাদি বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। এখন অবশ্য রাজনীতির জন্য জেলায় জেলায় সফর, জনসভা, বক্তৃতা প্রভৃতির খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে না। ঢাকায় এতসব বেসরকারি টিভি চ্যানেল রয়েছে, এর বাইরে নানা ধরনের তথাকথিত সোশ্যাল মিডিয়া তো রয়েছেই। এগুলোতেই নেতাদের বক্তৃতা আর কিছু কর্মীর হাততালির দৃশ্য প্রচারিত হলেই দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া বক্তব্য দলীয় নেতা-কর্মীদের জানার মধ্যেই চলে যায়। ডিজিটাল বাংলাদেশে এখন তাই বড় রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না, তেমন বেশি পয়সাও খরচ করতে হয় না।
পূজার আগেই মনে হয়েছিল, দেশে আন্দোলনের উত্তাপ ছড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। গতবার বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে ছড়ানো উত্তেজনা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, সরকারকে ফেলে দেওয়ার মনোভাব প্রকাশ্যেই দেখা গেছে। এখন যেই উত্তেজনা মাত্র শুরু হয়েছিল, তা দেখে মনে হয়েছিল দুই বছর পরের নির্বাচনের আগেই দেশে ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির একটা মহড়া হয়তো শুরু হচ্ছে। বিরোধী দল এবার সরকারকে ছেড়ে দেবে না—এমন কথা প্রতিদিনই উচ্চারণ করছে। বিএনপি গণমাধ্যমে সে ধরনের বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে বলেই আমরা জানতে পারছি। কিন্তু জামায়াত দীর্ঘদিন ধরে নীরব রয়েছে। প্রকাশ্যে আসে না, কথাও বলে না। তবে জামায়াতের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা মোটেও বসে নেই। গ্রামগঞ্জে তাদের কর্মীদের যাতায়াত অনেকটাই গোপনে হলেও নিয়মিত, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
জামায়াতের নেতা-কর্মীদের কাছে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রস্তুতি গ্রহণের নানা পরামর্শ আসছে বলে বিভিন্ন দিক থেকে শোনা যাচ্ছে; কিন্তু তাদের অনেক কিছুই এখন আগের মতো প্রকাশ্যে জানা যাবে না। তারা বেশ কৌশলী হয়ে পড়েছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ছাড়া অন্য কারও পক্ষে জামায়াতের প্রস্তুতি সম্পর্কে আগেভাগে জানা যাবে না। কিন্তু তারা আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে জিতিয়ে আনার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করছে—এমনটি দেশে-বিদেশে অবস্থানরত তাদের প্রচারমাধ্যমে জানা যাচ্ছে।
অন্যদিকে হেফাজতে ইসলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার পর কিছুটা দ্বিধাবিভক্ত হলেও সরকারের বিরুদ্ধে তাদের মনোভাব জামায়াতের চেয়ে কোনো অংশেই ভিন্নতর কিছু নয় বলেই মনে হয়। এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে এসে হঠাৎ দুর্গাপূজায় কুমিল্লার নানুয়া দিঘির পাড়ে পূজামণ্ডপে মুসলমানদের পবিত্র কোরআন মূর্তির পায়ের কাছে বসিয়ে যে ধর্মানুভূতির আবেগ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে, সেটি বিশেষভাবে মনোযোগের দাবি রাখে। ঘটনাটি যে খুব পরিকল্পিত ও নিপুণ হাতে করা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই একটি ঘটনাই গোটা দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট ছিল। কুমিল্লায় পরিস্থিতি যতটা নাজুক হওয়ার ধারণা করা হয়েছিল, ততটা হতে পারেনি। তবে হাজীগঞ্জ, চৌমুহনী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, সিলেটের হবিগঞ্জ এবং সবশেষে রংপুরের পীরগঞ্জে এর থাবা যেভাবে পড়েছিল, তাতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শুধু পূজাই পণ্ড হয়নি; জীবন, ঘরবাড়ি, সম্পদ এবং মনও ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। দেশে প্রায় ২০টি জেলায় ছোট-বড় আকারে অসংখ্য হামলা ঘটেছে। এতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর মহলবিশেষের গোসসা যেমন প্রকাশিত হয়েছে, আবার লুটপাটকারীদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণও ঘটেছে।
বেশ কিছুদিন ধরেই রাজনীতিসচেতন মহল দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা শঙ্কা প্রকাশ করে আসছিল। এ বছরই সরকারবিরোধী অপশক্তির দুটি বড় ধরনের আক্রমণের রিহার্সাল দৃশ্যমান হলো। প্রথমটি গত মার্চে, দ্বিতীয়টি দুর্গাপূজা উপলক্ষে। ভবিষ্যতে সরকারের বিরুদ্ধশক্তি আর কোনো রিহার্সাল মঞ্চস্থ করবে, নাকি তাদের ভাষায় ‘ফাইনাল খেলা’ খেলবে, সেটি ভবিষ্যতের বিষয়। যেটি স্পষ্ট বোঝা যায় তা হচ্ছে, জামায়াত এবং মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী সব গোষ্ঠী যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিশোধসহ বাংলাদেশকে আফগান-তালেবান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শেষ চেষ্টা তারা করবেই। এটি তাদের জন্য অনেকটা জীবনমরণ পণ। অন্যদিকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে দণ্ডিত, অনেকটা অসুস্থ, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কারাদণ্ড নিয়ে বিদেশ থেকে ভার্চুয়ালি দল পরিচালনা এবং আগামী নির্বাচনের কৌশল নির্ধারণ করছেন। তারাও চূড়ান্ত লড়াইয়ের চেষ্টা করবেই। এ ছাড়া আরও কিছু ছোট ছোট দল পর্দার অন্তরালে যুবসমাজসহ সমাজের বিক্ষুব্ধ অংশকে একত্র করার চেষ্টা করছে। তারাও ফাইনাল খেলার মনোভাব ব্যক্ত করছে। এ ছাড়া দেশের বাইরে থাকা এসব অপশক্তির বন্ধুরা মাঠ গরম করার জন্য প্রতিনিয়ত গুজব, অপপ্রচার, মিথ্যাচার, হুমকি-ধমকি ও উত্তেজনা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক কোনো কোনো মহল বিপুল অর্থবিত্ত নিয়ে আগামী নির্বাচনকে নিজেদের স্বার্থে আনার জন্য অনেক আগে থেকেই গোপনে কাজ করে চলেছে। বলা চলে, আওয়ামীবিরোধী সব শক্তি এখন মুখে ও বাইরে যা বলুক এবং দেখাক না কেন, ভেতরে-ভেতরে তারা এককাট্টা।
আমরা মনে করি, এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নীতি, পরিকল্পনা ও কৌশলে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রথমত, বর্তমান মন্ত্রিসভায় প্রয়োজনে দায়িত্ব পুনর্বণ্টন এবং দুর্বল অবস্থানে সবলের দৃঢ় ভূমিকা নেওয়ার ব্যবস্থা তৈরি করা একান্ত জরুরি। প্রশাসনের সর্বস্তরেও ঘাটতি, দুর্বলতা, দোদুল্যমানতা এবং সিদ্ধান্তহীনতার বিষয়গুলো এখনই চিহ্নিতকরণ, যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যোগ্য নেতৃত্বকে সমাসীন করা জরুরি। এ মুহূর্তে সরকারের বাণিজ্য, কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে নিবিড় সমন্বয় সাধন অপরিহার্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর বাজার মানুষের নাগালের মধ্যে আনতেই হবে। টিসিবিকে জনবান্ধব করা এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষা করার উপায় বের করতেই হবে। এটি অবশ্যই সম্ভব। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক শক্তির সমাবেশকে রাস্তায় প্রদর্শন না করে জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরের দুর্বলতা কারও অজানা নয়। সুতরাং দলকে সবল করার জন্য দলের তৃণমূল থেকে নীতিনির্ধারণী পর্যন্ত দলের চেইন অব কমান্ড সুদৃঢ় করতেই হবে। দলের বিতর্কিত নেতা-কর্মীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একই সঙ্গে দলের ত্যাগী, যোগ্য এবং প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের এই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের অনেক তরুণ নেতা-কর্মী সাম্প্রদায়িকতা-অসাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন না। এঁদের অনেকেই ফেসবুকে না বুঝে মন্তব্য করেন, যা দলের এবং রাষ্ট্রের আদর্শের পরিপন্থী। সুতরাং দলের তৃণমূল থেকে নেতা-কর্মীদের রাজনীতিসচেতন করা, শত্রুপক্ষের রাজনীতির পরিণতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া এবং দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে দলের করণীয়গুলো জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে বিতর্কিত ব্যক্তিদের কোনোভাবেই সম্মুখে আনা যাবে না। আওয়ামী লীগকে সমাজের সচেতন মহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে হবে। তাদের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কাজ ত্বরান্বিত করতে হবে। তৃতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছোট ছোট যেসব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পেশাজীবী সংগঠন রয়েছে, সেগুলোকে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সূচিত আন্দোলনে যুক্ত এবং ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা নিতে হবে। তাদের হাতেও তুলে দিতে হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলনীতি, আদর্শ এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক-সামাজিক চিন্তাভাবনার নানা ধরনের উপকরণ, যা তারা প্রয়োজনে ভার্চুয়ালি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে পারবে।
চতুর্থত, সামাজিক এবং গণমাধ্যমকে জনসচেতনতা তৈরিতে সহযোগিতা করার উপায় উদ্ভাবন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রচার যেন সব সময় নান্দনিক হয়, কোনো অবস্থায়ই নিন্দনীয় না হয়ে যায়—সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কোনো প্রচার-প্রচারণাই যেন অতিকথনে বিরক্তির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। আগামী নির্বাচনে শুধু লক্ষ্য হিসেবে স্থির থাকবে না; বরং পরবর্তী সময়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে সব পক্ষের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা নিশ্চিত করা জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়ন, সুশাসন, ন্যায়বিচার, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা, মানুষের মেধা ও যোগ্যতাভিত্তিক কর্মসংস্থান ইত্যাদির লক্ষ্য নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে দলীয় গণ্ডির ঊর্ধ্বে জাতীয় নেতৃত্বের পর্যায়ে দৃঢ় ভূমিকা নেওয়ার কথা ভাবতে হবে। সর্বক্ষেত্রেই যোগ্য ও মেধাবীদের দায়িত্ব প্রদান এবং তা পরিবীক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এটিই সময়ের দাবি।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
১৬ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
১৬ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
১৬ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
১৬ ঘণ্টা আগে