সেলিম জাহান
মাঝে মাঝে ভাবি, আমাদের যে দিন গেছে, তা রাতের তারার মতো, দিনের আলার গভীরে আছে কি না, জানি না। তবে নিশ্চিত জানি, তারা আছে আমাদের সবার হিরণ্ময় স্মৃতিতে।
প্রতিবছরই অক্টোবর-নভেম্বর মাস এলেই আমি কিছুটা উন্মনা হয়ে পড়ি। মনে পড়ে যায় দীর্ঘদিন আগে ১৯৬৯ সালে এই সময়টাতেই কোনো একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের ভেতরে পা রাখি।
সে-ও তো অর্ধশতাব্দীর ওপরে হয়ে গেল। এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়সও ১০০ বছর হয়ে গেল। স্মৃতিরা তাই ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে’ আমার হৃদয়ে কথা কইছে।
১৯৬৯-এর এক স্নিগ্ধ সকাল থেকে প্রায় পঁচিশ বছর, ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছিল নিত্য আনাগোনা–ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে বহু অনন্য মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছি, যাঁরা আমাকে ঋদ্ধ করেছেন।
অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপক মীর্জা নূরুল হুদা, অধ্যাপক আনিসুর রহমান, অধ্যাপক মুশাররফ হোসেনের মতো দিকপালদের আমি শিক্ষক ও সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি। অর্থনীতি শাস্ত্রের বহু শিক্ষা, বহু জ্ঞান, বহু বোধ তাঁদের কাছেই পাওয়া। বিভাগের বাইরে পেয়েছি অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মতো মনীষীদের, যাঁরা আমার চিন্তা-চেতনার বিকাশে সাহায্য করেছেন।
কী কারণে জানি না, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক আমাকে ‘জনাব সেলিম জাহান’ বলে সম্বোধন করতেন। বাড়িতে গেলেই বলতেন, ‘এক পিয়ালা চা খাইবেননি, জনাব সেলিম জাহান?’ ফুলার রোডের দোতলা যে বাড়িতে থাকতেন তিনি, তার দ্বিতলেই থাকতেন অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন ও অধ্যাপক ইনারী হোসেন তাঁদের দুই কিশোর পুত্র জাফর আর রাজাকে নিয়ে। সে বাড়িতে যাওয়ার পথেই রাজ্জাক স্যারের ডেরায় আমার ঢুঁ মারা। মুনীর কাকার কথা বলতেন খুব, বলতেন আমার পিতার কথাও, যিনি তাঁর ছাত্র ছিলেন। বাজার ও রান্না থেকে শুরু করে পূর্ব বাংলার মুসলমান, হ্যারল্ড লাস্কি থেকে শুরু করে নীরদ চৌধুরী, ঢাকার ইতিহাস থেকে আমার লেখা–কোনো কিছুই সে আলোচনায় পরিত্যাজ্য ছিল না। ছাত্রের পুত্র বলে একটি ‘পৌত্র-ছাত্রের’ মতো ব্যবহার ছিল তাঁর আমার প্রতি—গাম্ভীর্যবিহীন, ঠাট্টা-মশকরার, হালকা চালের। তবে দাবা বিষয়ে তাঁর ত্রিসীমানায় তিনি আমাকে ঘেঁষতে দিতেন না। লক্ষ করেছিলাম, আমাকে যেমন তিনি ‘জনাব সেলিম জাহান’ বলতেন, ছফা ভাইকেও সম্বোধন করতেন ‘মৌলভী আহমেদ ছফা’ বলে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে লেখালেখি, বেতার-টেলিভিশনে ভাষ্য, সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণে কতবার যে ভাবনা-চিন্তার আদান-প্রদান হয়েছে। বানান থেকে শুরু করে গ্রন্থপঞ্জি, সামাজিক আন্দোলন থেকে শুরু করে সম্পাদনা–কত বিষয়ে যে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি, তার লেখাজোখা নেই। অধ্যাপক সারওয়ার মুরশিদের সঙ্গে ‘একাল’ পত্রিকার কাজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি। মনে আছে আটকে গিয়ে বেশ রাতে ফোন করে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কাছে জানতে চেয়েছি, ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন’ রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতার অংশ, সঙ্গে সঙ্গে বলে দিয়েছেন। প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’ কবে বেরিয়েছিল, তা-ও জানিয়েছেন অন্য আরেক দিন এক লহমায়। তাঁর কন্যা রুচির আমি শিক্ষক ছিলাম বলে তিনি চিরকাল আমায় ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেছেন, এই কিছুদিন আগে ‘তুমি’তে পদোন্নতি হয়েছে আমার। গত বছর আমার ‘বেলা-অবেলার কথা’ বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন তিনি। সম্প্রতি ছেড়ে গেছেন তিনি আমাদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সাধারণ মানুষের অবিস্মরণীয় চরিত্র আমাকে মানবিক হতে সাহায্য করেছে। অর্থনীতি বিভাগের প্রবাদচরিত্র কানুদাকে কী করে ভুলি? তাঁর স্নেহ-মমতা আমাকে ঘিরে রেখেছে দীর্ঘ ২৫ বছর–আমার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকতা জীবনে। কানুদার পুত্র বাবুল, লাবু, মহসীন আমার আত্মীয়সম। প্রশাসন দপ্তরে খন্দকার সাহেবকে এখনো মনে আছে। বৃত্তির টাকা তুলতে তাঁর কাছে যেতাম। তিনি জানতেন, হয়তো আমি একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হব। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা তিনি প্রায়ই স্মরণ করিয়ে দিতেন। সে শিক্ষা আজও ভুলিনি।
সলিমুল্লাহ হলের নাজু দারোয়ানকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। লম্বা পাগড়ির, বিরাট গোঁফের নাজু দারোয়ানকে এক অবিস্মরণীয় চরিত্র বলে মনে হতো। শুনেছিলাম আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার ২২-২৩ বছর আগে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় আমার বাবাও নাজুকে সলিমুল্লাহ হলে দেখেছিলেন। প্রথম সাক্ষাতে বাবাকে দেখে নাজু দারোয়ানের চোখে-মুখে সে কী আনন্দের আভা। সে কী যত্ন-আত্তি আমার। স্বাধীনতার পরে তাঁকে আর দেখিনি। ভুলিনি কালুদাকেও। শিক্ষক থাকাকালে তিনি আমার কক্ষের ঝাড়া-মোছা করতেন। শ্রেণিকক্ষে বক্তৃতা করে ফিরলে প্রায়ই বলতেন তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে, ‘স্যার, সব সাফা করে দিছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার জানার বিস্তার এবং আমার সময় কাটানোর পরিসীমার বেশির ভাগই ব্যাপৃত ছিল শ্রেণিকক্ষের বাইরে। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মাঠ ও মিলনায়তন, গ্রন্থাগারের চাতাল, শরীফ মিয়ার ক্যানটিন–এসবই ছিল আমার শিক্ষাক্ষেত্র। আড্ডার ঝড় তুলেছি ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মাঠ ও গ্রন্থাগারের চাতালে–জীবন ও জগতের বহু পাঠ তো সেখান থেকেই নেওয়া। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মিলনায়তনে বিতর্কের যুক্তিতে শাণিত করেছি নিজের চিন্তাশক্তি ও বলনের ক্ষমতা।
আর শরীফ মিয়ার ক্যানটিন? সে ছিল এক মহামিলন ক্ষেত্র। শিল্প-সাহিত্য-সংগীত-চিত্রকলার তীর্থস্থান। কে আসতেন না সেখানে–শেখ লুৎফর রহমান থেকে রফিকুন নবী, কবি নির্মলেন্দু গুণ থেকে শাহরিয়ার কবির, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম থেকে মাহ্ফুজ আনাম। আসতেন কবি আবুল হাসান, সোহরাব হোসেন, অজয় রায়, জাহেদুর রহিম, ইকবাল আহমেদ, শওকত আনোয়ার আরও কজনা। বাংলা, অর্থনীতি, ইংরেজি আর অন্যান্য বিভাগের দু-এক ক্লাস ওপরের ছাত্রছাত্রীসহ আসত আমার সতীর্থরা। যেমন আসতেন রিজওয়ানুল ইসলাম, মোহাম্মদ মুক্তাদা, সেলিম সারওয়ার, হুমায়ুন আজাদ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ম. হামিদ, তেমনি আসত কাজী শহীদুল্লাহ, শেখ কামাল, কায়সার হামিদুল হক, ফিরদৌস মুর্শেদ। অনুজদের মধ্যে আতিউর রহমান, হোসেন জিল্লুর রহমান, আনিস আহমেদ আরও কতজন।
দু-একজন মাঝেমধ্যে উঁকি দিলেও মেয়েরা আসত না শরীফ মিয়ায়। তারা ওই গ্রন্থাগারের চাতালেই বসত। তাদের জন্য চা-বিস্কুট নিয়ে যাওয়া হতো। হাসিতে-গানে-হই-হল্লায় ভরে যেত চারদিক। মনে আছে ওই চাতালে বসেই একদিন তাজিন মুর্শেদ ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’ পুরোটা গেয়ে আমাদের তাজ্জব বানিয়ে দিয়েছিল। শেখ কামাল কোরাসে ‘পাগলার মন নাচাইয়া, পাগলি গেল চলিয়া’–তারস্বরে চিৎকার করে গেয়েছিল।
শরীফ মিয়ার ক্যানটিনে কত-কী যে শিখেছি! হাসান ভাই একদিন ছন্দের শিক্ষা দিয়েছিলেন। আমার বাল্যবন্ধু প্রয়াত শিল্পী হাসি চক্রবর্তী বুঝিয়েছিল রেখার টান বিষয়ে। শুদ্ধ কবিতার জন্য কবিতা, না সমাজ-চিন্তার জন্য কবিতা—এ বিতর্কে একদিন রেগেমেগে শাহনূর খান বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এক সপ্তাহ কথা বলেননি আমার সঙ্গে। নভেরার ভাস্কর্যের ব্যাখ্যা নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়েছিল খান মোহাম্মদ ফারাবীর সঙ্গে। ওই চাতালের আড্ডা থেকেই কামাল একদিন ধরে নিয়ে গিয়েছিল এদের ৩২ নম্বরের বাড়িতে, সেই একবারই জীবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছিলাম।
চলতি ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ১০০ বছর হলো। ভাবতে অবাক লাগে যে গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমারও চেনা-জানার ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে আমরা বয়সের সুতো ধরে অনেক দূর এগিয়েছি, হারিয়েছি বহু শিক্ষককে, চলে গেছে বহু সতীর্থ বন্ধু। কিন্তু আমরা উনসত্তর আর একাত্তরের সন্তানেরা এখনো আছি—হাত ধরে আছি পরস্পরের। যখন পেছন ফিরে তাকাই, মনেই হয় না এত দিন পেরিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ভাবি, আমাদের যে দিন গেছে, তা রাতের তারার মতো, দিনের আলার গভীরে আছে কি না, জানি না। তবে নিশ্চিত জানি, তারা আছে আমাদের সবার হিরণ্ময় স্মৃতিতে।
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।
মাঝে মাঝে ভাবি, আমাদের যে দিন গেছে, তা রাতের তারার মতো, দিনের আলার গভীরে আছে কি না, জানি না। তবে নিশ্চিত জানি, তারা আছে আমাদের সবার হিরণ্ময় স্মৃতিতে।
প্রতিবছরই অক্টোবর-নভেম্বর মাস এলেই আমি কিছুটা উন্মনা হয়ে পড়ি। মনে পড়ে যায় দীর্ঘদিন আগে ১৯৬৯ সালে এই সময়টাতেই কোনো একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের ভেতরে পা রাখি।
সে-ও তো অর্ধশতাব্দীর ওপরে হয়ে গেল। এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়সও ১০০ বছর হয়ে গেল। স্মৃতিরা তাই ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে’ আমার হৃদয়ে কথা কইছে।
১৯৬৯-এর এক স্নিগ্ধ সকাল থেকে প্রায় পঁচিশ বছর, ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছিল নিত্য আনাগোনা–ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে বহু অনন্য মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছি, যাঁরা আমাকে ঋদ্ধ করেছেন।
অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপক মীর্জা নূরুল হুদা, অধ্যাপক আনিসুর রহমান, অধ্যাপক মুশাররফ হোসেনের মতো দিকপালদের আমি শিক্ষক ও সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি। অর্থনীতি শাস্ত্রের বহু শিক্ষা, বহু জ্ঞান, বহু বোধ তাঁদের কাছেই পাওয়া। বিভাগের বাইরে পেয়েছি অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মতো মনীষীদের, যাঁরা আমার চিন্তা-চেতনার বিকাশে সাহায্য করেছেন।
কী কারণে জানি না, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক আমাকে ‘জনাব সেলিম জাহান’ বলে সম্বোধন করতেন। বাড়িতে গেলেই বলতেন, ‘এক পিয়ালা চা খাইবেননি, জনাব সেলিম জাহান?’ ফুলার রোডের দোতলা যে বাড়িতে থাকতেন তিনি, তার দ্বিতলেই থাকতেন অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন ও অধ্যাপক ইনারী হোসেন তাঁদের দুই কিশোর পুত্র জাফর আর রাজাকে নিয়ে। সে বাড়িতে যাওয়ার পথেই রাজ্জাক স্যারের ডেরায় আমার ঢুঁ মারা। মুনীর কাকার কথা বলতেন খুব, বলতেন আমার পিতার কথাও, যিনি তাঁর ছাত্র ছিলেন। বাজার ও রান্না থেকে শুরু করে পূর্ব বাংলার মুসলমান, হ্যারল্ড লাস্কি থেকে শুরু করে নীরদ চৌধুরী, ঢাকার ইতিহাস থেকে আমার লেখা–কোনো কিছুই সে আলোচনায় পরিত্যাজ্য ছিল না। ছাত্রের পুত্র বলে একটি ‘পৌত্র-ছাত্রের’ মতো ব্যবহার ছিল তাঁর আমার প্রতি—গাম্ভীর্যবিহীন, ঠাট্টা-মশকরার, হালকা চালের। তবে দাবা বিষয়ে তাঁর ত্রিসীমানায় তিনি আমাকে ঘেঁষতে দিতেন না। লক্ষ করেছিলাম, আমাকে যেমন তিনি ‘জনাব সেলিম জাহান’ বলতেন, ছফা ভাইকেও সম্বোধন করতেন ‘মৌলভী আহমেদ ছফা’ বলে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে লেখালেখি, বেতার-টেলিভিশনে ভাষ্য, সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণে কতবার যে ভাবনা-চিন্তার আদান-প্রদান হয়েছে। বানান থেকে শুরু করে গ্রন্থপঞ্জি, সামাজিক আন্দোলন থেকে শুরু করে সম্পাদনা–কত বিষয়ে যে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি, তার লেখাজোখা নেই। অধ্যাপক সারওয়ার মুরশিদের সঙ্গে ‘একাল’ পত্রিকার কাজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি। মনে আছে আটকে গিয়ে বেশ রাতে ফোন করে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কাছে জানতে চেয়েছি, ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন’ রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতার অংশ, সঙ্গে সঙ্গে বলে দিয়েছেন। প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’ কবে বেরিয়েছিল, তা-ও জানিয়েছেন অন্য আরেক দিন এক লহমায়। তাঁর কন্যা রুচির আমি শিক্ষক ছিলাম বলে তিনি চিরকাল আমায় ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেছেন, এই কিছুদিন আগে ‘তুমি’তে পদোন্নতি হয়েছে আমার। গত বছর আমার ‘বেলা-অবেলার কথা’ বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন তিনি। সম্প্রতি ছেড়ে গেছেন তিনি আমাদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সাধারণ মানুষের অবিস্মরণীয় চরিত্র আমাকে মানবিক হতে সাহায্য করেছে। অর্থনীতি বিভাগের প্রবাদচরিত্র কানুদাকে কী করে ভুলি? তাঁর স্নেহ-মমতা আমাকে ঘিরে রেখেছে দীর্ঘ ২৫ বছর–আমার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকতা জীবনে। কানুদার পুত্র বাবুল, লাবু, মহসীন আমার আত্মীয়সম। প্রশাসন দপ্তরে খন্দকার সাহেবকে এখনো মনে আছে। বৃত্তির টাকা তুলতে তাঁর কাছে যেতাম। তিনি জানতেন, হয়তো আমি একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হব। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা তিনি প্রায়ই স্মরণ করিয়ে দিতেন। সে শিক্ষা আজও ভুলিনি।
সলিমুল্লাহ হলের নাজু দারোয়ানকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। লম্বা পাগড়ির, বিরাট গোঁফের নাজু দারোয়ানকে এক অবিস্মরণীয় চরিত্র বলে মনে হতো। শুনেছিলাম আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার ২২-২৩ বছর আগে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় আমার বাবাও নাজুকে সলিমুল্লাহ হলে দেখেছিলেন। প্রথম সাক্ষাতে বাবাকে দেখে নাজু দারোয়ানের চোখে-মুখে সে কী আনন্দের আভা। সে কী যত্ন-আত্তি আমার। স্বাধীনতার পরে তাঁকে আর দেখিনি। ভুলিনি কালুদাকেও। শিক্ষক থাকাকালে তিনি আমার কক্ষের ঝাড়া-মোছা করতেন। শ্রেণিকক্ষে বক্তৃতা করে ফিরলে প্রায়ই বলতেন তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে, ‘স্যার, সব সাফা করে দিছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার জানার বিস্তার এবং আমার সময় কাটানোর পরিসীমার বেশির ভাগই ব্যাপৃত ছিল শ্রেণিকক্ষের বাইরে। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মাঠ ও মিলনায়তন, গ্রন্থাগারের চাতাল, শরীফ মিয়ার ক্যানটিন–এসবই ছিল আমার শিক্ষাক্ষেত্র। আড্ডার ঝড় তুলেছি ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মাঠ ও গ্রন্থাগারের চাতালে–জীবন ও জগতের বহু পাঠ তো সেখান থেকেই নেওয়া। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মিলনায়তনে বিতর্কের যুক্তিতে শাণিত করেছি নিজের চিন্তাশক্তি ও বলনের ক্ষমতা।
আর শরীফ মিয়ার ক্যানটিন? সে ছিল এক মহামিলন ক্ষেত্র। শিল্প-সাহিত্য-সংগীত-চিত্রকলার তীর্থস্থান। কে আসতেন না সেখানে–শেখ লুৎফর রহমান থেকে রফিকুন নবী, কবি নির্মলেন্দু গুণ থেকে শাহরিয়ার কবির, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম থেকে মাহ্ফুজ আনাম। আসতেন কবি আবুল হাসান, সোহরাব হোসেন, অজয় রায়, জাহেদুর রহিম, ইকবাল আহমেদ, শওকত আনোয়ার আরও কজনা। বাংলা, অর্থনীতি, ইংরেজি আর অন্যান্য বিভাগের দু-এক ক্লাস ওপরের ছাত্রছাত্রীসহ আসত আমার সতীর্থরা। যেমন আসতেন রিজওয়ানুল ইসলাম, মোহাম্মদ মুক্তাদা, সেলিম সারওয়ার, হুমায়ুন আজাদ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ম. হামিদ, তেমনি আসত কাজী শহীদুল্লাহ, শেখ কামাল, কায়সার হামিদুল হক, ফিরদৌস মুর্শেদ। অনুজদের মধ্যে আতিউর রহমান, হোসেন জিল্লুর রহমান, আনিস আহমেদ আরও কতজন।
দু-একজন মাঝেমধ্যে উঁকি দিলেও মেয়েরা আসত না শরীফ মিয়ায়। তারা ওই গ্রন্থাগারের চাতালেই বসত। তাদের জন্য চা-বিস্কুট নিয়ে যাওয়া হতো। হাসিতে-গানে-হই-হল্লায় ভরে যেত চারদিক। মনে আছে ওই চাতালে বসেই একদিন তাজিন মুর্শেদ ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’ পুরোটা গেয়ে আমাদের তাজ্জব বানিয়ে দিয়েছিল। শেখ কামাল কোরাসে ‘পাগলার মন নাচাইয়া, পাগলি গেল চলিয়া’–তারস্বরে চিৎকার করে গেয়েছিল।
শরীফ মিয়ার ক্যানটিনে কত-কী যে শিখেছি! হাসান ভাই একদিন ছন্দের শিক্ষা দিয়েছিলেন। আমার বাল্যবন্ধু প্রয়াত শিল্পী হাসি চক্রবর্তী বুঝিয়েছিল রেখার টান বিষয়ে। শুদ্ধ কবিতার জন্য কবিতা, না সমাজ-চিন্তার জন্য কবিতা—এ বিতর্কে একদিন রেগেমেগে শাহনূর খান বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এক সপ্তাহ কথা বলেননি আমার সঙ্গে। নভেরার ভাস্কর্যের ব্যাখ্যা নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়েছিল খান মোহাম্মদ ফারাবীর সঙ্গে। ওই চাতালের আড্ডা থেকেই কামাল একদিন ধরে নিয়ে গিয়েছিল এদের ৩২ নম্বরের বাড়িতে, সেই একবারই জীবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছিলাম।
চলতি ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ১০০ বছর হলো। ভাবতে অবাক লাগে যে গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমারও চেনা-জানার ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে আমরা বয়সের সুতো ধরে অনেক দূর এগিয়েছি, হারিয়েছি বহু শিক্ষককে, চলে গেছে বহু সতীর্থ বন্ধু। কিন্তু আমরা উনসত্তর আর একাত্তরের সন্তানেরা এখনো আছি—হাত ধরে আছি পরস্পরের। যখন পেছন ফিরে তাকাই, মনেই হয় না এত দিন পেরিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ভাবি, আমাদের যে দিন গেছে, তা রাতের তারার মতো, দিনের আলার গভীরে আছে কি না, জানি না। তবে নিশ্চিত জানি, তারা আছে আমাদের সবার হিরণ্ময় স্মৃতিতে।
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
১৪ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
১৪ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
১৪ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
১৪ ঘণ্টা আগে