বিভুরঞ্জন সরকার
বয়স বাড়লে নাকি মানুষ সামনে তাকানোর চেয়ে পেছন ফিরে স্মৃতিরোমন্থনে সুখ অনুভব করে বেশি। আজকাল আমারও পেছনের কথা, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ও বন্ধুদের কথা খুবই মনে পড়ে। তাহলে কি বুড়ো হয়ে গেলাম? সকালে হাঁটতে যাই রমনা পার্কে। এখন করোনার ভয়ে মুখ ঢাকা থাকে মাস্কে। তারপরও দু-একজন পরিচিত মানুষ ঠিকই চিনতে পারেন, সামনে এসে জিজ্ঞেস করেন তাঁকে চিনতে পেরেছি কিনা! কথা না বলে হ্যাঁসূচক ঘাড় নাড়ি। মুখে হাসি থাকে, কিন্তু মাস্কের কারণে তিনি তা দেখতে পান না। সেদিন দেখা হলো জগন্নাথ হলের এক সাবেক ছাত্রের সঙ্গে। তিনি আমার দুই বছরের সিনিয়র। আমরা প্রতি সকালে একসঙ্গে হল ক্যান্টিনে নাশতা করতে যেতাম। দুটি পরোটা, একটি ডিমের মামলেট, আর একটু সবজি বা ডাল ছিল আমার নিত্যদিনের নাশতা। অধিকাংশ ছাত্রই আবার ডিম প্রতিদিন খেত না। আমাদের সময় জগন্নাথ হলের অনেক ছাত্রকেই ‘গুরুগিরি’ করে নিজের শিক্ষাব্যয় জোগাড় করতে হতো। অনেকের পারিবারিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না। তবে আলালের ঘরের দুলাল একেবারে ছিল না, তা-ও নয়। যাদের বাড়ি থেকে নিয়মিত মোটামুটি ভালো টাকা আসত, তাদের চলনবলনও কিছুটা আলাদা ছিল। পোশাক-আশাকেও তাদের অবস্থা বোঝা যেত।
এক সকালে একজনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হলের ক্যানটিনে ৩৫টি পরোটা এবং ১৫টি ডিমের মামলেট খেয়েছিলেন রমনায় দেখা হওয়া ওই দাদা। তাঁর শরীরটা আগাগোড়াই গাট্টাগোট্টা ছিল। অমন দেহখান সচল রাখতে তেলমবিল একটু বেশি লাগারই কথা। তিনি নিয়মিত অবশ্য সকালের নাশতায় আট-দশটি পরোটা সাবাড় করতেন। দুপুরে-রাতে ভাতও তিনি কয়েকজনেরটা একাই খেতে পারতেন। বহু বছর পর দেখা। শরীর খুব একটা ভাঙেনি এখনো। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সে সময়ে আমার দুজন ঘনিষ্ঠ মানুষের কথা মনে পড়ায় তাঁদের নিয়ে কিছু না লিখে স্বস্তি পাচ্ছি না।
তাঁদের একজন মুকুল চক্রবর্তী, আরেকজন সুলতান আহমেদ। মুকুল আমার ব্যাচমেট। পড়ত পদার্থ বিজ্ঞানে। সুলতান ভাই একটু সিনিয়র। তিনি বাংলার ছাত্র, আমিও। মুকুল আর আমি জগন্নাথ হলে থাকতাম। সুলতান ভাই জহুরুল হক হলে। তবে আড্ডা দিতেন বেশি জগন্নাথ হলেই। জগন্নাথ হল ছিল আমাদের আমলে ছাত্র ইউনিয়নের দুর্গ। মুকুল প্রথম দিকে জাসদ ছাত্রলীগের কর্মী ছিল, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে ঝাঁজালো স্লোগানে ক্যাম্পাস কাঁপাত। পরে অবশ্য আমাদের প্রভাবে মুকুলও ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিল।
সুলতান ভাই ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিটি মিছিলে থাকতেন উচ্চকিত। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি ভিয়েতনামের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের জন্য যে মিছিলে পুলিশের গুলিতে মতিউল-কাদের নিহত হন, সেই মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন সুলতান ভাইও।
আমার সঙ্গে কী করে যেন এই দুজনেরই হয়েছিল যাকে বলে গলায়-গলায় ভাব। কত সময় যে আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি। কত কী যে করেছি! কত স্বপ্নের জাল বুনেছি।
পৃথিবীটা সব মানুষের বাসযোগ্য করার জন্য সে কী ব্যাকুলতা-আকুলতা আমাদের। বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। কোনো মানুষ নিরক্ষর থাকবে না। কেউ বেকার থাকবে না। সবাই মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে। রোগে চিকিৎসা পাবে। আমাদের সবটুকু সময় তাই সংগঠন গড়ে তোলার কাজে ব্যয় করতাম। বাস্তবিক অর্থেই আমাদের ‘নাওয়া-খাওয়া’র ঠিকঠিকানা ছিল না। এমন অনেক দিন গেছে সত্যি সত্যি পেটে দানাপানি পড়েনি। তাতে আমাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। কত মানুষেরই তো প্রতিদিন আহার জোটে না!
আমাদের বয়সী অনেক ছাত্র তখন রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হলের সামনে দিয়ে ঘুর ঘুর করত। বিকেলে জটলা করত। বন্ধু জোটানো-পটানোর জন্য কতজনের কত কোশেশ। যারা সফল হতো, তাদের ভাবসাবই ছিল আলাদা। অসফলেরা ওদের হিংসা করত।
আমরা যারা ছাত্র ইউনিয়ন করতাম, ওসব করার তেমন সময় হতো না। দু-একজন যে ব্যতিক্রম ছিলেন না, তা অবশ্যই নয়! আবার সাংগঠনিক শৃঙ্খলার কারণে এবং কে কী মনে করে, তার ভয়ে আমাদের একটু সমঝেও চলতে হতো।
তাই বলে আমাদের কী কোনো সাধ-আহ্লাদ ছিল না? বয়সের দোষ বলে যে কথাটা আছে, আমাদের কি তা একেবারেই ছিল না? ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু তা অবদমনের ক্ষমতা কী করে যেন আমরা অর্জন করেছিলাম।
দিঘলকেশী কাউকে দেখে আমাদের মন কি গেয়ে উঠত না, ‘কুন্তল বন্যা, কে দিল তোমায় বলো কন্যা?’ মনে হতো, একটু কাছে যাই, পাশে পাশে একটু হাঁটি। না-ই বা হলো কোনো কথা! মনের ভেতর আনচান করা ভাবটা তো একটু কমত। কিন্তু না, কে যেন সাবধান করত, চেপে যা বাপ! আর বাড়িস না।
মুকুল ঠোঁট দিয়ে চমৎকার শিশ দিতে পারত। কয়েকটি গানের এমন সুন্দর সুর তুলত যে, শুনলে কানমন জুড়িয়ে যেত। মাঝেমধ্যে গভীর রাতে জগন্নাথ হলের দেয়াল টপকে আমি, মুকুল এবং আরও দু-একজন শামসুন্নাহার হলের সামনের রাস্তায় চলে যেতাম। মুকুল শিশ দিয়ে সুরের মূর্ছনা তুলত: ‘এই রাত শুধু তোমার আমার!’
শামসুন্নাহার হলের বারান্দায় লক্ষ্য করতাম, একে একে অনেক ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়াচ্ছে। কয়েক মিনিট যেন মোহাবিষ্ট থাকতাম আমরা। ব্যস, ওটুকুই! তাতেই আমরা আমোদিত হতাম। ওগুলো কি প্রেম ছিল? নাকি ভালো লাগার কিছু মুহূর্ত? চাঁদপুরের মতলবের মুকুলের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পরও কিছুদিন চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল। ও এলাকায় চলে গিয়েছিল। দেশে বিপ্লব হয়নি, সবার জন্য সমানাধিকার নিশ্চিত হয়নি। মুকুলের জীবনটা যেন কেমন শেকড় থেকে উপড়ে গিয়েছিল! আহা, মুকুল কোথায় গেলি বন্ধু!
মুকুলের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। মুকুল কেন হঠাৎ এসে আমার স্মৃতির দুয়ারে হানা দিল? বন্ধু মুকুল, ক্ষমা করে দিস এই অভাজনকে। মানুষের জীবন এমনই। যাকে ছাড়া চলবে না বলে মনে করা হয়, দেখা যায় সময়ের স্রোত তাকে ছাড়াই দিব্যি টেনে নিয়ে যায়!
সুলতান ভাই। কী প্রাণোচ্ছল এক মানুষ ছিলেন! হাসি-গল্পে মাতিয়ে রাখতেন। তাঁর নীতি ছিল: ‘নো চিন্তা, ডু ফুর্তি’। দুশ্চিন্তাহীন এক নতুন জীবনের সন্ধানী ছিলেন সুলতান ভাই। কত রকম পাগলামিই না করতেন। ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সভাপতি ছিলেন। একসঙ্গে কত সময় আমরা কাটিয়েছি, কত ধরনের কাজই না আমরা করেছি।
তখন আমরা বলাকা সিনেমা হলে প্রায়ই নাইট শো সিনেমা দেখতাম। রাত ১২টায় শো শেষ হয়েছে, সুলতান ভাইয়ের মনে হলো, ছবির নায়িকাকে গিয়ে অভিনন্দন জানিয়ে আসি! যাহা ভাবা, তাহা কাজ। অত রাতে ছোটা হলো অলিভিয়ার বাসায়। পাগল আর কাকে বলে! তাঁর পাগলামির সহযাত্রী আমি। দারোয়ান গেট খুলবে না। সুলতান ভাই বললেন, ‘যাও ম্যাডামকে বলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট সুলতান এসেছে।’
দারোয়ান ভেতরে গেল এবং একটু পরে হাসি মুখে এসে আমাদের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিল। রাতের পোশাকপরা নায়িকা অলিভিয়া দরজা খুলতেই অভিনন্দন জানালেন সুলতান ভাই। ছবির নাম ছিল ‘যখন বৃষ্টি এলো’ ইংরেজি টাইটেল ছিল: The Rain.
সুলতান ভাই অলিভিয়ার কাছে জানতে চাইলেন, ‘যখন সুলতান এলো’-এর ইংরেজি কি হবে— The Sultan?
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন অলিভিয়া।
সুলতান ভাইয়ের চোখমুখ ঠিকরে বের হচ্ছে উচ্ছ্বাস। খুব ছেলেমানুষি কি? ভেতরে ঢুকে আমরা একটুক্ষণ বসেই বিদায় নিলাম।
আরেক দিন আলমগীর কবিরের ‘সূর্যকন্যা’ দেখে বেরিয়ে সুলতান ভাইয়ের মনে হলো নায়িকা জয়শ্রী কবিরকে অভিনন্দন জানাতে হবে।
আমাকে সঙ্গে নিয়ে রাত দুপুরে হানা দিলেন আজিমপুর কলোনিতে আলমগীর কবিরের বাসায়। আলমগীর কবিরের সঙ্গে আমার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। আমি ছাত্রাবস্থায় ‘মুক্তকণ্ঠ’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন বের করতাম। তাতে চলচ্চিত্র বিষয়ে আলমগীর কবিরের একাধিক লেখা ছাপা হয়েছে। সুন্দরী রূপসী জয়শ্রী কবির সে রাতে আমাদের চাপ্যায়িত (চা পানে আপ্যায়িত, চাপ্যায়িত শব্দটি সাহিত্যিক শওকত ওসমান উদ্ভাবিত) করেছিলেন।
আজকের দিনে এসব ভাবা যায়! গাঁজাখুরি গল্প মনে হলেও এগুলো সত্য এবং এগুলো সম্ভব ছিল সুলতান ভাইয়ের পক্ষেই।
আচ্ছা, সুলতান ভাইয়ের মতো আমুদে মানুষটি কোথায় হারিয়ে গেলেন?
খুব মনে পড়ছে, মন পুড়ছে।
মুকুল কিংবা সুলতান ভাইয়ের কি এসব কথা মনে আছে? মনে পড়ে? সত্যি, কেউ ভোলে আর কেউ ভোলে না অতীত দিনের স্মৃতি!
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
বয়স বাড়লে নাকি মানুষ সামনে তাকানোর চেয়ে পেছন ফিরে স্মৃতিরোমন্থনে সুখ অনুভব করে বেশি। আজকাল আমারও পেছনের কথা, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ও বন্ধুদের কথা খুবই মনে পড়ে। তাহলে কি বুড়ো হয়ে গেলাম? সকালে হাঁটতে যাই রমনা পার্কে। এখন করোনার ভয়ে মুখ ঢাকা থাকে মাস্কে। তারপরও দু-একজন পরিচিত মানুষ ঠিকই চিনতে পারেন, সামনে এসে জিজ্ঞেস করেন তাঁকে চিনতে পেরেছি কিনা! কথা না বলে হ্যাঁসূচক ঘাড় নাড়ি। মুখে হাসি থাকে, কিন্তু মাস্কের কারণে তিনি তা দেখতে পান না। সেদিন দেখা হলো জগন্নাথ হলের এক সাবেক ছাত্রের সঙ্গে। তিনি আমার দুই বছরের সিনিয়র। আমরা প্রতি সকালে একসঙ্গে হল ক্যান্টিনে নাশতা করতে যেতাম। দুটি পরোটা, একটি ডিমের মামলেট, আর একটু সবজি বা ডাল ছিল আমার নিত্যদিনের নাশতা। অধিকাংশ ছাত্রই আবার ডিম প্রতিদিন খেত না। আমাদের সময় জগন্নাথ হলের অনেক ছাত্রকেই ‘গুরুগিরি’ করে নিজের শিক্ষাব্যয় জোগাড় করতে হতো। অনেকের পারিবারিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না। তবে আলালের ঘরের দুলাল একেবারে ছিল না, তা-ও নয়। যাদের বাড়ি থেকে নিয়মিত মোটামুটি ভালো টাকা আসত, তাদের চলনবলনও কিছুটা আলাদা ছিল। পোশাক-আশাকেও তাদের অবস্থা বোঝা যেত।
এক সকালে একজনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হলের ক্যানটিনে ৩৫টি পরোটা এবং ১৫টি ডিমের মামলেট খেয়েছিলেন রমনায় দেখা হওয়া ওই দাদা। তাঁর শরীরটা আগাগোড়াই গাট্টাগোট্টা ছিল। অমন দেহখান সচল রাখতে তেলমবিল একটু বেশি লাগারই কথা। তিনি নিয়মিত অবশ্য সকালের নাশতায় আট-দশটি পরোটা সাবাড় করতেন। দুপুরে-রাতে ভাতও তিনি কয়েকজনেরটা একাই খেতে পারতেন। বহু বছর পর দেখা। শরীর খুব একটা ভাঙেনি এখনো। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সে সময়ে আমার দুজন ঘনিষ্ঠ মানুষের কথা মনে পড়ায় তাঁদের নিয়ে কিছু না লিখে স্বস্তি পাচ্ছি না।
তাঁদের একজন মুকুল চক্রবর্তী, আরেকজন সুলতান আহমেদ। মুকুল আমার ব্যাচমেট। পড়ত পদার্থ বিজ্ঞানে। সুলতান ভাই একটু সিনিয়র। তিনি বাংলার ছাত্র, আমিও। মুকুল আর আমি জগন্নাথ হলে থাকতাম। সুলতান ভাই জহুরুল হক হলে। তবে আড্ডা দিতেন বেশি জগন্নাথ হলেই। জগন্নাথ হল ছিল আমাদের আমলে ছাত্র ইউনিয়নের দুর্গ। মুকুল প্রথম দিকে জাসদ ছাত্রলীগের কর্মী ছিল, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে ঝাঁজালো স্লোগানে ক্যাম্পাস কাঁপাত। পরে অবশ্য আমাদের প্রভাবে মুকুলও ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিল।
সুলতান ভাই ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিটি মিছিলে থাকতেন উচ্চকিত। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি ভিয়েতনামের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের জন্য যে মিছিলে পুলিশের গুলিতে মতিউল-কাদের নিহত হন, সেই মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন সুলতান ভাইও।
আমার সঙ্গে কী করে যেন এই দুজনেরই হয়েছিল যাকে বলে গলায়-গলায় ভাব। কত সময় যে আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি। কত কী যে করেছি! কত স্বপ্নের জাল বুনেছি।
পৃথিবীটা সব মানুষের বাসযোগ্য করার জন্য সে কী ব্যাকুলতা-আকুলতা আমাদের। বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। কোনো মানুষ নিরক্ষর থাকবে না। কেউ বেকার থাকবে না। সবাই মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে। রোগে চিকিৎসা পাবে। আমাদের সবটুকু সময় তাই সংগঠন গড়ে তোলার কাজে ব্যয় করতাম। বাস্তবিক অর্থেই আমাদের ‘নাওয়া-খাওয়া’র ঠিকঠিকানা ছিল না। এমন অনেক দিন গেছে সত্যি সত্যি পেটে দানাপানি পড়েনি। তাতে আমাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। কত মানুষেরই তো প্রতিদিন আহার জোটে না!
আমাদের বয়সী অনেক ছাত্র তখন রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হলের সামনে দিয়ে ঘুর ঘুর করত। বিকেলে জটলা করত। বন্ধু জোটানো-পটানোর জন্য কতজনের কত কোশেশ। যারা সফল হতো, তাদের ভাবসাবই ছিল আলাদা। অসফলেরা ওদের হিংসা করত।
আমরা যারা ছাত্র ইউনিয়ন করতাম, ওসব করার তেমন সময় হতো না। দু-একজন যে ব্যতিক্রম ছিলেন না, তা অবশ্যই নয়! আবার সাংগঠনিক শৃঙ্খলার কারণে এবং কে কী মনে করে, তার ভয়ে আমাদের একটু সমঝেও চলতে হতো।
তাই বলে আমাদের কী কোনো সাধ-আহ্লাদ ছিল না? বয়সের দোষ বলে যে কথাটা আছে, আমাদের কি তা একেবারেই ছিল না? ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু তা অবদমনের ক্ষমতা কী করে যেন আমরা অর্জন করেছিলাম।
দিঘলকেশী কাউকে দেখে আমাদের মন কি গেয়ে উঠত না, ‘কুন্তল বন্যা, কে দিল তোমায় বলো কন্যা?’ মনে হতো, একটু কাছে যাই, পাশে পাশে একটু হাঁটি। না-ই বা হলো কোনো কথা! মনের ভেতর আনচান করা ভাবটা তো একটু কমত। কিন্তু না, কে যেন সাবধান করত, চেপে যা বাপ! আর বাড়িস না।
মুকুল ঠোঁট দিয়ে চমৎকার শিশ দিতে পারত। কয়েকটি গানের এমন সুন্দর সুর তুলত যে, শুনলে কানমন জুড়িয়ে যেত। মাঝেমধ্যে গভীর রাতে জগন্নাথ হলের দেয়াল টপকে আমি, মুকুল এবং আরও দু-একজন শামসুন্নাহার হলের সামনের রাস্তায় চলে যেতাম। মুকুল শিশ দিয়ে সুরের মূর্ছনা তুলত: ‘এই রাত শুধু তোমার আমার!’
শামসুন্নাহার হলের বারান্দায় লক্ষ্য করতাম, একে একে অনেক ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়াচ্ছে। কয়েক মিনিট যেন মোহাবিষ্ট থাকতাম আমরা। ব্যস, ওটুকুই! তাতেই আমরা আমোদিত হতাম। ওগুলো কি প্রেম ছিল? নাকি ভালো লাগার কিছু মুহূর্ত? চাঁদপুরের মতলবের মুকুলের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পরও কিছুদিন চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল। ও এলাকায় চলে গিয়েছিল। দেশে বিপ্লব হয়নি, সবার জন্য সমানাধিকার নিশ্চিত হয়নি। মুকুলের জীবনটা যেন কেমন শেকড় থেকে উপড়ে গিয়েছিল! আহা, মুকুল কোথায় গেলি বন্ধু!
মুকুলের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। মুকুল কেন হঠাৎ এসে আমার স্মৃতির দুয়ারে হানা দিল? বন্ধু মুকুল, ক্ষমা করে দিস এই অভাজনকে। মানুষের জীবন এমনই। যাকে ছাড়া চলবে না বলে মনে করা হয়, দেখা যায় সময়ের স্রোত তাকে ছাড়াই দিব্যি টেনে নিয়ে যায়!
সুলতান ভাই। কী প্রাণোচ্ছল এক মানুষ ছিলেন! হাসি-গল্পে মাতিয়ে রাখতেন। তাঁর নীতি ছিল: ‘নো চিন্তা, ডু ফুর্তি’। দুশ্চিন্তাহীন এক নতুন জীবনের সন্ধানী ছিলেন সুলতান ভাই। কত রকম পাগলামিই না করতেন। ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সভাপতি ছিলেন। একসঙ্গে কত সময় আমরা কাটিয়েছি, কত ধরনের কাজই না আমরা করেছি।
তখন আমরা বলাকা সিনেমা হলে প্রায়ই নাইট শো সিনেমা দেখতাম। রাত ১২টায় শো শেষ হয়েছে, সুলতান ভাইয়ের মনে হলো, ছবির নায়িকাকে গিয়ে অভিনন্দন জানিয়ে আসি! যাহা ভাবা, তাহা কাজ। অত রাতে ছোটা হলো অলিভিয়ার বাসায়। পাগল আর কাকে বলে! তাঁর পাগলামির সহযাত্রী আমি। দারোয়ান গেট খুলবে না। সুলতান ভাই বললেন, ‘যাও ম্যাডামকে বলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট সুলতান এসেছে।’
দারোয়ান ভেতরে গেল এবং একটু পরে হাসি মুখে এসে আমাদের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিল। রাতের পোশাকপরা নায়িকা অলিভিয়া দরজা খুলতেই অভিনন্দন জানালেন সুলতান ভাই। ছবির নাম ছিল ‘যখন বৃষ্টি এলো’ ইংরেজি টাইটেল ছিল: The Rain.
সুলতান ভাই অলিভিয়ার কাছে জানতে চাইলেন, ‘যখন সুলতান এলো’-এর ইংরেজি কি হবে— The Sultan?
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন অলিভিয়া।
সুলতান ভাইয়ের চোখমুখ ঠিকরে বের হচ্ছে উচ্ছ্বাস। খুব ছেলেমানুষি কি? ভেতরে ঢুকে আমরা একটুক্ষণ বসেই বিদায় নিলাম।
আরেক দিন আলমগীর কবিরের ‘সূর্যকন্যা’ দেখে বেরিয়ে সুলতান ভাইয়ের মনে হলো নায়িকা জয়শ্রী কবিরকে অভিনন্দন জানাতে হবে।
আমাকে সঙ্গে নিয়ে রাত দুপুরে হানা দিলেন আজিমপুর কলোনিতে আলমগীর কবিরের বাসায়। আলমগীর কবিরের সঙ্গে আমার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। আমি ছাত্রাবস্থায় ‘মুক্তকণ্ঠ’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন বের করতাম। তাতে চলচ্চিত্র বিষয়ে আলমগীর কবিরের একাধিক লেখা ছাপা হয়েছে। সুন্দরী রূপসী জয়শ্রী কবির সে রাতে আমাদের চাপ্যায়িত (চা পানে আপ্যায়িত, চাপ্যায়িত শব্দটি সাহিত্যিক শওকত ওসমান উদ্ভাবিত) করেছিলেন।
আজকের দিনে এসব ভাবা যায়! গাঁজাখুরি গল্প মনে হলেও এগুলো সত্য এবং এগুলো সম্ভব ছিল সুলতান ভাইয়ের পক্ষেই।
আচ্ছা, সুলতান ভাইয়ের মতো আমুদে মানুষটি কোথায় হারিয়ে গেলেন?
খুব মনে পড়ছে, মন পুড়ছে।
মুকুল কিংবা সুলতান ভাইয়ের কি এসব কথা মনে আছে? মনে পড়ে? সত্যি, কেউ ভোলে আর কেউ ভোলে না অতীত দিনের স্মৃতি!
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
৭ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
৭ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
৭ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
৭ ঘণ্টা আগে