মর্তুজা হাসান সৈকত
চলতি বছর পাকিস্তান থেকে পৃথক হওয়ার ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে বাংলাদেশের। ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে যখন বাংলাদেশের জন্ম হয়, তখন দেশটি ছিল খাঁ খাঁ বিরানভূমি। সামরিক শক্তিধর পাকিস্তান ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সমগ্র বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পাশাপাশি সব সম্পদ লুট করে। তদুপরি, নয় মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে খুন হন দেশের সেরা ও মেধাবী মানুষেরা। সেই প্রেক্ষাপটে অনেকেই ভেবেছিলেন যে বাংলাদেশ নামক শিশুরাষ্ট্রটি মুখ থুবড়ে পড়বে। এর পাশাপাশি অর্থনীতির বিভিন্ন পরিসংখ্যান এবং তৎকালীন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আদৌ টিকবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন বিশ্বের নামকরা অর্থনীতিবিদেরা।
১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন দেশ সম্পর্কে ‘বাংলাদেশ একটি তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে মন্তব্য করেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। অপরদিকে, ১৯৭৬ সালে নরওয়ের অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড এবং মার্কিন অর্থনীতিবিদ জে আর পার্কিনসন লন্ডন থেকে ‘বাংলাদেশ দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’ নামের একটি বই প্রকাশ করেন। সেই বইয়ে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে উন্নয়নের একটি পরীক্ষাক্ষেত্র। বাংলাদেশ যদি তার উন্নয়ন সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে যেকোনো দেশই উন্নতি করতে পারবে।’ তবে আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, এককালের সেই পেছনের সারির দেশটিই আজ পূর্ণতার পথে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করেছে। এমনকি স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির আগেই যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে গেছে পাকিস্তান থেকে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক উপদেষ্টা ও পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ আবিদ হাসান বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রশংসা করে মাত্রই কয় মাস আগে লিখেছেন, ২০ বছর আগেও চিন্তা করা যেত না যে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের প্রায় দ্বিগুণ হবে। বাংলাদেশের বর্তমান অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে এটি ২০৩০ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হবে। তিনি আরও লিখেছেন, পাকিস্তানের এখনকার পরিস্থিতির পরিবর্তন না ঘটলে ২০৩০ সালের দিকেই হয়তো বাংলাদেশের কাছে সাহায্য চাইতে হবে। যেকোনো দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ধরা হয় মানবসম্পদকে। যাতে বাংলাদেশ শুধু পাকিস্তান নয়, বেশ কিছু সূচকে এখন ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংক, ওয়ার্ল্ড
ইকোনমিক ফোরাম, ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে চিহ্নিত করেছে ‘বিস্ময়কর ধাঁধা’ হিসেবে। বিশ্বের শূন্য দশমিক ৪ শতাংশের তুলনায় ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে প্রতিবছর ৮ দশমিক ৬ শতাংশ হারে। তদুপরি, গত অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৯ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ২২৭ ডলার। অন্যদিকে, পাকিস্তানের ১ হাজার ৫৪৩ ডলার। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তো উন্নয়নের মডেলের কথা উঠলেই কথায় কথায় বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনেন। গত বছর বাংলাদেশ সফরকালে বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন উড়ন্ত সূচনার পর্যায়ে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, শিগগিরই এশিয়ার নতুন বাঘ হিসেবে আবির্ভূত হবে বাংলাদেশ।’ অন্যদিকে, বেশ কয়েক বছর আগে ‘আউট অব দ্য বাস্কেট’ নিবন্ধে ইকোনমিস্ট বলেছে, ‘কী করে উন্নয়নের মডেলে পরিণত হওয়া যায়, সেটা দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।’
বাংলাদেশের এই এগিয়ে যাওয়া ও পাকিস্তানের পিছিয়ে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, গত দশ বছরে বাংলাদেশ যেখানে গড়ে ৭ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি অর্জন করে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে, সেখানে পাকিস্তান ৩-৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে দক্ষিণ এশিয়াতেই তলানির দিকে আছে। এর পাশাপাশি পাকিস্তানের সমস্যার পাহাড় বড় করছে জনসংখ্যাও। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের জনসংখ্যা যেখানে বাংলাদেশের চেয়ে ১ কোটি কম ছিল, সেখানে বর্তমানে প্রায় ৪ কোটি বেশি। এই সময়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যেখানে ১ দশমিক ২ শতাংশ ছিল, পাকিস্তানের সেখানে ২ দশমিক ১ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ। জনসংখ্যা বিস্ফোরণের এই হুমকি কীভাবে সামাল দেওয়া যায়, তা নিয়ে রীতিমতো দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পাকিস্তানের সমাজবিজ্ঞানীরা। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই বর্ধিত জনসংখ্যা হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও। পাকিস্তানের অসচ্ছল পরিবারগুলো আর্থিক অনটনের কারণে তাদের সন্তানদের আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায় মাদ্রাসায় পাঠাচ্ছে। আর এসব মাদ্রাসা থেকে অনেক ‘জিহাদি’ এবং ধর্মীয় উগ্রপন্থী বের হচ্ছে।
অন্যদিকে, সামাজিক অবস্থার কারণেও পিছিয়ে গেছে পাকিস্তান। সেখানে সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা এমন যে, সব সম্পত্তি অল্পসংখ্যক লোকের হাতে কুক্ষিগত রয়েছে। ফলে সমগ্র পাকিস্তান দুটো শ্রেণিতে বিভক্ত—একটি হচ্ছে ধনিক শ্রেণি, আরেকটি গরিব শ্রেণি। মোটাদাগে কোনো মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠেনি সেখানে। কোনো একটি দেশে মধ্যবিত্ত না থাকলে সে দেশে বলার মতো শিল্পপণ্যের বা কৃষির বাজার গড়ে ওঠে না, বহুমুখী উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে ওঠে না। ফলে এর প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে, পড়ে রাজনীতিতেও। এ কারণে গণতন্ত্রের ভিতও শক্ত হয় না। যেমনটা হয়েছে পাকিস্তানে। এর পাশাপাশি দেশটিতে নারীর অধিকার নেই বললেই চলে। জেন্ডার প্যারিটি ইনডেক্সে ১৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ যেখানে ৫০তম, সেখানে পাকিস্তান আছে ১৫১তম অবস্থানে; অর্থাৎ একেবারে তলানিতে পড়ে আছে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৮ শতাংশ, যা পাকিস্তানে ২৩ শতাংশ। এখনো সেখানে অনার কিলিং বিদ্যমান।
কয়েক বছর আগে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর ক্ষমতায় বসে ঘোষণা দেন যে সুইডিশ গভর্নেন্স মডেলে দেশ পরিচালনা করবেন।
তিনি পাঁচ বছরের মধ্যে পাকিস্তানকে সুইডেনে রূপান্তরের স্বপ্নও দেখান। এর ফলে তখন পাকিস্তানজুড়ে রোল মডেল নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। ঠিক এ সময় পাকিস্তানের নাগরিক সমাজে তোলপাড় ফেলে দেয় ‘দ্য নেশন’ পত্রিকায় প্রকাশিত উন্নয়নকর্মী জাইঘাম খানের লেখা একটি কলাম। ‘দ্য বাংলাদেশ মডেল’ শিরোনামের সেই লেখায় পাকিস্তানকে সুইডেনে রূপান্তরের পরিবর্তে বাংলাদেশ হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। জাইঘাম খানের সেই প্রস্তাবের সমর্থনে একে একে বক্তব্য-বিবৃতি আসতে থাকে। গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে থাকে কলাম।
টেলিভিশনের টক শোতেও হয় আলোচনা। এমন একটি টক শোর একটি ক্লিপিং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেখানে আলোচক জাইঘাম খান বেশ জোরালো গলায় বলেন, অন্য কোনো দেশের উদাহরণ দিয়ে লাভ নেই, পাকিস্তানের উচিত প্রথমে বাংলাদেশ হওয়ার চেষ্টা করা। আর তা হতে কমপক্ষে ১০ বছর সময় লাগবে। তত দিনে বাংলাদেশ উন্নয়নের দিক দিয়ে অনেক দূর চলে যাবে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশটি পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে গেল, সেই দেশকেই এখন রোল মডেল ভাবছে পাকিস্তানের মানুষ, ভাবা যায়! বাংলাদেশ কতটা এগিয়ে গেল এটা তুলে ধরার জন্য এ তথ্যই তো যথেষ্ট।
এককালের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’খ্যাত দেশ বাংলাদেশকে যে পাকিস্তানিরা অনুসরণ করতে চায় তার প্রধানতম কারণ হচ্ছে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকগুলোয় নজিরবিহীন উত্থান।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার পরের চার দশকে বেশির ভাগ সূচকেই পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও শেখ হাসিনার গত এক দশকের শাসনামলে ব্যবধান ক্রমেই কমিয়ে আনে বাংলাদেশ। আর এখন তো পাকিস্তানই বাংলাদেশের চেয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে।
অন্যদিকে, সামরিক শাসন ও মৌলবাদ পাকিস্তানকে তলানিতে নিয়ে গেছে দিন দিন। জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং ফতোয়াভিত্তিক শাসনব্যবস্থাও পাকিস্তানের অগ্রযাত্রা স্থবির হওয়ার অন্যতম কারণ। তাই শুধু বাংলাদেশকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করলেই হবে না, এসব কাঠামোগত সংকটকেও দূর করতে হবে, না হলে আরও পিছিয়ে যেতে হবে পাকিস্তানকে।
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট
চলতি বছর পাকিস্তান থেকে পৃথক হওয়ার ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে বাংলাদেশের। ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে যখন বাংলাদেশের জন্ম হয়, তখন দেশটি ছিল খাঁ খাঁ বিরানভূমি। সামরিক শক্তিধর পাকিস্তান ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সমগ্র বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পাশাপাশি সব সম্পদ লুট করে। তদুপরি, নয় মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে খুন হন দেশের সেরা ও মেধাবী মানুষেরা। সেই প্রেক্ষাপটে অনেকেই ভেবেছিলেন যে বাংলাদেশ নামক শিশুরাষ্ট্রটি মুখ থুবড়ে পড়বে। এর পাশাপাশি অর্থনীতির বিভিন্ন পরিসংখ্যান এবং তৎকালীন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আদৌ টিকবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন বিশ্বের নামকরা অর্থনীতিবিদেরা।
১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন দেশ সম্পর্কে ‘বাংলাদেশ একটি তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে মন্তব্য করেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। অপরদিকে, ১৯৭৬ সালে নরওয়ের অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড এবং মার্কিন অর্থনীতিবিদ জে আর পার্কিনসন লন্ডন থেকে ‘বাংলাদেশ দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’ নামের একটি বই প্রকাশ করেন। সেই বইয়ে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে উন্নয়নের একটি পরীক্ষাক্ষেত্র। বাংলাদেশ যদি তার উন্নয়ন সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে যেকোনো দেশই উন্নতি করতে পারবে।’ তবে আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, এককালের সেই পেছনের সারির দেশটিই আজ পূর্ণতার পথে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করেছে। এমনকি স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির আগেই যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে গেছে পাকিস্তান থেকে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক উপদেষ্টা ও পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ আবিদ হাসান বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রশংসা করে মাত্রই কয় মাস আগে লিখেছেন, ২০ বছর আগেও চিন্তা করা যেত না যে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের প্রায় দ্বিগুণ হবে। বাংলাদেশের বর্তমান অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে এটি ২০৩০ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হবে। তিনি আরও লিখেছেন, পাকিস্তানের এখনকার পরিস্থিতির পরিবর্তন না ঘটলে ২০৩০ সালের দিকেই হয়তো বাংলাদেশের কাছে সাহায্য চাইতে হবে। যেকোনো দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ধরা হয় মানবসম্পদকে। যাতে বাংলাদেশ শুধু পাকিস্তান নয়, বেশ কিছু সূচকে এখন ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংক, ওয়ার্ল্ড
ইকোনমিক ফোরাম, ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে চিহ্নিত করেছে ‘বিস্ময়কর ধাঁধা’ হিসেবে। বিশ্বের শূন্য দশমিক ৪ শতাংশের তুলনায় ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে প্রতিবছর ৮ দশমিক ৬ শতাংশ হারে। তদুপরি, গত অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৯ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ২২৭ ডলার। অন্যদিকে, পাকিস্তানের ১ হাজার ৫৪৩ ডলার। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তো উন্নয়নের মডেলের কথা উঠলেই কথায় কথায় বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনেন। গত বছর বাংলাদেশ সফরকালে বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন উড়ন্ত সূচনার পর্যায়ে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, শিগগিরই এশিয়ার নতুন বাঘ হিসেবে আবির্ভূত হবে বাংলাদেশ।’ অন্যদিকে, বেশ কয়েক বছর আগে ‘আউট অব দ্য বাস্কেট’ নিবন্ধে ইকোনমিস্ট বলেছে, ‘কী করে উন্নয়নের মডেলে পরিণত হওয়া যায়, সেটা দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।’
বাংলাদেশের এই এগিয়ে যাওয়া ও পাকিস্তানের পিছিয়ে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, গত দশ বছরে বাংলাদেশ যেখানে গড়ে ৭ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি অর্জন করে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে, সেখানে পাকিস্তান ৩-৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে দক্ষিণ এশিয়াতেই তলানির দিকে আছে। এর পাশাপাশি পাকিস্তানের সমস্যার পাহাড় বড় করছে জনসংখ্যাও। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের জনসংখ্যা যেখানে বাংলাদেশের চেয়ে ১ কোটি কম ছিল, সেখানে বর্তমানে প্রায় ৪ কোটি বেশি। এই সময়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যেখানে ১ দশমিক ২ শতাংশ ছিল, পাকিস্তানের সেখানে ২ দশমিক ১ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ। জনসংখ্যা বিস্ফোরণের এই হুমকি কীভাবে সামাল দেওয়া যায়, তা নিয়ে রীতিমতো দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পাকিস্তানের সমাজবিজ্ঞানীরা। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই বর্ধিত জনসংখ্যা হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও। পাকিস্তানের অসচ্ছল পরিবারগুলো আর্থিক অনটনের কারণে তাদের সন্তানদের আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায় মাদ্রাসায় পাঠাচ্ছে। আর এসব মাদ্রাসা থেকে অনেক ‘জিহাদি’ এবং ধর্মীয় উগ্রপন্থী বের হচ্ছে।
অন্যদিকে, সামাজিক অবস্থার কারণেও পিছিয়ে গেছে পাকিস্তান। সেখানে সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা এমন যে, সব সম্পত্তি অল্পসংখ্যক লোকের হাতে কুক্ষিগত রয়েছে। ফলে সমগ্র পাকিস্তান দুটো শ্রেণিতে বিভক্ত—একটি হচ্ছে ধনিক শ্রেণি, আরেকটি গরিব শ্রেণি। মোটাদাগে কোনো মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠেনি সেখানে। কোনো একটি দেশে মধ্যবিত্ত না থাকলে সে দেশে বলার মতো শিল্পপণ্যের বা কৃষির বাজার গড়ে ওঠে না, বহুমুখী উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে ওঠে না। ফলে এর প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে, পড়ে রাজনীতিতেও। এ কারণে গণতন্ত্রের ভিতও শক্ত হয় না। যেমনটা হয়েছে পাকিস্তানে। এর পাশাপাশি দেশটিতে নারীর অধিকার নেই বললেই চলে। জেন্ডার প্যারিটি ইনডেক্সে ১৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ যেখানে ৫০তম, সেখানে পাকিস্তান আছে ১৫১তম অবস্থানে; অর্থাৎ একেবারে তলানিতে পড়ে আছে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৮ শতাংশ, যা পাকিস্তানে ২৩ শতাংশ। এখনো সেখানে অনার কিলিং বিদ্যমান।
কয়েক বছর আগে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর ক্ষমতায় বসে ঘোষণা দেন যে সুইডিশ গভর্নেন্স মডেলে দেশ পরিচালনা করবেন।
তিনি পাঁচ বছরের মধ্যে পাকিস্তানকে সুইডেনে রূপান্তরের স্বপ্নও দেখান। এর ফলে তখন পাকিস্তানজুড়ে রোল মডেল নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। ঠিক এ সময় পাকিস্তানের নাগরিক সমাজে তোলপাড় ফেলে দেয় ‘দ্য নেশন’ পত্রিকায় প্রকাশিত উন্নয়নকর্মী জাইঘাম খানের লেখা একটি কলাম। ‘দ্য বাংলাদেশ মডেল’ শিরোনামের সেই লেখায় পাকিস্তানকে সুইডেনে রূপান্তরের পরিবর্তে বাংলাদেশ হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। জাইঘাম খানের সেই প্রস্তাবের সমর্থনে একে একে বক্তব্য-বিবৃতি আসতে থাকে। গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে থাকে কলাম।
টেলিভিশনের টক শোতেও হয় আলোচনা। এমন একটি টক শোর একটি ক্লিপিং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেখানে আলোচক জাইঘাম খান বেশ জোরালো গলায় বলেন, অন্য কোনো দেশের উদাহরণ দিয়ে লাভ নেই, পাকিস্তানের উচিত প্রথমে বাংলাদেশ হওয়ার চেষ্টা করা। আর তা হতে কমপক্ষে ১০ বছর সময় লাগবে। তত দিনে বাংলাদেশ উন্নয়নের দিক দিয়ে অনেক দূর চলে যাবে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশটি পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে গেল, সেই দেশকেই এখন রোল মডেল ভাবছে পাকিস্তানের মানুষ, ভাবা যায়! বাংলাদেশ কতটা এগিয়ে গেল এটা তুলে ধরার জন্য এ তথ্যই তো যথেষ্ট।
এককালের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’খ্যাত দেশ বাংলাদেশকে যে পাকিস্তানিরা অনুসরণ করতে চায় তার প্রধানতম কারণ হচ্ছে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকগুলোয় নজিরবিহীন উত্থান।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার পরের চার দশকে বেশির ভাগ সূচকেই পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও শেখ হাসিনার গত এক দশকের শাসনামলে ব্যবধান ক্রমেই কমিয়ে আনে বাংলাদেশ। আর এখন তো পাকিস্তানই বাংলাদেশের চেয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে।
অন্যদিকে, সামরিক শাসন ও মৌলবাদ পাকিস্তানকে তলানিতে নিয়ে গেছে দিন দিন। জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং ফতোয়াভিত্তিক শাসনব্যবস্থাও পাকিস্তানের অগ্রযাত্রা স্থবির হওয়ার অন্যতম কারণ। তাই শুধু বাংলাদেশকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করলেই হবে না, এসব কাঠামোগত সংকটকেও দূর করতে হবে, না হলে আরও পিছিয়ে যেতে হবে পাকিস্তানকে।
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
৬ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
৬ ঘণ্টা আগে