ড. মইনুল ইসলাম
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিনিময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কনফেডারেশন গঠনসংক্রান্ত মার্কিন প্রস্তাবে সায় দিয়ে খোন্দকার মোশতাকের গোপন ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে ‘স্বাধীনতা, শুধুই বাংলাদেশের স্বাধীনতার’ সপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি তাজউদ্দীনের আপসহীন অবস্থান গ্রহণকে সম্মান জানানোর জন্যই আজকের কলামটি লিখছি। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি তাজউদ্দীনের প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা প্রদানের ব্যাপারে এখনো বিস্ময়কর কৃপণতা দেখানো হচ্ছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বিকেলে যখন ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করলেন, তখনই বোঝা গিয়েছিল যে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালি জাতির ওপর সশস্ত্র আঘাত হানতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বেরও এ ব্যাপারে প্রস্তুতি ছিল। পরিকল্পনা মোতাবেক বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার কথা ছিল; বঙ্গবন্ধু এ ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছিলেন।
আক্রমণের জন্য সেনাবাহিনীর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে রওনা হওয়ার খবর পেয়েই তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর বাসায় গেলেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেতে, পুরান ঢাকার একটি বাসাও ঠিক করে রাখা হয়েছিল আত্মগোপনের জন্য। কিন্তু ইতিহাসের ওই যুগসন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধু কোথাও যেতে রাজি হলেন না। তাজউদ্দীনের তাবৎ কাকুতি-মিনতি বিফলে গেল। বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত, ‘তোমরা যা করার করো, আমি কোথাও যাব না।’ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার জন্য পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাজউদ্দীন ঘোষণাপত্র এবং টেপরেকর্ডারও নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু টেপে ঘোষণা দিতে বা স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালেন। বঙ্গবন্ধুর মন্তব্য, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্যে বিচার করতে পারবে’ (সূত্র: শারমিন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা, ঐতিহ্য, এপ্রিল ২০১৪)।
তাজউদ্দীনকে ফিরিয়ে দিলেও স্বাধীনতা ঘোষণার বিকল্প ব্যবস্থা ছিল বঙ্গবন্ধুর, এটা এখন প্রমাণিত। তিনি স্বেচ্ছায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার সিদ্ধান্ত যেমন নিয়েছিলেন, তেমনি আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের অগোচরে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটিও জাতিকে জানানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। তাজউদ্দীনকন্যা শারমিন আহমদের বইয়ে ওয়্যারলেস বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হকের একটি টেলিফোন কল রিসিভ করার প্রসঙ্গটি বর্ণিত হয়েছে, যে কল ২৫ মার্চ মধ্যরাতের অব্যবহিত পর রিসিভ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী গোলাম মোরশেদ। জনাব নুরুল হক গোলাম মোরশেদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘মেসেজটি পাঠানো হয়ে গেছে। এখন মেশিনটি কী করব?’ তখন গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। তাই বঙ্গবন্ধু টেলিফোন কল রিসিভ না করেই গোলাম মোরশেদের মাধ্যমে জবাব দিয়েছিলেন, ‘মেশিনটি ভেঙে ফেলে পালিয়ে যেতে বল্’। গোলাম মোরশেদের এই কাহিনির সমর্থন মিলছে ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হককে ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ওই ওয়্যারলেস মেসেজ পাঠানোর অপরাধে বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করার ঘটনায়। শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু তদানীন্তন ইপিআরের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ওয়্যারলেস মেসেজটি পাঠিয়েছিলেন। আরেকটি ভার্সন বলছে, মগবাজার ওয়্যারলেস অফিসের মাধ্যমে মেসেজটি পাঠানো হয়েছিল। যেভাবেই পাঠানো হোক, কয়েকটি দেশের সংবাদপত্রে স্বাধীনতা ঘোষণার টেলিপ্রিন্টার মেসেজের ভিত্তিতে ২৬ মার্চ সকালে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এই কাহিনি ২৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার অকাট্য প্রমাণ, যা ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ওই মেসেজ চট্টগ্রামের সিলিমপুরের ওয়্যারলেস অফিস থেকে মিসেস নুরুন্নাহার জহুরকে ফোনে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল, যেটা সাইক্লোস্টাইল করে ২৬ মার্চ সকালে চট্টগ্রামে প্রচার করা হয়েছিল। একটি ঘোড়ার গাড়িতে করে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারকারীদের হাত থেকে আমিও লিফলেটটা পেয়েছিলাম চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায়।
এরপর কীভাবে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বিক্ষুব্ধ তাজউদ্দীনকে গভীর রাতে বাসা থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে লালমাটিয়ার একটি বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন এবং ২৭ মার্চ কারফিউ প্রত্যাহারের পর তিন দিন তিন রাতের কঠিন ও বিপৎসংকুল যাত্রা পার হয়ে ৩০ মার্চ কুষ্টিয়ার জীবননগর সীমান্তের টুঙ্গ নামক জায়গার একটি কালভার্টের ওপর পৌঁছে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও মাহবুবউদ্দিন আহমদকে বিএসএফের ক্যাম্পে আলোচনার জন্য পাঠিয়েছিলেন, তার মনোমুগ্ধকর বর্ণনা শারমিন আহমদের বইটির ১০৬ থেকে ১১০ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত আছে। তাজউদ্দীন ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, টুঙ্গর ওই কালভার্টের ওপর অপেক্ষার সময়েই তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে একটা স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন এবং এর জন্য ভারতের সাহায্য কামনা করবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাজউদ্দীন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে বিএসএফের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে আসেন বিএসএফের পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক প্রধান গোলোক মজুমদার। তাঁর মাধ্যমে বিএসএফের মহাপরিচালক সুন্দরজি খবর পেয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। মিসেস গান্ধী তাজউদ্দীন ও ব্যারিস্টার আমীর-উলকে সাক্ষাৎদানে সম্মত হওয়ায় তাঁদের নয়াদিল্লিতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এয়ারপোর্টে তাঁদের জামাকাপড়ের মলিন ও জীর্ণদশা দেখে সুন্দরজি নিজের স্যুটকেস থেকে কাপড় দিয়ে তাঁদের কাপড় পাল্টানোর সুযোগ করে দেন। পরে তাঁদের আরও কিছু জামাকাপড় কিনে দেওয়া হয়েছিল। এপ্রিলের ৩ তারিখে শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। দিল্লিতে এরই মধ্যে গিয়ে পৌঁছান বাংলাদেশের দুজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ প্রফেসর রেহমান সোবহান ও ড. আনিসুর রহমান, তাঁরাও আলোচনায় শরিক হন। একাধিক বৈঠকের পর ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন বেতার ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। স্বাধীনতা ঘোষণার ভাষণটির মুসাবিদা করেছিলেন তাজউদ্দীন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও প্রফেসর রেহমান সোবহান। এভাবেই রচিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিলের মুজিবনগর দিবসের ইতিহাস। ইতিহাসের রায় হলো, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্বের কাছে ‘অবিসংবাদিত বৈধতা’ দিয়েছিল। এই ইতিহাসের স্রষ্টাকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে কৃপণতা কেন? এটা খুবই বেদনাদায়ক যে, কোনো অজানা কারণে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় একবারও মুজিবনগরে যাননি, শেখ হাসিনাও কখনো মুজিবনগরে যান না। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনে মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি তাজউদ্দীনের যে ভূমিকা ওপরে বর্ণিত হলো, সেখানে তাঁর অপরাধ কোথায়?
অথচ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরত আসার দিনেই তাঁর এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের পেছনে অসৎ উদ্দেশ্যের মিথ্যা বয়ান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে তাজউদ্দীনের ওপর রুষ্ট করেছিল কে বা কারা! সেপ্টেম্বর মাসে খোন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্যও হয়তো দায়ী করা হয়েছিল তাজউদ্দীনকে!! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে পরবর্তী সময়ে তাঁর বন্ধু তাজউদ্দীন জানিয়েছিলেন, ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি তারিখেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি বঙ্গবন্ধুর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। বিনা অপরাধে এহেন শাস্তি পেয়ে তাজউদ্দীন অভিমান করেছিলেন। তিনি একাধিকবার বলেছেন, ‘আমি কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করলাম, মুজিব ভাই একটিবারও জানতে চাইলেন না।’ জাতির চরম দুর্ভাগ্য, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের আস্থার সম্পর্ক তাঁদের জীবদ্দশায় আর জোড়া লাগেনি। আত্মসম্মানবোধের কারণে তাজউদ্দীনও নিজের ভূমিকা ব্যাখ্যা করে বঙ্গবন্ধুর ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করেননি একবারও। শারমিন আহমদের বই থেকেই জানতে পেরেছি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তাজউদ্দীন বারবার আফসোস করেছিলেন, ‘মুজিব ভাই জেনেও গেলেন না কে তাঁর বন্ধু আর কে শত্রু।’ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ইতিহাস একদিন তাজউদ্দীনের অভিমানকে মূল্যায়ন করবেই। মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারিকে যাঁরা প্রাপ্য মর্যাদা দিচ্ছেন না, তাঁদেরও শুভবুদ্ধির উদয় হবে।
বঙ্গবন্ধুই ছিলেন তাজউদ্দীন-ঘোষিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি, বঙ্গবন্ধুর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল। বৈদ্যনাথতলার ভবেরপাড়াকে ‘মুজিবনগর’ নামকরণও করেছিলেন স্বয়ং তাজউদ্দীন। আবার সেপ্টেম্বর মাসে স্বাধীনতাকে ভন্ডুল করার জন্য খোন্দকার মোশতাকের মাধ্যমে প্রদত্ত মার্কিন কূটচালকেও রুখে দিয়েছিলেন তাজউদ্দীনই। তাঁকে সম্মান জানালে তাজউদ্দীনকে দূরে ঠেলে দিয়ে বঙ্গবন্ধু যে ভুল করেছিলেন, তা সংশোধিত হবে, বঙ্গবন্ধুর আত্মা এতে শান্তি পাবে।
লেখক: ড. মইনুল ইসলাম একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিনিময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কনফেডারেশন গঠনসংক্রান্ত মার্কিন প্রস্তাবে সায় দিয়ে খোন্দকার মোশতাকের গোপন ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে ‘স্বাধীনতা, শুধুই বাংলাদেশের স্বাধীনতার’ সপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি তাজউদ্দীনের আপসহীন অবস্থান গ্রহণকে সম্মান জানানোর জন্যই আজকের কলামটি লিখছি। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি তাজউদ্দীনের প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা প্রদানের ব্যাপারে এখনো বিস্ময়কর কৃপণতা দেখানো হচ্ছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বিকেলে যখন ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করলেন, তখনই বোঝা গিয়েছিল যে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালি জাতির ওপর সশস্ত্র আঘাত হানতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বেরও এ ব্যাপারে প্রস্তুতি ছিল। পরিকল্পনা মোতাবেক বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার কথা ছিল; বঙ্গবন্ধু এ ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছিলেন।
আক্রমণের জন্য সেনাবাহিনীর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে রওনা হওয়ার খবর পেয়েই তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর বাসায় গেলেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেতে, পুরান ঢাকার একটি বাসাও ঠিক করে রাখা হয়েছিল আত্মগোপনের জন্য। কিন্তু ইতিহাসের ওই যুগসন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধু কোথাও যেতে রাজি হলেন না। তাজউদ্দীনের তাবৎ কাকুতি-মিনতি বিফলে গেল। বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত, ‘তোমরা যা করার করো, আমি কোথাও যাব না।’ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার জন্য পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাজউদ্দীন ঘোষণাপত্র এবং টেপরেকর্ডারও নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু টেপে ঘোষণা দিতে বা স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালেন। বঙ্গবন্ধুর মন্তব্য, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্যে বিচার করতে পারবে’ (সূত্র: শারমিন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা, ঐতিহ্য, এপ্রিল ২০১৪)।
তাজউদ্দীনকে ফিরিয়ে দিলেও স্বাধীনতা ঘোষণার বিকল্প ব্যবস্থা ছিল বঙ্গবন্ধুর, এটা এখন প্রমাণিত। তিনি স্বেচ্ছায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার সিদ্ধান্ত যেমন নিয়েছিলেন, তেমনি আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের অগোচরে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটিও জাতিকে জানানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। তাজউদ্দীনকন্যা শারমিন আহমদের বইয়ে ওয়্যারলেস বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হকের একটি টেলিফোন কল রিসিভ করার প্রসঙ্গটি বর্ণিত হয়েছে, যে কল ২৫ মার্চ মধ্যরাতের অব্যবহিত পর রিসিভ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী গোলাম মোরশেদ। জনাব নুরুল হক গোলাম মোরশেদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘মেসেজটি পাঠানো হয়ে গেছে। এখন মেশিনটি কী করব?’ তখন গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। তাই বঙ্গবন্ধু টেলিফোন কল রিসিভ না করেই গোলাম মোরশেদের মাধ্যমে জবাব দিয়েছিলেন, ‘মেশিনটি ভেঙে ফেলে পালিয়ে যেতে বল্’। গোলাম মোরশেদের এই কাহিনির সমর্থন মিলছে ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হককে ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ওই ওয়্যারলেস মেসেজ পাঠানোর অপরাধে বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করার ঘটনায়। শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু তদানীন্তন ইপিআরের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ওয়্যারলেস মেসেজটি পাঠিয়েছিলেন। আরেকটি ভার্সন বলছে, মগবাজার ওয়্যারলেস অফিসের মাধ্যমে মেসেজটি পাঠানো হয়েছিল। যেভাবেই পাঠানো হোক, কয়েকটি দেশের সংবাদপত্রে স্বাধীনতা ঘোষণার টেলিপ্রিন্টার মেসেজের ভিত্তিতে ২৬ মার্চ সকালে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এই কাহিনি ২৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার অকাট্য প্রমাণ, যা ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ওই মেসেজ চট্টগ্রামের সিলিমপুরের ওয়্যারলেস অফিস থেকে মিসেস নুরুন্নাহার জহুরকে ফোনে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল, যেটা সাইক্লোস্টাইল করে ২৬ মার্চ সকালে চট্টগ্রামে প্রচার করা হয়েছিল। একটি ঘোড়ার গাড়িতে করে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারকারীদের হাত থেকে আমিও লিফলেটটা পেয়েছিলাম চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায়।
এরপর কীভাবে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বিক্ষুব্ধ তাজউদ্দীনকে গভীর রাতে বাসা থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে লালমাটিয়ার একটি বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন এবং ২৭ মার্চ কারফিউ প্রত্যাহারের পর তিন দিন তিন রাতের কঠিন ও বিপৎসংকুল যাত্রা পার হয়ে ৩০ মার্চ কুষ্টিয়ার জীবননগর সীমান্তের টুঙ্গ নামক জায়গার একটি কালভার্টের ওপর পৌঁছে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও মাহবুবউদ্দিন আহমদকে বিএসএফের ক্যাম্পে আলোচনার জন্য পাঠিয়েছিলেন, তার মনোমুগ্ধকর বর্ণনা শারমিন আহমদের বইটির ১০৬ থেকে ১১০ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত আছে। তাজউদ্দীন ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, টুঙ্গর ওই কালভার্টের ওপর অপেক্ষার সময়েই তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে একটা স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন এবং এর জন্য ভারতের সাহায্য কামনা করবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাজউদ্দীন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে বিএসএফের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে আসেন বিএসএফের পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক প্রধান গোলোক মজুমদার। তাঁর মাধ্যমে বিএসএফের মহাপরিচালক সুন্দরজি খবর পেয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। মিসেস গান্ধী তাজউদ্দীন ও ব্যারিস্টার আমীর-উলকে সাক্ষাৎদানে সম্মত হওয়ায় তাঁদের নয়াদিল্লিতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এয়ারপোর্টে তাঁদের জামাকাপড়ের মলিন ও জীর্ণদশা দেখে সুন্দরজি নিজের স্যুটকেস থেকে কাপড় দিয়ে তাঁদের কাপড় পাল্টানোর সুযোগ করে দেন। পরে তাঁদের আরও কিছু জামাকাপড় কিনে দেওয়া হয়েছিল। এপ্রিলের ৩ তারিখে শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। দিল্লিতে এরই মধ্যে গিয়ে পৌঁছান বাংলাদেশের দুজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ প্রফেসর রেহমান সোবহান ও ড. আনিসুর রহমান, তাঁরাও আলোচনায় শরিক হন। একাধিক বৈঠকের পর ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন বেতার ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। স্বাধীনতা ঘোষণার ভাষণটির মুসাবিদা করেছিলেন তাজউদ্দীন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও প্রফেসর রেহমান সোবহান। এভাবেই রচিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিলের মুজিবনগর দিবসের ইতিহাস। ইতিহাসের রায় হলো, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্বের কাছে ‘অবিসংবাদিত বৈধতা’ দিয়েছিল। এই ইতিহাসের স্রষ্টাকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে কৃপণতা কেন? এটা খুবই বেদনাদায়ক যে, কোনো অজানা কারণে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় একবারও মুজিবনগরে যাননি, শেখ হাসিনাও কখনো মুজিবনগরে যান না। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনে মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি তাজউদ্দীনের যে ভূমিকা ওপরে বর্ণিত হলো, সেখানে তাঁর অপরাধ কোথায়?
অথচ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরত আসার দিনেই তাঁর এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের পেছনে অসৎ উদ্দেশ্যের মিথ্যা বয়ান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে তাজউদ্দীনের ওপর রুষ্ট করেছিল কে বা কারা! সেপ্টেম্বর মাসে খোন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্যও হয়তো দায়ী করা হয়েছিল তাজউদ্দীনকে!! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে পরবর্তী সময়ে তাঁর বন্ধু তাজউদ্দীন জানিয়েছিলেন, ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি তারিখেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি বঙ্গবন্ধুর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। বিনা অপরাধে এহেন শাস্তি পেয়ে তাজউদ্দীন অভিমান করেছিলেন। তিনি একাধিকবার বলেছেন, ‘আমি কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করলাম, মুজিব ভাই একটিবারও জানতে চাইলেন না।’ জাতির চরম দুর্ভাগ্য, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের আস্থার সম্পর্ক তাঁদের জীবদ্দশায় আর জোড়া লাগেনি। আত্মসম্মানবোধের কারণে তাজউদ্দীনও নিজের ভূমিকা ব্যাখ্যা করে বঙ্গবন্ধুর ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করেননি একবারও। শারমিন আহমদের বই থেকেই জানতে পেরেছি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তাজউদ্দীন বারবার আফসোস করেছিলেন, ‘মুজিব ভাই জেনেও গেলেন না কে তাঁর বন্ধু আর কে শত্রু।’ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ইতিহাস একদিন তাজউদ্দীনের অভিমানকে মূল্যায়ন করবেই। মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারিকে যাঁরা প্রাপ্য মর্যাদা দিচ্ছেন না, তাঁদেরও শুভবুদ্ধির উদয় হবে।
বঙ্গবন্ধুই ছিলেন তাজউদ্দীন-ঘোষিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি, বঙ্গবন্ধুর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল। বৈদ্যনাথতলার ভবেরপাড়াকে ‘মুজিবনগর’ নামকরণও করেছিলেন স্বয়ং তাজউদ্দীন। আবার সেপ্টেম্বর মাসে স্বাধীনতাকে ভন্ডুল করার জন্য খোন্দকার মোশতাকের মাধ্যমে প্রদত্ত মার্কিন কূটচালকেও রুখে দিয়েছিলেন তাজউদ্দীনই। তাঁকে সম্মান জানালে তাজউদ্দীনকে দূরে ঠেলে দিয়ে বঙ্গবন্ধু যে ভুল করেছিলেন, তা সংশোধিত হবে, বঙ্গবন্ধুর আত্মা এতে শান্তি পাবে।
লেখক: ড. মইনুল ইসলাম একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
১ দিন আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
১ দিন আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
১ দিন আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
১ দিন আগে