সেলিম জাহান
‘সত্যবাবুদের বাড়ির প্রতিমা সবচেয়ে সুন্দর হয়েছে।’ বেশ জোরের সঙ্গে তার সিদ্ধান্ত জানায় তিন কিশোরের একজন। ‘তোকে বলেছে!’, প্রতিবাদ জানায় দ্বিতীয় কিশোর, ‘সবচেয়ে ভালো হয়েছে চকবাজারের মণ্ডপ।’ ‘তুই প্রতিমার কী জানিস?’ রেগে যায় প্রথম কিশোর, ‘তোরা পূজা করিস?’ উত্তেজিত দুই কিশোর প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে আসে। তৃতীয় যে বালকটি এতক্ষণ চুপচাপ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল, সে এবার নিচু স্বরে বলে, ‘এই চুপ, চুপ! পণ্ডিত মশায় আসছেন।’ অন্য দুই কিশোর এ সাবধানবাণীতে সচেতন হয়ে ওঠে। ততক্ষণে তিনি একেবারে কাছে এসে পড়েছেন। ‘নমস্কার, পণ্ডিত মশায়’ বলতে বলতে দুই মিনিট আগের ঝগড়া ভুলে গিয়ে তিন কিশোরই পণ্ডিত মশায়ের পদতলে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত। ‘বেঁচে থাকো, বাবারা, দীর্ঘজীবী হও’, বলতে বলতে তিন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী তিন কিশোরকে বুকে টেনে নেন পণ্ডিত মশায় সত্যবাবুদের বিরাট পূজামণ্ডপের সামনে। ৬০ বছরের ওপরে কোনো এক বিজয়া দশমী। স্থান বরিশাল শহরের মধ্যস্থল।
‘খুব খিদে পেয়েছে’, তিন কিশোরের একজন ঘোষণা করে পণ্ডিত মশায়ের বিদায়ের ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই। কিছুক্ষণ আগের জোর তর্ক তখন ইতিহাস মাত্র। ‘বিমলদের বাড়ি সবচেয়ে কাছে’, একজন বলে ওঠে। মিনিট দশেকের মধ্যেই তিনজনকে দেখা যায় বিমলদের বাড়ির রান্নাঘরের সামনে। বিমলবাবু তখন সবেমাত্র ফলারে বসেছেন। এই ত্রিমূর্তিকে দেখে তিনি মোটেই প্রীত হন না, বুঝতেই পারেন বন্ধুরা ভাগ বসাতে এসেছে। কিন্তু ভারি খুশি হন আশা মাসিমা, বিমলের মা। উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তাঁর মুখ হাসি আর আনন্দে। ‘আয়, আয় বোস’, বলতে বলতে তিন পাত পাড়েন তিনজনের জন্য। খিদের চোটে ত্রিরত্ন মাসিমাকে বিজয়ার প্রণাম করতে ভুলে যায়। ‘ওদের পাতে দুটো করে নাড়ু দিয়েছ কেন? আমাকে দিয়েছ একটা মাত্র’, বিমলবাবু কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন। ‘ছি, এভাবে বলতে হয় না, বাবা। ওরা অতিথি না? অতিথি নারায়ণ’, বিমলের মা ভারি নরম গলায় বলেন। ‘কেন, ঈদের সময় যখন আমাদের বাড়িতে যাস, তখন আম্মা তোকে আটটা মাংসের টুকরো দেন না? আমাকে দেন মাত্র চারটে’, একটি কিশোর মোক্ষম যুক্তি উত্থাপন করে।
পেটপূজা সেরে মাসিমাকে কোনোক্রমে একটি ছোট্ট প্রণাম সেরে তিন বন্ধু বাইরে এসে দাঁড়ায়। পেটটা ঠিকমতো ভরানো হয়নি। কী করা যায় এখন? ‘চল, শুভদের বাড়িতে গিয়ে রাবড়ি খেয়ে আসি’, একজন প্রস্তাব দেয়। এর চেয়ে ভালো কথা আর হয় না, ভাবে অন্য দুজন। নীলিমা কাকিমা ভারি ভালো রাবড়ি বানান। শিবরাম পড়ার পর থেকে তিনজনই রাবড়ির ভারি ভক্ত। মিনিট বিশেক পর এই তিন হরিহর আত্মাকে দেখা যায় কলেজপাড়ায় শুভেন্দুদের বাড়ির সামনের দরজায়।
খোলা দরজা দিয়ে তিনজনই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। আর পড়বি তো পড় একেবারে নীলিমা কাকিমার সামনে। একপেড়ে করে মোটা লাল পাড়ের গরদের শাড়িপরা, কপালে লাল বড় টিপ, শাঁখা-সিঁদুরে ফরসা কাকিমাকে সাক্ষাৎ প্রতিমার মতো মনে হয় তিন কিশোরের। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম কাকিমার, দু-হাতে দুটো নৈবেদ্যের থালা। ঢিপ ঢিপ করে কাকিমাকে প্রণাম করে তিনজনই। ‘ওরে, থাম, থাম। থালা দুটো আগে নামিয়ে রাখি।’ কাকিমা বলে ওঠেন। ‘রাবড়ি আছে?’ সময় নষ্ট করতে রাজি নয় ত্রিরত্ন। ‘ও, এ জন্যই আসা বাবুদের’, মুখ টিপে হাসেন নীলিমা কাকি, ‘বিজয়ার প্রণাম-ট্রনাম কিছুই নয়’। ঢিপ ঢিপ করে আবার প্রণাম, রাবড়ি না ফসকে যায়। খিলখিল করে হেসে ওঠেন কাকিমা। তারপর ভারি মায়াময় কণ্ঠে বলেন, ‘আয়, দিচ্ছি।’
রাবড়ি দিয়ে পেট ভরিয়ে রাস্তায় নামতেই দেখা গেল হারান কাকা ও সিরাজ চাচা গল্প করতে করতে এদিকেই আসছেন। ‘রাবড়ি খেতে আসছেন’, তিন কিশোরের একজন বাকি দুজনকে জানায়। তারপর তিনজনেই হাসিতে ভেঙে পড়ে। ‘কী রে, টইটই করে সারা দুপুর পাড়া বেড়াচ্ছিস কেন? যা বাড়ি যা’, সিরাজ চাচা ধমকে ওঠেন। ওঁরা পার হয়ে যেতেই তিন কিশোর ঠোঁট বাঁকায়, ‘হুঁ, নিজেরা পাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে! আর আমরা ঘুরলেই সব দোষ।’ ‘বড়রা ভারি হিংসুটে হয়’, দ্রুত এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে তিন কিশোরের এক মিনিটও লাগে না।
ঠিক তখনই দেখা যায় বাঁ দিকের গলি থেকে বেরিয়ে আসছেন নাজমা আপা আর রত্নাদি। কলেজের শেষ বছরে পড়া দুজনের গলায়-গলায় বন্ধুত্ব। গুজ গুজ করে তিন বন্ধু কী যেন মতলব ফাঁদে। তারপর তরুণী দুজন একেবারে সামনে আসতেই দুজন কিশোর দ্রুত প্রণামের ভঙ্গিতে আপা আর দিদির পা জড়িয়ে বসে পড়ে। তরুণী দুজন চরম বিব্রত। ‘এই, এ কী শয়তানি হচ্ছে!’ ‘দাঁড়া, এমন মার খাবি না! ছেড়ে দে লক্ষ্মী ভাই আমার।’ ভয় দেখানো, অনুরোধ-উপরোধ; কিন্তু নট নড়ন-চড়ন, নট কিচ্ছু। ‘বিজয়ার প্রণাম। দুজনকে দুটো টাকা দিয়ে দাও, ছেড়ে দেবে’, তৃতীয় কিশোরটি ত্রাণকর্তার ভূমিকা নেয়। পারলে তিনজনকেই ভস্ম করে দেয় তরুণী দুজন তাদের চোখের দৃষ্টি দিয়ে। দিতেই হয় টাকা—তিন কিশোরের উল্লাস দেখে কে? আপাতত বাড়ি যাওয়া যাক। রাতে আবার প্রতিমা বিসর্জনের সময় দেখা হবে।
গভীর রাত। কীর্তনখোলার পাড়। প্রতিমা নৌকায় নিয়ে মাঝনদীতে গেছে। ঢোলের বাদ্যি তুঙ্গে। নদীর পাড় ধরে শত শত মানুষ। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ওই তিন কিশোর। সবার চোখে জল—তিন কিশোরেরও। প্রণামের ভঙ্গিতে সবাই যুক্তকর হয়—কে কোন ধর্মের তা সেখানে তুচ্ছ। একসময়ে ঝপাৎ করে একটা শব্দ হয়। প্রতিমা বিসর্জিত হয়েছে। তিন কিশোর বন্ধু জলভরা চোখে পরস্পরকে টেনে নেয় উষ্ণ আলিঙ্গনে।
এবারও বিজয়া দশমী আসবে। কিন্তু সময় কত বদলে গেছে, বদলে গেছে মানুষ। একসময় যা ছিল সর্বজনীন, আজ তা হয়ে গেছে খণ্ডিত। একসময় যা ছিল অবিভাজ্য, আজ তা হয়ে গেছে বিভাজিত। একসময় যা ছিল বৃহত্তর সংস্কৃতি, আজ তা হয়ে গেছে সীমিত ধর্ম। বলা হচ্ছে, রাম আর রহিম আলাদা, জলের সঙ্গে পানি মিলতে পারে না, আল্লাহ আর ভগবান এক নন। নানান জায়গায় পূজায় বাধা দেওয়া হচ্ছে, মণ্ডপ ভাঙা হচ্ছে এখানে-ওখানে। অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ।
‘তবু আশা জাগে, তবু ভালো লাগে’—বিজয়ার শুভেচ্ছা যায় এক মানুষের কাছ থেকে আরেক মানুষের কাছে, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ‘ভালো থাকুক সবাই, আনন্দ আসুক প্রতিটি জীবনে, মঙ্গল হোক সবার’—সব শুভেচ্ছার ওটাই তো মূলকথা। কিন্তু তারপরও কথা আছে বিজয়ার শুভেচ্ছার—‘আমরা কেউ একা নই, আমরা সবাই সবার সঙ্গে আছি, আমরা সবাই মিলে ওই অদ্ভুত আঁধারকে সরিয়ে দেব।’ আমাদের সবার ‘মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে’।
৬০ বছর পর এবারের বিজয়া দশমীতে ওই তিন কিশোরের একজন পেছন ফিরে তাকাবে। ওই তো ১৯৬৪-র দাঙ্গার পর অপূর্বরা চলে যাচ্ছে দেশ ছেড়ে অতি ভোরে। ঠেলাগাড়ির মাথায় বসা অপূর্ব জামার হাতায় চোখ মুছছে। আজকের পেছন ফিরে তাকিয়ে থাকা কিশোরটি সেদিন হাতের ডালটি মট করে ভেঙে ফেলেছিল—কোন রাগে কে জানে। ওই তো তার কয়েক বছর পর ডেনিশরা অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমাল। সংখ্যালঘু খ্রিষ্টানদের জন্য নিরাপদ নয় এই দেশ। যেদিন ওরা চলে যায়, আজকের পেছন ফিরে তাকানো কিশোরটি সেদিন শুধু একবার আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। কী যে তার নালিশ এবং কার কাছে যে তার নালিশ—কে জানে। আস্তে আস্তে পেছন ফিরে তাকানো কিশোরটি সামনের দিকে মুখ ফেরায়—দেখা যায় তাকে পরিষ্কার। এ তো আর কেউ নয়—এ যে আমি।
‘সত্যবাবুদের বাড়ির প্রতিমা সবচেয়ে সুন্দর হয়েছে।’ বেশ জোরের সঙ্গে তার সিদ্ধান্ত জানায় তিন কিশোরের একজন। ‘তোকে বলেছে!’, প্রতিবাদ জানায় দ্বিতীয় কিশোর, ‘সবচেয়ে ভালো হয়েছে চকবাজারের মণ্ডপ।’ ‘তুই প্রতিমার কী জানিস?’ রেগে যায় প্রথম কিশোর, ‘তোরা পূজা করিস?’ উত্তেজিত দুই কিশোর প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে আসে। তৃতীয় যে বালকটি এতক্ষণ চুপচাপ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল, সে এবার নিচু স্বরে বলে, ‘এই চুপ, চুপ! পণ্ডিত মশায় আসছেন।’ অন্য দুই কিশোর এ সাবধানবাণীতে সচেতন হয়ে ওঠে। ততক্ষণে তিনি একেবারে কাছে এসে পড়েছেন। ‘নমস্কার, পণ্ডিত মশায়’ বলতে বলতে দুই মিনিট আগের ঝগড়া ভুলে গিয়ে তিন কিশোরই পণ্ডিত মশায়ের পদতলে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত। ‘বেঁচে থাকো, বাবারা, দীর্ঘজীবী হও’, বলতে বলতে তিন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী তিন কিশোরকে বুকে টেনে নেন পণ্ডিত মশায় সত্যবাবুদের বিরাট পূজামণ্ডপের সামনে। ৬০ বছরের ওপরে কোনো এক বিজয়া দশমী। স্থান বরিশাল শহরের মধ্যস্থল।
‘খুব খিদে পেয়েছে’, তিন কিশোরের একজন ঘোষণা করে পণ্ডিত মশায়ের বিদায়ের ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই। কিছুক্ষণ আগের জোর তর্ক তখন ইতিহাস মাত্র। ‘বিমলদের বাড়ি সবচেয়ে কাছে’, একজন বলে ওঠে। মিনিট দশেকের মধ্যেই তিনজনকে দেখা যায় বিমলদের বাড়ির রান্নাঘরের সামনে। বিমলবাবু তখন সবেমাত্র ফলারে বসেছেন। এই ত্রিমূর্তিকে দেখে তিনি মোটেই প্রীত হন না, বুঝতেই পারেন বন্ধুরা ভাগ বসাতে এসেছে। কিন্তু ভারি খুশি হন আশা মাসিমা, বিমলের মা। উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তাঁর মুখ হাসি আর আনন্দে। ‘আয়, আয় বোস’, বলতে বলতে তিন পাত পাড়েন তিনজনের জন্য। খিদের চোটে ত্রিরত্ন মাসিমাকে বিজয়ার প্রণাম করতে ভুলে যায়। ‘ওদের পাতে দুটো করে নাড়ু দিয়েছ কেন? আমাকে দিয়েছ একটা মাত্র’, বিমলবাবু কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন। ‘ছি, এভাবে বলতে হয় না, বাবা। ওরা অতিথি না? অতিথি নারায়ণ’, বিমলের মা ভারি নরম গলায় বলেন। ‘কেন, ঈদের সময় যখন আমাদের বাড়িতে যাস, তখন আম্মা তোকে আটটা মাংসের টুকরো দেন না? আমাকে দেন মাত্র চারটে’, একটি কিশোর মোক্ষম যুক্তি উত্থাপন করে।
পেটপূজা সেরে মাসিমাকে কোনোক্রমে একটি ছোট্ট প্রণাম সেরে তিন বন্ধু বাইরে এসে দাঁড়ায়। পেটটা ঠিকমতো ভরানো হয়নি। কী করা যায় এখন? ‘চল, শুভদের বাড়িতে গিয়ে রাবড়ি খেয়ে আসি’, একজন প্রস্তাব দেয়। এর চেয়ে ভালো কথা আর হয় না, ভাবে অন্য দুজন। নীলিমা কাকিমা ভারি ভালো রাবড়ি বানান। শিবরাম পড়ার পর থেকে তিনজনই রাবড়ির ভারি ভক্ত। মিনিট বিশেক পর এই তিন হরিহর আত্মাকে দেখা যায় কলেজপাড়ায় শুভেন্দুদের বাড়ির সামনের দরজায়।
খোলা দরজা দিয়ে তিনজনই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। আর পড়বি তো পড় একেবারে নীলিমা কাকিমার সামনে। একপেড়ে করে মোটা লাল পাড়ের গরদের শাড়িপরা, কপালে লাল বড় টিপ, শাঁখা-সিঁদুরে ফরসা কাকিমাকে সাক্ষাৎ প্রতিমার মতো মনে হয় তিন কিশোরের। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম কাকিমার, দু-হাতে দুটো নৈবেদ্যের থালা। ঢিপ ঢিপ করে কাকিমাকে প্রণাম করে তিনজনই। ‘ওরে, থাম, থাম। থালা দুটো আগে নামিয়ে রাখি।’ কাকিমা বলে ওঠেন। ‘রাবড়ি আছে?’ সময় নষ্ট করতে রাজি নয় ত্রিরত্ন। ‘ও, এ জন্যই আসা বাবুদের’, মুখ টিপে হাসেন নীলিমা কাকি, ‘বিজয়ার প্রণাম-ট্রনাম কিছুই নয়’। ঢিপ ঢিপ করে আবার প্রণাম, রাবড়ি না ফসকে যায়। খিলখিল করে হেসে ওঠেন কাকিমা। তারপর ভারি মায়াময় কণ্ঠে বলেন, ‘আয়, দিচ্ছি।’
রাবড়ি দিয়ে পেট ভরিয়ে রাস্তায় নামতেই দেখা গেল হারান কাকা ও সিরাজ চাচা গল্প করতে করতে এদিকেই আসছেন। ‘রাবড়ি খেতে আসছেন’, তিন কিশোরের একজন বাকি দুজনকে জানায়। তারপর তিনজনেই হাসিতে ভেঙে পড়ে। ‘কী রে, টইটই করে সারা দুপুর পাড়া বেড়াচ্ছিস কেন? যা বাড়ি যা’, সিরাজ চাচা ধমকে ওঠেন। ওঁরা পার হয়ে যেতেই তিন কিশোর ঠোঁট বাঁকায়, ‘হুঁ, নিজেরা পাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে! আর আমরা ঘুরলেই সব দোষ।’ ‘বড়রা ভারি হিংসুটে হয়’, দ্রুত এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে তিন কিশোরের এক মিনিটও লাগে না।
ঠিক তখনই দেখা যায় বাঁ দিকের গলি থেকে বেরিয়ে আসছেন নাজমা আপা আর রত্নাদি। কলেজের শেষ বছরে পড়া দুজনের গলায়-গলায় বন্ধুত্ব। গুজ গুজ করে তিন বন্ধু কী যেন মতলব ফাঁদে। তারপর তরুণী দুজন একেবারে সামনে আসতেই দুজন কিশোর দ্রুত প্রণামের ভঙ্গিতে আপা আর দিদির পা জড়িয়ে বসে পড়ে। তরুণী দুজন চরম বিব্রত। ‘এই, এ কী শয়তানি হচ্ছে!’ ‘দাঁড়া, এমন মার খাবি না! ছেড়ে দে লক্ষ্মী ভাই আমার।’ ভয় দেখানো, অনুরোধ-উপরোধ; কিন্তু নট নড়ন-চড়ন, নট কিচ্ছু। ‘বিজয়ার প্রণাম। দুজনকে দুটো টাকা দিয়ে দাও, ছেড়ে দেবে’, তৃতীয় কিশোরটি ত্রাণকর্তার ভূমিকা নেয়। পারলে তিনজনকেই ভস্ম করে দেয় তরুণী দুজন তাদের চোখের দৃষ্টি দিয়ে। দিতেই হয় টাকা—তিন কিশোরের উল্লাস দেখে কে? আপাতত বাড়ি যাওয়া যাক। রাতে আবার প্রতিমা বিসর্জনের সময় দেখা হবে।
গভীর রাত। কীর্তনখোলার পাড়। প্রতিমা নৌকায় নিয়ে মাঝনদীতে গেছে। ঢোলের বাদ্যি তুঙ্গে। নদীর পাড় ধরে শত শত মানুষ। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ওই তিন কিশোর। সবার চোখে জল—তিন কিশোরেরও। প্রণামের ভঙ্গিতে সবাই যুক্তকর হয়—কে কোন ধর্মের তা সেখানে তুচ্ছ। একসময়ে ঝপাৎ করে একটা শব্দ হয়। প্রতিমা বিসর্জিত হয়েছে। তিন কিশোর বন্ধু জলভরা চোখে পরস্পরকে টেনে নেয় উষ্ণ আলিঙ্গনে।
এবারও বিজয়া দশমী আসবে। কিন্তু সময় কত বদলে গেছে, বদলে গেছে মানুষ। একসময় যা ছিল সর্বজনীন, আজ তা হয়ে গেছে খণ্ডিত। একসময় যা ছিল অবিভাজ্য, আজ তা হয়ে গেছে বিভাজিত। একসময় যা ছিল বৃহত্তর সংস্কৃতি, আজ তা হয়ে গেছে সীমিত ধর্ম। বলা হচ্ছে, রাম আর রহিম আলাদা, জলের সঙ্গে পানি মিলতে পারে না, আল্লাহ আর ভগবান এক নন। নানান জায়গায় পূজায় বাধা দেওয়া হচ্ছে, মণ্ডপ ভাঙা হচ্ছে এখানে-ওখানে। অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ।
‘তবু আশা জাগে, তবু ভালো লাগে’—বিজয়ার শুভেচ্ছা যায় এক মানুষের কাছ থেকে আরেক মানুষের কাছে, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ‘ভালো থাকুক সবাই, আনন্দ আসুক প্রতিটি জীবনে, মঙ্গল হোক সবার’—সব শুভেচ্ছার ওটাই তো মূলকথা। কিন্তু তারপরও কথা আছে বিজয়ার শুভেচ্ছার—‘আমরা কেউ একা নই, আমরা সবাই সবার সঙ্গে আছি, আমরা সবাই মিলে ওই অদ্ভুত আঁধারকে সরিয়ে দেব।’ আমাদের সবার ‘মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে’।
৬০ বছর পর এবারের বিজয়া দশমীতে ওই তিন কিশোরের একজন পেছন ফিরে তাকাবে। ওই তো ১৯৬৪-র দাঙ্গার পর অপূর্বরা চলে যাচ্ছে দেশ ছেড়ে অতি ভোরে। ঠেলাগাড়ির মাথায় বসা অপূর্ব জামার হাতায় চোখ মুছছে। আজকের পেছন ফিরে তাকিয়ে থাকা কিশোরটি সেদিন হাতের ডালটি মট করে ভেঙে ফেলেছিল—কোন রাগে কে জানে। ওই তো তার কয়েক বছর পর ডেনিশরা অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমাল। সংখ্যালঘু খ্রিষ্টানদের জন্য নিরাপদ নয় এই দেশ। যেদিন ওরা চলে যায়, আজকের পেছন ফিরে তাকানো কিশোরটি সেদিন শুধু একবার আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। কী যে তার নালিশ এবং কার কাছে যে তার নালিশ—কে জানে। আস্তে আস্তে পেছন ফিরে তাকানো কিশোরটি সামনের দিকে মুখ ফেরায়—দেখা যায় তাকে পরিষ্কার। এ তো আর কেউ নয়—এ যে আমি।
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
২০ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
২০ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
২০ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
২০ ঘণ্টা আগে