জাহীদ রেজা নূর
আমার কেন যেন মনে হলো, তাঁকে আমি দেখেছি। তাঁকে আমি চিনতাম।
কিন্তু সময়ের হিসেব মেলাতে গিয়ে দেখি, তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। কারণ, ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে আমি পড়াশুনা শেষ করে রাশিয়া থেকে দেশে ফিরেছিলাম। ১৯৯৬ সালেরই সেপ্টেম্বরে কমরেড আবদুস শহীদ মারা গেছেন। ১৯৯৭ সালের জুলাইয়ে আমি সংবাদে আমার চাকরিজীবন শুরু করেছি। তাই তাঁকে দেখার কোনো উপায়ই ছিল না আমার।
তাহলে কেন মনে হচ্ছে, তাঁকে আমি দেখেছি?
ভেবে দেখলাম, এর মূল কারণ হয়তো তানিয়া। হ্যাঁ, আবদুস শহীদের মেয়ে তানিয়া। আমি যখন সংবাদ ছেড়ে মুক্তকণ্ঠে যোগ দিলাম, তখন সেখানে তানিয়াকে পেলাম সহকর্মী হিসেবে। ও ছিল কম্পোজ বিভাগে। সে বহু আগের কথা। কিন্তু এখনো মনে পড়ে, তানিয়ার কম্পোজে ভুল প্রায় থাকতই না। ওর করা কম্পোজ নির্দ্বিধায় প্রুফ রিডিং ছাড়াই পড়া যেত। সহকর্মী হাসান মামুনই সম্ভবত কমরেড আবদুস শহীদের মেয়ে হিসেবে তানিয়াকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এবং তিনিই কমরেড সম্পর্কে আমাকে জানিয়েছিলেন। হাসান মামুন কমরেড আবদুস শহীদকে চিনতেন। কারণ, দীর্ঘদিন তিনি সংবাদে চাকরি করেছেন। তিনি যে সময় সংবাদে ছিলেন, তখন প্রায়ই আবদুস শহীদ আসতেন সংবাদ অফিসে।
বামপন্থী রাজনীতির প্রতি ঝোঁক ছিল আমার। তাই খাপড়া ওয়ার্ডের হত্যাকাণ্ডের কথা অজানা থাকার কথা নয়। হাসান মামুন সে কথা মনে করিয়ে দিতেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের সহকর্মী তানিয়া একটা ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার বহন করছে।
তানিয়ার গুনপণার শেষ নেই। ওকে কখনো রাগ করতে দেখিনি। এক বছর সময়কালে যতবার দেখা হয়েছে, ওর হাসি মুখটাই দেখেছি।
খাপড়া ওয়ার্ড নিয়ে এরপরও কিছু কিছু পড়েছি। প্রথম আলোয় চাকরি শুরু করার পর জয়া শহীদের সঙ্গে পরিচয় হয়। তানিয়ার ছোট বোন জয়া। বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে নিউজ ছাপাতে কিংবা মৃত্যুবার্ষিকীর সংবাদটি দিতে ও আসত। তানিয়ার মতো নয় ও, একটু চঞ্চল। অনর্গল কথা বলতে পারে। অনেক ব্যাপারে ওর আগ্রহ। বাবার স্মৃতিকে উজ্জ্বল রাখার জন্য জয়া ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
দুই.
আমরা এমন একজন মানুষ সম্পর্কে কথা বলতে যাচ্ছি, যিনি সাম্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। পার্টি করা অবস্থায় কিংবা পার্টি থেকে সরে যাওয়ার পরও তিনি সাম্যবাদকেই জীবনের অঙ্গ বলে মনে করতেন। একটা অদ্ভুত সময়ে জন্ম হয়েছিল কিছু অদ্ভুত মানুষের। আবদুস শহীদও ছিলেন সে সময়ের সে রকম একজন অদ্ভুত মানুষ। ‘অদ্ভুত’ শব্দটা কি ঠিক বলা হলো? এর চেয়ে ‘আশ্চর্য’ শব্দটিই বুঝি সুপ্রযুক্ত হতো। বর্তমান সময়ে এ ধরনের মানুষ নেই বললেই চলে।
এখন বুঝতে চেষ্টা করি, সাম্যবাদ কী করে পৃথিবীজুড়ে কোটি কোটি মানুষের মনে জ্বালিয়েছিল দীপশিখা। প্রায় একটা শতাব্দিজুড়ে বিশ্বের মানুষ স্বপ্ন বুনেছে, সাম্যের কথা ভাবতে চেয়েছে। ভেবেছে, এই পৃথিবীতে সব মানুষ হবে সমান।
কিন্তু হঠাৎ এক ঝড়ে সবকিছুই যখন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল, তখন অনেকের জীবন থেকেই ঝরে গেল সে স্বপ্ন। আমার জানতে ইচ্ছে করে, কমরেড শহীদের মন থেকেও সে স্বপ্ন ঝরে গিয়েছিল কিনা। এ প্রশ্ন মনে আসার কারণ হলো, আমি তাঁর সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, তাতে সাম্যবাদের প্রতি তাঁর প্রবল নিষ্ঠারই প্রকাশ দেখেছি। তাই, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাপ্তি তাঁকে কতটা হতবিহ্বল করেছিল, তা আমার জানা দরকার। আমার জানা দরকার, বিপ্লবের ভিত্তিভূমি প্রস্তুত হওয়ার আগেই তুলনামূলকভাবে ইউরোপের অনগ্রসর একটি দেশে বিপ্লবের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনকে তিনি কী চোখে দেখতেন। পার্টির আমলাতন্ত্র যখন একটি স্বপ্নের টুঁটি টিপে ধরেছিল, তখন তা থেকে উত্তরণের কোনো দিশা কি ছিল তাঁর ভাবনায়?
এ প্রশ্নসহ আরও অনেক প্রশ্ন আছে আমার। শুধু আবদুস শহীদকে নয়, সে আমলের সব সৎ কমিউনিস্টের উদ্দেশেই প্রশ্নগুলো।
তিন.
আমরা যখন রাগ করে বলি, ‘যাও, জেলের ঘানি টানো’, তখন বুঝি না যে, সত্যিই একসময় বন্দীদের দিয়ে ঘানি টানানো হতো। গরুর কাজ করানো হতো মানুষকে দিয়ে। আধুনিককালে অবশ্য যন্ত্র এসে ঘানি টানার সমাপ্তি ঘটিয়েছে। কিন্তু যে মানসিকতায় মানুষকে দিয়ে ঘানি টানানো হতো, তাতে প্রবলভাবে বর্ণবাদকেও দেখি। ব্রিটিশেরা বিদায় নিয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ আত্মা তখনো ভর করে ছিল নব্যসৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের ঘাড়ে। সে সময় যে তিনটি ধারায় এ দেশের রাজনীতি বিকশিত হয়েছে—গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ইসলামি—তারই একটি ধারার প্রতি সবচেয়ে বেশি রোষ ছিল পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের। সমাজতন্ত্রীদের সবচেয়ে ঘৃণার চোখে দেখত তারা। এ কথা তো ঠিক, কমিউনিস্ট বা লাল জুজুর ভয় সবসময়ই স্বৈরাচারী রাষ্ট্রগুলোকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখত। সে আমলের তরুণদের অনেকেই সাম্যবাদে দীক্ষা নিত। সোভিয়েত ইউনিয়নে বিপ্লবের বিজয়ের পর কীভাবে একটি নতুন ধরনের সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, তা নিয়ে ভাবত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাম্যবাদীরা। বাংলাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কমরেড শহীদ সেই ধারার উজ্জ্বল এক প্রতিনিধি।
আবদুস শহীদের একটি অমর কীর্তি আছে ‘কারাস্মৃতি’ নামে। এ বইতে আমরা খাপড়া ওয়ার্ডের সেই বিভীষিকার দেখা পাই। পঞ্চাশ সালের ২৪ এপ্রিলের নৃশংসতায় যারা নিহত হয়েছিলেন, সেই সাতজন, বিজল সেন (রাজশাহী), হানিফ শেখ (কুষ্টিয়া), দেলওয়ার (কুষ্টিয়া), আনোয়ার (খুলনা), সুখেন ভট্টাচার্য (ময়মনসিংহ), সুধীন ধর (রংপুর), কম্পরাম সিং (দিনাজপুর)—এর তালিকায়ও জায়গা করে নিতে পারতেন আবদুস শহীদ। আমরা অনেকেই আমাদের ভাবনার আয়নায় দেখতে পাব—১৯৫০ সালের দিকে দেশের বহু কারাগারেই রাজবন্দীরা নিজেদের মর্যাদা রক্ষার জন্য লড়াই করছেন। রাজবন্দীদের পাশাপাশি সাধারণ কয়েদিরাও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন।
ব্রিটিশ আমলে গরুর বদলে কয়েদিদের দিয়ে ঘানি টানানো হতো। ভারি লোহার রড কাঁধে নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে কয়েদিরা ঘানি টানছে—এ কথা মনে হলেই আমার স্মরণে আসে জয়নুল আবেদিনের আঁকা গরুর গাড়ি ঠেলার সেই অসাধারণ ছবিটির কথা। বহু হাজতি ছিলেন, যারা বছরের পর বছর জেলে বন্দী ছিলেন। যদিও স্বাধীনতা যুদ্ধের পর যে বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি, সেখানেও বিনা বিচারে বন্দী থাকার ঘটনা ঘটেই চলেছে। সে কথা থাক।
রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডের সেই নারকীয় ঘটনাটা অতি সংক্ষেপে এখানে বলে রাখি। একদিন যখন জেলের ভেতরে আইজিপি (প্রিজন) আমিরুদ্দীন আসেন, সেদিন কয়েদিদের ১২/১৪ জন প্রতিনিধি তাঁর সঙ্গে কয়েদিদের দাবিদাওয়া নিয়ে কথা বলেন। আমিরুদ্দীন সাধারণ কয়েদিদের বিষয়ে আলাপই করতে চাইলেন না। তিনি চাইলেন শুধু রাজবন্দীদের কথা শুনতে। আপত্তি তুললেন প্রতিনিধিরা। তাঁরা বললেন, সাধারণ কয়েদি ও রাজবন্দীরা একই কারাগারে বাস করছে। তাঁদের একই ধরনের সমস্যা। সুতরাং সবার দাবি–দাওয়া নিয়েই কথা বলতে হবে। আইজিপি শুধু রাজবন্দীদের প্রতি তাঁর সহানুভূতির কথা জানালেন। আলোচনা ব্যর্থ হলো।
আইজিপি তখন জেল সুপার মি. বিলকে নির্দেশ দিলেন ওই প্রতিনিধিদের খাপড়া ওয়ার্ড থেকে সরিয়ে নিতে হবে। নিতে হবে ১৪ নং সেলে। ১৪ নং সেল ছিল কনডেমনড সেল। জঘন্য ছিল সে সেলটি। আলোচনা করে খাপড়া ওয়ার্ডের বন্দীরা সিদ্ধান্ত নিলেন, এই ওয়ার্ড ছেড়ে ১৪ নং সেলে কেউ যাবে না।
এর পর এল ২৪ এপ্রিল। যথারীতি চা–রুটি দিয়ে নাশতা শেষ করেছেন বন্দীরা। ক্লান্ত। কুষ্টিয়ার কমরেড হানিফের সভাপতিত্বে আলোচনা চলছে। তিনি সবাইকে সংক্ষেপে বক্তব্য দিতে বলছেন। এ কথা বলার পরই শোনা গেল বুটের খটখট আওয়াজ। সুপার মি. বিলের সঙ্গে ২৫/৩০ জন মেট ও সিপাহী ঢুকে পড়ল খাপড়া ওয়ার্ডে। মি. বিল বললেন, ‘এখান থেকে কয়েকজনকে সরিয়ে নেওয়া হবে।’ কিছুটা কথা কাটাকাটির পর মি. বিল ওয়ার্ডের দরজা বন্ধ করে দিতে বলেন। নিজেরাও সেখানে আটকা পড়ে যাবেন বুঝে দ্রুত তাঁরা বেরিয়ে পড়েন ওয়ার্ড থেকে। মি. বিল ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে গিয়েই হুইসেল বাজান। তারপর ৪০ জনের মতো সিপাহি গরাদের ওপর দিকে লাঠিচার্জ করতে লাগল। এ সময় একজন মেট আবদুস শহীদের হাতে এমনভাবে লাঠি দিয়ে আঘাত করল যে, তাঁর তর্জনি কেটে চামড়ার সঙ্গে ঝুলে থাকল।
বন্দীরা হাতের কাছে যা পাচ্ছিল, তাই ছুড়ে মেরে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু একটু পরই যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটে যাবে, সে কথা কেউ ভাবতেও পারেননি।
ওয়ার্ডের প্রায় ৫০টি জানালায় দেখা গেল বন্দুক। সিপাইরা নির্বিচারে গুলি করতে লাগল। কমরেড হানিফের শরীরে গুলি লেগেছে, তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা গেলেন। স্প্লিন্টার ঢুকে গিয়েছিল কমরেড শহীদের পায়ে। এর পর তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এর মধ্যে যা ঘটার ঘটে গেছে। সাতজন মারা যান, ২৯ জন আহত হয়ে কোনোভাবে বেঁচে যান।
আবদুস শহীদ শিক্ষকতা করেছেন। লিখেছেন কয়েকটি বই। বিশ্বের নানা দেশের গণসংগীত নিয়েও রয়েছে তাঁর একটি বই। মানুষ তাঁর কাছে কোন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল, তার একটি প্রমাণ এই বই।
চার.
আবদুস শহীদের দিকে চোখ রাখলে আমরা দেখতে পাব, তাঁর জন্ম ১৯১৭ সালে বরিশালের বানারিপাড়ার বলহার গ্রামে। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হন। কমিউনিস্টদের ছাত্র ফেডারেশনে কাজ করার পর তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতেও যোগ দেন। বরিশালের জোতদারদের বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন করেন। ১৯৪৮ সালে গ্রেপ্তার হলে তাঁকে রাজশাহী জেলে রাখা হয়। এখন শুনলে নতুন প্রজন্মের মানুষের কাছে অবাক লাগতে পারে, পার্টির নির্দেশে তিনি সরকারি চাকরি করেননি। কয়েকটি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি করেছিলেন মাত্র।
এখানে যা উহ্য থাকল, তা হলো জীবনে তিনি কখনো বিত্তবৈভবের মুখ দেখেননি। আজীবন দারিদ্র্যের মধ্যেই বসবাস করেছেন। তারই মধ্যে সংসারজীবন অতিবাহিত করেছেন। সাম্যবাদের প্রতি প্রবল আগ্রহ তাঁর সংসার জীবনকেও সংকটে ফেলেছে। কিন্তু আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে তিনি জীবন অতিবাহিত করে গেছেন।
এখানে আমরা একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করব। আবদুস শহীদের জন্মসালটির দিকে তাকালেই দেখতে পাব, রুশ বিপ্লব আর তাঁর জন্ম একই সালে। ১৯১৭ সাল এক সময় মুক্তিকামী মানুষের জন্য ছিল মুক্তির অন্য নাম। কিন্তু সে স্বপ্ন যে বাস্তব হলো না, এ বড় কষ্টের বিষয়।
পাঁচ.
বর্তমান বিশ্বে, এই বাজার অর্থনীতির যুগে একটি কথা তো পরিষ্কার—সংখ্যাই এখানে সবচেয়ে বড় ব্যাপার। মানবিকতাকে পাশে ঠেলে রেখে তার কথা ভুলে গেলে কিছুই আসে যায় না মানুষের। যে মূল্যবোধগুলোকে ওপরে তুলে ধরা হয়েছিল একসময়, তার আর দাম নেই। কেউই এখন আর ‘কমিউনিস্ট’ নাম শুনে শিহরিত হয় না। খুব কম মানুষই এখন ত্যাগকে জীবনের আদর্শ বলে ভাবতে পারে না। এই রকম একটি পটভূমিতে দাঁড়িয়ে আবদুস শহীদকে একজন বোকা মানুষ বলেই মনে হবে। আক্ষেপ হবে, কেন তিনি এ ধরনের একটি ছন্নছাড়া জীবনযাপন করে গেলেন। কেউ কেউ চায়ে চুমুক দিয়ে শ্লেষের সঙ্গে বলতেও পারবে, ‘জীবনটা অকারণে পানিতে ফেললেন ভদ্রলোক!’ কেউ আঁৎকে উঠে বলবে, ‘ওহো! ও তো এক রকম আত্মহত্যা!’
আমি তা মনে করি না। আমি সে সময়ের সাম্যবাদে বিশ্বাসী মানুষদের মনে করি কালের মহানায়ক। এখন তারা অনেকের কাছেই অবোধ্য, কিন্তু এটা তাঁদের কল্যাণ–চিন্তাকে কোনোভাবেই খাটো করতে পারে না। আমরা কমিউনিস্ট পার্টির নানা ভুল দেখেছি। আমলাতন্ত্র ও স্বৈরাচারের মিশ্রণে কীভাবে একটি স্বপ্ন কবরে চলে যায়, তা দেখেছি। কিন্তু সঙ্গে তো এও দেখেছি, সত্যিকার স্বপ্নেরা মরে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। সেখানে এখন পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোয় সমাজতন্ত্রের অনেক উপাদান যে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, তা তো সেই স্বপ্নেরই ফসল।
তাই কমরেড আবদুস শহীদের কথা বলতে গেলে আমাকে একটি অসাধারণ মানবিক স্বপ্নের কথাই বলতে হয়। কোনো দ্বিধা ছাড়াই বলতে হয়, তিনি যা বিশ্বাস করেছেন, তা বুকে লালন করেছেন পরম যত্নে। জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ ছিল সেটাই। তানিয়া, আর জয়ার দিকে তাকালে আমার মনে হয়, তাঁর সেই স্বপ্নটা ওদের মধ্য দিয়েই বেঁচে আছে। দারিদ্র্যের চাবুক ওদের রিক্ত করতে চেয়েছিল। তা নিয়ে ওদের আক্ষেপও আছে হয়তো। বাবার প্রতি এক ধরনের অভিমানও হয়তো আছে। কিন্তু ওরা এও জানে, সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য বাসযোগ্য একটি পৃথিবী গড়তে চেয়েছিলেন যারা, তাঁদেরই একজন ছিলেন তাঁদের স্বপ্নবান বাবা। এই গর্ব সবাই করতে পারে না। এই অর্জনের জন্য কেউ যদি তানিয়া আর জয়াকে ঈর্ষা করে, আমি তাতে মোটেও অবাক হব না। আজ ৮ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যুদিনে এই কথাগুলোই মনে এল।
আমার কেন যেন মনে হলো, তাঁকে আমি দেখেছি। তাঁকে আমি চিনতাম।
কিন্তু সময়ের হিসেব মেলাতে গিয়ে দেখি, তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। কারণ, ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে আমি পড়াশুনা শেষ করে রাশিয়া থেকে দেশে ফিরেছিলাম। ১৯৯৬ সালেরই সেপ্টেম্বরে কমরেড আবদুস শহীদ মারা গেছেন। ১৯৯৭ সালের জুলাইয়ে আমি সংবাদে আমার চাকরিজীবন শুরু করেছি। তাই তাঁকে দেখার কোনো উপায়ই ছিল না আমার।
তাহলে কেন মনে হচ্ছে, তাঁকে আমি দেখেছি?
ভেবে দেখলাম, এর মূল কারণ হয়তো তানিয়া। হ্যাঁ, আবদুস শহীদের মেয়ে তানিয়া। আমি যখন সংবাদ ছেড়ে মুক্তকণ্ঠে যোগ দিলাম, তখন সেখানে তানিয়াকে পেলাম সহকর্মী হিসেবে। ও ছিল কম্পোজ বিভাগে। সে বহু আগের কথা। কিন্তু এখনো মনে পড়ে, তানিয়ার কম্পোজে ভুল প্রায় থাকতই না। ওর করা কম্পোজ নির্দ্বিধায় প্রুফ রিডিং ছাড়াই পড়া যেত। সহকর্মী হাসান মামুনই সম্ভবত কমরেড আবদুস শহীদের মেয়ে হিসেবে তানিয়াকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এবং তিনিই কমরেড সম্পর্কে আমাকে জানিয়েছিলেন। হাসান মামুন কমরেড আবদুস শহীদকে চিনতেন। কারণ, দীর্ঘদিন তিনি সংবাদে চাকরি করেছেন। তিনি যে সময় সংবাদে ছিলেন, তখন প্রায়ই আবদুস শহীদ আসতেন সংবাদ অফিসে।
বামপন্থী রাজনীতির প্রতি ঝোঁক ছিল আমার। তাই খাপড়া ওয়ার্ডের হত্যাকাণ্ডের কথা অজানা থাকার কথা নয়। হাসান মামুন সে কথা মনে করিয়ে দিতেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের সহকর্মী তানিয়া একটা ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার বহন করছে।
তানিয়ার গুনপণার শেষ নেই। ওকে কখনো রাগ করতে দেখিনি। এক বছর সময়কালে যতবার দেখা হয়েছে, ওর হাসি মুখটাই দেখেছি।
খাপড়া ওয়ার্ড নিয়ে এরপরও কিছু কিছু পড়েছি। প্রথম আলোয় চাকরি শুরু করার পর জয়া শহীদের সঙ্গে পরিচয় হয়। তানিয়ার ছোট বোন জয়া। বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে নিউজ ছাপাতে কিংবা মৃত্যুবার্ষিকীর সংবাদটি দিতে ও আসত। তানিয়ার মতো নয় ও, একটু চঞ্চল। অনর্গল কথা বলতে পারে। অনেক ব্যাপারে ওর আগ্রহ। বাবার স্মৃতিকে উজ্জ্বল রাখার জন্য জয়া ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
দুই.
আমরা এমন একজন মানুষ সম্পর্কে কথা বলতে যাচ্ছি, যিনি সাম্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। পার্টি করা অবস্থায় কিংবা পার্টি থেকে সরে যাওয়ার পরও তিনি সাম্যবাদকেই জীবনের অঙ্গ বলে মনে করতেন। একটা অদ্ভুত সময়ে জন্ম হয়েছিল কিছু অদ্ভুত মানুষের। আবদুস শহীদও ছিলেন সে সময়ের সে রকম একজন অদ্ভুত মানুষ। ‘অদ্ভুত’ শব্দটা কি ঠিক বলা হলো? এর চেয়ে ‘আশ্চর্য’ শব্দটিই বুঝি সুপ্রযুক্ত হতো। বর্তমান সময়ে এ ধরনের মানুষ নেই বললেই চলে।
এখন বুঝতে চেষ্টা করি, সাম্যবাদ কী করে পৃথিবীজুড়ে কোটি কোটি মানুষের মনে জ্বালিয়েছিল দীপশিখা। প্রায় একটা শতাব্দিজুড়ে বিশ্বের মানুষ স্বপ্ন বুনেছে, সাম্যের কথা ভাবতে চেয়েছে। ভেবেছে, এই পৃথিবীতে সব মানুষ হবে সমান।
কিন্তু হঠাৎ এক ঝড়ে সবকিছুই যখন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল, তখন অনেকের জীবন থেকেই ঝরে গেল সে স্বপ্ন। আমার জানতে ইচ্ছে করে, কমরেড শহীদের মন থেকেও সে স্বপ্ন ঝরে গিয়েছিল কিনা। এ প্রশ্ন মনে আসার কারণ হলো, আমি তাঁর সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, তাতে সাম্যবাদের প্রতি তাঁর প্রবল নিষ্ঠারই প্রকাশ দেখেছি। তাই, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাপ্তি তাঁকে কতটা হতবিহ্বল করেছিল, তা আমার জানা দরকার। আমার জানা দরকার, বিপ্লবের ভিত্তিভূমি প্রস্তুত হওয়ার আগেই তুলনামূলকভাবে ইউরোপের অনগ্রসর একটি দেশে বিপ্লবের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনকে তিনি কী চোখে দেখতেন। পার্টির আমলাতন্ত্র যখন একটি স্বপ্নের টুঁটি টিপে ধরেছিল, তখন তা থেকে উত্তরণের কোনো দিশা কি ছিল তাঁর ভাবনায়?
এ প্রশ্নসহ আরও অনেক প্রশ্ন আছে আমার। শুধু আবদুস শহীদকে নয়, সে আমলের সব সৎ কমিউনিস্টের উদ্দেশেই প্রশ্নগুলো।
তিন.
আমরা যখন রাগ করে বলি, ‘যাও, জেলের ঘানি টানো’, তখন বুঝি না যে, সত্যিই একসময় বন্দীদের দিয়ে ঘানি টানানো হতো। গরুর কাজ করানো হতো মানুষকে দিয়ে। আধুনিককালে অবশ্য যন্ত্র এসে ঘানি টানার সমাপ্তি ঘটিয়েছে। কিন্তু যে মানসিকতায় মানুষকে দিয়ে ঘানি টানানো হতো, তাতে প্রবলভাবে বর্ণবাদকেও দেখি। ব্রিটিশেরা বিদায় নিয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ আত্মা তখনো ভর করে ছিল নব্যসৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের ঘাড়ে। সে সময় যে তিনটি ধারায় এ দেশের রাজনীতি বিকশিত হয়েছে—গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ইসলামি—তারই একটি ধারার প্রতি সবচেয়ে বেশি রোষ ছিল পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের। সমাজতন্ত্রীদের সবচেয়ে ঘৃণার চোখে দেখত তারা। এ কথা তো ঠিক, কমিউনিস্ট বা লাল জুজুর ভয় সবসময়ই স্বৈরাচারী রাষ্ট্রগুলোকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখত। সে আমলের তরুণদের অনেকেই সাম্যবাদে দীক্ষা নিত। সোভিয়েত ইউনিয়নে বিপ্লবের বিজয়ের পর কীভাবে একটি নতুন ধরনের সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, তা নিয়ে ভাবত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাম্যবাদীরা। বাংলাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কমরেড শহীদ সেই ধারার উজ্জ্বল এক প্রতিনিধি।
আবদুস শহীদের একটি অমর কীর্তি আছে ‘কারাস্মৃতি’ নামে। এ বইতে আমরা খাপড়া ওয়ার্ডের সেই বিভীষিকার দেখা পাই। পঞ্চাশ সালের ২৪ এপ্রিলের নৃশংসতায় যারা নিহত হয়েছিলেন, সেই সাতজন, বিজল সেন (রাজশাহী), হানিফ শেখ (কুষ্টিয়া), দেলওয়ার (কুষ্টিয়া), আনোয়ার (খুলনা), সুখেন ভট্টাচার্য (ময়মনসিংহ), সুধীন ধর (রংপুর), কম্পরাম সিং (দিনাজপুর)—এর তালিকায়ও জায়গা করে নিতে পারতেন আবদুস শহীদ। আমরা অনেকেই আমাদের ভাবনার আয়নায় দেখতে পাব—১৯৫০ সালের দিকে দেশের বহু কারাগারেই রাজবন্দীরা নিজেদের মর্যাদা রক্ষার জন্য লড়াই করছেন। রাজবন্দীদের পাশাপাশি সাধারণ কয়েদিরাও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন।
ব্রিটিশ আমলে গরুর বদলে কয়েদিদের দিয়ে ঘানি টানানো হতো। ভারি লোহার রড কাঁধে নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে কয়েদিরা ঘানি টানছে—এ কথা মনে হলেই আমার স্মরণে আসে জয়নুল আবেদিনের আঁকা গরুর গাড়ি ঠেলার সেই অসাধারণ ছবিটির কথা। বহু হাজতি ছিলেন, যারা বছরের পর বছর জেলে বন্দী ছিলেন। যদিও স্বাধীনতা যুদ্ধের পর যে বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি, সেখানেও বিনা বিচারে বন্দী থাকার ঘটনা ঘটেই চলেছে। সে কথা থাক।
রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডের সেই নারকীয় ঘটনাটা অতি সংক্ষেপে এখানে বলে রাখি। একদিন যখন জেলের ভেতরে আইজিপি (প্রিজন) আমিরুদ্দীন আসেন, সেদিন কয়েদিদের ১২/১৪ জন প্রতিনিধি তাঁর সঙ্গে কয়েদিদের দাবিদাওয়া নিয়ে কথা বলেন। আমিরুদ্দীন সাধারণ কয়েদিদের বিষয়ে আলাপই করতে চাইলেন না। তিনি চাইলেন শুধু রাজবন্দীদের কথা শুনতে। আপত্তি তুললেন প্রতিনিধিরা। তাঁরা বললেন, সাধারণ কয়েদি ও রাজবন্দীরা একই কারাগারে বাস করছে। তাঁদের একই ধরনের সমস্যা। সুতরাং সবার দাবি–দাওয়া নিয়েই কথা বলতে হবে। আইজিপি শুধু রাজবন্দীদের প্রতি তাঁর সহানুভূতির কথা জানালেন। আলোচনা ব্যর্থ হলো।
আইজিপি তখন জেল সুপার মি. বিলকে নির্দেশ দিলেন ওই প্রতিনিধিদের খাপড়া ওয়ার্ড থেকে সরিয়ে নিতে হবে। নিতে হবে ১৪ নং সেলে। ১৪ নং সেল ছিল কনডেমনড সেল। জঘন্য ছিল সে সেলটি। আলোচনা করে খাপড়া ওয়ার্ডের বন্দীরা সিদ্ধান্ত নিলেন, এই ওয়ার্ড ছেড়ে ১৪ নং সেলে কেউ যাবে না।
এর পর এল ২৪ এপ্রিল। যথারীতি চা–রুটি দিয়ে নাশতা শেষ করেছেন বন্দীরা। ক্লান্ত। কুষ্টিয়ার কমরেড হানিফের সভাপতিত্বে আলোচনা চলছে। তিনি সবাইকে সংক্ষেপে বক্তব্য দিতে বলছেন। এ কথা বলার পরই শোনা গেল বুটের খটখট আওয়াজ। সুপার মি. বিলের সঙ্গে ২৫/৩০ জন মেট ও সিপাহী ঢুকে পড়ল খাপড়া ওয়ার্ডে। মি. বিল বললেন, ‘এখান থেকে কয়েকজনকে সরিয়ে নেওয়া হবে।’ কিছুটা কথা কাটাকাটির পর মি. বিল ওয়ার্ডের দরজা বন্ধ করে দিতে বলেন। নিজেরাও সেখানে আটকা পড়ে যাবেন বুঝে দ্রুত তাঁরা বেরিয়ে পড়েন ওয়ার্ড থেকে। মি. বিল ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে গিয়েই হুইসেল বাজান। তারপর ৪০ জনের মতো সিপাহি গরাদের ওপর দিকে লাঠিচার্জ করতে লাগল। এ সময় একজন মেট আবদুস শহীদের হাতে এমনভাবে লাঠি দিয়ে আঘাত করল যে, তাঁর তর্জনি কেটে চামড়ার সঙ্গে ঝুলে থাকল।
বন্দীরা হাতের কাছে যা পাচ্ছিল, তাই ছুড়ে মেরে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু একটু পরই যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটে যাবে, সে কথা কেউ ভাবতেও পারেননি।
ওয়ার্ডের প্রায় ৫০টি জানালায় দেখা গেল বন্দুক। সিপাইরা নির্বিচারে গুলি করতে লাগল। কমরেড হানিফের শরীরে গুলি লেগেছে, তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা গেলেন। স্প্লিন্টার ঢুকে গিয়েছিল কমরেড শহীদের পায়ে। এর পর তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এর মধ্যে যা ঘটার ঘটে গেছে। সাতজন মারা যান, ২৯ জন আহত হয়ে কোনোভাবে বেঁচে যান।
আবদুস শহীদ শিক্ষকতা করেছেন। লিখেছেন কয়েকটি বই। বিশ্বের নানা দেশের গণসংগীত নিয়েও রয়েছে তাঁর একটি বই। মানুষ তাঁর কাছে কোন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল, তার একটি প্রমাণ এই বই।
চার.
আবদুস শহীদের দিকে চোখ রাখলে আমরা দেখতে পাব, তাঁর জন্ম ১৯১৭ সালে বরিশালের বানারিপাড়ার বলহার গ্রামে। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হন। কমিউনিস্টদের ছাত্র ফেডারেশনে কাজ করার পর তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতেও যোগ দেন। বরিশালের জোতদারদের বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন করেন। ১৯৪৮ সালে গ্রেপ্তার হলে তাঁকে রাজশাহী জেলে রাখা হয়। এখন শুনলে নতুন প্রজন্মের মানুষের কাছে অবাক লাগতে পারে, পার্টির নির্দেশে তিনি সরকারি চাকরি করেননি। কয়েকটি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি করেছিলেন মাত্র।
এখানে যা উহ্য থাকল, তা হলো জীবনে তিনি কখনো বিত্তবৈভবের মুখ দেখেননি। আজীবন দারিদ্র্যের মধ্যেই বসবাস করেছেন। তারই মধ্যে সংসারজীবন অতিবাহিত করেছেন। সাম্যবাদের প্রতি প্রবল আগ্রহ তাঁর সংসার জীবনকেও সংকটে ফেলেছে। কিন্তু আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে তিনি জীবন অতিবাহিত করে গেছেন।
এখানে আমরা একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করব। আবদুস শহীদের জন্মসালটির দিকে তাকালেই দেখতে পাব, রুশ বিপ্লব আর তাঁর জন্ম একই সালে। ১৯১৭ সাল এক সময় মুক্তিকামী মানুষের জন্য ছিল মুক্তির অন্য নাম। কিন্তু সে স্বপ্ন যে বাস্তব হলো না, এ বড় কষ্টের বিষয়।
পাঁচ.
বর্তমান বিশ্বে, এই বাজার অর্থনীতির যুগে একটি কথা তো পরিষ্কার—সংখ্যাই এখানে সবচেয়ে বড় ব্যাপার। মানবিকতাকে পাশে ঠেলে রেখে তার কথা ভুলে গেলে কিছুই আসে যায় না মানুষের। যে মূল্যবোধগুলোকে ওপরে তুলে ধরা হয়েছিল একসময়, তার আর দাম নেই। কেউই এখন আর ‘কমিউনিস্ট’ নাম শুনে শিহরিত হয় না। খুব কম মানুষই এখন ত্যাগকে জীবনের আদর্শ বলে ভাবতে পারে না। এই রকম একটি পটভূমিতে দাঁড়িয়ে আবদুস শহীদকে একজন বোকা মানুষ বলেই মনে হবে। আক্ষেপ হবে, কেন তিনি এ ধরনের একটি ছন্নছাড়া জীবনযাপন করে গেলেন। কেউ কেউ চায়ে চুমুক দিয়ে শ্লেষের সঙ্গে বলতেও পারবে, ‘জীবনটা অকারণে পানিতে ফেললেন ভদ্রলোক!’ কেউ আঁৎকে উঠে বলবে, ‘ওহো! ও তো এক রকম আত্মহত্যা!’
আমি তা মনে করি না। আমি সে সময়ের সাম্যবাদে বিশ্বাসী মানুষদের মনে করি কালের মহানায়ক। এখন তারা অনেকের কাছেই অবোধ্য, কিন্তু এটা তাঁদের কল্যাণ–চিন্তাকে কোনোভাবেই খাটো করতে পারে না। আমরা কমিউনিস্ট পার্টির নানা ভুল দেখেছি। আমলাতন্ত্র ও স্বৈরাচারের মিশ্রণে কীভাবে একটি স্বপ্ন কবরে চলে যায়, তা দেখেছি। কিন্তু সঙ্গে তো এও দেখেছি, সত্যিকার স্বপ্নেরা মরে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। সেখানে এখন পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোয় সমাজতন্ত্রের অনেক উপাদান যে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, তা তো সেই স্বপ্নেরই ফসল।
তাই কমরেড আবদুস শহীদের কথা বলতে গেলে আমাকে একটি অসাধারণ মানবিক স্বপ্নের কথাই বলতে হয়। কোনো দ্বিধা ছাড়াই বলতে হয়, তিনি যা বিশ্বাস করেছেন, তা বুকে লালন করেছেন পরম যত্নে। জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ ছিল সেটাই। তানিয়া, আর জয়ার দিকে তাকালে আমার মনে হয়, তাঁর সেই স্বপ্নটা ওদের মধ্য দিয়েই বেঁচে আছে। দারিদ্র্যের চাবুক ওদের রিক্ত করতে চেয়েছিল। তা নিয়ে ওদের আক্ষেপও আছে হয়তো। বাবার প্রতি এক ধরনের অভিমানও হয়তো আছে। কিন্তু ওরা এও জানে, সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য বাসযোগ্য একটি পৃথিবী গড়তে চেয়েছিলেন যারা, তাঁদেরই একজন ছিলেন তাঁদের স্বপ্নবান বাবা। এই গর্ব সবাই করতে পারে না। এই অর্জনের জন্য কেউ যদি তানিয়া আর জয়াকে ঈর্ষা করে, আমি তাতে মোটেও অবাক হব না। আজ ৮ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যুদিনে এই কথাগুলোই মনে এল।
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
৮ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
৮ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
৮ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
৮ ঘণ্টা আগে