বিভুরঞ্জন সরকার
দেশে একটি শক্তিশালী, সক্রিয় ও কার্যকর বিরোধী দল না থাকায় যাঁরা আক্ষেপ করেন, তাঁদের আশ্বস্ত করে আওয়ামী লীগের নেতারা বলতে পারেন, বিরোধী দল নেই তো কী হয়েছে, আমরা আছি না?
বিরোধী দল কী করে? সরকারের সমালোচনা, বিরোধিতা, আন্দোলন, পথ অবরোধ, ধর্মঘট, জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি–এসবই তো? দেশে কার্যকর কোনো বিরোধী দল না থাকায় এই কাজগুলো কি বন্ধ রয়েছে? সারা দেশে ঘোষণা দিয়ে একযোগে না হলেও আওয়ামী লীগ কিংবা তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো দেশের কোথাও না কোথাও এসব কাজ ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে।
সরকারি ও বিরোধী দলের সমর্থকদের মধ্যে তেমন উল্লেখ করার মতো সংঘাত-সংঘর্ষ দেশে একেবারে বন্ধ নেই। আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিরোধের জেরে এই করোনাকালেও হতাহতের ঘটনা সংবাদপত্রে কম ছাপা হয়নি। এক নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জেই আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ ও গুলি বিনিময়ের ঘটনায় গত এক বছরের কম সময়ে একজন সাংবাদিকসহ কমপক্ষে দুজন নিহত এবং আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছে অনেককে। একই স্থানে দুই গ্রুপ সমাবেশ ডাকায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা জারির ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার।
চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে এই সময়কালে প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটেছে একাধিক। নির্বাচনী সহিংসতা, রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন ও আধিপত্য বিস্তারের জন্যই প্রকাশ্যে এই অস্ত্র প্রদর্শন বলে সংবাদপত্রে সচিত্র খবর ছাপা হয়েছে। পেশাদার সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি যুবলীগ ও ছাত্রলীগের পদধারী নেতারাও অস্ত্র হাতে দাপট দেখিয়েছেন অকুতোভয়ে। বড় কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে থাকলে বল-ভরসা এমনিতেই বেড়ে যায়, তারপর নাম যদি সরকারি দলের খাতায় ওঠে, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। সিনা টান করে যাকে-তাকে বলা যায়, জানেন বা জানিস ‘আমি কে’?
অন্য সব এলাকার কথা বাদ দিয়ে নোয়াখালীর বসুরহাটের কথাই বলা যাক। ছোট একটি পৌরসভার মেয়র এক বছর ধরে যে দাপট দেখিয়ে চলেছেন, তা কার না চোখে পড়েছে? বাংলাদেশের রাজনীতির রাজধানী বুঝি বসুরহাটে স্থানান্তর হয়েছে বলেও কেউ কেউ ভাবতে শুরু করেছিলেন। আবদুল কাদের মির্জা নামে যে একজন বিশাল মাপের বঙ্গবন্ধুর সৈনিক আছেন, এত বছর ধরে রাজনৈতিক বিষয়ে লেখালেখি করেও তাঁর নাম না জেনে আমি তো নিজেকেই ধিক্কার দিয়েছিলাম। রাজনীতির দুই ‘মির্জা’র নামের সঙ্গে আমি পরিচিত বহু বছর ধরে। এর মধ্যে বড় মির্জা হলেন মির্জা গোলাম হাফিজ, যিনি এখন আর বেঁচে নেই। তবে খালেদা জিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে তিনি ছিলেন এক দাপুটে আইনমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচারের বাইরে রাখার জন্য জারিকৃত কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা একটি অসম্ভব বিষয় বলে তিনি মনে করতেন।
তিনি নিজে বয়সে মুরব্বি হয়েও তাঁর রাজনৈতিক মুরব্বিদের খুশি করতে তিনি ছিলেন অতি তৎপর। আমার চেনা ছোট ‘মির্জা’ হলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এই দুই মির্জাই বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার মানুষ। আমিও তাই। সে জন্য দুজনের সঙ্গে পরিচয়ের একটি আঞ্চলিকতার যোগসূত্র আছে। মির্জা ফখরুলকে দেখুন, সরকারি কলেজের একজন সাবেক শিক্ষক, ঠাকুরগাঁওয়ে একসময় অতিশয় ভদ্র ও বিনয়ী হিসেবে পরিচিত মানুষটি (যদিও তাঁর পিতা চখা মিয়া একজন মুসলিম লীগার এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বী হিসেবেই বেশি খ্যাত) রাজনীতির চক্করে পড়ে কেমন তালবেতাল অবস্থান নিয়ে বিএনপিতে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে চলেছেন।
যুবদলের সাবেক প্রধান, ঢাকার সাবেক মেয়র এবং এখন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের নামের সঙ্গে বহু আগে থেকে পরিচিত হলেও তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই।
আমি তখন মনে করতাম ‘মির্জা’রা বুঝি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কে বাঁধা। আমার ভুল ভেঙেছে আবদুল কাদের মির্জার নাম কানে আসার পর। মির্জা শুধু বিএনপিতে নেই, আওয়ামী লীগেও আছে। বিএনপির বর্তমান মির্জারা আওয়ামী লীগের ‘দুর্নীতি-দুঃশাসন’ নিয়ে যত কড়া কথা বলতে না পারেন, আওয়ামী লীগের মির্জা তা অবলীলায় বলে চলেছেন দিনের পর দিন। প্রশ্ন হলো, একটি পৌরসভার মেয়র ক্ষমতাসীন দল ও সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে দিব্যি আছেন, তাঁকে কেউ থামাতে পারছে না, তাঁর এই অপরিসীম শক্তির প্রকৃত উৎস আসলে কী?
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এবং মহাসড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই এই আবদুল কাদের মির্জা। তিনি গত ৩১ ডিসেম্বর পৌরসভা নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করতে গিয়ে প্রথম শব্দবোমা ফাটিয়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ফেনীর দুই সংসদ সদস্যের দুর্নীতি, অনিয়ম এবং নিয়োগ-বাণিজ্য নিয়ে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে এমন বলেছিলেন যে, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের এমপিদের কেউ কেউ পালানোর জন্য দরজা খুঁজে পাবেন না।’ তারপর থেকে তিনি নানা সময়ে নিজের বড় ভাই, ভাবি ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে লাগামহীন কথা বলা অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর এসব কথাবার্তা শুনে মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে একটি কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে তিনিই বুঝি বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। সরকার কারও কোনো সমালোচনা সহ্য করে না, সরকারবিরোধীদের রাস্তায় নামতে দেয় না, এটা ভুল প্রমাণ করতেই যেন মাঠে আছেন আবদুল কাদের মির্জা।
কাদের মির্জার বিরুদ্ধে সংগঠনের শৃঙ্খলা ভঙ্গ বা আর কোনো অভিযোগও আনা হচ্ছে না। ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই না হয়ে অন্য কেউ এমন আচরণ করলে কি এমন কানে তুলো দেওয়ার নীতি অনুসরণ করা হতো? কাদের মির্জাকে ‘লাই’ দিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে কী বার্তা দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা? এভাবে চলতে থাকলে আওয়ামী লীগ কি আর সংগঠনের মধ্যে কোন্দল মিটিয়ে দলকে সংহত করতে পারবে?
আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের ভেতরে যেসব দ্বন্দ্ব ও সংকট আছে, তা মিটিয়ে ফেলে সবাইকে মিলেমিশে কাজ করার পরামর্শ দিলেও তা কেউ শুনছে বা মানছে কি? অনেক জেলা, উপজেলা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পর্যায়ে দলের অভ্যন্তরে নানা ধরনের সমস্যা আছে। দলের মধ্যে নেতায় নেতায় কোন্দল এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়। মন্ত্রীদের সঙ্গে এমপিদের, এমপিদের সঙ্গে দলের পদ-পদবিধারী নেতাদের কিংবা পদবঞ্চিতদের বিরোধ, মনোমালিন্য প্রবল এবং প্রকাশ্য। কোথাও কোথাও এসব বিরোধের কারণে মারামারি-হানাহানির ঘটনাও ঘটেছে। কোনো কোনো জায়গায় প্রশাসন, স্থানীয় সরকার সংস্থাও এসব বিরোধের পক্ষ হয়ে জটিল প্রশাসনিক সমস্যা তৈরি করছে। পরিণতিতে নাগরিক জীবনেও দেখা দিচ্ছে ভোগান্তি-বিড়ম্বনা। বরিশালের মেয়রের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও একজন প্রতিমন্ত্রীর বিরোধের জেরে সরকারি প্রশাসন পক্ষভুক্ত হয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা দ্রুত মীমাংসার উদ্যোগ না নেওয়া হলে সেই আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের একটি ভিডিও বক্তব্যকে কেন্দ্র করেও সেখানে রাজনৈতিক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু, গোয়েন্দা সংস্থা এবং জেলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সম্পর্কে মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন বলে অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগ দাবি করে গাজীপুরে সড়ক-রেল অবরোধের মতো কর্মসূচিও পালন করেছে আওয়ামী লীগের একাংশ। মেয়রবিরোধী অংশের নেতৃত্বে আছেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল।
আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সভায় দলীয় প্রধান নিজেই মাদারীপুরের শাজাহান খানকে পুরোমাত্রায় আওয়ামী লীগার হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। শাজাহান খান জাসদ থেকে আওয়ামী লীগে এসে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য হয়েছেন। সড়ক পরিবহন শ্রমিকনেতা হিসেবে পরিচিত এই নেতা দাপটের সঙ্গে মন্ত্রিত্ব করেছেন কয়েক বছর। তার পরও মাদারীপুরে আওয়ামী লীগের আর যাঁরা নেতা আছেন, তাঁদের কাছে শাজাহান খান এখনো ঘরের মানুষ হয়ে উঠতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী বিরোধ মেটানোর কথা বলার পর শাজাহান খান আনুষ্ঠানিকভাবে দলের অন্তত ছয়জন কেন্দ্রীয় নেতাকে একটি বৈঠকে ডাকলেও একজনও তাঁর ডাকে সাড়া দেননি। এই নেতারা শাজাহান খানকে ঐক্যের অন্তরায় হিসেবে ভাবছেন।
বিরোধ মীমাংসার উদ্দশ্যে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের যে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে নাম নেই আবদুল কাদের মির্জার। কমিটি সম্পর্কে কাদের মির্জা বলেছেন, এটা বানরের পিঠা ভাগ। এই কমিটির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হয়নি। এই কমিটি হচ্ছে অপরাজনীতির আরও একটি চমক। কাদের মির্জা ওবায়দুল কাদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘উনি সারা দিন মিথ্যা কথা বলেন। তিনি মিথ্যুক। আমার কাছে দুই মাস আগে যে ওয়াদা তিনি করেছেন, তার একটিও পূরণ করেননি।’ আগামী নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে কাদের মির্জা বলেছেন, আগামী নির্বাচনে কোম্পানীগঞ্জের মানুষ ওবায়দুল কাদেরের কবর রচনা করবে।
এসব কথাকে কি ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ বা পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে, নাকি এসব সুস্থ রাজনীতির ধারায় ফেরা যে আওয়ামী লীগের পক্ষে সহজ, নয়, তারই আলামত?
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
দেশে একটি শক্তিশালী, সক্রিয় ও কার্যকর বিরোধী দল না থাকায় যাঁরা আক্ষেপ করেন, তাঁদের আশ্বস্ত করে আওয়ামী লীগের নেতারা বলতে পারেন, বিরোধী দল নেই তো কী হয়েছে, আমরা আছি না?
বিরোধী দল কী করে? সরকারের সমালোচনা, বিরোধিতা, আন্দোলন, পথ অবরোধ, ধর্মঘট, জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি–এসবই তো? দেশে কার্যকর কোনো বিরোধী দল না থাকায় এই কাজগুলো কি বন্ধ রয়েছে? সারা দেশে ঘোষণা দিয়ে একযোগে না হলেও আওয়ামী লীগ কিংবা তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো দেশের কোথাও না কোথাও এসব কাজ ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে।
সরকারি ও বিরোধী দলের সমর্থকদের মধ্যে তেমন উল্লেখ করার মতো সংঘাত-সংঘর্ষ দেশে একেবারে বন্ধ নেই। আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিরোধের জেরে এই করোনাকালেও হতাহতের ঘটনা সংবাদপত্রে কম ছাপা হয়নি। এক নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জেই আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ ও গুলি বিনিময়ের ঘটনায় গত এক বছরের কম সময়ে একজন সাংবাদিকসহ কমপক্ষে দুজন নিহত এবং আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছে অনেককে। একই স্থানে দুই গ্রুপ সমাবেশ ডাকায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা জারির ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার।
চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে এই সময়কালে প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটেছে একাধিক। নির্বাচনী সহিংসতা, রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন ও আধিপত্য বিস্তারের জন্যই প্রকাশ্যে এই অস্ত্র প্রদর্শন বলে সংবাদপত্রে সচিত্র খবর ছাপা হয়েছে। পেশাদার সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি যুবলীগ ও ছাত্রলীগের পদধারী নেতারাও অস্ত্র হাতে দাপট দেখিয়েছেন অকুতোভয়ে। বড় কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে থাকলে বল-ভরসা এমনিতেই বেড়ে যায়, তারপর নাম যদি সরকারি দলের খাতায় ওঠে, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। সিনা টান করে যাকে-তাকে বলা যায়, জানেন বা জানিস ‘আমি কে’?
অন্য সব এলাকার কথা বাদ দিয়ে নোয়াখালীর বসুরহাটের কথাই বলা যাক। ছোট একটি পৌরসভার মেয়র এক বছর ধরে যে দাপট দেখিয়ে চলেছেন, তা কার না চোখে পড়েছে? বাংলাদেশের রাজনীতির রাজধানী বুঝি বসুরহাটে স্থানান্তর হয়েছে বলেও কেউ কেউ ভাবতে শুরু করেছিলেন। আবদুল কাদের মির্জা নামে যে একজন বিশাল মাপের বঙ্গবন্ধুর সৈনিক আছেন, এত বছর ধরে রাজনৈতিক বিষয়ে লেখালেখি করেও তাঁর নাম না জেনে আমি তো নিজেকেই ধিক্কার দিয়েছিলাম। রাজনীতির দুই ‘মির্জা’র নামের সঙ্গে আমি পরিচিত বহু বছর ধরে। এর মধ্যে বড় মির্জা হলেন মির্জা গোলাম হাফিজ, যিনি এখন আর বেঁচে নেই। তবে খালেদা জিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে তিনি ছিলেন এক দাপুটে আইনমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচারের বাইরে রাখার জন্য জারিকৃত কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা একটি অসম্ভব বিষয় বলে তিনি মনে করতেন।
তিনি নিজে বয়সে মুরব্বি হয়েও তাঁর রাজনৈতিক মুরব্বিদের খুশি করতে তিনি ছিলেন অতি তৎপর। আমার চেনা ছোট ‘মির্জা’ হলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এই দুই মির্জাই বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার মানুষ। আমিও তাই। সে জন্য দুজনের সঙ্গে পরিচয়ের একটি আঞ্চলিকতার যোগসূত্র আছে। মির্জা ফখরুলকে দেখুন, সরকারি কলেজের একজন সাবেক শিক্ষক, ঠাকুরগাঁওয়ে একসময় অতিশয় ভদ্র ও বিনয়ী হিসেবে পরিচিত মানুষটি (যদিও তাঁর পিতা চখা মিয়া একজন মুসলিম লীগার এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বী হিসেবেই বেশি খ্যাত) রাজনীতির চক্করে পড়ে কেমন তালবেতাল অবস্থান নিয়ে বিএনপিতে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে চলেছেন।
যুবদলের সাবেক প্রধান, ঢাকার সাবেক মেয়র এবং এখন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের নামের সঙ্গে বহু আগে থেকে পরিচিত হলেও তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই।
আমি তখন মনে করতাম ‘মির্জা’রা বুঝি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কে বাঁধা। আমার ভুল ভেঙেছে আবদুল কাদের মির্জার নাম কানে আসার পর। মির্জা শুধু বিএনপিতে নেই, আওয়ামী লীগেও আছে। বিএনপির বর্তমান মির্জারা আওয়ামী লীগের ‘দুর্নীতি-দুঃশাসন’ নিয়ে যত কড়া কথা বলতে না পারেন, আওয়ামী লীগের মির্জা তা অবলীলায় বলে চলেছেন দিনের পর দিন। প্রশ্ন হলো, একটি পৌরসভার মেয়র ক্ষমতাসীন দল ও সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে দিব্যি আছেন, তাঁকে কেউ থামাতে পারছে না, তাঁর এই অপরিসীম শক্তির প্রকৃত উৎস আসলে কী?
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এবং মহাসড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই এই আবদুল কাদের মির্জা। তিনি গত ৩১ ডিসেম্বর পৌরসভা নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করতে গিয়ে প্রথম শব্দবোমা ফাটিয়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ফেনীর দুই সংসদ সদস্যের দুর্নীতি, অনিয়ম এবং নিয়োগ-বাণিজ্য নিয়ে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে এমন বলেছিলেন যে, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের এমপিদের কেউ কেউ পালানোর জন্য দরজা খুঁজে পাবেন না।’ তারপর থেকে তিনি নানা সময়ে নিজের বড় ভাই, ভাবি ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে লাগামহীন কথা বলা অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর এসব কথাবার্তা শুনে মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে একটি কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে তিনিই বুঝি বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। সরকার কারও কোনো সমালোচনা সহ্য করে না, সরকারবিরোধীদের রাস্তায় নামতে দেয় না, এটা ভুল প্রমাণ করতেই যেন মাঠে আছেন আবদুল কাদের মির্জা।
কাদের মির্জার বিরুদ্ধে সংগঠনের শৃঙ্খলা ভঙ্গ বা আর কোনো অভিযোগও আনা হচ্ছে না। ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই না হয়ে অন্য কেউ এমন আচরণ করলে কি এমন কানে তুলো দেওয়ার নীতি অনুসরণ করা হতো? কাদের মির্জাকে ‘লাই’ দিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে কী বার্তা দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা? এভাবে চলতে থাকলে আওয়ামী লীগ কি আর সংগঠনের মধ্যে কোন্দল মিটিয়ে দলকে সংহত করতে পারবে?
আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের ভেতরে যেসব দ্বন্দ্ব ও সংকট আছে, তা মিটিয়ে ফেলে সবাইকে মিলেমিশে কাজ করার পরামর্শ দিলেও তা কেউ শুনছে বা মানছে কি? অনেক জেলা, উপজেলা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পর্যায়ে দলের অভ্যন্তরে নানা ধরনের সমস্যা আছে। দলের মধ্যে নেতায় নেতায় কোন্দল এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়। মন্ত্রীদের সঙ্গে এমপিদের, এমপিদের সঙ্গে দলের পদ-পদবিধারী নেতাদের কিংবা পদবঞ্চিতদের বিরোধ, মনোমালিন্য প্রবল এবং প্রকাশ্য। কোথাও কোথাও এসব বিরোধের কারণে মারামারি-হানাহানির ঘটনাও ঘটেছে। কোনো কোনো জায়গায় প্রশাসন, স্থানীয় সরকার সংস্থাও এসব বিরোধের পক্ষ হয়ে জটিল প্রশাসনিক সমস্যা তৈরি করছে। পরিণতিতে নাগরিক জীবনেও দেখা দিচ্ছে ভোগান্তি-বিড়ম্বনা। বরিশালের মেয়রের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও একজন প্রতিমন্ত্রীর বিরোধের জেরে সরকারি প্রশাসন পক্ষভুক্ত হয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা দ্রুত মীমাংসার উদ্যোগ না নেওয়া হলে সেই আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের একটি ভিডিও বক্তব্যকে কেন্দ্র করেও সেখানে রাজনৈতিক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু, গোয়েন্দা সংস্থা এবং জেলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সম্পর্কে মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন বলে অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগ দাবি করে গাজীপুরে সড়ক-রেল অবরোধের মতো কর্মসূচিও পালন করেছে আওয়ামী লীগের একাংশ। মেয়রবিরোধী অংশের নেতৃত্বে আছেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল।
আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সভায় দলীয় প্রধান নিজেই মাদারীপুরের শাজাহান খানকে পুরোমাত্রায় আওয়ামী লীগার হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। শাজাহান খান জাসদ থেকে আওয়ামী লীগে এসে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য হয়েছেন। সড়ক পরিবহন শ্রমিকনেতা হিসেবে পরিচিত এই নেতা দাপটের সঙ্গে মন্ত্রিত্ব করেছেন কয়েক বছর। তার পরও মাদারীপুরে আওয়ামী লীগের আর যাঁরা নেতা আছেন, তাঁদের কাছে শাজাহান খান এখনো ঘরের মানুষ হয়ে উঠতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী বিরোধ মেটানোর কথা বলার পর শাজাহান খান আনুষ্ঠানিকভাবে দলের অন্তত ছয়জন কেন্দ্রীয় নেতাকে একটি বৈঠকে ডাকলেও একজনও তাঁর ডাকে সাড়া দেননি। এই নেতারা শাজাহান খানকে ঐক্যের অন্তরায় হিসেবে ভাবছেন।
বিরোধ মীমাংসার উদ্দশ্যে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের যে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে নাম নেই আবদুল কাদের মির্জার। কমিটি সম্পর্কে কাদের মির্জা বলেছেন, এটা বানরের পিঠা ভাগ। এই কমিটির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হয়নি। এই কমিটি হচ্ছে অপরাজনীতির আরও একটি চমক। কাদের মির্জা ওবায়দুল কাদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘উনি সারা দিন মিথ্যা কথা বলেন। তিনি মিথ্যুক। আমার কাছে দুই মাস আগে যে ওয়াদা তিনি করেছেন, তার একটিও পূরণ করেননি।’ আগামী নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে কাদের মির্জা বলেছেন, আগামী নির্বাচনে কোম্পানীগঞ্জের মানুষ ওবায়দুল কাদেরের কবর রচনা করবে।
এসব কথাকে কি ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ বা পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে, নাকি এসব সুস্থ রাজনীতির ধারায় ফেরা যে আওয়ামী লীগের পক্ষে সহজ, নয়, তারই আলামত?
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
২১ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
১ দিন আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
১ দিন আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
১ দিন আগে