সেলিম জাহান
একজন মানুষের নানান সত্তা থাকে, থাকে নানান পরিচয়। এই যে আমি, আমি তো একজন বহুধা সত্তাসম্পন্ন মানুষ। আমি দক্ষিণ এশীয়, আমি বাঙালি, আমি একটি নির্দিষ্ট বয়ঃক্রমের, আমি পুরুষ, আমি একজন শিল্প-সাহিত্যরসিক, আমি দুই কন্যার জনক ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার এই বহুধা পরিচয়ের নানান মাত্রিকতা আছে। তার অন্যতম হচ্ছে যে এ সত্তাবলয় আমি যত প্রসারিত করব, তত আমার সত্তার বৈচিত্র্য বাড়বে, সন্দেহ নেই। সেই বৈচিত্র্য যদি আমরা মেনে নিই, তার প্রতি যদি আমরা প্রত্যেকে শ্রদ্ধাশীল হই, তাহলে ওই বৈচিত্র্য আমাদের শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের বহুধা সত্তার একটিকেই বেছে নিই আমাদের একক ও অদ্বিতীয় সত্তা হিসেবে, তখন আমার বহুধা সত্তাকে আমি খর্বিত করি এবং বহু মাত্রিকতার মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ আমি হারাই।
তাতেও অসুবিধে নেই। কিন্তু মুশকিল হয়, যখন আমি আমার নির্বাচিত সত্তাটিকে মানুষের শ্রেষ্ঠতম সত্তা হিসেবে মনে করি এবং অন্য যাঁরা সে সত্তার অনুগামী নন, তাঁরা আমার চেয়ে নিকৃষ্টতর বলে বিবেচনা করি এবং ভাবি যে তাঁরা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নন। সে অবস্থায় বিভাজন, বিরোধ, সংঘর্ষ এবং সহিংসতা অবশ্যম্ভাবী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানিতে নাৎসিদের বিশুদ্ধ জাতিগত কৌলীন্য ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবি ও ইহুদি নিধন এর উল্লেখযোগ্য প্রমাণ। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের কার্যকলাপও এর প্রমাণ।
উপর্যুক্ত চিত্রটি সবচেয়ে প্রকট হয়ে ওঠে ধর্মসত্তার ক্ষেত্রে। ধর্মসত্তা মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও বোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ কথা মেনে নিয়ে অন্য সবার ধর্মসত্তার প্রতি আমরা প্রত্যেকে যদি শ্রদ্ধাশীল, সহিঞ্চু ও সহনশীল থাকি ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, তাহলে যেকোনো সমাজে বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব এবং আমাদের সমাজে সনাতন চিরায়তভাবে সেটাই তো হয়ে এসেছে।
কিন্তু কালক্রমে বিভিন্ন সমাজে এ-জাতীয় ধর্মীয় সহিষ্ণু শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা লুপ্ত হয়েছে এবং তার বদলে স্থান করে নিয়েছে ধর্মীয় উন্মাদনা, অসহিষ্ণুতা এবং অসহনশীলতা। তবে একটা প্রশ্ন থেকে যায়, বিভাজন তো অন্যান্য ক্ষেত্রেও আছে, কিন্তু তা তো একটা উন্মাদনাময়, অসহিঞ্চু সংঘর্ষে গিয়ে পৌঁছায় না। কই, অধূমপায়ীরা নানান পার্থক্য সত্ত্বেও ধূমপায়ীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন না? কিংবা কখনো কিন্তু শুনিনি যে উচ্চাঙ্গসংগীতপ্রেমীরা অন্যান্য সংগীতের রসিকজনদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছেন। তাহলে ধর্মের ক্ষেত্রে এলেই ব্যাপারটা একটা উন্মাদ, অসহিঞ্চু ও অসহনশীল রূপ নেয় কেন?
কারণ, বোধ করি অনেক আছে—কিন্তু তিনটি কারণ হয়তো বেশ জোরালো। যেমন ধূমপায়ী বনাম অধূমপায়ী প্রশ্নে যুক্তি, বিচারবুদ্ধি, তথ্য-উপাত্ত কিংবা বিজ্ঞানমনস্কতা একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত করে, যেখানে কোনো চরম অবস্থান না নিয়েই একটি অর্থবহ বিতর্ক প্রায়ই ঘটে। সেখানে ধূমপায়ী কিংবা অধূমপায়ী কেউই তাদের ধূমপান সত্তাকে তাদের একক ও অদ্বিতীয় সত্তা হিসেবে চিহ্নিত করে না, তার শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করা তো দূরের কথা। ফলে একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সেখানে সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় বিশ্বাস ভিন্ন অন্য সবকিছুকে আমরা যদি বাদ দিয়ে দিই, তাহলে ধর্মীয় অনুশাসন আমাদের জীবনের নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সেসব অনুশাসনই আমাদের জীবনধারা, শিক্ষা-সংস্কৃতির নির্ণায়ক হয়ে পড়ে। সে অবস্থায় আমাদের জীবনে অন্য কোনো কিছুই আর গ্রহণযোগ্য হয় না। ফলে আমাদের বিশ্বাসের বাইরে যাঁদের বিশ্বাসবলয়, তাঁদের আমরা আর মেনে নিতে পারি না।
তাই ধর্মীয় সত্তার ক্ষেত্রে অনেকেই তাঁদের অন্য সব সত্তাকে গৌণ করে ধর্মীয় সত্তাকেই তাঁদের একমাত্র ও অদ্বিতীয় সত্তা হিসেবে চিহ্নিত করেন। ফলে এসব ব্যক্তি তাঁদের নিজ নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব, খাঁটিত্ব, কৌলীন্য সম্পর্কে অনড় দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন একটি চরম অবস্থান নেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে অন্যদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আত্মপরিচয়ের প্রতি তাঁদের নমনীয়তা, শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দিয়ে একটি ধর্মীয় উন্মত্ততা, অসহিঞ্চুতা ও সংঘর্ষের সূচনা হয়।
এ-জাতীয় ধর্মীয় উন্মত্ততা আমরা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে দেখেছি। এ দেশেও নানান সময়ে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তার একটি বড় প্রমাণ। এসব দাঙ্গা ও সংঘর্ষের মূল লক্ষ্য থাকেন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। তবে ধর্মীয় বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ এসব দাঙ্গার আপাত কারণ মনে হলেও এর পেছনে এক গূঢ় রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনীতি কাজ করে।
রাজনৈতিক দিক থেকে এ-জাতীয় ক্রিয়াকলাপের মূল লক্ষ্য থাকে একটি ধর্মান্ধ সমাজ তৈরি করে মধ্যযুগের দিকে সমাজকে ঠেলে দেওয়া। এর মাধ্যমে দুটো উদ্দেশ্য সাধিত হয়। এক. নারীদের সব অধিকার হরণ করে তাঁদের অবদমিত করা যায় ও দুই. সমাজে বিজ্ঞানমনস্কতা নষ্ট করে মৌলবাদী ধ্যান-ধারণাকে শক্তভূমির ওপরে প্রতিষ্ঠিত করা যায়।
অন্য সবকিছুকে গুঁড়িয়ে দিয়ে সংখ্যাগুরুর ধর্মসত্তার উন্মাদনা যখন প্রবল হয়ে ওঠে, তখন সমাজে একটি ভীতির সংস্কৃতি তৈরি করা হয়। ফলে একদিকে যেমন সংখ্যালঘুদের কণ্ঠরোধের ব্যবস্থা করা হয়, তেমনি তাঁদের দেশছাড়া করার একটি পরিবেশ তৈরি করা হয়। এর মাধ্যমে সংখ্যাগুরুদের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণকে নিরঙ্কুশ করার ব্যবস্থা করা হয়। এত সব করার পেছনে একটি অর্থনৈতিক প্রণোদনাও কাজ করে। সংখ্যালঘুদের বিতাড়নের ব্যবস্থা করে সংখ্যাগুরুরা তাঁদের ভূমি, অন্যান্য সম্পদ ও সম্পত্তি বেদখল করে নিতে বা নামমাত্র মূল্যে কিনে নিতে পারে।
কিন্তু ধর্মসত্তা বিষয়টি আরও জটিল আকার ধারণ করে, যখন সেটা ব্যক্তিগত অঙ্গন পেরিয়ে রাষ্ট্রের সীমারেখায় চলে আসে। ‘ধর্ম’ শব্দটির দুটো মাত্রিকতা আছে–একটি হচ্ছে ‘বৈশিষ্ট্য’ ও অন্যটি হচ্ছে ‘বিশ্বাস’। ধর্ম শব্দটি যেমন বৈশিষ্ট্য বোঝায়, তেমনি বোঝায় বিশ্বাস।
এই যেমন পাঠ্যপুস্তকে লেখা থাকে, ‘জলের ধর্ম হচ্ছে যে পাত্রে রাখা হয়, তার আকার ধারণ করা’ কিংবা ‘আগুনের ধর্ম হচ্ছে জ্বালানো’। অথবা আমরাও কথা প্রসঙ্গেই বলি,‘গাছের ধর্ম হচ্ছে ছায়া প্রদান’ কিংবা ‘বিড়ালের ধর্ম হচ্ছে চুরি করে খাওয়া’।
এসব কথাতেই ধর্ম শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ‘বৈশিষ্ট্য’ অর্থে এর সঙ্গে ‘বিশ্বাসের’ কোনো সম্পর্ক নেই। তাই আমরা যখন বলি, ‘আগুনের ধর্ম হচ্ছে জ্বালানো’, এর মানে হচ্ছে আগুনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রজ্বালিত করা। এ কাজটি আগুনের বিশ্বাস-উদ্ভূত নয়। জল, আগুন, গাছ কিংবা বিড়ালের কোনো ‘বিশ্বাস’ থাকতে পারে না। আসলে মানুষবহির্ভূত প্রাণীর কিংবা বস্তুর ধর্ম বলতে শুধু তাদের বৈশিষ্ট্যই বোঝায়।
কেবল মানুষের ক্ষেত্রেই ধর্ম শব্দটির দুটো মাত্রিকতাই কাজ করে—‘বৈশিষ্ট্য’ ও ‘বিশ্বাস’। তাই যখন বলি, ‘শিক্ষকের ধর্ম হচ্ছে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানদান’ কিংবা ‘চিকিৎসকের ধর্ম হচ্ছে মানুষকে সেবাদান’, তখন আমরা বোঝাতে চাই যে এগুলো হচ্ছে তাঁদের পেশার বৈশিষ্ট্য।
কিন্তু ‘বৈশিষ্ট্যকেন্দ্রিক’ ধর্মের বাইরেও মানুষের বিধাতা, জীবনবোধ, পরলোক বিষয়ে একটি ব্যক্তিগত বিশ্বাস থাকে। সেটাও মানুষের ধর্ম; তবে ‘বৈশিষ্ট্য-উদ্ভূত’ নয়, সেটা ‘বিশ্বাস-উৎসারিত’। সেই ব্যক্তিগত বিশ্বাস-উৎসারিত ধর্মের নানান বিভাজনের ভিত্তিতে কেউ খ্রিষ্টান, কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান হিসেবে চিহ্নিত। বিশ্বাস-উৎসারিত ধর্ম শুধু মানুষেরই
থাকতে পারে।
এসব কথার পরিপ্রেক্ষিতে এটা সুস্পষ্ট যে সংজ্ঞাগত, কাঠামোগত দিক থেকে রাষ্ট্র সত্তাটির ‘বৈশিষ্ট্য-উদ্ভূত’ ধর্ম থাকে, কিন্তু কেমন করে তার ‘বিশ্বাস-উদ্ভূত’ ধর্ম থাকে? প্রত্যাশিত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একটি রাষ্ট্রের ধর্ম হচ্ছে তার ‘ভৌগোলিক সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা করা, তার ‘নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সমানাধিকার সুনিশ্চিত করা’ ইত্যাদি। এগুলো রাষ্ট্রের সাংগঠনিক কাঠামো-উৎসারিত।
মানুষের মতো রাষ্ট্রের কোনো বিশ্বাস-উদ্ভূত ধর্ম অপ্রাসঙ্গিক, কারণ নানান জনগোষ্ঠী একটি রাষ্ট্রে বাস করলেও রাষ্ট্র কোনো মানুষ নয়। রাষ্ট্র যদি মানুষের মতো ধর্ম বিশ্বাসী হয়, তখন রাষ্ট্রের মতো সত্তাটির পক্ষে ধর্মীয় অনুশাসনে আবদ্ধ হওয়া ভিন্ন আর কোনো যৌক্তিক পথ খোলা থাকে না।
এ অনভিপ্রেত অবস্থাটা এড়াতে হলে তিনটি বিষয় বোধ হয় করা যেতে পারে। এক. আমরা শিকড়ে ফিরে যেতে পারি। ‘মানুষই প্রথম এবং প্রথমেই মানুষ’ এই ভিত্তিভূমি থেকে আমরা বলতে পারি যে মানবিকতাই সব মানুষের মৌলিক পরিচয় এবং সব সত্তার ন্যূনতম যোগসূত্র। দুই. উপর্যুক্ত কথাগুলোকে আমরা যদি মেনে নিই, তাহলে অন্যের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে, তাকে মেনে নেওয়া, তার প্রতি সহিষ্ণু হওয়া সহজ হয়ে যায়। তিন. আমাদের নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাসটিকে আমরা যদি আমাদের ব্যক্তিগত নিজস্ব বলয়ে ধারণ করি, তাহলে ধার্মিক হয়েও আমরা ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারব। এ তিনটি পন্থাকে অনুসরণ করলেই সব বিভাজন এবং সব সংঘর্ষ থেকে উত্তরণ সম্ভব হতে পারে।
আমি মনে করি, চূড়ান্ত বিচারে যা আমি ধারণ করে আছি এবং যা আমাকে ধারণ করে আছে, তা-ই আমার ধর্ম। আমি ধারণ করে আছি সর্বজনীন মানবতা বোধ, মৌলিক মানবিক মূল্যবোধ, মুক্তবুদ্ধি এবং মুক্তচিন্তা। আমাকে ধারণ করে আছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, আমাদের সংস্কৃতি ও জীবনবোধ, আমাদের সমাজ ও তার পরিমণ্ডল। আমার ধর্ম এসব কিছু নিয়েই আর সেখানে মানুষ হিসেবে আমার সবচেয়ে বড় ধর্ম আমার মানবিকতা।
একজন মানুষের নানান সত্তা থাকে, থাকে নানান পরিচয়। এই যে আমি, আমি তো একজন বহুধা সত্তাসম্পন্ন মানুষ। আমি দক্ষিণ এশীয়, আমি বাঙালি, আমি একটি নির্দিষ্ট বয়ঃক্রমের, আমি পুরুষ, আমি একজন শিল্প-সাহিত্যরসিক, আমি দুই কন্যার জনক ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার এই বহুধা পরিচয়ের নানান মাত্রিকতা আছে। তার অন্যতম হচ্ছে যে এ সত্তাবলয় আমি যত প্রসারিত করব, তত আমার সত্তার বৈচিত্র্য বাড়বে, সন্দেহ নেই। সেই বৈচিত্র্য যদি আমরা মেনে নিই, তার প্রতি যদি আমরা প্রত্যেকে শ্রদ্ধাশীল হই, তাহলে ওই বৈচিত্র্য আমাদের শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের বহুধা সত্তার একটিকেই বেছে নিই আমাদের একক ও অদ্বিতীয় সত্তা হিসেবে, তখন আমার বহুধা সত্তাকে আমি খর্বিত করি এবং বহু মাত্রিকতার মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ আমি হারাই।
তাতেও অসুবিধে নেই। কিন্তু মুশকিল হয়, যখন আমি আমার নির্বাচিত সত্তাটিকে মানুষের শ্রেষ্ঠতম সত্তা হিসেবে মনে করি এবং অন্য যাঁরা সে সত্তার অনুগামী নন, তাঁরা আমার চেয়ে নিকৃষ্টতর বলে বিবেচনা করি এবং ভাবি যে তাঁরা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নন। সে অবস্থায় বিভাজন, বিরোধ, সংঘর্ষ এবং সহিংসতা অবশ্যম্ভাবী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানিতে নাৎসিদের বিশুদ্ধ জাতিগত কৌলীন্য ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবি ও ইহুদি নিধন এর উল্লেখযোগ্য প্রমাণ। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের কার্যকলাপও এর প্রমাণ।
উপর্যুক্ত চিত্রটি সবচেয়ে প্রকট হয়ে ওঠে ধর্মসত্তার ক্ষেত্রে। ধর্মসত্তা মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও বোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ কথা মেনে নিয়ে অন্য সবার ধর্মসত্তার প্রতি আমরা প্রত্যেকে যদি শ্রদ্ধাশীল, সহিঞ্চু ও সহনশীল থাকি ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, তাহলে যেকোনো সমাজে বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব এবং আমাদের সমাজে সনাতন চিরায়তভাবে সেটাই তো হয়ে এসেছে।
কিন্তু কালক্রমে বিভিন্ন সমাজে এ-জাতীয় ধর্মীয় সহিষ্ণু শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা লুপ্ত হয়েছে এবং তার বদলে স্থান করে নিয়েছে ধর্মীয় উন্মাদনা, অসহিষ্ণুতা এবং অসহনশীলতা। তবে একটা প্রশ্ন থেকে যায়, বিভাজন তো অন্যান্য ক্ষেত্রেও আছে, কিন্তু তা তো একটা উন্মাদনাময়, অসহিঞ্চু সংঘর্ষে গিয়ে পৌঁছায় না। কই, অধূমপায়ীরা নানান পার্থক্য সত্ত্বেও ধূমপায়ীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন না? কিংবা কখনো কিন্তু শুনিনি যে উচ্চাঙ্গসংগীতপ্রেমীরা অন্যান্য সংগীতের রসিকজনদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছেন। তাহলে ধর্মের ক্ষেত্রে এলেই ব্যাপারটা একটা উন্মাদ, অসহিঞ্চু ও অসহনশীল রূপ নেয় কেন?
কারণ, বোধ করি অনেক আছে—কিন্তু তিনটি কারণ হয়তো বেশ জোরালো। যেমন ধূমপায়ী বনাম অধূমপায়ী প্রশ্নে যুক্তি, বিচারবুদ্ধি, তথ্য-উপাত্ত কিংবা বিজ্ঞানমনস্কতা একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত করে, যেখানে কোনো চরম অবস্থান না নিয়েই একটি অর্থবহ বিতর্ক প্রায়ই ঘটে। সেখানে ধূমপায়ী কিংবা অধূমপায়ী কেউই তাদের ধূমপান সত্তাকে তাদের একক ও অদ্বিতীয় সত্তা হিসেবে চিহ্নিত করে না, তার শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করা তো দূরের কথা। ফলে একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সেখানে সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় বিশ্বাস ভিন্ন অন্য সবকিছুকে আমরা যদি বাদ দিয়ে দিই, তাহলে ধর্মীয় অনুশাসন আমাদের জীবনের নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সেসব অনুশাসনই আমাদের জীবনধারা, শিক্ষা-সংস্কৃতির নির্ণায়ক হয়ে পড়ে। সে অবস্থায় আমাদের জীবনে অন্য কোনো কিছুই আর গ্রহণযোগ্য হয় না। ফলে আমাদের বিশ্বাসের বাইরে যাঁদের বিশ্বাসবলয়, তাঁদের আমরা আর মেনে নিতে পারি না।
তাই ধর্মীয় সত্তার ক্ষেত্রে অনেকেই তাঁদের অন্য সব সত্তাকে গৌণ করে ধর্মীয় সত্তাকেই তাঁদের একমাত্র ও অদ্বিতীয় সত্তা হিসেবে চিহ্নিত করেন। ফলে এসব ব্যক্তি তাঁদের নিজ নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব, খাঁটিত্ব, কৌলীন্য সম্পর্কে অনড় দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন একটি চরম অবস্থান নেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে অন্যদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আত্মপরিচয়ের প্রতি তাঁদের নমনীয়তা, শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দিয়ে একটি ধর্মীয় উন্মত্ততা, অসহিঞ্চুতা ও সংঘর্ষের সূচনা হয়।
এ-জাতীয় ধর্মীয় উন্মত্ততা আমরা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে দেখেছি। এ দেশেও নানান সময়ে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তার একটি বড় প্রমাণ। এসব দাঙ্গা ও সংঘর্ষের মূল লক্ষ্য থাকেন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। তবে ধর্মীয় বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ এসব দাঙ্গার আপাত কারণ মনে হলেও এর পেছনে এক গূঢ় রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনীতি কাজ করে।
রাজনৈতিক দিক থেকে এ-জাতীয় ক্রিয়াকলাপের মূল লক্ষ্য থাকে একটি ধর্মান্ধ সমাজ তৈরি করে মধ্যযুগের দিকে সমাজকে ঠেলে দেওয়া। এর মাধ্যমে দুটো উদ্দেশ্য সাধিত হয়। এক. নারীদের সব অধিকার হরণ করে তাঁদের অবদমিত করা যায় ও দুই. সমাজে বিজ্ঞানমনস্কতা নষ্ট করে মৌলবাদী ধ্যান-ধারণাকে শক্তভূমির ওপরে প্রতিষ্ঠিত করা যায়।
অন্য সবকিছুকে গুঁড়িয়ে দিয়ে সংখ্যাগুরুর ধর্মসত্তার উন্মাদনা যখন প্রবল হয়ে ওঠে, তখন সমাজে একটি ভীতির সংস্কৃতি তৈরি করা হয়। ফলে একদিকে যেমন সংখ্যালঘুদের কণ্ঠরোধের ব্যবস্থা করা হয়, তেমনি তাঁদের দেশছাড়া করার একটি পরিবেশ তৈরি করা হয়। এর মাধ্যমে সংখ্যাগুরুদের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণকে নিরঙ্কুশ করার ব্যবস্থা করা হয়। এত সব করার পেছনে একটি অর্থনৈতিক প্রণোদনাও কাজ করে। সংখ্যালঘুদের বিতাড়নের ব্যবস্থা করে সংখ্যাগুরুরা তাঁদের ভূমি, অন্যান্য সম্পদ ও সম্পত্তি বেদখল করে নিতে বা নামমাত্র মূল্যে কিনে নিতে পারে।
কিন্তু ধর্মসত্তা বিষয়টি আরও জটিল আকার ধারণ করে, যখন সেটা ব্যক্তিগত অঙ্গন পেরিয়ে রাষ্ট্রের সীমারেখায় চলে আসে। ‘ধর্ম’ শব্দটির দুটো মাত্রিকতা আছে–একটি হচ্ছে ‘বৈশিষ্ট্য’ ও অন্যটি হচ্ছে ‘বিশ্বাস’। ধর্ম শব্দটি যেমন বৈশিষ্ট্য বোঝায়, তেমনি বোঝায় বিশ্বাস।
এই যেমন পাঠ্যপুস্তকে লেখা থাকে, ‘জলের ধর্ম হচ্ছে যে পাত্রে রাখা হয়, তার আকার ধারণ করা’ কিংবা ‘আগুনের ধর্ম হচ্ছে জ্বালানো’। অথবা আমরাও কথা প্রসঙ্গেই বলি,‘গাছের ধর্ম হচ্ছে ছায়া প্রদান’ কিংবা ‘বিড়ালের ধর্ম হচ্ছে চুরি করে খাওয়া’।
এসব কথাতেই ধর্ম শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ‘বৈশিষ্ট্য’ অর্থে এর সঙ্গে ‘বিশ্বাসের’ কোনো সম্পর্ক নেই। তাই আমরা যখন বলি, ‘আগুনের ধর্ম হচ্ছে জ্বালানো’, এর মানে হচ্ছে আগুনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রজ্বালিত করা। এ কাজটি আগুনের বিশ্বাস-উদ্ভূত নয়। জল, আগুন, গাছ কিংবা বিড়ালের কোনো ‘বিশ্বাস’ থাকতে পারে না। আসলে মানুষবহির্ভূত প্রাণীর কিংবা বস্তুর ধর্ম বলতে শুধু তাদের বৈশিষ্ট্যই বোঝায়।
কেবল মানুষের ক্ষেত্রেই ধর্ম শব্দটির দুটো মাত্রিকতাই কাজ করে—‘বৈশিষ্ট্য’ ও ‘বিশ্বাস’। তাই যখন বলি, ‘শিক্ষকের ধর্ম হচ্ছে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানদান’ কিংবা ‘চিকিৎসকের ধর্ম হচ্ছে মানুষকে সেবাদান’, তখন আমরা বোঝাতে চাই যে এগুলো হচ্ছে তাঁদের পেশার বৈশিষ্ট্য।
কিন্তু ‘বৈশিষ্ট্যকেন্দ্রিক’ ধর্মের বাইরেও মানুষের বিধাতা, জীবনবোধ, পরলোক বিষয়ে একটি ব্যক্তিগত বিশ্বাস থাকে। সেটাও মানুষের ধর্ম; তবে ‘বৈশিষ্ট্য-উদ্ভূত’ নয়, সেটা ‘বিশ্বাস-উৎসারিত’। সেই ব্যক্তিগত বিশ্বাস-উৎসারিত ধর্মের নানান বিভাজনের ভিত্তিতে কেউ খ্রিষ্টান, কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান হিসেবে চিহ্নিত। বিশ্বাস-উৎসারিত ধর্ম শুধু মানুষেরই
থাকতে পারে।
এসব কথার পরিপ্রেক্ষিতে এটা সুস্পষ্ট যে সংজ্ঞাগত, কাঠামোগত দিক থেকে রাষ্ট্র সত্তাটির ‘বৈশিষ্ট্য-উদ্ভূত’ ধর্ম থাকে, কিন্তু কেমন করে তার ‘বিশ্বাস-উদ্ভূত’ ধর্ম থাকে? প্রত্যাশিত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একটি রাষ্ট্রের ধর্ম হচ্ছে তার ‘ভৌগোলিক সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা করা, তার ‘নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সমানাধিকার সুনিশ্চিত করা’ ইত্যাদি। এগুলো রাষ্ট্রের সাংগঠনিক কাঠামো-উৎসারিত।
মানুষের মতো রাষ্ট্রের কোনো বিশ্বাস-উদ্ভূত ধর্ম অপ্রাসঙ্গিক, কারণ নানান জনগোষ্ঠী একটি রাষ্ট্রে বাস করলেও রাষ্ট্র কোনো মানুষ নয়। রাষ্ট্র যদি মানুষের মতো ধর্ম বিশ্বাসী হয়, তখন রাষ্ট্রের মতো সত্তাটির পক্ষে ধর্মীয় অনুশাসনে আবদ্ধ হওয়া ভিন্ন আর কোনো যৌক্তিক পথ খোলা থাকে না।
এ অনভিপ্রেত অবস্থাটা এড়াতে হলে তিনটি বিষয় বোধ হয় করা যেতে পারে। এক. আমরা শিকড়ে ফিরে যেতে পারি। ‘মানুষই প্রথম এবং প্রথমেই মানুষ’ এই ভিত্তিভূমি থেকে আমরা বলতে পারি যে মানবিকতাই সব মানুষের মৌলিক পরিচয় এবং সব সত্তার ন্যূনতম যোগসূত্র। দুই. উপর্যুক্ত কথাগুলোকে আমরা যদি মেনে নিই, তাহলে অন্যের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে, তাকে মেনে নেওয়া, তার প্রতি সহিষ্ণু হওয়া সহজ হয়ে যায়। তিন. আমাদের নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাসটিকে আমরা যদি আমাদের ব্যক্তিগত নিজস্ব বলয়ে ধারণ করি, তাহলে ধার্মিক হয়েও আমরা ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারব। এ তিনটি পন্থাকে অনুসরণ করলেই সব বিভাজন এবং সব সংঘর্ষ থেকে উত্তরণ সম্ভব হতে পারে।
আমি মনে করি, চূড়ান্ত বিচারে যা আমি ধারণ করে আছি এবং যা আমাকে ধারণ করে আছে, তা-ই আমার ধর্ম। আমি ধারণ করে আছি সর্বজনীন মানবতা বোধ, মৌলিক মানবিক মূল্যবোধ, মুক্তবুদ্ধি এবং মুক্তচিন্তা। আমাকে ধারণ করে আছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, আমাদের সংস্কৃতি ও জীবনবোধ, আমাদের সমাজ ও তার পরিমণ্ডল। আমার ধর্ম এসব কিছু নিয়েই আর সেখানে মানুষ হিসেবে আমার সবচেয়ে বড় ধর্ম আমার মানবিকতা।
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
১৬ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
১৭ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
১৭ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
১৭ ঘণ্টা আগে