মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
জামায়াত-বিএনপির সমর্থন, অর্থ ও নেতাকর্মীদের নিয়ে যে দলের আবির্ভাব, সেটি দ্বারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ইত্যাদি কতটা অর্জিত হবে, তা ২০০১-০৬ শাসনকালে অনেকটাই দেখা গেছে।
২৬ অক্টোবর, মঙ্গলবার দুপুরে পুরানা পল্টনের প্রিতম টাওয়ারে ‘গণ অধিকার পরিষদ’ নামে একটি নতুন দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। কদিন আগ থেকেই শোনা যাচ্ছিল ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছেন। অবশেষে সেটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। তবে সংগঠনের আহ্বায়কের দায়িত্ব নিয়েছেন রেজা কিবরিয়া। রেজা কিবরিয়ার অতীত রাজনৈতিক ভূমিকা তেমন নেই। তিনি সাবেক সফল অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে।
রেজা কিবরিয়া দীর্ঘকাল বিদেশে ছিলেন। দেশেও তাঁর আসা-যাওয়া ছিল। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি শাহ এ এম এস কিবরিয়া তাঁর নির্বাচনী এলাকা হবিগঞ্জের বৈদ্যেরবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে এক সভা শেষে জঙ্গিদের গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তৎকালীন জোট সরকার তাঁকে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় আনার ব্যাপারে হেলিকপ্টার দিয়ে সহযোগিতা না করায় অ্যাম্বুলেন্সযোগে হবিগঞ্জ থেকে শাহ কিবরিয়াকে ঢাকায় আনার পথে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। রেজা কিবরিয়া সেই সময় পিতা হত্যার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবাদ সভায় অংশ নেওয়ার মাধ্যমে পরিচিত হন। তিনি তখন সব মহলের ব্যাপক সহানুভূতি লাভ করেছিলেন।
সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র, সফল কূটনীতিবিদ ও এসকাপের (ESCAP) প্রধান নির্বাহী। ২০০৬ সালের নির্বাচনে শাহ এ এম এস কিবরিয়ার আসনে তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ১/১১-এর সরকারের সময় তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। সম্ভবত সে কারণে রেজা কিবরিয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগের বনিবনা আর সেভাবে হয়নি।
তারপর তাঁকে দেশে খুব একটা দেখা যায়নি। ২০১৮ সালে আকস্মিকভাবে তিনি গণফোরামে যোগ দেন। ড. কামাল হোসেনের বদান্যতায় তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। এ নিয়ে গণফোরামে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ড. রেজা কিবরিয়া পিতার পরিচয়ে সহানুভূতি পেলেও পরবর্তী সময়ে নানা কারণে তিনি বিতর্কিত হয়েছেন। এমনকি গণফোরামেও বেশি দিন টিকতে পারেননি। অবশেষে গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক হলেন। তবে রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ, পদ-পদবি পেতে আগ্রহী রেজা কিবরিয়ার এই অবস্থান কত দিন থাকবে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। নতুন দল গঠনে যেসব নেপথ্য শক্তি রয়েছে, তারা তাঁকে কত দিন রাখবে, সেটি নিশ্চিত নয়।
২০১৯ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটাবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত কেউ কেউ ছাত্র অধিকার আন্দোলনের নেতা নামে পরিচিতি পান। নুরুল হক নুর সেই আন্দোলনে তরুণদের কাছে ‘হিরো’ হয়ে ওঠেন। তবে তাঁর বক্তব্য ও আচার-আচরণ নিয়ে তরুণদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও ছিল। ওই আন্দোলনের ভাবমূর্তি নিয়েই নুরুল হক নুর ডাকসুর নির্বাচনে ভিপি পদে দাঁড়ান। ওই পদে ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল তাঁকে গোপনে সমর্থন করে। নিরাপদ সড়ক ও কোটাবিরোধী আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত করার গোপন চেষ্টা ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল করেছিল। নুরুল হক তার পুরস্কার হিসেবেই ডাকসুর ভিপি হওয়ার সুযোগ পান।
নুরুল হক একসময় ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন বলে শোনা যায়। কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তাঁর উত্থান ভিন্নভাবে হতে থাকে। তিনি তখন বিএনপি, জামায়াত, নাগরিক ঐক্যসহ আওয়ামী লীগবিরোধী বিভিন্ন দলের আনুকূল্য লাভ করতে থাকেন।
আমাদের দেশে একটি ধারণা প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়ে থাকে যে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত না হওয়ার কারণে নতুন নেতা তৈরি হতে পারছে না। জাতীয় রাজনীতিতেও সে কারণে যোগ্য নেতার আবির্ভাব ঘটছে না। এটি একটি সহজ-সরল মত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে জাতীয় রাজনীতির নেতা তৈরি হওয়ার জন্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনই একমাত্র উপায় নয়। এভাবে আকস্মিকভাবে নেতা তৈরি হওয়ার নজিরও খুব বেশি নেই। সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রসংগঠনের নেতার পরিচয়ে যাঁরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করছেন, তাঁদের বেশির ভাগের সঙ্গেই লেখাপড়ার সংযোগ নেই। ব্যতিক্রম খুবই কম। ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নেতা হলেই যে কেউ দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নেতা হবেন, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া খুবই কঠিন। তা ছাড়া, আন্দোলন-সংগ্রাম, দলের রাজনীতির নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় ছাড়া কেউ হঠাৎ করে ছাত্র সংসদের নেতা নির্বাচিত হলেই তিনি পরবর্তীকালে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিকশিত হওয়ার ধৈর্য ধারণ করবেন—এমন অভিজ্ঞতাও খুব বেশি দেখা যায় না। ছাত্র সংসদে নেতা নির্বাচিত হয়ে পরে রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে।
নুরুল হক ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর রাজনৈতিক আদর্শচর্চা, লেখাপড়ার পাশাপাশি দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য যে নিষ্ঠা, ত্যাগ ও সততার প্রমাণ রাখা প্রয়োজন ছিল, সেটি তাঁর ক্ষেত্রে খুব একটা দেখা যায়নি। উল্টো তাঁর পেছনে ছাত্রশিবির, ছাত্রদল এবং অতি বাম, অতি ডানেরা সমবেত হয়ে তাঁকে সঠিক পথচলায় বিভ্রান্ত করেছে। ডাকসুর ভিপি পদটি নুরুলের জন্য ব্যক্তিগতভাবে এটি ছিল বড় পাওয়া। কিন্তু দেশ ও জাতির আদর্শ তাঁর কাছে যতটা বিবেচিত হওয়া জরুরি ছিল, সেটা বোঝার অবস্থানে সম্ভবত নুরুলের ছিল না। তিনি অন্যের ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবেই ব্যাবহৃত হলেন কি না, সেটা ভবিষ্যৎই প্রমাণ করবে। তাঁর জন্যও একটি সিঁড়ি তৈরি হয়েছিল, যার যথাযথ ব্যবহারে তিনি সক্ষমতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
নুরুলের বক্তব্য এবং আদর্শেও কোনো সামঞ্জস্য কখনোই সেভাবে ছিল না। ছাত্রশিবির সম্পর্কেও তাঁর কোনো নেতিবাচক অবস্থান ছিল না। আবার ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারও করেছিলেন। আগাগোড়াই তিনি দোদুল্যমান চরিত্রের একজন ‘ছাত্রনেতা’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। এর পেছনে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আদর্শের কোনো ভিত্তি এর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
নুরুল হক নতুন সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারে জামায়াত ও বিএনপির সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ করছিলেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিদেশে অবস্থানরত জামায়াতের নেতারাই মূলত তাঁর দল গঠনে অর্থ সহায়তা করছেন বলেও খবর বেরিয়েছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যেহেতু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাই জামায়াত ও বিএনপি ছাত্র-যুবকদের সমর্থন লাভের জন্য নুরুল হকের উদ্যোগকে সমর্থন দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, পরবর্তী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জামায়াত-বিএনপিসহ আওয়ামীবিরোধী শক্তি নানা কৌশলে মাঠে থাকবে। সে ক্ষেত্রে রেজা কিবরিয়াকে সঙ্গে পাওয়ায় নুরুলকে নিয়ে অগ্রসর হওয়ার হিসাবটি জামায়াত-বিএনপির দিক থেকে বেশ সহজতর হয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলায় গণ অধিকার পরিষদের ব্যানারে ছাত্রশিবির এবং ছাত্রদলের নেতাদের নিয়ে যেসব কমিটি গঠিত হয়েছে, সেগুলোকেই এখন একত্র করে গণ অধিকার পরিষদ নামে একটি কেন্দ্রীয় সংগঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামে ২১ অক্টোবর যুব অধিকার পরিষদের নেতৃত্বে পূজামণ্ডপে আক্রমণ করার খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সেখানে ধরা পড়া যুবকেরা নিজেদের পরিচয় এবং তাঁদের দলের সঙ্গে জামায়াত ও বিএনপির সম্পৃক্ততার কথা জানিয়েছেন। যে ৮৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়েছে, এঁদের প্রায় সবাই বয়সে অত্যন্ত তরুণ, তাঁদের তেমন কোনো রাজনৈতিক পরিচয় জানা না গেলেও ছাত্রশিবির এবং ছাত্রদলের পদবঞ্চিতদের দিয়েই এই সংগঠনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাখা হবে— এমন কথা রাজনৈতিক মহলে আলোচনায় আছে।
নতুন দলের আত্মপ্রকাশের দিন প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তাঁকে নাকি দলীয় প্রধান হওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। তিনি বয়সের অজুহাতে তাতে সম্মত হননি।
গণতন্ত্র, অধিকার, ন্যায়বিচার ও জাতীয় স্বার্থকে নতুন দলের আদর্শ নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শের অনেক সংগঠন অতীতে এ ধরনের প্রগতিশীল মতাদর্শের কথা বলেই জনগণের কাছে হাজির হয়েছে। কিন্তু তাদের আদর্শ বোঝা গেছে যখন তারা ক্ষমতা লাভ করেছিল। ইতালির ফ্যাসিস্ট এবং জার্মানির নাৎসিবাদী পার্টি এর উদাহরণ। উভয় দলই সমাজতন্ত্রের নামে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
সুতরাং নামে কী হবে, কাজেই এই দলের পরিচয় কোথায় নির্ধারিত হবে, সেটি তার পূর্বপ্রস্তুতি থেকে এখনই বোঝা যাচ্ছে।
গণ অধিকার পরিষদ আসলে নামে নতুন হলেও অতীত অভিজ্ঞতা বলে যে প্রতিক্রিয়াশীলরা নানা কৌশলে গণতন্ত্রের সুযোগ গ্রহণ করলেও তাদের হাতে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, অধিকার ও জাতীয় স্বার্থ কখনো কোনো দেশে নিরাপদ থাকেনি। অভিজ্ঞতাবিহীন কিছু ব্যক্তি একটি দল গঠনে ঘোষণা দিলেই দেশের মানুষ সেই দলের পেছনে কাতারবন্দী হবে, তেমন আশা করা যায় না। অতীতে কেউ কেউ নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়ে সফল হতে পারেননি। এমনকি একসময়ের জনপ্রিয় ছাত্রনেতাও দল গঠন করে জনগণের সমর্থন না পেয়ে হাঁটুভাঙা ‘দ’- এর অবস্থায় আছেন। নুরুলের কপালে কী জোটে, তা-ই এখন দেখার অপেক্ষা।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট।
জামায়াত-বিএনপির সমর্থন, অর্থ ও নেতাকর্মীদের নিয়ে যে দলের আবির্ভাব, সেটি দ্বারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ইত্যাদি কতটা অর্জিত হবে, তা ২০০১-০৬ শাসনকালে অনেকটাই দেখা গেছে।
২৬ অক্টোবর, মঙ্গলবার দুপুরে পুরানা পল্টনের প্রিতম টাওয়ারে ‘গণ অধিকার পরিষদ’ নামে একটি নতুন দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। কদিন আগ থেকেই শোনা যাচ্ছিল ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছেন। অবশেষে সেটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। তবে সংগঠনের আহ্বায়কের দায়িত্ব নিয়েছেন রেজা কিবরিয়া। রেজা কিবরিয়ার অতীত রাজনৈতিক ভূমিকা তেমন নেই। তিনি সাবেক সফল অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে।
রেজা কিবরিয়া দীর্ঘকাল বিদেশে ছিলেন। দেশেও তাঁর আসা-যাওয়া ছিল। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি শাহ এ এম এস কিবরিয়া তাঁর নির্বাচনী এলাকা হবিগঞ্জের বৈদ্যেরবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে এক সভা শেষে জঙ্গিদের গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তৎকালীন জোট সরকার তাঁকে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় আনার ব্যাপারে হেলিকপ্টার দিয়ে সহযোগিতা না করায় অ্যাম্বুলেন্সযোগে হবিগঞ্জ থেকে শাহ কিবরিয়াকে ঢাকায় আনার পথে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। রেজা কিবরিয়া সেই সময় পিতা হত্যার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবাদ সভায় অংশ নেওয়ার মাধ্যমে পরিচিত হন। তিনি তখন সব মহলের ব্যাপক সহানুভূতি লাভ করেছিলেন।
সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র, সফল কূটনীতিবিদ ও এসকাপের (ESCAP) প্রধান নির্বাহী। ২০০৬ সালের নির্বাচনে শাহ এ এম এস কিবরিয়ার আসনে তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ১/১১-এর সরকারের সময় তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। সম্ভবত সে কারণে রেজা কিবরিয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগের বনিবনা আর সেভাবে হয়নি।
তারপর তাঁকে দেশে খুব একটা দেখা যায়নি। ২০১৮ সালে আকস্মিকভাবে তিনি গণফোরামে যোগ দেন। ড. কামাল হোসেনের বদান্যতায় তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। এ নিয়ে গণফোরামে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ড. রেজা কিবরিয়া পিতার পরিচয়ে সহানুভূতি পেলেও পরবর্তী সময়ে নানা কারণে তিনি বিতর্কিত হয়েছেন। এমনকি গণফোরামেও বেশি দিন টিকতে পারেননি। অবশেষে গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক হলেন। তবে রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ, পদ-পদবি পেতে আগ্রহী রেজা কিবরিয়ার এই অবস্থান কত দিন থাকবে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। নতুন দল গঠনে যেসব নেপথ্য শক্তি রয়েছে, তারা তাঁকে কত দিন রাখবে, সেটি নিশ্চিত নয়।
২০১৯ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটাবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত কেউ কেউ ছাত্র অধিকার আন্দোলনের নেতা নামে পরিচিতি পান। নুরুল হক নুর সেই আন্দোলনে তরুণদের কাছে ‘হিরো’ হয়ে ওঠেন। তবে তাঁর বক্তব্য ও আচার-আচরণ নিয়ে তরুণদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও ছিল। ওই আন্দোলনের ভাবমূর্তি নিয়েই নুরুল হক নুর ডাকসুর নির্বাচনে ভিপি পদে দাঁড়ান। ওই পদে ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল তাঁকে গোপনে সমর্থন করে। নিরাপদ সড়ক ও কোটাবিরোধী আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত করার গোপন চেষ্টা ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল করেছিল। নুরুল হক তার পুরস্কার হিসেবেই ডাকসুর ভিপি হওয়ার সুযোগ পান।
নুরুল হক একসময় ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন বলে শোনা যায়। কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তাঁর উত্থান ভিন্নভাবে হতে থাকে। তিনি তখন বিএনপি, জামায়াত, নাগরিক ঐক্যসহ আওয়ামী লীগবিরোধী বিভিন্ন দলের আনুকূল্য লাভ করতে থাকেন।
আমাদের দেশে একটি ধারণা প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়ে থাকে যে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত না হওয়ার কারণে নতুন নেতা তৈরি হতে পারছে না। জাতীয় রাজনীতিতেও সে কারণে যোগ্য নেতার আবির্ভাব ঘটছে না। এটি একটি সহজ-সরল মত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে জাতীয় রাজনীতির নেতা তৈরি হওয়ার জন্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনই একমাত্র উপায় নয়। এভাবে আকস্মিকভাবে নেতা তৈরি হওয়ার নজিরও খুব বেশি নেই। সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রসংগঠনের নেতার পরিচয়ে যাঁরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করছেন, তাঁদের বেশির ভাগের সঙ্গেই লেখাপড়ার সংযোগ নেই। ব্যতিক্রম খুবই কম। ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নেতা হলেই যে কেউ দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নেতা হবেন, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া খুবই কঠিন। তা ছাড়া, আন্দোলন-সংগ্রাম, দলের রাজনীতির নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় ছাড়া কেউ হঠাৎ করে ছাত্র সংসদের নেতা নির্বাচিত হলেই তিনি পরবর্তীকালে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিকশিত হওয়ার ধৈর্য ধারণ করবেন—এমন অভিজ্ঞতাও খুব বেশি দেখা যায় না। ছাত্র সংসদে নেতা নির্বাচিত হয়ে পরে রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে।
নুরুল হক ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর রাজনৈতিক আদর্শচর্চা, লেখাপড়ার পাশাপাশি দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য যে নিষ্ঠা, ত্যাগ ও সততার প্রমাণ রাখা প্রয়োজন ছিল, সেটি তাঁর ক্ষেত্রে খুব একটা দেখা যায়নি। উল্টো তাঁর পেছনে ছাত্রশিবির, ছাত্রদল এবং অতি বাম, অতি ডানেরা সমবেত হয়ে তাঁকে সঠিক পথচলায় বিভ্রান্ত করেছে। ডাকসুর ভিপি পদটি নুরুলের জন্য ব্যক্তিগতভাবে এটি ছিল বড় পাওয়া। কিন্তু দেশ ও জাতির আদর্শ তাঁর কাছে যতটা বিবেচিত হওয়া জরুরি ছিল, সেটা বোঝার অবস্থানে সম্ভবত নুরুলের ছিল না। তিনি অন্যের ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবেই ব্যাবহৃত হলেন কি না, সেটা ভবিষ্যৎই প্রমাণ করবে। তাঁর জন্যও একটি সিঁড়ি তৈরি হয়েছিল, যার যথাযথ ব্যবহারে তিনি সক্ষমতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
নুরুলের বক্তব্য এবং আদর্শেও কোনো সামঞ্জস্য কখনোই সেভাবে ছিল না। ছাত্রশিবির সম্পর্কেও তাঁর কোনো নেতিবাচক অবস্থান ছিল না। আবার ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারও করেছিলেন। আগাগোড়াই তিনি দোদুল্যমান চরিত্রের একজন ‘ছাত্রনেতা’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। এর পেছনে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আদর্শের কোনো ভিত্তি এর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
নুরুল হক নতুন সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারে জামায়াত ও বিএনপির সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ করছিলেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিদেশে অবস্থানরত জামায়াতের নেতারাই মূলত তাঁর দল গঠনে অর্থ সহায়তা করছেন বলেও খবর বেরিয়েছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যেহেতু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাই জামায়াত ও বিএনপি ছাত্র-যুবকদের সমর্থন লাভের জন্য নুরুল হকের উদ্যোগকে সমর্থন দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, পরবর্তী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জামায়াত-বিএনপিসহ আওয়ামীবিরোধী শক্তি নানা কৌশলে মাঠে থাকবে। সে ক্ষেত্রে রেজা কিবরিয়াকে সঙ্গে পাওয়ায় নুরুলকে নিয়ে অগ্রসর হওয়ার হিসাবটি জামায়াত-বিএনপির দিক থেকে বেশ সহজতর হয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলায় গণ অধিকার পরিষদের ব্যানারে ছাত্রশিবির এবং ছাত্রদলের নেতাদের নিয়ে যেসব কমিটি গঠিত হয়েছে, সেগুলোকেই এখন একত্র করে গণ অধিকার পরিষদ নামে একটি কেন্দ্রীয় সংগঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামে ২১ অক্টোবর যুব অধিকার পরিষদের নেতৃত্বে পূজামণ্ডপে আক্রমণ করার খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সেখানে ধরা পড়া যুবকেরা নিজেদের পরিচয় এবং তাঁদের দলের সঙ্গে জামায়াত ও বিএনপির সম্পৃক্ততার কথা জানিয়েছেন। যে ৮৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়েছে, এঁদের প্রায় সবাই বয়সে অত্যন্ত তরুণ, তাঁদের তেমন কোনো রাজনৈতিক পরিচয় জানা না গেলেও ছাত্রশিবির এবং ছাত্রদলের পদবঞ্চিতদের দিয়েই এই সংগঠনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাখা হবে— এমন কথা রাজনৈতিক মহলে আলোচনায় আছে।
নতুন দলের আত্মপ্রকাশের দিন প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তাঁকে নাকি দলীয় প্রধান হওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। তিনি বয়সের অজুহাতে তাতে সম্মত হননি।
গণতন্ত্র, অধিকার, ন্যায়বিচার ও জাতীয় স্বার্থকে নতুন দলের আদর্শ নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শের অনেক সংগঠন অতীতে এ ধরনের প্রগতিশীল মতাদর্শের কথা বলেই জনগণের কাছে হাজির হয়েছে। কিন্তু তাদের আদর্শ বোঝা গেছে যখন তারা ক্ষমতা লাভ করেছিল। ইতালির ফ্যাসিস্ট এবং জার্মানির নাৎসিবাদী পার্টি এর উদাহরণ। উভয় দলই সমাজতন্ত্রের নামে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
সুতরাং নামে কী হবে, কাজেই এই দলের পরিচয় কোথায় নির্ধারিত হবে, সেটি তার পূর্বপ্রস্তুতি থেকে এখনই বোঝা যাচ্ছে।
গণ অধিকার পরিষদ আসলে নামে নতুন হলেও অতীত অভিজ্ঞতা বলে যে প্রতিক্রিয়াশীলরা নানা কৌশলে গণতন্ত্রের সুযোগ গ্রহণ করলেও তাদের হাতে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, অধিকার ও জাতীয় স্বার্থ কখনো কোনো দেশে নিরাপদ থাকেনি। অভিজ্ঞতাবিহীন কিছু ব্যক্তি একটি দল গঠনে ঘোষণা দিলেই দেশের মানুষ সেই দলের পেছনে কাতারবন্দী হবে, তেমন আশা করা যায় না। অতীতে কেউ কেউ নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়ে সফল হতে পারেননি। এমনকি একসময়ের জনপ্রিয় ছাত্রনেতাও দল গঠন করে জনগণের সমর্থন না পেয়ে হাঁটুভাঙা ‘দ’- এর অবস্থায় আছেন। নুরুলের কপালে কী জোটে, তা-ই এখন দেখার অপেক্ষা।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট।
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
১১ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
১২ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
১২ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
১২ ঘণ্টা আগে