বিজন সাহা
ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়ার সঙ্গে মূলত ন্যাটোর ছায়া যুদ্ধ। এর আড়ালে যুদ্ধ চলছে অনেক ক্ষেত্রেই। বেশ কিছুদিন ধরে চীন বেইজিং থেকে ইউরোপ পর্যন্ত সিল্করুটের অনুরূপ এক নতুন পথ (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই) তৈরির কথা বলছে, যেখানে রাশিয়া পালন করবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যুক্তরাষ্ট্র এই পথের বিরোধিতা করে আসছে বিভিন্ন কারণে। ভারতও এই বিরোধিতায় সামিল হয়েছে, ঠিক যেমনটা ইউক্রেন নর্থ স্ট্রীম–২ এর বিরোধিতা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এতে কী লাভ? এই পথ না হলে চীনের সঙ্গে ইউরোপের যোগাযোগের মাধ্যম সমুদ্র পথই থাকবে। আর এ পথ যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সেদিক থেকে এই বিআরআই চীনকে ইউরোপের কাছে নিয়ে আসছে। এতে চীনের ওপর মার্কিন কর্তৃত্ব শিথিল হয়। তাই ইউক্রেনের যুদ্ধ বহুমুখী।
মুদ্রা নিয়েও আছে আরেক যুদ্ধ। যুদ্ধের প্রাথমিক ফল হিসেবে প্রথম ধাক্কাই লাগে রুশ মুদ্রা রুবলে। এ নিয়ে শুরুতে কড়াকড়ি আরোপ করা হলেও পরে তা শিথিল করা হয়। বলা হয়, এখন থেকে যে কেউ ইচ্ছামতো বিদেশি মুদ্রা কিনতে পারবে। তবে হাতে পাবে ১০ হাজার ডলার বা তার সমমানের ইউরো। বাকিটা নিতে হবে রুবলে। জ্বালানি তো আছে। গ্যাস বিক্রি থেকে এ বছর রাশিয়া অতিরিক্ত তিন শতাধিক বিলিয়ন ডলার আয় করবে। এরই মধ্যে রাশিয়া ডলারের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কমিয়ে এনেছে। তারা ডলার রিজার্ভের পরিমাণ মোট রিজার্ভের ৪০ থেকে ১৭ শতাংশে কমিয়ে এনেছে। শুধু তাই নয়, ডলার ও ইউরোতে লেনদেন বন্ধের পর এরা রুবলে তেল ও গ্যাস বিক্রির কথা ঘোষণা করেছে। আবার চীন ও ভারতের সঙ্গে ইউয়ান ও রুপিতে বাণিজ্য করার ঘোষণাও এসেছে। এতে একদিকে যেমন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়ানো যাবে, অন্যদিকে তেমনি সেটা হবে ডলারের ওপর এক বিরাট আঘাত। এটা করতে এরা ইতিমধ্যে রুবলকে সোনার সঙ্গে বেঁধে দিয়েছে। ফলে রুবল এক সময় শক্তিশালী মুদ্রাও হয়ে উঠতে পারে।
মনে রাখতে হবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ডলার ছিল আন্তর্জাতিক ব্যবসার একমাত্র মাধ্যম। এ থেকে যুক্তরাষ্ট্র বড় অঙ্কের কমিশন পেত। এটা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকেই সচল রাখত না। ডলার ছিল অন্য দেশের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির শক্তিশালী হাতিয়ার। এই বাজারে ভাগ বসাতে এল ইউরো। আর এর ফল হিসেবে ব্রেক্সিট প্রত্যক্ষ করছে বিশ্ব। দু-একটা ছোটখাটো ঘটনা বাদ দিলে এতদিন পর্যন্ত ডলারের ওপর বিশ্বাস হারানোর কারণ ঘটেনি। কিন্তু রাশিয়ার রিজার্ভ আটকে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ডলার সেই আস্থা হারিয়েছে। এখন অনেক দেশই নিজেদের ডলারের নাগপাশ থেকে বের করে আনার কথা ভাবছে। কাজটা সহজ হবে না। তবে করতে পারলে তা বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অনেকটাই খর্ব করবে।
নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত জনগণের সব উপার্জন, তার কলকারখানা, তার শিল্প, তার খনি—সবকিছু যখন কিছু লোকের হাতে চলে যায়, তারাই হয়ে ওঠে এ দেশের ভাগ্যবিধাতা। ইয়েলৎসিনের রাশিয়ায় তারাই ছিল সব ক্ষমতার অধিকারী। কথিত আছে, ২০০০ সালে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন এসব ধনকুবেরদের ডেকে বলেন, তাদের ব্যবসায় রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না, তারাও যেন রাষ্ট্রের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করে; তখন সে সময়ের রাশিয়ার সবচেয়ে বিত্তশালী খাদারকভস্কি পুতিনকে শুনিয়ে পেছন থেকে খুব সম্ভবত পতানিনকে বলেন, ‘তুমি প্রধানমন্ত্রী হও, আর আমি প্রেসিডেন্ট। এ কথা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন সেই সময়ের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান গেরাসেঙ্কো। এরপরই খাদারকভস্কি গ্রেপ্তার হন এবং ইউকস জাতীয়করণ হয়। তাঁর নামে মামলাটি কিন্তু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক ছিল।
এখানে বলে রাখি, নাভালনিও কিন্তু অর্থনৈতিক কারণেই সাজাপ্রাপ্ত। বাইরের প্রোপাগান্ডায় মনে হতে পারে, সে প্রচণ্ড জনপ্রিয় নেতা। বাস্তব সেটা বলে না। হাতেগোনা কয়েক শতাংশ সমর্থন আছে তাঁর। কিন্তু রাশিয়ার রাজনৈতিক আকাশে তিনি নক্ষত্র নন, বড়জোর ছোটখাটো উল্কা। ক্যারিশমাটিক, তবে প্রচণ্ড রকম জাতীয়তাবাদী। পশ্চিমা প্রোজেক্ট। নাভালনির ওপর বিষ প্রয়োগ নিয়ে পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ শেষ করে দিয়েছে। ইউক্রেনে যেমন উগ্র জাতীয়তাবাদীরা অপ্রাপ্তবয়স্কদের রাজনীতিতে টানছিল, নাভালনিও সে পথেই যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে আমার পরিচিত অনেক নাভালনি-সমর্থক ওই ঘটনার পর তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
যা হোক, খাদারকভস্কিকে আইনের আওতায় আনা ছিল ধনকুবেরদের প্রতি পুতিনের সিগন্যাল। যেহেতু ইয়েলৎসিনের হাত ধরেই ক্ষমতায় আসা, তিনি চেষ্টা করেছেন, সেই সময়ে গৃহীত আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে যারা বিত্তশালী হয়েছে, তাদের দিকে চোখ বন্ধ করে থাকতে। তবে একটাই শর্তে—তাঁরা রাজনৈতিক ব্যাপারে নাক গলাবে না। এরপরও এ দেশে ধনকুবেররা নির্বিঘ্নে কাজ করে গেছেন। অধিকাংশই এ দেশে আয় করলেও অর্থ রেখেছেন পশ্চিমা ব্যাংকে। তবে এই যুদ্ধের ফলে পশ্চিমা বিশ্ব তাদের সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করেছে। ফলে অনেকের বিশ্বাস ভবিষ্যতে রাশিয়ার রাজনীতি ধনকুবেরদের প্রভাব থেকে মুক্ত হবে। ২০১৪ সালের পর থেকেই এখানে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা হয় সোশ্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার। গত গ্রীষ্মে ৭ হাজার কিলোমিটার জার্নির সময় সেটা নিজের চোখে দেখেছি। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি চোখে পড়ার মতো। অনেক বছর হলো প্রতিটি বাচ্চার জন্ম দেওয়ার জন্য মায়েরা ভাল অঙ্কের অর্থ সাহায্য পাচ্ছে। অনেকেরই ধারণা এর পর থেকে এ দেশ আরও বেশি করে সমাজমুখী ও গণমুখী হবে। সেটা অবশ্যই সোভিয়েত ইউনিয়ন হবে না। তবে নব্বইয়ের দশকে যখন সোভিয়েত অর্জনগুলো ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছিল, এর পর থেকে সেই সময়ের অর্জনগুলোর অনেক কিছুই ফিরে আসবে। আমি আশাবাদী যে শিক্ষা ব্যবস্থা আবার সেই সোভিয়েত আমলের মতোই হবে। সে ব্যবস্থা সারা বিশ্বেই সমাদর পেয়েছিল। এখনও ফিনল্যান্ডে সেই শিক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়।
ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কী হবে? এ নিয়েও বিভিন্ন কথা হচ্ছে। রাশিয়া বলেছে, তারা ইউক্রেন দখল করবে না। সে দেশের সামরিক শক্তি খর্ব ও সেখানে বান্দেরার অনুসারীদের হাত থেকে মুক্ত করাই তার মিশন। দনবাসে যুদ্ধ চলছে। জাপারোঝিয়া, খেরসন—এসব এলাকায় নতুন প্রশাসন গঠিত হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রায় সমস্ত মুক্ত এলাকায় স্থানীয়রা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতাকা উত্তোলন করছে। কেন? মনে হয় এখনো সোভিয়েত অতীতই ১৫টি রিপাবলিকের অনেককেই এক করে। আর সোভিয়েত পতাকাই ছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ের প্রতীক। রেইখস্ট্যাগের ওপরে উত্তোলিত সেই লাল পতাকাই তাদের সাহস জোগায় নব্য ফাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে।
কিন্তু এর পর কী? এটাই আজ তাদের জীবন-মরণ প্রশ্ন। কারণ, তাদের ভয়—রুশ সৈন্য যদি ইউক্রেন ছেড়ে চলে যায়, তবে ইউরোপ বা অন্য কোথাও আশ্রয় নেওয়া বান্দেরার অনুসারীরা ফিরে এসে তাদের ওপর নতুন করে অত্যাচার চালাবে। কারণ, তারা দেখছে বুচা বা অন্যান্য শহরে, যেখানে জনগণ রুশদের কাছ থেকে ত্রাণ গ্রহণ করেছে, তাদের অনেকেই রুশ সেনা চলে যাওয়ার পর ইউক্রেন সেনাদের হাতে নিগৃহীত হয়েছে, অনেকে প্রাণও হারিয়েছে কোলাবরেশনের অভিযোগে। এসব ভিডিও ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেই প্রচার করা হয়েছে। তাই এখন রাশিয়ায় এ নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক চলছে।
তবে একটা বিষয় ঠিক। দনবাস মানে দানিয়েৎস্ক ও লুহানস্ক আর কখনোই ইউক্রেনে ফিরবে না। একদল চাইছে খারকভ থেকে শুরু করে ওদেসা পর্যন্ত সমস্ত দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে, যেখানে রুশপন্থীরা বরাবরই শক্তিশালী, সেখানে রাশিয়ার প্রতি লয়াল সরকার গঠন করতে। অনেকে মনে করে, সমস্ত ইউক্রেন বান্দেরামুক্ত করে ওদের হাতেই নিজেদের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেওয়া উচিত। তবে যেহেতু উত্তর-পশ্চিম ইউক্রেন সবসময়ই রুশবিরোধী তাই অনেকের ধারণা—ওই অঞ্চল ছেড়ে দেওয়াই ভালো হবে।
তাহলে? এ রকম মতও আছে যে, ইউক্রেন আসলে তিন অংশে বিভক্ত হবে—কিয়েভ, পলতাভা–এসব অংশ নিয়ে হবে ইউক্রেন; আর খারকভ থেকে ওদেসা পর্যন্ত এলাকা নিয়ে হবে মালাইয়া রাশিয়া (আসলে ঐতিহাসিক ভাবেই এর অস্তিত্ব ছিল)। আর লভভ, ইভান ফ্রাঙ্কো, জাকারপাতিয়া–এসব যাবে পোল্যান্ডের অধীনে। তবে এখানে অন্য প্রশ্ন আসতে পারে। পোল্যান্ড ন্যাটোর সদস্য হওয়ায় এসব অঞ্চলে ন্যাটোর ঘাঁটি স্থাপিত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার ভূমিকা কী হবে? ধরেই নেওয়া হয়ছে যে, রাশিয়া এ যুদ্ধে জিতবেই। কেন? রাশিয়ার হারার কোনো বিকল্প নেই। হারা মানে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে রুশ জাতি চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। হিটলার এই পরিকল্পনা নিয়েই এসেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। এই পরিকল্পনা থেকে পশ্চিমা বিশ্ব কখনোই সরে আসেনি। আর যুক্তরাষ্ট্রের সেই অভিজ্ঞতা তো আছেই। তিন শ বছর আগে যেমন ভারতীয়দের রিজার্ভেশনে পাঠিয়েছিল, এখন কেন রুশদের পারবে না। অন্তত এখানকার বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এ রকমটাই ভাবেন। তাই তাঁরা মনে করেন, যুদ্ধে রাশিয়ার হারার কোনো প্রশ্নই আসে না, এমনকি যদি সেটা চরম মূল্যের বিনিময়েও হয়।
চরম মূল্য আসলে কী? মস্কোর পক্ষ থেকে এরই মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধের কথাও উচ্চারণ করা হয়েছে। উচ্চারণ না করলেও এ বাস্তবতা সবারই জানা। এ আশঙ্কা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। প্রতিদিন ইউক্রেনে নতুন নতুন অস্ত্র আসছে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো থেকে। আগেই বলেছি রাশিয়াকে বিভিন্ন দিক থেকে ব্যস্ত রাখার পরিকল্পনার কথা। এরই মধ্যে বাল্টিকের দেশগুলো রাশিয়ার সঙ্গে কালিনিনগ্রাদের সংযোগকারী স্থলপথ বন্ধ করে দিতে চাইছে। এর মানে কালিনিনগ্রাদ অবরোধ। এটা রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে উত্তেজনা বাড়াবে। জেলেনস্কি এ ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করছেন। আসলে তিনি তো একজন অভিনেতা। আর একজন অভিনেতার মতোই তিনি তাঁর ভূমিকা পালন করছেন। যখন যে রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে কথা বলছেন, অবস্থান নিচ্ছেন তাঁর মতো করে। কারণ তিনি জানেন, যুদ্ধ শেষ মানেই তাঁর ভূমিকা শেষ। অনেকের ধারণা জেলেনস্কির এ অভিনেতা মনস্তত্ত্বই আসলে দেশটির মানুষের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটা জিনিস খেয়াল করলে দেখবেন, যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের সময় তাদের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে এমন নিষেধাজ্ঞাগুলো এড়িয়ে চলছে। যেমন, সারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ইউরেনিয়াম এই তালিকায় কখনোই আসেনি। কিন্তু ইউরোপ সেটা করছে ভালোমন্দ কোনো দিকে না তাকিয়ে। এর অর্থ ইউরোপ আত্মরক্ষার ইনস্টিংকট হারিয়ে ফেলেছে। এটাই বিপজ্জনক। কারণ, যখন কেউ আত্মরক্ষার স্বাভাবিক প্রবণতা হারিয়ে ফেলে, সে তখন যেকোনো আত্মঘাতী কাজ করতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান বলেছেন, তিনি ডিপ্লোম্যাসি নয়, যুদ্ধের মাঠেই এই সমস্যার সমাধান চান। ওদিকে পেন্টাগনের মুখপাত্র বলেছেন, তিনি চান ইউক্রেনের মাটিতে রুশ বাহিনীর পরাজয় দেখতে। এর আগেও বাইডেন পুতিনকে খুনি বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীও’ বললেন। অথচ এই বাইডেনের হাত হাজার হাজার সার্ব ও আরবের রক্তে রঞ্জিত। অবশ্য শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বারাক ওবামার হাতেও কম খুন নেই। কিন্তু কথা হলো দেশের নেতৃত্বের এ ধরনের ভাষা কূটনীতির পথ বন্ধ করে দেয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পুতিন নিজে বা রাশিয়ার কোনো উচ্চপদস্থ নেতা কোনো দেশের কোনো নেতা সম্পর্কে এমন ভাষা ব্যবহার করেননি। আসলে ইউক্রেনের এই যুদ্ধ আসলে রাশিয়ান রুলেটের মতো।
অনেক আগে বিসমার্ক বলেছিলেন, ‘আমি হাজারটা উপায় জানি রুশ ভালুককে তার গুহা থেকে বের করে আনার, কিন্তু তাকে গুহায় ফিরিয়ে নেওয়ার একটা উপায়ও আমা জানা নেই।’ মনে হয় এই কথা এখন আর কেউই মনে রাখে না। ফলে বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রায়ই যুদ্ধংদেহী স্লোগান দিচ্ছে। তবে এখানে অনেকের ধারণা পেন্টাগনে এখনো কিছু লোক আছে, যারা রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের ভয়াবহতা বুঝতে পারে। এটাই হয়তো এবারের মতো পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবে।
গত ডিসেম্বরে রাশিয়া আমেরিকার কাছে তার নিরাপত্তা বিষয়ে কিছু দাবি পেশ করে। ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানোর মাধ্যমে এর জবাব দিয়েছিল ওয়াশিংটন। তখন নর্থ স্ট্রিম-২ নিয়ে জার্মানির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঝামেলা চলছিল। যুদ্ধের কয়েক দিনের মধ্যেই যখন জার্মানি কার্যত নর্থ স্ট্রিম-২ এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল, ইউক্রেন আক্রমণ করে পুতিন বিশ্বের অন্যতম ‘জননন্দিত’ নেতা থেকে ‘জননিন্দিত’ ব্যক্তিতে পরিণত হলেন। দুই স্লাভিয়ান দেশের মানুষ আরও বেশি দূরে সরে গেল। আর সেটা হলো যুক্তরাস্ট্রের পক্ষ থেকে একটি গুলিও খরচ না করে। ভাবা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধটা তাড়াতাড়ি শেষ করার পদক্ষেপ নেবে। সেটা হলো না। তখন যুদ্ধের পক্ষে এ দেশে জনসমর্থন ছিল ৫০ শতাংশের একটু বেশি। যদিও দনবাসকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে সমর্থন আরও বেশি ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র গেল উত্তেজনা বাড়ানোর পথে। তাদের ধারণা ছিল, এতে মানুষ পুতিনের বিরুদ্ধে নামবে। বাইডেন এমনকি পোল্যান্ডে এসে রুশ জনগণের প্রতি সেই আহ্বানও জানালেন। ফল হলো উল্টো। জনমত যুদ্ধের পক্ষেই গেল। তবে এটা ঠিক, এই যুদ্ধের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ডে, এমনকি ন্যাটোর দেশগুলোতেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জনগণ এক হয়ে দাঁড়িয়েছে রাশিয়ার বিপক্ষে। অনেক দিন পর ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিক দল দুটো কোন কোন বিষয়ে একমত হয়, আর বরিস জনসন পতনের হাত থেকে রক্ষা পান।
কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে, ইউরোপের মানুষ ততই তাদের সরকারগুলোর ভূমিকা বুঝতে পারছে। বিভিন্ন জায়গায় ফ্যাসিবাদবিরোধী মিছিল হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে রুশদের পক্ষেও। ছোট, কিন্তু ছোট থেকেই তো বড় হয়। রাশিয়াকে ভাগ করাই কি পশ্চিমা বিশ্বের উদ্দেশ্য? মনে হয় না। অন্তত এখন তো নয়ই। কারণ, এখন তারা রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করছে পরে চীনকে ধরবে বলে। এখন রাশিয়াকে ভাগ করলে সাইবেরিয়া যে চীনের দখলে যাবে না, সে গ্যারান্টি নেই। তেমনটি হলে চীন আরও শক্তিশালী হবে। অন্যদিকে যদি রাশিয়া পরাজিত হয় চীনের বিআরআই পরিকল্পনাও ভেস্তে যাবে। ফলে চীন রাশিয়ার পরাজয়ে উৎসাহী নয়।
ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়ার সঙ্গে মূলত ন্যাটোর ছায়া যুদ্ধ। এর আড়ালে যুদ্ধ চলছে অনেক ক্ষেত্রেই। বেশ কিছুদিন ধরে চীন বেইজিং থেকে ইউরোপ পর্যন্ত সিল্করুটের অনুরূপ এক নতুন পথ (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই) তৈরির কথা বলছে, যেখানে রাশিয়া পালন করবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যুক্তরাষ্ট্র এই পথের বিরোধিতা করে আসছে বিভিন্ন কারণে। ভারতও এই বিরোধিতায় সামিল হয়েছে, ঠিক যেমনটা ইউক্রেন নর্থ স্ট্রীম–২ এর বিরোধিতা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এতে কী লাভ? এই পথ না হলে চীনের সঙ্গে ইউরোপের যোগাযোগের মাধ্যম সমুদ্র পথই থাকবে। আর এ পথ যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সেদিক থেকে এই বিআরআই চীনকে ইউরোপের কাছে নিয়ে আসছে। এতে চীনের ওপর মার্কিন কর্তৃত্ব শিথিল হয়। তাই ইউক্রেনের যুদ্ধ বহুমুখী।
মুদ্রা নিয়েও আছে আরেক যুদ্ধ। যুদ্ধের প্রাথমিক ফল হিসেবে প্রথম ধাক্কাই লাগে রুশ মুদ্রা রুবলে। এ নিয়ে শুরুতে কড়াকড়ি আরোপ করা হলেও পরে তা শিথিল করা হয়। বলা হয়, এখন থেকে যে কেউ ইচ্ছামতো বিদেশি মুদ্রা কিনতে পারবে। তবে হাতে পাবে ১০ হাজার ডলার বা তার সমমানের ইউরো। বাকিটা নিতে হবে রুবলে। জ্বালানি তো আছে। গ্যাস বিক্রি থেকে এ বছর রাশিয়া অতিরিক্ত তিন শতাধিক বিলিয়ন ডলার আয় করবে। এরই মধ্যে রাশিয়া ডলারের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কমিয়ে এনেছে। তারা ডলার রিজার্ভের পরিমাণ মোট রিজার্ভের ৪০ থেকে ১৭ শতাংশে কমিয়ে এনেছে। শুধু তাই নয়, ডলার ও ইউরোতে লেনদেন বন্ধের পর এরা রুবলে তেল ও গ্যাস বিক্রির কথা ঘোষণা করেছে। আবার চীন ও ভারতের সঙ্গে ইউয়ান ও রুপিতে বাণিজ্য করার ঘোষণাও এসেছে। এতে একদিকে যেমন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়ানো যাবে, অন্যদিকে তেমনি সেটা হবে ডলারের ওপর এক বিরাট আঘাত। এটা করতে এরা ইতিমধ্যে রুবলকে সোনার সঙ্গে বেঁধে দিয়েছে। ফলে রুবল এক সময় শক্তিশালী মুদ্রাও হয়ে উঠতে পারে।
মনে রাখতে হবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ডলার ছিল আন্তর্জাতিক ব্যবসার একমাত্র মাধ্যম। এ থেকে যুক্তরাষ্ট্র বড় অঙ্কের কমিশন পেত। এটা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকেই সচল রাখত না। ডলার ছিল অন্য দেশের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির শক্তিশালী হাতিয়ার। এই বাজারে ভাগ বসাতে এল ইউরো। আর এর ফল হিসেবে ব্রেক্সিট প্রত্যক্ষ করছে বিশ্ব। দু-একটা ছোটখাটো ঘটনা বাদ দিলে এতদিন পর্যন্ত ডলারের ওপর বিশ্বাস হারানোর কারণ ঘটেনি। কিন্তু রাশিয়ার রিজার্ভ আটকে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ডলার সেই আস্থা হারিয়েছে। এখন অনেক দেশই নিজেদের ডলারের নাগপাশ থেকে বের করে আনার কথা ভাবছে। কাজটা সহজ হবে না। তবে করতে পারলে তা বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অনেকটাই খর্ব করবে।
নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত জনগণের সব উপার্জন, তার কলকারখানা, তার শিল্প, তার খনি—সবকিছু যখন কিছু লোকের হাতে চলে যায়, তারাই হয়ে ওঠে এ দেশের ভাগ্যবিধাতা। ইয়েলৎসিনের রাশিয়ায় তারাই ছিল সব ক্ষমতার অধিকারী। কথিত আছে, ২০০০ সালে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন এসব ধনকুবেরদের ডেকে বলেন, তাদের ব্যবসায় রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না, তারাও যেন রাষ্ট্রের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করে; তখন সে সময়ের রাশিয়ার সবচেয়ে বিত্তশালী খাদারকভস্কি পুতিনকে শুনিয়ে পেছন থেকে খুব সম্ভবত পতানিনকে বলেন, ‘তুমি প্রধানমন্ত্রী হও, আর আমি প্রেসিডেন্ট। এ কথা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন সেই সময়ের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান গেরাসেঙ্কো। এরপরই খাদারকভস্কি গ্রেপ্তার হন এবং ইউকস জাতীয়করণ হয়। তাঁর নামে মামলাটি কিন্তু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক ছিল।
এখানে বলে রাখি, নাভালনিও কিন্তু অর্থনৈতিক কারণেই সাজাপ্রাপ্ত। বাইরের প্রোপাগান্ডায় মনে হতে পারে, সে প্রচণ্ড জনপ্রিয় নেতা। বাস্তব সেটা বলে না। হাতেগোনা কয়েক শতাংশ সমর্থন আছে তাঁর। কিন্তু রাশিয়ার রাজনৈতিক আকাশে তিনি নক্ষত্র নন, বড়জোর ছোটখাটো উল্কা। ক্যারিশমাটিক, তবে প্রচণ্ড রকম জাতীয়তাবাদী। পশ্চিমা প্রোজেক্ট। নাভালনির ওপর বিষ প্রয়োগ নিয়ে পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ শেষ করে দিয়েছে। ইউক্রেনে যেমন উগ্র জাতীয়তাবাদীরা অপ্রাপ্তবয়স্কদের রাজনীতিতে টানছিল, নাভালনিও সে পথেই যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে আমার পরিচিত অনেক নাভালনি-সমর্থক ওই ঘটনার পর তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
যা হোক, খাদারকভস্কিকে আইনের আওতায় আনা ছিল ধনকুবেরদের প্রতি পুতিনের সিগন্যাল। যেহেতু ইয়েলৎসিনের হাত ধরেই ক্ষমতায় আসা, তিনি চেষ্টা করেছেন, সেই সময়ে গৃহীত আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে যারা বিত্তশালী হয়েছে, তাদের দিকে চোখ বন্ধ করে থাকতে। তবে একটাই শর্তে—তাঁরা রাজনৈতিক ব্যাপারে নাক গলাবে না। এরপরও এ দেশে ধনকুবেররা নির্বিঘ্নে কাজ করে গেছেন। অধিকাংশই এ দেশে আয় করলেও অর্থ রেখেছেন পশ্চিমা ব্যাংকে। তবে এই যুদ্ধের ফলে পশ্চিমা বিশ্ব তাদের সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করেছে। ফলে অনেকের বিশ্বাস ভবিষ্যতে রাশিয়ার রাজনীতি ধনকুবেরদের প্রভাব থেকে মুক্ত হবে। ২০১৪ সালের পর থেকেই এখানে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা হয় সোশ্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার। গত গ্রীষ্মে ৭ হাজার কিলোমিটার জার্নির সময় সেটা নিজের চোখে দেখেছি। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি চোখে পড়ার মতো। অনেক বছর হলো প্রতিটি বাচ্চার জন্ম দেওয়ার জন্য মায়েরা ভাল অঙ্কের অর্থ সাহায্য পাচ্ছে। অনেকেরই ধারণা এর পর থেকে এ দেশ আরও বেশি করে সমাজমুখী ও গণমুখী হবে। সেটা অবশ্যই সোভিয়েত ইউনিয়ন হবে না। তবে নব্বইয়ের দশকে যখন সোভিয়েত অর্জনগুলো ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছিল, এর পর থেকে সেই সময়ের অর্জনগুলোর অনেক কিছুই ফিরে আসবে। আমি আশাবাদী যে শিক্ষা ব্যবস্থা আবার সেই সোভিয়েত আমলের মতোই হবে। সে ব্যবস্থা সারা বিশ্বেই সমাদর পেয়েছিল। এখনও ফিনল্যান্ডে সেই শিক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়।
ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কী হবে? এ নিয়েও বিভিন্ন কথা হচ্ছে। রাশিয়া বলেছে, তারা ইউক্রেন দখল করবে না। সে দেশের সামরিক শক্তি খর্ব ও সেখানে বান্দেরার অনুসারীদের হাত থেকে মুক্ত করাই তার মিশন। দনবাসে যুদ্ধ চলছে। জাপারোঝিয়া, খেরসন—এসব এলাকায় নতুন প্রশাসন গঠিত হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রায় সমস্ত মুক্ত এলাকায় স্থানীয়রা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতাকা উত্তোলন করছে। কেন? মনে হয় এখনো সোভিয়েত অতীতই ১৫টি রিপাবলিকের অনেককেই এক করে। আর সোভিয়েত পতাকাই ছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ের প্রতীক। রেইখস্ট্যাগের ওপরে উত্তোলিত সেই লাল পতাকাই তাদের সাহস জোগায় নব্য ফাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে।
কিন্তু এর পর কী? এটাই আজ তাদের জীবন-মরণ প্রশ্ন। কারণ, তাদের ভয়—রুশ সৈন্য যদি ইউক্রেন ছেড়ে চলে যায়, তবে ইউরোপ বা অন্য কোথাও আশ্রয় নেওয়া বান্দেরার অনুসারীরা ফিরে এসে তাদের ওপর নতুন করে অত্যাচার চালাবে। কারণ, তারা দেখছে বুচা বা অন্যান্য শহরে, যেখানে জনগণ রুশদের কাছ থেকে ত্রাণ গ্রহণ করেছে, তাদের অনেকেই রুশ সেনা চলে যাওয়ার পর ইউক্রেন সেনাদের হাতে নিগৃহীত হয়েছে, অনেকে প্রাণও হারিয়েছে কোলাবরেশনের অভিযোগে। এসব ভিডিও ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেই প্রচার করা হয়েছে। তাই এখন রাশিয়ায় এ নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক চলছে।
তবে একটা বিষয় ঠিক। দনবাস মানে দানিয়েৎস্ক ও লুহানস্ক আর কখনোই ইউক্রেনে ফিরবে না। একদল চাইছে খারকভ থেকে শুরু করে ওদেসা পর্যন্ত সমস্ত দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে, যেখানে রুশপন্থীরা বরাবরই শক্তিশালী, সেখানে রাশিয়ার প্রতি লয়াল সরকার গঠন করতে। অনেকে মনে করে, সমস্ত ইউক্রেন বান্দেরামুক্ত করে ওদের হাতেই নিজেদের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেওয়া উচিত। তবে যেহেতু উত্তর-পশ্চিম ইউক্রেন সবসময়ই রুশবিরোধী তাই অনেকের ধারণা—ওই অঞ্চল ছেড়ে দেওয়াই ভালো হবে।
তাহলে? এ রকম মতও আছে যে, ইউক্রেন আসলে তিন অংশে বিভক্ত হবে—কিয়েভ, পলতাভা–এসব অংশ নিয়ে হবে ইউক্রেন; আর খারকভ থেকে ওদেসা পর্যন্ত এলাকা নিয়ে হবে মালাইয়া রাশিয়া (আসলে ঐতিহাসিক ভাবেই এর অস্তিত্ব ছিল)। আর লভভ, ইভান ফ্রাঙ্কো, জাকারপাতিয়া–এসব যাবে পোল্যান্ডের অধীনে। তবে এখানে অন্য প্রশ্ন আসতে পারে। পোল্যান্ড ন্যাটোর সদস্য হওয়ায় এসব অঞ্চলে ন্যাটোর ঘাঁটি স্থাপিত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার ভূমিকা কী হবে? ধরেই নেওয়া হয়ছে যে, রাশিয়া এ যুদ্ধে জিতবেই। কেন? রাশিয়ার হারার কোনো বিকল্প নেই। হারা মানে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে রুশ জাতি চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। হিটলার এই পরিকল্পনা নিয়েই এসেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। এই পরিকল্পনা থেকে পশ্চিমা বিশ্ব কখনোই সরে আসেনি। আর যুক্তরাষ্ট্রের সেই অভিজ্ঞতা তো আছেই। তিন শ বছর আগে যেমন ভারতীয়দের রিজার্ভেশনে পাঠিয়েছিল, এখন কেন রুশদের পারবে না। অন্তত এখানকার বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এ রকমটাই ভাবেন। তাই তাঁরা মনে করেন, যুদ্ধে রাশিয়ার হারার কোনো প্রশ্নই আসে না, এমনকি যদি সেটা চরম মূল্যের বিনিময়েও হয়।
চরম মূল্য আসলে কী? মস্কোর পক্ষ থেকে এরই মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধের কথাও উচ্চারণ করা হয়েছে। উচ্চারণ না করলেও এ বাস্তবতা সবারই জানা। এ আশঙ্কা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। প্রতিদিন ইউক্রেনে নতুন নতুন অস্ত্র আসছে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো থেকে। আগেই বলেছি রাশিয়াকে বিভিন্ন দিক থেকে ব্যস্ত রাখার পরিকল্পনার কথা। এরই মধ্যে বাল্টিকের দেশগুলো রাশিয়ার সঙ্গে কালিনিনগ্রাদের সংযোগকারী স্থলপথ বন্ধ করে দিতে চাইছে। এর মানে কালিনিনগ্রাদ অবরোধ। এটা রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে উত্তেজনা বাড়াবে। জেলেনস্কি এ ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করছেন। আসলে তিনি তো একজন অভিনেতা। আর একজন অভিনেতার মতোই তিনি তাঁর ভূমিকা পালন করছেন। যখন যে রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে কথা বলছেন, অবস্থান নিচ্ছেন তাঁর মতো করে। কারণ তিনি জানেন, যুদ্ধ শেষ মানেই তাঁর ভূমিকা শেষ। অনেকের ধারণা জেলেনস্কির এ অভিনেতা মনস্তত্ত্বই আসলে দেশটির মানুষের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটা জিনিস খেয়াল করলে দেখবেন, যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের সময় তাদের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে এমন নিষেধাজ্ঞাগুলো এড়িয়ে চলছে। যেমন, সারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ইউরেনিয়াম এই তালিকায় কখনোই আসেনি। কিন্তু ইউরোপ সেটা করছে ভালোমন্দ কোনো দিকে না তাকিয়ে। এর অর্থ ইউরোপ আত্মরক্ষার ইনস্টিংকট হারিয়ে ফেলেছে। এটাই বিপজ্জনক। কারণ, যখন কেউ আত্মরক্ষার স্বাভাবিক প্রবণতা হারিয়ে ফেলে, সে তখন যেকোনো আত্মঘাতী কাজ করতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান বলেছেন, তিনি ডিপ্লোম্যাসি নয়, যুদ্ধের মাঠেই এই সমস্যার সমাধান চান। ওদিকে পেন্টাগনের মুখপাত্র বলেছেন, তিনি চান ইউক্রেনের মাটিতে রুশ বাহিনীর পরাজয় দেখতে। এর আগেও বাইডেন পুতিনকে খুনি বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীও’ বললেন। অথচ এই বাইডেনের হাত হাজার হাজার সার্ব ও আরবের রক্তে রঞ্জিত। অবশ্য শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বারাক ওবামার হাতেও কম খুন নেই। কিন্তু কথা হলো দেশের নেতৃত্বের এ ধরনের ভাষা কূটনীতির পথ বন্ধ করে দেয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পুতিন নিজে বা রাশিয়ার কোনো উচ্চপদস্থ নেতা কোনো দেশের কোনো নেতা সম্পর্কে এমন ভাষা ব্যবহার করেননি। আসলে ইউক্রেনের এই যুদ্ধ আসলে রাশিয়ান রুলেটের মতো।
অনেক আগে বিসমার্ক বলেছিলেন, ‘আমি হাজারটা উপায় জানি রুশ ভালুককে তার গুহা থেকে বের করে আনার, কিন্তু তাকে গুহায় ফিরিয়ে নেওয়ার একটা উপায়ও আমা জানা নেই।’ মনে হয় এই কথা এখন আর কেউই মনে রাখে না। ফলে বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রায়ই যুদ্ধংদেহী স্লোগান দিচ্ছে। তবে এখানে অনেকের ধারণা পেন্টাগনে এখনো কিছু লোক আছে, যারা রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের ভয়াবহতা বুঝতে পারে। এটাই হয়তো এবারের মতো পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবে।
গত ডিসেম্বরে রাশিয়া আমেরিকার কাছে তার নিরাপত্তা বিষয়ে কিছু দাবি পেশ করে। ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানোর মাধ্যমে এর জবাব দিয়েছিল ওয়াশিংটন। তখন নর্থ স্ট্রিম-২ নিয়ে জার্মানির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঝামেলা চলছিল। যুদ্ধের কয়েক দিনের মধ্যেই যখন জার্মানি কার্যত নর্থ স্ট্রিম-২ এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল, ইউক্রেন আক্রমণ করে পুতিন বিশ্বের অন্যতম ‘জননন্দিত’ নেতা থেকে ‘জননিন্দিত’ ব্যক্তিতে পরিণত হলেন। দুই স্লাভিয়ান দেশের মানুষ আরও বেশি দূরে সরে গেল। আর সেটা হলো যুক্তরাস্ট্রের পক্ষ থেকে একটি গুলিও খরচ না করে। ভাবা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধটা তাড়াতাড়ি শেষ করার পদক্ষেপ নেবে। সেটা হলো না। তখন যুদ্ধের পক্ষে এ দেশে জনসমর্থন ছিল ৫০ শতাংশের একটু বেশি। যদিও দনবাসকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে সমর্থন আরও বেশি ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র গেল উত্তেজনা বাড়ানোর পথে। তাদের ধারণা ছিল, এতে মানুষ পুতিনের বিরুদ্ধে নামবে। বাইডেন এমনকি পোল্যান্ডে এসে রুশ জনগণের প্রতি সেই আহ্বানও জানালেন। ফল হলো উল্টো। জনমত যুদ্ধের পক্ষেই গেল। তবে এটা ঠিক, এই যুদ্ধের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ডে, এমনকি ন্যাটোর দেশগুলোতেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জনগণ এক হয়ে দাঁড়িয়েছে রাশিয়ার বিপক্ষে। অনেক দিন পর ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিক দল দুটো কোন কোন বিষয়ে একমত হয়, আর বরিস জনসন পতনের হাত থেকে রক্ষা পান।
কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে, ইউরোপের মানুষ ততই তাদের সরকারগুলোর ভূমিকা বুঝতে পারছে। বিভিন্ন জায়গায় ফ্যাসিবাদবিরোধী মিছিল হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে রুশদের পক্ষেও। ছোট, কিন্তু ছোট থেকেই তো বড় হয়। রাশিয়াকে ভাগ করাই কি পশ্চিমা বিশ্বের উদ্দেশ্য? মনে হয় না। অন্তত এখন তো নয়ই। কারণ, এখন তারা রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করছে পরে চীনকে ধরবে বলে। এখন রাশিয়াকে ভাগ করলে সাইবেরিয়া যে চীনের দখলে যাবে না, সে গ্যারান্টি নেই। তেমনটি হলে চীন আরও শক্তিশালী হবে। অন্যদিকে যদি রাশিয়া পরাজিত হয় চীনের বিআরআই পরিকল্পনাও ভেস্তে যাবে। ফলে চীন রাশিয়ার পরাজয়ে উৎসাহী নয়।
শেখ হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে এ দেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে শাসন করেছে। মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ কনসেপ্ট। এটার সবচেয়ে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা হলো, এটা একটা গড়, যেটা স্বল্পসংখ্যক ধনী এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন-মধ্যবিত্ত
১ দিন আগেআমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীকে জলবায়ু-বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’-এর ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
১ দিন আগেআমেরিকার ১৩২ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম মেয়াদে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ট্রাম্প।
১ দিন আগেজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড্ড কষ্ট বুকে নিয়েই ‘সব শালারা বাটপার’ স্লোগানটি দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা দ্বিতীয় ক্যাম্পাস পাচ্ছেন না। ঠিকাদারেরা ভেলকিবাজি করছেন।ক্যাম্পাসের জন্য জমিও অধিগ্রহণ করা হয়নি।
১ দিন আগে