বিজন সাহা
যুদ্ধ চলছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। না না, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, সেই অর্থে বিশ্বযুদ্ধ এখনো শুরু হয়নি। কিন্তু সারা বিশ্ব যেভাবে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে, এই যুদ্ধের তাপ, সত্যি কথা বললে শীতল স্পর্শ অনুভব করছে, তাতে একে বিশ্বযুদ্ধ বললে ভুল বলা হবে বলে মনে হয় না। দেশে দেশে প্রায় প্রতিটি রান্না ঘরে মানুষ টের পাচ্ছে এই যুদ্ধের অগ্নি স্ফুলিঙ্গ। তেল-গ্যাস থেকে শুরু করে খাদ্য পর্যন্ত; সবাই মিছিল করে বলছে, তারাও চায় ন্যায্য মূল্য, এই ভোগবাদী বিশ্বে তারাও চায় তাদের সঠিক মূল্যায়ন।
যদিও অনেকেই ইউক্রেনের যুদ্ধের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও পরবর্তী রাজনীতির তুলনা করাটা ভালো চোখে দেখেন না। তবুও আমার মনে হয় বর্তমান ইউক্রেনকে, এর রাজনীতিকে বুঝতে হলে তুলনাটা মোটেই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বরং ঘটনাগুলো বুঝতে সাহায্য করবে। প্রাকৃতিক পরিবর্তনগুলো যেমন কিছু কিছু সমীকরণের সাধারণ সমাধান দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়, আর প্রতিটি বিশেষ অবস্থা ব্যাখ্যার জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ ইনিশিয়াল ও বাউন্ডারি কন্ডিশন আরোপ করতে হয়, এখানেও তাই।
সব বিশেষ সমস্যার সমাধান থাকে না। তবে সাধারণ সমাধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়—এমন সমাধান প্রাকৃতিক বিবর্তনের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে না। তবে এও ঠিক, প্রতিটি মানুষই নিজের অবস্থাটা বিশেষভাবে দেখতে চায়। সে নিজেকে দশজনের চেয়ে আলাদা বলে ভাবতেই তৃপ্তি বোধ করে। তাই অনেকেই যে এ ধরনের তুলনায় বিব্রত বোধ করবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এখানে একটা কথা বলা দরকার যে, মূল যুদ্ধটা বর্তমানে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের হলেও এটা আসলে যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপের বাজার দখলের যুদ্ধ। আর সঠিক করে বলতে গেলে রাশিয়া ও জার্মানি যাতে একত্রিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারে, সেই পরিকল্পনার অংশ এটা। কারণ ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানি হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের একজন। সে যদি রাশিয়া থেকে স্বল্প মূল্যে তেল ও গ্যাস পায়, তাহলে তার পণ্য বিশ্ববাজারে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে।
অন্যদিকে জার্মানির সঙ্গে সুসম্পর্ক হলে রাশিয়া তার তেল ও গ্যাসের জন্য পাবে স্থিতিশীল বাজার। স্বাভাবিকভাবেই তা সামরিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শত্রু রাশিয়াকে আরও শক্তিশালী করবে। যদি এই দুই দেশের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি করা যায়, তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়। তবে পশ্চিমা প্রোপাগান্ডায় এসব নিয়ে কোনো লেখা দেখা যাবে না। সেখানে আপনি পাবেন ‘পুতিন হটাও ইউক্রেন বাঁচাও’ নামে এক জিহাদের আওয়াজ। হ্যাঁ, জিহাদ। কারণ, সেই ১৯৮৮ সালে অর্থোডক্স খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণের পর থেকে বিভিন্ন সময় পশ্চিমারা দল বেঁধে রাশিয়া আক্রমণ করেছে। নেপোলিয়ন যখন রাশিয়া আক্রমণ করেন, তাঁর সঙ্গে ছিল অধিকৃত সমগ্র ইউরোপ। একই ঘটনা ঘটেছিল হিটলারের জার্মানির রাশিয়া আক্রমণের সময়েও। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। সরাসরি অংশ না নিলেও এবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে এক হয়েছে সমগ্র ইউরোপ, সঙ্গে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ। যুদ্ধের বিভিন্ন কারণ নিয়ে এর আগে জ্বলদর্চি পত্রিকায় ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায়’ শীর্ষক লেখায় আমি লিখেছি।
প্রায়ই যে কথাটা শোনা যায়, তা হলো ইউক্রেন দেশটার জন্ম কবে? ১৯৪৭ সালের আগে যেমন পাকিস্তানের অস্তিত্ব ছিল না, ঠিক তেমনি ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের আগে ইউক্রেনের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তার মানে এই নয় যে, সেখানে কেউ বাস করত না। হাজার হাজার বছর ধরে এখানে লোক বাস করছে।
তবে নবম শতকে নভগোরাদের রাজা রিউরিক কর্তৃক কিয়েভ কেন্দ্রিক রুশের (সঠিকভাবে বললে রুছ) জন্মের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নতুন পথযাত্রা। কিয়েভেই এ দেশ খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে। এর পর তারা ছড়িয়ে পড়ে বর্তমান রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। শেষ পর্যন্ত ১১৪৭ সালে রিউরিকের উত্তরসূরি ইউরি দলগোরুকির প্রতিষ্ঠিত মস্কভা বা মস্কোই সবাইকে নিজ পতাকাতলে নিয়ে আসে। এই মস্কো ও পরে সাঙ্কত পিতেরবুরগের (সেন্ট পিটার্সবার্গ) জারদের হাতেই জন্ম নেয় বর্তমান ইউক্রেনের বিভিন্ন শহর। রুশ সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে ইউক্রেন পিপলস রিপাবলিক নামে এক অটনোমাস রাষ্ট্র জন্ম নেয়। তবে সে বছরের ডিসেম্বর মাসেই তা নিজেকে সোভিয়েত হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯১৮ সালে ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধের পর সেখানে সোভিয়েত রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আত্মপ্রকাশ করে। এর প্রথম অংশগ্রহণকারী প্রজাতন্ত্রগুলো হলো—রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশিয়া, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া ও জর্জিয়া।
সে সময় লেনিন রাশিয়ার এক বিশাল ভূখণ্ড ইউক্রেনকে দান করেন। পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে স্তালিন পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও রুমানিয়ার কিছু কিছু অংশ ইউক্রেনের সঙ্গে যোগ করেন। ১৯৫৪ সালে খ্রুশেভ (ক্রুশ্চেভ) ক্রিমিয়া প্রজাতন্ত্র রাশিয়া থেকে নিয়ে ইউক্রেনকে দান করেন। সোভিয়েত আমলে ক্রিমিয়া ছিল অটোনোমাস রিপাবলিক। তবে ১৯৯১ পরবর্তী সময়ে সে তার স্বাতন্ত্র্য হারায়। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা গেছে। সেদিক থেকে ক্রিমিয়া কখনোই ইউক্রেনের শাসন মেনে নেয়নি। আর এ নিয়ে বিভিন্ন সময় রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের, বিশেষ করে মস্কোর মেয়র লুঝকভের সঙ্গে কিয়েভের নেতাদের মনোমালিন্য হয়েছে।
উল্লেখ্য, ক্রিমিয়াসহ খারকভ থেকে শুরু করে ওদেসা পর্যন্ত পুরো দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনের ভাষা মূলত রুশ। ১৯৯১ পরবর্তী প্রতিটি নির্বাচনে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী রুশ ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে, আর এদের ভোটে নির্বাচনে জিতে সেটা বেমালুম ভুলে গেছে। এটা যেমন প্রো-মার্কিন নেতাদের ক্ষেত্রে সত্যি, তেমনি সত্যি ইয়ানুকোভিচের মতো তথাকথিত রুশপন্থী নেতাদের জন্যও। আর এর কারণ সোভিয়েত-পরবর্তী ইউক্রেনে জাতীয়তাবাদী ও ফ্যাসিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী গোষ্ঠীগুলোর সে দেশের রাজনীতিকে জিম্মি করে রাখা। এটা হয়েছে মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার প্রত্যক্ষ মদদে। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে কিয়েভে ক্ষমতার রদবদল হয়। তুরচিনভ ক্ষমতায় এসেই রুশ ভাষা পারতপক্ষে নিষিদ্ধ করেন। এর ফলাফল ক্রিমিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা ও রাশিয়ার সঙ্গে এর যোগদান। এ ব্যাপারে বিস্তারিত লিখেছি জ্বলদর্চি পত্রিকায় ‘রাশিয়া ও ইউক্রেন—বিপর্যস্ত মানবতা’ শীর্ষক লেখায়।
এরপরই শুরু হয় দনবাসের স্বাধীনতা সংগ্রাম, যা আসলে ছিল স্বায়ত্তশাসন ও রুশ ভাষাকে নিজ এলাকার মাতৃভাষা করার দাবি। উত্তরে তারা পায় আট বছর ধরে চলমান যুদ্ধ। কী পারাশেঙ্কো, কী জেলেনস্কি—এরা সবাই যুদ্ধ থামিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়েই ক্ষমতায় আসেন। তবে অল্প দিনের মধ্যেই নিজেদের পরিকল্পনা (যদি ধরে নিই তাঁরা সত্যি সত্যি যুদ্ধ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, যদিও দুজনেই পরবর্তীকালে দনবাসের মানুষদের মানুষ বলে মানতে অস্বীকার করেছেন বিভিন্ন বক্তৃতায়) থেকে সরে আসেন। কারণ, ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেন শাসন করেছে উগ্রবাদী রুশ বিরোধীরা। এটা অনেকটা আমাদের দেশে বিএনপির শাসনের মতো যখন নেপথ্য থেকে সব কলকাঠি নাড়িয়েছে জামাত-শিবির। যদিও এদের তেমন জনসমর্থন নেই, তারপরও শুধু ক্যাডারভিত্তিক সংগঠনের মাধ্যমে তারা শুধু রাজনীতিবিদদের নয়, সমগ্র ইউক্রেনের জনগণকে জিম্মি করে রাখে। দিন-দুপুরে হারিয়ে যায় ভিন্নমত পোষণকারী সাংবাদিক, ব্লগার, অ্যাকটিভিস্ট। ২০১৪ সালে প্রকাশ্যে দিনের বেলায় ওদেসার ট্রেড ইউনিয়ন হাউসে পুড়িয়ে মারা হয় পঞ্চাশেরও বেশি মানুষকে (সরকারি হিসেবে ৪৮)। খারকভে নিখোঁজ হন অনেকে। খোদ কিয়েভে দিন-দুপুরে নিহত হন অনেকে। পার্লামেন্ট মেম্বাররাও এদের হাত থেকে রেহাই পায় না। এমনকি ২০১৪ সালে তারা জাপারোঝিয়ার পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দখল করে সেখানে বিস্ফোরণ ঘটানোর হুমকি দেয়।
একসময় তারা শুধু অফিস আদালত নয়, এমনকি রাস্তাঘাটে, হাটবাজারে কেউ রুশ বললে তাদের পর্যন্ত হেনস্তা করতে শুরু করে। যদিও সাধারণ মানুষ তো বটেই এমনকি পারাশেঙ্কো, জেলেনস্কি কখনোই ইউক্রেন ভাষায় পারদর্শী ছিলেন না। এভাবেই শুধু দনবাসেই নয়, এমনকি খোদ ইউক্রেনে উগ্রপন্থীরা এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। অনেকেই এ কথা বিশ্বাস করতে চান না। বলেন, তাদের বন্ধুদের ফোন করে এ রকম কিছু শুনতে পাননি। কিন্তু তাঁরা ভুলে যান, এমন অবস্থায় খুব কম লোকই টেলিফোনে সত্য কথা বলবে। এটা বুঝতে চাইলে আমাদের দেশের বিভিন্ন ধরনের সংখ্যালঘুদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন, বিশেষ করে যখন বিএনপি ক্ষমতায় থাকে, আর তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে পেছন থেকে জামাত-শিবির তাণ্ডব চালায়। একবার ভয়ের সংস্কৃতি চালু করতে পারলে মানুষকে দাবিয়ে রাখা খুব কঠিন নয়। ওপরের এই ঘটনাগুলো রুশ টিভির অপপ্রচার নয়। ইউক্রেন চ্যানেলেই এসব দেখানো হতো।
লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো
আগামীকাল পড়ুন: এ যুদ্ধের সঙ্গে যেখানে মিল বাংলাদেশের
যুদ্ধ চলছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। না না, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, সেই অর্থে বিশ্বযুদ্ধ এখনো শুরু হয়নি। কিন্তু সারা বিশ্ব যেভাবে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে, এই যুদ্ধের তাপ, সত্যি কথা বললে শীতল স্পর্শ অনুভব করছে, তাতে একে বিশ্বযুদ্ধ বললে ভুল বলা হবে বলে মনে হয় না। দেশে দেশে প্রায় প্রতিটি রান্না ঘরে মানুষ টের পাচ্ছে এই যুদ্ধের অগ্নি স্ফুলিঙ্গ। তেল-গ্যাস থেকে শুরু করে খাদ্য পর্যন্ত; সবাই মিছিল করে বলছে, তারাও চায় ন্যায্য মূল্য, এই ভোগবাদী বিশ্বে তারাও চায় তাদের সঠিক মূল্যায়ন।
যদিও অনেকেই ইউক্রেনের যুদ্ধের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও পরবর্তী রাজনীতির তুলনা করাটা ভালো চোখে দেখেন না। তবুও আমার মনে হয় বর্তমান ইউক্রেনকে, এর রাজনীতিকে বুঝতে হলে তুলনাটা মোটেই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বরং ঘটনাগুলো বুঝতে সাহায্য করবে। প্রাকৃতিক পরিবর্তনগুলো যেমন কিছু কিছু সমীকরণের সাধারণ সমাধান দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়, আর প্রতিটি বিশেষ অবস্থা ব্যাখ্যার জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ ইনিশিয়াল ও বাউন্ডারি কন্ডিশন আরোপ করতে হয়, এখানেও তাই।
সব বিশেষ সমস্যার সমাধান থাকে না। তবে সাধারণ সমাধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়—এমন সমাধান প্রাকৃতিক বিবর্তনের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে না। তবে এও ঠিক, প্রতিটি মানুষই নিজের অবস্থাটা বিশেষভাবে দেখতে চায়। সে নিজেকে দশজনের চেয়ে আলাদা বলে ভাবতেই তৃপ্তি বোধ করে। তাই অনেকেই যে এ ধরনের তুলনায় বিব্রত বোধ করবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এখানে একটা কথা বলা দরকার যে, মূল যুদ্ধটা বর্তমানে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের হলেও এটা আসলে যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপের বাজার দখলের যুদ্ধ। আর সঠিক করে বলতে গেলে রাশিয়া ও জার্মানি যাতে একত্রিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারে, সেই পরিকল্পনার অংশ এটা। কারণ ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানি হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের একজন। সে যদি রাশিয়া থেকে স্বল্প মূল্যে তেল ও গ্যাস পায়, তাহলে তার পণ্য বিশ্ববাজারে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে।
অন্যদিকে জার্মানির সঙ্গে সুসম্পর্ক হলে রাশিয়া তার তেল ও গ্যাসের জন্য পাবে স্থিতিশীল বাজার। স্বাভাবিকভাবেই তা সামরিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শত্রু রাশিয়াকে আরও শক্তিশালী করবে। যদি এই দুই দেশের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি করা যায়, তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়। তবে পশ্চিমা প্রোপাগান্ডায় এসব নিয়ে কোনো লেখা দেখা যাবে না। সেখানে আপনি পাবেন ‘পুতিন হটাও ইউক্রেন বাঁচাও’ নামে এক জিহাদের আওয়াজ। হ্যাঁ, জিহাদ। কারণ, সেই ১৯৮৮ সালে অর্থোডক্স খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণের পর থেকে বিভিন্ন সময় পশ্চিমারা দল বেঁধে রাশিয়া আক্রমণ করেছে। নেপোলিয়ন যখন রাশিয়া আক্রমণ করেন, তাঁর সঙ্গে ছিল অধিকৃত সমগ্র ইউরোপ। একই ঘটনা ঘটেছিল হিটলারের জার্মানির রাশিয়া আক্রমণের সময়েও। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। সরাসরি অংশ না নিলেও এবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে এক হয়েছে সমগ্র ইউরোপ, সঙ্গে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ। যুদ্ধের বিভিন্ন কারণ নিয়ে এর আগে জ্বলদর্চি পত্রিকায় ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায়’ শীর্ষক লেখায় আমি লিখেছি।
প্রায়ই যে কথাটা শোনা যায়, তা হলো ইউক্রেন দেশটার জন্ম কবে? ১৯৪৭ সালের আগে যেমন পাকিস্তানের অস্তিত্ব ছিল না, ঠিক তেমনি ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের আগে ইউক্রেনের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তার মানে এই নয় যে, সেখানে কেউ বাস করত না। হাজার হাজার বছর ধরে এখানে লোক বাস করছে।
তবে নবম শতকে নভগোরাদের রাজা রিউরিক কর্তৃক কিয়েভ কেন্দ্রিক রুশের (সঠিকভাবে বললে রুছ) জন্মের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নতুন পথযাত্রা। কিয়েভেই এ দেশ খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে। এর পর তারা ছড়িয়ে পড়ে বর্তমান রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। শেষ পর্যন্ত ১১৪৭ সালে রিউরিকের উত্তরসূরি ইউরি দলগোরুকির প্রতিষ্ঠিত মস্কভা বা মস্কোই সবাইকে নিজ পতাকাতলে নিয়ে আসে। এই মস্কো ও পরে সাঙ্কত পিতেরবুরগের (সেন্ট পিটার্সবার্গ) জারদের হাতেই জন্ম নেয় বর্তমান ইউক্রেনের বিভিন্ন শহর। রুশ সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে ইউক্রেন পিপলস রিপাবলিক নামে এক অটনোমাস রাষ্ট্র জন্ম নেয়। তবে সে বছরের ডিসেম্বর মাসেই তা নিজেকে সোভিয়েত হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯১৮ সালে ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধের পর সেখানে সোভিয়েত রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আত্মপ্রকাশ করে। এর প্রথম অংশগ্রহণকারী প্রজাতন্ত্রগুলো হলো—রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশিয়া, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া ও জর্জিয়া।
সে সময় লেনিন রাশিয়ার এক বিশাল ভূখণ্ড ইউক্রেনকে দান করেন। পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে স্তালিন পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও রুমানিয়ার কিছু কিছু অংশ ইউক্রেনের সঙ্গে যোগ করেন। ১৯৫৪ সালে খ্রুশেভ (ক্রুশ্চেভ) ক্রিমিয়া প্রজাতন্ত্র রাশিয়া থেকে নিয়ে ইউক্রেনকে দান করেন। সোভিয়েত আমলে ক্রিমিয়া ছিল অটোনোমাস রিপাবলিক। তবে ১৯৯১ পরবর্তী সময়ে সে তার স্বাতন্ত্র্য হারায়। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা গেছে। সেদিক থেকে ক্রিমিয়া কখনোই ইউক্রেনের শাসন মেনে নেয়নি। আর এ নিয়ে বিভিন্ন সময় রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের, বিশেষ করে মস্কোর মেয়র লুঝকভের সঙ্গে কিয়েভের নেতাদের মনোমালিন্য হয়েছে।
উল্লেখ্য, ক্রিমিয়াসহ খারকভ থেকে শুরু করে ওদেসা পর্যন্ত পুরো দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনের ভাষা মূলত রুশ। ১৯৯১ পরবর্তী প্রতিটি নির্বাচনে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী রুশ ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে, আর এদের ভোটে নির্বাচনে জিতে সেটা বেমালুম ভুলে গেছে। এটা যেমন প্রো-মার্কিন নেতাদের ক্ষেত্রে সত্যি, তেমনি সত্যি ইয়ানুকোভিচের মতো তথাকথিত রুশপন্থী নেতাদের জন্যও। আর এর কারণ সোভিয়েত-পরবর্তী ইউক্রেনে জাতীয়তাবাদী ও ফ্যাসিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী গোষ্ঠীগুলোর সে দেশের রাজনীতিকে জিম্মি করে রাখা। এটা হয়েছে মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার প্রত্যক্ষ মদদে। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে কিয়েভে ক্ষমতার রদবদল হয়। তুরচিনভ ক্ষমতায় এসেই রুশ ভাষা পারতপক্ষে নিষিদ্ধ করেন। এর ফলাফল ক্রিমিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা ও রাশিয়ার সঙ্গে এর যোগদান। এ ব্যাপারে বিস্তারিত লিখেছি জ্বলদর্চি পত্রিকায় ‘রাশিয়া ও ইউক্রেন—বিপর্যস্ত মানবতা’ শীর্ষক লেখায়।
এরপরই শুরু হয় দনবাসের স্বাধীনতা সংগ্রাম, যা আসলে ছিল স্বায়ত্তশাসন ও রুশ ভাষাকে নিজ এলাকার মাতৃভাষা করার দাবি। উত্তরে তারা পায় আট বছর ধরে চলমান যুদ্ধ। কী পারাশেঙ্কো, কী জেলেনস্কি—এরা সবাই যুদ্ধ থামিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়েই ক্ষমতায় আসেন। তবে অল্প দিনের মধ্যেই নিজেদের পরিকল্পনা (যদি ধরে নিই তাঁরা সত্যি সত্যি যুদ্ধ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, যদিও দুজনেই পরবর্তীকালে দনবাসের মানুষদের মানুষ বলে মানতে অস্বীকার করেছেন বিভিন্ন বক্তৃতায়) থেকে সরে আসেন। কারণ, ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেন শাসন করেছে উগ্রবাদী রুশ বিরোধীরা। এটা অনেকটা আমাদের দেশে বিএনপির শাসনের মতো যখন নেপথ্য থেকে সব কলকাঠি নাড়িয়েছে জামাত-শিবির। যদিও এদের তেমন জনসমর্থন নেই, তারপরও শুধু ক্যাডারভিত্তিক সংগঠনের মাধ্যমে তারা শুধু রাজনীতিবিদদের নয়, সমগ্র ইউক্রেনের জনগণকে জিম্মি করে রাখে। দিন-দুপুরে হারিয়ে যায় ভিন্নমত পোষণকারী সাংবাদিক, ব্লগার, অ্যাকটিভিস্ট। ২০১৪ সালে প্রকাশ্যে দিনের বেলায় ওদেসার ট্রেড ইউনিয়ন হাউসে পুড়িয়ে মারা হয় পঞ্চাশেরও বেশি মানুষকে (সরকারি হিসেবে ৪৮)। খারকভে নিখোঁজ হন অনেকে। খোদ কিয়েভে দিন-দুপুরে নিহত হন অনেকে। পার্লামেন্ট মেম্বাররাও এদের হাত থেকে রেহাই পায় না। এমনকি ২০১৪ সালে তারা জাপারোঝিয়ার পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দখল করে সেখানে বিস্ফোরণ ঘটানোর হুমকি দেয়।
একসময় তারা শুধু অফিস আদালত নয়, এমনকি রাস্তাঘাটে, হাটবাজারে কেউ রুশ বললে তাদের পর্যন্ত হেনস্তা করতে শুরু করে। যদিও সাধারণ মানুষ তো বটেই এমনকি পারাশেঙ্কো, জেলেনস্কি কখনোই ইউক্রেন ভাষায় পারদর্শী ছিলেন না। এভাবেই শুধু দনবাসেই নয়, এমনকি খোদ ইউক্রেনে উগ্রপন্থীরা এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। অনেকেই এ কথা বিশ্বাস করতে চান না। বলেন, তাদের বন্ধুদের ফোন করে এ রকম কিছু শুনতে পাননি। কিন্তু তাঁরা ভুলে যান, এমন অবস্থায় খুব কম লোকই টেলিফোনে সত্য কথা বলবে। এটা বুঝতে চাইলে আমাদের দেশের বিভিন্ন ধরনের সংখ্যালঘুদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন, বিশেষ করে যখন বিএনপি ক্ষমতায় থাকে, আর তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে পেছন থেকে জামাত-শিবির তাণ্ডব চালায়। একবার ভয়ের সংস্কৃতি চালু করতে পারলে মানুষকে দাবিয়ে রাখা খুব কঠিন নয়। ওপরের এই ঘটনাগুলো রুশ টিভির অপপ্রচার নয়। ইউক্রেন চ্যানেলেই এসব দেখানো হতো।
লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো
আগামীকাল পড়ুন: এ যুদ্ধের সঙ্গে যেখানে মিল বাংলাদেশের
শেখ হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে এ দেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে শাসন করেছে। মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ কনসেপ্ট। এটার সবচেয়ে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা হলো, এটা একটা গড়, যেটা স্বল্পসংখ্যক ধনী এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন-মধ্যবিত্ত
২১ ঘণ্টা আগেআমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীকে জলবায়ু-বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’-এর ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
২১ ঘণ্টা আগেআমেরিকার ১৩২ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম মেয়াদে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ট্রাম্প।
২১ ঘণ্টা আগেজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড্ড কষ্ট বুকে নিয়েই ‘সব শালারা বাটপার’ স্লোগানটি দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা দ্বিতীয় ক্যাম্পাস পাচ্ছেন না। ঠিকাদারেরা ভেলকিবাজি করছেন।ক্যাম্পাসের জন্য জমিও অধিগ্রহণ করা হয়নি।
২১ ঘণ্টা আগে