মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
জনগণকে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুতে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। এর ফলে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজে সম্প্রদায়গত পরিচয়টি সংখ্যাগুরুদের কাছে সাম্প্রদায়িকতার ভাবাদর্শ বিস্তারে সুযোগ পেয়েছে।
আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িকতার সর্বগ্রাসী বিস্তার দেখে অনেকেই এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করছেন। সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যাবে, সেই পথেরও সন্ধান করার চেষ্টা চলছে। যাঁরা সাম্প্রদায়িকতা থেকে দেশকে মুক্ত রাখতে চাইছেন, তাঁদের সংখ্যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নাই-বা করলাম। কিন্তু কাজটি অত্যন্ত কঠিন। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ থেকে মুক্ত হওয়া কিংবা রাষ্ট্র ও সমাজ খুঁজে পাওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। এটিকে নিয়ে যাঁরা চিন্তাভাবনা করছেন, তাঁরাও জানেন যে সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে রাষ্ট্র ও সমাজে তুলে ধরার জন্য অনেক বিষয়ে স্পষ্ট জ্ঞানগত ধারণা অর্জন করা অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তির জন্য খুবই জরুরি। সে কারণে যাঁরা বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে ধর্মীয় গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িক মনোভাব এবং এর বলয়ের মধ্যে নিজে ও পরিবারের সদস্যদের আটকে রাখার ব্যবস্থা করছেন, তাঁরা নিতান্তই আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজের কতগুলো অপরিহার্য বিষয় সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞানগত ধারণা রাখেন না। সেই সীমাবদ্ধতা থেকে তাঁরা বের হয়ে আসতে পারেন না। ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে যে দূরত্ব আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাখতে হয়, সেটি সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণার অভাবের কারণে অনেকেই দুটোকে গুলিয়ে ফেলেন। এ সমস্যাটি আমাদের দেশে তৈরি হয়েছে একবার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কালে, অন্যবার ১৯৭৫-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। তখন বেশির ভাগ মানুষই বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি আস্থাশীল হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল। সেখানে কারও ধর্মপরিচয় কেউ বড় করে দেখেনি। কারণ, পাকিস্তান রাষ্ট্রব্যবস্থা পূর্ব বাংলার জনগণকে ধর্মীয় পরিচয়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করলেও পূর্ব বাংলার জনগণকে অত্যন্ত হেয় চোখে দেখত, পূর্ব বাংলার মুসলমানদেরই তারা বিশুদ্ধ মনে করত না। অন্য ধর্মাবলম্বীদের অবস্থান পাকিস্তান রাষ্ট্রের চোখে অমর্যাদাকর ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে উগ্রতা ও বৈষম্যের রাজনীতি প্রকট ছিল। সে কারণে পূর্ব বাংলার বাঙালি জনসাধারণ পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভেদবুদ্ধি অতিক্রম করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হতে থাকে। ভাষাকেন্দ্রিক আন্দোলন ১৯৪৭ সালেই শুরু হয়েছিল। এটি পূর্ব বাংলার জনগণকে জাতিগত পরিচয়ে উদ্বুদ্ধ হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছিল। ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পাকিস্তান রাষ্ট্রে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিকশিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেছিল। ৬ দফার স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে যে শক্তি জুগিয়েছিল, তাই উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ সে কারণেই হয়ে উঠেছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রকে প্রত্যাখ্যান এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভাবাদর্শে অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এক চরম মুক্তির লড়াইয়ে। একটি জাতি-রাষ্ট্র লাভের মধ্য দিয়ে শুধু বাঙালি জাতিই নয়, অন্য ছোট ছোট নৃ-জাতিগোষ্ঠীও নাগরিকতার পরিচয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বসবাস করার অধিকার লাভ করবে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সে ধরনেরই একটি জাতি-রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। একটি অসাম্প্রদায়িক সংবিধান এবং জাতি গঠনের শিক্ষাব্যবস্থা চালুর উদ্যোগও তিনি নিয়েছিলেন। তিনি এবং তাঁর দল উদারবাদী, জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল, তা উনিশ শতকে ইউরোপে জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিজ্ঞতা থেকে গ্রহণ করা হয়েছিল। জার্মান জাতি ৩৬০টি ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। সে কারণে জার্মানরা প্রতিবেশী শক্তিশালী রাষ্ট্রের আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট জার্মান জাতিকে পরাজিত করেছিলেন। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে জার্মান জাতি প্রথমে কনফেডারেশন গঠন করে, পরে বিসমার্কের নেতৃত্ব ১৮৭০ সালে ঐক্যবদ্ধ জার্মান রাষ্ট্র গঠন করতে সক্ষম হয়। এরপর জার্মানিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রোম সাম্রাজ্যের পতনের পর রোমান জাতি অস্ট্রিয়া ও ফরাসিদের দখলে দীর্ঘদিন ছিল। রোমানরা বিভক্ত ছিল ছোট ছোট রাজ্যে। অবশেষে তারাই একত্র হওয়ার জন্য যুদ্ধ করেছিল অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে। এভাবেই ১৮৭০ সালে ঐক্যবদ্ধ ইতালি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ইউরোপে জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা বাস্তবে রূপলাভ করে। তবে একই রাষ্ট্রে একাধিক জাতির বসবাসকেও মেনে নেওয়া হয়। নাগরিকতাই জাতি-রাষ্ট্রের কাছে বড় পরিচয় হিসেবে বিবেচিত হয়। কোনো বিশেষ জাতি বা ধর্মের পরিচয়ে কারও রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিশেষ কোনো সুবিধা বা বঞ্চনার শিকার হওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি।
ভারতবর্ষ অসংখ্য জাতি, উপজাতি ও নৃ-জাতি নিয়ে গঠিত ফেডারেল পদ্ধতির একটি জাতি-রাষ্ট্র। ভারত সে কারণেই এখন পর্যন্ত জাতিগত বড় ধরনের বিরোধ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছে। তবে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার সমস্যাটি আগে থেকেই ভারতবর্ষে বিরাজমান থাকায় এর প্রভাব থেকে বৃহত্তর ভারত রাষ্ট্র এখনো মুক্ত হতে পারেনি। পাকিস্তান জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাই গ্রহণ করেনি। ফলে ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার জন্য অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়েছিল। তারপরও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রগতিশীল ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠী যুদ্ধের মাধ্যমেই স্বাধীনতা লাভ করেছে। কিন্তু পঁচাত্তরের পর থেকে জাতির ধারণাই বিভক্ত করে ফেলা হলো। বাঙালি ও বাংলাদেশি কূটতর্ক রাজনীতি ও সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সাম্প্রদায়িকতার পুনরুজ্জীবন ঘটানো হলো। সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে উগ্র ধর্মীয় মতাদর্শ, যা মানুষকে জাতিগত পরিচয়ে নয়, ধর্মীয় পরিচয়ে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা লাভের প্রশ্রয় দেওয়া হয়। ধর্মীয় সম্প্রদায়গত পরিচয় কখনো প্রতিক্রিয়াশীল নয়। কিন্তু যখন এর জোরজবরদস্তিমূলক ব্যবহার, অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়কে হেয়প্রতিপন্ন করা কিংবা তাদের সম্পর্কে বিদ্বেষ প্রচার করা হয়, তখন সম্প্রদায়গত পরিচয়টি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতায় রূপান্তরিত হয়। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা জাতিগত পরিচয়কে অস্বীকার ও অবজ্ঞা করে এবং নিজ ধর্মীয় সম্প্রদায়গত শ্রেষ্ঠত্বকে সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করার আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। এর ফলে রাষ্ট্র ও সমাজে জাতিগত, সম্প্রদায়গত বিরোধ, সংঘাত, হানাহানি, রক্তারক্তি ও অনাস্থা বৃদ্ধি পায়।
সম্প্রদায়গত পরিচয়টি কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি অনেক সময় একাধিক মহাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। যেমন মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু সম্প্রদায়গত পরিচয়ে মানুষকে একাধিক রাষ্ট্র ও মহাদেশে বসবাস করতে দেখা যায়। ধর্মীয় বিশ্বাস ও ভ্রাতৃত্বের দিক থেকে তারা একই সম্প্রদায়ের হলেও ভাষা, সংস্কৃতি, বর্ণ, আর্থসামাজিক অবস্থার ভিন্নতা মোটেও অস্বীকার করার উপায় নেই। ফলে এক রাষ্ট্রে বসবাস করার বাস্তবতা এত বৈচিত্র্যের অধিকারী বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে খুব একটা ঘটতে দেখা যায় না। অন্যদিকে অভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, বর্ণ ইত্যাদিতে এক বা একাধিক রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। অভিন্ন ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ে ঐতিহাসিকভাবে যে রাষ্ট্র গঠিত হয়, সেটি জাতিগত অর্জন, বৈশিষ্ট্য ও উপাদানকে অবলম্বন করেই অনেক বেশি নিরাপত্তা বিধান করতে পারে। সে ক্ষেত্রে জাতিগত পরিচয়ের মধ্যে একাধিক ধর্মীয় সম্প্রদায়গত মানুষের বসবাস ঐতিহাসিকভাবে চলে আসার বন্ধনকে শিথিল করার মাধ্যমে জাতি-রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পৃথিবীতে অনেক জাতি-রাষ্ট্রই আছে, যেখানে একাধিক ধর্মবিশ্বাসে কিন্তু অভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা জাতি বসবাস করছে।
বাংলাদেশে পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে গুরুত্বহীন করে ফেলা হয়। জনগণকে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুতে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। এর ফলে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজে সম্প্রদায়গত পরিচয়টি সংখ্যাগুরুদের কাছে সাম্প্রদায়িকতার ভাবাদর্শ বিস্তারে সুযোগ পেয়েছে। এটি মোটেও ঘটত না যদি বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ নাগরিক বাঙালি পরিচয়ে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিকভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ লাভ করত। পাশাপাশি ২ শতাংশ মানুষ নিজেদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার পরিচয়ে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে সমান নাগরিক অধিকারের মর্যাদায় বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেত। বাঙালি জাতি-গোষ্ঠী নিজেদের অভ্যন্তরের ধর্মীয় সম্প্রদায়গত পরিচয়কে অক্ষুণ্ন রেখে ভিন্ন সম্প্রদায়ের ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠার সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠত। যেকোনো ব্যক্তিরই একাধিক পরিচয় ঐতিহাসিকভাবেই রয়েছে। আমি একটি পরিবারের সদস্য, এলাকারও সদস্য, ধর্মীয়ভাবে বিশেষ একটি ধর্মের পরিচয়েও পরিচিত, আবার ভাষা সংস্কৃতির পরিচয়ে আমার বাঙালি পরিচয়টি কিছুতেই মুছে ফেলার নয়। একজন মানুষ তার ধর্ম পরিবর্তন করতে পারে কিন্তু ভাষা ও জাতিগত পরিচয় বিলুপ্ত করা যায় না। নাগরিকত্বও রাষ্ট্রের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। মানুষের জীবনব্যবস্থায় জাতিগত ধারণার পূর্ণতা থাকতে হয়। আমাদের রাষ্ট্র জাতি গঠনের সেই কঠিন কাজটি শিক্ষার মাধ্যমে করতে পারেনি বলেই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ও প্রতিক্রিয়া এত অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ঘটতে দেখা যায়। সুতরাং মনোযোগ দিতে হবে আধুনিক শিক্ষা ও জাতি-রাষ্ট্রের গঠন ও বিকাশে।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট।
জনগণকে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুতে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। এর ফলে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজে সম্প্রদায়গত পরিচয়টি সংখ্যাগুরুদের কাছে সাম্প্রদায়িকতার ভাবাদর্শ বিস্তারে সুযোগ পেয়েছে।
আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িকতার সর্বগ্রাসী বিস্তার দেখে অনেকেই এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করছেন। সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যাবে, সেই পথেরও সন্ধান করার চেষ্টা চলছে। যাঁরা সাম্প্রদায়িকতা থেকে দেশকে মুক্ত রাখতে চাইছেন, তাঁদের সংখ্যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নাই-বা করলাম। কিন্তু কাজটি অত্যন্ত কঠিন। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ থেকে মুক্ত হওয়া কিংবা রাষ্ট্র ও সমাজ খুঁজে পাওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। এটিকে নিয়ে যাঁরা চিন্তাভাবনা করছেন, তাঁরাও জানেন যে সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে রাষ্ট্র ও সমাজে তুলে ধরার জন্য অনেক বিষয়ে স্পষ্ট জ্ঞানগত ধারণা অর্জন করা অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তির জন্য খুবই জরুরি। সে কারণে যাঁরা বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে ধর্মীয় গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িক মনোভাব এবং এর বলয়ের মধ্যে নিজে ও পরিবারের সদস্যদের আটকে রাখার ব্যবস্থা করছেন, তাঁরা নিতান্তই আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজের কতগুলো অপরিহার্য বিষয় সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞানগত ধারণা রাখেন না। সেই সীমাবদ্ধতা থেকে তাঁরা বের হয়ে আসতে পারেন না। ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে যে দূরত্ব আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাখতে হয়, সেটি সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণার অভাবের কারণে অনেকেই দুটোকে গুলিয়ে ফেলেন। এ সমস্যাটি আমাদের দেশে তৈরি হয়েছে একবার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কালে, অন্যবার ১৯৭৫-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। তখন বেশির ভাগ মানুষই বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি আস্থাশীল হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল। সেখানে কারও ধর্মপরিচয় কেউ বড় করে দেখেনি। কারণ, পাকিস্তান রাষ্ট্রব্যবস্থা পূর্ব বাংলার জনগণকে ধর্মীয় পরিচয়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করলেও পূর্ব বাংলার জনগণকে অত্যন্ত হেয় চোখে দেখত, পূর্ব বাংলার মুসলমানদেরই তারা বিশুদ্ধ মনে করত না। অন্য ধর্মাবলম্বীদের অবস্থান পাকিস্তান রাষ্ট্রের চোখে অমর্যাদাকর ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে উগ্রতা ও বৈষম্যের রাজনীতি প্রকট ছিল। সে কারণে পূর্ব বাংলার বাঙালি জনসাধারণ পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভেদবুদ্ধি অতিক্রম করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হতে থাকে। ভাষাকেন্দ্রিক আন্দোলন ১৯৪৭ সালেই শুরু হয়েছিল। এটি পূর্ব বাংলার জনগণকে জাতিগত পরিচয়ে উদ্বুদ্ধ হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছিল। ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পাকিস্তান রাষ্ট্রে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিকশিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেছিল। ৬ দফার স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে যে শক্তি জুগিয়েছিল, তাই উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ সে কারণেই হয়ে উঠেছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রকে প্রত্যাখ্যান এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভাবাদর্শে অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এক চরম মুক্তির লড়াইয়ে। একটি জাতি-রাষ্ট্র লাভের মধ্য দিয়ে শুধু বাঙালি জাতিই নয়, অন্য ছোট ছোট নৃ-জাতিগোষ্ঠীও নাগরিকতার পরিচয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বসবাস করার অধিকার লাভ করবে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সে ধরনেরই একটি জাতি-রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। একটি অসাম্প্রদায়িক সংবিধান এবং জাতি গঠনের শিক্ষাব্যবস্থা চালুর উদ্যোগও তিনি নিয়েছিলেন। তিনি এবং তাঁর দল উদারবাদী, জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল, তা উনিশ শতকে ইউরোপে জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিজ্ঞতা থেকে গ্রহণ করা হয়েছিল। জার্মান জাতি ৩৬০টি ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। সে কারণে জার্মানরা প্রতিবেশী শক্তিশালী রাষ্ট্রের আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট জার্মান জাতিকে পরাজিত করেছিলেন। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে জার্মান জাতি প্রথমে কনফেডারেশন গঠন করে, পরে বিসমার্কের নেতৃত্ব ১৮৭০ সালে ঐক্যবদ্ধ জার্মান রাষ্ট্র গঠন করতে সক্ষম হয়। এরপর জার্মানিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রোম সাম্রাজ্যের পতনের পর রোমান জাতি অস্ট্রিয়া ও ফরাসিদের দখলে দীর্ঘদিন ছিল। রোমানরা বিভক্ত ছিল ছোট ছোট রাজ্যে। অবশেষে তারাই একত্র হওয়ার জন্য যুদ্ধ করেছিল অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে। এভাবেই ১৮৭০ সালে ঐক্যবদ্ধ ইতালি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ইউরোপে জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা বাস্তবে রূপলাভ করে। তবে একই রাষ্ট্রে একাধিক জাতির বসবাসকেও মেনে নেওয়া হয়। নাগরিকতাই জাতি-রাষ্ট্রের কাছে বড় পরিচয় হিসেবে বিবেচিত হয়। কোনো বিশেষ জাতি বা ধর্মের পরিচয়ে কারও রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিশেষ কোনো সুবিধা বা বঞ্চনার শিকার হওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি।
ভারতবর্ষ অসংখ্য জাতি, উপজাতি ও নৃ-জাতি নিয়ে গঠিত ফেডারেল পদ্ধতির একটি জাতি-রাষ্ট্র। ভারত সে কারণেই এখন পর্যন্ত জাতিগত বড় ধরনের বিরোধ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছে। তবে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার সমস্যাটি আগে থেকেই ভারতবর্ষে বিরাজমান থাকায় এর প্রভাব থেকে বৃহত্তর ভারত রাষ্ট্র এখনো মুক্ত হতে পারেনি। পাকিস্তান জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাই গ্রহণ করেনি। ফলে ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার জন্য অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়েছিল। তারপরও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রগতিশীল ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠী যুদ্ধের মাধ্যমেই স্বাধীনতা লাভ করেছে। কিন্তু পঁচাত্তরের পর থেকে জাতির ধারণাই বিভক্ত করে ফেলা হলো। বাঙালি ও বাংলাদেশি কূটতর্ক রাজনীতি ও সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সাম্প্রদায়িকতার পুনরুজ্জীবন ঘটানো হলো। সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে উগ্র ধর্মীয় মতাদর্শ, যা মানুষকে জাতিগত পরিচয়ে নয়, ধর্মীয় পরিচয়ে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা লাভের প্রশ্রয় দেওয়া হয়। ধর্মীয় সম্প্রদায়গত পরিচয় কখনো প্রতিক্রিয়াশীল নয়। কিন্তু যখন এর জোরজবরদস্তিমূলক ব্যবহার, অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়কে হেয়প্রতিপন্ন করা কিংবা তাদের সম্পর্কে বিদ্বেষ প্রচার করা হয়, তখন সম্প্রদায়গত পরিচয়টি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতায় রূপান্তরিত হয়। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা জাতিগত পরিচয়কে অস্বীকার ও অবজ্ঞা করে এবং নিজ ধর্মীয় সম্প্রদায়গত শ্রেষ্ঠত্বকে সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করার আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। এর ফলে রাষ্ট্র ও সমাজে জাতিগত, সম্প্রদায়গত বিরোধ, সংঘাত, হানাহানি, রক্তারক্তি ও অনাস্থা বৃদ্ধি পায়।
সম্প্রদায়গত পরিচয়টি কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি অনেক সময় একাধিক মহাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। যেমন মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু সম্প্রদায়গত পরিচয়ে মানুষকে একাধিক রাষ্ট্র ও মহাদেশে বসবাস করতে দেখা যায়। ধর্মীয় বিশ্বাস ও ভ্রাতৃত্বের দিক থেকে তারা একই সম্প্রদায়ের হলেও ভাষা, সংস্কৃতি, বর্ণ, আর্থসামাজিক অবস্থার ভিন্নতা মোটেও অস্বীকার করার উপায় নেই। ফলে এক রাষ্ট্রে বসবাস করার বাস্তবতা এত বৈচিত্র্যের অধিকারী বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে খুব একটা ঘটতে দেখা যায় না। অন্যদিকে অভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, বর্ণ ইত্যাদিতে এক বা একাধিক রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। অভিন্ন ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ে ঐতিহাসিকভাবে যে রাষ্ট্র গঠিত হয়, সেটি জাতিগত অর্জন, বৈশিষ্ট্য ও উপাদানকে অবলম্বন করেই অনেক বেশি নিরাপত্তা বিধান করতে পারে। সে ক্ষেত্রে জাতিগত পরিচয়ের মধ্যে একাধিক ধর্মীয় সম্প্রদায়গত মানুষের বসবাস ঐতিহাসিকভাবে চলে আসার বন্ধনকে শিথিল করার মাধ্যমে জাতি-রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পৃথিবীতে অনেক জাতি-রাষ্ট্রই আছে, যেখানে একাধিক ধর্মবিশ্বাসে কিন্তু অভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা জাতি বসবাস করছে।
বাংলাদেশে পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে গুরুত্বহীন করে ফেলা হয়। জনগণকে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুতে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। এর ফলে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজে সম্প্রদায়গত পরিচয়টি সংখ্যাগুরুদের কাছে সাম্প্রদায়িকতার ভাবাদর্শ বিস্তারে সুযোগ পেয়েছে। এটি মোটেও ঘটত না যদি বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ নাগরিক বাঙালি পরিচয়ে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিকভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ লাভ করত। পাশাপাশি ২ শতাংশ মানুষ নিজেদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার পরিচয়ে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে সমান নাগরিক অধিকারের মর্যাদায় বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেত। বাঙালি জাতি-গোষ্ঠী নিজেদের অভ্যন্তরের ধর্মীয় সম্প্রদায়গত পরিচয়কে অক্ষুণ্ন রেখে ভিন্ন সম্প্রদায়ের ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠার সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠত। যেকোনো ব্যক্তিরই একাধিক পরিচয় ঐতিহাসিকভাবেই রয়েছে। আমি একটি পরিবারের সদস্য, এলাকারও সদস্য, ধর্মীয়ভাবে বিশেষ একটি ধর্মের পরিচয়েও পরিচিত, আবার ভাষা সংস্কৃতির পরিচয়ে আমার বাঙালি পরিচয়টি কিছুতেই মুছে ফেলার নয়। একজন মানুষ তার ধর্ম পরিবর্তন করতে পারে কিন্তু ভাষা ও জাতিগত পরিচয় বিলুপ্ত করা যায় না। নাগরিকত্বও রাষ্ট্রের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। মানুষের জীবনব্যবস্থায় জাতিগত ধারণার পূর্ণতা থাকতে হয়। আমাদের রাষ্ট্র জাতি গঠনের সেই কঠিন কাজটি শিক্ষার মাধ্যমে করতে পারেনি বলেই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ও প্রতিক্রিয়া এত অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ঘটতে দেখা যায়। সুতরাং মনোযোগ দিতে হবে আধুনিক শিক্ষা ও জাতি-রাষ্ট্রের গঠন ও বিকাশে।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট।
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
৮ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
৯ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
৯ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
৯ ঘণ্টা আগে