আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বিএনপি তার প্রতিষ্ঠার ৪৩ বছরে পা দিয়েছে। সামরিক শাসকের ইচ্ছায় বিএনপির জন্ম। এই জন্মের সঙ্গে প্যালেস ক্লিক বা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র জড়িত। পনেরো বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপি গণতান্ত্রিক রাজনীতির কোনো ‘সবক’ নিয়েছে, তা মনে হয় না। দলে কোনো নতুন রক্তও যোগ হয়নি। পুরোনো নেতারা দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একত্র হয়ে সেই পুরোনো কথারই চর্বিতচর্বণ করেছেন।
সামরিক শাসকদের দ্বারা গঠিত কোনো রাজনৈতিক দল দীর্ঘকাল টিকে থাকে, তার উদাহরণ কম। পাকিস্তানে আইয়ুবের কনভেনশন মুসলিম লীগ এখন ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা। বাংলাদেশে সামরিক শাসকের ষড়যন্ত্রে প্রতিষ্ঠিত বিএনপিও এত দিনে কনভেনশন মুসলিম লীগের দশাপ্রাপ্ত হতো, যদি খালেদা জিয়া স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর তখনকার উপদেষ্টাদের পরামর্শে দলটিকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে না নামাতেন। এরশাদ হটাও আন্দোলনে নামার ফলে বিএনপির চরিত্র বদলে যায়। দলটিকে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে জনগণ মেনে নেয়। এটাকে বিএনপির পুনর্জন্ম বলা চলে।
ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া একটি ভালো কাজ করেন। তিনি বিরোধী দলগুলোর, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের দাবি মেনে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির মাখামাখি থাকলেও প্রথমবার ক্ষমতায় থাকাকালে খালেদা জিয়া এই মাখামাখিকে প্রকাশ্যে সামনে আসতে দেননি; বরং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের সময় জামায়াতের পাকিস্তানি আমির গোলাম আযমকে কারাগারেও পাঠিয়েছিলেন। অনেকেই আশা করেছিলেন, বিএনপি তার চরিত্র বদল করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে দেখা দেবে এবং দেশে দ্বিদলীয় গণতন্ত্রের সুবাতাস বইবে।
কিন্তু খালেদা জিয়াকে পথভ্রষ্ট করে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সার্ভিস, তাঁর পুত্র তারেক রহমানের মাধ্যমে। তারেক রহমান লায়েক হয়ে উঠতেই জামায়াতের সঙ্গে প্রকাশ্য মাখামাখি শুরু করেন। বিবৃতি দেন, জামায়াত আর বিএনপি একই পরিবারের লোক। ২০০১ সালে আবার ক্ষমতায় এসে তারেকের পরামর্শে জামায়াতকে খালেদা জিয়া মন্ত্রিসভায় গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রবীণ সদস্যদের তারেক একে একে দল থেকে বিতাড়ন করেন অথবা দলের ভেতর নিষ্ক্রিয় করে রাখেন। দলের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীও তাঁর আক্রোশ থেকে বাঁচতে পারেননি। লুৎফুজ্জামান বাবরের মতো ব্যক্তিদের এনে তিনি মন্ত্রীর আসনে বসান। বিএনপির শাসনামলেই একাত্তরের রাজাকার আবদুর রহমান বিশ্বাস বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদে বসেছিলেন।
দেশের মানুষ আশা করেছিল, একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপি তার অবস্থান পরিষ্কার করে দেশ শাসন করবে। আবার যখন বিরোধী দলে থাকবে, তখন আওয়ামী লীগ সরকারের ভুলভ্রান্তি এবং সরকার কোনো গণবিরোধী নীতি গ্রহণ করলে তার বিরোধিতা করবে। দেখা গেল, ক্ষমতায় থাকাকালে এবং বিরোধী দলে থাকার সময়েও বিএনপির কর্মসূচি ছিল শুধু আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করা নয়, মুক্তিযুদ্ধের সব আদর্শ ও চেতনার বিরোধিতা করা। এটা বাংলাদেশের মানুষের সহ্য করার কথা নয়।
বিএনপির কাছে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। তারা ইদানীং রাজনৈতিক কথাবার্তা বলছে না। অতীতের কাসুন্দি ঘাঁটছে। জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ এবং মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি যে বিতর্ক চলছে, তাতে বিএনপি নেতারা কিছু রাজনৈতিক কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু কী এই রাজনৈতিক বক্তব্য? এই বক্তব্য–দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত খালেদা জিয়ার মুক্তি, তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আদায় করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার।
তারেক রহমান দেশে ফিরুন, এটা আওয়ামী লীগ সরকারও চায়। কারণ, তিনি দেশের উচ্চ আদালত কর্তৃক একাধিক মামলায় দণ্ডিত আসামি। তিনি দেশে এসে দণ্ড গ্রহণ করুন এবং তারপর সুযোগ পেলে রাজনীতি করুন। তাঁকে বাধা দিচ্ছে কে? ১/১১ সরকারের হুলিয়া মাথায় নিয়ে শেখ হাসিনা দেশে ফিরেছিলেন। তারেক রহমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাইলে সেই সাহস দেখাচ্ছেন না কেন? তিনি চান তাঁকে দেওয়া আদালতের দণ্ড মওকুফ করে হাতিতে চড়িয়ে দেশে ফিরিয়ে আনা হোক। তিনি দেশে এসে আবার হাওয়া ভবন তৈরি করবেন। এটা তো মামাবাড়ির আবদার। কোনো রাজনৈতিক দাবি নয়। কোনো গণতান্ত্রিক সরকার এই দাবি মানতে পারে না।
এখন প্রশ্ন, বিএনপি কি অতীতের অন্ধ গলিতেই ঘুরপাক খাবে; না ভবিষ্যতের দিকে নতুনভাবে আশাভরা দৃষ্টিতে তাকাবে? ভবিষ্যতের দিকে আশাভরা দৃষ্টিতে তাকাতে হলে বিএনপিকে তার কাঁধ থেকে সিন্দবাদের সেই দৈত্যের বোঝা নামাতে হবে। সিন্দবাদের সেই দৈত্যের বোঝা হচ্ছে তারেক রহমান। যাঁর কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই, দূরদৃষ্টি নেই। বিএনপির জন্য তিনি যে কত বড় বোঝা, তা দলটিকে এবং তারেক রহমানকেও বুঝতে হবে।
তারেক রহমান বিলেতে বসে বড়শির নাট নাড়বেন, আর কিছু পুঁটিমাছ সেই দড়ির ময়লা চাটার জন্য দৌড়াদৌড়ি করবে, তা দিয়ে রাজনীতি হয় না। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাদের অনেকেই এখন আর বিএনপিতে নেই। এখন যাঁরা শূন্য গোয়াল ভর্তি করেছেন, তাঁদের মধ্যে রাজনীতির ‘অ-আ-ক-খ’র জ্ঞান আছে কি না সন্দেহ। মির্জা ফখরুল থেকে গয়েশ্বর–এঁরা কোন ব্র্যান্ডের রাজনীতি করেন? সেই পুরোনো কথা ও পুরোনো প্রবচনের রাজনীতি, পুরোনো কথার চর্বিতচর্বণ। শেখ হাসিনাকে নতুন করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার জন্য নতুন প্রজন্মকে ডিজিটাল বাংলার স্বপ্ন দেখাতে হয়েছে। তারেক রহমান বাংলার নবপ্রজন্মের তারুণ্যকে কী স্বপ্ন দেখাবেন, হাওয়া ভবন তৈরির স্বপ্ন? জেল থেকে বাবরকে বের করে এনে তরুণ প্রজন্মের কাছে ‘মডেল’ হিসেবে দাঁড় করাবেন?
আমার ধারণা, বিএনপির বর্তমান নেতারা একটি আশায় বুক বেঁধে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করছেন। তাঁদের বিশ্বাস, আওয়ামী লীগে নেতা-কর্মীদের অনেকে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকার ফলে আগের আদর্শবান চরিত্র ধরে রাখতে পারেননি। তাঁরা যত পথভ্রষ্ট হচ্ছেন, বিএনপির মধ্যে ততই নেগেটিভ ভোটে নির্বাচনে জয়ের আশা বাড়ছে। এত কাল আওয়ামী লীগের যে ভোটব্যাংক ছিল অভগ্ন, তাতে এখন ভাঙন ধরেছে। বাম রাজনৈতিক দলগুলো আওয়ামী লীগের প্রতি বীতস্পৃহ। আগামী নির্বাচনে তারা আওয়ামী লীগের নৌকায় না চড়ে আলাদা খেয়া নৌকা তৈরি করতে পারে। তাদের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন থাকতে পারে আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশেরও, যারা সরকারের মৌলবাদীদের সঙ্গে আপস করে চলার নীতিতে অসন্তুষ্ট।
অন্যদিকে দেশের ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলো এবার যে গতবারের চেয়েও শক্ত জোট বাঁধবে, তার আভাস পাওয়া যায় ড. কামাল হোসেনের বিবৃতি ও কার্যকলাপে। ড. কামাল হোসেন দেশের স্বাভাবিক রাজনীতির ধারায় থাকেন না। নির্বাচন এলেই তিনি ভীষ্মের
মতো নড়েচড়ে বসেন। মুখে একটাই বুলি, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। আসল লক্ষ্য বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটানো।
আগামী নির্বাচনে পরীক্ষা হবে শেখ হাসিনার রাজনীতি বাংলাদেশের মাটিতে টিকে থাকবে কি থাকবে না। আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনেক সাফল্য আছে। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী নয়। দেশের প্রকৃত শাসনভার ধীরে ধীরে চলে গেছে কলোনিয়াল আমলাতন্ত্রের হাতে। এই আমলাতন্ত্র রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের চাহিদা পূরণের ধারা রক্ষা করতে পারে না। নিজেরা দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ায় দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয় না, হয়নি। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা আগামী নির্বাচনে সম্পূর্ণ নির্ভর করবেন শেখ হাসিনার ক্যারিশমা ও বঙ্গবন্ধু নামের তাবিজের ওপর। অতি ব্যবহারে এ দুটোতেও আগের মতো ফল পাওয়া যাবে কি না, সে সংশয়ও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
বামপন্থীরা নিজেদের মধ্যে নেতৃত্বের ও তত্ত্বের দ্বন্দ্বের কি নিরসন করতে পারবেন? ডানপন্থীরা এবার ড. কামাল হোসেন বা আর যাঁর নেতৃত্বেই জোট বাঁধুক, গণতন্ত্রের সোনার পাথরবাটি ছাড়া জনগণকে আর কিছু দেখাতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে প্রভূত সম্ভাবনা ছিল বিএনপির—দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দলটির। জিয়ার মৃত্যুর পর তারা যেমন দিক পাল্টেছিল, এবারও যদি তারা আবার দিক পাল্টানোর সাহস দেখাতে পারত, মন্দ হতো না। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই তাদের বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর রাজনীতি ত্যাগ করতে হবে। জাতির পিতা, স্বাধীনতা ঘোষণা, জাতির অসাম্প্রদায়িক নবযাত্রা—এসব বিষয়ে বিতর্ক জিইয়ে রাখা চলবে না।
ভারতে যেমন মহাত্মা গান্ধীকে জাতির পিতা হিসেবে দলীয়ভাবে বিজেপি এবং তাদের সরকারও মানে, তেমনি বঙ্গবন্ধু যে জাতির পিতা, বিএনপিকে এই অকাট্য সত্য মেনে নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মৌল আদর্শগুলোকে বিতর্কিত করে না রেখে আওয়ামী লীগের অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে কোমরে গামছা বেঁধে বিএনপি লড়াইয়ে নামুক, অনেকে তাতে বাহ্বা দেবেন। আওয়ামী লীগের কিছু কিছু অপশাসনে যাঁরা বিরক্ত, তাঁরা বিএনপিকে সে ক্ষেত্রে সমর্থন দেবেন। কেন, ভারতের রাজনীতিতে বিজেপি ক্ষমতায় যায়নি?
এবারের ৪৩ বছরের জন্মদিনেও জাতিকে কোনো দিকনির্দেশনা বিএনপি দিতে পারেনি। নিজেদের জন্যও কোনো দিকনির্দেশনা নির্দিষ্ট করতে পারেনি। দেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দলই শূন্যতার আবর্তে ঘুরছে। এ অবস্থায় সচেতন সবার মনেই প্রশ্ন: দেশের ভবিষ্যৎ কী? তাহলে কি সময় ও সুযোগ বুঝে তালেবানপন্থীরাই এই শূন্যস্থান পূরণ করবে? আফগানিস্তানে
বেজে ওঠা সানাইয়ের সুর কি বাংলাদেশেও শোনা যাবে?
লেখক: বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও কলামিস্ট
বিএনপি তার প্রতিষ্ঠার ৪৩ বছরে পা দিয়েছে। সামরিক শাসকের ইচ্ছায় বিএনপির জন্ম। এই জন্মের সঙ্গে প্যালেস ক্লিক বা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র জড়িত। পনেরো বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপি গণতান্ত্রিক রাজনীতির কোনো ‘সবক’ নিয়েছে, তা মনে হয় না। দলে কোনো নতুন রক্তও যোগ হয়নি। পুরোনো নেতারা দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একত্র হয়ে সেই পুরোনো কথারই চর্বিতচর্বণ করেছেন।
সামরিক শাসকদের দ্বারা গঠিত কোনো রাজনৈতিক দল দীর্ঘকাল টিকে থাকে, তার উদাহরণ কম। পাকিস্তানে আইয়ুবের কনভেনশন মুসলিম লীগ এখন ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা। বাংলাদেশে সামরিক শাসকের ষড়যন্ত্রে প্রতিষ্ঠিত বিএনপিও এত দিনে কনভেনশন মুসলিম লীগের দশাপ্রাপ্ত হতো, যদি খালেদা জিয়া স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর তখনকার উপদেষ্টাদের পরামর্শে দলটিকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে না নামাতেন। এরশাদ হটাও আন্দোলনে নামার ফলে বিএনপির চরিত্র বদলে যায়। দলটিকে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে জনগণ মেনে নেয়। এটাকে বিএনপির পুনর্জন্ম বলা চলে।
ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া একটি ভালো কাজ করেন। তিনি বিরোধী দলগুলোর, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের দাবি মেনে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির মাখামাখি থাকলেও প্রথমবার ক্ষমতায় থাকাকালে খালেদা জিয়া এই মাখামাখিকে প্রকাশ্যে সামনে আসতে দেননি; বরং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের সময় জামায়াতের পাকিস্তানি আমির গোলাম আযমকে কারাগারেও পাঠিয়েছিলেন। অনেকেই আশা করেছিলেন, বিএনপি তার চরিত্র বদল করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে দেখা দেবে এবং দেশে দ্বিদলীয় গণতন্ত্রের সুবাতাস বইবে।
কিন্তু খালেদা জিয়াকে পথভ্রষ্ট করে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সার্ভিস, তাঁর পুত্র তারেক রহমানের মাধ্যমে। তারেক রহমান লায়েক হয়ে উঠতেই জামায়াতের সঙ্গে প্রকাশ্য মাখামাখি শুরু করেন। বিবৃতি দেন, জামায়াত আর বিএনপি একই পরিবারের লোক। ২০০১ সালে আবার ক্ষমতায় এসে তারেকের পরামর্শে জামায়াতকে খালেদা জিয়া মন্ত্রিসভায় গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রবীণ সদস্যদের তারেক একে একে দল থেকে বিতাড়ন করেন অথবা দলের ভেতর নিষ্ক্রিয় করে রাখেন। দলের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীও তাঁর আক্রোশ থেকে বাঁচতে পারেননি। লুৎফুজ্জামান বাবরের মতো ব্যক্তিদের এনে তিনি মন্ত্রীর আসনে বসান। বিএনপির শাসনামলেই একাত্তরের রাজাকার আবদুর রহমান বিশ্বাস বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদে বসেছিলেন।
দেশের মানুষ আশা করেছিল, একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপি তার অবস্থান পরিষ্কার করে দেশ শাসন করবে। আবার যখন বিরোধী দলে থাকবে, তখন আওয়ামী লীগ সরকারের ভুলভ্রান্তি এবং সরকার কোনো গণবিরোধী নীতি গ্রহণ করলে তার বিরোধিতা করবে। দেখা গেল, ক্ষমতায় থাকাকালে এবং বিরোধী দলে থাকার সময়েও বিএনপির কর্মসূচি ছিল শুধু আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করা নয়, মুক্তিযুদ্ধের সব আদর্শ ও চেতনার বিরোধিতা করা। এটা বাংলাদেশের মানুষের সহ্য করার কথা নয়।
বিএনপির কাছে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। তারা ইদানীং রাজনৈতিক কথাবার্তা বলছে না। অতীতের কাসুন্দি ঘাঁটছে। জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ এবং মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি যে বিতর্ক চলছে, তাতে বিএনপি নেতারা কিছু রাজনৈতিক কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু কী এই রাজনৈতিক বক্তব্য? এই বক্তব্য–দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত খালেদা জিয়ার মুক্তি, তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আদায় করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার।
তারেক রহমান দেশে ফিরুন, এটা আওয়ামী লীগ সরকারও চায়। কারণ, তিনি দেশের উচ্চ আদালত কর্তৃক একাধিক মামলায় দণ্ডিত আসামি। তিনি দেশে এসে দণ্ড গ্রহণ করুন এবং তারপর সুযোগ পেলে রাজনীতি করুন। তাঁকে বাধা দিচ্ছে কে? ১/১১ সরকারের হুলিয়া মাথায় নিয়ে শেখ হাসিনা দেশে ফিরেছিলেন। তারেক রহমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাইলে সেই সাহস দেখাচ্ছেন না কেন? তিনি চান তাঁকে দেওয়া আদালতের দণ্ড মওকুফ করে হাতিতে চড়িয়ে দেশে ফিরিয়ে আনা হোক। তিনি দেশে এসে আবার হাওয়া ভবন তৈরি করবেন। এটা তো মামাবাড়ির আবদার। কোনো রাজনৈতিক দাবি নয়। কোনো গণতান্ত্রিক সরকার এই দাবি মানতে পারে না।
এখন প্রশ্ন, বিএনপি কি অতীতের অন্ধ গলিতেই ঘুরপাক খাবে; না ভবিষ্যতের দিকে নতুনভাবে আশাভরা দৃষ্টিতে তাকাবে? ভবিষ্যতের দিকে আশাভরা দৃষ্টিতে তাকাতে হলে বিএনপিকে তার কাঁধ থেকে সিন্দবাদের সেই দৈত্যের বোঝা নামাতে হবে। সিন্দবাদের সেই দৈত্যের বোঝা হচ্ছে তারেক রহমান। যাঁর কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই, দূরদৃষ্টি নেই। বিএনপির জন্য তিনি যে কত বড় বোঝা, তা দলটিকে এবং তারেক রহমানকেও বুঝতে হবে।
তারেক রহমান বিলেতে বসে বড়শির নাট নাড়বেন, আর কিছু পুঁটিমাছ সেই দড়ির ময়লা চাটার জন্য দৌড়াদৌড়ি করবে, তা দিয়ে রাজনীতি হয় না। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাদের অনেকেই এখন আর বিএনপিতে নেই। এখন যাঁরা শূন্য গোয়াল ভর্তি করেছেন, তাঁদের মধ্যে রাজনীতির ‘অ-আ-ক-খ’র জ্ঞান আছে কি না সন্দেহ। মির্জা ফখরুল থেকে গয়েশ্বর–এঁরা কোন ব্র্যান্ডের রাজনীতি করেন? সেই পুরোনো কথা ও পুরোনো প্রবচনের রাজনীতি, পুরোনো কথার চর্বিতচর্বণ। শেখ হাসিনাকে নতুন করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার জন্য নতুন প্রজন্মকে ডিজিটাল বাংলার স্বপ্ন দেখাতে হয়েছে। তারেক রহমান বাংলার নবপ্রজন্মের তারুণ্যকে কী স্বপ্ন দেখাবেন, হাওয়া ভবন তৈরির স্বপ্ন? জেল থেকে বাবরকে বের করে এনে তরুণ প্রজন্মের কাছে ‘মডেল’ হিসেবে দাঁড় করাবেন?
আমার ধারণা, বিএনপির বর্তমান নেতারা একটি আশায় বুক বেঁধে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করছেন। তাঁদের বিশ্বাস, আওয়ামী লীগে নেতা-কর্মীদের অনেকে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকার ফলে আগের আদর্শবান চরিত্র ধরে রাখতে পারেননি। তাঁরা যত পথভ্রষ্ট হচ্ছেন, বিএনপির মধ্যে ততই নেগেটিভ ভোটে নির্বাচনে জয়ের আশা বাড়ছে। এত কাল আওয়ামী লীগের যে ভোটব্যাংক ছিল অভগ্ন, তাতে এখন ভাঙন ধরেছে। বাম রাজনৈতিক দলগুলো আওয়ামী লীগের প্রতি বীতস্পৃহ। আগামী নির্বাচনে তারা আওয়ামী লীগের নৌকায় না চড়ে আলাদা খেয়া নৌকা তৈরি করতে পারে। তাদের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন থাকতে পারে আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশেরও, যারা সরকারের মৌলবাদীদের সঙ্গে আপস করে চলার নীতিতে অসন্তুষ্ট।
অন্যদিকে দেশের ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলো এবার যে গতবারের চেয়েও শক্ত জোট বাঁধবে, তার আভাস পাওয়া যায় ড. কামাল হোসেনের বিবৃতি ও কার্যকলাপে। ড. কামাল হোসেন দেশের স্বাভাবিক রাজনীতির ধারায় থাকেন না। নির্বাচন এলেই তিনি ভীষ্মের
মতো নড়েচড়ে বসেন। মুখে একটাই বুলি, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। আসল লক্ষ্য বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটানো।
আগামী নির্বাচনে পরীক্ষা হবে শেখ হাসিনার রাজনীতি বাংলাদেশের মাটিতে টিকে থাকবে কি থাকবে না। আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনেক সাফল্য আছে। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী নয়। দেশের প্রকৃত শাসনভার ধীরে ধীরে চলে গেছে কলোনিয়াল আমলাতন্ত্রের হাতে। এই আমলাতন্ত্র রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের চাহিদা পূরণের ধারা রক্ষা করতে পারে না। নিজেরা দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ায় দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয় না, হয়নি। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা আগামী নির্বাচনে সম্পূর্ণ নির্ভর করবেন শেখ হাসিনার ক্যারিশমা ও বঙ্গবন্ধু নামের তাবিজের ওপর। অতি ব্যবহারে এ দুটোতেও আগের মতো ফল পাওয়া যাবে কি না, সে সংশয়ও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
বামপন্থীরা নিজেদের মধ্যে নেতৃত্বের ও তত্ত্বের দ্বন্দ্বের কি নিরসন করতে পারবেন? ডানপন্থীরা এবার ড. কামাল হোসেন বা আর যাঁর নেতৃত্বেই জোট বাঁধুক, গণতন্ত্রের সোনার পাথরবাটি ছাড়া জনগণকে আর কিছু দেখাতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে প্রভূত সম্ভাবনা ছিল বিএনপির—দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দলটির। জিয়ার মৃত্যুর পর তারা যেমন দিক পাল্টেছিল, এবারও যদি তারা আবার দিক পাল্টানোর সাহস দেখাতে পারত, মন্দ হতো না। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই তাদের বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর রাজনীতি ত্যাগ করতে হবে। জাতির পিতা, স্বাধীনতা ঘোষণা, জাতির অসাম্প্রদায়িক নবযাত্রা—এসব বিষয়ে বিতর্ক জিইয়ে রাখা চলবে না।
ভারতে যেমন মহাত্মা গান্ধীকে জাতির পিতা হিসেবে দলীয়ভাবে বিজেপি এবং তাদের সরকারও মানে, তেমনি বঙ্গবন্ধু যে জাতির পিতা, বিএনপিকে এই অকাট্য সত্য মেনে নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মৌল আদর্শগুলোকে বিতর্কিত করে না রেখে আওয়ামী লীগের অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে কোমরে গামছা বেঁধে বিএনপি লড়াইয়ে নামুক, অনেকে তাতে বাহ্বা দেবেন। আওয়ামী লীগের কিছু কিছু অপশাসনে যাঁরা বিরক্ত, তাঁরা বিএনপিকে সে ক্ষেত্রে সমর্থন দেবেন। কেন, ভারতের রাজনীতিতে বিজেপি ক্ষমতায় যায়নি?
এবারের ৪৩ বছরের জন্মদিনেও জাতিকে কোনো দিকনির্দেশনা বিএনপি দিতে পারেনি। নিজেদের জন্যও কোনো দিকনির্দেশনা নির্দিষ্ট করতে পারেনি। দেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দলই শূন্যতার আবর্তে ঘুরছে। এ অবস্থায় সচেতন সবার মনেই প্রশ্ন: দেশের ভবিষ্যৎ কী? তাহলে কি সময় ও সুযোগ বুঝে তালেবানপন্থীরাই এই শূন্যস্থান পূরণ করবে? আফগানিস্তানে
বেজে ওঠা সানাইয়ের সুর কি বাংলাদেশেও শোনা যাবে?
লেখক: বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
৫ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
৬ ঘণ্টা আগে