রবিউল হোসেন
অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহসী কৌশল চাপ সামলাতে অবশ্যই সহায়ক হতে পারে যদি কাজের ওপর কর্তার প্রকৃত দক্ষতা থাকে। তাই বলতে হয়, দক্ষ কর্মীর নিরাপদ হাত মানেই একটি বিজয়ী হাত।
সম্প্রতি ‘আজকের পত্রিকায়’ আমার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। ব্যাংকিং নিয়ে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে আমার মতামতের ওপর যেকোনো স্তরের ব্যাংকারের বিরূপ মন্তব্য আসা অস্বাভাবিক নয়। কারণ মতামতটি আত্মসমালোচনামূলক বিধায় তা অপ্রিয় হওয়াই স্বাভাবিক। অতএব, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কথিত অবারিত সমালোচনার ওপর সংক্ষেপে দুটো কথা বলতে চাই:
ওই সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত আমার কথাটি কী ছিল, তা আগে জানা দরকার। কথাটি ছিল ব্যাংকিংয়ের নিম্নমুখী অবস্থার জন্য ব্যাংকাররা দায় এড়াতে পারেন না। বলা যায়, তাঁরাই দায়ী। অভিজ্ঞতার বলে আমি এমনটাই বিশ্বাস করি। কারণ, দায়িত্ব আমার কিন্তু দায় আমার নয়, এমনটি হয় না। বয়স ৭৬ বছর হয়েছে বলে আমি ঠিক বলছি না, এমন ভাবনার গতিবেগ দুর্বল হতে পারে আমাকে সশরীরে দেখলে। কারণ, এখনো অধিক মনোযোগ দিয়ে কোনো কাজ করলে, কোনো কথা বললে বা কোনো কথা শুনলে, তা সহজে ভুল হয় না।
৮ বছর আগপর্যন্ত প্রায় ৪৫ বছর ধরে ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। এখনো এ বিষয়ে আমার লেখা, টক শো ইত্যাদি মাঝেমধ্যে প্রকাশিত হয়। মনোযোগী হয়ে কাজ করেছি বলে হয়তো অনেক ঘটনা এখনো স্মৃতিতে অম্লান হয়ে রয়েছে। এ ছাড়া সব সময়ে সব কাজ সঠিকভাবে করার কারণেই কোথাও কখনো ঠেকিনি এবং তেমন বিপদেও পড়তে হয়নি। অবশ্য হিংসার ধাক্কা যে একেবারেই খাইনি, তা বলা যাবে না। তবে তা সামাল দিয়েছি। ওই সব অভিজ্ঞতা আমার লেখা বই ‘জীবন ও মানুষ: ব্যাংক ও ব্যাংকিং’ এবং ‘একজন ব্যাংকারের দুর্লভ অভিজ্ঞতা’য় তুলে ধরেছি।
তো যাহোক, ব্যাংকারদের দায়-দায়িত্বের ওপর আমার মতামতের সপক্ষে তর্কের খাতিরে বলতে হয়, গুদামের নিরাপত্তাপ্রহরী যেমন তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন মালামাল চুরির দায় এড়াতে পারেন না, তেমনি ব্যাংক-আমানতের হেফাজতকারী হয়ে ব্যাংকাররা সেই আমানত খেয়ানত হয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এড়াবেন কী করে? অনস্বীকার্যভাবে ব্যাংকাররা বেশি বেতন-ভাতা এবং সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। ফলে গ্রহীতা হিসেবে ব্যাংকারদের সংসার ভালোভাবে চলে, সম্পত্তি বাড়ে অথচ দাতা হিসেবে ব্যাংকের সম্পদ কমে।
এখানে একটি অভিজ্ঞতার কথা বলেই লেখাটি শেষ করব। সরাসরি অফিসার গ্রেড-২ হিসেবে জনতার পূর্বসূরি ব্যাংকে যোগদানের প্রথম ১০ বছর মফস্বলে কাজ করতে হয়। এরপর বদলি হই ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে। নতুন পরিবেশ। খুব ভয়ে ছিলাম। ইতিমধ্যে এক নতুন জিএম সাহেব আমাদের জনতা ব্যাংকে এলেন সোনালী ব্যাংক থেকে পদোন্নতি পেয়ে। খুব কড়া মানুষ। সামনে পড়লেই একটা না একটা শাস্তি। একদিন হঠাৎ আমার ডাক পড়ল তাঁর অফিসে। বুক ধড়ফড়ানি নিয়ে ‘আয়তাল কুরসি’ পড়তে পড়তে তিনতলা থেকে দোতলায় নেমে জিএম সাহেবের কেবিনে ঢুকে দেখি তিনজন বহিরাগত অতিথি তাঁর সামনে বসা। আমার উপস্থিতি জানান দিতেই আমার দিকে তাকিয়ে বেশ গম্ভীর স্বরে জিএম সাহেব বললেন, ‘ইনারা আমার আত্মীয়, দেশ থেকে এসেছেন।’ দেখলাম, তিনি যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে তাঁদের খাতির যত্ন করছেন। এতে আমার বুঝতে বাকি থাকল না যে তাঁরা কত কাছের লোক। জিএম সাহেব একটি ঋণপ্রস্তাব আমার দিকে এগিয়ে ধরে বললেন, ‘এটি দেখবেন। আমি বলছি বলে তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই।’ তখন মনে হলো উনি যতই বলুন, এই লোনের অনুমোদন তাড়াতাড়িই দিতে হবে। কারণ, জরুরি না হলে তিনি তো প্রস্তাবটি আমার কাছেই পাঠিয়ে দিতেন। যাহোক, একনজর দেখেই এক বিশেষ কারণে বোঝা গেল যে রুল মেনে এই প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া যাবে না। তবে তখনই জিএম সাহেবকে কিছু বললাম না এই ভেবে যে, তিনি অপ্রস্তুত হবেন মেহমানদের সামনে এবং আমাকেও সার্কুলার ইত্যাদি দেখে আমার তাৎক্ষণিক নেতিবাচক অনুমান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। তখন আমি জিএম সাহেবকে অনুনয়ের সুরে বললাম, ‘স্যার, ওনাদের নিয়ে আমার টেবিলে যাই।’ তিনি সম্মতি দিলেন।
অতঃপর দোতলা থেকে তিনতলায় আমার অফিসে আসার পর মেহমানদের জন্য চা-নাশতার ব্যবস্থা করলাম। সেই ফাঁকে সার্কুলার, ডেলিগেশন-অব-পাওয়ার, ইত্যাদির সাহায্যে প্রস্তাবটির ওপর আমার সংশয়ী ত্রুটির বিষয়ে যাচাই করে নিশ্চিত হয়ে জিএম সাহেবের কাছে গেলাম। বললাম, ‘স্যার, আপনার হয়তো মনে আছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সম্প্রতি জারিকৃত একটি বিশেষ সার্কুলার অনুযায়ী থানা বা উপজেলা হেডকোয়ার্টার্স সীমানার বাইরে অবস্থিত কোনো জমির ওপর গৃহনির্মাণ করতে ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া যাবে না। আপনি নিশ্চয়ই মানবেন যে প্রস্তাবিত জমিটির অবস্থান থানা হেডকোয়ার্টার্স সীমানার বাইরে। তাই এই ঋণ দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধি ভঙ্গ হবে। আরও দেখা যাচ্ছে, ‘ব্যাংকের ডেলিগেশন-অব-পাওয়ার’ অনুযায়ী এই ঋণ অনুমোদন ক্ষমতা “জিএম”, অর্থাৎ আপনার। তবে আত্মীয় বলে এমডি সাহেবকে দিয়ে ঋণটি অনুমোদন করানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তাতে ভবিষ্যতে ঝুঁকির দায়-দায়িত্ব আপনার ওপর বর্তানোর আশঙ্কা রয়েছে, যেহেতু প্রস্তাবটি মূলত আইন পরিপন্থী।’ জিএম সাহেব তখন সবকিছু দেখে-শুনে এবং বুঝে আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘রবিউল, আমি সব জানি। কিন্তু তাঁরা আমার আত্মীয়। কিছু একটা করেন, যাতে তাঁরা আর আমার কাছে না আসে।’
নামাজের বোঝা হালকা করতে গিয়ে রোজার দায়িত্ব ঘাড়ে চেপে বসার মতো গরম জিএম সাহেবের নরম সুর আমাকে অধিকতর দায়িত্বের ফাঁদে ফেলে দিল। দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে নিজের অফিসে ফিরে দেখি জিএম সাহেবের আত্মীয়রা মহা খুশিতে চা-নাশতা উপভোগে মগ্ন। কারণ অতি সহজেই তাঁরা পাঁচ লাখ টাকার ঋণ পেয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের খুশির আমেজ আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এনে দিল। তাঁদের বললাম, ‘আপনারা খুবই ভাগ্যবান। আমাদের জিএম সাহেব, অর্থাৎ আপনাদের ছেলে, সরকারি জয়েন্ট সেক্রেটারি লেভেলের একজন উচ্চপর্যায়ের অফিসার হওয়া সত্ত্বেও আপনাদের মতো গ্রামের আত্মীয়-স্বজনদের যে সম্মান দেখালেন তা সত্যিই অভাবনীয়।’ আমার এমন কথায় তাঁরা আরও পুলকিত হলেন। তাঁদের সেই বাড়তি খুশির সুযোগ নিয়ে বললাম, ‘আপনারা জিএম সাহেবকে কতটুকু ভালোবাসেন?’ সগর্ব জবাব, ‘অনেক’। তখন আবারও বললাম, ‘ওনার কোনো বিপদ হলে আপনারা কী করবেন?’ দৃঢ় জবাব, ‘আমরা রুখে দাঁড়াব।’ আমি তখন বললাম, ‘আপনাদের লোন দিতে গিয়ে যদি ওনার কোনো অসুবিধা হয়?’ তাঁরা অবলীলায় বলে উঠলেন, ‘তাহলে এই লোনই নেব না।’ তখন আমি বললাম, ‘উনি তো তাতে অনেক কষ্ট পাবেন এবং লজ্জাও পাবেন। কিন্তু তাঁকে আপনারা অনেক ভালোবাসেন। অথচ আপনাদের জন্য তিনি কিছুই করতে পারছেন না।’ তখন তাঁরা দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘আমরা তাঁর কাছে আর যাবই না।’ তখন মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। দেখুন, যে চাপের কথা বলা হলো তা কীভাবে ম্যানেজ হয়ে গেল। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। আসলে ‘চাপ’ সাপের মতোই দুর্বল, যা লাঠিকে ভয় পায়। তাই সৎ ও সাহসী দক্ষতা দিয়ে লাঠিকে বাঁচিয়েও সাপ মারা যায়।
এরপরও সমালোচকেরা হয়তো বলবেন, ‘আগের চাপ আর এখনকার চাপ এক নয়।’ এর জবাবে বলতেই হয়, চাপের কোনো নির্দিষ্ট বাপ নেই, সময়ও নেই। যে তাকে দমাতে পারে, সে-ই তার বাপ এবং তখনই হয় তার নিষ্ঠুর ‘শেষ সময়’। পরিশেষে বলি, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহসী কৌশল চাপ সামলাতে অবশ্যই সহায়ক হতে পারে যদি কাজের ওপর কর্তার প্রকৃত দক্ষতা থাকে। তাই বলতে হয়, দক্ষ কর্মীর নিরাপদ হাত মানেই একটি বিজয়ী হাত। আসুন, আমরা কাজের ‘নুক্তা’ বের না করে মনোযোগ দিয়ে সঠিক কাজ করে তার সর্বজনীন সুফল দিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরের গতি ফেরাই।
লেখক: সাবেক এমডি সোনালী ও রূপালী ব্যাংক।
অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহসী কৌশল চাপ সামলাতে অবশ্যই সহায়ক হতে পারে যদি কাজের ওপর কর্তার প্রকৃত দক্ষতা থাকে। তাই বলতে হয়, দক্ষ কর্মীর নিরাপদ হাত মানেই একটি বিজয়ী হাত।
সম্প্রতি ‘আজকের পত্রিকায়’ আমার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। ব্যাংকিং নিয়ে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে আমার মতামতের ওপর যেকোনো স্তরের ব্যাংকারের বিরূপ মন্তব্য আসা অস্বাভাবিক নয়। কারণ মতামতটি আত্মসমালোচনামূলক বিধায় তা অপ্রিয় হওয়াই স্বাভাবিক। অতএব, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কথিত অবারিত সমালোচনার ওপর সংক্ষেপে দুটো কথা বলতে চাই:
ওই সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত আমার কথাটি কী ছিল, তা আগে জানা দরকার। কথাটি ছিল ব্যাংকিংয়ের নিম্নমুখী অবস্থার জন্য ব্যাংকাররা দায় এড়াতে পারেন না। বলা যায়, তাঁরাই দায়ী। অভিজ্ঞতার বলে আমি এমনটাই বিশ্বাস করি। কারণ, দায়িত্ব আমার কিন্তু দায় আমার নয়, এমনটি হয় না। বয়স ৭৬ বছর হয়েছে বলে আমি ঠিক বলছি না, এমন ভাবনার গতিবেগ দুর্বল হতে পারে আমাকে সশরীরে দেখলে। কারণ, এখনো অধিক মনোযোগ দিয়ে কোনো কাজ করলে, কোনো কথা বললে বা কোনো কথা শুনলে, তা সহজে ভুল হয় না।
৮ বছর আগপর্যন্ত প্রায় ৪৫ বছর ধরে ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। এখনো এ বিষয়ে আমার লেখা, টক শো ইত্যাদি মাঝেমধ্যে প্রকাশিত হয়। মনোযোগী হয়ে কাজ করেছি বলে হয়তো অনেক ঘটনা এখনো স্মৃতিতে অম্লান হয়ে রয়েছে। এ ছাড়া সব সময়ে সব কাজ সঠিকভাবে করার কারণেই কোথাও কখনো ঠেকিনি এবং তেমন বিপদেও পড়তে হয়নি। অবশ্য হিংসার ধাক্কা যে একেবারেই খাইনি, তা বলা যাবে না। তবে তা সামাল দিয়েছি। ওই সব অভিজ্ঞতা আমার লেখা বই ‘জীবন ও মানুষ: ব্যাংক ও ব্যাংকিং’ এবং ‘একজন ব্যাংকারের দুর্লভ অভিজ্ঞতা’য় তুলে ধরেছি।
তো যাহোক, ব্যাংকারদের দায়-দায়িত্বের ওপর আমার মতামতের সপক্ষে তর্কের খাতিরে বলতে হয়, গুদামের নিরাপত্তাপ্রহরী যেমন তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন মালামাল চুরির দায় এড়াতে পারেন না, তেমনি ব্যাংক-আমানতের হেফাজতকারী হয়ে ব্যাংকাররা সেই আমানত খেয়ানত হয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এড়াবেন কী করে? অনস্বীকার্যভাবে ব্যাংকাররা বেশি বেতন-ভাতা এবং সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। ফলে গ্রহীতা হিসেবে ব্যাংকারদের সংসার ভালোভাবে চলে, সম্পত্তি বাড়ে অথচ দাতা হিসেবে ব্যাংকের সম্পদ কমে।
এখানে একটি অভিজ্ঞতার কথা বলেই লেখাটি শেষ করব। সরাসরি অফিসার গ্রেড-২ হিসেবে জনতার পূর্বসূরি ব্যাংকে যোগদানের প্রথম ১০ বছর মফস্বলে কাজ করতে হয়। এরপর বদলি হই ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে। নতুন পরিবেশ। খুব ভয়ে ছিলাম। ইতিমধ্যে এক নতুন জিএম সাহেব আমাদের জনতা ব্যাংকে এলেন সোনালী ব্যাংক থেকে পদোন্নতি পেয়ে। খুব কড়া মানুষ। সামনে পড়লেই একটা না একটা শাস্তি। একদিন হঠাৎ আমার ডাক পড়ল তাঁর অফিসে। বুক ধড়ফড়ানি নিয়ে ‘আয়তাল কুরসি’ পড়তে পড়তে তিনতলা থেকে দোতলায় নেমে জিএম সাহেবের কেবিনে ঢুকে দেখি তিনজন বহিরাগত অতিথি তাঁর সামনে বসা। আমার উপস্থিতি জানান দিতেই আমার দিকে তাকিয়ে বেশ গম্ভীর স্বরে জিএম সাহেব বললেন, ‘ইনারা আমার আত্মীয়, দেশ থেকে এসেছেন।’ দেখলাম, তিনি যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে তাঁদের খাতির যত্ন করছেন। এতে আমার বুঝতে বাকি থাকল না যে তাঁরা কত কাছের লোক। জিএম সাহেব একটি ঋণপ্রস্তাব আমার দিকে এগিয়ে ধরে বললেন, ‘এটি দেখবেন। আমি বলছি বলে তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই।’ তখন মনে হলো উনি যতই বলুন, এই লোনের অনুমোদন তাড়াতাড়িই দিতে হবে। কারণ, জরুরি না হলে তিনি তো প্রস্তাবটি আমার কাছেই পাঠিয়ে দিতেন। যাহোক, একনজর দেখেই এক বিশেষ কারণে বোঝা গেল যে রুল মেনে এই প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া যাবে না। তবে তখনই জিএম সাহেবকে কিছু বললাম না এই ভেবে যে, তিনি অপ্রস্তুত হবেন মেহমানদের সামনে এবং আমাকেও সার্কুলার ইত্যাদি দেখে আমার তাৎক্ষণিক নেতিবাচক অনুমান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। তখন আমি জিএম সাহেবকে অনুনয়ের সুরে বললাম, ‘স্যার, ওনাদের নিয়ে আমার টেবিলে যাই।’ তিনি সম্মতি দিলেন।
অতঃপর দোতলা থেকে তিনতলায় আমার অফিসে আসার পর মেহমানদের জন্য চা-নাশতার ব্যবস্থা করলাম। সেই ফাঁকে সার্কুলার, ডেলিগেশন-অব-পাওয়ার, ইত্যাদির সাহায্যে প্রস্তাবটির ওপর আমার সংশয়ী ত্রুটির বিষয়ে যাচাই করে নিশ্চিত হয়ে জিএম সাহেবের কাছে গেলাম। বললাম, ‘স্যার, আপনার হয়তো মনে আছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সম্প্রতি জারিকৃত একটি বিশেষ সার্কুলার অনুযায়ী থানা বা উপজেলা হেডকোয়ার্টার্স সীমানার বাইরে অবস্থিত কোনো জমির ওপর গৃহনির্মাণ করতে ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া যাবে না। আপনি নিশ্চয়ই মানবেন যে প্রস্তাবিত জমিটির অবস্থান থানা হেডকোয়ার্টার্স সীমানার বাইরে। তাই এই ঋণ দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধি ভঙ্গ হবে। আরও দেখা যাচ্ছে, ‘ব্যাংকের ডেলিগেশন-অব-পাওয়ার’ অনুযায়ী এই ঋণ অনুমোদন ক্ষমতা “জিএম”, অর্থাৎ আপনার। তবে আত্মীয় বলে এমডি সাহেবকে দিয়ে ঋণটি অনুমোদন করানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তাতে ভবিষ্যতে ঝুঁকির দায়-দায়িত্ব আপনার ওপর বর্তানোর আশঙ্কা রয়েছে, যেহেতু প্রস্তাবটি মূলত আইন পরিপন্থী।’ জিএম সাহেব তখন সবকিছু দেখে-শুনে এবং বুঝে আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘রবিউল, আমি সব জানি। কিন্তু তাঁরা আমার আত্মীয়। কিছু একটা করেন, যাতে তাঁরা আর আমার কাছে না আসে।’
নামাজের বোঝা হালকা করতে গিয়ে রোজার দায়িত্ব ঘাড়ে চেপে বসার মতো গরম জিএম সাহেবের নরম সুর আমাকে অধিকতর দায়িত্বের ফাঁদে ফেলে দিল। দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে নিজের অফিসে ফিরে দেখি জিএম সাহেবের আত্মীয়রা মহা খুশিতে চা-নাশতা উপভোগে মগ্ন। কারণ অতি সহজেই তাঁরা পাঁচ লাখ টাকার ঋণ পেয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের খুশির আমেজ আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এনে দিল। তাঁদের বললাম, ‘আপনারা খুবই ভাগ্যবান। আমাদের জিএম সাহেব, অর্থাৎ আপনাদের ছেলে, সরকারি জয়েন্ট সেক্রেটারি লেভেলের একজন উচ্চপর্যায়ের অফিসার হওয়া সত্ত্বেও আপনাদের মতো গ্রামের আত্মীয়-স্বজনদের যে সম্মান দেখালেন তা সত্যিই অভাবনীয়।’ আমার এমন কথায় তাঁরা আরও পুলকিত হলেন। তাঁদের সেই বাড়তি খুশির সুযোগ নিয়ে বললাম, ‘আপনারা জিএম সাহেবকে কতটুকু ভালোবাসেন?’ সগর্ব জবাব, ‘অনেক’। তখন আবারও বললাম, ‘ওনার কোনো বিপদ হলে আপনারা কী করবেন?’ দৃঢ় জবাব, ‘আমরা রুখে দাঁড়াব।’ আমি তখন বললাম, ‘আপনাদের লোন দিতে গিয়ে যদি ওনার কোনো অসুবিধা হয়?’ তাঁরা অবলীলায় বলে উঠলেন, ‘তাহলে এই লোনই নেব না।’ তখন আমি বললাম, ‘উনি তো তাতে অনেক কষ্ট পাবেন এবং লজ্জাও পাবেন। কিন্তু তাঁকে আপনারা অনেক ভালোবাসেন। অথচ আপনাদের জন্য তিনি কিছুই করতে পারছেন না।’ তখন তাঁরা দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘আমরা তাঁর কাছে আর যাবই না।’ তখন মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। দেখুন, যে চাপের কথা বলা হলো তা কীভাবে ম্যানেজ হয়ে গেল। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। আসলে ‘চাপ’ সাপের মতোই দুর্বল, যা লাঠিকে ভয় পায়। তাই সৎ ও সাহসী দক্ষতা দিয়ে লাঠিকে বাঁচিয়েও সাপ মারা যায়।
এরপরও সমালোচকেরা হয়তো বলবেন, ‘আগের চাপ আর এখনকার চাপ এক নয়।’ এর জবাবে বলতেই হয়, চাপের কোনো নির্দিষ্ট বাপ নেই, সময়ও নেই। যে তাকে দমাতে পারে, সে-ই তার বাপ এবং তখনই হয় তার নিষ্ঠুর ‘শেষ সময়’। পরিশেষে বলি, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহসী কৌশল চাপ সামলাতে অবশ্যই সহায়ক হতে পারে যদি কাজের ওপর কর্তার প্রকৃত দক্ষতা থাকে। তাই বলতে হয়, দক্ষ কর্মীর নিরাপদ হাত মানেই একটি বিজয়ী হাত। আসুন, আমরা কাজের ‘নুক্তা’ বের না করে মনোযোগ দিয়ে সঠিক কাজ করে তার সর্বজনীন সুফল দিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরের গতি ফেরাই।
লেখক: সাবেক এমডি সোনালী ও রূপালী ব্যাংক।
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
১১ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
১২ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
১২ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
১২ ঘণ্টা আগে