জাহীদ রেজা নূর
স্কুলড্রেস পরিহিত শিক্ষার্থীদের দেখা গেল রোববারের রাস্তায়। স্কুলের সামনের রাস্তাগুলোয় মৃদু যানজট। যে ছেলেমেয়েরা স্কুলে ঢুকছিল, তাদের চোখে-মুখে ছিল আনন্দের প্রকাশ। করোনার ভয়াবহতায় থমকে দাঁড়িয়েছিল শিক্ষাব্যবস্থা। অনলাইন ক্লাসের সুযোগ সবাই পায়নি। বাংলাদেশের সাড়ে তিন কোটি শিশু বহুদিন ছিল স্কুলবঞ্চিত। এবার তাদের মধ্যে এসেছে প্রাণচাঞ্চল্য।
দেড় বছর শিক্ষার্থীরা স্কুলমুখো হতে পারেনি, ভাবা যায়!
স্কুল নিয়ে কিছু প্রশ্ন তোলা দরকার এখনই। শুধু স্কুলের জন্য নির্দিষ্ট করা বইগুলো গেলানোর জন্যই তো স্কুল নয়, শিশুর আচরণ, কল্পনাশক্তির বিকাশ, পরমতসহিষ্ণুতা, বন্ধুত্বসহ জীবন গড়ে দেওয়ার একটা ক্ষেত্রও বটে। বাড়ির পরে স্কুলই সে দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু শিক্ষার সে ক্ষেত্রটি কি ঠিকভাবে কাজ করছে?
প্রথমেই স্বীকার করে নিতে হবে, ভালো মানুষের চেয়ে নম্বর বেশি পাওয়া মানুষ তৈরির কারখানা হিসেবে স্কুলকে অলিখিত স্বীকৃতি দিয়েছেন অভিভাবকদের বড় একটি অংশ। শিক্ষকদের বড় একটা অংশও চান, শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকে যেন এক একজন জিপিএ ফাইভপ্রাপ্তির সৈনিক হয়ে ওঠে। সে কাজটি স্কুলে না হলে আছে কোচিং সেন্টার। কোচিং সেন্টারই গ্যারান্টি দিচ্ছে শিশুর ‘সার্বিক উন্নয়নে’র। ‘সার্বিক উন্নয়ন’ মানে হলো জিপিএ ফাইভপ্রাপ্তি।
দুই. সোভিয়েত ইউনিয়নের রুশ ফেডারেশনের ক্রাসনাদার শহরে ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে আমার পড়াশোনা। মাস্টার্সের ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে এক মাস ক্লাস নিতে হয়েছিল। স্কুলে ক্লাস নিতে যাওয়ার আগে আমার গাইড গেওর্গি পাভলোভিচ নেমেৎস্ বলেছিলেন, ‘তুমি কিন্তু ওদের স্কুলের বই মুখস্থ করাবে না। নতুন বিষয়ে কথা বলবে, যেন ওদের জানার আগ্রহ বাড়ে।’
‘সেটা কী রকম?’
‘তুমি এমন কিছু বলবে, যা ওদের সৃজনশীল মনের বিকাশ ঘটায়। ওরা যেন যুক্তি দিয়ে ভাবতে শেখে।’
স্কুলটা ছিল ভাসতোচনোয়ে দিপো, অর্থাৎ ট্রামের দক্ষিণ ডিপোর কাছে। প্রথম দিনেই ছাত্রছাত্রীদের কাছে জানতে চাইলাম, ‘তোমরা আমার সঙ্গে কী নিয়ে কথা বলতে চাও?’
‘আপনার দেশ নিয়ে।’
আমাদের দেশ সম্পর্কে কী কী জানে, এই প্রশ্নের উত্তরে কিছু মজার ও কিছু উদ্ভট কথা বলল ওরা। তারাবাতিকে রুশ ভাষায় বলা হয় ‘বেঙ্গালস্কি আগোন’, মানে ‘বাংলার আগুন’। সে কথা বলে একজন বলল, ‘তারাবাতি আপনাদের দেশ থেকে এসেছে।’ আরেকজন বলল, ‘বেঙ্গালস্কি তিগর আপনাদের রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়।’ রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে ওরা ‘বাংলার বাঘ’ বলে থাকে।
আমাদের ক্লাসগুলো এরপর থেকে চলে গেল বাংলার সংস্কৃতি, সাহিত্য, প্রকৃতির দখলে। বাংলার লোকসংস্কৃতির প্রতি শিক্ষার্থীদের প্রবল আগ্রহ দেখা গেল। ষাঁড়ের লড়াই, নৌকাবাইচ, মোরগের লড়াই, লাঠিখেলা, বায়োস্কোপ ইত্যাদির কথা শুনল ওরা তন্ময় হয়ে। বাংলার রূপকথার প্রতি ছিল আগ্রহ। ডালিম কুমার, লাল কমল-নীল কমল শুনে ওরা ওদের দেশে প্রচলিত রূপকথার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটাল।
তিন. ঘটনাটি আমার মনে জুগিয়েছিল ভাবনার খোরাক। রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের দেশের মিলই নেই। অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া শিশুদের কাছে এ রকম অজানা একটি দেশের লোকসংস্কৃতি এতটা আকর্ষণীয় হয়ে উঠল কেন?
উত্তরটা আসলে ছিল হাতের কাছেই। আমরা যখন অনার্স প্রথম বর্ষে ক্লাস শুরু করেছি, তখনই সিলেবাসে রুশ লোকসংস্কৃতির আলাদা ক্লাস ছিল। শহর থেকে অনেক দূরে বুড়ি দাদিমাদের কাছে গিয়েছি, প্রচলিত গল্প তাঁদের মুখে শোনার জন্য। তখনই মনে হয়েছে, দাদি, মা, ফুফু, খালারাও তো একসময় আমাদের রূপকথার গল্প শুনিয়েছেন। মায়ের মুখে কতবার যে ‘সুখী আর দুঃখী’র গল্প শুনেছি!
রাশিয়ার স্কুলগুলোয় লোকসংস্কৃতি পড়াশোনার অঙ্গ। রূপকথার রাজ্যে রুশ শিশুদের অধিকার ষোলো আনা। কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে দেওয়া, মানবিক ভাবনা মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজগুলো এভাবেই হয়ে যায়। পড়ালেখা জীবনের বাইরের কিছু নয়, সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্কুলের শিক্ষা শিশুদের শুধু বইপোকা হতে শেখাবে না, মানবিকও করে তুলবে, সেটাই তো কাম্য।
চার. আমরা লক্ষ করলে দেখব, সত্যিকার অর্থে শিশুদের সৃজনশীলতার পায়েই কুঠার মারা হয়েছে। সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরও গাইড বইয়ে পাওয়া যায়, ভাবা যায়! একটা বলয়ের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে শিশুকে। খাতাভর্তি বাড়ির কাজ দেওয়াই সার! স্কুলে এতটা সময় কাটিয়ে আবার বাড়িতেও স্কুলের বোঝা বইতে হবে–এ কোনো কাজের কথা নয়। তারপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা–কোচিং!
স্কুলের আসল উদ্দেশ্য তো মানুষ তৈরি করা, এ জন্যই শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ তৈরির কারিগর। এখন স্কুলগুলোর কাজ হয়ে উঠেছে স্কুলে অবশ্যপাঠ্য বইগুলোর মাধ্যমে শিশুদের তোতাপাখি করে তোলা। কী পড়া হচ্ছে, তার সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক কী, সেটা ঊহ্যই থেকে যাচ্ছে। শিক্ষালয়ের সর্বোচ্চ ভাবনা হলো, জেএসসি কিংবা এসএসসি পরীক্ষায় ভালোভাবে উতরে যাওয়া। শিক্ষা নয়, পরীক্ষাই মূল লক্ষ্য!
কিন্তু পরীক্ষা তো শিশুকে দেশের সুনাগরিক হতে শেখায় না, ব্যক্তিত্ব বিকাশ করতে শেখায় না, দেশপ্রেমিক করে তোলে না। এসব তো হয় শিক্ষার্থী-শিক্ষকের মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। শিশুকে সেভাবে তৈরি করার জন্য শিক্ষককেও তো প্রস্তুত হতে হয় সেভাবেই। সেটা না থাকায় শিশুরা ওই পরীক্ষাকেই জীবনের ধ্যান-জ্ঞান বলে স্বীকার করে নিয়েছে। মূল লক্ষ্যটাই গেছে বদলে।
পাঁচ. প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ বিভিন্ন রকম। কেউ অঙ্কে ১০০ পাবে, কেউ পাবে ৩৫। কারও ‘আউট বই’ পড়তে ভালো লাগবে, কেউ ক্রিকেট মাঠে মারবে ছক্কা। কেউ বিতর্ক করবে, কেউ দাবা খেলবে–এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সবাইকে যদি সবগুলোতেই তুখোড় হতে হয়, তাহলে তো বৈচিত্র্যই থাকবে না সমাজে। যে বিষয়গুলো শিশুকে শিখে নিতে হবে তা হলো—ভাবা, যুক্তি দিয়ে বিচার করা, পরিকল্পনা করা। এগুলো যদি শিশুর বিকাশের সঙ্গী না হয়, তাহলে তো জিপিএ ফাইভ যন্ত্রের জন্ম হতেই থাকবে!
স্মার্টফোন প্রজন্মের জন্য প্রথাগত পড়াশোনার জায়গায় পরিবর্তন আনার কথাও কিন্তু ভাবতে হবে। স্কুল হতে হবে আনন্দের জায়গা, যেন সকাল হওয়ার আগে থেকেই শিশুরা স্কুলে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে ওঠে।
কিন্তু আদতে হচ্ছেটা কী? শিশুরা চায়, তাকে গুরুত্ব দেওয়া হোক। স্কুলগুলোতে কে বেশি গুরুত্ব পায়—শিশু নাকি রসকষহীন বইগুলো? একটু ভেবে উত্তর দিন। শিশু নিজে গুরুত্ব না পেলে জীবনের শুরু থেকেই এই প্রক্রিয়াকে সে নেতিবাচকভাবে গ্রহণ করবে এবং সে যন্ত্র হয়ে যাবে অনায়াসে।
ছয়. স্কুলে তো শিশুর নৈতিক বিকাশ ঘটবে, সংস্কৃতির মধ্যে লালিত হবে সে, ভালোবাসবে দেশকে, বিশ্বকে, পরিবার ও স্বজনদের প্রতি তার মনে জন্মাবে ভালোবাসা। ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে সে জীবনকে দেখবে। স্কুল যদি শিশুর মনে এ বিষয়গুলো ঢুকিয়ে দিতে না পারে, তাহলে যে সমাজটা তৈরি হবে, তার নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হতে বাধ্য। এত যে ঘুষের
রাজত্ব সর্বত্র, তার পেছনে কি এ দুর্বলতাটি প্রচ্ছন্ন নেই?
বদলে যাওয়া পৃথিবীতে নতুন ধরনের শিক্ষকও চাই, যাঁরা এই পেশাটাকে যান্ত্রিক পেশা ভাববেন না। (এখানে বলে রাখা দরকার, আমাদের স্কুলগুলোয় আন্তরিক শিক্ষক কিন্তু আছেন, তবে তাঁরা দিনে দিনে বিরল হয়ে পড়ছেন)। এই শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের ভালোবাসবেন এবং তাঁদের ভেতরের ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো মেলে ধরবেন। শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীকে ভালো না বাসেন, তাহলে শিক্ষার্থীও শিক্ষককে ভালো বাসবে না। শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তাতে শিক্ষার্থীদের ভালোবাসার ওপর বেশি নম্বরের ক্লাস থাকা দরকার এবং সেই প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেরা শিক্ষক নিজের শিক্ষকজীবনে সেটা অনুসরণ করছেন কি না, সেটাও দেখা দরকার।
এ বিষয়ে আরও কিছু বলার আছে। আলোচনাটা চলবে আরও।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
স্কুলড্রেস পরিহিত শিক্ষার্থীদের দেখা গেল রোববারের রাস্তায়। স্কুলের সামনের রাস্তাগুলোয় মৃদু যানজট। যে ছেলেমেয়েরা স্কুলে ঢুকছিল, তাদের চোখে-মুখে ছিল আনন্দের প্রকাশ। করোনার ভয়াবহতায় থমকে দাঁড়িয়েছিল শিক্ষাব্যবস্থা। অনলাইন ক্লাসের সুযোগ সবাই পায়নি। বাংলাদেশের সাড়ে তিন কোটি শিশু বহুদিন ছিল স্কুলবঞ্চিত। এবার তাদের মধ্যে এসেছে প্রাণচাঞ্চল্য।
দেড় বছর শিক্ষার্থীরা স্কুলমুখো হতে পারেনি, ভাবা যায়!
স্কুল নিয়ে কিছু প্রশ্ন তোলা দরকার এখনই। শুধু স্কুলের জন্য নির্দিষ্ট করা বইগুলো গেলানোর জন্যই তো স্কুল নয়, শিশুর আচরণ, কল্পনাশক্তির বিকাশ, পরমতসহিষ্ণুতা, বন্ধুত্বসহ জীবন গড়ে দেওয়ার একটা ক্ষেত্রও বটে। বাড়ির পরে স্কুলই সে দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু শিক্ষার সে ক্ষেত্রটি কি ঠিকভাবে কাজ করছে?
প্রথমেই স্বীকার করে নিতে হবে, ভালো মানুষের চেয়ে নম্বর বেশি পাওয়া মানুষ তৈরির কারখানা হিসেবে স্কুলকে অলিখিত স্বীকৃতি দিয়েছেন অভিভাবকদের বড় একটি অংশ। শিক্ষকদের বড় একটা অংশও চান, শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকে যেন এক একজন জিপিএ ফাইভপ্রাপ্তির সৈনিক হয়ে ওঠে। সে কাজটি স্কুলে না হলে আছে কোচিং সেন্টার। কোচিং সেন্টারই গ্যারান্টি দিচ্ছে শিশুর ‘সার্বিক উন্নয়নে’র। ‘সার্বিক উন্নয়ন’ মানে হলো জিপিএ ফাইভপ্রাপ্তি।
দুই. সোভিয়েত ইউনিয়নের রুশ ফেডারেশনের ক্রাসনাদার শহরে ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে আমার পড়াশোনা। মাস্টার্সের ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে এক মাস ক্লাস নিতে হয়েছিল। স্কুলে ক্লাস নিতে যাওয়ার আগে আমার গাইড গেওর্গি পাভলোভিচ নেমেৎস্ বলেছিলেন, ‘তুমি কিন্তু ওদের স্কুলের বই মুখস্থ করাবে না। নতুন বিষয়ে কথা বলবে, যেন ওদের জানার আগ্রহ বাড়ে।’
‘সেটা কী রকম?’
‘তুমি এমন কিছু বলবে, যা ওদের সৃজনশীল মনের বিকাশ ঘটায়। ওরা যেন যুক্তি দিয়ে ভাবতে শেখে।’
স্কুলটা ছিল ভাসতোচনোয়ে দিপো, অর্থাৎ ট্রামের দক্ষিণ ডিপোর কাছে। প্রথম দিনেই ছাত্রছাত্রীদের কাছে জানতে চাইলাম, ‘তোমরা আমার সঙ্গে কী নিয়ে কথা বলতে চাও?’
‘আপনার দেশ নিয়ে।’
আমাদের দেশ সম্পর্কে কী কী জানে, এই প্রশ্নের উত্তরে কিছু মজার ও কিছু উদ্ভট কথা বলল ওরা। তারাবাতিকে রুশ ভাষায় বলা হয় ‘বেঙ্গালস্কি আগোন’, মানে ‘বাংলার আগুন’। সে কথা বলে একজন বলল, ‘তারাবাতি আপনাদের দেশ থেকে এসেছে।’ আরেকজন বলল, ‘বেঙ্গালস্কি তিগর আপনাদের রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়।’ রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে ওরা ‘বাংলার বাঘ’ বলে থাকে।
আমাদের ক্লাসগুলো এরপর থেকে চলে গেল বাংলার সংস্কৃতি, সাহিত্য, প্রকৃতির দখলে। বাংলার লোকসংস্কৃতির প্রতি শিক্ষার্থীদের প্রবল আগ্রহ দেখা গেল। ষাঁড়ের লড়াই, নৌকাবাইচ, মোরগের লড়াই, লাঠিখেলা, বায়োস্কোপ ইত্যাদির কথা শুনল ওরা তন্ময় হয়ে। বাংলার রূপকথার প্রতি ছিল আগ্রহ। ডালিম কুমার, লাল কমল-নীল কমল শুনে ওরা ওদের দেশে প্রচলিত রূপকথার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটাল।
তিন. ঘটনাটি আমার মনে জুগিয়েছিল ভাবনার খোরাক। রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের দেশের মিলই নেই। অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া শিশুদের কাছে এ রকম অজানা একটি দেশের লোকসংস্কৃতি এতটা আকর্ষণীয় হয়ে উঠল কেন?
উত্তরটা আসলে ছিল হাতের কাছেই। আমরা যখন অনার্স প্রথম বর্ষে ক্লাস শুরু করেছি, তখনই সিলেবাসে রুশ লোকসংস্কৃতির আলাদা ক্লাস ছিল। শহর থেকে অনেক দূরে বুড়ি দাদিমাদের কাছে গিয়েছি, প্রচলিত গল্প তাঁদের মুখে শোনার জন্য। তখনই মনে হয়েছে, দাদি, মা, ফুফু, খালারাও তো একসময় আমাদের রূপকথার গল্প শুনিয়েছেন। মায়ের মুখে কতবার যে ‘সুখী আর দুঃখী’র গল্প শুনেছি!
রাশিয়ার স্কুলগুলোয় লোকসংস্কৃতি পড়াশোনার অঙ্গ। রূপকথার রাজ্যে রুশ শিশুদের অধিকার ষোলো আনা। কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে দেওয়া, মানবিক ভাবনা মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজগুলো এভাবেই হয়ে যায়। পড়ালেখা জীবনের বাইরের কিছু নয়, সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্কুলের শিক্ষা শিশুদের শুধু বইপোকা হতে শেখাবে না, মানবিকও করে তুলবে, সেটাই তো কাম্য।
চার. আমরা লক্ষ করলে দেখব, সত্যিকার অর্থে শিশুদের সৃজনশীলতার পায়েই কুঠার মারা হয়েছে। সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরও গাইড বইয়ে পাওয়া যায়, ভাবা যায়! একটা বলয়ের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে শিশুকে। খাতাভর্তি বাড়ির কাজ দেওয়াই সার! স্কুলে এতটা সময় কাটিয়ে আবার বাড়িতেও স্কুলের বোঝা বইতে হবে–এ কোনো কাজের কথা নয়। তারপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা–কোচিং!
স্কুলের আসল উদ্দেশ্য তো মানুষ তৈরি করা, এ জন্যই শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ তৈরির কারিগর। এখন স্কুলগুলোর কাজ হয়ে উঠেছে স্কুলে অবশ্যপাঠ্য বইগুলোর মাধ্যমে শিশুদের তোতাপাখি করে তোলা। কী পড়া হচ্ছে, তার সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক কী, সেটা ঊহ্যই থেকে যাচ্ছে। শিক্ষালয়ের সর্বোচ্চ ভাবনা হলো, জেএসসি কিংবা এসএসসি পরীক্ষায় ভালোভাবে উতরে যাওয়া। শিক্ষা নয়, পরীক্ষাই মূল লক্ষ্য!
কিন্তু পরীক্ষা তো শিশুকে দেশের সুনাগরিক হতে শেখায় না, ব্যক্তিত্ব বিকাশ করতে শেখায় না, দেশপ্রেমিক করে তোলে না। এসব তো হয় শিক্ষার্থী-শিক্ষকের মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। শিশুকে সেভাবে তৈরি করার জন্য শিক্ষককেও তো প্রস্তুত হতে হয় সেভাবেই। সেটা না থাকায় শিশুরা ওই পরীক্ষাকেই জীবনের ধ্যান-জ্ঞান বলে স্বীকার করে নিয়েছে। মূল লক্ষ্যটাই গেছে বদলে।
পাঁচ. প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ বিভিন্ন রকম। কেউ অঙ্কে ১০০ পাবে, কেউ পাবে ৩৫। কারও ‘আউট বই’ পড়তে ভালো লাগবে, কেউ ক্রিকেট মাঠে মারবে ছক্কা। কেউ বিতর্ক করবে, কেউ দাবা খেলবে–এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সবাইকে যদি সবগুলোতেই তুখোড় হতে হয়, তাহলে তো বৈচিত্র্যই থাকবে না সমাজে। যে বিষয়গুলো শিশুকে শিখে নিতে হবে তা হলো—ভাবা, যুক্তি দিয়ে বিচার করা, পরিকল্পনা করা। এগুলো যদি শিশুর বিকাশের সঙ্গী না হয়, তাহলে তো জিপিএ ফাইভ যন্ত্রের জন্ম হতেই থাকবে!
স্মার্টফোন প্রজন্মের জন্য প্রথাগত পড়াশোনার জায়গায় পরিবর্তন আনার কথাও কিন্তু ভাবতে হবে। স্কুল হতে হবে আনন্দের জায়গা, যেন সকাল হওয়ার আগে থেকেই শিশুরা স্কুলে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে ওঠে।
কিন্তু আদতে হচ্ছেটা কী? শিশুরা চায়, তাকে গুরুত্ব দেওয়া হোক। স্কুলগুলোতে কে বেশি গুরুত্ব পায়—শিশু নাকি রসকষহীন বইগুলো? একটু ভেবে উত্তর দিন। শিশু নিজে গুরুত্ব না পেলে জীবনের শুরু থেকেই এই প্রক্রিয়াকে সে নেতিবাচকভাবে গ্রহণ করবে এবং সে যন্ত্র হয়ে যাবে অনায়াসে।
ছয়. স্কুলে তো শিশুর নৈতিক বিকাশ ঘটবে, সংস্কৃতির মধ্যে লালিত হবে সে, ভালোবাসবে দেশকে, বিশ্বকে, পরিবার ও স্বজনদের প্রতি তার মনে জন্মাবে ভালোবাসা। ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে সে জীবনকে দেখবে। স্কুল যদি শিশুর মনে এ বিষয়গুলো ঢুকিয়ে দিতে না পারে, তাহলে যে সমাজটা তৈরি হবে, তার নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হতে বাধ্য। এত যে ঘুষের
রাজত্ব সর্বত্র, তার পেছনে কি এ দুর্বলতাটি প্রচ্ছন্ন নেই?
বদলে যাওয়া পৃথিবীতে নতুন ধরনের শিক্ষকও চাই, যাঁরা এই পেশাটাকে যান্ত্রিক পেশা ভাববেন না। (এখানে বলে রাখা দরকার, আমাদের স্কুলগুলোয় আন্তরিক শিক্ষক কিন্তু আছেন, তবে তাঁরা দিনে দিনে বিরল হয়ে পড়ছেন)। এই শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের ভালোবাসবেন এবং তাঁদের ভেতরের ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো মেলে ধরবেন। শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীকে ভালো না বাসেন, তাহলে শিক্ষার্থীও শিক্ষককে ভালো বাসবে না। শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তাতে শিক্ষার্থীদের ভালোবাসার ওপর বেশি নম্বরের ক্লাস থাকা দরকার এবং সেই প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেরা শিক্ষক নিজের শিক্ষকজীবনে সেটা অনুসরণ করছেন কি না, সেটাও দেখা দরকার।
এ বিষয়ে আরও কিছু বলার আছে। আলোচনাটা চলবে আরও।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
৫ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
৬ ঘণ্টা আগে