অর্ণব সান্যাল
এ দেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সৃষ্টি এবং তাতে শরিক হওয়ার ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। সেই ইতিহাস আদতে বাংলাদেশের জন্মের চেয়েও পুরোনো। ইতিহাসবিদেরা প্রায়ই বলে থাকেন, ছাত্র আন্দোলনের কারণেই এ দেশের স্বাধীকারের সংগ্রাম গতি পেয়েছিল। আর এমন ঐতিহ্য থাকা এক দেশেই এখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পেটানোর ছবি সংবাদমাধ্যমের পাতায় বড় করে ছাপা হয়। সেই সঙ্গে শিরোনামে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও হল ছাড়ার ঘোষণার কথা। কিন্তু আন্দোলন হলেই কেন শিক্ষার্থীদের বের করে দিতে হবে?
এই প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শোনাবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জানমালের নিরাপত্তা, শিক্ষার্থীদের কথিত ‘উগ্র’ মনোভাব, ‘অহেতুক’ আন্দোলন ইত্যাদি ইত্যাদি। হ্যাঁ, তা বলতেই পারেন। তবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের এমন আন্দোলনের খবর এখন বেশ নিয়মিত বিরতিতেই পাওয়া যায়। সেগুলোর ময়নাতদন্ত করলে কিছু চিত্র বেশ স্পষ্ট এবং নিয়মিত আমাদের সামনে ধরা দেয়। প্রথমত, আন্দোলনের শুরুর দিকে কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ পাত্তা দিতে চায় না। দ্বিতীয়ত, কখনো কখনো একধরনের সাময়িক পদক্ষেপ নেওয়া হয় এবং তার পরেই শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলনের পরিধি বিস্তৃত করে। তৃতীয়ত, এর ঠিক পরপরই আন্দোলনরতদের ওপর বলপ্রয়োগের, বিশেষ করে লাঠিপেটার খবর মেলে। তাতে যেমন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া যায়, তেমনি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের অংশগ্রহণেরও চিত্র দেখতে হয়। এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন আরও জোরদার হওয়ার ইঙ্গিত পেলে আসে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা, হল ত্যাগ করার নির্দেশ।
ঠিক এমনটাই দেখা যাচ্ছে এখন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি)। সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, অসদাচরণের অভিযোগ এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী ছাত্রী হলের প্রভোস্ট কমিটির পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে গত শনিবার সন্ধ্যায় আন্দোলনরত ছাত্রীদের ওপর হামলা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আন্দোলন চলাকালে গত রোববার সন্ধ্যায় পুলিশের লাঠিপেটায় অর্ধশতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, রোববার সকালে সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের অর্ধশতাধিক ছাত্রী তিন দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ প্রধান রাস্তা ‘কিলো সড়ক’ অবরোধ করেছিলেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে কথা বলেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিন, প্রক্টর ড. আলমগীর কবীর, ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক জহীর উদ্দীন আহমদ, শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. তুলসী কুমার দাসসহ অন্যরা। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি প্রশাসন ও শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মুখে পড়েন। তাঁকে একটি ভবনে অবরুদ্ধ করা হয়। তখন উপাচার্যকে মুক্ত করতে যান পুলিশ সদস্যরা। কিন্তু শিক্ষার্থীরা পুলিশকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেন। এ নিয়ে ধাক্কাধাক্কির একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা শুরু করে পুলিশ। শিক্ষার্থীরাও তখন পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। পরে উপাচার্যকে উদ্ধার করে তাঁর বাসভবনে নিয়ে যায় পুলিশ। বলা হচ্ছে, পুলিশের হামলা ও লাঠিপেটায় আহতদের মধ্যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী—দুই পক্ষই আছে। যদিও পুলিশ বলছে, তারা শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়নি। তবে সংবাদমাধ্যমের কাছে আসা ছবি সেই দাবিকে সমর্থন করছে না।
এরপরই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় শাবিপ্রবি। উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ এই তথ্য জানিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছেন, বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ (লিজা) ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছেন। তাঁর জায়গায় নতুন প্রাধ্যক্ষ হিসেবে অধ্যাপক নাজিয়া চৌধুরীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ যাঁকে নিয়ে অভিযোগ, তিনি অন্তত পদ থেকে সরে গেছেন।
সব মিলিয়ে বলাই যায় যে, শাবিপ্রবি এখন ক্ষোভে উত্তাল। যদি এ ঘটনার আপাত বিশ্লেষণও করেন, তাহলে লেখার শুরুর দিকে দেওয়া চিত্রনাট্যের সঙ্গে মিল পাবেন। কিছুদিন আগে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়েও এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ক্ষোভে উত্তাল হয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। সেখানেও অনেকটা একই প্রবাহে ঘটনা এগিয়েছে বটে। অর্থাৎ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে থাকা ‘সিস্টেম’ ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের একধরনের ক্ষোভ দীর্ঘদিন ধরেই আছে। সেটির যে কোনো কার্যকর সমাধান হচ্ছে না, তা প্রমাণ করে দিচ্ছে কয়েক দিন পর পর ঘটা আন্দোলনগুলোই। বরং ক্ষোভ প্রশমনের চেয়ে তা দমনের পথেই যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এবং তাতেই একধরনের স্থায়ী ক্ষত তৈরি হচ্ছে শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্কে। এই ক্ষত অবিশ্বাসের, অনাস্থার।
দমনের মাধ্যমে এই পৃথিবীতে কোনো বিক্ষোভই নিভিয়ে দেওয়া যায়নি। কর্তৃপক্ষ বলতেই পারে, সব দাবি ন্যায্য বা বাস্তবানুগ হতে পারে না। ঠিক আছে, তাহলে আলোচনা তো করাই যায়। আলোচনার টেবিলে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো শান্তিপূর্ণ সমাধান বের হয়েই আসবে। যাঁরা পড়াশোনা ফেলে আন্দোলন করছেন রাস্তায়, তাঁদের নিশ্চয়ই আসল কাজ ছেড়ে গলা ফাটিয়ে দাবি জানানোর শখ নেই। কারণ পরিশেষে ক্ষতিটা তাঁদেরই হয় এবং তা বোঝার মতো বয়স তাঁদেরও হয়েছে। দেখতে হবে যে, তাঁদের সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়ে গেছে কি না। শিক্ষকেরা বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন শিক্ষার্থীদের অধিকার লঙ্ঘনের মতো কাজ বারংবার করে যাচ্ছেন কি না।
এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তেমনটা হওয়ার অসংখ্য উপাদান আছে। লেজুড়বৃত্তি ও অযাচিত ক্ষমতার অপব্যবহারের ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। সমালোচনা আছে অযোগ্য ও দলান্ধ শিক্ষক নিয়োগ নিয়েও। ওদিকে শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে ‘ক্ষমতাবান’ ছাত্র সংগঠনগুলোর মাথায় ব্যথা নেই দীর্ঘদিন ধরেই। বরং গেস্টরুমে প্রতি রাতের জমায়েত কেমন হলো, কোন কমিটিতে কে নেতা-নেত্রী হলো এবং তদনগদ অভিনন্দন জানানোর জোয়ারে গা ভাসাতেই ব্যস্ত থাকে সবাই। ‘ক্ষমতা’র বলয়ে না থাকা যেসব সংগঠন দু-একটা কথা এত দিন ধরে বলত কিছু কিছু, তারাও সময়ের বিচারে হালনাগাদ হয়নি। ফলে গত কিছুদিন ধরে আমরা কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থাকা শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নেমে আসতে দেখছি। তারা খেপে যাচ্ছে ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে চুল কেটে দেওয়ায়। তাদের দাবিনামার মধ্যে থাকছে হলের যাবতীয় অব্যবস্থাপনা নির্মূল করা বা হলের, শিক্ষার স্বাভাবিক সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়গুলো। অথচ নানা কাজে ‘বিখ্যাত’ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনেরই এসব দাবি তোলার কথা ছিল। সেই সব ছাত্র সংগঠন এবং ওই সব নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের পারফরম্যান্স যে করুণ, সেটি দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। যদিও চোখে ঠুলি পরা থাকলে এবং সহমতের প্লাবনে ভেসে যাওয়ার কালে এসব স্পষ্টতা আর চোখে ধরে না; বরং কলম ধরা হাতে হকিস্টিক বা লাঠি উঠে বগল বাজায়।
অথচ এ দেশের জন্মের কালে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যূথবদ্ধ আন্দোলনের কথা আমরা শুনি প্রায়ই। সেই সোনালি দিনগুলোর কথা অবশ্য নতুন প্রজন্মের কাছে ‘গল্প’ বলে ভ্রম হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এখন ভাবার সময় এসেছে যে কেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভাবনাগত জায়গায় তাঁদের সমুদ্রসমান ফারাক তৈরি হয়েছে। কেন স্বাধীন বাংলাদেশে সেই ফারাক দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। কেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকসংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সমস্যার সমাধানে একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না। মনে রাখতে হবে, ১৯৭১ সালের আগে শিক্ষার্থীদের উদ্দীপ্ত করেছিলেন শিক্ষকেরাই। সেই শ্রদ্ধার আসন এখন টলে গেছে, নাকি একদমই অস্তিত্বহীন, তার মূল কারণ খোঁজার সময় এসে গেছে। এবং শিক্ষাগুরু হিসেবে শিক্ষকদেরই তাতে বেশি উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। কারণ ঐতিহ্যবাহী পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্কটা উবে গেলে তাঁরা আর গর্ব করবেন কী নিয়ে? নাকি সেখানে এখন সুপিরিয়র-ইনফিরিয়রের রাজত্ব চলছে?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষকে এখন ভাবতে হবে, তারা আসলে শিক্ষার্থীদের কী শিক্ষা দিতে চায়। শিক্ষার্থীরা কি শিখে নেবে যে দমনে দাবিনামা বিধ্বস্ত করাই ক্ষোভ মেটানোর প্রকৃত পন্থা? নাকি একসঙ্গে বসে এক পরিবারের মতো যূথবদ্ধ যৌক্তিক আলাপ? ভবিষ্যতে আন্দোলনের কারণে আরও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা আমরা পেলে বুঝে নিতে হবে—‘কিল মারার গোঁসাই’ জয়যুক্ত হয়েছে, জয়যুক্ত হয়েছে, জয়যুক্ত হয়েছে!
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
এ দেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সৃষ্টি এবং তাতে শরিক হওয়ার ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। সেই ইতিহাস আদতে বাংলাদেশের জন্মের চেয়েও পুরোনো। ইতিহাসবিদেরা প্রায়ই বলে থাকেন, ছাত্র আন্দোলনের কারণেই এ দেশের স্বাধীকারের সংগ্রাম গতি পেয়েছিল। আর এমন ঐতিহ্য থাকা এক দেশেই এখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পেটানোর ছবি সংবাদমাধ্যমের পাতায় বড় করে ছাপা হয়। সেই সঙ্গে শিরোনামে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও হল ছাড়ার ঘোষণার কথা। কিন্তু আন্দোলন হলেই কেন শিক্ষার্থীদের বের করে দিতে হবে?
এই প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শোনাবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জানমালের নিরাপত্তা, শিক্ষার্থীদের কথিত ‘উগ্র’ মনোভাব, ‘অহেতুক’ আন্দোলন ইত্যাদি ইত্যাদি। হ্যাঁ, তা বলতেই পারেন। তবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের এমন আন্দোলনের খবর এখন বেশ নিয়মিত বিরতিতেই পাওয়া যায়। সেগুলোর ময়নাতদন্ত করলে কিছু চিত্র বেশ স্পষ্ট এবং নিয়মিত আমাদের সামনে ধরা দেয়। প্রথমত, আন্দোলনের শুরুর দিকে কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ পাত্তা দিতে চায় না। দ্বিতীয়ত, কখনো কখনো একধরনের সাময়িক পদক্ষেপ নেওয়া হয় এবং তার পরেই শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলনের পরিধি বিস্তৃত করে। তৃতীয়ত, এর ঠিক পরপরই আন্দোলনরতদের ওপর বলপ্রয়োগের, বিশেষ করে লাঠিপেটার খবর মেলে। তাতে যেমন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া যায়, তেমনি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের অংশগ্রহণেরও চিত্র দেখতে হয়। এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন আরও জোরদার হওয়ার ইঙ্গিত পেলে আসে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা, হল ত্যাগ করার নির্দেশ।
ঠিক এমনটাই দেখা যাচ্ছে এখন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি)। সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, অসদাচরণের অভিযোগ এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী ছাত্রী হলের প্রভোস্ট কমিটির পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে গত শনিবার সন্ধ্যায় আন্দোলনরত ছাত্রীদের ওপর হামলা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আন্দোলন চলাকালে গত রোববার সন্ধ্যায় পুলিশের লাঠিপেটায় অর্ধশতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, রোববার সকালে সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের অর্ধশতাধিক ছাত্রী তিন দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ প্রধান রাস্তা ‘কিলো সড়ক’ অবরোধ করেছিলেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে কথা বলেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিন, প্রক্টর ড. আলমগীর কবীর, ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক জহীর উদ্দীন আহমদ, শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. তুলসী কুমার দাসসহ অন্যরা। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি প্রশাসন ও শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মুখে পড়েন। তাঁকে একটি ভবনে অবরুদ্ধ করা হয়। তখন উপাচার্যকে মুক্ত করতে যান পুলিশ সদস্যরা। কিন্তু শিক্ষার্থীরা পুলিশকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেন। এ নিয়ে ধাক্কাধাক্কির একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা শুরু করে পুলিশ। শিক্ষার্থীরাও তখন পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। পরে উপাচার্যকে উদ্ধার করে তাঁর বাসভবনে নিয়ে যায় পুলিশ। বলা হচ্ছে, পুলিশের হামলা ও লাঠিপেটায় আহতদের মধ্যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী—দুই পক্ষই আছে। যদিও পুলিশ বলছে, তারা শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়নি। তবে সংবাদমাধ্যমের কাছে আসা ছবি সেই দাবিকে সমর্থন করছে না।
এরপরই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় শাবিপ্রবি। উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ এই তথ্য জানিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছেন, বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ (লিজা) ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছেন। তাঁর জায়গায় নতুন প্রাধ্যক্ষ হিসেবে অধ্যাপক নাজিয়া চৌধুরীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ যাঁকে নিয়ে অভিযোগ, তিনি অন্তত পদ থেকে সরে গেছেন।
সব মিলিয়ে বলাই যায় যে, শাবিপ্রবি এখন ক্ষোভে উত্তাল। যদি এ ঘটনার আপাত বিশ্লেষণও করেন, তাহলে লেখার শুরুর দিকে দেওয়া চিত্রনাট্যের সঙ্গে মিল পাবেন। কিছুদিন আগে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়েও এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ক্ষোভে উত্তাল হয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। সেখানেও অনেকটা একই প্রবাহে ঘটনা এগিয়েছে বটে। অর্থাৎ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে থাকা ‘সিস্টেম’ ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের একধরনের ক্ষোভ দীর্ঘদিন ধরেই আছে। সেটির যে কোনো কার্যকর সমাধান হচ্ছে না, তা প্রমাণ করে দিচ্ছে কয়েক দিন পর পর ঘটা আন্দোলনগুলোই। বরং ক্ষোভ প্রশমনের চেয়ে তা দমনের পথেই যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এবং তাতেই একধরনের স্থায়ী ক্ষত তৈরি হচ্ছে শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্কে। এই ক্ষত অবিশ্বাসের, অনাস্থার।
দমনের মাধ্যমে এই পৃথিবীতে কোনো বিক্ষোভই নিভিয়ে দেওয়া যায়নি। কর্তৃপক্ষ বলতেই পারে, সব দাবি ন্যায্য বা বাস্তবানুগ হতে পারে না। ঠিক আছে, তাহলে আলোচনা তো করাই যায়। আলোচনার টেবিলে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো শান্তিপূর্ণ সমাধান বের হয়েই আসবে। যাঁরা পড়াশোনা ফেলে আন্দোলন করছেন রাস্তায়, তাঁদের নিশ্চয়ই আসল কাজ ছেড়ে গলা ফাটিয়ে দাবি জানানোর শখ নেই। কারণ পরিশেষে ক্ষতিটা তাঁদেরই হয় এবং তা বোঝার মতো বয়স তাঁদেরও হয়েছে। দেখতে হবে যে, তাঁদের সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়ে গেছে কি না। শিক্ষকেরা বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন শিক্ষার্থীদের অধিকার লঙ্ঘনের মতো কাজ বারংবার করে যাচ্ছেন কি না।
এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তেমনটা হওয়ার অসংখ্য উপাদান আছে। লেজুড়বৃত্তি ও অযাচিত ক্ষমতার অপব্যবহারের ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। সমালোচনা আছে অযোগ্য ও দলান্ধ শিক্ষক নিয়োগ নিয়েও। ওদিকে শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে ‘ক্ষমতাবান’ ছাত্র সংগঠনগুলোর মাথায় ব্যথা নেই দীর্ঘদিন ধরেই। বরং গেস্টরুমে প্রতি রাতের জমায়েত কেমন হলো, কোন কমিটিতে কে নেতা-নেত্রী হলো এবং তদনগদ অভিনন্দন জানানোর জোয়ারে গা ভাসাতেই ব্যস্ত থাকে সবাই। ‘ক্ষমতা’র বলয়ে না থাকা যেসব সংগঠন দু-একটা কথা এত দিন ধরে বলত কিছু কিছু, তারাও সময়ের বিচারে হালনাগাদ হয়নি। ফলে গত কিছুদিন ধরে আমরা কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থাকা শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নেমে আসতে দেখছি। তারা খেপে যাচ্ছে ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে চুল কেটে দেওয়ায়। তাদের দাবিনামার মধ্যে থাকছে হলের যাবতীয় অব্যবস্থাপনা নির্মূল করা বা হলের, শিক্ষার স্বাভাবিক সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়গুলো। অথচ নানা কাজে ‘বিখ্যাত’ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনেরই এসব দাবি তোলার কথা ছিল। সেই সব ছাত্র সংগঠন এবং ওই সব নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের পারফরম্যান্স যে করুণ, সেটি দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। যদিও চোখে ঠুলি পরা থাকলে এবং সহমতের প্লাবনে ভেসে যাওয়ার কালে এসব স্পষ্টতা আর চোখে ধরে না; বরং কলম ধরা হাতে হকিস্টিক বা লাঠি উঠে বগল বাজায়।
অথচ এ দেশের জন্মের কালে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যূথবদ্ধ আন্দোলনের কথা আমরা শুনি প্রায়ই। সেই সোনালি দিনগুলোর কথা অবশ্য নতুন প্রজন্মের কাছে ‘গল্প’ বলে ভ্রম হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এখন ভাবার সময় এসেছে যে কেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভাবনাগত জায়গায় তাঁদের সমুদ্রসমান ফারাক তৈরি হয়েছে। কেন স্বাধীন বাংলাদেশে সেই ফারাক দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। কেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকসংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সমস্যার সমাধানে একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না। মনে রাখতে হবে, ১৯৭১ সালের আগে শিক্ষার্থীদের উদ্দীপ্ত করেছিলেন শিক্ষকেরাই। সেই শ্রদ্ধার আসন এখন টলে গেছে, নাকি একদমই অস্তিত্বহীন, তার মূল কারণ খোঁজার সময় এসে গেছে। এবং শিক্ষাগুরু হিসেবে শিক্ষকদেরই তাতে বেশি উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। কারণ ঐতিহ্যবাহী পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্কটা উবে গেলে তাঁরা আর গর্ব করবেন কী নিয়ে? নাকি সেখানে এখন সুপিরিয়র-ইনফিরিয়রের রাজত্ব চলছে?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষকে এখন ভাবতে হবে, তারা আসলে শিক্ষার্থীদের কী শিক্ষা দিতে চায়। শিক্ষার্থীরা কি শিখে নেবে যে দমনে দাবিনামা বিধ্বস্ত করাই ক্ষোভ মেটানোর প্রকৃত পন্থা? নাকি একসঙ্গে বসে এক পরিবারের মতো যূথবদ্ধ যৌক্তিক আলাপ? ভবিষ্যতে আন্দোলনের কারণে আরও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা আমরা পেলে বুঝে নিতে হবে—‘কিল মারার গোঁসাই’ জয়যুক্ত হয়েছে, জয়যুক্ত হয়েছে, জয়যুক্ত হয়েছে!
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
৩ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
৩ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
৩ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
৩ ঘণ্টা আগে