সেলিম জাহান
‘চমকে তাকিয়ে দেখি, টুপ করে একটা কাগজের ছোট্ট দলা রিকশার পাদানিতে আমার পায়ের পাশে এসে পড়ল মৃদু শব্দ করে’, মৃদুস্বরে আমাকে তাঁর কিশোরীকালের গল্প বলছিলেন স্নেহভাজন একজন। ‘নিচু হয়ে তুলতে যাওয়ার আগেই দুরন্ত এক হাওয়া ওই টুকরোটি উড়িয়ে নিয়ে গেল। আর তখনই আমার রিকশার পাশ দিয়ে সাঁই করে এক যুবকের সাইকেল বেরিয়ে গেল। একঝলকের জন্য মানুষটি তাকাল আমার মুখের দিকে’, জানালার বাইরে নারকেল পাতায় রোদের ঝিকিমিকি দেখে ভারি নরম গলায় বলে সে। ‘আমি কিন্তু তার মুখ দেখতে পাইনি, জানি না সে কে?’ ভারি হতাশ শোনায় তার গলা।
‘কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা কি জানেন?’ বলে চলে সে আমার চোখে চোখ রেখে। ‘আমি কোনো দিনই জানব না কী লেখা ছিল ওই চিঠিতে। আমাকে কি বলতে চেয়েছিল ওই অচেনা যুবক?’ গাঢ় ব্যথিত হয়ে আসে তার গলা। এক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাইটে অধ্যাপক সে, তবু তার কণ্ঠের আর্তি টের পাই আমি।
এ কথা শুনতে শুনতে বহুকাল আগের একটি স্মৃতি মনে পড়ে যায়। ১৯৭৪ সালের কথা। সবে আমাদের স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। তাতে আমার ফল এবং সেই সঙ্গে বিতর্কের কারণে রবি আমার তখন তুঙ্গে। ঠিক সেই সময়ে একটি মোড়ক আসে অর্থনীতি বিভাগে আমার নামে। বারান্দায় বেরিয়ে মোড়ক খুলে দেখি একটি কবিতার বই–কবি আহসান হাবীবের ‘আশায় বসতি’। প্রচ্ছদে পাতার ওপরে বর্ষার জলবিন্দু ফোঁটা ফোঁটা। প্রথম পাতা ওল্টাতেই চোখে পড়ল গোটা গোটা অক্ষরে লেখা: ‘বড় আশা করে এসেছি গো, কাছে ডেকে লও।’ আর কিচ্ছু নেই।
ওই বইয়ের রহস্যও ভেদ করা যায়নি কোনো দিন–আমার অতি উৎসাহী কিছু বান্ধবের সুতীক্ষ্ণ গোয়েন্দাগিরি সত্ত্বেও। কে পাঠিয়েছিলেন, কেন লিখেছিলেন, কোন আশায় বসতি স্থাপন করতে চেয়েছিলেন–কোনো দিন জানা যাবে না।
আসলে জীবনে বহু কিছু জানা হয়ে ওঠে না আমাদের। কতটুকুই-বা জানা যায়? না, না, জ্ঞানের কথা বলছি না। একজীবনে আর কতটুকু জ্ঞান লাভ করা যায়? স্বয়ং নিউটনই যদি সারা জীবন ধরে জ্ঞানসাগরের তীরে বসে নুড়িই শুধু কুড়ান, আমরা তো তাহলে তুশ্চু! আর জ্ঞানের ব্যাপারে আমার উৎসাহ আছে, কিন্তু অতি জ্ঞানী হওয়ার পাগলামি নেই।
না জানার কথা যেটা বলছিলাম, তা আমাদের অতি প্রিয়জন, আশপাশের আপনজন, চারদিকে আমরা যা দেখছি-শুনছি সে সম্পর্কে। অনেক দিন আগে কোনো এক উত্তপ্ত তর্কের মুহূর্তে আবেগতাড়িত হয়ে আমাদের এক কন্যা আমাকে বলেছিল, ‘আমার জীবনের কতটুকু তুমি জানো?’ ত্রিশোর্ধ্ব আমার তনয়ার তীক্ষ্ণ সে অনুযোগে প্রবল এক নাড়া খেয়েছিল আমার পিতৃহৃদয়। ঠিকই তো, আমি তার পিতা হতে পারি, কিন্তু ওই মানুষটির বহু কিছুই তো আমার অজানা। তার প্রতিদিনের জীবন, তার কর্মকাণ্ড, তার সখ্যর বলয়, তার চিন্তা-চেতনার বহু কিছুই তো আমার অজানা–জেনেছি কি সেই সবকিছু পরতে পরতে? না, জানিনি। আমার আত্মজা আমার কাছে অজানাই থেকে গেল নানান দিকে।
মা-বাবার কথা খুব মনে হয়। মা-বাবা হিসেবেই ওই দুটি মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয়। কিন্তু তার আগে—যখন তাঁরা আমার বাবা-মা হননি? জানি কি কেমন ছিলেন আমার জনক-জননীরা শৈশবে, কৈশোরে, প্রথম যৌবনে?
আমার বাবা খুব স্বল্পভাষী ছিলেন। তার চেয়েও কম কথা বলতেন আমার পিতামহী। আমার বাবার পূর্বজীবনের কথা তাই অন্যদের কাছ থেকে শোনা আমার, তা-ও খুব বেশি নয়। কিছু শুনেছি, কিছু জেনেছি, বহুটাই জানিনি, জানতেও পারব না সম্ভবত আর কোনো দিন।
কৈশোরে বাবা গ্রামের কোন স্কুলে পড়তেন, তা শুনেছি আমার পিতামহীর কাছে। ছোটবেলায় বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বিড়ি ধরেছিলেন, তা-ও জানা আছে আমার। কিন্তু কারা তাঁর বন্ধু ছিলেন, তা জানি না। পুরো নোয়াখালী ছেড়ে কেন তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে বিএ পড়তে গেলেন, তা-ও জানি না। তবে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে আমার শ্বশ্রূপিতা প্রয়াত অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বাবাদের শ্রেণিতে টমাস হার্ডির The Mayor of Casterbridge পড়িয়েছেন, সেটা তাঁর মুখেই শুনেছি। পরবর্তীকালে দুজনেই অবশ্য সহকর্মী হয়েছিলেন বরিশালের বিএম কলেজে।
আমার পিতামহকে আমি দেখিনি। আমার মা-ও দেখেননি। তাঁর কোনো ছবি নেই। শুনেছি, ঘোর কৃষ্ণবর্ণের এই ব্যক্তিটির রেঙ্গুনে বড় ব্যবসা ছিল। কিন্তু আমার পিতামহের সঙ্গে আমার পিতার কেমন সম্পর্ক ছিল, কী কথা হতো তাঁদের মধ্যে, কতটা আদর করতেন আমার পিতামহ আমার পিতাকে–কোনো দিনই জানতে পারিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনরত তাঁর পুত্রকে দেখতে এসে কলেরায় আমার পিতামহের মৃত্যু ঘটে এবং আজিমপুর গোরস্থানে গণকবরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ঢাকায় এলে আমার পিতা সেখানে যেতেন একা। কোনো দিন আমাকে বলেননি তাঁর সঙ্গী হতে। কেন, তা-ও কোনো দিন জানতে পারিনি।
১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলে পরে আমার বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন। পিতা হিসেবে প্রীত হতেই পারেন তিনি। এর কিছুকাল পর এক বৈশাখী মেলায় রমনা উদ্যানে দেখা হলো অধ্যাপক দেবেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জির কন্যা নীলিমাদির সঙ্গে—বাবার ছাত্রী। ‘তুই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্যারের জন্য এটা যে কত গর্বের কথা, সেটা জানিস?’
জানতাম না, জানলাম তাঁর কাছ থেকে এক অশ্রুত গল্প শুনে–বাবার শিক্ষকজীবনের প্রথম দিকের ছাত্রী হয়ে যা তিনি জানতেন, পুত্র হয়েও আমি তা জানতাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করলেও বাবাকে বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নেওয়া হয়নি। কারণ, বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক নিউম্যানের সঙ্গে তাঁর রেষারেষি। সে জায়গায় নিযুক্তি পেয়েছিলেন তৃতীয় শ্রেণিপ্রাপ্ত একজন। অনুমান করতে পারি, এটা কত বড় আঘাত ছিল আমার পিতার জন্য। ‘বহুদিন আগের একটা অন্যায়ের শুদ্ধি হলো স্যারের কাছে তোর নিযুক্তির দ্বারা, বুঝলি?’ বলেছিলেন নীলিমাদি। আমি পুরো কাহিনি শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। জানতাম না এর কিছুই।
কিশোরী বয়সে আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল। ছোটখাটো মানুষটি, টকটকে ফরসা রং, মাথার চুল কোমর ছাড়িয়ে। তাঁরও কৈশোরের তেমন কিছু আমি জানি না। চার বোন ছিলেন তাঁরা। আমার মা সেজ। পিঠাপিঠি মেজ বোনের সঙ্গে মায়ের লাগত প্রায়ই। তাঁদের দুজনের তালা দেওয়া দুটো টিনের বাক্স ছিল, দুই কিশোরীর সব সম্পদসহ। দুই বোনে ঝগড়া হলেই একজন লুকিয়ে অন্যের বাক্স ঝাঁকাতেন, যাতে ভেতরের সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যায়। এখন ভেবে অবাক হই যে আমার মেজ খালাকে আমি জীবনে একবারই দেখেছি।
শুনেছি, কিশোরী বয়সে দুই বন্ধু ছিল আমার মায়ের–কমলা ও শমলা। মা বলতেন শমলা, আমার ধারণা এটা শ্যামলা হবে, কে জানে? জানি না কেমন করে মা-বাবার প্রথম দেখা হয়েছিল, ভয় পেয়েছিলেন কি মা, যখন কিশোরী তিনি রেল ও জলপথে স্বামীর সঙ্গে সুদূর নোয়াখালী থেকে বরিশালে এসেছিলেন আত্মীয়স্বজনবিহীন একটি জায়গায়? কেমন করে পেতেছিলেন তাঁর প্রথম সংসার?
জানা হয়নি অনেক কিছুই–জানা হবে না আর এ জীবনে। আসলে নিজেকেই-বা কতটুকু জানি? যাপিত জীবনের প্রতিটি দিনের কথা কি মনে আছে? ঠিকঠাক বলতে পারব কি সব ঘটনা? তবু একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে বেশিটুকুই জানে সে নিজে—আর কেউ নয়। কিন্তু তারপরও তো কথা থেকে যায়, বলতে ইচ্ছে করে, ‘আপনাকে জানা আমার ফুরাবে না’, এবং তার আগেই হয়তো জীবনই ফুরিয়ে যায়।
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
‘চমকে তাকিয়ে দেখি, টুপ করে একটা কাগজের ছোট্ট দলা রিকশার পাদানিতে আমার পায়ের পাশে এসে পড়ল মৃদু শব্দ করে’, মৃদুস্বরে আমাকে তাঁর কিশোরীকালের গল্প বলছিলেন স্নেহভাজন একজন। ‘নিচু হয়ে তুলতে যাওয়ার আগেই দুরন্ত এক হাওয়া ওই টুকরোটি উড়িয়ে নিয়ে গেল। আর তখনই আমার রিকশার পাশ দিয়ে সাঁই করে এক যুবকের সাইকেল বেরিয়ে গেল। একঝলকের জন্য মানুষটি তাকাল আমার মুখের দিকে’, জানালার বাইরে নারকেল পাতায় রোদের ঝিকিমিকি দেখে ভারি নরম গলায় বলে সে। ‘আমি কিন্তু তার মুখ দেখতে পাইনি, জানি না সে কে?’ ভারি হতাশ শোনায় তার গলা।
‘কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা কি জানেন?’ বলে চলে সে আমার চোখে চোখ রেখে। ‘আমি কোনো দিনই জানব না কী লেখা ছিল ওই চিঠিতে। আমাকে কি বলতে চেয়েছিল ওই অচেনা যুবক?’ গাঢ় ব্যথিত হয়ে আসে তার গলা। এক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাইটে অধ্যাপক সে, তবু তার কণ্ঠের আর্তি টের পাই আমি।
এ কথা শুনতে শুনতে বহুকাল আগের একটি স্মৃতি মনে পড়ে যায়। ১৯৭৪ সালের কথা। সবে আমাদের স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। তাতে আমার ফল এবং সেই সঙ্গে বিতর্কের কারণে রবি আমার তখন তুঙ্গে। ঠিক সেই সময়ে একটি মোড়ক আসে অর্থনীতি বিভাগে আমার নামে। বারান্দায় বেরিয়ে মোড়ক খুলে দেখি একটি কবিতার বই–কবি আহসান হাবীবের ‘আশায় বসতি’। প্রচ্ছদে পাতার ওপরে বর্ষার জলবিন্দু ফোঁটা ফোঁটা। প্রথম পাতা ওল্টাতেই চোখে পড়ল গোটা গোটা অক্ষরে লেখা: ‘বড় আশা করে এসেছি গো, কাছে ডেকে লও।’ আর কিচ্ছু নেই।
ওই বইয়ের রহস্যও ভেদ করা যায়নি কোনো দিন–আমার অতি উৎসাহী কিছু বান্ধবের সুতীক্ষ্ণ গোয়েন্দাগিরি সত্ত্বেও। কে পাঠিয়েছিলেন, কেন লিখেছিলেন, কোন আশায় বসতি স্থাপন করতে চেয়েছিলেন–কোনো দিন জানা যাবে না।
আসলে জীবনে বহু কিছু জানা হয়ে ওঠে না আমাদের। কতটুকুই-বা জানা যায়? না, না, জ্ঞানের কথা বলছি না। একজীবনে আর কতটুকু জ্ঞান লাভ করা যায়? স্বয়ং নিউটনই যদি সারা জীবন ধরে জ্ঞানসাগরের তীরে বসে নুড়িই শুধু কুড়ান, আমরা তো তাহলে তুশ্চু! আর জ্ঞানের ব্যাপারে আমার উৎসাহ আছে, কিন্তু অতি জ্ঞানী হওয়ার পাগলামি নেই।
না জানার কথা যেটা বলছিলাম, তা আমাদের অতি প্রিয়জন, আশপাশের আপনজন, চারদিকে আমরা যা দেখছি-শুনছি সে সম্পর্কে। অনেক দিন আগে কোনো এক উত্তপ্ত তর্কের মুহূর্তে আবেগতাড়িত হয়ে আমাদের এক কন্যা আমাকে বলেছিল, ‘আমার জীবনের কতটুকু তুমি জানো?’ ত্রিশোর্ধ্ব আমার তনয়ার তীক্ষ্ণ সে অনুযোগে প্রবল এক নাড়া খেয়েছিল আমার পিতৃহৃদয়। ঠিকই তো, আমি তার পিতা হতে পারি, কিন্তু ওই মানুষটির বহু কিছুই তো আমার অজানা। তার প্রতিদিনের জীবন, তার কর্মকাণ্ড, তার সখ্যর বলয়, তার চিন্তা-চেতনার বহু কিছুই তো আমার অজানা–জেনেছি কি সেই সবকিছু পরতে পরতে? না, জানিনি। আমার আত্মজা আমার কাছে অজানাই থেকে গেল নানান দিকে।
মা-বাবার কথা খুব মনে হয়। মা-বাবা হিসেবেই ওই দুটি মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয়। কিন্তু তার আগে—যখন তাঁরা আমার বাবা-মা হননি? জানি কি কেমন ছিলেন আমার জনক-জননীরা শৈশবে, কৈশোরে, প্রথম যৌবনে?
আমার বাবা খুব স্বল্পভাষী ছিলেন। তার চেয়েও কম কথা বলতেন আমার পিতামহী। আমার বাবার পূর্বজীবনের কথা তাই অন্যদের কাছ থেকে শোনা আমার, তা-ও খুব বেশি নয়। কিছু শুনেছি, কিছু জেনেছি, বহুটাই জানিনি, জানতেও পারব না সম্ভবত আর কোনো দিন।
কৈশোরে বাবা গ্রামের কোন স্কুলে পড়তেন, তা শুনেছি আমার পিতামহীর কাছে। ছোটবেলায় বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বিড়ি ধরেছিলেন, তা-ও জানা আছে আমার। কিন্তু কারা তাঁর বন্ধু ছিলেন, তা জানি না। পুরো নোয়াখালী ছেড়ে কেন তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে বিএ পড়তে গেলেন, তা-ও জানি না। তবে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে আমার শ্বশ্রূপিতা প্রয়াত অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বাবাদের শ্রেণিতে টমাস হার্ডির The Mayor of Casterbridge পড়িয়েছেন, সেটা তাঁর মুখেই শুনেছি। পরবর্তীকালে দুজনেই অবশ্য সহকর্মী হয়েছিলেন বরিশালের বিএম কলেজে।
আমার পিতামহকে আমি দেখিনি। আমার মা-ও দেখেননি। তাঁর কোনো ছবি নেই। শুনেছি, ঘোর কৃষ্ণবর্ণের এই ব্যক্তিটির রেঙ্গুনে বড় ব্যবসা ছিল। কিন্তু আমার পিতামহের সঙ্গে আমার পিতার কেমন সম্পর্ক ছিল, কী কথা হতো তাঁদের মধ্যে, কতটা আদর করতেন আমার পিতামহ আমার পিতাকে–কোনো দিনই জানতে পারিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনরত তাঁর পুত্রকে দেখতে এসে কলেরায় আমার পিতামহের মৃত্যু ঘটে এবং আজিমপুর গোরস্থানে গণকবরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ঢাকায় এলে আমার পিতা সেখানে যেতেন একা। কোনো দিন আমাকে বলেননি তাঁর সঙ্গী হতে। কেন, তা-ও কোনো দিন জানতে পারিনি।
১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলে পরে আমার বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন। পিতা হিসেবে প্রীত হতেই পারেন তিনি। এর কিছুকাল পর এক বৈশাখী মেলায় রমনা উদ্যানে দেখা হলো অধ্যাপক দেবেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জির কন্যা নীলিমাদির সঙ্গে—বাবার ছাত্রী। ‘তুই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্যারের জন্য এটা যে কত গর্বের কথা, সেটা জানিস?’
জানতাম না, জানলাম তাঁর কাছ থেকে এক অশ্রুত গল্প শুনে–বাবার শিক্ষকজীবনের প্রথম দিকের ছাত্রী হয়ে যা তিনি জানতেন, পুত্র হয়েও আমি তা জানতাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করলেও বাবাকে বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নেওয়া হয়নি। কারণ, বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক নিউম্যানের সঙ্গে তাঁর রেষারেষি। সে জায়গায় নিযুক্তি পেয়েছিলেন তৃতীয় শ্রেণিপ্রাপ্ত একজন। অনুমান করতে পারি, এটা কত বড় আঘাত ছিল আমার পিতার জন্য। ‘বহুদিন আগের একটা অন্যায়ের শুদ্ধি হলো স্যারের কাছে তোর নিযুক্তির দ্বারা, বুঝলি?’ বলেছিলেন নীলিমাদি। আমি পুরো কাহিনি শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। জানতাম না এর কিছুই।
কিশোরী বয়সে আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল। ছোটখাটো মানুষটি, টকটকে ফরসা রং, মাথার চুল কোমর ছাড়িয়ে। তাঁরও কৈশোরের তেমন কিছু আমি জানি না। চার বোন ছিলেন তাঁরা। আমার মা সেজ। পিঠাপিঠি মেজ বোনের সঙ্গে মায়ের লাগত প্রায়ই। তাঁদের দুজনের তালা দেওয়া দুটো টিনের বাক্স ছিল, দুই কিশোরীর সব সম্পদসহ। দুই বোনে ঝগড়া হলেই একজন লুকিয়ে অন্যের বাক্স ঝাঁকাতেন, যাতে ভেতরের সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যায়। এখন ভেবে অবাক হই যে আমার মেজ খালাকে আমি জীবনে একবারই দেখেছি।
শুনেছি, কিশোরী বয়সে দুই বন্ধু ছিল আমার মায়ের–কমলা ও শমলা। মা বলতেন শমলা, আমার ধারণা এটা শ্যামলা হবে, কে জানে? জানি না কেমন করে মা-বাবার প্রথম দেখা হয়েছিল, ভয় পেয়েছিলেন কি মা, যখন কিশোরী তিনি রেল ও জলপথে স্বামীর সঙ্গে সুদূর নোয়াখালী থেকে বরিশালে এসেছিলেন আত্মীয়স্বজনবিহীন একটি জায়গায়? কেমন করে পেতেছিলেন তাঁর প্রথম সংসার?
জানা হয়নি অনেক কিছুই–জানা হবে না আর এ জীবনে। আসলে নিজেকেই-বা কতটুকু জানি? যাপিত জীবনের প্রতিটি দিনের কথা কি মনে আছে? ঠিকঠাক বলতে পারব কি সব ঘটনা? তবু একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে বেশিটুকুই জানে সে নিজে—আর কেউ নয়। কিন্তু তারপরও তো কথা থেকে যায়, বলতে ইচ্ছে করে, ‘আপনাকে জানা আমার ফুরাবে না’, এবং তার আগেই হয়তো জীবনই ফুরিয়ে যায়।
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
৬ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
৬ ঘণ্টা আগে