বিভুরঞ্জন সরকার
বাংলাদেশ হলো আন্দোলনের দেশ, প্রতিবাদের দেশ, আত্মদানের দেশ। বহু শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা আন্দোলনে বিজয় অর্জন করি। কিন্তু অর্জিত বিজয়কে আমরা সংহতও করতে পারি না, ধরেও রাখতে পারি না। আমাদের ত্রুটি কোথায়, কেন আমরা পেয়েও হারাই, তা নিয়ে আমাদের গভীর কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। আমরা সাধারণত কোনো কিছুর গভীরে না গিয়ে তাৎক্ষণিকতায় মেতে উঠি।
১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেনের কথা মনে করেই ওপরের কথাগুলো বলা হলো। প্রতি বছর ১০ নভেম্বর আমরা নূর হোসেন দিবস পালন করি। তাঁর সাহসী আত্মদানের কথা বক্তৃতায় বলি। কিন্তু নূর হোসেন যে স্লোগান বুক-পিঠে লিখে মিছিলে নেমেছিলেন, সেই লক্ষ্য কি পূরণ হয়েছে? এ প্রশ্নের সম্ভবত এক রকম জবাব পাওয়া যাবে না। একপক্ষ বলবেন, ‘হ্যাঁ, স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের মাধ্যমে নূর হোসেনের এক দাবি “স্বৈরাচার নিপাত যাক” পূরণ হয়েছে।’ অন্যরা হয়তো বলবেন, ‘পোশাক পরা স্বৈরাচারের পতন হলেও দেশ কর্তৃত্ববাদী শাসনের হাত থেকে মুক্তি পায়নি।’
নূর হোসেনের আরেক দাবি ছিল ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। তো, গণতন্ত্র কি সত্যি মুক্তি পেয়েছে? এখানেও এক রকম জবাব পাওয়ার আশা করা বাতুলতা হবে। একপক্ষ বলবেন, ‘গণতন্ত্র এখন পুরো মুক্ত অবস্থায় আছে। শেখ হাসিনা হলেন ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’। তিনি যেহেতু টানা তিন মেয়াদে দেশের শাসনভার পেয়েছেন, সেহেতু গণতন্ত্র অবশ্যই মুক্ত অবস্থায় আছে।’
এর বিরুদ্ধে বলা মানুষের সংখ্যা দেশে কম নেই। আওয়ামী লীগ বা সরকারবিরোধীরা দিবানিশি ক্লান্তিহীনভাবে বলে চলেছেন, ‘দেশে আসলে গণতন্ত্র নেই।’ গণতন্ত্রের মূল সৌন্দর্য হলো বহু দলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। নানা মত ও পথের মানুষ পাশাপাশি বসবাস করবে। সবাই তার বিশ্বাস বা মত বিনা বাধায় প্রকাশ করবেন। ভোটের মাধ্যমে ঠিক হবে দেশ শাসনের অধিকার কোন দলের। যে দল শতকরা ৫১ ভাগ ভোটারের সমর্থন সংগ্রহ করতে পারবে, দেশ শাসনের হক সেই দলের। আর যারা শতকরা ৪৯ ভাগ ভোটারের মন জয় করতে পারবে, তাদের বসতে হবে বিরোধী দলের আসনে। বিরোধী দলও আসলে সরকারের অংশ। সরকার ভুল করলে, জনবিরোধী কোনো নীতি-পদক্ষেপ গ্রহণ করলে, তার বিরোধিতা করবে। শুধু বিরোধিতা করলেই হবে না, সরকারের ভুলটা কী বা কোথায় এবং কী করলে, কীভাবে করলে ভালো হতো, সেটাও খোলাসা করে বলতে হবে। মাঠ গরম করা বক্তৃতা নয়, জনচিত্ত জয় করার মতো কাজ করতে হবে। এসব আসলে আমাদের দেশে কষ্টকল্পনার বিষয়। তাহলে কি বলা যায় যে, আমরা মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশে বসবাস করছি?
এরশাদ ক্ষমতায় বসেছিলেন বিচারপতি সাত্তারকে বন্দুকের নলের মুখে রেখে সামরিক বাহিনীর সহায়তায়। তিনি ক্ষমতা দখলের প্রথম থেকেই শুরু হয়েছিল বিরোধিতা। এরশাদ যত বছর ক্ষমতায় ছিলেন, দেশ তত বছর আন্দোলনমুক্ত ছিল না। সামরিক শাসকেরা ক্ষমতা দখলের সময় নির্বাচন দিয়ে দ্রুত ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে সেটা আর রক্ষা করে না। ফলে এরশাদের শাসনকাল জুড়েই ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের কখনো যুগপৎ, কখনো ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থেকে আন্দোলন। এরশাদ চেষ্টা করছেন বিরোধী দলের ঐক্যে ভাঙন ধরাতে। কিছু সফলতা পেলেও মোটাদাগে তিনি ব্যর্থই হয়েছেন।
১৯৮৬ সালের ৭ মে দেশে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮-দলীয় জোট অংশ নিলেও বিএনপির নেতৃত্বের ৭-দলীয় জোট এবং বাম দলগুলোর ৫-দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করে। আবার বিএনপি ঘেঁষা জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে অংশ নিলে ওই নির্বাচনেই এরশাদের বিদায় নিশ্চিত হতো। বিরোধী দলের অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে ব্যাপক ভোট ডাকাতির মাধ্যমে এরশাদের জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনে জয় পায়। এরশাদ ভোটে জিতেও বিরোধী দলের বিরোধিতা থেকে রেহাই পাননি।
নির্বাচনের এক বছরের মধ্যে আবার বিরোধী দলীয় জোটগুলো একযোগে আন্দোলনের ডাক দেয়। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেশে তৈরি হয় টানটান উত্তেজনা। এরশাদ কঠোর অবস্থান নিয়েও মানুষকে ঘরে রাখতে পারেননি। পুলিশ-বিডিআর নামিয়ে, যানবাহন চলাচল বন্ধ করিয়েও সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি ঠেকানো যায়নি। বিক্ষুব্ধ মানুষের সমাবেশ-মিছিল বন্ধ করতে গুলি বর্ষণ করতেও দ্বিধা করেনি এরশাদের লেলিয়ে দেওয়া সশস্ত্র পোশাকি বাহিনী। গুলিতে নিহত হন অন্তত দুজন। একজন নূর হোসেন, অন্যজন সৈয়দ আমিনুল হুদা।
নূর হোসেন ঢাকাতেই থাকতেন। আর আমিনুল হুদা টিটো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষে খেতমজুরদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই সংগঠিত করতে নিজ উপজেলা কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে থাকতেন। সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ নিতে টিটো বাজিতপুর থেকে বাইসাইকেল চালিয়ে ঢাকা এসেছিলেন। কারণ, বিরোধী জোটগুলোর ডাকা কর্মসূচি ব্যর্থ করতে এরশাদ সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিলেন। টিটো আর তাঁর বাড়ি ফিরে যেতে পারেননি। এমনকি তাঁর মরদেহটিও গায়েব করেছিল এরশাদের পেটোয়া বাহিনী।
টিটোর মৃত্যুর খবর তাৎক্ষণিকভাবে জানতে না পারায় তাঁর ব্যাপারটি অনেকেরই গোচরে আসেনি। কিন্তু নূর হোসেনের মৃত্যু মানুষকে বেশি আবেগতাড়িত করেছে। ১০ নভেম্বর সমাবেশ বা মিছিলে তাঁর ছিল ব্যতিক্রমী উপস্থিতি। নূর হোসেন তাঁর বুকে-পিঠে স্লোগান লিখে রাস্তায় নেমেছিলেন। পিঠে লেখা ছিল ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ আর বুকে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’। বুকে-পিঠে স্লোগান লিখে আগে আর কেউ মিছিলে নেমেছিলেন বলে জানা নেই। ফলে স্বাভাবিকভাবে সবার দৃষ্টি কেড়েছিলেন তিনি। আবার এভাবে তিনি শত্রুপক্ষের নিশানার মধ্যে ছিলেন। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে টার্গেট করেই গুলি ছোড়া হয়েছিল। যারা এই টার্গেট করেছিল, তাদের নিশানা ব্যর্থ হয়নি।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনারও নজরে পড়েছিলেন নূর হোসেন। শেখ হাসিনা একটি হুডখোলা গাড়িতে করে সমাবেশ উপস্থিত হয়েছিলেন। গাড়িতে চড়ে জনতার মধ্য দিয়ে চলার সময় তাঁর চোখ গিয়েছিল নূর হোসেনের গায়ে লেখা ওই স্লোগানের দিকে। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠেছিল তাঁর মন। নূর হোসেনকে কাছে ডেকে তাঁকে সতর্ক করেছিলেন। ‘ওরা টোকাই কেন’ বইতে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘মনে পড়ে আমি তাকে বলেছিলাম, জামাটা গায়ে দাও, এ কি সর্বনাশ করছ, ওরা যে তোমাকে গুলি করে মারবে। নূর হোসেন মাথাটা এগিয়ে দিল আমার কাছে। বলল, “জান দিয়া দিমু আপা, আপনে শুধু মাথায় হাত বুলাইয়্যা দেন। ” ’ শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আমার হাত ধরে বেশ কিছুক্ষণ নূর হোসেন গাড়ির পাশে হাঁটল। তারপর কখন যেন জনতার স্রোতে হারিয়ে গেল।’
এর কিছুক্ষণ পরই গুলির শব্দ। স্লোগান অঙ্কিত বুক-পিঠ ঝাঁজরা হয়েছিল মুহূর্তে। রক্তে ভেসেছিল রাজপথ। তাকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় পুলিশ তাঁর গুলিবিদ্ধ দেহ জোর করে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে অতি গোপনে জুরাইন কবরস্থানে নিয়ে তড়িঘড়ি সমাহিত করেছিল। তাঁর মৃত্যু দেশের মানুষকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল। দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান তাঁকে নিয়ে লিখেছেন কবিতা—‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। কবিতার শেষ কটি লাইন:
উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে-পিঠে
রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য শ্লোগান,
বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ
শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা
নূর হোসেনের বুক নয়, যেন বাংলাদেশের হৃদয়
ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ
বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার
বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।
নভেম্বরের ১০ তারিখ প্রতি বছরই আসে। নূর হোসেনকে স্মরণ করে ১০ নভেম্বরকে করা হয়েছে নূর হোসেন দিবস। কিন্তু এই দিবস উদ্যাপন এখন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কোনো গুরুত্ব কি বহন করে?
গণতন্ত্র এখনো আমাদের কাছে সোনার হরিণ। আর স্বৈরাচার? আগে ছিল পোশাক পরা স্বৈরাচার, আর এখন আছে স্বেচ্ছাচার। হাতে বন্দুক নেই এখন; কিন্তু আছে নিয়ন্ত্রণমূলক আইনকানুন। নিয়ন্ত্রণমুক্ত অবাধ গণতন্ত্র পাওয়ার জন্য আরও কি ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়? আবারও কি দরকার হবে কোনো গরিব ঘরের সাহসী যুবক নূর হোসেনের?
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
বাংলাদেশ হলো আন্দোলনের দেশ, প্রতিবাদের দেশ, আত্মদানের দেশ। বহু শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা আন্দোলনে বিজয় অর্জন করি। কিন্তু অর্জিত বিজয়কে আমরা সংহতও করতে পারি না, ধরেও রাখতে পারি না। আমাদের ত্রুটি কোথায়, কেন আমরা পেয়েও হারাই, তা নিয়ে আমাদের গভীর কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। আমরা সাধারণত কোনো কিছুর গভীরে না গিয়ে তাৎক্ষণিকতায় মেতে উঠি।
১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেনের কথা মনে করেই ওপরের কথাগুলো বলা হলো। প্রতি বছর ১০ নভেম্বর আমরা নূর হোসেন দিবস পালন করি। তাঁর সাহসী আত্মদানের কথা বক্তৃতায় বলি। কিন্তু নূর হোসেন যে স্লোগান বুক-পিঠে লিখে মিছিলে নেমেছিলেন, সেই লক্ষ্য কি পূরণ হয়েছে? এ প্রশ্নের সম্ভবত এক রকম জবাব পাওয়া যাবে না। একপক্ষ বলবেন, ‘হ্যাঁ, স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের মাধ্যমে নূর হোসেনের এক দাবি “স্বৈরাচার নিপাত যাক” পূরণ হয়েছে।’ অন্যরা হয়তো বলবেন, ‘পোশাক পরা স্বৈরাচারের পতন হলেও দেশ কর্তৃত্ববাদী শাসনের হাত থেকে মুক্তি পায়নি।’
নূর হোসেনের আরেক দাবি ছিল ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। তো, গণতন্ত্র কি সত্যি মুক্তি পেয়েছে? এখানেও এক রকম জবাব পাওয়ার আশা করা বাতুলতা হবে। একপক্ষ বলবেন, ‘গণতন্ত্র এখন পুরো মুক্ত অবস্থায় আছে। শেখ হাসিনা হলেন ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’। তিনি যেহেতু টানা তিন মেয়াদে দেশের শাসনভার পেয়েছেন, সেহেতু গণতন্ত্র অবশ্যই মুক্ত অবস্থায় আছে।’
এর বিরুদ্ধে বলা মানুষের সংখ্যা দেশে কম নেই। আওয়ামী লীগ বা সরকারবিরোধীরা দিবানিশি ক্লান্তিহীনভাবে বলে চলেছেন, ‘দেশে আসলে গণতন্ত্র নেই।’ গণতন্ত্রের মূল সৌন্দর্য হলো বহু দলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। নানা মত ও পথের মানুষ পাশাপাশি বসবাস করবে। সবাই তার বিশ্বাস বা মত বিনা বাধায় প্রকাশ করবেন। ভোটের মাধ্যমে ঠিক হবে দেশ শাসনের অধিকার কোন দলের। যে দল শতকরা ৫১ ভাগ ভোটারের সমর্থন সংগ্রহ করতে পারবে, দেশ শাসনের হক সেই দলের। আর যারা শতকরা ৪৯ ভাগ ভোটারের মন জয় করতে পারবে, তাদের বসতে হবে বিরোধী দলের আসনে। বিরোধী দলও আসলে সরকারের অংশ। সরকার ভুল করলে, জনবিরোধী কোনো নীতি-পদক্ষেপ গ্রহণ করলে, তার বিরোধিতা করবে। শুধু বিরোধিতা করলেই হবে না, সরকারের ভুলটা কী বা কোথায় এবং কী করলে, কীভাবে করলে ভালো হতো, সেটাও খোলাসা করে বলতে হবে। মাঠ গরম করা বক্তৃতা নয়, জনচিত্ত জয় করার মতো কাজ করতে হবে। এসব আসলে আমাদের দেশে কষ্টকল্পনার বিষয়। তাহলে কি বলা যায় যে, আমরা মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশে বসবাস করছি?
এরশাদ ক্ষমতায় বসেছিলেন বিচারপতি সাত্তারকে বন্দুকের নলের মুখে রেখে সামরিক বাহিনীর সহায়তায়। তিনি ক্ষমতা দখলের প্রথম থেকেই শুরু হয়েছিল বিরোধিতা। এরশাদ যত বছর ক্ষমতায় ছিলেন, দেশ তত বছর আন্দোলনমুক্ত ছিল না। সামরিক শাসকেরা ক্ষমতা দখলের সময় নির্বাচন দিয়ে দ্রুত ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে সেটা আর রক্ষা করে না। ফলে এরশাদের শাসনকাল জুড়েই ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের কখনো যুগপৎ, কখনো ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থেকে আন্দোলন। এরশাদ চেষ্টা করছেন বিরোধী দলের ঐক্যে ভাঙন ধরাতে। কিছু সফলতা পেলেও মোটাদাগে তিনি ব্যর্থই হয়েছেন।
১৯৮৬ সালের ৭ মে দেশে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮-দলীয় জোট অংশ নিলেও বিএনপির নেতৃত্বের ৭-দলীয় জোট এবং বাম দলগুলোর ৫-দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করে। আবার বিএনপি ঘেঁষা জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে অংশ নিলে ওই নির্বাচনেই এরশাদের বিদায় নিশ্চিত হতো। বিরোধী দলের অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে ব্যাপক ভোট ডাকাতির মাধ্যমে এরশাদের জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনে জয় পায়। এরশাদ ভোটে জিতেও বিরোধী দলের বিরোধিতা থেকে রেহাই পাননি।
নির্বাচনের এক বছরের মধ্যে আবার বিরোধী দলীয় জোটগুলো একযোগে আন্দোলনের ডাক দেয়। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেশে তৈরি হয় টানটান উত্তেজনা। এরশাদ কঠোর অবস্থান নিয়েও মানুষকে ঘরে রাখতে পারেননি। পুলিশ-বিডিআর নামিয়ে, যানবাহন চলাচল বন্ধ করিয়েও সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি ঠেকানো যায়নি। বিক্ষুব্ধ মানুষের সমাবেশ-মিছিল বন্ধ করতে গুলি বর্ষণ করতেও দ্বিধা করেনি এরশাদের লেলিয়ে দেওয়া সশস্ত্র পোশাকি বাহিনী। গুলিতে নিহত হন অন্তত দুজন। একজন নূর হোসেন, অন্যজন সৈয়দ আমিনুল হুদা।
নূর হোসেন ঢাকাতেই থাকতেন। আর আমিনুল হুদা টিটো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষে খেতমজুরদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই সংগঠিত করতে নিজ উপজেলা কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে থাকতেন। সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ নিতে টিটো বাজিতপুর থেকে বাইসাইকেল চালিয়ে ঢাকা এসেছিলেন। কারণ, বিরোধী জোটগুলোর ডাকা কর্মসূচি ব্যর্থ করতে এরশাদ সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিলেন। টিটো আর তাঁর বাড়ি ফিরে যেতে পারেননি। এমনকি তাঁর মরদেহটিও গায়েব করেছিল এরশাদের পেটোয়া বাহিনী।
টিটোর মৃত্যুর খবর তাৎক্ষণিকভাবে জানতে না পারায় তাঁর ব্যাপারটি অনেকেরই গোচরে আসেনি। কিন্তু নূর হোসেনের মৃত্যু মানুষকে বেশি আবেগতাড়িত করেছে। ১০ নভেম্বর সমাবেশ বা মিছিলে তাঁর ছিল ব্যতিক্রমী উপস্থিতি। নূর হোসেন তাঁর বুকে-পিঠে স্লোগান লিখে রাস্তায় নেমেছিলেন। পিঠে লেখা ছিল ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ আর বুকে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’। বুকে-পিঠে স্লোগান লিখে আগে আর কেউ মিছিলে নেমেছিলেন বলে জানা নেই। ফলে স্বাভাবিকভাবে সবার দৃষ্টি কেড়েছিলেন তিনি। আবার এভাবে তিনি শত্রুপক্ষের নিশানার মধ্যে ছিলেন। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে টার্গেট করেই গুলি ছোড়া হয়েছিল। যারা এই টার্গেট করেছিল, তাদের নিশানা ব্যর্থ হয়নি।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনারও নজরে পড়েছিলেন নূর হোসেন। শেখ হাসিনা একটি হুডখোলা গাড়িতে করে সমাবেশ উপস্থিত হয়েছিলেন। গাড়িতে চড়ে জনতার মধ্য দিয়ে চলার সময় তাঁর চোখ গিয়েছিল নূর হোসেনের গায়ে লেখা ওই স্লোগানের দিকে। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠেছিল তাঁর মন। নূর হোসেনকে কাছে ডেকে তাঁকে সতর্ক করেছিলেন। ‘ওরা টোকাই কেন’ বইতে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘মনে পড়ে আমি তাকে বলেছিলাম, জামাটা গায়ে দাও, এ কি সর্বনাশ করছ, ওরা যে তোমাকে গুলি করে মারবে। নূর হোসেন মাথাটা এগিয়ে দিল আমার কাছে। বলল, “জান দিয়া দিমু আপা, আপনে শুধু মাথায় হাত বুলাইয়্যা দেন। ” ’ শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আমার হাত ধরে বেশ কিছুক্ষণ নূর হোসেন গাড়ির পাশে হাঁটল। তারপর কখন যেন জনতার স্রোতে হারিয়ে গেল।’
এর কিছুক্ষণ পরই গুলির শব্দ। স্লোগান অঙ্কিত বুক-পিঠ ঝাঁজরা হয়েছিল মুহূর্তে। রক্তে ভেসেছিল রাজপথ। তাকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় পুলিশ তাঁর গুলিবিদ্ধ দেহ জোর করে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে অতি গোপনে জুরাইন কবরস্থানে নিয়ে তড়িঘড়ি সমাহিত করেছিল। তাঁর মৃত্যু দেশের মানুষকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল। দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান তাঁকে নিয়ে লিখেছেন কবিতা—‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। কবিতার শেষ কটি লাইন:
উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে-পিঠে
রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য শ্লোগান,
বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ
শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা
নূর হোসেনের বুক নয়, যেন বাংলাদেশের হৃদয়
ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ
বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার
বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।
নভেম্বরের ১০ তারিখ প্রতি বছরই আসে। নূর হোসেনকে স্মরণ করে ১০ নভেম্বরকে করা হয়েছে নূর হোসেন দিবস। কিন্তু এই দিবস উদ্যাপন এখন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কোনো গুরুত্ব কি বহন করে?
গণতন্ত্র এখনো আমাদের কাছে সোনার হরিণ। আর স্বৈরাচার? আগে ছিল পোশাক পরা স্বৈরাচার, আর এখন আছে স্বেচ্ছাচার। হাতে বন্দুক নেই এখন; কিন্তু আছে নিয়ন্ত্রণমূলক আইনকানুন। নিয়ন্ত্রণমুক্ত অবাধ গণতন্ত্র পাওয়ার জন্য আরও কি ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়? আবারও কি দরকার হবে কোনো গরিব ঘরের সাহসী যুবক নূর হোসেনের?
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
৪ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
৪ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
৪ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
৪ ঘণ্টা আগে