সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ছাঁটাই হয়ে গেছে। এখানে ধর্ম মন্ত্রণালয় তো আছেই, রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সাংবিধানিক স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে। উপমহাদেশের শাসকশ্রেণি ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার অভ্যাস এখনো ছাড়তে পারেনি।
মানুষ তো সমাজেই বাস করে এবং সমাজের দ্বারা যতটা নয় তার চেয়ে বেশি রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ওদিকে ধর্ম বলতে যদি সদাচার, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, কল্যাণকামিতা, আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি বোঝায়, তাহলে সব মানুষেরই ধর্ম থাকতে পারে, এমনকি নাস্তিকেরও। কিন্তু ধর্মের আবার আনুষ্ঠানিক দিকও রয়েছে; অনুষ্ঠান করতে গিয়ে ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং আচার-আচরণের ব্যাপার থাকে না, সমাজের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মের ভিত্তিতে সমাজে বিভাজনও দেখা দেয়, ধর্ম প্রবেশ করে রাজনীতিতে।
রাজনীতির মূল বিষয়টি হচ্ছে ক্ষমতা। ক্ষমতার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা হয় আর তখন উদ্ভব ঘটে সাম্প্রদায়িকতার। সাম্প্রদায়িকতা ধর্মের নয়, রাজনীতির ব্যাপার।
সাম্প্রদায়িকতায় ধর্ম চলে যায় রাজনীতির অধীনে, তখন হানাহানি অনিবার্য হয়ে পড়ে। আমাদের এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার অনাচার আমরা অতীতে দেখেছি, এখনো দেখছি। কেবল উপমহাদেশে কেন, বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই তো এখন সাম্প্রদায়িকতার তাণ্ডব চলছে। ক্রুসেড ও জিহাদের ঘটনা অতীতকালের ব্যাপার নয়, একালেও বিদ্যমান। ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে ফিলিস্তিনবাসীকে উচ্ছেদ করে ধর্মরাজ্য কায়েম করা হয়েছে।
আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও খনিজসমৃদ্ধ এলাকায় দখলদারি প্রতিষ্ঠার যে ভয়াবহ উদ্যোগ নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে সেসব দেশের বামপন্থীদের রুখে দাঁড়ানোর কথা ছিল; কিন্তু সেখানে বামপন্থীদের নির্মূল করেছে স্থানীয় শাসকেরা, নিজেদের স্বৈরশাসনকে পাকাপোক্ত করার প্রয়োজনে। মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তো উঠবেই, উঠেছে ধর্মীয় জঙ্গিদের কাছ থেকে, যাদের একসময়ে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছিল বামপন্থীদের ধ্বংস করার প্রয়োজনে। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই পরিণত হয়েছে ধর্মীয় জিহাদে।
ওদিকে আমেরিকার সক্রিয় উসকানিতে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নি সংঘর্ষ দেখা দিয়েছে। পাকিস্তানেও সে ব্যাধিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাজনীতিতে তাই ধর্ম এসে যায়। পুঁজিবাদীরা ও সাম্রাজ্যবাদীরাই নিয়ে আসে; ধর্মের স্বার্থে নয়, নিজেদের বস্তুগত স্বার্থে। নিষ্পেষিত মানুষকে শান্ত রাখার উদ্দেশ্যেও তারা ধর্মকে ব্যবহার করে। আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের সবচেয়ে অনুন্নত যে এলাকা, যেখানে দরিদ্র শ্রমজীবীদের বসবাস; সেখানে গেলে দেখা যায় সবকিছুই নোংরা ও বিষণ্ন, কেবল দুটি ভবন ছাড়া; একটি হচ্ছে উপাসনালয়, অপরটি পানশালা। দুটিতেই মাদকের সরবরাহ চলে। একটি ধর্মীয় তৃপ্তির, অপরটিতে নগদ দামে কেনা উত্তেজনার। সেই সঙ্গে পুঁজিবাদ যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করছে, তার থেকে সাময়িক মুক্তিরও ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। উপাসনার মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের যে অনুভূতি তৈরি হয়, তা ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা তো অবশ্যই, সেই সঙ্গে ক্ষমতাহীনতা ও হতাশার ভাব কাটাতেও সাহায্য করে। শাসনকর্তারা এভাবেই ধর্মকে ব্যবহার করা অত্যন্ত সুবিধাজনক হিসেবে দেখে।
এই কিছুদিন আগে লন্ডনের রাস্তায় দুজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী বলে কথিত আফ্রিকান যুবক প্রকাশ্য দিবালোকে একজন তরুণ ব্রিটিশ সৈন্যকে হত্যা করেছে। ওই কাজের সময় তারা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়েছে, যাতে সবাই বুঝতে পারে যে তারা মুসলমান। কেন এ কাজ করল–দুজনের একজন তার ব্যাখ্যাও দিয়েছে। ব্যাখ্যাটা এই যে, ব্রিটিশ সৈন্যরা মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের হত্যা করছে। কাজটার জন্য মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীরাই দায়ী, কিন্তু তাঁদের যেহেতু হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না, তাই ওই সৈন্যটিকে হত্যা করে তারা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে চায় যে, মুসলমানদের ওপর অত্যাচার না থামালে এ ধরনের প্রতিশোধ গ্রহণ চলতে থাকবে।
ওই যুবকটি জন্মসূত্রে মুসলমান নয়; সে ধর্মান্তরিত। ধর্মান্তরিত হয়ে সে তার মনস্তাত্ত্বিক বিচ্ছিন্নতা ঘুচিয়েছে এবং তার ভেতর ক্ষমতার একটি বোধ জন্মেছে, যেটিকে সে প্রকাশ্যে প্রদর্শন করেছে। সে ভাবেনি যে সে কোনো পাপ করেছে; বরং তার ধারণা হয়েছে যে, সে একজন পাপীকে শাস্তি দিয়ে পুণ্য সঞ্চয় করেছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পেছনে এ ধরনের মনোভাব কাজ করে থাকে।
সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে বিরোধের মূল কারণটি রাজনৈতিক, যার সঙ্গে রাষ্ট্র জড়িত থাকে। সে জন্যই রাষ্ট্রের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া আবশ্যক। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের প্রতিরোধক বৈকি। কিন্তু সেটিই প্রধান কারণ নয়, যে জন্য রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা প্রয়োজন। মূল কারণ হলো, রাষ্ট্র হচ্ছে নাগরিকদের স্বার্থরক্ষার প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র সব নাগরিককে সমান চোখে দেখবে—এটিই প্রত্যাশিত। তেমন আচরণ অবশ্য কোনো রাষ্ট্রই করে না।
রাষ্ট্রমাত্রই রাষ্ট্রশাসকদের স্বার্থ দেখে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব নাগরিকের ভেতর অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করবে—এমন অঙ্গীকার বেশ জোর গলায় ব্যক্ত করা হয়ে থাকে। কিন্তু রাষ্ট্র তা মান্য করে না। না করুক, তবু এমনকি বুর্জোয়া গণতন্ত্রও যদি কায়েম করতে হয় তাহলেও রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা হবে একেবারে প্রাথমিক পদক্ষেপ।
কারণটি সোজা। রাষ্ট্র তো ব্যক্তি নয়, রাষ্ট্রের স্বঘোষিত পরিচয় হলো নাগরিকদের জন্য গড়ে তোলার প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তির ধর্ম থাকতে পারে, থাকেও; কিন্তু রাষ্ট্র যদি কোনো বিশেষ ধর্মে ‘বিশ্বাসী’ হয়, তাহলে তো তার সর্বজনীনতা একেবারে শুরুতেই নাকচ হয়ে গেল। সে যে নিরপেক্ষ থাকবে না, বিশেষ একটি ধর্মের প্রতি তার পক্ষপাত রয়েছে, এটি তো সে জানিয়েই দিচ্ছে। তা হলে?
এ রকম একটি ধারণা প্রচলিত আছে, বিশেষ করে আমাদের এই উপমহাদেশে, যে রাষ্ট্রর ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হলো সব ধর্মকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সমান মর্যাদাদান। আশা করা হয় যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন করবে না। এর অর্থ প্রকারান্তরে দাঁড়ায় যে সব ধর্মকেই সমপরিমাণে উৎসাহ প্রদান করা হবে। এ ধারণাটি কিন্তু সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। ধর্মনিরপেক্ষতার সরল অর্থ, রাষ্ট্রের ধর্মহীনতা। রাষ্ট্রের নাগরিকদের যার যার ধর্ম তার তার, রাষ্ট্র ধর্মাচরণে বাধা দেবে না, আবার উৎসাহও যে দেবে তা-ও নয়; রাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে উদাসীন থাকবে। উপমহাদেশের তিনটি রাষ্ট্রের মধ্যে পাকিস্তান ঘোষিতরূপেই ধর্মনিরপেক্ষ নয়, নিজেকে সে সরাসরি ইসলামি রাষ্ট্রই বলে থাকে এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সঙ্গে এমন আচরণে অভ্যস্ত যে তারা অনেকেই প্রাণভয়ে ইতিমধ্যে জন্মভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। ভারত অবশ্য ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে পরিচিত। কিন্তু সেখানে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতাও কবজা করে ফেলেছে। ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের সদস্যরা যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয় না, এমন নয়। বাংলাদেশের ব্যাপারটি ভিন্ন। এই রাষ্ট্রের অভ্যুদয় একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে। কিন্তু সেই চরিত্র সে রক্ষা করতে পারেনি। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ছাঁটাই হয়ে গেছে। এখানে ধর্ম মন্ত্রণালয় তো আছেই, রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সাংবিধানিক স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে। উপমহাদেশের শাসকশ্রেণি ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার অভ্যাস এখনো ছাড়তে পারেনি।
যাকে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বলছি, তার একটি রাজনৈতিক চরিত্র যেমন আছে, তেমনি রয়েছে একটি দার্শনিক দিক। রাজনৈতিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ রাষ্ট্রের ধর্মহীনতা; দার্শনিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থটি হলো ইহজাগতিকতা। ধর্মনিরপেক্ষতাকে ইংরেজিতে বলে সেক্যুলারিজম। ধারণাটি ইউরোপ থেকেই এসেছে, সেক্যুলারিজম নামটিও সেখানকারই। সেক্যুলারিজমের বাংলা ইহজাগতিকতাই সংগত হতো, কিন্তু রাষ্ট্রের গুরুত্ব বিবেচনা করেই হয়তো সেক্যুলারিজমের নামকরণ ধর্মনিরপেক্ষতা দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ করা চাই, এটিই হয়তো আকাঙ্ক্ষা।
ইউরোপে ধর্মনিরপেক্ষতার আবির্ভাব মধ্যযুগের শেষে, রেনেসাঁর কালে। মধ্যযুগ ছিল খ্রিষ্টীয় ধর্মশাসনের কাল: সময়টিকে অন্ধকারের যুগ বলেও অতিশয় সংগত কারণেই অভিহিত করা হয়ে থাকে। যুগটি ছিল ঈশ্বরকেন্দ্রিক, রেনেসাঁস সেখানে নিয়ে এল মানবকেন্দ্রিকতা। বলা হলো ঈশ্বর আছেন, তিনি থাকবেনও, তবে থাকবেন তাঁর নিজের জায়গাতেই; তাঁকে ভক্তি-শ্রদ্ধা সবই জানানো হবে, কিন্তু ইহজগতে মানুষই প্রধান, এই জগৎ মানুষেরই জগৎ। ধর্মীয় শাসনের অন্ধকার যুগে বিধানটি ছিল এমন যে মানুষ তার জীবনের চরিতার্থতা খুঁজে পাবে ঈশ্বরের ইচ্ছাপূরণের মধ্যে। নতুন যুগের প্রত্যয়টা দাঁড়াল জ্ঞানে-বিজ্ঞানে উন্নয়নে-উদ্ভাবনায় ইহজগৎকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করা চাই। কেননা, মানুষের মনুষ্যত্বের সার্থকতা ওখানেই নিহিত রয়েছে।
ঈশ্বর নয়, মানুষই হয়ে উঠল সবকিছুর মাপকাঠি। ফলে এমন সব অর্জন সম্ভব হলো, পূর্বকালে যা ছিল অকল্পনীয়। পুঁজিবাদ এগোতে থাকল, শিল্পবিপ্লব ঘটল। মানুষের মনুষ্যত্ব বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেল। কিন্তু মুক্তি তো সবার জন্য এল না। পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠা মালিক-শ্রমিক ব্যবধান তৈরি করল। সমস্যা দাঁড়াল ওই বৈষম্য নিয়েই। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি বিপ্লব বৈষম্য দূর করবে বলে আশা করেছিল। কিন্তু বৈষম্য দূর হলো না, যার জন্য বিংশ শতাব্দীতে রুশ বিপ্লব ঘটেছে। ইহজাগতিকতা মানুষের জন্য মানসিক ও কারও কারও জন্য ইহজাগতিক মুক্তি এনেছে, কিন্তু সব মানুষের জন্য অর্থনৈতিক মুক্তি যে নিশ্চিত করবে, তা পারেনি।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ছাঁটাই হয়ে গেছে। এখানে ধর্ম মন্ত্রণালয় তো আছেই, রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সাংবিধানিক স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে। উপমহাদেশের শাসকশ্রেণি ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার অভ্যাস এখনো ছাড়তে পারেনি।
মানুষ তো সমাজেই বাস করে এবং সমাজের দ্বারা যতটা নয় তার চেয়ে বেশি রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ওদিকে ধর্ম বলতে যদি সদাচার, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, কল্যাণকামিতা, আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি বোঝায়, তাহলে সব মানুষেরই ধর্ম থাকতে পারে, এমনকি নাস্তিকেরও। কিন্তু ধর্মের আবার আনুষ্ঠানিক দিকও রয়েছে; অনুষ্ঠান করতে গিয়ে ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং আচার-আচরণের ব্যাপার থাকে না, সমাজের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মের ভিত্তিতে সমাজে বিভাজনও দেখা দেয়, ধর্ম প্রবেশ করে রাজনীতিতে।
রাজনীতির মূল বিষয়টি হচ্ছে ক্ষমতা। ক্ষমতার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা হয় আর তখন উদ্ভব ঘটে সাম্প্রদায়িকতার। সাম্প্রদায়িকতা ধর্মের নয়, রাজনীতির ব্যাপার।
সাম্প্রদায়িকতায় ধর্ম চলে যায় রাজনীতির অধীনে, তখন হানাহানি অনিবার্য হয়ে পড়ে। আমাদের এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার অনাচার আমরা অতীতে দেখেছি, এখনো দেখছি। কেবল উপমহাদেশে কেন, বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই তো এখন সাম্প্রদায়িকতার তাণ্ডব চলছে। ক্রুসেড ও জিহাদের ঘটনা অতীতকালের ব্যাপার নয়, একালেও বিদ্যমান। ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে ফিলিস্তিনবাসীকে উচ্ছেদ করে ধর্মরাজ্য কায়েম করা হয়েছে।
আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও খনিজসমৃদ্ধ এলাকায় দখলদারি প্রতিষ্ঠার যে ভয়াবহ উদ্যোগ নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে সেসব দেশের বামপন্থীদের রুখে দাঁড়ানোর কথা ছিল; কিন্তু সেখানে বামপন্থীদের নির্মূল করেছে স্থানীয় শাসকেরা, নিজেদের স্বৈরশাসনকে পাকাপোক্ত করার প্রয়োজনে। মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তো উঠবেই, উঠেছে ধর্মীয় জঙ্গিদের কাছ থেকে, যাদের একসময়ে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছিল বামপন্থীদের ধ্বংস করার প্রয়োজনে। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই পরিণত হয়েছে ধর্মীয় জিহাদে।
ওদিকে আমেরিকার সক্রিয় উসকানিতে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নি সংঘর্ষ দেখা দিয়েছে। পাকিস্তানেও সে ব্যাধিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাজনীতিতে তাই ধর্ম এসে যায়। পুঁজিবাদীরা ও সাম্রাজ্যবাদীরাই নিয়ে আসে; ধর্মের স্বার্থে নয়, নিজেদের বস্তুগত স্বার্থে। নিষ্পেষিত মানুষকে শান্ত রাখার উদ্দেশ্যেও তারা ধর্মকে ব্যবহার করে। আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের সবচেয়ে অনুন্নত যে এলাকা, যেখানে দরিদ্র শ্রমজীবীদের বসবাস; সেখানে গেলে দেখা যায় সবকিছুই নোংরা ও বিষণ্ন, কেবল দুটি ভবন ছাড়া; একটি হচ্ছে উপাসনালয়, অপরটি পানশালা। দুটিতেই মাদকের সরবরাহ চলে। একটি ধর্মীয় তৃপ্তির, অপরটিতে নগদ দামে কেনা উত্তেজনার। সেই সঙ্গে পুঁজিবাদ যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করছে, তার থেকে সাময়িক মুক্তিরও ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। উপাসনার মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের যে অনুভূতি তৈরি হয়, তা ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা তো অবশ্যই, সেই সঙ্গে ক্ষমতাহীনতা ও হতাশার ভাব কাটাতেও সাহায্য করে। শাসনকর্তারা এভাবেই ধর্মকে ব্যবহার করা অত্যন্ত সুবিধাজনক হিসেবে দেখে।
এই কিছুদিন আগে লন্ডনের রাস্তায় দুজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী বলে কথিত আফ্রিকান যুবক প্রকাশ্য দিবালোকে একজন তরুণ ব্রিটিশ সৈন্যকে হত্যা করেছে। ওই কাজের সময় তারা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়েছে, যাতে সবাই বুঝতে পারে যে তারা মুসলমান। কেন এ কাজ করল–দুজনের একজন তার ব্যাখ্যাও দিয়েছে। ব্যাখ্যাটা এই যে, ব্রিটিশ সৈন্যরা মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের হত্যা করছে। কাজটার জন্য মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীরাই দায়ী, কিন্তু তাঁদের যেহেতু হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না, তাই ওই সৈন্যটিকে হত্যা করে তারা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে চায় যে, মুসলমানদের ওপর অত্যাচার না থামালে এ ধরনের প্রতিশোধ গ্রহণ চলতে থাকবে।
ওই যুবকটি জন্মসূত্রে মুসলমান নয়; সে ধর্মান্তরিত। ধর্মান্তরিত হয়ে সে তার মনস্তাত্ত্বিক বিচ্ছিন্নতা ঘুচিয়েছে এবং তার ভেতর ক্ষমতার একটি বোধ জন্মেছে, যেটিকে সে প্রকাশ্যে প্রদর্শন করেছে। সে ভাবেনি যে সে কোনো পাপ করেছে; বরং তার ধারণা হয়েছে যে, সে একজন পাপীকে শাস্তি দিয়ে পুণ্য সঞ্চয় করেছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পেছনে এ ধরনের মনোভাব কাজ করে থাকে।
সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে বিরোধের মূল কারণটি রাজনৈতিক, যার সঙ্গে রাষ্ট্র জড়িত থাকে। সে জন্যই রাষ্ট্রের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া আবশ্যক। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের প্রতিরোধক বৈকি। কিন্তু সেটিই প্রধান কারণ নয়, যে জন্য রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা প্রয়োজন। মূল কারণ হলো, রাষ্ট্র হচ্ছে নাগরিকদের স্বার্থরক্ষার প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র সব নাগরিককে সমান চোখে দেখবে—এটিই প্রত্যাশিত। তেমন আচরণ অবশ্য কোনো রাষ্ট্রই করে না।
রাষ্ট্রমাত্রই রাষ্ট্রশাসকদের স্বার্থ দেখে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব নাগরিকের ভেতর অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করবে—এমন অঙ্গীকার বেশ জোর গলায় ব্যক্ত করা হয়ে থাকে। কিন্তু রাষ্ট্র তা মান্য করে না। না করুক, তবু এমনকি বুর্জোয়া গণতন্ত্রও যদি কায়েম করতে হয় তাহলেও রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা হবে একেবারে প্রাথমিক পদক্ষেপ।
কারণটি সোজা। রাষ্ট্র তো ব্যক্তি নয়, রাষ্ট্রের স্বঘোষিত পরিচয় হলো নাগরিকদের জন্য গড়ে তোলার প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তির ধর্ম থাকতে পারে, থাকেও; কিন্তু রাষ্ট্র যদি কোনো বিশেষ ধর্মে ‘বিশ্বাসী’ হয়, তাহলে তো তার সর্বজনীনতা একেবারে শুরুতেই নাকচ হয়ে গেল। সে যে নিরপেক্ষ থাকবে না, বিশেষ একটি ধর্মের প্রতি তার পক্ষপাত রয়েছে, এটি তো সে জানিয়েই দিচ্ছে। তা হলে?
এ রকম একটি ধারণা প্রচলিত আছে, বিশেষ করে আমাদের এই উপমহাদেশে, যে রাষ্ট্রর ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হলো সব ধর্মকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সমান মর্যাদাদান। আশা করা হয় যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন করবে না। এর অর্থ প্রকারান্তরে দাঁড়ায় যে সব ধর্মকেই সমপরিমাণে উৎসাহ প্রদান করা হবে। এ ধারণাটি কিন্তু সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। ধর্মনিরপেক্ষতার সরল অর্থ, রাষ্ট্রের ধর্মহীনতা। রাষ্ট্রের নাগরিকদের যার যার ধর্ম তার তার, রাষ্ট্র ধর্মাচরণে বাধা দেবে না, আবার উৎসাহও যে দেবে তা-ও নয়; রাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে উদাসীন থাকবে। উপমহাদেশের তিনটি রাষ্ট্রের মধ্যে পাকিস্তান ঘোষিতরূপেই ধর্মনিরপেক্ষ নয়, নিজেকে সে সরাসরি ইসলামি রাষ্ট্রই বলে থাকে এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সঙ্গে এমন আচরণে অভ্যস্ত যে তারা অনেকেই প্রাণভয়ে ইতিমধ্যে জন্মভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। ভারত অবশ্য ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে পরিচিত। কিন্তু সেখানে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতাও কবজা করে ফেলেছে। ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের সদস্যরা যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয় না, এমন নয়। বাংলাদেশের ব্যাপারটি ভিন্ন। এই রাষ্ট্রের অভ্যুদয় একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে। কিন্তু সেই চরিত্র সে রক্ষা করতে পারেনি। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ছাঁটাই হয়ে গেছে। এখানে ধর্ম মন্ত্রণালয় তো আছেই, রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সাংবিধানিক স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে। উপমহাদেশের শাসকশ্রেণি ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার অভ্যাস এখনো ছাড়তে পারেনি।
যাকে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বলছি, তার একটি রাজনৈতিক চরিত্র যেমন আছে, তেমনি রয়েছে একটি দার্শনিক দিক। রাজনৈতিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ রাষ্ট্রের ধর্মহীনতা; দার্শনিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থটি হলো ইহজাগতিকতা। ধর্মনিরপেক্ষতাকে ইংরেজিতে বলে সেক্যুলারিজম। ধারণাটি ইউরোপ থেকেই এসেছে, সেক্যুলারিজম নামটিও সেখানকারই। সেক্যুলারিজমের বাংলা ইহজাগতিকতাই সংগত হতো, কিন্তু রাষ্ট্রের গুরুত্ব বিবেচনা করেই হয়তো সেক্যুলারিজমের নামকরণ ধর্মনিরপেক্ষতা দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ করা চাই, এটিই হয়তো আকাঙ্ক্ষা।
ইউরোপে ধর্মনিরপেক্ষতার আবির্ভাব মধ্যযুগের শেষে, রেনেসাঁর কালে। মধ্যযুগ ছিল খ্রিষ্টীয় ধর্মশাসনের কাল: সময়টিকে অন্ধকারের যুগ বলেও অতিশয় সংগত কারণেই অভিহিত করা হয়ে থাকে। যুগটি ছিল ঈশ্বরকেন্দ্রিক, রেনেসাঁস সেখানে নিয়ে এল মানবকেন্দ্রিকতা। বলা হলো ঈশ্বর আছেন, তিনি থাকবেনও, তবে থাকবেন তাঁর নিজের জায়গাতেই; তাঁকে ভক্তি-শ্রদ্ধা সবই জানানো হবে, কিন্তু ইহজগতে মানুষই প্রধান, এই জগৎ মানুষেরই জগৎ। ধর্মীয় শাসনের অন্ধকার যুগে বিধানটি ছিল এমন যে মানুষ তার জীবনের চরিতার্থতা খুঁজে পাবে ঈশ্বরের ইচ্ছাপূরণের মধ্যে। নতুন যুগের প্রত্যয়টা দাঁড়াল জ্ঞানে-বিজ্ঞানে উন্নয়নে-উদ্ভাবনায় ইহজগৎকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করা চাই। কেননা, মানুষের মনুষ্যত্বের সার্থকতা ওখানেই নিহিত রয়েছে।
ঈশ্বর নয়, মানুষই হয়ে উঠল সবকিছুর মাপকাঠি। ফলে এমন সব অর্জন সম্ভব হলো, পূর্বকালে যা ছিল অকল্পনীয়। পুঁজিবাদ এগোতে থাকল, শিল্পবিপ্লব ঘটল। মানুষের মনুষ্যত্ব বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেল। কিন্তু মুক্তি তো সবার জন্য এল না। পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠা মালিক-শ্রমিক ব্যবধান তৈরি করল। সমস্যা দাঁড়াল ওই বৈষম্য নিয়েই। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি বিপ্লব বৈষম্য দূর করবে বলে আশা করেছিল। কিন্তু বৈষম্য দূর হলো না, যার জন্য বিংশ শতাব্দীতে রুশ বিপ্লব ঘটেছে। ইহজাগতিকতা মানুষের জন্য মানসিক ও কারও কারও জন্য ইহজাগতিক মুক্তি এনেছে, কিন্তু সব মানুষের জন্য অর্থনৈতিক মুক্তি যে নিশ্চিত করবে, তা পারেনি।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
১২ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
১২ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
১২ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
১২ ঘণ্টা আগে