ফজলুল কবির
এ এক মনোরম শাঁখের করাত। আসতেও কাটছে, যেতেও কাটছে। কোনো নিদানের খোঁজ মিলছে না। যে কাটা পড়ছে, তার নাম ‘গণতন্ত্র’, আর যে কাটছে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। একবার বলা হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম বিশেষত ফেসবুক গণতন্ত্রের জন্য বিরাট হুমকি সৃষ্টি করেছে। আবার কোনো দেশ বা অঞ্চলের গণতান্ত্রিক অবস্থা কেমন, তা বিচারের অন্যতম মানদণ্ড হিসেবে দেখা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রবেশ এবং সেখানে নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টিকে। সেখানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে দেখা হচ্ছে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হিসেবে।
এই দুইয়ের টানাটানিতে সবচেয়ে করুণ অবস্থা হয়েছে বেচারা গণতন্ত্রের। কোথায় দাঁড়ালে যে এই মহার্ঘ বস্তুটি হুমকির ঊর্ধ্বে থাকবে, তা এখন বোঝা মুশকিল। সব মিলিয়ে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটিই এক বিমূর্ত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কীসে যে সে থাকে, এবং কীসে যে থাকে না, তা বোঝা এক কথায় অসম্ভব। বাংলাদেশের মতো দেশে তো এই বস্তু বহু আগেই এক অবোধ্য ধারণায় পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের কাছে গণতন্ত্র আছে। আর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলের কাছে এ বস্তু তো কবেই গত হয়েছে। ফলে যে ‘গণ’ উপলক্ষ করে এত এত বাণী ও বিতর্ক, সেই গণ রীতিমতো ধন্ধে পড়ে যায় ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে।
গত শুক্রবার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা হয়েছে। এই পুরস্কার এবার যৌথভাবে দুই সাংবাদিক পেয়েছেন। এর একজন রাশিয়ার দিমিত্রি মুরাতভ, অন্যজন ফিলিপাইনের মারিয়া রেসা। একজন ভ্লাদিমির পুতিনের দেশের লোক, অন্যজন রদ্রিগো দুতার্তের দেশের, যে দুই দেশ গোটা বিশ্বে একচেটিয়া শাসনের কারণে বেশ আলোচিত। এই দুই দেশ থেকে দুই সাংবাদিকের শান্তিতে নোবেল বিজয় তাই সবাইকে আগ্রহী করে তুলেছে। একই সঙ্গে এই দুই সাংবাদিক এমন দুই কট্টর শাসকের দেশে বসে কী করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে লড়ে গেলেন, তা নিয়েও সবাই আগ্রহী।
এ অবস্থার মধ্যেই মারিয়া রেসা সাক্ষাৎকার দিলেন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে। সেখানে তিনি বললেন, ‘ঘৃণা ও ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। এর মধ্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি তৈরি করছে।’ এমন এক সময় মারিয়া রেসা এ মন্তব্য করলেন, যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির ওপর ‘ভীতিকর ও মুসলিমবিদ্বেষী’ কনটেন্ট ছড়ানো ঠেকাতে ব্যর্থতার অভিযোগ এনেছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক কর্মী ফ্রান্সেস হাউগেন।
বহুদিন থেকেই আলোচনার কেন্দ্রে ফেসবুক। সেই মার্কিন নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপ থেকে শুরু করে ক্যাপিটল হিলে হামলা—সব ক্ষেত্রেই ফেসবুকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ বারবার এসেছে। মূল অভিযোগ—‘ব্যবহারকারীরা ভীতিকর ও মুসলিমবিদ্বেষী কনটেন্ট ছড়াচ্ছেন জেনেও ফেসবুক ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বিশ্বে ভুয়া তথ্য ও জাতিগত সহিংসতা ছড়ানোর এটি অন্যতম কারণ।’
কথা হলো এই যে অভিযোগ, এর বিপরীতে কিন্তু ফেসবুকের জোরালো কোনো বক্তব্য নেই। এর আগেও মার্কিন কংগ্রেসে শুনানির জন্য মার্ক জাকারবার্গকে ডাকা হয়েছে। নিজের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তিনি যেমন সাফাই গেয়েছেন, তেমনি কিছু ভুল শুধরে নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। তা তিনি রেখেছেন কি-না, বা এই যে নতুন করে নিজেদের সাবেক কর্মী ফ্রান্সিস হাউগেনের সঙ্গে ফেসবুকের মডারেটররা বসার আগ্রহ দেখিয়েছেন, তা কোনো পরিবর্তন আনবে কি-না, তা নিয়ে বলাটা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।
এই গোটা আলোচনায় কেন্দ্রটিই আসলে এখনো প্রচ্ছন্ন রয়ে গেছে। আর তা হলো—প্রচলিত তথ্য মাধ্যমগুলো প্রভাব হারাচ্ছে। মানুষের কাছে সংবাদের অন্যতম উৎস হয়ে উঠেছে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। অর্থাৎ, প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের তুলনায় প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে এই প্ল্যাটফর্মগুলো। এগুলো আবার ওপেন প্ল্যাটফর্ম হওয়ায় যে যেমন পারছে, তেমন করে তথ্য দিচ্ছে। এর একেকটির একেক রকম উদ্দেশ্য থাকছে। ফেসবুকের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ হচ্ছে এই উদ্দেশ্যগুলোর মধ্য থেকে গুটিকয় উদ্দেশ্যকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহার করা।
এ তো গেল অভিযোগের বিষয়টি। এবার আসা যাক ফ্রিডম হাউসের কাছে। কোন দেশে গণতন্ত্রের অবস্থা কী, তা নিরূপণে যে কয়টি মানদণ্ড এই সংস্থার রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। অনলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মানদণ্ড হিসেবে দেখে সংস্থাটি। তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়েই ইন্টারনেটে স্বাধীনতা কমেছে। তাও এক-দু বছর ধরে নয়, এগারো বছর ধরে। সবচেয়ে বাজে অবস্থা মিয়ানমার, বেলারুশ ও উগান্ডার। বাংলাদেশের অবস্থানও খুব খারাপ। এ ক্ষেত্রে অনলাইনে প্রবেশযোগ্যতা, সবার জন্য এই সেবার প্রাপ্যতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদিকে গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে দেখা হয়েছে। এই সব ক্ষেত্রেই অবনমন হয়েছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশের। ফ্রিডম হাউস এই পরিস্থিতিকে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বলে মনে করছে।
ফলে গণতন্ত্রের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেন এক দু-ধারি তলোয়ারে পরিণত হয়েছে। এটি বন্ধ বা নিয়ন্ত্রিত থাকলেও গণতন্ত্র ঝুঁকিতে পড়ছে, আবার ব্যাপক সরব থাকলেও পড়ছে। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে একেকজন একেক ধরনের দাওয়াই দিচ্ছে। কেউ বলছে নিয়ন্ত্রণ করা হোক। খোদ ফেসবুকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সম্প্রতি বলেছেন, কিছু ক্ষেত্রে ফেসবুকের অ্যালগরিদমে রাষ্ট্রীয় তদারককারী প্রতিষ্ঠানের প্রবেশাধিকার থাকা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
কিন্তু ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলো জনমত প্রভাবিত করছে, বা সরকারি সংস্থাগুলো নানা নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের নিত্যদিনের আচরণও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে—এই আলোচনার কী হবে। এই কিছুদিন আগেই তো নজরদারি নিয়ে বেশ একটা হইচই হয়ে গেল। বলা হলো গণতন্ত্র একেবারে রসাতলে গেল। কিন্তু এখন আবার ফেসবুকে গুজব, ভুয়া তথ্য ইত্যাদি ছড়ানোর বিষয়কে সামনে এনে এই তদারকির নামে যা বলা হচ্ছে, তা কি ঘুরপথে নজরদারিই নয়? তাহলে বিষয়টি কি এমন দাঁড়াল যে, সোজাসুজি নজরদারিতে গণতন্ত্র আহত হলেও ঘুরপথের নজরদারিতে হয় না?
মোদ্দা কথা হলো, নতুন সময়ের এই প্রযুক্তির সঙ্গে দেশে দেশে বিদ্যমান আইনগুলো ঠিক পেরে উঠছে না। মানুষের অধিকারের প্রশ্নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই আইনের যেমন নবায়ন হয়নি, তেমনি নতুন বাস্তবতার জন্য সামাজিক ও রাজনৈতিক চুক্তিটি ঠিক কী হবে, তাও নিশ্চিত নয়। এই অনিশ্চয়তাই এখন সবচেয়ে প্রভাবশালী। তাই রাজনীতি প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, নাকি প্রযুক্তি রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, করলে মাত্রাটি ঠিক কী, এ দুইয়ের সম্পর্কই-বা কেমন হবে বা হওয়া উচিত, তা এখনো নির্ধারণে হিমশিম খেতে হচ্ছে নীতিনির্ধারকদের।
এ তো গেল একটি দিক। হালের এই আলোচনাগুলো কিন্তু একটি সত্যের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে—আর তা হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আদতে ‘নিমিত্ত মাত্র’। ওই যে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত সংলাপ—‘যা করে দাদার খড়ম, আমি তো নিমিত্তমাত্র।’ ঠিক সেই দশা চলছে এখন। যে শাসক জনগণের অধিকার হরণ করতে চায়, সে করছে। যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মূল্য দিতে চায়, সে দিচ্ছে। তফাৎ হলো, আগের মতো অধিকার প্রশ্নে পথে-ঘাটে আর আন্দোলন হচ্ছে না। ফলে অধিকার হরণ করতে চাওয়া শাসকের সংখ্যা বা শাসকের মধ্যে অধিকার খর্বের প্রবণতা বাড়ছে। আন্দোলন হচ্ছে না বললে অবশ্য এখনকার নেটাগরিকেরা একটু চটে যেতে পারেন। কিন্তু ভেবে দেখুন, অনলাইনে হ্যাশট্যাগ আন্দোলন, বা প্রোফাইল ছবি কালো করে ক্ষোভ জানানো, একের পর এক মিম তৈরি করে শাসকের সমালোচনা করা—এতে আসলে কার কতটুকু আসে-যায়? বিপরীতে জনা বিশেক লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে অবরোধ করল, রাস্তায় যানজট ইত্যাদি সৃষ্টি হলো, আরও হাজারজন দাবিটি মন দিয়ে বা বিরক্তি নিয়ে শুনল, অর্থনীতির চাকায় একটা মৃদু ধাক্কা লাগল, সাধারণের নিত্যকার জীবনযাপনে একটা অস্বস্তি তৈরি হলো—এতে কজনের কী এল-গেল? নিশ্চিতভাবে দ্বিতীয় দশাটিই এড়াতে চাইবেন যেকোনো শাসক। আর তাই অনলাইনে ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশে শাসকদের একটা পর্যায় পর্যন্ত বেশ সহনশীল হতে দেখা যায়। এর শতভাগের একভাগও দেখা যায় না রাস্তায় সশরীরে আন্দোলনের ক্ষেত্রে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো—রাজনীতির ময়দান এখনো রাজাদেরই দখলে। এত এত বুলি ও প্রতিশ্রুতি, সূচক ইত্যাদি সত্ত্বেও এই ‘নীতি’ কিন্তু রাজার বাড়ি ছেড়ে জনতার বাড়িতে আসতে পারেনি। ‘রাজনীতি’ থেকে ‘জননীতি’ হয়ে উঠতে না পারা এই নীতিই কিন্তু ‘গণতন্ত্রের’ ‘গণ-বিচ্ছিন্ন’ থেকে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ। এই কারণ এখনো শনাক্ত হয়নি কেন, বা হলেও কেন এতটা অনালোচিত, তা অবশ্য বোধগম্য নয়। এও একটি ‘রাজনীতিই’ নয়?
ফজলুল কবির: লেখক ও সাংবাদিক
এ এক মনোরম শাঁখের করাত। আসতেও কাটছে, যেতেও কাটছে। কোনো নিদানের খোঁজ মিলছে না। যে কাটা পড়ছে, তার নাম ‘গণতন্ত্র’, আর যে কাটছে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। একবার বলা হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম বিশেষত ফেসবুক গণতন্ত্রের জন্য বিরাট হুমকি সৃষ্টি করেছে। আবার কোনো দেশ বা অঞ্চলের গণতান্ত্রিক অবস্থা কেমন, তা বিচারের অন্যতম মানদণ্ড হিসেবে দেখা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রবেশ এবং সেখানে নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টিকে। সেখানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে দেখা হচ্ছে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হিসেবে।
এই দুইয়ের টানাটানিতে সবচেয়ে করুণ অবস্থা হয়েছে বেচারা গণতন্ত্রের। কোথায় দাঁড়ালে যে এই মহার্ঘ বস্তুটি হুমকির ঊর্ধ্বে থাকবে, তা এখন বোঝা মুশকিল। সব মিলিয়ে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটিই এক বিমূর্ত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কীসে যে সে থাকে, এবং কীসে যে থাকে না, তা বোঝা এক কথায় অসম্ভব। বাংলাদেশের মতো দেশে তো এই বস্তু বহু আগেই এক অবোধ্য ধারণায় পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের কাছে গণতন্ত্র আছে। আর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলের কাছে এ বস্তু তো কবেই গত হয়েছে। ফলে যে ‘গণ’ উপলক্ষ করে এত এত বাণী ও বিতর্ক, সেই গণ রীতিমতো ধন্ধে পড়ে যায় ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে।
গত শুক্রবার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা হয়েছে। এই পুরস্কার এবার যৌথভাবে দুই সাংবাদিক পেয়েছেন। এর একজন রাশিয়ার দিমিত্রি মুরাতভ, অন্যজন ফিলিপাইনের মারিয়া রেসা। একজন ভ্লাদিমির পুতিনের দেশের লোক, অন্যজন রদ্রিগো দুতার্তের দেশের, যে দুই দেশ গোটা বিশ্বে একচেটিয়া শাসনের কারণে বেশ আলোচিত। এই দুই দেশ থেকে দুই সাংবাদিকের শান্তিতে নোবেল বিজয় তাই সবাইকে আগ্রহী করে তুলেছে। একই সঙ্গে এই দুই সাংবাদিক এমন দুই কট্টর শাসকের দেশে বসে কী করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে লড়ে গেলেন, তা নিয়েও সবাই আগ্রহী।
এ অবস্থার মধ্যেই মারিয়া রেসা সাক্ষাৎকার দিলেন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে। সেখানে তিনি বললেন, ‘ঘৃণা ও ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। এর মধ্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি তৈরি করছে।’ এমন এক সময় মারিয়া রেসা এ মন্তব্য করলেন, যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির ওপর ‘ভীতিকর ও মুসলিমবিদ্বেষী’ কনটেন্ট ছড়ানো ঠেকাতে ব্যর্থতার অভিযোগ এনেছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক কর্মী ফ্রান্সেস হাউগেন।
বহুদিন থেকেই আলোচনার কেন্দ্রে ফেসবুক। সেই মার্কিন নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপ থেকে শুরু করে ক্যাপিটল হিলে হামলা—সব ক্ষেত্রেই ফেসবুকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ বারবার এসেছে। মূল অভিযোগ—‘ব্যবহারকারীরা ভীতিকর ও মুসলিমবিদ্বেষী কনটেন্ট ছড়াচ্ছেন জেনেও ফেসবুক ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বিশ্বে ভুয়া তথ্য ও জাতিগত সহিংসতা ছড়ানোর এটি অন্যতম কারণ।’
কথা হলো এই যে অভিযোগ, এর বিপরীতে কিন্তু ফেসবুকের জোরালো কোনো বক্তব্য নেই। এর আগেও মার্কিন কংগ্রেসে শুনানির জন্য মার্ক জাকারবার্গকে ডাকা হয়েছে। নিজের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তিনি যেমন সাফাই গেয়েছেন, তেমনি কিছু ভুল শুধরে নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। তা তিনি রেখেছেন কি-না, বা এই যে নতুন করে নিজেদের সাবেক কর্মী ফ্রান্সিস হাউগেনের সঙ্গে ফেসবুকের মডারেটররা বসার আগ্রহ দেখিয়েছেন, তা কোনো পরিবর্তন আনবে কি-না, তা নিয়ে বলাটা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।
এই গোটা আলোচনায় কেন্দ্রটিই আসলে এখনো প্রচ্ছন্ন রয়ে গেছে। আর তা হলো—প্রচলিত তথ্য মাধ্যমগুলো প্রভাব হারাচ্ছে। মানুষের কাছে সংবাদের অন্যতম উৎস হয়ে উঠেছে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। অর্থাৎ, প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের তুলনায় প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে এই প্ল্যাটফর্মগুলো। এগুলো আবার ওপেন প্ল্যাটফর্ম হওয়ায় যে যেমন পারছে, তেমন করে তথ্য দিচ্ছে। এর একেকটির একেক রকম উদ্দেশ্য থাকছে। ফেসবুকের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ হচ্ছে এই উদ্দেশ্যগুলোর মধ্য থেকে গুটিকয় উদ্দেশ্যকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহার করা।
এ তো গেল অভিযোগের বিষয়টি। এবার আসা যাক ফ্রিডম হাউসের কাছে। কোন দেশে গণতন্ত্রের অবস্থা কী, তা নিরূপণে যে কয়টি মানদণ্ড এই সংস্থার রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। অনলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মানদণ্ড হিসেবে দেখে সংস্থাটি। তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়েই ইন্টারনেটে স্বাধীনতা কমেছে। তাও এক-দু বছর ধরে নয়, এগারো বছর ধরে। সবচেয়ে বাজে অবস্থা মিয়ানমার, বেলারুশ ও উগান্ডার। বাংলাদেশের অবস্থানও খুব খারাপ। এ ক্ষেত্রে অনলাইনে প্রবেশযোগ্যতা, সবার জন্য এই সেবার প্রাপ্যতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদিকে গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে দেখা হয়েছে। এই সব ক্ষেত্রেই অবনমন হয়েছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশের। ফ্রিডম হাউস এই পরিস্থিতিকে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বলে মনে করছে।
ফলে গণতন্ত্রের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেন এক দু-ধারি তলোয়ারে পরিণত হয়েছে। এটি বন্ধ বা নিয়ন্ত্রিত থাকলেও গণতন্ত্র ঝুঁকিতে পড়ছে, আবার ব্যাপক সরব থাকলেও পড়ছে। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে একেকজন একেক ধরনের দাওয়াই দিচ্ছে। কেউ বলছে নিয়ন্ত্রণ করা হোক। খোদ ফেসবুকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সম্প্রতি বলেছেন, কিছু ক্ষেত্রে ফেসবুকের অ্যালগরিদমে রাষ্ট্রীয় তদারককারী প্রতিষ্ঠানের প্রবেশাধিকার থাকা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
কিন্তু ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলো জনমত প্রভাবিত করছে, বা সরকারি সংস্থাগুলো নানা নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের নিত্যদিনের আচরণও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে—এই আলোচনার কী হবে। এই কিছুদিন আগেই তো নজরদারি নিয়ে বেশ একটা হইচই হয়ে গেল। বলা হলো গণতন্ত্র একেবারে রসাতলে গেল। কিন্তু এখন আবার ফেসবুকে গুজব, ভুয়া তথ্য ইত্যাদি ছড়ানোর বিষয়কে সামনে এনে এই তদারকির নামে যা বলা হচ্ছে, তা কি ঘুরপথে নজরদারিই নয়? তাহলে বিষয়টি কি এমন দাঁড়াল যে, সোজাসুজি নজরদারিতে গণতন্ত্র আহত হলেও ঘুরপথের নজরদারিতে হয় না?
মোদ্দা কথা হলো, নতুন সময়ের এই প্রযুক্তির সঙ্গে দেশে দেশে বিদ্যমান আইনগুলো ঠিক পেরে উঠছে না। মানুষের অধিকারের প্রশ্নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই আইনের যেমন নবায়ন হয়নি, তেমনি নতুন বাস্তবতার জন্য সামাজিক ও রাজনৈতিক চুক্তিটি ঠিক কী হবে, তাও নিশ্চিত নয়। এই অনিশ্চয়তাই এখন সবচেয়ে প্রভাবশালী। তাই রাজনীতি প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, নাকি প্রযুক্তি রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, করলে মাত্রাটি ঠিক কী, এ দুইয়ের সম্পর্কই-বা কেমন হবে বা হওয়া উচিত, তা এখনো নির্ধারণে হিমশিম খেতে হচ্ছে নীতিনির্ধারকদের।
এ তো গেল একটি দিক। হালের এই আলোচনাগুলো কিন্তু একটি সত্যের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে—আর তা হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আদতে ‘নিমিত্ত মাত্র’। ওই যে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত সংলাপ—‘যা করে দাদার খড়ম, আমি তো নিমিত্তমাত্র।’ ঠিক সেই দশা চলছে এখন। যে শাসক জনগণের অধিকার হরণ করতে চায়, সে করছে। যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মূল্য দিতে চায়, সে দিচ্ছে। তফাৎ হলো, আগের মতো অধিকার প্রশ্নে পথে-ঘাটে আর আন্দোলন হচ্ছে না। ফলে অধিকার হরণ করতে চাওয়া শাসকের সংখ্যা বা শাসকের মধ্যে অধিকার খর্বের প্রবণতা বাড়ছে। আন্দোলন হচ্ছে না বললে অবশ্য এখনকার নেটাগরিকেরা একটু চটে যেতে পারেন। কিন্তু ভেবে দেখুন, অনলাইনে হ্যাশট্যাগ আন্দোলন, বা প্রোফাইল ছবি কালো করে ক্ষোভ জানানো, একের পর এক মিম তৈরি করে শাসকের সমালোচনা করা—এতে আসলে কার কতটুকু আসে-যায়? বিপরীতে জনা বিশেক লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে অবরোধ করল, রাস্তায় যানজট ইত্যাদি সৃষ্টি হলো, আরও হাজারজন দাবিটি মন দিয়ে বা বিরক্তি নিয়ে শুনল, অর্থনীতির চাকায় একটা মৃদু ধাক্কা লাগল, সাধারণের নিত্যকার জীবনযাপনে একটা অস্বস্তি তৈরি হলো—এতে কজনের কী এল-গেল? নিশ্চিতভাবে দ্বিতীয় দশাটিই এড়াতে চাইবেন যেকোনো শাসক। আর তাই অনলাইনে ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশে শাসকদের একটা পর্যায় পর্যন্ত বেশ সহনশীল হতে দেখা যায়। এর শতভাগের একভাগও দেখা যায় না রাস্তায় সশরীরে আন্দোলনের ক্ষেত্রে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো—রাজনীতির ময়দান এখনো রাজাদেরই দখলে। এত এত বুলি ও প্রতিশ্রুতি, সূচক ইত্যাদি সত্ত্বেও এই ‘নীতি’ কিন্তু রাজার বাড়ি ছেড়ে জনতার বাড়িতে আসতে পারেনি। ‘রাজনীতি’ থেকে ‘জননীতি’ হয়ে উঠতে না পারা এই নীতিই কিন্তু ‘গণতন্ত্রের’ ‘গণ-বিচ্ছিন্ন’ থেকে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ। এই কারণ এখনো শনাক্ত হয়নি কেন, বা হলেও কেন এতটা অনালোচিত, তা অবশ্য বোধগম্য নয়। এও একটি ‘রাজনীতিই’ নয়?
ফজলুল কবির: লেখক ও সাংবাদিক
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
১৭ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
১৭ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
১৮ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
১৮ ঘণ্টা আগে