সেলিম জাহান
কড়া নাড়ব না বৈদ্যুতিক ঘণ্টিটি বাজাব, তা ভাবতেই মিনিটখানেক কেটে গেল। অকারণে নয়, সময়টার কথা ভেবেই আমার এ দ্বিধা। শীতের পড়ন্ত বিকেল। ইতিমধ্যেই সূর্য এলিয়ে পড়েছে পশ্চিম গগনে।
চারদিক সুনসান, শব্দদের নীলডাউন করিয়ে রাখা হয়েছে চারপাশে–নিস্তব্ধতার গন্ধ এসে লাগছে নাকে। আমি ক্ষয়ে যাওয়া, বিবর্ণ হয়ে ওঠা লাল মেঝের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অবশ্য এ পর্যন্ত আসতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বেশ কিছু চিহ্ন মেলাতে হয়েছে মন দিয়ে। যেমন, বড় রাস্তায় রিকশা থেকে নেমে প্রথমেই খুঁজে বের করতে হয়েছে পুরোনো প্রায় ভেঙেপড়া গোল বারান্দাওয়ালা ছাত্রদের মেসবাড়িটি আছে কি না।
ওটা পেয়ে স্বস্তিবোধ করেছি, যদিও বাড়িটি প্রায় ধসে পড়েছে। তবু চেনা যায়। একটু এগোতেই রফিকদের বাড়ির সামনের মজা পুকুর। প্রায় ৫০ বছর আগেও এটা মজা পুকুরই ছিল। এখন ছোট হতে হতে ডোবা হয়ে গেছে। ভেঙেপড়া পাড়ে জলের ওপর কলমিলতা আর তার বেগুনি রঙের ফুল, হেলেঞ্চার ঝোপ, এখানে-ওখানে ঢেঁকিশাকের সাপের মতো পেঁচানো শুঁড়। একটা ফড়িং কেবলই উড়ে উড়ে সেই শুঁড়ে বসছে আর সরে যাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত কড়াটিই নাড়লাম মৃদুভাবে শুধু এই কারণেই যে, কড়ার শব্দ আমার আঙুলের নিয়ন্ত্রণে, বৈদ্যুতিক ঘণ্টি তো নয়। কিছুক্ষণ বাদে ভেতরে সন্তর্পণে ছিটকিনি খোলার শব্দ পেলাম। খুলে গেল দরজার পাল্লা এবং আমার সামনে দেখতে পেলাম এক ভারি মিষ্টি চেহারার কিশোরীকে। সাপের মতো তার চুলের দুই বেণি দুলছে মাথার দু-পাশে, মুখে একটা ঔৎসুক্য। ‘এটা কি রফিকদের বাড়ি?’ নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম আমি। তার চমকানোটা আমি টের পাই এবং বুঝতে পারি; কিন্তু কী করব আমি? ও ছাড়া যে এ বাড়ির অন্য কোনো পরিচয় আমার জানা নেই। ‘দাঁড়ান একটু,’ বলেই সে ভেতরে চলে যায়।
একটু পরেই ভেতরের ঘরের পর্দা ঠেলে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। আমার দিকে এগোতে এগোতে বললেন, ‘কাকে চাইছেন?’ আমি দ্রুত এদিক-ওদিক তাকাই, কথা খুঁজতে চেষ্টা করি, ‘মানে আমি...’ ততক্ষণে ভদ্রলোক আমার কাছে চলে এসেছেন। তারপরেই তাঁর উচ্ছ্বসিত বিস্ময়, ‘সেলিম ভাই না?’ আমি তখনো একটু বিভ্রান্ত দেখে তিনি হেসে বললেন, ‘চিনতে পারলেন না তো? আমি শফিক।’ এতক্ষণে চেনা গেল তাঁকে–রফিকের সবচেয়ে ছোট ভাই।
‘আসুন, ভেতরে আসুন,’ আমার হাত ধরে শফিকের সাদর আহ্বান। ভেতরে ঢুকি। শীত-বিকেলের রোদ পড়ে এসেছে। ঘরের ভেতরে ধূসর ছায়ার মিহি পর্দা। শফিক বাতি জ্বালে ঘরের। বিবর্ণ আলোয় কক্ষের জরাজীর্ণ অবস্থাই যেন ফুটে ওঠে। ‘বসুন, আমি সবাইকে ডাকি,’ বলতে বলতে ভেতরের দরজার পর্দা ঠেলে শফিক কক্ষান্তরে চলে যায়।
আমি বসি না, চারদিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাই। এই ঘর, এর আসবাব আমার চেনা। পড়ন্ত কৈশোরে বহুবার এসেছি এই ঘরে। কাটিয়েছি দীর্ঘ সময়–আড্ডায়, গল্পে, ক্যারম খেলায়। তখন অবশ্য এ ঘরের জৌলুশ ছিল, যৌবন ছিল বলা যায়। চোখ চলে যায় বাঁ-দিকের দেয়ালে–ধূলিধূসরিত কাত হয়ে ঝুলছে প্রায় বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কালো ফ্রেমবদ্ধ একটি ছবি। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই। বুঝতে পারি, ওটা রফিকেরই ছবি। হাস্যোজ্জ্বল এক কিশোরের মুখ। কত দিন হলো রফিক চলে গেছে? ‘তা প্রায় ৫০ বছর তো হবেই।’ ‘আপনি কি বড় চাচার বন্ধু?’ প্রশ্ন শুনে চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখি, ভেতরের দরজার পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে সেই কিশোরীটি, যে আমার দরজা খুলে দিয়েছিল।
‘হ্যাঁ’, সহাস্যে বলি আমি, ‘একই ক্লাসে পড়তাম আমরা স্কুলে। এসো, এখানে এসে বসো,’ নিজে বসতে বসতে তাকে বলি। কাছে এসে দাঁড়াতেই তাকে হাত ধরে পাশে বসাই। টের পাই ছাড়ছে না সে আমার হাত এবং সরাচ্ছে না তার চোখ আমার মুখের ওপর থেকে। বুঝতে পারি, আমার মাঝে সে তার চলে যাওয়া পিতৃব্যকে খুঁজছে। ‘বড় চাচাকে আমি দেখিনি,’ খুব মৃদুস্বরে নরম গলায় বলে সে।
পর্দার দিকে তাকিয়ে দেখি বেশ কটি বালক-বালিকা পর্দার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে প্রচণ্ড কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে। নতুন আসা এক অতিথির প্রতি তাদের ঔৎসুক্যের শেষ নেই। বুঝতে পারি, আমার পরিচয় পৌঁছে গেছে অন্দরে। ঠিক তখনই শফিক ঘরে ঢোকে একজন ভদ্রলোক, কয়েকজন মহিলা ও কিশোর-কিশোরী নিয়ে। বুঝতে পারি, পুরো পরিবার এসে গেছে।
‘বাহ্, তিতিরের সঙ্গে গল্প শুরু হয়ে গেছে দেখছি—আমার বড় মেয়ে,’ হাসিমুখে শফিক বলে। ‘শুরু করেছি মাত্র,’ বলি আমি। তারপর সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পালা। রফিকের মেজ ভাই তারিককে সহজেই চিনতে পারি–আমাদের দুই ক্লাস নিচে পড়ত সে। ‘বলুন তো আমি কে?’ দুষ্টু হাসির ঝিলিক তুলে জিজ্ঞেস করেন এক মহিলা। আমি হেসে ফেলি। বলি, ‘লিলি। তোমার গালের ওই বিখ্যাত টোলের জন্য তুমি লুকোতে পারবে না কোথাও কখনো।’ লিলি রফিকের ছোট বোন। আমার কথায় লালের ছোপ লাগে লিলির গালে।
পরিচিত হই পরিবারের বধূদের ও অন্যান্য পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যদের সঙ্গে। তারপর গল্প জমে ওঠে। জলখাবার আসে, আসে ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা। ওঠে হাস্যরোল। সব গল্পই রফিককে ঘিরে। টের পাই স্মৃতি থেকে উঠে এসে রফিক জীবন্ত হয়ে উঠছে ওর ভাই-বোনদের কাছে, পরিবারের বধূদের কাছে, তাঁদের ছেলে-মেয়েদের কাছে। স্মৃতির সঠিকতা নিয়ে ওর ভাই-বোনেরা বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করে, কথা-কাটাকাটি হয়, আমাকে সাক্ষী মানে। অন্যরা গল্প শোনে উদ্গ্রীব হয়ে, উপভোগ করে সাক্ষী মানার ব্যাপারটি, হেসে ওঠে পরিণত বয়সের কয়েকজন মানুষের শিশুদের মতো কলহে।
বুঝতে পারি, আমার মাঝখান দিয়ে ওরা পৌঁছে গেছে কিশোর বয়সে চলে যাওয়া ওদের অগ্রজের কাছে। টের পাই, লিলি কিংবা তারিক কথা বলতে বলতে স্পর্শ করছে আমাকে। যেন আমার মধ্য দিয়েই ওরা ছুঁচ্ছে রফিককে। কত গল্প, কত স্মৃতি। তার কিছু আমি জানি, কিছু জানি না। তারপর ধীরে ধীরে গল্প থিতিয়ে আসে, আস্তে আস্তে নিস্তব্ধতা কালো বেড়ালের মতো ঘরের মাঝে তার থাবা ছড়িয়ে দেয়।
একসময়ে লিলি কথা কয়ে ওঠে। ‘কত বছর পর ভাইয়ার কথা উঠল। কত দিন পর ভাইয়ার কথা বললাম সবাই মিলে। আপনিই তো ভাইয়াকে আবার আমাদের কাছে এনে দিলেন।’ জলের ধারা নামে তার চোখে। ‘সেলিম ভাই, নিত্যদিনের জীবনে ভাইয়া আমাদের কাছে এখন শুধু একটা ছবি। প্রায়ই মনে থাকে না, আমাদের একটা বড় ভাই ছিল। আপনিই তো আমাদের সেই কবে চলে যাওয়া ভাইয়া,’ ভাঙা গলায় বলে শফিক। চেয়ে দেখি চোখ কারও শুকনো নেই–না যারা রফিককে দেখেছে, না যারা তাকে দেখেনি।
তারপর কেমন করে জানি আমাদের সবার চোখ অভ্রান্তভাবে চলে যায় দেয়ালের বিবর্ণ হয়ে যাওয়া প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে তোলা রফিকের ছবিটির দিকে। সময়ের রেখা ধরে আমাদের সবার বয়স বেড়েছে; কিন্তু রফিক তো রয়ে গেছে তিতিরের বয়সে। মনে হয়, সেই চির কিশোর মুখের রফিক যেন বলছে, ‘কী হে, কেমন আছো সবাই? সবকিছু ঠিকঠাক? এত দিনে মনে পড়ল আমাকে?’
কেমন যেন একটা ঠান্ডা নিশ্চুপতা নেমে আসে আমাদের ঘিরে ওই ধূসর সন্ধ্যায়। তার মাঝেও অনুভব করি আমাদের প্রত্যেকের মনের মধ্যে নানান স্মৃতি, নানান না-বলা কথা উঠে আসছে নানাভাবে। ‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।’ হতে পারে। কিন্তু স্মৃতির আয়ুর কি কোনো সময় আছে, না হতে পারে?
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
কড়া নাড়ব না বৈদ্যুতিক ঘণ্টিটি বাজাব, তা ভাবতেই মিনিটখানেক কেটে গেল। অকারণে নয়, সময়টার কথা ভেবেই আমার এ দ্বিধা। শীতের পড়ন্ত বিকেল। ইতিমধ্যেই সূর্য এলিয়ে পড়েছে পশ্চিম গগনে।
চারদিক সুনসান, শব্দদের নীলডাউন করিয়ে রাখা হয়েছে চারপাশে–নিস্তব্ধতার গন্ধ এসে লাগছে নাকে। আমি ক্ষয়ে যাওয়া, বিবর্ণ হয়ে ওঠা লাল মেঝের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অবশ্য এ পর্যন্ত আসতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বেশ কিছু চিহ্ন মেলাতে হয়েছে মন দিয়ে। যেমন, বড় রাস্তায় রিকশা থেকে নেমে প্রথমেই খুঁজে বের করতে হয়েছে পুরোনো প্রায় ভেঙেপড়া গোল বারান্দাওয়ালা ছাত্রদের মেসবাড়িটি আছে কি না।
ওটা পেয়ে স্বস্তিবোধ করেছি, যদিও বাড়িটি প্রায় ধসে পড়েছে। তবু চেনা যায়। একটু এগোতেই রফিকদের বাড়ির সামনের মজা পুকুর। প্রায় ৫০ বছর আগেও এটা মজা পুকুরই ছিল। এখন ছোট হতে হতে ডোবা হয়ে গেছে। ভেঙেপড়া পাড়ে জলের ওপর কলমিলতা আর তার বেগুনি রঙের ফুল, হেলেঞ্চার ঝোপ, এখানে-ওখানে ঢেঁকিশাকের সাপের মতো পেঁচানো শুঁড়। একটা ফড়িং কেবলই উড়ে উড়ে সেই শুঁড়ে বসছে আর সরে যাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত কড়াটিই নাড়লাম মৃদুভাবে শুধু এই কারণেই যে, কড়ার শব্দ আমার আঙুলের নিয়ন্ত্রণে, বৈদ্যুতিক ঘণ্টি তো নয়। কিছুক্ষণ বাদে ভেতরে সন্তর্পণে ছিটকিনি খোলার শব্দ পেলাম। খুলে গেল দরজার পাল্লা এবং আমার সামনে দেখতে পেলাম এক ভারি মিষ্টি চেহারার কিশোরীকে। সাপের মতো তার চুলের দুই বেণি দুলছে মাথার দু-পাশে, মুখে একটা ঔৎসুক্য। ‘এটা কি রফিকদের বাড়ি?’ নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম আমি। তার চমকানোটা আমি টের পাই এবং বুঝতে পারি; কিন্তু কী করব আমি? ও ছাড়া যে এ বাড়ির অন্য কোনো পরিচয় আমার জানা নেই। ‘দাঁড়ান একটু,’ বলেই সে ভেতরে চলে যায়।
একটু পরেই ভেতরের ঘরের পর্দা ঠেলে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। আমার দিকে এগোতে এগোতে বললেন, ‘কাকে চাইছেন?’ আমি দ্রুত এদিক-ওদিক তাকাই, কথা খুঁজতে চেষ্টা করি, ‘মানে আমি...’ ততক্ষণে ভদ্রলোক আমার কাছে চলে এসেছেন। তারপরেই তাঁর উচ্ছ্বসিত বিস্ময়, ‘সেলিম ভাই না?’ আমি তখনো একটু বিভ্রান্ত দেখে তিনি হেসে বললেন, ‘চিনতে পারলেন না তো? আমি শফিক।’ এতক্ষণে চেনা গেল তাঁকে–রফিকের সবচেয়ে ছোট ভাই।
‘আসুন, ভেতরে আসুন,’ আমার হাত ধরে শফিকের সাদর আহ্বান। ভেতরে ঢুকি। শীত-বিকেলের রোদ পড়ে এসেছে। ঘরের ভেতরে ধূসর ছায়ার মিহি পর্দা। শফিক বাতি জ্বালে ঘরের। বিবর্ণ আলোয় কক্ষের জরাজীর্ণ অবস্থাই যেন ফুটে ওঠে। ‘বসুন, আমি সবাইকে ডাকি,’ বলতে বলতে ভেতরের দরজার পর্দা ঠেলে শফিক কক্ষান্তরে চলে যায়।
আমি বসি না, চারদিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাই। এই ঘর, এর আসবাব আমার চেনা। পড়ন্ত কৈশোরে বহুবার এসেছি এই ঘরে। কাটিয়েছি দীর্ঘ সময়–আড্ডায়, গল্পে, ক্যারম খেলায়। তখন অবশ্য এ ঘরের জৌলুশ ছিল, যৌবন ছিল বলা যায়। চোখ চলে যায় বাঁ-দিকের দেয়ালে–ধূলিধূসরিত কাত হয়ে ঝুলছে প্রায় বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কালো ফ্রেমবদ্ধ একটি ছবি। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই। বুঝতে পারি, ওটা রফিকেরই ছবি। হাস্যোজ্জ্বল এক কিশোরের মুখ। কত দিন হলো রফিক চলে গেছে? ‘তা প্রায় ৫০ বছর তো হবেই।’ ‘আপনি কি বড় চাচার বন্ধু?’ প্রশ্ন শুনে চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখি, ভেতরের দরজার পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে সেই কিশোরীটি, যে আমার দরজা খুলে দিয়েছিল।
‘হ্যাঁ’, সহাস্যে বলি আমি, ‘একই ক্লাসে পড়তাম আমরা স্কুলে। এসো, এখানে এসে বসো,’ নিজে বসতে বসতে তাকে বলি। কাছে এসে দাঁড়াতেই তাকে হাত ধরে পাশে বসাই। টের পাই ছাড়ছে না সে আমার হাত এবং সরাচ্ছে না তার চোখ আমার মুখের ওপর থেকে। বুঝতে পারি, আমার মাঝে সে তার চলে যাওয়া পিতৃব্যকে খুঁজছে। ‘বড় চাচাকে আমি দেখিনি,’ খুব মৃদুস্বরে নরম গলায় বলে সে।
পর্দার দিকে তাকিয়ে দেখি বেশ কটি বালক-বালিকা পর্দার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে প্রচণ্ড কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে। নতুন আসা এক অতিথির প্রতি তাদের ঔৎসুক্যের শেষ নেই। বুঝতে পারি, আমার পরিচয় পৌঁছে গেছে অন্দরে। ঠিক তখনই শফিক ঘরে ঢোকে একজন ভদ্রলোক, কয়েকজন মহিলা ও কিশোর-কিশোরী নিয়ে। বুঝতে পারি, পুরো পরিবার এসে গেছে।
‘বাহ্, তিতিরের সঙ্গে গল্প শুরু হয়ে গেছে দেখছি—আমার বড় মেয়ে,’ হাসিমুখে শফিক বলে। ‘শুরু করেছি মাত্র,’ বলি আমি। তারপর সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পালা। রফিকের মেজ ভাই তারিককে সহজেই চিনতে পারি–আমাদের দুই ক্লাস নিচে পড়ত সে। ‘বলুন তো আমি কে?’ দুষ্টু হাসির ঝিলিক তুলে জিজ্ঞেস করেন এক মহিলা। আমি হেসে ফেলি। বলি, ‘লিলি। তোমার গালের ওই বিখ্যাত টোলের জন্য তুমি লুকোতে পারবে না কোথাও কখনো।’ লিলি রফিকের ছোট বোন। আমার কথায় লালের ছোপ লাগে লিলির গালে।
পরিচিত হই পরিবারের বধূদের ও অন্যান্য পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যদের সঙ্গে। তারপর গল্প জমে ওঠে। জলখাবার আসে, আসে ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা। ওঠে হাস্যরোল। সব গল্পই রফিককে ঘিরে। টের পাই স্মৃতি থেকে উঠে এসে রফিক জীবন্ত হয়ে উঠছে ওর ভাই-বোনদের কাছে, পরিবারের বধূদের কাছে, তাঁদের ছেলে-মেয়েদের কাছে। স্মৃতির সঠিকতা নিয়ে ওর ভাই-বোনেরা বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করে, কথা-কাটাকাটি হয়, আমাকে সাক্ষী মানে। অন্যরা গল্প শোনে উদ্গ্রীব হয়ে, উপভোগ করে সাক্ষী মানার ব্যাপারটি, হেসে ওঠে পরিণত বয়সের কয়েকজন মানুষের শিশুদের মতো কলহে।
বুঝতে পারি, আমার মাঝখান দিয়ে ওরা পৌঁছে গেছে কিশোর বয়সে চলে যাওয়া ওদের অগ্রজের কাছে। টের পাই, লিলি কিংবা তারিক কথা বলতে বলতে স্পর্শ করছে আমাকে। যেন আমার মধ্য দিয়েই ওরা ছুঁচ্ছে রফিককে। কত গল্প, কত স্মৃতি। তার কিছু আমি জানি, কিছু জানি না। তারপর ধীরে ধীরে গল্প থিতিয়ে আসে, আস্তে আস্তে নিস্তব্ধতা কালো বেড়ালের মতো ঘরের মাঝে তার থাবা ছড়িয়ে দেয়।
একসময়ে লিলি কথা কয়ে ওঠে। ‘কত বছর পর ভাইয়ার কথা উঠল। কত দিন পর ভাইয়ার কথা বললাম সবাই মিলে। আপনিই তো ভাইয়াকে আবার আমাদের কাছে এনে দিলেন।’ জলের ধারা নামে তার চোখে। ‘সেলিম ভাই, নিত্যদিনের জীবনে ভাইয়া আমাদের কাছে এখন শুধু একটা ছবি। প্রায়ই মনে থাকে না, আমাদের একটা বড় ভাই ছিল। আপনিই তো আমাদের সেই কবে চলে যাওয়া ভাইয়া,’ ভাঙা গলায় বলে শফিক। চেয়ে দেখি চোখ কারও শুকনো নেই–না যারা রফিককে দেখেছে, না যারা তাকে দেখেনি।
তারপর কেমন করে জানি আমাদের সবার চোখ অভ্রান্তভাবে চলে যায় দেয়ালের বিবর্ণ হয়ে যাওয়া প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে তোলা রফিকের ছবিটির দিকে। সময়ের রেখা ধরে আমাদের সবার বয়স বেড়েছে; কিন্তু রফিক তো রয়ে গেছে তিতিরের বয়সে। মনে হয়, সেই চির কিশোর মুখের রফিক যেন বলছে, ‘কী হে, কেমন আছো সবাই? সবকিছু ঠিকঠাক? এত দিনে মনে পড়ল আমাকে?’
কেমন যেন একটা ঠান্ডা নিশ্চুপতা নেমে আসে আমাদের ঘিরে ওই ধূসর সন্ধ্যায়। তার মাঝেও অনুভব করি আমাদের প্রত্যেকের মনের মধ্যে নানান স্মৃতি, নানান না-বলা কথা উঠে আসছে নানাভাবে। ‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।’ হতে পারে। কিন্তু স্মৃতির আয়ুর কি কোনো সময় আছে, না হতে পারে?
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
১৭ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
১৭ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
১৭ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
১৭ ঘণ্টা আগে