বিভুরঞ্জন সরকার
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কতগুলো লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছিল। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ফলে রাজনীতিতে যে পাকিস্তানি ধারার অবসান ঘটেছিল, তা উল্টে দিয়ে আবার পাকিস্তানি ধারা ফিরিয়ে আনার পথ মুক্ত করা হয়েছিল। অবৈধভাবে, অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা দখল শুরু হয়েছিল। রাষ্ট্রের স্থপতিকে সপরিবারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে রাজনীতিতে যে বড় শূন্যতা ও অস্থিরতার সৃষ্টি করা হয়েছিল, তা আমরা এখনো পুরোপুরি সামলে উঠতে পারিনি। এ কথা ঠিক যে ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীদের বিচার হয়েছে, আদালত তাঁদের দণ্ড দিয়েছেন এবং কয়েকজনের দণ্ড কার্যকরও হয়েছে। কয়েকজন এখনো বিদেশে পালিয়ে আছেন।
আগস্ট মাস এলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়টি আবার সামনে আসে এবং এ নিয়ে নানা প্রিয়-অপ্রিয় আলোচনা-সমালোচনা হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে না। ১ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা ছিল, একদিন সেটা বের হবে। প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুক-রশিদের বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাবেক সেনাশাসক জিয়াউর রহমানকে নেপথ্য শক্তি হিসেবে উল্লেখের তথ্য তুলে ধরেন। এতে গোসসা করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পরের দিন বলেছেন, হত্যাকাণ্ড যাঁরা ঘটিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। অথচ আওয়ামী লীগ এখন নতুন গীত শুরু করেছে যে, জিয়াউর রহমান এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার পরদিন আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আগস্ট মাস এলেই বিএনপি রক্তাক্ত অতীতের অন্তর্জ্বালায় অস্থির হয়ে পড়ে। এই পাল্টাপাল্টি বাক্য চালাচালি আমাদের রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে সদিচ্ছা, সততা ও সাহসের প্রয়োজন, তা রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে দেখা যায় না।
বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা কতটা, সে বিষয়ে বিতর্ক করা গেলেও ওই হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি যে ছিলেন জিয়াউর রহমান, তা কি অস্বীকার করা যাবে? বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে, অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা দখলের পথ তৈরি না হলে জিয়াউর রহমান কি রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে বিএনপি নামের রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ পেতেন? আর তিনি ক্ষমতার শীর্ষে না উঠলে কোথায় থাকতেন তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া?
দুই
ঐতিহাসিকভাবেই আমাদের দেশের রাজনীতি হলো বিরোধিতার, ‘না’ বলার। ব্রিটিশবিরোধিতা দিয়ে যার শুরু হয়েছে, তার অবসান আমরা ঘটাতে পারিনি। তাই ক্ষমতাসীন সরকার ও দলের বিরুদ্ধে না কথা বললে পাবলিক খায় না। আবার আমাদের দেশে কিছু ‘নিরপেক্ষ’ লেখক-চিন্তক আছেন, যাঁদের আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ‘রিজার্ভেশন’ আছে। তাঁরা আওয়ামী লীগের সমালোচনায় আনন্দ পান, বিএনপির সমালোচনায় মনে কষ্ট পান। অথচ আওয়ামী লীগ দলটির জন্ম হয়েছে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, জনগণের প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে আর বিএনপির জন্ম হয়েছে ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থের পাহারাদার হওয়ার জন্য। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এক করে দেখার যে রাজনীতি, সেটা অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফল। সে জন্যই বিএনপির অন্যায্য অবস্থানেরও পক্ষে দাঁড়াতে যাঁরা কুণ্ঠাবোধ করেন না, তাঁরা আওয়ামী লীগের ন্যায্য অবস্থানেও নাখোশ হন।
বিএনপির দুর্নীতি-অনিয়মের কথা বললে তাঁরা আহত হয়ে বলেন, এখন বিএনপির সমালোচনা কেন? বিএনপির পাপের শাস্তি বিএনপি পেয়েছে। এত বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে আছে। এখন টানা ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ এবং তারা এখন দেশটাকে লুটপাটের ভাগাড় বানিয়েছে। তাই এখন সমালোচনা করতে হবে আওয়ামী লীগের।
কথা মিথ্যা না। আমরা যখন দেশের জিম্মাদার আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে বানিয়েছি, তখনই বড় ভুল করেছি। সংবিধান অনুযায়ী দেশের মালিক জনগণ। কিন্তু কীভাবে দেশের মালিক-মোক্তার আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বনে গেল, সে প্রশ্নের জবাব নেই। আমরা, বাংলাদেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী কীভাবে যেন এটা মেনে নিয়েছি যে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি পালাক্রমে দেশ শাসন করবে।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে এই ধারায় পরিবর্তন আসায়, আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকায় ওই নিরপেক্ষ চিন্তকদের গায়ের জ্বালা বেড়ে গেছে। প্রশ্ন হলো, বিএনপি টানা ক্ষমতার বাইরে আছে বলে কি দলটির রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনায় কোনো পরিবর্তন এসেছে? বিএনপি কি তাদের অতীত রাজনীতির ত্রুটি-বিচ্যুতির মূল্যায়ন-বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে তারা আর দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-অনিয়মকে প্রশ্রয় দেবে না? প্রতিহিংসার রাজনীতি করবে না? রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলে হত্যা-খুনের রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবে না? না, তেমন কোনো পরিবর্তন বিএনপিতে দৃশ্যমান নয়।
অনেকে মনে করেন, বিএনপি না বদলালে আওয়ামী লীগ বদলাবে না। এই দুই দল ক্ষমতার রাজনীতির প্রতিযোগী এবং প্রতিপক্ষ। মোটাদাগে এটা বলা যায়, দেশে অপরাজনীতি বা খারাপ রাজনীতি চালু করেছে বিএনপি। তাতে দলটির জনপ্রিয় হতে অসুবিধা হয়নি। সম্ভবত এ জন্যই কিছু ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ এখন বিএনপিকে অনুসরণ করছে।
বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল মূলত দুটি। আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগবিরোধী। আওয়ামী লীগবিরোধী দলের নেতৃত্বে আছে বিএনপি। মানুষের মনোজগতে আমরা তো এটাই প্রোথিত করেছি যে, আওয়ামী লীগের বিকল্প হলো বিএনপি। বিভিন্ন সময়ে কিছু উদ্যোগ-আয়োজন দেখা গেলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একটি তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটছে না।
মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল হয়েছে। আওয়ামী লীগ যে তার রাজনৈতিক নীতি-কৌশলে সময়ে-সময়ে পরিবর্তন এনেছে—মধ্য ডান থেকে মধ্য বাম, মধ্য বাম থেকে বামের দিকে ঝুঁকেছে, তার একটি বড় কারণ তখন আওয়ামী লীগের প্রতিযোগিতা ছিল ভালোর সঙ্গে। তখন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল বাম বা বামমুখী। আওয়ামী লীগ তখন নিজেদের তুলনায় ভালোর (বাম) সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে অধিক ভালো হওয়ার চেষ্টা করেছে।
লক্ষ করার বিষয়, দেশের মানুষ বাম বা ভালোর রাজনীতি বর্জন করেছে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে খারাপ ধারার (বিএনপি) রাজনীতিকে গ্রহণ করেছে। মাঠের রাজনীতির এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়েই আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য খারাপের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে ক্রমে খারাপের দিকে ঝুঁকতে ঝুঁকতে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে।
তিন
বলা হবে, মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনাই তো রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। রাজনৈতিক নেতার দায়িত্ব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের ধারণা মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করেছিলেন, আবার তিনিই পাকিস্তান বিরোধিতাও মানুষের মধ্যে প্রবল করেছিলেন। এখন জনমত পরিবর্তনে আওয়ামী লীগ দলগতভাবে কোনো দায়িত্ব পালন করছে বলে মনে হয় না।
কেউ কেউ মনে করেন, আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞতা হলো, সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দলটিকে ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ কৌশল বদলিয়ে সুফল পেয়েছে।
প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগের মতবদল, পথবদলের সবকিছু কি আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবীরা সব সময় শর্তহীনভাবে সমর্থন করেছেন?
আওয়ামী লীগের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা আওয়ামী লীগের খারাপ কাজের সমালোচনা করেন। ধর্মীয় রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি আওয়ামী লীগের নমনীয়তা বা আত্মসমর্পণ অনেকের কাছেই প্রশংসিত হয়নি। সমস্যা হলো, আওয়ামী লীগের সমালোচনা করলে তার বেনিফিট গিয়ে জমা হয় বিএনপির তহবিলে।
বিএনপির সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা কি বিএনপির কোনো খারাপ কাজের সমালোচনা করেন? তারেক রহমানের দুর্বৃত্তির কোনো সমালোচনা বিএনপি-সমর্থক কেউ করেছেন? হাওয়া ভবন নামের বিকল্প ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে আওয়ামী লীগ নিধনের নীলনকশা বাস্তবায়নের মতো ঘৃণ্য কাজের কোনো নিন্দা-সমালোচনা বিএনপি-দরদি কেউ করেছেন? ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন বানানো যে ঠিক হয়নি, এ কথাটা বিএনপি-সমর্থক কারও মুখে শোনা গেছে?
বলা হয়ে থাকে, বিএনপি তো খারাপ। বিএনপির কাছে আমরা ভালো কিছু আশা করি না। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল। আওয়ামী লীগ কেন বিপথে যাবে, খারাপ কাজ করবে?
যাঁরা এমন বলেন, তাঁরা হয়তো ভুলে যান যে আওয়ামী লীগও একটি রাজনৈতিক দল, এটা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বা রামকৃষ্ণ মিশনের মতো সেবামূলক প্রতিষ্ঠান নয়। আওয়ামী লীগকে লড়তে হয় বা প্রতিযোগিতা করতে হয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই।
মানুষ এখন অনেক কিছু শিখেছে। মানুষ এখন কেবল ক্ষমতার (দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-অনিয়মের) হাতবদল চায় না। মানুষ আওয়ামী লীগের চোর-বাটপারদের বদলে বিএনপির চোর-বাটপারদের ক্ষমতা দিতে চায় না। তাই অহেতুক বাক্য চালাচালি না করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচিত, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে নিজেদের ভেতরের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হওয়া।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কতগুলো লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছিল। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ফলে রাজনীতিতে যে পাকিস্তানি ধারার অবসান ঘটেছিল, তা উল্টে দিয়ে আবার পাকিস্তানি ধারা ফিরিয়ে আনার পথ মুক্ত করা হয়েছিল। অবৈধভাবে, অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা দখল শুরু হয়েছিল। রাষ্ট্রের স্থপতিকে সপরিবারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে রাজনীতিতে যে বড় শূন্যতা ও অস্থিরতার সৃষ্টি করা হয়েছিল, তা আমরা এখনো পুরোপুরি সামলে উঠতে পারিনি। এ কথা ঠিক যে ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীদের বিচার হয়েছে, আদালত তাঁদের দণ্ড দিয়েছেন এবং কয়েকজনের দণ্ড কার্যকরও হয়েছে। কয়েকজন এখনো বিদেশে পালিয়ে আছেন।
আগস্ট মাস এলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়টি আবার সামনে আসে এবং এ নিয়ে নানা প্রিয়-অপ্রিয় আলোচনা-সমালোচনা হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে না। ১ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা ছিল, একদিন সেটা বের হবে। প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুক-রশিদের বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাবেক সেনাশাসক জিয়াউর রহমানকে নেপথ্য শক্তি হিসেবে উল্লেখের তথ্য তুলে ধরেন। এতে গোসসা করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পরের দিন বলেছেন, হত্যাকাণ্ড যাঁরা ঘটিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। অথচ আওয়ামী লীগ এখন নতুন গীত শুরু করেছে যে, জিয়াউর রহমান এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার পরদিন আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আগস্ট মাস এলেই বিএনপি রক্তাক্ত অতীতের অন্তর্জ্বালায় অস্থির হয়ে পড়ে। এই পাল্টাপাল্টি বাক্য চালাচালি আমাদের রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে সদিচ্ছা, সততা ও সাহসের প্রয়োজন, তা রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে দেখা যায় না।
বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা কতটা, সে বিষয়ে বিতর্ক করা গেলেও ওই হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি যে ছিলেন জিয়াউর রহমান, তা কি অস্বীকার করা যাবে? বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে, অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা দখলের পথ তৈরি না হলে জিয়াউর রহমান কি রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে বিএনপি নামের রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ পেতেন? আর তিনি ক্ষমতার শীর্ষে না উঠলে কোথায় থাকতেন তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া?
দুই
ঐতিহাসিকভাবেই আমাদের দেশের রাজনীতি হলো বিরোধিতার, ‘না’ বলার। ব্রিটিশবিরোধিতা দিয়ে যার শুরু হয়েছে, তার অবসান আমরা ঘটাতে পারিনি। তাই ক্ষমতাসীন সরকার ও দলের বিরুদ্ধে না কথা বললে পাবলিক খায় না। আবার আমাদের দেশে কিছু ‘নিরপেক্ষ’ লেখক-চিন্তক আছেন, যাঁদের আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ‘রিজার্ভেশন’ আছে। তাঁরা আওয়ামী লীগের সমালোচনায় আনন্দ পান, বিএনপির সমালোচনায় মনে কষ্ট পান। অথচ আওয়ামী লীগ দলটির জন্ম হয়েছে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, জনগণের প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে আর বিএনপির জন্ম হয়েছে ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থের পাহারাদার হওয়ার জন্য। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এক করে দেখার যে রাজনীতি, সেটা অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফল। সে জন্যই বিএনপির অন্যায্য অবস্থানেরও পক্ষে দাঁড়াতে যাঁরা কুণ্ঠাবোধ করেন না, তাঁরা আওয়ামী লীগের ন্যায্য অবস্থানেও নাখোশ হন।
বিএনপির দুর্নীতি-অনিয়মের কথা বললে তাঁরা আহত হয়ে বলেন, এখন বিএনপির সমালোচনা কেন? বিএনপির পাপের শাস্তি বিএনপি পেয়েছে। এত বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে আছে। এখন টানা ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ এবং তারা এখন দেশটাকে লুটপাটের ভাগাড় বানিয়েছে। তাই এখন সমালোচনা করতে হবে আওয়ামী লীগের।
কথা মিথ্যা না। আমরা যখন দেশের জিম্মাদার আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে বানিয়েছি, তখনই বড় ভুল করেছি। সংবিধান অনুযায়ী দেশের মালিক জনগণ। কিন্তু কীভাবে দেশের মালিক-মোক্তার আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বনে গেল, সে প্রশ্নের জবাব নেই। আমরা, বাংলাদেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী কীভাবে যেন এটা মেনে নিয়েছি যে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি পালাক্রমে দেশ শাসন করবে।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে এই ধারায় পরিবর্তন আসায়, আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকায় ওই নিরপেক্ষ চিন্তকদের গায়ের জ্বালা বেড়ে গেছে। প্রশ্ন হলো, বিএনপি টানা ক্ষমতার বাইরে আছে বলে কি দলটির রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনায় কোনো পরিবর্তন এসেছে? বিএনপি কি তাদের অতীত রাজনীতির ত্রুটি-বিচ্যুতির মূল্যায়ন-বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে তারা আর দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-অনিয়মকে প্রশ্রয় দেবে না? প্রতিহিংসার রাজনীতি করবে না? রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলে হত্যা-খুনের রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবে না? না, তেমন কোনো পরিবর্তন বিএনপিতে দৃশ্যমান নয়।
অনেকে মনে করেন, বিএনপি না বদলালে আওয়ামী লীগ বদলাবে না। এই দুই দল ক্ষমতার রাজনীতির প্রতিযোগী এবং প্রতিপক্ষ। মোটাদাগে এটা বলা যায়, দেশে অপরাজনীতি বা খারাপ রাজনীতি চালু করেছে বিএনপি। তাতে দলটির জনপ্রিয় হতে অসুবিধা হয়নি। সম্ভবত এ জন্যই কিছু ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ এখন বিএনপিকে অনুসরণ করছে।
বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল মূলত দুটি। আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগবিরোধী। আওয়ামী লীগবিরোধী দলের নেতৃত্বে আছে বিএনপি। মানুষের মনোজগতে আমরা তো এটাই প্রোথিত করেছি যে, আওয়ামী লীগের বিকল্প হলো বিএনপি। বিভিন্ন সময়ে কিছু উদ্যোগ-আয়োজন দেখা গেলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একটি তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটছে না।
মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল হয়েছে। আওয়ামী লীগ যে তার রাজনৈতিক নীতি-কৌশলে সময়ে-সময়ে পরিবর্তন এনেছে—মধ্য ডান থেকে মধ্য বাম, মধ্য বাম থেকে বামের দিকে ঝুঁকেছে, তার একটি বড় কারণ তখন আওয়ামী লীগের প্রতিযোগিতা ছিল ভালোর সঙ্গে। তখন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল বাম বা বামমুখী। আওয়ামী লীগ তখন নিজেদের তুলনায় ভালোর (বাম) সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে অধিক ভালো হওয়ার চেষ্টা করেছে।
লক্ষ করার বিষয়, দেশের মানুষ বাম বা ভালোর রাজনীতি বর্জন করেছে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে খারাপ ধারার (বিএনপি) রাজনীতিকে গ্রহণ করেছে। মাঠের রাজনীতির এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়েই আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য খারাপের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে ক্রমে খারাপের দিকে ঝুঁকতে ঝুঁকতে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে।
তিন
বলা হবে, মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনাই তো রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। রাজনৈতিক নেতার দায়িত্ব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের ধারণা মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করেছিলেন, আবার তিনিই পাকিস্তান বিরোধিতাও মানুষের মধ্যে প্রবল করেছিলেন। এখন জনমত পরিবর্তনে আওয়ামী লীগ দলগতভাবে কোনো দায়িত্ব পালন করছে বলে মনে হয় না।
কেউ কেউ মনে করেন, আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞতা হলো, সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দলটিকে ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ কৌশল বদলিয়ে সুফল পেয়েছে।
প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগের মতবদল, পথবদলের সবকিছু কি আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবীরা সব সময় শর্তহীনভাবে সমর্থন করেছেন?
আওয়ামী লীগের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা আওয়ামী লীগের খারাপ কাজের সমালোচনা করেন। ধর্মীয় রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি আওয়ামী লীগের নমনীয়তা বা আত্মসমর্পণ অনেকের কাছেই প্রশংসিত হয়নি। সমস্যা হলো, আওয়ামী লীগের সমালোচনা করলে তার বেনিফিট গিয়ে জমা হয় বিএনপির তহবিলে।
বিএনপির সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা কি বিএনপির কোনো খারাপ কাজের সমালোচনা করেন? তারেক রহমানের দুর্বৃত্তির কোনো সমালোচনা বিএনপি-সমর্থক কেউ করেছেন? হাওয়া ভবন নামের বিকল্প ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে আওয়ামী লীগ নিধনের নীলনকশা বাস্তবায়নের মতো ঘৃণ্য কাজের কোনো নিন্দা-সমালোচনা বিএনপি-দরদি কেউ করেছেন? ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন বানানো যে ঠিক হয়নি, এ কথাটা বিএনপি-সমর্থক কারও মুখে শোনা গেছে?
বলা হয়ে থাকে, বিএনপি তো খারাপ। বিএনপির কাছে আমরা ভালো কিছু আশা করি না। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল। আওয়ামী লীগ কেন বিপথে যাবে, খারাপ কাজ করবে?
যাঁরা এমন বলেন, তাঁরা হয়তো ভুলে যান যে আওয়ামী লীগও একটি রাজনৈতিক দল, এটা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বা রামকৃষ্ণ মিশনের মতো সেবামূলক প্রতিষ্ঠান নয়। আওয়ামী লীগকে লড়তে হয় বা প্রতিযোগিতা করতে হয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই।
মানুষ এখন অনেক কিছু শিখেছে। মানুষ এখন কেবল ক্ষমতার (দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-অনিয়মের) হাতবদল চায় না। মানুষ আওয়ামী লীগের চোর-বাটপারদের বদলে বিএনপির চোর-বাটপারদের ক্ষমতা দিতে চায় না। তাই অহেতুক বাক্য চালাচালি না করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচিত, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে নিজেদের ভেতরের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হওয়া।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
৫ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
৫ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
৬ ঘণ্টা আগে