মহিউদ্দিন আহমদ
কিছুদিন ধরে কঠোর লকডাউনের কারণে আমলাদের ওপর হামলা-আক্রমণ দৃশ্যত কিছুটা কমেছে বলে মনে হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের বিশাল পরিমাণের অনিয়ম-বেনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়ার পরে সারা দেশের সব গণমাধ্যমে বিষয়টা ব্যাপকভাবে কাভারেজ পায়, ব্যাপকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা যথার্থভাবেই নিন্দিত ও সমালোচিত হন। কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছে, বিষয়টায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। কোরবানির ঈদ, কোরবানির পশু বেচাকেনা, লোকজনের গ্রামের বাড়িতে যাওয়া এবং ওখান থেকে ফিরে আসার যন্ত্রণা আশ্রয়ণ প্রকল্পের দুর্নীতি ও অনিয়ম-বেনিয়মকে দৃশ্যত চাপা দিয়ে ফেলেছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের দুর্নীতিতে যাঁরা জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে বলে এক মাস ধরে শুনে আসছি। এসব তদন্ত আমরা আগেও অনেকবার দেখেছি, কিন্তু কামের কাম কিছুই হয়নি। এখানেও বিভিন্ন রকমের তদবির, ওপর মহল থেকে বিষয়টা ভুলে যাওয়ার একরকমের চেষ্টা হবে এবং যাঁরা এমন গুরুতর অপরাধে অপরাধী, তাঁদের বাঁচানোর চেষ্টাও বিভিন্ন ক্ষমতাশীল মহল থেকে বিলক্ষণ দেখা যাবে।
এভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি মহৎ উদ্যোগ ব্যর্থ করে দেবে কিছু সরকারি আমলা। কিন্তু আগেই যেমন বলেছি, এদের ধরাছোঁয়া যাবে না। কারণ, বিষয়টা দিনদিন গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে, যেমন আমরা অতীতে বারবার দেখেছি।
কিন্তু এই কয়েকজন দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তার বিপরীতে আমরা অসাধারণ দক্ষ, সৎ ও দেশপ্রেমিক সরকারি কর্মকর্তাদের দেশ গঠনে প্রবল ভূমিকা পালন করতেও দেখেছি। ঠিক এই মুহূর্তে এমন দুজন সরকারি কর্মকর্তার নাম মনে পড়তেই আমার মাথা শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে নত হয়ে আসছে। তাঁদের একজন প্রয়াত নুরুল কাদের (খান)। এই নুরুল কাদের খান বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের জনক হিসেবে যথার্থই স্বীকৃতি ও সম্মান পেয়েছেন। সত্তরের দশকের শেষ দিকে তিনিই প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশি বড় একটা দলকে পাঠিয়ে গার্মেন্ট উৎপাদন, বিপণন, রপ্তানিসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে দেশে ফিরিয়ে আনেন। তার পরেই গার্মেন্টস শিল্পে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং দিনদিন এই শিল্পের ব্যাপ্তিও ঘটে। এই শিল্প থেকে আমরা আগামী কয়েক বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করতে পারব বলে আশা রাখি। আমরা সবাই ইতিমধ্যে জানি যে আমাদের গার্মেন্টস শিল্প এখন বিশ্বে দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থান অধিকার করে রয়েছে। চীন ও ভিয়েতনামের পর দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানে অবস্থিত আমাদের গার্মেন্টস শিল্পে এখন প্রায় ৪০ লাখ কর্মী কাজ করেন। এঁদের বেশির ভাগই আবার নারী। এই নারী গোষ্ঠীর সরাসরি আয়-রোজগারের সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে নারীদের ক্ষমতায়ন হচ্ছে, তা-ও আমাদের জন্য একটি বিরাট সাফল্য।
অনেকেই হয়তো জানেন, এই নুরুল কাদের খান একজন সিএসপি এবং পরে ১৯৭১ সালে পাবনার জেলা প্রশাসক ছিলেন। এখান থেকে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য কলকাতায় মুজিবনগর সরকারে যোগ দেন। সংস্থাপনসচিব হিসেবে তখন তিনি মুজিবনগর সরকারের দায়িত্ব পালন করেন পুরো ৯ মাস। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু দৃঢ় চরিত্রের কারণে তিনি দ্রুতই বাংলাদেশ সরকারে তাঁর গুরুত্ব হারান। তাঁকে বানানো হয় পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান। এখানেও তিনি বেশি দিন থাকেননি। এখান থেকে পদত্যাগ করে তিনি নিজে বাংলাদেশ গঠনে ও উন্নয়নে অভিনব কিছু করার জন্য তাড়িত হন।
এই অভিনব, নতুন কিছুই ছিল তাঁর উদ্যোগে বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের শুরু। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়, তিনি পুরোদস্তুর একজন আমলা ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি ছিলেন না কোনো সাহিত্যিক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী বা কোনো রাজনীতিবিদ। এখানে দেশের পরিবর্তনে উন্নয়ন-অগ্রগতিতে একজন আমলার বিশাল বিপ্লবী চরিত্রের অবদান লক্ষ করতে হয়।
(২)
আরেকজন খাঁটি ও দক্ষ আমলা কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান হিসেবে বাংলাদেশের চেহারাটাই বদলে দিলেন। আমরা যে এখন গ্রামগঞ্জে রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট—এত সব দেখছি; দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চলাচল, সড়ক ও সেতুর সংযোগ এবং মানুষের চলাচলের জন্য সহজ-সুবিধাজনক ছোট-বড় রাস্তা নির্মাণ করে গেলেন এবং গ্রামগঞ্জের ছোটখাটো কৃষি উৎপাদনকারীদের পণ্যসামগ্রী বাজারজাতকরণের সহজ ব্যবস্থা করে গেলেন, তা ওই এক আমলা। ওই এক আমলা কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর বিশাল অবদান। কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী একজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন এবং তাঁর কাজকর্মে দেশ গঠনের একটা কঠোর অঙ্গীকারও ছিল।
খুবই মনে পড়ে, বাংলাদেশের ওপর বিশ্বব্যাংকের একটা রিপোর্টে তাঁর নাম উল্লেখ না করে কিন্তু আকারে-ইঙ্গিতে নির্দেশিত করে তাঁকে প্রশংসা করা হয়। তাঁর এই প্রশংসা পড়ে তাঁকে টেলিফোন করলাম। তখনো তাঁর অফিস আগারগাঁওয়ে আছে। আমার টেলিফোনে তিনি এমন একটি ধারণা দিলেন যে তিনিও আমাকে আগে থেকে চেনেন। আমাকে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ড্রাই লাঞ্চের দাওয়াত করলেন। আমি যখন তাঁর অফিসে গিয়ে পৌঁছালাম, মিনিট দুয়েকের কুশল বিনিময়ের পর তিনি আমাকে সোফায় আসন গ্রহণ করতে বললেন। তিনি জানালেন, আধা ঘণ্টার মধ্যে আওয়ামী লীগের দুটি গ্রুপ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসবে। আমি যেন তাদের কথা শুনি, কিন্তু কোনো মন্তব্য না করি। এ দুই গ্রুপের কথাবার্তায় সেদিন যে অভিজ্ঞতা হলো, এখনো তা মনে পড়লে আপনা-আপনি হেসে উঠি। প্রথম গ্রুপ তাদের এলাকায় কিছু রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট বানিয়ে দেওয়ার জন্য কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীকে অনুরোধ করল। তিনি তাদের কথা শুনলেন, কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতি দিলেন না। এর পরেই ঢুকল একই এলাকার আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য গ্রুপটি। তাদের দাবি, প্রথম গ্রুপের দাবিদাওয়া কোনোভাবেই মানা যাবে না। তাদের আশঙ্কা, প্রথম গ্রুপের দাবি মেনে নেওয়া হলে বিপক্ষ গ্রুপের সাফল্যের উদাহরণ সৃষ্টি হয়ে যাবে। এতে পরবর্তী নির্বাচনে তাদের সমূহ বিপদ দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া তাদের বিপরীত গ্রুপে কিছু দেশবিরোধী জামায়াত-শিবিরও আছে। সুতরাং তাদের দাবিদাওয়া মেনে নিলে শিবির-জামায়াতের এই কৃতিত্ব এলাকার মানুষের কাছে প্রচার পাবে। কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী এই গ্রুপকেও কোনো ওয়াদা দিলেন না। দুই গ্রুপ তাদের নিজ নিজ বক্তব্য কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীকে জানিয়ে বিদায় নিল। তাদের প্রস্থানের পর কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, এই হচ্ছে আওয়ামী লীগ।
আবারও সবাইকে লক্ষ করতে অনুরোধ করি যে ওপরে বর্ণিত নুরুল কাদের খান ও কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী দুজনই ছিলেন খাঁটি আমলা, দেশপ্রেমিক এবং দেশ গঠনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে দীক্ষিত। নুরুল কাদের খান ও কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর মতো দেশপ্রেমিক আমলা এ দেশে আরও আছে, কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে তাঁদের মাপের নাম এখন মনে পড়ছে না। প্রশ্ন হলো, নুরুল কাদের খান ও কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর মতো কর্মকর্তা আমরা দেশে আরও বেশি সংখ্যায় বেরিয়ে আসতে দেখলাম না কেন? ১৯৭১ সালে বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তো মুজিবনগর সরকারকে যতভাবে সম্ভব সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন, কিন্তু পরে তাঁরা এমন থাকলেন না কেন? তাঁদের মধ্যে অধঃপতনও দেখলাম। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দেশে ফিরে এসে পরিত্যক্ত বাড়িঘর ও অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল করার হিড়িকের মধ্যে পড়ে গেলেন। তা তো আমাদের কলঙ্কের আরেকটা দিক।
বলতেই হবে, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই সময় এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রত্যাশিতভাবে গাইড করতে পারেননি। তারপর শুরু হয় দলীয় ভিত্তিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অপব্যবহার। একেকটা সরকারের বদল ঘটে আর পুরো সরকারি যন্ত্রটি ওই সরকারের ব্যক্তিমালিকানাধীন হয়ে যায়। যতভাবে সম্ভব এসব সরকারি কর্মকর্তা রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের তোয়াজ-পোষণ করতে থাকেন। বিনিময়ে রাজনৈতিক নেতারাও সরকারি কর্মকর্তাদের প্রদর্শিত পথে অনিয়ম-বেনিয়ম-দুর্নীতি করে ফেঁপেফুলে মোটা হতে থাকেন। অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের একটি কথা কয়েক দিন ধরে ফেসবুকে বারবার দেখছি। তিনি সেখানে বলেছেন, আগের জমানায় জমিদারেরা রাজনীতি করতে করতে ফকিন্নির পুত হয়ে যেত; আর এখন ফকিন্নির পুতেরা রাজনীতি করে করে জমিদার-রাজা-বাদশাহ হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের চারপাশে তাকালেই আমরা দেখি প্রতিবছর কী পরিমাণে মানুষ কোরবানির বড় বড় ষাঁড়ের মতো মোটাতাজা হচ্ছে। তার বিপরীতে শুধু এক টুকরো কোরবানির মাংসের জন্য শত শত মানুষ, শিশু-নারী-বৃদ্ধা বাড়ির দরজার সামনে ভিড় করছে।
আমাদের স্বাস্থ্য খাতের দিকে তাকালে শোচনীয় অবস্থাটা আরও প্রকট হয়ে দেখা দেয়। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদ্যাপন করছি আমরা, কিন্তু এখন পর্যন্ত দেশের বিরাট অংশের মানুষের বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে পারিনি।
আমাদের নেতা-মন্ত্রীরা যে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির দাবি করে যাচ্ছেন, তা কি আমলাদের অবদান, নাকি রাজনীতিবিদ-সাংবাদিকদের? আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, যদি রাজনৈতিক নেতারা আমলাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারতেন, তবে এই প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হতে পারত। তাহলে কারণে-অকারণে আমলাদের নিন্দা করতে হতো না। হয় দাবি করা ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার সম্পূর্ণ সত্য নয়, নয়তো অসততা-অদক্ষতা-দুর্নীতি সত্ত্বেও আমলারাই সরকারকে এই প্রবৃদ্ধি এনে দিচ্ছেন। আর যেসব আমলা অসততার পথ বেছে নিচ্ছেন, তাঁদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা উচিত।
সেটা যদি সম্ভব হতো, তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ১৩ বছরের একটানা শাসনে ‘সোনা রফিক’-এর সোনার বাংলা না বানিয়ে ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা’ বানাতে পারতেন।
‘শিউলিতলা’, উত্তরা; সোমবার, ২৬ জুলাই, ২০২১
লেখক: সাবেক সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কলামিস্ট
কিছুদিন ধরে কঠোর লকডাউনের কারণে আমলাদের ওপর হামলা-আক্রমণ দৃশ্যত কিছুটা কমেছে বলে মনে হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের বিশাল পরিমাণের অনিয়ম-বেনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়ার পরে সারা দেশের সব গণমাধ্যমে বিষয়টা ব্যাপকভাবে কাভারেজ পায়, ব্যাপকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা যথার্থভাবেই নিন্দিত ও সমালোচিত হন। কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছে, বিষয়টায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। কোরবানির ঈদ, কোরবানির পশু বেচাকেনা, লোকজনের গ্রামের বাড়িতে যাওয়া এবং ওখান থেকে ফিরে আসার যন্ত্রণা আশ্রয়ণ প্রকল্পের দুর্নীতি ও অনিয়ম-বেনিয়মকে দৃশ্যত চাপা দিয়ে ফেলেছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের দুর্নীতিতে যাঁরা জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে বলে এক মাস ধরে শুনে আসছি। এসব তদন্ত আমরা আগেও অনেকবার দেখেছি, কিন্তু কামের কাম কিছুই হয়নি। এখানেও বিভিন্ন রকমের তদবির, ওপর মহল থেকে বিষয়টা ভুলে যাওয়ার একরকমের চেষ্টা হবে এবং যাঁরা এমন গুরুতর অপরাধে অপরাধী, তাঁদের বাঁচানোর চেষ্টাও বিভিন্ন ক্ষমতাশীল মহল থেকে বিলক্ষণ দেখা যাবে।
এভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি মহৎ উদ্যোগ ব্যর্থ করে দেবে কিছু সরকারি আমলা। কিন্তু আগেই যেমন বলেছি, এদের ধরাছোঁয়া যাবে না। কারণ, বিষয়টা দিনদিন গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে, যেমন আমরা অতীতে বারবার দেখেছি।
কিন্তু এই কয়েকজন দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তার বিপরীতে আমরা অসাধারণ দক্ষ, সৎ ও দেশপ্রেমিক সরকারি কর্মকর্তাদের দেশ গঠনে প্রবল ভূমিকা পালন করতেও দেখেছি। ঠিক এই মুহূর্তে এমন দুজন সরকারি কর্মকর্তার নাম মনে পড়তেই আমার মাথা শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে নত হয়ে আসছে। তাঁদের একজন প্রয়াত নুরুল কাদের (খান)। এই নুরুল কাদের খান বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের জনক হিসেবে যথার্থই স্বীকৃতি ও সম্মান পেয়েছেন। সত্তরের দশকের শেষ দিকে তিনিই প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশি বড় একটা দলকে পাঠিয়ে গার্মেন্ট উৎপাদন, বিপণন, রপ্তানিসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে দেশে ফিরিয়ে আনেন। তার পরেই গার্মেন্টস শিল্পে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং দিনদিন এই শিল্পের ব্যাপ্তিও ঘটে। এই শিল্প থেকে আমরা আগামী কয়েক বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করতে পারব বলে আশা রাখি। আমরা সবাই ইতিমধ্যে জানি যে আমাদের গার্মেন্টস শিল্প এখন বিশ্বে দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থান অধিকার করে রয়েছে। চীন ও ভিয়েতনামের পর দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানে অবস্থিত আমাদের গার্মেন্টস শিল্পে এখন প্রায় ৪০ লাখ কর্মী কাজ করেন। এঁদের বেশির ভাগই আবার নারী। এই নারী গোষ্ঠীর সরাসরি আয়-রোজগারের সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে নারীদের ক্ষমতায়ন হচ্ছে, তা-ও আমাদের জন্য একটি বিরাট সাফল্য।
অনেকেই হয়তো জানেন, এই নুরুল কাদের খান একজন সিএসপি এবং পরে ১৯৭১ সালে পাবনার জেলা প্রশাসক ছিলেন। এখান থেকে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য কলকাতায় মুজিবনগর সরকারে যোগ দেন। সংস্থাপনসচিব হিসেবে তখন তিনি মুজিবনগর সরকারের দায়িত্ব পালন করেন পুরো ৯ মাস। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু দৃঢ় চরিত্রের কারণে তিনি দ্রুতই বাংলাদেশ সরকারে তাঁর গুরুত্ব হারান। তাঁকে বানানো হয় পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান। এখানেও তিনি বেশি দিন থাকেননি। এখান থেকে পদত্যাগ করে তিনি নিজে বাংলাদেশ গঠনে ও উন্নয়নে অভিনব কিছু করার জন্য তাড়িত হন।
এই অভিনব, নতুন কিছুই ছিল তাঁর উদ্যোগে বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের শুরু। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়, তিনি পুরোদস্তুর একজন আমলা ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি ছিলেন না কোনো সাহিত্যিক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী বা কোনো রাজনীতিবিদ। এখানে দেশের পরিবর্তনে উন্নয়ন-অগ্রগতিতে একজন আমলার বিশাল বিপ্লবী চরিত্রের অবদান লক্ষ করতে হয়।
(২)
আরেকজন খাঁটি ও দক্ষ আমলা কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান হিসেবে বাংলাদেশের চেহারাটাই বদলে দিলেন। আমরা যে এখন গ্রামগঞ্জে রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট—এত সব দেখছি; দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চলাচল, সড়ক ও সেতুর সংযোগ এবং মানুষের চলাচলের জন্য সহজ-সুবিধাজনক ছোট-বড় রাস্তা নির্মাণ করে গেলেন এবং গ্রামগঞ্জের ছোটখাটো কৃষি উৎপাদনকারীদের পণ্যসামগ্রী বাজারজাতকরণের সহজ ব্যবস্থা করে গেলেন, তা ওই এক আমলা। ওই এক আমলা কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর বিশাল অবদান। কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী একজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন এবং তাঁর কাজকর্মে দেশ গঠনের একটা কঠোর অঙ্গীকারও ছিল।
খুবই মনে পড়ে, বাংলাদেশের ওপর বিশ্বব্যাংকের একটা রিপোর্টে তাঁর নাম উল্লেখ না করে কিন্তু আকারে-ইঙ্গিতে নির্দেশিত করে তাঁকে প্রশংসা করা হয়। তাঁর এই প্রশংসা পড়ে তাঁকে টেলিফোন করলাম। তখনো তাঁর অফিস আগারগাঁওয়ে আছে। আমার টেলিফোনে তিনি এমন একটি ধারণা দিলেন যে তিনিও আমাকে আগে থেকে চেনেন। আমাকে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ড্রাই লাঞ্চের দাওয়াত করলেন। আমি যখন তাঁর অফিসে গিয়ে পৌঁছালাম, মিনিট দুয়েকের কুশল বিনিময়ের পর তিনি আমাকে সোফায় আসন গ্রহণ করতে বললেন। তিনি জানালেন, আধা ঘণ্টার মধ্যে আওয়ামী লীগের দুটি গ্রুপ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসবে। আমি যেন তাদের কথা শুনি, কিন্তু কোনো মন্তব্য না করি। এ দুই গ্রুপের কথাবার্তায় সেদিন যে অভিজ্ঞতা হলো, এখনো তা মনে পড়লে আপনা-আপনি হেসে উঠি। প্রথম গ্রুপ তাদের এলাকায় কিছু রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট বানিয়ে দেওয়ার জন্য কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীকে অনুরোধ করল। তিনি তাদের কথা শুনলেন, কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতি দিলেন না। এর পরেই ঢুকল একই এলাকার আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য গ্রুপটি। তাদের দাবি, প্রথম গ্রুপের দাবিদাওয়া কোনোভাবেই মানা যাবে না। তাদের আশঙ্কা, প্রথম গ্রুপের দাবি মেনে নেওয়া হলে বিপক্ষ গ্রুপের সাফল্যের উদাহরণ সৃষ্টি হয়ে যাবে। এতে পরবর্তী নির্বাচনে তাদের সমূহ বিপদ দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া তাদের বিপরীত গ্রুপে কিছু দেশবিরোধী জামায়াত-শিবিরও আছে। সুতরাং তাদের দাবিদাওয়া মেনে নিলে শিবির-জামায়াতের এই কৃতিত্ব এলাকার মানুষের কাছে প্রচার পাবে। কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী এই গ্রুপকেও কোনো ওয়াদা দিলেন না। দুই গ্রুপ তাদের নিজ নিজ বক্তব্য কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীকে জানিয়ে বিদায় নিল। তাদের প্রস্থানের পর কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, এই হচ্ছে আওয়ামী লীগ।
আবারও সবাইকে লক্ষ করতে অনুরোধ করি যে ওপরে বর্ণিত নুরুল কাদের খান ও কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী দুজনই ছিলেন খাঁটি আমলা, দেশপ্রেমিক এবং দেশ গঠনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে দীক্ষিত। নুরুল কাদের খান ও কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর মতো দেশপ্রেমিক আমলা এ দেশে আরও আছে, কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে তাঁদের মাপের নাম এখন মনে পড়ছে না। প্রশ্ন হলো, নুরুল কাদের খান ও কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর মতো কর্মকর্তা আমরা দেশে আরও বেশি সংখ্যায় বেরিয়ে আসতে দেখলাম না কেন? ১৯৭১ সালে বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তো মুজিবনগর সরকারকে যতভাবে সম্ভব সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন, কিন্তু পরে তাঁরা এমন থাকলেন না কেন? তাঁদের মধ্যে অধঃপতনও দেখলাম। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দেশে ফিরে এসে পরিত্যক্ত বাড়িঘর ও অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল করার হিড়িকের মধ্যে পড়ে গেলেন। তা তো আমাদের কলঙ্কের আরেকটা দিক।
বলতেই হবে, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই সময় এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রত্যাশিতভাবে গাইড করতে পারেননি। তারপর শুরু হয় দলীয় ভিত্তিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অপব্যবহার। একেকটা সরকারের বদল ঘটে আর পুরো সরকারি যন্ত্রটি ওই সরকারের ব্যক্তিমালিকানাধীন হয়ে যায়। যতভাবে সম্ভব এসব সরকারি কর্মকর্তা রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের তোয়াজ-পোষণ করতে থাকেন। বিনিময়ে রাজনৈতিক নেতারাও সরকারি কর্মকর্তাদের প্রদর্শিত পথে অনিয়ম-বেনিয়ম-দুর্নীতি করে ফেঁপেফুলে মোটা হতে থাকেন। অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের একটি কথা কয়েক দিন ধরে ফেসবুকে বারবার দেখছি। তিনি সেখানে বলেছেন, আগের জমানায় জমিদারেরা রাজনীতি করতে করতে ফকিন্নির পুত হয়ে যেত; আর এখন ফকিন্নির পুতেরা রাজনীতি করে করে জমিদার-রাজা-বাদশাহ হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের চারপাশে তাকালেই আমরা দেখি প্রতিবছর কী পরিমাণে মানুষ কোরবানির বড় বড় ষাঁড়ের মতো মোটাতাজা হচ্ছে। তার বিপরীতে শুধু এক টুকরো কোরবানির মাংসের জন্য শত শত মানুষ, শিশু-নারী-বৃদ্ধা বাড়ির দরজার সামনে ভিড় করছে।
আমাদের স্বাস্থ্য খাতের দিকে তাকালে শোচনীয় অবস্থাটা আরও প্রকট হয়ে দেখা দেয়। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদ্যাপন করছি আমরা, কিন্তু এখন পর্যন্ত দেশের বিরাট অংশের মানুষের বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে পারিনি।
আমাদের নেতা-মন্ত্রীরা যে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির দাবি করে যাচ্ছেন, তা কি আমলাদের অবদান, নাকি রাজনীতিবিদ-সাংবাদিকদের? আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, যদি রাজনৈতিক নেতারা আমলাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারতেন, তবে এই প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হতে পারত। তাহলে কারণে-অকারণে আমলাদের নিন্দা করতে হতো না। হয় দাবি করা ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার সম্পূর্ণ সত্য নয়, নয়তো অসততা-অদক্ষতা-দুর্নীতি সত্ত্বেও আমলারাই সরকারকে এই প্রবৃদ্ধি এনে দিচ্ছেন। আর যেসব আমলা অসততার পথ বেছে নিচ্ছেন, তাঁদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা উচিত।
সেটা যদি সম্ভব হতো, তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ১৩ বছরের একটানা শাসনে ‘সোনা রফিক’-এর সোনার বাংলা না বানিয়ে ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা’ বানাতে পারতেন।
‘শিউলিতলা’, উত্তরা; সোমবার, ২৬ জুলাই, ২০২১
লেখক: সাবেক সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কলামিস্ট
তিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
২ মিনিট আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১ দিন আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১ দিন আগে