নূরে আলম সিদ্দিকী
শাহীন রেজা নূর আজ প্রয়াত একটি মানুষের নাম। এক বছর হলো সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। কী বলে আমার সাথে তার সম্পর্ক চিহ্নিত করব, আমি নিজেই ভাষা খুঁজে পাই না। সন্তানপ্রতিম বললেও যেন কথাটা বলা হয় না। কিছু যেন অব্যক্ত, কিছু যেন অপূর্ণ থেকে যায়। সে আমার ঔরসজাত সন্তান না হলেও সন্তানই ছিল। তাই সন্তানপ্রতিম বলতেও আমার দ্বিধা হয়, হৃদয়টা খচ্খচ্ করে।
জন্মের পর থেকেই না হলেও শাহীন যখন ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটত, তখন থেকেই তাকে কোলে-পিঠে নিতে আমি একটা অনাবিল আনন্দ পেতাম। তার পিতা শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন বড় ভাইয়ের মতো নয়, আমার বড় ভাই-ই ছিলেন। ঢাকায় আমার অভিভাবক বলতে তিনিই ছিলেন। অবশ্য বাকী ভাইয়ের (সৈয়দ মাযহারুল হক বাকী) নাম উল্লেখ না করলে সত্যকে অস্বীকার করা হবে, অন্যায় হবে। সে যাই হোক, সিরাজ ভাইয়ের বাড়ি বৃহত্তর যশোরের মাগুরার শালিখায়। আমাদের ঝিনাইদহের বাড়ি হতে খুব বড়জোর বিশ মাইল। এই বিশ মাইলের দূরত্ব নিঃশেষিত হয়েছিল সিরাজ ভাইয়ের হৃদয় হতে। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের পরপর যখন আমি ঢাকায় আসি, তখনই সিরাজ ভাই হৃদয়ের সমস্ত ঔদার্য দিয়ে আমাকে গ্রহণ করে নেন অনুজের স্নেহলালিত্যে। তারপর থেকে কোনো দিন কোনো অবস্থাতেই সিরাজ ভাইয়ের স্নেহবঞ্চিত হইনি। এটা শাহীন রেজা নূরের চোখে দেখা ঘটনা।
সিরাজ ভাই আমাকে তার মায়ের পেটের ভাইয়ের মতোই স্নেহ করতেন। সিরাজ ভাইয়ের আট ছেলে। শাহীন রেজা নূর ছিল তাদের মধ্যে দ্বিতীয়। ওরা সবসময় আমাকে কাকা ডাকত। আলম কাকা বা সিদ্দিকী কাকা বলে কখনো ডাকেনি। রক্তের বাঁধন না থাকলেও সম্পর্ক কত গভীর ও অমলিন হতে পারে, আজকের দিনে অনেকের পক্ষে তা ভাবাও কঠিন। রাত নাই-দিন নাই, সকাল নাই-দুপুর নাই, চামেলীবাগের বাসায় গেলে আমাকে ভাত খেতেই হতো। এ ব্যাপারে ভাবির আন্তরিকতাও আমাকে মুগ্ধ করে।
সিরাজুদ্দীন হোসেন শাহীন রেজা নূরের পিতা। সিরাজুদ্দীন হোসেনের ভালোবাসার অনবদ্য টান ও অকৃত্রিম আকর্ষণ আমার কাছে এতই তীব্র ছিল যে, সন্ধ্যার পর ইত্তেফাক অফিসে সিরাজ ভাইয়ের বিরাট টেবিলের বিপরীতে বসে টোস্ট বিস্কুট, আর চা খাওয়াটা নৈমিত্তিক ছিল। এ ছাড়া যেন পেটের ভাত হজম হতো না। ইত্তেফাকে ঢুকলেই সিরাজ ভাই যে কাউকে দেখতে পেতেন। কারণ, তার টেবিলটা ছিল সরাসরি দরজা বরাবর। দিনের বেলায় গেলে সিরাজ ভাই বলতেন, ‘এই আলম, আমি দুপুরে বাসায় যাব, তুই চলে যাস না।’ আমিও সন্তুষ্টচিত্ত ঋষিবালকের মতো শান্তভাবে বসে থাকতাম সিরাজ ভাইয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য।
শাহীন স্বপ্রণোদিত হয়ে আমার জীবনী লেখার দায়িত্ব নিয়েছিল। টেলিফোনে তার সঙ্গে আমার শেষ আলাপেও সে আমাকে দৃঢ় চিত্তে বলেছিল, ‘কাকা, আপনার জীবনীটা শেষ করাই আমার জীবনের প্রধান কাজ। এটা ছাড়া আমি মরেও শান্তি পাব না।’ আল্লাহ তার আত্মার শান্তি প্রদান করুন। আমার আত্মজীবনীর কাজ কোন পর্যায়ে আছে, আমি জানিও না। জিজ্ঞেস করলেই সে বলত, ‘কাকা, চিন্তা করবেন না। আপনার আত্মজীবনীর কাজ শেষ না করে আমি মরব না।’
আত্মজীবনীটি বড় কথা নয়। আমার শাহীন ইহকাল থেকে বিদায় নিয়েছে ভাবতেই আমার বুকটা হাহাকার করে ওঠে। রাতে বিছানায় ছটফট করি, উঠে চেয়ারে বসি। কখনো কখনো নিজের অজান্তেই ভাবি, শাহীনকে একটা ফোন করি। ওদের ওখানে তো (ভ্যাঙ্কুভারে) দিন। তাই ওর দিনের বেলা, আমাদের এই গভীর রাতে বিরক্ত করা হবে না। অথচ আমি অবর্ণনীয় পরিতৃপ্তি লাভ করব। আমার কনিষ্ঠ পুত্র তানজিরের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা প্রচণ্ড গভীর ছিল। ওরা রোজই দু-একবার ফোনে কথা বলত। আমার কনিষ্ঠ পুত্র আমাকে কখনো বলেনি, শাহীন মৃত্যুর দিকে এতখানি এগিয়ে গেছে। তার রক্তশূন্য পাণ্ডুর মুখ দেখলে তার পরিচিত যেকোনো লোকই হয়তো চমকে উঠত। ভ্যাঙ্কুভার থেকে শাহীন রেজা নূর বা ঢাকা থেকে তানজির, কেউই আমাকে বুঝতে দেয়নি, শাহীন এত দ্রুত পরপারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। শেষ যেদিন তার সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়, সেদিনও আমি অনুধাবন করতে পারিনি তার জীবনঘাতী ব্যাধির গভীরতা। বরং কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে আমি বলেছি, ‘আত্মজীবনী বইটা হয়তো প্রকাশ পাবে, তবে আমি জীবিত থাকাকালীন নয়, আমার মৃত্যুর পর।’ শাহীন ও তানজির উভয়কেই বলতাম, আত্মজীবনীটা আমি আমার জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারব না, এটা আমার বদ্ধমূল ধারণা। এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করলে শাহীন বলত, ‘না কাকা, বইয়ের কাজ নব্বই ভাগ শেষ। আর একটু সময় পেলেই আমি অমি’র (তানজির) ই-মেইলে পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে দেব।’ বেদনাহত চিত্তে অশ্রুসিক্ত নয়নে শূন্য হৃদয় নিয়ে এখন আমার ভাবনায় পাণ্ডুলিপি আমার কাছে অন্তঃসারশূন্য, আমার শাহীনই যেখানে নেই।
দীর্ঘসময় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম ৭১-এর সভাপতি ছিল শাহীন রেজা নূর। তার পিতা শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের প্রতি আজও আমার একটা ক্ষোভ, তাঁর মতো একজন প্রথিতযশা, প্রগতিশীল, স্বাধীনচেতা ও স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ কেন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে নিজের বাড়িতে থাকতেন। আজকের দিনের মতো তখন মোবাইল ফোনের ব্যবস্থা থাকলে তাঁকে সরে থাকার জন্য পীড়াপীড়ি করতাম। জানি না, তিনি আমার অনুরোধ রাখতেন কি-না। আমার হৃদয়ের নিভৃত কন্দরে স্নেহের মণিমুক্তা-খচিত যে আসন, সেখানে শাহীন রেজা নূরের অবস্থান অমলিন। অনেক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সময়ে শাহীন আমার কাছে ছুটে এসেছে। ‘কাকা, কী হয়েছে’—বলে ডাকলেই বেশ কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেয়েছি, মনোবল পেয়েছি। এটা হয়তো কাউকেই বোঝানো যাবে না, তাহজীব-তানজিরই কেবল আমার সন্তান নয়। শাহীন রেজা নূরও আমার সন্তান। বলতে গেলে বয়সের মাপকাঠিতে সেই জ্যেষ্ঠ সন্তান। সিরাজ ভাইয়ের সুবাদে আমাকে ও কাকা ডাকত। আমি কিন্তু তাকে সন্তানপ্রতিমই মনে করতাম।
মৃত্যু জীবনেরই আরেকটি নাম। কোনো জীবিত প্রাণীই মৃত্যুকে এড়াতে পারে না। তবুও কিছু কিছু মৃত্যুকে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু। এটা বহন করা খুবই কঠিন।
শাহীন রেজা নূর শুধু আমার কাছে নয়, অসংখ্য অগণিত মানুষের কাছে অপরিসীম গুরুত্ব বহন করত। প্রজন্ম ৭১-এর সভাপতি, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা, যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিটি বিচারের অকুতোভয় একজন সৈনিক। দেশবাসীর কাছে নানাবিধ গৌরবদীপ্ত পরিচয়ে উদ্ভাসিত তার নাম। সরাসরি রাজনৈতিক দল না করলেও সে একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিমনস্ক সংগঠক ছিল। সাংবাদিকতা তার পেশা হলেও সামাজিক কর্মকাণ্ডই ছিল তার নেশা। একাত্তরে সীমান্তের ওপারে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেনি বটে, কিন্তু তার ক্ষুরধার বিশ্লেষণ স্বাধীনতার চেতনাকে মানুষের হৃদয়ে অমলিনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। যে শুধু সাংবাদিক বা সংবাদ বিশ্লেষক ছিল না। তার সমগ্র সত্তাটাই ছিল স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের এক বাস্তবধর্মী বিশ্লেষণ। তার পিতা সিরাজুদ্দীন হোসেন বুদ্ধিজীবী হিসেবে আলবদর বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন। এই যন্ত্রণা শেষ নিশ্বাস ত্যাগের মুহূর্ত পর্যন্ত শাহীন রেজা নূর সবার অলক্ষ্যে আপন হৃদয়ে বহন করেছে। ঔরসজাত সন্তান না হলেও আমি নিঃসংশয় চিত্তে দাবি করব, সন্তানপ্রতিম নয়, সে আমার সন্তান। আমি শতভাগ নিশ্চিত, সে আমার চেতনা ও বিশ্বাসকে বক্ষে লালন করত।
অসংখ্য বিবেকবান কলমধারী মানুষ তার বিবেক-আপ্লুত আদর্শ ও দেশপ্রেমকে হৃদয়ের নিভৃত কন্দরে সযত্নে লালন করেন। শাহীন রেজা নূরের অকাল মৃত্যু, যত বেদনাদায়কই হোক না কেন, তার চেতনার প্রদীপ্ত শিখা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রজ্বলিত মশালের মতো পথ দেখাবে—এটা তো বিশ্বাস করে বলাই যায়। নিষ্ঠুর সত্য হলো, শাহীন রেজা নূর আজ পরলোকে। বাংলাদেশের অনেক তরুণ তাজা দীপ্ত প্রাণ মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছেন। শাহীন রেজা নূরের পিতা সিরাজুদ্দীন হোসেনও শহীদ হয়েছেন। কলম দিয়ে তিনি যেভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিরতিহীন যুদ্ধ করেছেন, তাতে আল্লাহ তাঁকে নির্মল শহীদী সম্মান দেবেন—এ আশা আমরা করতেই পারি। শাহীন রেজা নূর আজকে না ফেরার দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। এ যে কী কষ্টের, কতখানি যন্ত্রণায় অনুভূতিকে কীভাবে ক্ষতবিক্ষত করে, স্বাভাবিক জীবনের চিন্তা-চেতনা, সুখ-দুঃখকে কীভাবে বিপর্যস্ত করে বিশ্বের সমগ্র স্বাভাবিকতাকে ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়, শাহীন রেজা নূরের মৃত্যুর সংবাদ আমার ক্ষেত্রে তাই করেছিল। এই শোক আমি আজীবন বহন করে যাব।
লেখক: স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতা ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি
শাহীন রেজা নূর আজ প্রয়াত একটি মানুষের নাম। এক বছর হলো সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। কী বলে আমার সাথে তার সম্পর্ক চিহ্নিত করব, আমি নিজেই ভাষা খুঁজে পাই না। সন্তানপ্রতিম বললেও যেন কথাটা বলা হয় না। কিছু যেন অব্যক্ত, কিছু যেন অপূর্ণ থেকে যায়। সে আমার ঔরসজাত সন্তান না হলেও সন্তানই ছিল। তাই সন্তানপ্রতিম বলতেও আমার দ্বিধা হয়, হৃদয়টা খচ্খচ্ করে।
জন্মের পর থেকেই না হলেও শাহীন যখন ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটত, তখন থেকেই তাকে কোলে-পিঠে নিতে আমি একটা অনাবিল আনন্দ পেতাম। তার পিতা শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন বড় ভাইয়ের মতো নয়, আমার বড় ভাই-ই ছিলেন। ঢাকায় আমার অভিভাবক বলতে তিনিই ছিলেন। অবশ্য বাকী ভাইয়ের (সৈয়দ মাযহারুল হক বাকী) নাম উল্লেখ না করলে সত্যকে অস্বীকার করা হবে, অন্যায় হবে। সে যাই হোক, সিরাজ ভাইয়ের বাড়ি বৃহত্তর যশোরের মাগুরার শালিখায়। আমাদের ঝিনাইদহের বাড়ি হতে খুব বড়জোর বিশ মাইল। এই বিশ মাইলের দূরত্ব নিঃশেষিত হয়েছিল সিরাজ ভাইয়ের হৃদয় হতে। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের পরপর যখন আমি ঢাকায় আসি, তখনই সিরাজ ভাই হৃদয়ের সমস্ত ঔদার্য দিয়ে আমাকে গ্রহণ করে নেন অনুজের স্নেহলালিত্যে। তারপর থেকে কোনো দিন কোনো অবস্থাতেই সিরাজ ভাইয়ের স্নেহবঞ্চিত হইনি। এটা শাহীন রেজা নূরের চোখে দেখা ঘটনা।
সিরাজ ভাই আমাকে তার মায়ের পেটের ভাইয়ের মতোই স্নেহ করতেন। সিরাজ ভাইয়ের আট ছেলে। শাহীন রেজা নূর ছিল তাদের মধ্যে দ্বিতীয়। ওরা সবসময় আমাকে কাকা ডাকত। আলম কাকা বা সিদ্দিকী কাকা বলে কখনো ডাকেনি। রক্তের বাঁধন না থাকলেও সম্পর্ক কত গভীর ও অমলিন হতে পারে, আজকের দিনে অনেকের পক্ষে তা ভাবাও কঠিন। রাত নাই-দিন নাই, সকাল নাই-দুপুর নাই, চামেলীবাগের বাসায় গেলে আমাকে ভাত খেতেই হতো। এ ব্যাপারে ভাবির আন্তরিকতাও আমাকে মুগ্ধ করে।
সিরাজুদ্দীন হোসেন শাহীন রেজা নূরের পিতা। সিরাজুদ্দীন হোসেনের ভালোবাসার অনবদ্য টান ও অকৃত্রিম আকর্ষণ আমার কাছে এতই তীব্র ছিল যে, সন্ধ্যার পর ইত্তেফাক অফিসে সিরাজ ভাইয়ের বিরাট টেবিলের বিপরীতে বসে টোস্ট বিস্কুট, আর চা খাওয়াটা নৈমিত্তিক ছিল। এ ছাড়া যেন পেটের ভাত হজম হতো না। ইত্তেফাকে ঢুকলেই সিরাজ ভাই যে কাউকে দেখতে পেতেন। কারণ, তার টেবিলটা ছিল সরাসরি দরজা বরাবর। দিনের বেলায় গেলে সিরাজ ভাই বলতেন, ‘এই আলম, আমি দুপুরে বাসায় যাব, তুই চলে যাস না।’ আমিও সন্তুষ্টচিত্ত ঋষিবালকের মতো শান্তভাবে বসে থাকতাম সিরাজ ভাইয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য।
শাহীন স্বপ্রণোদিত হয়ে আমার জীবনী লেখার দায়িত্ব নিয়েছিল। টেলিফোনে তার সঙ্গে আমার শেষ আলাপেও সে আমাকে দৃঢ় চিত্তে বলেছিল, ‘কাকা, আপনার জীবনীটা শেষ করাই আমার জীবনের প্রধান কাজ। এটা ছাড়া আমি মরেও শান্তি পাব না।’ আল্লাহ তার আত্মার শান্তি প্রদান করুন। আমার আত্মজীবনীর কাজ কোন পর্যায়ে আছে, আমি জানিও না। জিজ্ঞেস করলেই সে বলত, ‘কাকা, চিন্তা করবেন না। আপনার আত্মজীবনীর কাজ শেষ না করে আমি মরব না।’
আত্মজীবনীটি বড় কথা নয়। আমার শাহীন ইহকাল থেকে বিদায় নিয়েছে ভাবতেই আমার বুকটা হাহাকার করে ওঠে। রাতে বিছানায় ছটফট করি, উঠে চেয়ারে বসি। কখনো কখনো নিজের অজান্তেই ভাবি, শাহীনকে একটা ফোন করি। ওদের ওখানে তো (ভ্যাঙ্কুভারে) দিন। তাই ওর দিনের বেলা, আমাদের এই গভীর রাতে বিরক্ত করা হবে না। অথচ আমি অবর্ণনীয় পরিতৃপ্তি লাভ করব। আমার কনিষ্ঠ পুত্র তানজিরের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা প্রচণ্ড গভীর ছিল। ওরা রোজই দু-একবার ফোনে কথা বলত। আমার কনিষ্ঠ পুত্র আমাকে কখনো বলেনি, শাহীন মৃত্যুর দিকে এতখানি এগিয়ে গেছে। তার রক্তশূন্য পাণ্ডুর মুখ দেখলে তার পরিচিত যেকোনো লোকই হয়তো চমকে উঠত। ভ্যাঙ্কুভার থেকে শাহীন রেজা নূর বা ঢাকা থেকে তানজির, কেউই আমাকে বুঝতে দেয়নি, শাহীন এত দ্রুত পরপারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। শেষ যেদিন তার সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়, সেদিনও আমি অনুধাবন করতে পারিনি তার জীবনঘাতী ব্যাধির গভীরতা। বরং কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে আমি বলেছি, ‘আত্মজীবনী বইটা হয়তো প্রকাশ পাবে, তবে আমি জীবিত থাকাকালীন নয়, আমার মৃত্যুর পর।’ শাহীন ও তানজির উভয়কেই বলতাম, আত্মজীবনীটা আমি আমার জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারব না, এটা আমার বদ্ধমূল ধারণা। এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করলে শাহীন বলত, ‘না কাকা, বইয়ের কাজ নব্বই ভাগ শেষ। আর একটু সময় পেলেই আমি অমি’র (তানজির) ই-মেইলে পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে দেব।’ বেদনাহত চিত্তে অশ্রুসিক্ত নয়নে শূন্য হৃদয় নিয়ে এখন আমার ভাবনায় পাণ্ডুলিপি আমার কাছে অন্তঃসারশূন্য, আমার শাহীনই যেখানে নেই।
দীর্ঘসময় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম ৭১-এর সভাপতি ছিল শাহীন রেজা নূর। তার পিতা শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের প্রতি আজও আমার একটা ক্ষোভ, তাঁর মতো একজন প্রথিতযশা, প্রগতিশীল, স্বাধীনচেতা ও স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ কেন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে নিজের বাড়িতে থাকতেন। আজকের দিনের মতো তখন মোবাইল ফোনের ব্যবস্থা থাকলে তাঁকে সরে থাকার জন্য পীড়াপীড়ি করতাম। জানি না, তিনি আমার অনুরোধ রাখতেন কি-না। আমার হৃদয়ের নিভৃত কন্দরে স্নেহের মণিমুক্তা-খচিত যে আসন, সেখানে শাহীন রেজা নূরের অবস্থান অমলিন। অনেক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সময়ে শাহীন আমার কাছে ছুটে এসেছে। ‘কাকা, কী হয়েছে’—বলে ডাকলেই বেশ কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেয়েছি, মনোবল পেয়েছি। এটা হয়তো কাউকেই বোঝানো যাবে না, তাহজীব-তানজিরই কেবল আমার সন্তান নয়। শাহীন রেজা নূরও আমার সন্তান। বলতে গেলে বয়সের মাপকাঠিতে সেই জ্যেষ্ঠ সন্তান। সিরাজ ভাইয়ের সুবাদে আমাকে ও কাকা ডাকত। আমি কিন্তু তাকে সন্তানপ্রতিমই মনে করতাম।
মৃত্যু জীবনেরই আরেকটি নাম। কোনো জীবিত প্রাণীই মৃত্যুকে এড়াতে পারে না। তবুও কিছু কিছু মৃত্যুকে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু। এটা বহন করা খুবই কঠিন।
শাহীন রেজা নূর শুধু আমার কাছে নয়, অসংখ্য অগণিত মানুষের কাছে অপরিসীম গুরুত্ব বহন করত। প্রজন্ম ৭১-এর সভাপতি, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা, যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিটি বিচারের অকুতোভয় একজন সৈনিক। দেশবাসীর কাছে নানাবিধ গৌরবদীপ্ত পরিচয়ে উদ্ভাসিত তার নাম। সরাসরি রাজনৈতিক দল না করলেও সে একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিমনস্ক সংগঠক ছিল। সাংবাদিকতা তার পেশা হলেও সামাজিক কর্মকাণ্ডই ছিল তার নেশা। একাত্তরে সীমান্তের ওপারে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেনি বটে, কিন্তু তার ক্ষুরধার বিশ্লেষণ স্বাধীনতার চেতনাকে মানুষের হৃদয়ে অমলিনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। যে শুধু সাংবাদিক বা সংবাদ বিশ্লেষক ছিল না। তার সমগ্র সত্তাটাই ছিল স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের এক বাস্তবধর্মী বিশ্লেষণ। তার পিতা সিরাজুদ্দীন হোসেন বুদ্ধিজীবী হিসেবে আলবদর বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন। এই যন্ত্রণা শেষ নিশ্বাস ত্যাগের মুহূর্ত পর্যন্ত শাহীন রেজা নূর সবার অলক্ষ্যে আপন হৃদয়ে বহন করেছে। ঔরসজাত সন্তান না হলেও আমি নিঃসংশয় চিত্তে দাবি করব, সন্তানপ্রতিম নয়, সে আমার সন্তান। আমি শতভাগ নিশ্চিত, সে আমার চেতনা ও বিশ্বাসকে বক্ষে লালন করত।
অসংখ্য বিবেকবান কলমধারী মানুষ তার বিবেক-আপ্লুত আদর্শ ও দেশপ্রেমকে হৃদয়ের নিভৃত কন্দরে সযত্নে লালন করেন। শাহীন রেজা নূরের অকাল মৃত্যু, যত বেদনাদায়কই হোক না কেন, তার চেতনার প্রদীপ্ত শিখা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রজ্বলিত মশালের মতো পথ দেখাবে—এটা তো বিশ্বাস করে বলাই যায়। নিষ্ঠুর সত্য হলো, শাহীন রেজা নূর আজ পরলোকে। বাংলাদেশের অনেক তরুণ তাজা দীপ্ত প্রাণ মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছেন। শাহীন রেজা নূরের পিতা সিরাজুদ্দীন হোসেনও শহীদ হয়েছেন। কলম দিয়ে তিনি যেভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিরতিহীন যুদ্ধ করেছেন, তাতে আল্লাহ তাঁকে নির্মল শহীদী সম্মান দেবেন—এ আশা আমরা করতেই পারি। শাহীন রেজা নূর আজকে না ফেরার দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। এ যে কী কষ্টের, কতখানি যন্ত্রণায় অনুভূতিকে কীভাবে ক্ষতবিক্ষত করে, স্বাভাবিক জীবনের চিন্তা-চেতনা, সুখ-দুঃখকে কীভাবে বিপর্যস্ত করে বিশ্বের সমগ্র স্বাভাবিকতাকে ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়, শাহীন রেজা নূরের মৃত্যুর সংবাদ আমার ক্ষেত্রে তাই করেছিল। এই শোক আমি আজীবন বহন করে যাব।
লেখক: স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতা ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
২ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
২ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
৩ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
৩ ঘণ্টা আগে