মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
করোনা শুরু হওয়ার আগে বাংলাদেশ সমাজ উন্নয়নের যেসব ক্ষেত্রে দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল বাল্যবিবাহ কমিয়ে আনা। রোধ করা অবশ্য তখনো সম্ভব হয়নি। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে কন্যাসন্তানকে যত তাড়াতাড়ি অভিভাবকেরা বিয়ে দিতে পারতেন, তত তাঁরা দুশ্চিন্তা ও বোঝামুক্ত হতে পারতেন বলে মনে করতেন। পরিবারের মেয়েটি যদি একটু বয়সে বেশি হয়ে যায়, তাহলে নানাজনের নানা কথা শুনতে শুনতে অভিভাবকেরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়তেন। বিয়ের প্রস্তাব এলে যৌতুকের দাবিটাও অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সের মেয়েদের জন্য বেশি দাবি করা হতো। সমাজের ওই শ্রেণির মানুষের কাছে ১৪ বছরের নিচেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার উপযুক্ত সময় বলে মনে করা হতো। যেসব পরিবার ছেলে বিয়ে করাত, তারা কম বয়সী মেয়েকেই প্রাধান্য দিত। তাদের কাছে মেয়েদের স্বাস্থ্য, বয়ঃসন্ধিক্ষণ, বুদ্ধি-বিবেচনা, সংসারের দায়-দায়িত্ব ইত্যাদি কোনো কিছুই জ্ঞানসম্মতভাবে গুরুত্ব পেত না। তারা বরং যুগ যুগ ধরে বিয়ের জন্য পাত্রীর কম বয়সকেই প্রাধান্য দিত। বিষয়টি সমাজে একধরনের অন্ধবিশ্বাসের মতো কাজ করত। মূলত নারী-পুরুষের জীবন, শিক্ষা-দীক্ষা, সচেতনতা, কর্মজীবনে নারী ও পুরুষের বাইরে চাকরি কিংবা কাজ করার বিষয়গুলো এখনো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মোটেও খুব একটা ভালো দৃষ্টিতে দেখা হয় না। মেয়েদের ঘরকন্নার বেশি কিছু ভাবার অভ্যস্ততায় অনেকেই নেই।
তা ছাড়া, গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ দরিদ্র পরিবারেই ছেলেকে বিয়ে করিয়ে শুধু একজন ঘরকন্নাই আনা নয়; সঙ্গে টাকাপয়সা, আসবাব ইত্যাদি যৌতুক পাওয়াও একটি দুর্ভেদ্য নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ যে পরিবার ছেলে বিয়ে করিয়ে যৌতুকসহ নববধূ ঘরে আনছে, সেই পরিবারও আবার নিজের কন্যাসন্তানকে পাত্রস্থ করতে একই ধরনের যৌতুক প্রদানের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকে। এখানে একধরনের দেওয়া-নেওয়ার মধ্য দিয়ে সমান সমান অথবা জেতার প্রবণতা কাজ করে। যদিও গত দু-তিন দশকে সমাজের সর্বত্র অর্থনৈতিক পরিবর্তন কমবেশি ঘটেছে, অনেক পরিবারই এখন আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়ে উঠেছে; কিন্তু বিয়েশাদি-যৌতুক ইত্যাদি মানসিকতায় কেন যেন তারা আরও বেশি জড়িয়ে পড়ছে এবং লোভ-লালসার পথে পা বাড়িয়েছে। পাত্র যদি মধ্যপ্রাচ্য বা দূরপ্রাচ্যে যাওয়ার কোনো এজেন্ট খুঁজে পায়, তাহলে পাত্রীপক্ষের ওপর বিদেশ যাওয়ার খরচের বড় অঙ্কটা চাপিয়ে দেওয়া হয়। আবার ওই সব দেশে কর্মরত পাত্রের যৌতুকি বাজারদর অনেক বেড়ে যায়। সমাজের অভ্যন্তরে এখন বিয়েশাদি নিয়ে যেসব লেনদেন, যে দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস, আচার-আচরণ বেড়ে উঠছে; তাতে মেয়েদের জীবন সত্যি সত্যি অভিভাবকের অন্ধবিশ্বাস, লোভ-লালসা, কুসংস্কার এমনকি নানা ধরনের নির্যাতন ও নির্মম শিকারের বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে গেছে। দেশের এখনো অনেক জায়গায় মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের বাধানিষেধ কার্যকর রয়েছে। তাদের লেখাপড়া, মানুষ হওয়া, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, উচ্চশিক্ষা নেওয়া প্রভৃতি বিষয় খুব সহজে ঘটতে দেওয়া হয় না। ধনী ও প্রভাবশালী পরিবার ছাড়া অপেক্ষাকৃত দরিদ্র এমনকি গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারেও মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে বাধা, অপপ্রচার, কুসংস্কার এখনো জগদ্দল পাথরের মতো বিরাজ করছে। দেশে অনেক অঞ্চল আছে, যেখানকার মেয়েদের শহরে এসে গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা মেয়েদের জন্য বিয়ের ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। সেসব অঞ্চলে মেয়েদের ঘর থেকে বের হওয়াকে নানা সন্দেহের চোখে দেখা হয়ে থাকে। সমাজের এমন বাস্তবতায় করোনার আগেও বাল্যবিবাহ উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা অনেক জায়গায় সম্ভব হয়নি। তবে কিছু কিছু জায়গায় স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজ থাকার ফলে অভিভাবকদের একটি বড় অংশ মেয়েদের যথাসম্ভব শিক্ষিত পাত্রস্থ করার জন্য মেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ মনে করত। খুব কম পরিবারেই মেয়েরা উচ্চশিক্ষা নিয়ে বড় হবে, চাকরি করবে, স্বামী নির্বাচনে নিজের পছন্দ-অপছন্দকে প্রাধান্য দেবে—এমন ধারণা পোষণ করে। তারপরও সরকারের নানা প্রচার, প্রচারণা, উদ্যোগ, উপবৃত্তি প্রদান প্রভৃতি প্রণোদনার কারণে বেশ কিছু কাল ধরে মেয়েরা শিক্ষার দিক থেকে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে। এর মধ্যে বেশ কিছু মেয়ে শিক্ষার্থী নিজেদের মেধা ও শিক্ষাসচেতনতায় পরীক্ষায় ভালো ফল করে গ্রামের গণ্ডি অতিক্রম করে শহরে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেধাতালিকায় ভর্তির যোগ্যতা লাভ করার ফলে অনেক অভিভাবকই মেয়ের উচ্চশিক্ষার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে বাধা দেন না। এরা শহরে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভালো চাকরি, কর্মজীবন এবং নিজের পছন্দের বিয়েশাদি করে উন্নত জীবনযাপন করার ব্যবস্থা করে নিচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা খুব বেশি না হলেও মোটামুটি গত কয়েক বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এর একটা প্রভাব সেসব পরিবার, অঞ্চল এবং নিকট জীবনের মধ্যে কমবেশি পড়ার কারণে অন্যান্য মেয়ে শিক্ষার্থীও লেখাপড়ায় এগিয়ে যাওয়ার পারিবারিক সমর্থন ও সহযোগিতা পেতে শুরু করেছে। তবে গ্রামাঞ্চলে এখনো মেয়েদের উচ্চশিক্ষার মানসিকতা পরিবার ও সমাজে খুব বেশি জায়গা করে নিতে পারেনি। বেশির ভাগ স্কুল এবং কলেজে মেয়েদের পড়া অবস্থায়ই বিয়েশাদি দেওয়ার মানসিকতা বিরাজ করে। উপযুক্ত পাত্র পেলেই পড়ুয়া কন্যাটিকে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। এর ফলে কিছুকাল আগের মতো মেয়েদের ১০-১২ বছর বয়সেই বিয়ে দেওয়ার মানসিকতার বাস্তবতা অনেকটা পরিবর্তন হতে থাকে। মেয়েদের লেখাপড়ায় আগের চেয়ে সংখ্যায় অনেকটা বৃদ্ধিও পেয়েছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্রীসংখ্যা অনেক ক্ষেত্রেই ৫০ শতাংশের বেশি দেখা যেত। ছেলেদের একটি বড় অংশ শহরে অপেক্ষাকৃত নামীদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ নিয়ে থাকে। অভিভাবকেরাও ছেলেদের উচ্চশিক্ষার দিকে বেশি মনোযোগী হতে দেখা যায়। মেয়েদের উচ্চশিক্ষার গুরুত্ব বেশির ভাগ পরিবারেই ততটা আন্তরিক নয়। বিয়েশাদি দেওয়াই তাদের প্রধান বিবেচনায় থাকে। এ ধরনের একটি কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে আমাদের শিশু-কিশোরদের শৈশব, কৈশোর এবং শিক্ষাজীবন চলে আসছে।
করোনার এই দীর্ঘ দেড় বছরে শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ থাকায় গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে অভিভাবকেরা খুব বেশি ভাবতে চাননি। অনেকেই তাঁদের কন্যাকে ইচ্ছেমতো বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে বাদ যায়নি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীও। এত অল্প বয়সের মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে বয়স লুকানো, বিয়ের অনুষ্ঠানের খবর গোপন রাখা, বিয়ে রেজিস্ট্রেশনে বয়স বাড়িয়ে জালিয়াতি করাসহ সব ধরনের আইন ও নিয়ম ভঙ্গ করা হয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এখন ছাত্রীসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে।
এরই মধ্যে যৌতুক দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে বরপক্ষ, কনেপক্ষের বিবাদ-বিসংবাদও বেড়ে গেছে। কোথাও কোথাও বিয়ে ভেঙে গেছে। পিত্রালয়ে কন্যা ফিরে আসতে বাধ্যও হয়েছে। বাল্যবিবাহের এই হিড়িক নীরবেই গত দেড় বছর সমাজের অভ্যন্তরে ঘটে গেছে। এর মাধ্যমে বেশির ভাগ অভিভাবকের মধ্যেই কন্যার বিয়ের চিন্তাটি প্রাধান্য থাকে যে, সেটিরই বহিঃপ্রকাশ ও প্রমাণ পাওয়া যায়। বাল্যবিবাহের হিড়িক নীরবে শুধু গ্রামেই নয়, বিভিন্ন শহরেও ঘটেছে। বস্তি বা প্রান্তিক মানুষের আবাসস্থলেই নয়; শহরের মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তের এলাকায়ও অনেক বাল্যবিবাহ ঘটে গেছে। খোদ রাজধানী ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকায় অবস্থিত অনেক নামীদামি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় ঘটেছে। এই পরিবারগুলো একেবারে দরিদ্র, অশিক্ষিত, তা বলা যাবে না; কিন্তু নবম-দশম শ্রেণিপড়ুয়া মেয়েকে বিয়ে দিতে পিতামাতারা আলোকসজ্জার ব্যবস্থা হয়তো করেননি, ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়ার আয়োজন করতে কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করেননি; কিন্তু মেয়েটিকে শাড়ি পরিয়ে ‘সুপাত্রের’ হাতে তুলে দিতে দ্বিধা করেননি কিংবা কাগজপত্র বানিয়ে নিতেও বিবেক খরচ করেননি। সরকার অনেক তথ্যই তো সংগ্রহ করে থাকে।
গত দেড় বছরে দেশে বাল্যবিবাহের যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান সংগ্রহ করার মাধ্যমে আমাদের সমাজের মনস্তত্ত্বকে গভীরভাবে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। আমাদের জনসংখ্যার অর্ধেক হচ্ছে মেয়ে তথা নারী। তাদের যদি এভাবে বিয়ের পাত্রীর বেশি কিছু ভাবা না হয়, তাহলে আমাদের উন্নয়ন, সামাজিক চাকচিক্য, মানুষের সচেতনতার দাবি ইত্যাদি এখনো অত্যন্ত কাদামাটি পর্যায়ে পড়ে আছে, আধুনিক উন্নত জীবনব্যবস্থা গড়ার স্বপ্ন অনেক দূরের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই কঠিন সত্যটির মুখোমুখি এখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি। এখান থেকে আমাদের করণীয় উদ্ভাবন, নির্ধারণ, বাস্তবায়ন এবং মানুষের সচেতনতাবোধে মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতেই হবে। বাল্যবিবাহের সাম্প্রতিক চিত্রটি আমাদের যদি সেভাবে নাড়া দিয়ে থাকে, তবেই শুধু আমাদের জনসংখ্যার অর্ধেক নারীকে নিয়ে সমগ্র জনসংখ্যা আমাদের জনসম্পদে পরিণত হওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পেতে পারে।
লেখক: মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
করোনা শুরু হওয়ার আগে বাংলাদেশ সমাজ উন্নয়নের যেসব ক্ষেত্রে দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল বাল্যবিবাহ কমিয়ে আনা। রোধ করা অবশ্য তখনো সম্ভব হয়নি। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে কন্যাসন্তানকে যত তাড়াতাড়ি অভিভাবকেরা বিয়ে দিতে পারতেন, তত তাঁরা দুশ্চিন্তা ও বোঝামুক্ত হতে পারতেন বলে মনে করতেন। পরিবারের মেয়েটি যদি একটু বয়সে বেশি হয়ে যায়, তাহলে নানাজনের নানা কথা শুনতে শুনতে অভিভাবকেরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়তেন। বিয়ের প্রস্তাব এলে যৌতুকের দাবিটাও অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সের মেয়েদের জন্য বেশি দাবি করা হতো। সমাজের ওই শ্রেণির মানুষের কাছে ১৪ বছরের নিচেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার উপযুক্ত সময় বলে মনে করা হতো। যেসব পরিবার ছেলে বিয়ে করাত, তারা কম বয়সী মেয়েকেই প্রাধান্য দিত। তাদের কাছে মেয়েদের স্বাস্থ্য, বয়ঃসন্ধিক্ষণ, বুদ্ধি-বিবেচনা, সংসারের দায়-দায়িত্ব ইত্যাদি কোনো কিছুই জ্ঞানসম্মতভাবে গুরুত্ব পেত না। তারা বরং যুগ যুগ ধরে বিয়ের জন্য পাত্রীর কম বয়সকেই প্রাধান্য দিত। বিষয়টি সমাজে একধরনের অন্ধবিশ্বাসের মতো কাজ করত। মূলত নারী-পুরুষের জীবন, শিক্ষা-দীক্ষা, সচেতনতা, কর্মজীবনে নারী ও পুরুষের বাইরে চাকরি কিংবা কাজ করার বিষয়গুলো এখনো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মোটেও খুব একটা ভালো দৃষ্টিতে দেখা হয় না। মেয়েদের ঘরকন্নার বেশি কিছু ভাবার অভ্যস্ততায় অনেকেই নেই।
তা ছাড়া, গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ দরিদ্র পরিবারেই ছেলেকে বিয়ে করিয়ে শুধু একজন ঘরকন্নাই আনা নয়; সঙ্গে টাকাপয়সা, আসবাব ইত্যাদি যৌতুক পাওয়াও একটি দুর্ভেদ্য নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ যে পরিবার ছেলে বিয়ে করিয়ে যৌতুকসহ নববধূ ঘরে আনছে, সেই পরিবারও আবার নিজের কন্যাসন্তানকে পাত্রস্থ করতে একই ধরনের যৌতুক প্রদানের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকে। এখানে একধরনের দেওয়া-নেওয়ার মধ্য দিয়ে সমান সমান অথবা জেতার প্রবণতা কাজ করে। যদিও গত দু-তিন দশকে সমাজের সর্বত্র অর্থনৈতিক পরিবর্তন কমবেশি ঘটেছে, অনেক পরিবারই এখন আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়ে উঠেছে; কিন্তু বিয়েশাদি-যৌতুক ইত্যাদি মানসিকতায় কেন যেন তারা আরও বেশি জড়িয়ে পড়ছে এবং লোভ-লালসার পথে পা বাড়িয়েছে। পাত্র যদি মধ্যপ্রাচ্য বা দূরপ্রাচ্যে যাওয়ার কোনো এজেন্ট খুঁজে পায়, তাহলে পাত্রীপক্ষের ওপর বিদেশ যাওয়ার খরচের বড় অঙ্কটা চাপিয়ে দেওয়া হয়। আবার ওই সব দেশে কর্মরত পাত্রের যৌতুকি বাজারদর অনেক বেড়ে যায়। সমাজের অভ্যন্তরে এখন বিয়েশাদি নিয়ে যেসব লেনদেন, যে দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস, আচার-আচরণ বেড়ে উঠছে; তাতে মেয়েদের জীবন সত্যি সত্যি অভিভাবকের অন্ধবিশ্বাস, লোভ-লালসা, কুসংস্কার এমনকি নানা ধরনের নির্যাতন ও নির্মম শিকারের বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে গেছে। দেশের এখনো অনেক জায়গায় মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের বাধানিষেধ কার্যকর রয়েছে। তাদের লেখাপড়া, মানুষ হওয়া, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, উচ্চশিক্ষা নেওয়া প্রভৃতি বিষয় খুব সহজে ঘটতে দেওয়া হয় না। ধনী ও প্রভাবশালী পরিবার ছাড়া অপেক্ষাকৃত দরিদ্র এমনকি গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারেও মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে বাধা, অপপ্রচার, কুসংস্কার এখনো জগদ্দল পাথরের মতো বিরাজ করছে। দেশে অনেক অঞ্চল আছে, যেখানকার মেয়েদের শহরে এসে গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা মেয়েদের জন্য বিয়ের ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। সেসব অঞ্চলে মেয়েদের ঘর থেকে বের হওয়াকে নানা সন্দেহের চোখে দেখা হয়ে থাকে। সমাজের এমন বাস্তবতায় করোনার আগেও বাল্যবিবাহ উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা অনেক জায়গায় সম্ভব হয়নি। তবে কিছু কিছু জায়গায় স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজ থাকার ফলে অভিভাবকদের একটি বড় অংশ মেয়েদের যথাসম্ভব শিক্ষিত পাত্রস্থ করার জন্য মেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ মনে করত। খুব কম পরিবারেই মেয়েরা উচ্চশিক্ষা নিয়ে বড় হবে, চাকরি করবে, স্বামী নির্বাচনে নিজের পছন্দ-অপছন্দকে প্রাধান্য দেবে—এমন ধারণা পোষণ করে। তারপরও সরকারের নানা প্রচার, প্রচারণা, উদ্যোগ, উপবৃত্তি প্রদান প্রভৃতি প্রণোদনার কারণে বেশ কিছু কাল ধরে মেয়েরা শিক্ষার দিক থেকে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে। এর মধ্যে বেশ কিছু মেয়ে শিক্ষার্থী নিজেদের মেধা ও শিক্ষাসচেতনতায় পরীক্ষায় ভালো ফল করে গ্রামের গণ্ডি অতিক্রম করে শহরে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেধাতালিকায় ভর্তির যোগ্যতা লাভ করার ফলে অনেক অভিভাবকই মেয়ের উচ্চশিক্ষার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে বাধা দেন না। এরা শহরে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভালো চাকরি, কর্মজীবন এবং নিজের পছন্দের বিয়েশাদি করে উন্নত জীবনযাপন করার ব্যবস্থা করে নিচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা খুব বেশি না হলেও মোটামুটি গত কয়েক বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এর একটা প্রভাব সেসব পরিবার, অঞ্চল এবং নিকট জীবনের মধ্যে কমবেশি পড়ার কারণে অন্যান্য মেয়ে শিক্ষার্থীও লেখাপড়ায় এগিয়ে যাওয়ার পারিবারিক সমর্থন ও সহযোগিতা পেতে শুরু করেছে। তবে গ্রামাঞ্চলে এখনো মেয়েদের উচ্চশিক্ষার মানসিকতা পরিবার ও সমাজে খুব বেশি জায়গা করে নিতে পারেনি। বেশির ভাগ স্কুল এবং কলেজে মেয়েদের পড়া অবস্থায়ই বিয়েশাদি দেওয়ার মানসিকতা বিরাজ করে। উপযুক্ত পাত্র পেলেই পড়ুয়া কন্যাটিকে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। এর ফলে কিছুকাল আগের মতো মেয়েদের ১০-১২ বছর বয়সেই বিয়ে দেওয়ার মানসিকতার বাস্তবতা অনেকটা পরিবর্তন হতে থাকে। মেয়েদের লেখাপড়ায় আগের চেয়ে সংখ্যায় অনেকটা বৃদ্ধিও পেয়েছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্রীসংখ্যা অনেক ক্ষেত্রেই ৫০ শতাংশের বেশি দেখা যেত। ছেলেদের একটি বড় অংশ শহরে অপেক্ষাকৃত নামীদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ নিয়ে থাকে। অভিভাবকেরাও ছেলেদের উচ্চশিক্ষার দিকে বেশি মনোযোগী হতে দেখা যায়। মেয়েদের উচ্চশিক্ষার গুরুত্ব বেশির ভাগ পরিবারেই ততটা আন্তরিক নয়। বিয়েশাদি দেওয়াই তাদের প্রধান বিবেচনায় থাকে। এ ধরনের একটি কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে আমাদের শিশু-কিশোরদের শৈশব, কৈশোর এবং শিক্ষাজীবন চলে আসছে।
করোনার এই দীর্ঘ দেড় বছরে শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ থাকায় গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে অভিভাবকেরা খুব বেশি ভাবতে চাননি। অনেকেই তাঁদের কন্যাকে ইচ্ছেমতো বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে বাদ যায়নি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীও। এত অল্প বয়সের মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে বয়স লুকানো, বিয়ের অনুষ্ঠানের খবর গোপন রাখা, বিয়ে রেজিস্ট্রেশনে বয়স বাড়িয়ে জালিয়াতি করাসহ সব ধরনের আইন ও নিয়ম ভঙ্গ করা হয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এখন ছাত্রীসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে।
এরই মধ্যে যৌতুক দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে বরপক্ষ, কনেপক্ষের বিবাদ-বিসংবাদও বেড়ে গেছে। কোথাও কোথাও বিয়ে ভেঙে গেছে। পিত্রালয়ে কন্যা ফিরে আসতে বাধ্যও হয়েছে। বাল্যবিবাহের এই হিড়িক নীরবেই গত দেড় বছর সমাজের অভ্যন্তরে ঘটে গেছে। এর মাধ্যমে বেশির ভাগ অভিভাবকের মধ্যেই কন্যার বিয়ের চিন্তাটি প্রাধান্য থাকে যে, সেটিরই বহিঃপ্রকাশ ও প্রমাণ পাওয়া যায়। বাল্যবিবাহের হিড়িক নীরবে শুধু গ্রামেই নয়, বিভিন্ন শহরেও ঘটেছে। বস্তি বা প্রান্তিক মানুষের আবাসস্থলেই নয়; শহরের মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তের এলাকায়ও অনেক বাল্যবিবাহ ঘটে গেছে। খোদ রাজধানী ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকায় অবস্থিত অনেক নামীদামি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় ঘটেছে। এই পরিবারগুলো একেবারে দরিদ্র, অশিক্ষিত, তা বলা যাবে না; কিন্তু নবম-দশম শ্রেণিপড়ুয়া মেয়েকে বিয়ে দিতে পিতামাতারা আলোকসজ্জার ব্যবস্থা হয়তো করেননি, ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়ার আয়োজন করতে কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করেননি; কিন্তু মেয়েটিকে শাড়ি পরিয়ে ‘সুপাত্রের’ হাতে তুলে দিতে দ্বিধা করেননি কিংবা কাগজপত্র বানিয়ে নিতেও বিবেক খরচ করেননি। সরকার অনেক তথ্যই তো সংগ্রহ করে থাকে।
গত দেড় বছরে দেশে বাল্যবিবাহের যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান সংগ্রহ করার মাধ্যমে আমাদের সমাজের মনস্তত্ত্বকে গভীরভাবে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। আমাদের জনসংখ্যার অর্ধেক হচ্ছে মেয়ে তথা নারী। তাদের যদি এভাবে বিয়ের পাত্রীর বেশি কিছু ভাবা না হয়, তাহলে আমাদের উন্নয়ন, সামাজিক চাকচিক্য, মানুষের সচেতনতার দাবি ইত্যাদি এখনো অত্যন্ত কাদামাটি পর্যায়ে পড়ে আছে, আধুনিক উন্নত জীবনব্যবস্থা গড়ার স্বপ্ন অনেক দূরের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই কঠিন সত্যটির মুখোমুখি এখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি। এখান থেকে আমাদের করণীয় উদ্ভাবন, নির্ধারণ, বাস্তবায়ন এবং মানুষের সচেতনতাবোধে মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতেই হবে। বাল্যবিবাহের সাম্প্রতিক চিত্রটি আমাদের যদি সেভাবে নাড়া দিয়ে থাকে, তবেই শুধু আমাদের জনসংখ্যার অর্ধেক নারীকে নিয়ে সমগ্র জনসংখ্যা আমাদের জনসম্পদে পরিণত হওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পেতে পারে।
লেখক: মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
১৯ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
২০ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
২০ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
২০ ঘণ্টা আগে