জাহীদ রেজা নূর
শ্রীলঙ্কা, ভারত, মালদ্বীপ, পাকিস্তান এমনকি আফগানিস্তানের প্রাথমিক শিক্ষকেরা বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের চেয়ে ঢের বেশি টাকা বেতন পান। তাহলে আমরা যে বলছি, এ দেশে ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে খুব, সেই উন্নয়নের ফল ভোগ করছে মূলত কারা?
অনেক দিন ধরেই ভাবছি, প্রাথমিক শিক্ষকদের হাল-হকিকত নিয়ে কিছু লিখব। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মানসগঠনের প্রথম যে সোপান, সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো তার শিক্ষক-শিক্ষার্থী নিয়ে আদৌ কেমন আছে, সে খবর কিন্তু আমরা একেবারেই রাখি না। হাতে কলম থাকলে কিংবা ল্যাপটপের কি-বোর্ড থাকলে ‘ইহা করা উচিত’, ‘ইহা করা উচিত নহে’ বলে খুব সহজেই উপদেশ দেওয়া যায়। কিন্তু ঘটনাগুলো যে অনেক জটিল, সে কথা পারতপক্ষে বোঝা হয়ে ওঠে না।
অর্থের বিচারে যে মানুষদের সামাজিক মর্যাদা নেই, তাঁদের দেওয়া হয়েছে শিশুদের মানসগঠনের ভার। শিক্ষকদের সম্মান দেওয়া হবে না, কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে চাওয়া হবে মানবজীবনের সবচেয়ে জরুরি জিনিসটি–এটাকে পরিহাস ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?
দুই. পারিবারিক গণ্ডি থেকে জীবনের মহাসমুদ্রে প্রথম যে ডিঙিটি ভাসায় শিশু, তার গন্তব্য প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে যে মানুষটি তাঁর চিন্তাভাবনা প্রসারিত করার দায়িত্ব পান, তিনি শিক্ষক। শিশুরাও শিক্ষকদের কাছ থেকে যা শেখে, তাকে পরম বলে মান্য করে। এভাবেই পরিবার ও স্কুল একটি শিশুর মানসগঠনে অবদান রাখে।
সমাজের নানা স্তর থেকে জড়ো হওয়া শিশুদের জন্য একটি মানসিক অভয়ারণ্য গড়ে দেওয়ার কঠিন কাজটা করতে হয় শিক্ষককে। জাত-পাত-আশরাফ-আতরাফনির্বিশেষে সবাইকে আপন করে নেওয়ার মাধ্যমেই তিনি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন একটি গোটা প্রজন্মের মানসিক মুক্তিদাতা।
তিন. একটি গোটা প্রজন্মের মানসিক মুক্তিদাতা বলে যাঁকে এইমাত্র চিহ্নিত করলাম, তাঁকে হতে হবে আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকভাবে সচ্ছল ও স্বাবলম্বী একজন মানুষ। শিক্ষক যদি এই তিনভাবে স্বাবলম্বী না হন, তাহলে তাঁর নিজেরই তো আত্মিক বিকাশ ঘটবে না। আর সব বাদ দিলাম, এ প্রশ্ন তো স্বাভাবিক: শুধু অর্থনৈতিক কারণেই সব সময় গুটিয়ে থাকা প্রাথমিক শিক্ষকেরা অন্যের মনে আলো ছড়াবেন কী করে, যখন তাঁর চারদিকটা অন্ধকারে ঘেরা?
যে শিক্ষককে আমরা আমাদের সন্তানদের গড়ে তোলার প্রাথমিক ভার দিচ্ছি, তিনি মনোযোগের সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব পালন করছেন–আদর্শ পরিবেশে এমনটাই হয়। আদর্শ পরিবেশে আরও যা হয় তা হলো, প্রতিটি শিশুকে তিনি আলাদা সময় দেন, তাদের শেখান কীভাবে মানবিক হয়ে উঠতে হয়, কীভাবে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হয়। তাঁকে বুঝতে হয়, কেউ অঙ্কে ভালো করবে, কেউ ইতিহাসে, কেউ বাংলায়, কেউ ইংরেজিতে, কেউ বিজ্ঞানে, কেউ অর্থনীতিতে। যার যেটা ভালো লাগে, তাকে সে ব্যাপারেই তিনি উৎসাহ দেবেন। আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি শিশুকে তিনি চিনবেন। বুঝবেন, এরা মেষের পাল নয়। সবাইকে জিপিএ ফাইভ গিলিয়ে দিলেই একেক জন আদর্শ মানুষে পরিণত হবে না। তাঁর আরও জানা থাকবে, সবাই ‘আদর্শ মানুষ’ হবেও না। কিন্তু শিশুর বিকাশের জন্য সর্বোচ্চটা দেবেন শিক্ষক। এ ব্যাপারে আপসের প্রশ্নই আসে না।
জ্ঞানের সলতেয় আগুন দেওয়ার কাজটা এমনভাবে করবেন শিক্ষক, যেন যার যে বিষয়ে আগ্রহ আছে, সে আনন্দের সঙ্গে সেদিকে এগিয়ে যেতে পারে।
চার. এবার দেখা যাক, আদতে সেই শিক্ষক কেমন আছেন। মূলত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়েই কথা বলছি। কোনো কোনো বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা ভালো বেতন পেলেও সরকারি স্কুলের শিক্ষকেরা যে বেতন পান, তা মোটেই সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট নয়।
সারা পৃথিবীর কথা বাদ দিলাম, সার্ক দেশগুলোর মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনের যদি তুলনা করা হয়, দেখা যাবে, বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে শেষের দিকে (আসলে একেবারে তলানিতেই মনে হয়)। শ্রীলঙ্কা, ভারত, মালদ্বীপ, পাকিস্তান এমনকি আফগানিস্তানের প্রাথমিক শিক্ষকেরা বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের চেয়ে ঢের বেশি টাকা বেতন পান। তাহলে আমরা যে বলছি, এ দেশে ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে খুব, সেই উন্নয়নের ফল ভোগ করছে মূলত কারা? এই তালিকায় মানুষ গড়ার কারিগরেরা কেন নেই?
যে শিক্ষক গড়ে তুলবেন নতুন যুগের মানুষ, তাঁরাই যাপন করছেন মানবেতর জীবন, এটা ভাবতে গেলেই উন্নয়ন, বাজেট, লক্ষ্যমাত্রা ইত্যাদি শব্দগুলো ঘোলাটে লাগতে শুরু করে।
পাঁচ. সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো, প্রাথমিক শিক্ষকদের কোনো সামাজিক মর্যাদা নেই। কয়েকজন প্রাথমিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, এভাবে খোলামেলাভাবে তাঁদের কাছ থেকে অসহায়ত্ব আর অসম্মানের কথা না শুনলেই ভালো হতো। তাঁদের একজন যখন বললেন, উপজেলা সহকারী কৃষি কর্মকর্তা কিংবা ডিপ্লোমা-উত্তীর্ণ হাসপাতালের নার্সও এম এ পাস প্রাথমিক শিক্ষকের চেয়ে ভালো বেতন পান, তখন লজ্জায় আমার মাথাই নত হলো। আরেকজন বললেন, বাজারের মাছওয়ালা কিংবা চেনা রিকশাচালকও প্রাথমিক শিক্ষকদের অবজ্ঞার চোখে দেখেন।
কিছুদিন আগে প্রাথমিক শিক্ষকদের ত্রয়োদশ স্কেলে বেতন ধার্য করা হয়েছে। সেটা যে আহামরি কিছু নয়, তা এই স্কেলের বেতনের হার দেখলেই বোঝা যায়।
বাড়িভাড়া করে থাকা শহরাঞ্চলের প্রাথমিক শিক্ষকদের বিপদ বেশি। কোনোমতে সম্ভ্রম বাঁচিয়ে টিকে থাকতে হলে স্কুলের পর তাঁকে টিউশনির খোঁজে বেরিয়ে পড়তে হয়। টিউশনি সেরে বাড়ি ফিরতে রাত নটাও বাজে কারও কারও। এর মানে এমন নয় যে নিজের বাড়িতে থাকেন বলে গ্রামে বসবাসরত প্রাথমিক শিক্ষকের জীবনটা প্রাচুর্যে ভরপুর, তিনিও থাকেন অর্থকষ্টে, তবে তুলনামূলকভাবে হয়তো খানিক কম।
ছয়. অনেক কাজই আছে প্রাথমিক শিক্ষকের। পিটিআইয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এলে শিক্ষকদের অনেকেই হয়তো তাঁর প্রায়োগিক শিক্ষকতার পথটি আরও মসৃণ করার কথা ভাবেন। কিন্তু সে ফুরসত মেলে না। একজন শিক্ষক একটি ক্লাসে কজন শিক্ষার্থীকে পড়াতে পারেন? বড়জোর ৩০ জন? কিন্তু একটি ক্লাসে যদি ৫০ জন, কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি শিক্ষার্থী থাকে, তাহলে কীভাবে ক্লাসের শিক্ষার্থীদের পড়াবেন তিনি? ওরাই বা সেই ক্লাস থেকে আনন্দ আহরণ করবে কীভাবে?
আরও একটা ব্যাপার তো রয়েই গেছে। পড়ানো ছাড়াও মন্ত্রণালয় থেকে আসা নির্দেশ মানতে মানতেও তো অনেক সময় চলে যায়। নানা ধরনের জরিপ, নির্বাচনের কাজে শিক্ষকদের থাকতে হয়। তাতে শিক্ষাদানের আগ্রহ ক্রমেই ফিকে হয়ে গেলে তাঁকে কি দোষ দেওয়া যায়?
সাত. মাক্সিম গোর্কিকে একবার ডেকেছিলেন আন্তন চেখভ। সেটা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ অথবা বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার কথা। নানা কথার মধ্যে ঘুরেফিরে আসছিল রাশিয়া প্রসঙ্গ। রাশিয়ার কথা বলতে গিয়ে চেখভ বারবার বলছিলেন প্রাথমিক শিক্ষকদের কথা। সে সময়কার রাশিয়ায় শিক্ষকেরা যে খুবই কষ্টে আছেন, সেটাই ছিল আলোচনার বিষয়।
কখনো বলছিলেন, ‘জানেন, একজন অসুস্থ শিক্ষক সেদিন এসেছিলেন, বিবাহিত, তাঁকে কি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারেন? আপাতত আমি কিছু একটা কাজ দিয়েছি তাঁকে।’ কিংবা ‘গোর্কি, শুনুন, একজন শিক্ষক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। তিনি অসুস্থতার জন্য বাড়ি থেকে বের হতে পারেন না। আপনি কি একবার তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে দেখে আসবেন?’
এ রকমই একবার চেখভের বাড়িতে গিয়ে গোর্কি দেখলেন, রুশ সাহিত্যিকের সামনে বসে আছেন একজন প্রাথমিকের শিক্ষক। খুবই জড়সড় হয়ে কোনোরকমে বসে আছেন চেয়ারের একেবারে সামনের দিকটায়, মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম নিয়ে ‘শিক্ষিত মানুষের’ ভাষায় কিছু বলার চেষ্টা করছেন, কিন্তু লজ্জায় মুখ থেকে কথা বের হচ্ছিল না। তিনি মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিলেন এমন কিছু করতে, যাতে স্বনামধন্য লেখক চেখভের সামনে তাঁকে বোকা বলে মনে না হয় এবং না ভেবেই শত শত প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছিলেন চেখভের দিকে।
চেখভ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, আপনাদের জেলায় বাচ্চাদের কোন শিক্ষক পেটান?’
‘কী বলছেন? কে পেটাবে? আমি? কখনোই না!’ খুবই অপমানিত হয়ে শিক্ষক কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
‘আপনি উত্তেজিত হবেন না। আমি কি আপনার কথা বললাম নাকি?’ মৃদু হেসে চেখভ বললেন। ‘আমি কোনো পত্রিকায় এই তো সেদিন পড়লাম, আপনার জেলায় কোনো এক শিক্ষক ছাত্রদের ধরে পেটান।’
শিক্ষক বসলেন, ঘর্মাক্ত মুখ মুছলেন, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ঠিকই পড়েছেন। একটা ঘটনা ঘটেছিল। ঘটিয়েছিল মাকারভ। শুনুন, কেন ঘটাবে না? কোনো সন্দেহ নেই এটা পাশবিক, কিন্তু তার ব্যাখ্যাও তো আছে। ওর বউ আছে। চারটা বাচ্চা। বউ অসুস্থ। তার নিজেরও যক্ষ্মা। বেতন? বিশ রুবল। স্কুলটা মাটির নিচের স্যাঁতসেঁতে গুদামঘরে। শিক্ষকের একটাই ঘর। এ রকমভাবে যাকে টিকে থাকতে হয়, সে ফেরেশতাদেরও সামনে পেলে পেটাবে। আর শুনে রাখুন, ছাত্ররা একটাও ফেরেশতার মতো নয়!’
আট. শিক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা, সহবত বা আচরণ শেখানো আর শিক্ষার্থীকে ভালোবাসা–ন্যূনতম এই তিনটি গুণ থাকতে হয় প্রাথমিকের শিক্ষকের। কিন্তু চেখভের কাছে আসা শিক্ষকটির কথায় নিশ্চয়ই বোঝা যায়, কোন পরিবেশে খোদ ফেরেশতাকেও পেটাতে ইচ্ছে করে।
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের অবস্থা তৎকালীন রাশিয়ার গরিব প্রাথমিক শিক্ষকদের চেয়ে ভালো–এ কথা বলি কী করে?
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
শ্রীলঙ্কা, ভারত, মালদ্বীপ, পাকিস্তান এমনকি আফগানিস্তানের প্রাথমিক শিক্ষকেরা বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের চেয়ে ঢের বেশি টাকা বেতন পান। তাহলে আমরা যে বলছি, এ দেশে ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে খুব, সেই উন্নয়নের ফল ভোগ করছে মূলত কারা?
অনেক দিন ধরেই ভাবছি, প্রাথমিক শিক্ষকদের হাল-হকিকত নিয়ে কিছু লিখব। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মানসগঠনের প্রথম যে সোপান, সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো তার শিক্ষক-শিক্ষার্থী নিয়ে আদৌ কেমন আছে, সে খবর কিন্তু আমরা একেবারেই রাখি না। হাতে কলম থাকলে কিংবা ল্যাপটপের কি-বোর্ড থাকলে ‘ইহা করা উচিত’, ‘ইহা করা উচিত নহে’ বলে খুব সহজেই উপদেশ দেওয়া যায়। কিন্তু ঘটনাগুলো যে অনেক জটিল, সে কথা পারতপক্ষে বোঝা হয়ে ওঠে না।
অর্থের বিচারে যে মানুষদের সামাজিক মর্যাদা নেই, তাঁদের দেওয়া হয়েছে শিশুদের মানসগঠনের ভার। শিক্ষকদের সম্মান দেওয়া হবে না, কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে চাওয়া হবে মানবজীবনের সবচেয়ে জরুরি জিনিসটি–এটাকে পরিহাস ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?
দুই. পারিবারিক গণ্ডি থেকে জীবনের মহাসমুদ্রে প্রথম যে ডিঙিটি ভাসায় শিশু, তার গন্তব্য প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে যে মানুষটি তাঁর চিন্তাভাবনা প্রসারিত করার দায়িত্ব পান, তিনি শিক্ষক। শিশুরাও শিক্ষকদের কাছ থেকে যা শেখে, তাকে পরম বলে মান্য করে। এভাবেই পরিবার ও স্কুল একটি শিশুর মানসগঠনে অবদান রাখে।
সমাজের নানা স্তর থেকে জড়ো হওয়া শিশুদের জন্য একটি মানসিক অভয়ারণ্য গড়ে দেওয়ার কঠিন কাজটা করতে হয় শিক্ষককে। জাত-পাত-আশরাফ-আতরাফনির্বিশেষে সবাইকে আপন করে নেওয়ার মাধ্যমেই তিনি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন একটি গোটা প্রজন্মের মানসিক মুক্তিদাতা।
তিন. একটি গোটা প্রজন্মের মানসিক মুক্তিদাতা বলে যাঁকে এইমাত্র চিহ্নিত করলাম, তাঁকে হতে হবে আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকভাবে সচ্ছল ও স্বাবলম্বী একজন মানুষ। শিক্ষক যদি এই তিনভাবে স্বাবলম্বী না হন, তাহলে তাঁর নিজেরই তো আত্মিক বিকাশ ঘটবে না। আর সব বাদ দিলাম, এ প্রশ্ন তো স্বাভাবিক: শুধু অর্থনৈতিক কারণেই সব সময় গুটিয়ে থাকা প্রাথমিক শিক্ষকেরা অন্যের মনে আলো ছড়াবেন কী করে, যখন তাঁর চারদিকটা অন্ধকারে ঘেরা?
যে শিক্ষককে আমরা আমাদের সন্তানদের গড়ে তোলার প্রাথমিক ভার দিচ্ছি, তিনি মনোযোগের সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব পালন করছেন–আদর্শ পরিবেশে এমনটাই হয়। আদর্শ পরিবেশে আরও যা হয় তা হলো, প্রতিটি শিশুকে তিনি আলাদা সময় দেন, তাদের শেখান কীভাবে মানবিক হয়ে উঠতে হয়, কীভাবে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হয়। তাঁকে বুঝতে হয়, কেউ অঙ্কে ভালো করবে, কেউ ইতিহাসে, কেউ বাংলায়, কেউ ইংরেজিতে, কেউ বিজ্ঞানে, কেউ অর্থনীতিতে। যার যেটা ভালো লাগে, তাকে সে ব্যাপারেই তিনি উৎসাহ দেবেন। আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি শিশুকে তিনি চিনবেন। বুঝবেন, এরা মেষের পাল নয়। সবাইকে জিপিএ ফাইভ গিলিয়ে দিলেই একেক জন আদর্শ মানুষে পরিণত হবে না। তাঁর আরও জানা থাকবে, সবাই ‘আদর্শ মানুষ’ হবেও না। কিন্তু শিশুর বিকাশের জন্য সর্বোচ্চটা দেবেন শিক্ষক। এ ব্যাপারে আপসের প্রশ্নই আসে না।
জ্ঞানের সলতেয় আগুন দেওয়ার কাজটা এমনভাবে করবেন শিক্ষক, যেন যার যে বিষয়ে আগ্রহ আছে, সে আনন্দের সঙ্গে সেদিকে এগিয়ে যেতে পারে।
চার. এবার দেখা যাক, আদতে সেই শিক্ষক কেমন আছেন। মূলত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়েই কথা বলছি। কোনো কোনো বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা ভালো বেতন পেলেও সরকারি স্কুলের শিক্ষকেরা যে বেতন পান, তা মোটেই সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট নয়।
সারা পৃথিবীর কথা বাদ দিলাম, সার্ক দেশগুলোর মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনের যদি তুলনা করা হয়, দেখা যাবে, বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে শেষের দিকে (আসলে একেবারে তলানিতেই মনে হয়)। শ্রীলঙ্কা, ভারত, মালদ্বীপ, পাকিস্তান এমনকি আফগানিস্তানের প্রাথমিক শিক্ষকেরা বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের চেয়ে ঢের বেশি টাকা বেতন পান। তাহলে আমরা যে বলছি, এ দেশে ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে খুব, সেই উন্নয়নের ফল ভোগ করছে মূলত কারা? এই তালিকায় মানুষ গড়ার কারিগরেরা কেন নেই?
যে শিক্ষক গড়ে তুলবেন নতুন যুগের মানুষ, তাঁরাই যাপন করছেন মানবেতর জীবন, এটা ভাবতে গেলেই উন্নয়ন, বাজেট, লক্ষ্যমাত্রা ইত্যাদি শব্দগুলো ঘোলাটে লাগতে শুরু করে।
পাঁচ. সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো, প্রাথমিক শিক্ষকদের কোনো সামাজিক মর্যাদা নেই। কয়েকজন প্রাথমিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, এভাবে খোলামেলাভাবে তাঁদের কাছ থেকে অসহায়ত্ব আর অসম্মানের কথা না শুনলেই ভালো হতো। তাঁদের একজন যখন বললেন, উপজেলা সহকারী কৃষি কর্মকর্তা কিংবা ডিপ্লোমা-উত্তীর্ণ হাসপাতালের নার্সও এম এ পাস প্রাথমিক শিক্ষকের চেয়ে ভালো বেতন পান, তখন লজ্জায় আমার মাথাই নত হলো। আরেকজন বললেন, বাজারের মাছওয়ালা কিংবা চেনা রিকশাচালকও প্রাথমিক শিক্ষকদের অবজ্ঞার চোখে দেখেন।
কিছুদিন আগে প্রাথমিক শিক্ষকদের ত্রয়োদশ স্কেলে বেতন ধার্য করা হয়েছে। সেটা যে আহামরি কিছু নয়, তা এই স্কেলের বেতনের হার দেখলেই বোঝা যায়।
বাড়িভাড়া করে থাকা শহরাঞ্চলের প্রাথমিক শিক্ষকদের বিপদ বেশি। কোনোমতে সম্ভ্রম বাঁচিয়ে টিকে থাকতে হলে স্কুলের পর তাঁকে টিউশনির খোঁজে বেরিয়ে পড়তে হয়। টিউশনি সেরে বাড়ি ফিরতে রাত নটাও বাজে কারও কারও। এর মানে এমন নয় যে নিজের বাড়িতে থাকেন বলে গ্রামে বসবাসরত প্রাথমিক শিক্ষকের জীবনটা প্রাচুর্যে ভরপুর, তিনিও থাকেন অর্থকষ্টে, তবে তুলনামূলকভাবে হয়তো খানিক কম।
ছয়. অনেক কাজই আছে প্রাথমিক শিক্ষকের। পিটিআইয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এলে শিক্ষকদের অনেকেই হয়তো তাঁর প্রায়োগিক শিক্ষকতার পথটি আরও মসৃণ করার কথা ভাবেন। কিন্তু সে ফুরসত মেলে না। একজন শিক্ষক একটি ক্লাসে কজন শিক্ষার্থীকে পড়াতে পারেন? বড়জোর ৩০ জন? কিন্তু একটি ক্লাসে যদি ৫০ জন, কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি শিক্ষার্থী থাকে, তাহলে কীভাবে ক্লাসের শিক্ষার্থীদের পড়াবেন তিনি? ওরাই বা সেই ক্লাস থেকে আনন্দ আহরণ করবে কীভাবে?
আরও একটা ব্যাপার তো রয়েই গেছে। পড়ানো ছাড়াও মন্ত্রণালয় থেকে আসা নির্দেশ মানতে মানতেও তো অনেক সময় চলে যায়। নানা ধরনের জরিপ, নির্বাচনের কাজে শিক্ষকদের থাকতে হয়। তাতে শিক্ষাদানের আগ্রহ ক্রমেই ফিকে হয়ে গেলে তাঁকে কি দোষ দেওয়া যায়?
সাত. মাক্সিম গোর্কিকে একবার ডেকেছিলেন আন্তন চেখভ। সেটা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ অথবা বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার কথা। নানা কথার মধ্যে ঘুরেফিরে আসছিল রাশিয়া প্রসঙ্গ। রাশিয়ার কথা বলতে গিয়ে চেখভ বারবার বলছিলেন প্রাথমিক শিক্ষকদের কথা। সে সময়কার রাশিয়ায় শিক্ষকেরা যে খুবই কষ্টে আছেন, সেটাই ছিল আলোচনার বিষয়।
কখনো বলছিলেন, ‘জানেন, একজন অসুস্থ শিক্ষক সেদিন এসেছিলেন, বিবাহিত, তাঁকে কি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারেন? আপাতত আমি কিছু একটা কাজ দিয়েছি তাঁকে।’ কিংবা ‘গোর্কি, শুনুন, একজন শিক্ষক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। তিনি অসুস্থতার জন্য বাড়ি থেকে বের হতে পারেন না। আপনি কি একবার তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে দেখে আসবেন?’
এ রকমই একবার চেখভের বাড়িতে গিয়ে গোর্কি দেখলেন, রুশ সাহিত্যিকের সামনে বসে আছেন একজন প্রাথমিকের শিক্ষক। খুবই জড়সড় হয়ে কোনোরকমে বসে আছেন চেয়ারের একেবারে সামনের দিকটায়, মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম নিয়ে ‘শিক্ষিত মানুষের’ ভাষায় কিছু বলার চেষ্টা করছেন, কিন্তু লজ্জায় মুখ থেকে কথা বের হচ্ছিল না। তিনি মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিলেন এমন কিছু করতে, যাতে স্বনামধন্য লেখক চেখভের সামনে তাঁকে বোকা বলে মনে না হয় এবং না ভেবেই শত শত প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছিলেন চেখভের দিকে।
চেখভ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, আপনাদের জেলায় বাচ্চাদের কোন শিক্ষক পেটান?’
‘কী বলছেন? কে পেটাবে? আমি? কখনোই না!’ খুবই অপমানিত হয়ে শিক্ষক কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
‘আপনি উত্তেজিত হবেন না। আমি কি আপনার কথা বললাম নাকি?’ মৃদু হেসে চেখভ বললেন। ‘আমি কোনো পত্রিকায় এই তো সেদিন পড়লাম, আপনার জেলায় কোনো এক শিক্ষক ছাত্রদের ধরে পেটান।’
শিক্ষক বসলেন, ঘর্মাক্ত মুখ মুছলেন, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ঠিকই পড়েছেন। একটা ঘটনা ঘটেছিল। ঘটিয়েছিল মাকারভ। শুনুন, কেন ঘটাবে না? কোনো সন্দেহ নেই এটা পাশবিক, কিন্তু তার ব্যাখ্যাও তো আছে। ওর বউ আছে। চারটা বাচ্চা। বউ অসুস্থ। তার নিজেরও যক্ষ্মা। বেতন? বিশ রুবল। স্কুলটা মাটির নিচের স্যাঁতসেঁতে গুদামঘরে। শিক্ষকের একটাই ঘর। এ রকমভাবে যাকে টিকে থাকতে হয়, সে ফেরেশতাদেরও সামনে পেলে পেটাবে। আর শুনে রাখুন, ছাত্ররা একটাও ফেরেশতার মতো নয়!’
আট. শিক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা, সহবত বা আচরণ শেখানো আর শিক্ষার্থীকে ভালোবাসা–ন্যূনতম এই তিনটি গুণ থাকতে হয় প্রাথমিকের শিক্ষকের। কিন্তু চেখভের কাছে আসা শিক্ষকটির কথায় নিশ্চয়ই বোঝা যায়, কোন পরিবেশে খোদ ফেরেশতাকেও পেটাতে ইচ্ছে করে।
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের অবস্থা তৎকালীন রাশিয়ার গরিব প্রাথমিক শিক্ষকদের চেয়ে ভালো–এ কথা বলি কী করে?
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আমি দুই মাস আগেই বলেছিলাম, নভেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমি সেটা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতিটা আগের বছরগুলোর মতো না। অন্যান্য বছরে নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কমে আসতে শুরু করে।
২০ ঘণ্টা আগেআজ ১৭ নভেম্বর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুদিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস পেছনে ফেলে পরলোকগমন করেন। আজীবন সংগ্রামী ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ছিলেন প্রথম প্রবক্তা।
২০ ঘণ্টা আগেসকালের আলোয় মনটা অকারণে আনমনা হয়ে যায়। মনের কোণে হঠাৎ বেজে ওঠে চেনা গানের সুর—‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে...।’ মন ছুটে যায় সেই ছেলেবেলায়, যখন ঋতুবদল ঘটত গানের সুরেই।
২০ ঘণ্টা আগেজুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। ক্ষমতা পেয়েছে অন্তর্বর্তী এক সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অরাজনৈতিক অথচ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
২০ ঘণ্টা আগে